তুমুল শোরগোলে ঘুম ভেঙে গেল কামিনীর, এত চিৎকার-চেঁচামেচি
কীসের? যারাই করুক, পরে দেখা যাবে, আগে তো ওকে ডাকি। পাশেই শুয়েছিলেন তাঁর
স্বামী বিবিধান। রিটায়ার হতে আর বেশি দেরি নেই। এক মেয়ে ছিল। তারও বিয়ে
দিয়ে দিয়েছেন মাসখানেক আগে। জামাইটাও খুব ভাল পেয়েছেন। যেমনি ভাল পরিবার।
তেমনি দেখতে-শুনতে ভাল। তার উপর চাকরিও করে আরও ভাল। দমকলের চাকরি। বেশ ভাল
টাকাই মাইনেপত্র পায়। ফলে এখন তাঁদের ঝাড়া হাত-পা। বিছানায় শুলেই তাঁর
স্বামী নাক ডাকতে শুরু করে দেন। অথচ তাঁর চোখে ঘুম নেই। রাত দেড়টা-দুটো
অবধি একটার পর একটা সিরিয়ালের পুনঃসম্প্রচার দেখেন। টিভি দেখতে দেখতে
ক্লান্ত হয়ে গেলে ঘুমোবার চেষ্টা করেন। কিন্তু সেই ঘুম এত পাতলা যে, পাশের
বাড়ির কোনও বেড়াল একটু ‘ম্যাঁও’ করলেও তাঁর ঘুম চটকে যায়। আর সেই ঘুম
একবার ভেঙে গেলে কিছুতেই দু’চোখের পাতা এক হতে চায় না।
এই দু’দিন ধরে সেটা আরও বেড়েছে। কারণ, তিন দিন হয়ে গেল মেয়েটা শ্বশুরবাড়ি
থেকে এসেছে। তার নাকি মায়ের জন্য মন কেমন করছিল। তাই... খুব ভাল কথা।
কিন্তু আসার পর থেকে তার হাবভাব-চালচলন যেন কী রকম ঠেকছে। ও তো এ রকম ছিল
না!
কিন্তু আজ কী হল! বাইরে এত হই-হট্টগোল কীসের! মনে হচ্ছে তাঁদের বাড়ির
সামনেই হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ‘এই শুনছ, ওঠো না, বাইরে কী যেন হয়েছে, আরে উঠবে
তো, কী কুম্ভকর্ণের ঘুম রে বাবা!’ বলেও যখন গৃহকর্তার ঘুম ভাঙানো গেল না,
তখন বাধ্য হয়েই জোরে জোরে ধাক্কা দিয়ে তাঁকে ডেকে তুললেন। বললেন, বাইরে
বোধহয় কিছু একটা হয়েছে। শুনতে পাচ্ছ?
তাঁরা থাকেন দোতলায়। নীচে একটা গোলমাল হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সেটা যে কীসের,
কে যে কী বলছে, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। সবার কথা জড়িয়ে, তালগোল পাকিয়ে একটা
হই-হট্টগোল ভেসে আসছে। তার মধ্যে থেকে শুধু একটা শব্দই কোনও রকমে উদ্ধার
করতে পারলেন তিনি, আর সেই শব্দটা হল— চোর।
গণ্ডগোলটা যখন তাঁদের বাড়ির সামনেই হচ্ছে, তা হলে কি তাঁদের বাড়িতেই চোর
ঢুকেছে! উনি উঠতে যাচ্ছিলেন, কামিনী তাঁকে প্রায় জোর করে শুইয়ে দিলেন।
বললেন, তোমাকে উঠতে হবে না। ওদের কাছে কত রকমের কত কী থাকে, তুমি জানো? যদি
কিছু নিতে চায় তো নিক। জিনিস আগে না প্রাণ আগে? আর তা ছাড়া, আমাদের
বাড়ির সামনে চেঁচামেচি হচ্ছে মানেই যে আমাদের বাড়িতেই চোর ঢুকেছে, তা তো
নয়; আশপাশের বা উল্টো দিকের সান্যালদের বাড়িতেও তো হতে পারে, নাকি।
সে পারে। কিন্তু...
কোনও কিন্তু না। চুপ করে শোও তো।
চুপ করে যখন শুতেই বলছ, তা হলে খামোকা আমার কাঁচা ঘুম ভাঙাতে গেলে কেন?
যাঃ বাব্বা... কথাটা মুখে বললেও মনে মনে বললেন, আমি মরছি আমার জ্বালায়। আর উনি আছেন... কী
যে বলব! আচ্ছা, সত্যিই চোর তো! নাকি... আবার ওই ছেলেটা না তো! মেয়েটা যে
দিন এসেছে, সে দিনই তার মা তাঁর সঙ্গেই তাকে শুতে বলেছিলেন। কিন্তু বাধ
সেধেছিল ও-ই। বলেছিল, না না, আমি যে ঘরে শুতাম সে ঘরেই শোব। না-হলে আমার
ঘুম আসবে না।
বিয়ের আগে তাঁর মেয়ে ও-দিককার ঘরটাতেই শুত। ওই ঘরের লাগোয়া একটা
ঝুলবারান্দা আছে। রাস্তার দিকে। উনি প্রায়ই রাতে গিয়ে দেখে আসতেন,
ঝুলবারান্দার দরজাটা ও বন্ধ করেছে কি না। এবং বেশির ভাগ দিনই দেখতেন, সেটা
হাট করে খোলা। ফলে উনি সেটা ভেজিয়ে ছিটকিনি তুলে দিতেন।
শ্বশুরবাড়ি থেকে এসে সে দিনও ওই ঘরে শুয়েছে দেখে উনি ভেবেছিলেন, আগের মতো
আজও হয়তো ভুল করে ও ঝুলবারান্দার দরজাটা আটকায়নি। তাই সেই দরজাটা আটকাবার
জন্য মাঝরাতে ওর ঘরে ঢুকতে গিয়ে উনি দেখেন, ও যা কোনও দিনও করেনি, তা-ই
করেছে। ওই ঘরে ঢোকার এ দিককার দরজাটা আটকে দিয়েছে। আটকানো মানে এমনি ভেজিয়ে
রাখা নয়, রীতিমত ভেতর থেকে খিল বা ছিটকিনি তুলে দেওয়া। উনি ঠেলেই সেটা
বুঝতে পেরেছেন। আর এ দিককার দরজা যখন দেওয়া, তা হলে ও কি আর ওই দিকের
দরজাটা দেয়নি! নিশ্চয়ই দিয়েছে। এটা ভেবে উনি যখন ওই ঘরের দরজার সামনে থেকে
ফিরে আসছেন, ঠিক তখনই হঠাৎ অত্যন্ত চাপাস্বরে একটা পুরুষ-কণ্ঠ শুনতে পেলেন
তিনি। আর সেটা শুনেই চমকে উঠলেন, এ কী! তা হলে কি... আমি যা সন্দেহ
করেছিলাম, তাই! তাই তো বলি, সারাক্ষণ মোবাইলে কার সঙ্গে এত গুজগুজ-ফুসফুস
করে। কাকে এত ম্যাসেজ করে! কাছে গেলেই চুপ হয়ে যায় কেন।
শ্বশুরবাড়িতে এ সব করতে অসুবিধে হয় বলেই কি ও এখানে এসে আছে! ও বাড়িতে
যাওয়ার নাম করছে না! নাকি জামাই এটা আঁচ করেছে! করবে না! সে কি বোকা নাকি!
আর সে জন্যই বোধহয় সদ্য-সদ্য বিয়ে হওয়া সত্বেও আজ তিন দিন হতে চলল, আসার
নাম-গন্ধ করছে না। সামনেই তো অফিস, অফিস ছুটির পরেও তো একবার আসতে পারত,
নাকি! আসেনি মানে ডাল মে কুছ কালা হ্যায়।
কিন্তু সেটা কী? বিয়ের আগে সব মেয়েই একটু-আধটু প্রেম-ট্রেম করে বইকী! ও-ও
করেছে। কানাঘুষোয় তার কিছু কিছু তিনি শুনেছেনও। কিন্তু কারও সঙ্গেই তেমন
জোড়ালো কোনও সম্পর্ক নিশ্চয়ই সে ভাবে গড়ে ওঠেনি। তাই ওর বাবা আর উনি যখন
তাকে বিয়ের কথা বলেছিলেন, প্রথম দিকে একটু গাঁইগুঁই করলেও শেষে বলেছিল,
তোমরা যখন আমাকে বাড়ি থেকে তাড়াবেই ঠিক করেছ। তখন দ্যাখো, ছেলে দ্যাখো...
ওঁরা ছেলে দেখেছিলেন। এবং মেয়েরও খুব পছন্দ হয়েছিল তাকে। ফলে খুব ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল মাত্র আড়াই মায়ের মাথায়।
মেয়ে-জামাই যখন অষ্টমঙ্গলার গিঁট খুলতে এসেছিল, তখন তাঁরা বুঝেছিলেন;
তাঁদের মেয়ে খুব খুশি। খুব ভাল আছে ওরা। তাই কামিনী আর বিবিধান ঠিক
করেছিলেন এত দিন তো শুধু চাকরি-বাকরি নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। তেমন ভাবে কোথাও
ঘুরতে যাওয়া হয়নি। রিটায়ার হতে আর তো মাত্র বছর দেড়েক। দেখতে দেখতে কেটে
যাবে। তার পর দু’জনে মিলে বেরিয়ে পড়বেন। সিমলা-কুলু-মানালি-অমৃতসর দিয়ে
শুরু করবেন। তার পর পাহাড়-জঙ্গল-সমুদ্র। কিছুই বাদ দেবেন না।
কিন্তু এ যে নতুন ফ্যাচাং শুরু হল। তা হলে কি তার মেয়ের বিবাহিত জীবন সুখের
হয়নি! হলে কি স্বামী থাকতে কোনও মেয়ে আবার পর পুরুষের দিকে ঢলে!
অষ্টমঙ্গলার গিঁট খুলতে এসে ও যেটা আমাদের সামনে তুলে ধরেছিল। বুঝিয়েছিল,
ওর সঙ্গে ওর স্বামীর দারুণ সম্পর্ক। তা হলে কি সেটা শুধু আমাদের দেখানোর
জন্যই ছিল? সবটাই ভান! আমরা যাতে কষ্ট না-পাই, সে জন্য?
না-হলে বিয়ের মাত্র দেড় মাসের মাথায় কোনও মেয়ে এ রকম করতে পারে! ছিঃ...
নাকি বিয়ের আগে থেকেই এ সব ছিল! আমরা টের পাইনি! ছিল যখন বিয়ের আগে বলিসনি
কেন? আমরা তো জিজ্ঞেস করেছিলাম। এর পর কি আমরা আর কাউকে মুখ দেখাতে পারব!
ছিঃ...
কিন্তু কথা হচ্ছে, রাতদুপুরে ওর ঘরে যে-ই আসুক না কেন, তাঁদের দু’জনের
চোখকে ফাঁকি দিয়ে সে এল কী করে! ওই ঘরের মধ্যে ঢুকল কী করে! মেন গেটের চাবি
তো তার কাছেই থাকে। তা হলে কি কোনও এক ফাঁকে ওই চাবিটা নিয়ে ও একটা
ডুপ্লিকেট চাবি বানিয়ে নিয়েছে! না। এখন আর কিছুই অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে না।
সে দিন মেয়ের ওই কীর্তি আঁচ করার পরে বহু বার কামিনী ভেবেছেন, ব্যাপারটা
স্বামীকে জানাবেন। কিন্তু বারবার বলতে গিয়েও উনি আর শেষ পর্যন্ত বলে উঠতে
পারেননি, মেয়ে এমন একটা কাজ করেছে... ছিঃ...
হঠাৎ ডোরবেলের শব্দে সচকিত হলেন তিনি। এত রাতে কে বেল
বাজাচ্ছে! রাত-বাতির আলোয় দেয়াল-ঘড়ির দিকে তাকালেন। জ্বলজ্বল করতে থাকা
ঘণ্টা আর মিনিটের কাঁটাগুলি দেখে তিনি বুঝতে পারলেন রাত একটা বারো।
এত রাতে কে বেল বাজাচ্ছে! তিনি ঠিক শুনেছেন তো! নাকি সবটাই মনের ভুল! ক’দিন
ধরে মনের উপর দিয়ে যা যাচ্ছে... মনের আর কী দোষ! বোধহয় দশ সেকেন্ডও হয়নি।
আবার ডোরবেল বেজে উঠল। হ্যাঁ, ওই তো, ওই তো ডোরবেল বাজল। তিনি ঠিকই
শুনেছেন। শুধু তিনি নন, তাঁর স্বামীও নিশ্চয়ই শুনেছেন। না-হলে তাঁর অমন
ঘুম-কাতুরে স্বামী এ ভাবে বিছানার উপরে উঠে বসতেন না।
আবার ডোরবেল বেজে উঠল। এবং তার সঙ্গে তারস্বরে চিৎকার— ও বিধানবাবু, দরজাটা একটু খুলুন। আপনাদের বাড়িতে চোর ঢুকেছে। দরজাটা খুলুন।
স্বামীর নাম বিবিধান হলেও শুধু অফিসের সহকর্মীরাই নয়, পাড়ার লোকেরাও তাঁকে
বিধান বলেই ডাকে। ফলে তাঁর স্বামীকেই যে ডাকছে, বেশ বুঝতে পারলেন তিনি।
কিন্তু কামিনী জানেন, দরজা খুললেই সর্বনাশ। কারণ, তার বাড়িতে কেউ যদি এসে
থাকে, তা হলে সে আর যে-ই হোক না কেন, না। চোর নয়। আর সে যে কে, তিনি তা বেশ
ভাল করেই বুঝতে পারছেন। সে দিন রাতে তাঁর মেয়ের ঘরে তিনি যে ছেলেটাকে
চাপাস্বরে কথা বলতে শুনেছিলেন, নিশ্চয়ই সে। আর সত্যিই যদি সে হয়, তা হলে
একেবারে কেলেঙ্কারির একশেষ। এ পাড়ায় তাঁরা আর মুখ দেখাতে পারবেন না।
রাতারাতি এ বাড়ি বেচে দিয়ে অন্য কোথাও চলে যেতে হবে। তাই তিনি তাঁর
স্বামীকে বললেন, ডাকুক। তোমাকে যেতে হবে না...
স্বামী চোখ ডলতে-ডলতে বললেন, না গো, মনে হচ্ছে পাড়ার ছেলেরা...
হোক পাড়ার ছেলে। তোমাকে যেতে হবে না।
— কেন? ভয় পাচ্ছ কেন? আরে বাবা, ওদের কতাবার্তা শুনে আমরা যেমন বুঝতে
পারছি, বাড়ির সামনে লোকজন জড়ো হয়ে গেছে। তেমনি, চোর যদি সত্যি-সত্যিই
আমাদের বাড়িতে ঢুকে থাকে, তা হলে তো সে-ও টের পেয়েছে, পাড়ার লোকেরা
আমাদের বাড়ি ঘিরে আছে, পালাবার আর কোনও রাস্তা নেই। তাই কোনও কিছু করার
আগে সে অন্তত দু’বার ভাববে। বুঝেছ...
না। তোমাকে যেতে হবে না।
ছাড়ো না... তোমার চিন্তা নেই। আমি দেখছি। বলেই, উনি খাট থেকে নেমে গেলেন।
এখন কী করা উচিত কামিনী কিছুই বুঝতে পারলেন না। শুধু ভয়ঙ্কর এক সত্যের মুখোমুখি হওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করতে লাগলেন।
দু’মিনিটও হল না। পাড়ার কতকগুলো ছোকরা দুদ্দার করে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে
এল। তাদের মধ্যে থেকেই কে যেন উত্তেজিত গলায় জোরে জোরে বলতে লাগল, দ্যাখ
দ্যাখ দ্যাখ, ভাল করে দ্যাখ। আমি নিজের চোখে দেখেছি, ছেলেটা পাইপ বেয়ে
উঠেছে।
ওরা এ ঘরে ও ঘরে ছড়িয়ে পড়ল। কেউ খাটের তলা দেখছে। কেউ বাথরুম। কেউ
ফ্রিজের দরজা খুলে দেখছে চোরটা ওখানে লুকিয়েছে কি না। ওদের মধ্যে থেকেই
একজন বলে উঠল, মালটা আছে। এখানেই আছে। খোঁজ খোঁজ খোঁজ। পালাবে কোথায়? একবার
ধরতে পারলে দেখাচ্ছি মজা...
একজন ও দিকে গিয়ে ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ দেখে চিৎকার করে উঠল, মালটা মনে
হয় ভিতরে ঢুকে দরজা আটকে দিয়েছে। তার কথা শুনে এ দিক থেকে আর একজন গলা
চড়াল, ধাক্কা ধাক্কা, না-খুললে দরজা ভেঙে ফ্যাল। এত বড় সাহস, আমাদের
পাড়ায় ঢুকেছে চুরি করতে? ভাঙ ভাঙ, ভেঙে ফ্যাল...
কে যেন সত্যি-সত্যিই ভাঙতে যাচ্ছিল। কামিনী বললেন, না না, ও ঘরে কী করে যাবে? ও ঘরে তো আমার মেয়ে দরজা দিয়ে ঘুমিয়ে আছে।
— ঘুমিয়ে আছে! এত চিৎকার-চেঁচামেচিতেও ঘুম ভাঙেনি... তা হয় নাকি? নাকি
চোরটা ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে আপনার মেয়ের গলায় চাকু ধরে আছে? ডাকুন
ডাকুন, ডাকুন তো...
কামিনী আর বিবিধান দরজার সামনে গিয়ে জোরে জোরে মেয়ের নাম ধরে ডাকতে লাগলেন।
সঙ্গে দরজাও ধাক্কাতে লাগলেন। কিন্তু ভিতর থেকে কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল
না। ছেলেগুলোকে শান্ত করার জন্য কামিনী বললেন, আসলে ও একবার ঘুমিয়ে
পড়লে...
কে যেন বলল, তা বলে এ রকম ঘুম?
অন্য আর একজন বলল, আমার কেমন যেন লাগছে... আজকাল চার দিকে যা হচ্ছে... আবার অন্য কিছু ঘটেনি তো...
এ বার একটা ছেলে এগিয়ে এসে বলল, মাসিমা, আপনারা একটু সরুন তো। আমি দেখছি।
বলেই, দরজায় দড়াম দড়াম করে লাথি মারতে লাগল। আর ঠিক তখনই ভিতর থেকে ভেসে
এল মেয়ের গলা— আরে বাবা, এত চেঁচাচ্ছ কেন, বাড়িতে ডাকাত পড়েছে নাকি?
দাঁড়াও দাঁড়াও, খুলছি...
মেয়ে দরজা খুলে সামনে দাঁড়াতেই দু’-তিন জন ছেলে তাকে প্রায় ধাক্কা মেরে
ভিতরে ঢুকে গেল। সারাঘর তন্নতন্ন করে খুঁজেও কাউকে পেল না। একজন ও-দিককার
দরজা খুলে ঝুলবারান্দায় গিয়ে এ পাশে ও পাশে তাকাতেই দেখল, একটা ছেলে পাইপ
বেয়ে নামার চেষ্টা করছে। সঙ্গে সঙ্গে সে চিৎকার করে উঠল, চোর চোর চোর...
পাইপ বেয়ে নামছে, ধর ধর ধর...
যারা বাড়ির বাইরে অপেক্ষা করছিল, তারা তো বটেই, যারা দোতলায় ছিল, তারাও
পড়ি কি মড়ি করে তরতর করে নামতে লাগল। ওদের পিছু পিছু নামলেন বিবিধানও।
নীচে নেমে দেখেন চোরটাকে ওরা ধরে ফেলেছে। দু’-চার ঘা কষিয়েও দিয়েছে। বয়স্ক
দু’জন তাকে আগলে পা়ড়ার ছেলেদের বলছে, না। একদম না। একদম গায়ে হাত দিবি
না। আইন নিজের হাতে নিবি না। দরকার হলে থানায় ফোন কর। ওকে পুলিশের হাতে
দেব... তবু না। কেউ ওর গায়ে হাত দিবি না।
খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে এ সব কাণ্ড দেখে বিবিধান অবাক। তাঁর আর্থিক অবস্থা
তো তেমন নয়, তবু আশপাশে এত বড় বড় বাড়ি থাকতে তাঁর বাড়িতে চুরি করতে
এসেছিল কে! দেখি তো... বিবিধান গুটিগুটি পা ফেলে কাছে গিয়ে দেখেন, যে
ছেলেটাকে ওরা ধরেছে, জটলার মাঝখানে দাঁড়ানো যে ছেলেটাকে ঘিরে এত হইচই, সে
আর কেউ নয়, তাঁর জামাই।
শ্বশুরমশাইকে দেখেই সে মাথা নিচু করে ফেলল। যেন মুখ লুকোতে পারলে বাঁচে।
বাড়িতে এনে যখন তাকে বারবার জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, তুমি তোমার
শ্বশুরবাড়িতে আসবে, এ তো খুব ভাল কথা। তা বলে চোরের মতো পাইপ বেয়ে? তুমি
হঠাৎ এ রকম করতে গেলে কেন?
একই প্রশ্ন বারংবার করতে করতে সবাই যখন প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছে, তখন সে নয়,
মুখ খুলল তার বউ— আসলে ও ভীষণ লাজুক। আমি ওকে বলেছিলাম, আমি তো তোমার বউ।
তুমি আমার কাছে আসবে, এতে লজ্জার কী?
ও তখন বলেছিল, না, তোমার বাবা-মা কী ভাববেন! ভাববেন, আমি খুব হ্যাংলা।
তাঁদের মেয়েকে আমি একদিনও ছেড়ে থাকতে পারি না। তার চেয়ে বরং তোমার বাবা-মা
ঘুমিয়ে পড়লে আমাকে একটা মিস কল দিয়ো, আমি ঠিক চুপিচুপি তোমার কাছে চলে
আসব।
আমি বলেছিলাম, কিন্তু কী করে? মেন গেটের চাবি তো মায়ের কাছে থাকে।
ও বলেছিল, কোনও চিন্তা নেই। জানো না আমি কীসে কাজ করি? দমকলে। গাছের ঝুরি
বেয়ে আমরা মগডালে উঠে যেতে পারি। এ কার্নিস ও কার্নিস ধরে একটা বাড়ি থেকে
আর একটা বাড়ির ছাদে পৌঁছে যেতে পারি। আর আমি তোমার জন্য পাইপ বেয়ে সামান্য
দোতলার ঝুলবারান্দায় উঠতে পারব না? কী যে বলো!
আমি বলেছিলাম, পাইপ? পাইপ কোথায়?
ও বলেছিল, অষ্টমঙ্গলার গিঁট খুলতে গিয়ে আমি তোমাদের বাড়ির চার পাশটা খুব
ভাল করে দেখে এসেছি। দেখেছি, একটা পাইপ তোমাদের ঝুলবারান্দার পাশ দিয়ে সোজা
উঠে গেছে।
আমি বলেছিলাম, তা বলে পাইপ বেয়ে?
ও বলেছিল, আরে বাবা, সামনের গেট দিয়ে তো স্বামীরা ঢোকে। আমি তো শুধু তোমার
স্বামী নই, প্রেমিক। আমি প্রেমিক হয়েই তোমার কাছে বারবার যেতে চাই। আর
জানোই তো, প্রেমিকার সঙ্গে লুকিয়ে-লুকিয়ে দেখা করার ব্যাপারটাই আলাদা।
তখনই আমি বারবার করে ওকে বলেছিলাম, দেখবে, তুমি ঠিক একদিন ধরা পড়ে যাবে। কী? সেই ধরা পড়লে তো?
বউয়ের কথা শুনে লজ্জায় একেবারে মাটির সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল
জামাইয়ের। কিন্তু মেয়ের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাড়ার ছেলে থেকে প্রৌঢ়
যে-ভাবে হেসে উঠল, বাদ গেলেন না শ্বশুর-শাশুড়িও, তাতে তাঁদের সঙ্গে সায়
না-দিয়ে আর কোনও উপায় ছিল না। ও-ও হেসে উঠল। শ্বশুরমশাই বললেন, তোমাকে আর
পাইপ বেয়ে আসতে হবে না। আমাদের সামনে দিয়ে আসতে যদি তোমার লজ্জা করে, তা
হলে আমি কথা দিচ্ছি, মেয়ে যখন এখানে থাকবে, তখন সন্ধ্যার পর থেকে আমাদের
বাড়ির সদর দরজাটা তোমার জন্য খোলাই থাকবে... তাতে যদি সত্যি-সত্যিই চোর
আসে, তো আসুক। যদি কিছু নিয়ে যায়, তো নিক। তবু...
সে কথা শুনে পাড়ার ছেলেদের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠল, আর একটা কথা, আপনার
যদি পাইপ বেয়েই উঠতে ইচ্ছে করে, তো উঠবেন। আমরা তো অনেক রাত অবধি পাড়ার
মুখে বসেই আড্ডা মারি, ওঠার আগে শুধু আমাদের যে কোনও একজনকে বলে যাবেন,
আপনি পাইপে উঠতে যাচ্ছেন, তা হলেই হবে... বলেই, শুধু সে নয়, তার সঙ্গে
সঙ্গে বাকিরাও আরও একবার হো হো করে হেসে উঠল।