সৃজনশীল শিক্ষার্থীর প্রতীক্ষায়! ।। মনজুরুল ইসলাম
সৃজনশীল শিক্ষার্থীর প্রতীক্ষায়! ।।  মনজুরুল ইসলাম

চিত্ত ও মস্তিষ্কের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মাধ্যমে দীর্ঘ অথবা স্বল্প সময় ধরে ক্রিয়াশীল কোনো ভাবের আনন্দময় প্রস্রবণ থেকে উদ্ভূত অনুভূতির যে বিকাশ ঘটিয়ে থাকে স্বাভাবিক অর্থে তাই সৃজনশীলতা। যে বন্ধুত্বের সম্পর্কটি স্থাপন করবার মাধ্যমে মানব মনীষা ক্রমাগত বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ক্ষুদ্রতম সত্তা হিসেবে কণা পরিমাণ জ্ঞান অর্জনে হয়ত সক্ষম হয়ে উঠতে পারবে। বিশাল এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সীমাহীন জ্ঞানের আকর থেকে ক্ষুদ্র জ্ঞানটুকু অনবরত নিজেদের ভেতরে গ্রন্থিত করা সম্ভব হবে তখনই যখন সেই বন্ধুত্বের বন্ধনটি অটুট রয়ে যাবে। স্বাভাবিকভাবে কোনো ব্যক্তি অথবা শিক্ষার্থী যখন কোনো বিষয় অধ্যয়ন করবার নিমিত্তে মনোযোগী হবে তখন সফলভাবে সেই বিষয়ের অন্তর-রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব হবে যখন অধীত বিষয়ের ওপর নিবিড় মনোযোগ কেন্দ্রীভূত থাকবে। এবং ‘জ্ঞান’ নামীয় উপলব্ধির নির্জলা স্বাদ আস্বাদনে অধ্যয়নপটু ব্যক্তি এবং শিক্ষার্থীরা তাদের উপলব্ধির ইন্দ্রিয়গুলোকে অধিকতর সক্রিয় করে তুলতে পারবে। মনে রাখতে হবে, চিত্ত ও মস্তিষ্কের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের বন্ধন সৃষ্টির অন্তরালোকে যে সৃজনশীলতার অমূল্য বীজটি উদগমিত হয়ে থাকে- এমন বোধ আপনা আপনি প্রতিটি সত্তাকে আলোড়িত করবে।

প্রশ্ন উত্থিত হতে পারে যে- কোন ধরনের সৃষ্টিশীল কর্মকে সৃজনশীলতার আবর্তে উৎকীর্ণ করা যেতে পারে। যেহেতু স্বল্প এবং দীর্ঘ সময়ের ব্যাপ্তিটি শুরুতেই নির্দেশিত হয়েছে সেহেতু সেই দিকটিকে বিবেচনায় রেখে বিষয়টির গভীরে যাত্রা করা যেতে পারে। একজন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি, হতে পারেন তিনি বৃদ্ধা, বৃদ্ধ কিংবা পরিণত শিক্ষক অথবা দিনমজুর। এখন, একজন তরুণ কিংবা তরুণী অথবা জ্যেষ্ঠ কোনো ব্যক্তি তাৎক্ষণিকতায় আচরণিক মুগ্ধতা প্রদর্শন অথবা ইতিবাচক কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে যদি সেই পরিণত মুখমন্ডলগুলোয় আলোর প্রভা ছড়াতে সক্ষম হয়, সেক্ষেত্রে অবশ্যই স্বল্প সময়ে ঘটিত সেই সৃষ্টিশীল কর্মটিকে অথবা শোভামণ্ডিত আচরণিক বিশিষ্টতাকে সৃজনশীল অভিধায় স্বীকৃতি প্রদান করা যেতে পারে। যেহেতু উদাহরণীয় উক্ত কর্ম অথবা আচরণিক মুগ্ধতা প্রদর্শন করবার মাধ্যমে সেই সব তরুণ-তরুণী অথবা জ্যেষ্ঠ ব্যক্তি তাদের দীর্ঘদিনের সৃজিত ভাবনাগুলোর আনন্দময় প্রস্রবণকে অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাস্তবতার আবহে রূপদানের ক্ষেত্রে সক্ষমতার পরিচয় প্রদানের ক্ষেত্রে চেষ্টিত থেকেছেন। ঠিক একইভাবে যখন কোনো বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ অথবা সৃজনশীল কোনো পন্ডিত মানস তাদের সৃষ্টির মাধ্যমে উপযোগিতার ক্ষেত্রটির সীমানাটিকে সসীমের মাঝে বৃত্তায়িত না রেখে অসীমের মাঝে প্রক্ষিপ্ত করতে পারেন তখন সেই কর্মটিকে সৃজনশীল অভিধায় অভিহিত করা যেতে পারে। এবং অবশ্যই সেটি দীর্ঘ সময়ের ক্ষেত্র বিবেচনায়। যেহেতু এই দীর্ঘ সময়ের একনিষ্ঠ গবেষণার মাধ্যমে পরিব্যাপ্ত সেই সৃজনশীল ব্যক্তির মননসমুদ্রে এক অপরিসীম তৃপ্তিবোধ তাকে উদ্বেলিত করে। সুতরাং, জাতীয় শুদ্ধির উৎকর্ষ বিবেচনায় সৃজনশীলতার চান্দনিক সৌন্দর্য অন্বেষণের গুরুত্ব স্বল্প এবং দীর্ঘ উভয় প্রেক্ষিত বিবেচনায় অত্যন্ত সূক্ষভাবে বিশ্লেষণ, সংশ্লেষণ এবং গুরুত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে অগ্রণী হয়ে ওঠে। যেহেতু ব্যক্তি মানস সবসময়ের জন্যই প্রত্যাশা করে থাকেন - সবার কাছ থেকে সুস্থ আচরণ এবং যাপিত জীবনের উৎকৃষ্টতা নিশ্চিতির ক্ষেত্রে সর্বোত্তম উপকরণ প্রাপ্তির। সার্বজনীন এ প্রত্যাশাটি পূরণ করবার ক্ষেত্রে অবশ্যই দক্ষতাসীমার সেই স্তরটিতে প্রবেশ করা একটি অনিবার্য শর্ত।           

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার আঙিনায় অধ্যয়নকালীন একজন শিক্ষার্থী জ্ঞানের বহুমাত্রিক দরজায় প্রবেশ করবার মাধ্যমে আপন আপন দক্ষতার মাত্রাটিকে তুঙ্গ পর্যায়ে উন্নীত করে থাকেন; সম্মান অর্জন করবার পাশাপাশি নিশ্চিত করেন বৈষয়িক জীবন ভোগের সকল আয়োজন। তবুও প্রতিষ্ঠিত জীবনে অথবা জীবনের পড়ন্ত বেলায় অর্জিত উৎকর্ষের অবনয়ন তাদের ভাবিত করে তোলে প্রবলভাবে। ধীরে ধীরে লীন হতে থাকা অধ্যয়নের অভ্যাসটি যখন একেবারে খাদের কিনারায় এসে পৌঁছায় তখন বার বার ফিরে যেতে চায় সেই স্বর্ণালি সময়টুকুর কাছে। জীবন প্রবাহের সাথে পাঠের অভ্যাসটি অন্তর্নিবিষ্ট করতে না পারার আক্ষেপটি অন্তর্দগ্ধ করতে থাকে তীব্র তাপসম্পন্ন অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো। পাঠের অভ্যাসটি মৌলিক চাহিদা সীমারেখার অপর পারে রেখে সীমায়তির ভেতর আবৃত নিষ্ফলা জীবনের প্রচ্ছদটি প্রত্যক্ষ করবার মাধ্যমে আড়ষ্ট হয়ে পড়েন স্বভাবজ মানসিক প্রবৃত্তির কারণে। কিন্তু, কেউ কেউ আবার মনোজগতের আধারকে ঋদ্ধ থেকে ঋদ্ধতর করে তুলবার ক্ষেত্রে সক্ষমতার পরিচয় প্রদান করতে থাকেন। নৈমিত্তিক জীবনের প্রতিটি কর্মে সৃজনশীলতার প্রেক্ষিত বিবেচনায় অনুভব করেন নির্মোহ আনন্দ। পাঠের অভ্যাসটি ধরে রাখবার মাধ্যমে বোধের স্তরটিকে উন্নীত করেন অসীম উচ্চতায়। অর্থাৎ এক ধরনের ব্যক্তি অতীত জীবনে মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও শুধু নিয়মিত অধ্যয়নের অভাবে বাস্তব জীবনে নেতিবাচক পরিস্থিতির সম্মুখীন হন এবং অপরজন শিক্ষা জীবন থেকে অধ্যয়ন শুরু করে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অধ্যয়ন চালু রাখবার মাধ্যমে ইতিবাচকতার আবহে নিজের জীবনটিকে পরিচালিত করতে সক্ষম হন। তবে চেতনার অতলান্তিক গহ্বর যদি এ ধরনের চিন্তার দ্বারা স্পর্শিত হয় যে, দু’ধরনের প্রতিষ্ঠিত জীবনে এত বিস্তর পাথর্ক্যরে মর্মমূলে ঠিক কোন কারণটি দায়ী - অধিকতর নির্ভরশীল শিক্ষা নাকি ইচ্ছের ঘাটতি? এখন আর একটি প্রশ্ন আপনা আপনি এসে যায়- ইচ্ছে কী অথবা মানুষের জীবনে ইচ্ছের আবির্ভাব ঘটে কীভাবে? দ্বিতীয় প্রশ্নটির উত্তর প্রদানের পরেই প্রকৃত অনুসন্ধিৎসার দিকে এগুনো যাক। অজানাকে জানবার এবং অদৃশ্যকে দেখবার, একই সাথে সব কিছুকে একান্ত আপনার মতো করে পাবার প্রবল আকাহ্মা থেকে উৎকলিত চর্চার নিরন্তর প্রচেষ্টাটিই হলো ইচ্ছে। যেহেতু চর্চিত বিষয়ের ওপর শিক্ষার্থী অথবা ব্যক্তির ভালোলাগার উদ্রেক ঘটে এবং স্বাভাবিকভাবেই তার স্থায়িত্ব অটুট রয়ে যায় অকৃত্রিমভাবে। এখন যদি অতিমাত্রিক নির্ভরশীল শিক্ষার ওপর ভিত্তি করে সাফল্যের বীজটি অঙ্কুরিত হয়ে ক্রমান্বয়ে মহিরুত্ব প্রাপ্তির দিকে অগ্রগামী হয়ে থাকে তাহলে সেই অগ্রগামীতা অংকুরটিকে মহিরুহে রূপান্তরিত করবার পূর্বে নতুন কোনো বীজের সৃষ্টি করে সেই বীজ থেকে নতুন অঙ্কুর উদগমিত হওয়ার সম্ভাবনাটুকুকে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর করে তুলবে। যেহেতু সে ধরনের কোনো ইচ্ছেই মহিরুত্ব প্রাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত বৃক্ষটির মধ্যে নতুন কিছু সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষাই জাগ্রত করবে না। সে প্রেক্ষিতটিকে বিবেচনায় নিয়ে সেই আপাত সম্ভাবনার প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত বৃক্ষটির বোধে প্রকৃত ইচ্ছের সংজ্ঞাটি কখনোই ভবিষ্যতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। বরং কৃত্রিমতার প্রলেপে প্রলেপিত ইচ্ছের আরোপিত রূপটি উৎকটতারই চিহ্ন বহন করবে। অর্থাৎ কোনো মানুষ যদি বৈয়য়িক জীবনে সফল হবার উদ্দেশ্যেই তার শিক্ষাটি গ্রহণ করে তবে চাকরি পাবার পর থেকে তার আর পড়াশুনার প্রতি কোনো ইচ্ছে জাগ্রত হবে না এবং না হওয়াটিই হবে স্বাভাবিক। এবং তিনি অন্য কোনো ব্যক্তিকে গ্রন্থ পাঠের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হবেন, এক্ষেত্রে শিক্ষার্থী জীবনে তার ফলাফল যতই ভালো হোক। সেক্ষেত্রে নিষ্ফলা জীবনের জলছাপ প্রত্যক্ষ করবার সম্ভাবনাটিই দৃশ্যমান হয়ে উঠবে তার পুরো জীবনজুড়ে। পক্ষান্তরে, বিপরীত চিত্রটি দৃশ্যমান হবে তার ক্ষেত্রে, যিনি আজীবন পাঠের অভ্যাসটি ধরে রাখতে সক্ষম হবেন। পাশাপাশি তিনি অন্যকেও গ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে জীবনে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবার ক্ষেত্রে সফল ভূমিকা পালন করতে পারবেন।         

প্রতিষ্ঠিত জীবনে কোনো ব্যক্তিরই পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠবে না শিক্ষাজীবনে চর্চিত বিষয়গুলোর অবিকল উপস্থাপন-এটিই স্বাভাবিক। অথবা সকল শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থীদের পক্ষে শিক্ষাজীবনে ঘটিত প্রেক্ষাপটগুলোর স্মৃতি রোমন্থন অসম্ভব বলে প্রতীত হবে। কিন্তু, জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো তাদের মনোভূমিতে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল বড়জোর সেই বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা প্রদান করতে সক্ষম হবেন তারা। পাশাপাশি যে সকল জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থীদের প্রতি তাদের গভীর মমত্ব ও অফুরান ভালোবাসা অটুট ছিল তাদের কথাগুলোই স্মৃতিপটে নাক্ষত্রিক আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে। অন্যভাবেও বললে বলতে হয়-যে শিক্ষকের পাঠদান পদ্ধতি এবং যে সকল শিক্ষার্থীদের সঙ্গ তাদের প্রাণিত করেছিল তাদের কথা অবলীলায় স্মরণে নিয়ে আসতে পারবে। যেহেতু সেই শিক্ষকের পাঠদান এবং সঙ্গ তারা আনন্দের সাথে উপভোগ করতো। তারাই তাদের প্রতিনিয়ত পেছনের সময়গুলোতে বিচরণ করবার ক্ষেত্রে বিচরণ ক্ষেত্র নির্মাণ করে সেই ক্ষেত্রজ ভূমিতে পদসঞ্চার করতে তাদেরকে প্রবল বেগে ধাবিত করবে। অধ্যয়নের ক্ষেত্রে বিষয়টি ঠিক একইভাবে কাঠামোবদ্ধ। যে যে বিষয়গুলোতে অধ্যয়নে ব্যাপৃত থাকবার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা জাগিয়ে তুলতে পেরেছিল তাদের মনুষ্যত্বকে, জীবনবোধের সূক্ষ্ম অনুভূতিকে- সেই জ্ঞানটিই পরোক্ষভাবে যাত্রা করতে থাকবে জীবনের শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত। যেহেতু সমস্ত বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অধ্যয়ন করবার পর সেই অধীত বিষয়ের নির্যাসটুকু গ্রহণ করবার মাধ্যমে তারা একটি মূল্যবোধকে অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে এবং এই অর্জিত মূল্যবোধটুকু জাতীয় ঊর্ধ্বায়ন থেকে শুরু করে ব্যক্তিক আত্মিক উৎকর্ষ সাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। একই সাথে শিক্ষা গ্রহণের প্রকৃত সার্থকতা নিশ্চিত করে তুলবে- এটিই প্রকৃত দর্শন।

মুখস্থ নির্ভর বিদ্যা এবং অতিমাত্রিক নির্ভরশীল শিক্ষার প্রত্যক্ষ ইতিবাচক প্রভাবের ফলাফলের প্রাপ্তিযোগ ঘটে দ্রুত সময়ের মধ্যেই। কিন্তু, কিছুদিন পরই তার রেশটি অসীম শূন্যলোকে মিলিয়ে যায়। প্রকৃত অর্থে, যে জ্ঞান প্রকৃতই অনুভূত হয় চিত্ত দিয়ে অথবা যে জ্ঞান ব্যক্তিমানসের বিশ্লেষণ করবার ক্ষমতা, চিন্তা করবার সক্ষমতা সীমাহীনভাবে বৃদ্ধি করে সেই আহরিত জ্ঞানের স্থিতি শিক্ষার্থীদের মনোজগতে রূপ লাভ করে একটি স্থায়ী ভিত্তির ওপর। সেদিক থেকে জ্ঞান অর্জনের প্রত্যয়টিকে যদি হৃদয়াঙ্গম করে উপস্থাপন এবং অর্জন করা যায় তবে অবশ্যই সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী চিন্তার বিকাশ ঘটিয়ে শিক্ষার্থীদের স্ব-স্ব মেধার স্ফুরণ ঘটানো সম্ভব। সেক্ষেত্রে এটিই কি স্বতঃসিদ্ধ সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠার রূপ পরিগ্রহ করতে পারে যে- বর্তমান সময় থেকেই শিক্ষার্থীরা সৃজনশীল হয়ে উঠছে? উত্তরটি নেতিবাচকতার ইঙ্গিতকেই বার বার নির্দেশ করবে। ৯০০০ বছর পূর্বে মানুষ যখন প্রথম আগুনের ব্যবহার রপ্ত করে, তারও পরে পৃথিবীতে বসবাসের জন্য চাকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রকার যন্ত্রপাতির আবিষ্কার সম্ভব করে তোলে তখন থেকেই সৃজনশীল কর্মের সূত্রপাত ঘটে। এমনকি উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত আচরণিক সাধারণ বিশিষ্টতাগুলোকে অবশ্যই সৃজনশীলতার মোড়কে সংজ্ঞায়িত করা যায় যেহেতু এই সংঘবদ্ধ আচরণগুলো মানবজাতিকে ক্রমান্বয়িকভাবে উন্নত জীবন অভিমুখে যাত্রার ক্ষেত্রে কণ্টকিত পথটিকে নিষ্কণ্টক করতে শুরু করেছিল। কিন্তু, উদ্ভূত প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখবার ক্ষেত্রে সৃজনশীলতার সংজ্ঞায় এবং সৃজনশীল উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। যেহেতু সৃজনশীল পদ্ধতি ব্যবহারের প্রত্যক্ষ ফল শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য সাধনের ক্ষেত্রে সকলের দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিবাচক হিসেবে প্রশ্নহীনভাবে স্বীকৃত সেহেতু পরিবর্তনের সঙ্গে মিল রেখে চলবার নিমিত্তে ২০১০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে আমাদের দেশে সৃজনশীল পদ্ধতি ভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম গৃহীত হয়েছে। কিন্তু, বর্তমান সময়ে সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর পূর্বেই শিক্ষার্থীদের অবচেতনাতেই শিক্ষার্থীরাও সৃজনশীল হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। পরোক্ষভাবে সৃজনশীলতার অমূল্য উষ্ণিশটি অন্তর্নিহিত ছিল প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মস্তিষ্কের সীমাহীন রাজ্যে। পরিমাণ বিবেচনায় সেটি কম বেশি যাই হোক না কেন, বর্তমান বাস্তবতায় প্রত্যেক শিক্ষার্থীর অন্তর্জগতে সৃজনশীলতার গুণটিকে প্রবিষ্ট করবার লক্ষ্যে তা সরাসরি আরোপ করা হয়েছে যা অবশ্যই ইতিবাচক। 

সৃজনশীলতার প্রকৃত বৈশিষ্ট্য হলো শিক্ষার্থীদের যে কোনো বিষয়ের মর্মমূলে প্রোথিত প্রেক্ষিতটি আবিষ্কারে অনুসন্ধিৎসু করে গড়ে তোলা। জীবন প্রবাহে ঘটে যাওয়া প্রতিটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়ে অনির্বাণ অবিরত জিজ্ঞাসা সৃষ্টি সম্ভব শুধু সৃজনশীল শিক্ষার্থী হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করবার মাধ্যমে। এই পদ্ধতিতে জ্ঞান অন্বেষণ করবার ক্ষেত্রে কৃত্রিমতার কোনো স্থান নেই এবং কখনোই ছিল না। শিক্ষার্থীরা নিয়ত অকৃত্রিম আচরণগত বৈশিষ্ট্যের দ্বারা গ্রন্থিত হয়ে জ্ঞানের সর্বোচ্চ শিখরে অবস্থান করতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো শিক্ষার্থীরা কি ফলাফল ভালো করবে নাকি সৃজনশীলতার মূল বিষয়টিকে অনুধাবনে অগ্রগামী হয়ে উঠবে? প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়- ভালো ফলাফল অর্জন করবার দিকে একজন শিক্ষার্থীকে যেমন তার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টাটির প্রয়োগ জরুরি তেমনি অনুধাবন করবার ক্ষেত্রে মনোযোগী হওয়া অধিকতর জরুরি। বরং অনুধাবনে আগ্রহী হলে শিক্ষার্থীর মনোজগতে যে সুচিন্তিত বোধের সৃষ্টি হবে সেই বোধের ওপর ভিত্তি করে শিক্ষাজীবনের পরীক্ষা তো বটেই জীবনব্যাপী সকল পরীক্ষায় সহজেই উত্তীর্ণ হওয়া সম্ভব হবে। আর এখানেই সৃজনশীল পদ্ধতিতে পাঠদানের মূল ইতিবাচক আবহটি অন্তরিত। এক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন এখানে অবশ্যই উত্থিত হবার সম্ভাবনাকে নিশ্চিত করে যে- যে শিক্ষা কোনো শিক্ষার্থীর বাস্তব প্রেক্ষিতটিকে কোনোভাবেই কল্যাণগামিতার দিকে ধাবিত করবে না সে শিক্ষাকে কি প্রকৃত শিক্ষা হিসেবে গণ্য করা যাবে?

ক্রিকেট মাঠে একজন ব্যাটসম্যান যখন ব্যাটিং করেন অথবা একজন বোলার যখন বোলিং করেন তখন ব্যাটসম্যান বোলারের সার্বিক লক্ষণ পর্যালোচনা করে কোন পজিশনে ব্যাট চালনা করবেন সে মুহূর্তে সেই সিদ্ধান্তটি নিয়ে থাকেন। একইভাবে বোলার তার সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগ করবার মাধ্যমে ব্যাটসম্যানের মনস্তত্ত্বটিকে আয়ত্ত করবার চেষ্টা করেন এবং সে অনুযায়ী একেক সময় একেক ধরনের বল ডেলিভারি করেন। যে বিষয়টি এখানে লক্ষণীয় সেটি হলো-ব্যাটসম্যান এবং বোলার উভয়কেই খেলাটিকে তাদের মননে গেঁথে নেবার কাজটি করতে হয় স্ব-স্ব ক্ষেত্রে সাফল্যকে নিশ্চিত করবার ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে মননে গেঁথে নেবার বিষয়টি তখনই সফলতার দিকে ধাবিত হবে যখন সেই খেলোয়াড় খেলাটির ওপর তার প্রকৃত ভালোলাগা, প্রচেষ্টা এবং মনোযোগের সমন্বয় ঘটাতে সক্ষম হবেন। কিন্তু, ব্যাটসম্যান অথবা বোলার যদি কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই ব্যাট চালনা করেন কিংবা বল ডেলিভারি দেন, মেধা, প্রজ্ঞা ও প্রচেষ্টার সুষ্ঠু সমন্বয় ঘটাতে ব্যর্থ হন তবে সাময়িকভাবে হয়ত সফলতা লাভ করতে পারবেন। কিন্তু, ধারাবাহিকভাবে সাফল্যের মাত্রাটি অক্ষুণ্ন রাখতে অবশ্যই ব্যর্থ হবেন। ফলে এক সময় দলের অযোগ্য সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হবেন। যেহেতু ওই চর্চিত বিষয়টির ওপর প্রকৃত অর্থেই তার অনুরাগের সৃষ্টি হয় নি। অথবা স্বাভাবিকভাবেই একজন খেলোয়াড় বিকেলে মাঠে গিয়ে খেলায় অংশগ্রহণ করতে না পারলে তার ভেতরে এক ধরনের অমোঘ অস্থিরতা কাজ করবে। সেই অস্থিরতার রেশ ততক্ষণ পর্যন্ত ক্রিয়াশীল রয়ে যাবে যতক্ষণ পর্যন্ত না সেই খেলোয়াড় মাঠে গিয়ে খেলা শুরু করতে পারবে। কারণ, সেই খেলোয়াড় স্পষ্টতই উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে যে- ব্যাটবলের শৈল্পিক প্রদর্শনীর মাধ্যমে সে দর্শকদের আনন্দ প্রদান করতে পারবে এবং নিজে আনন্দ লাভ করবে নিশ্চিতভাবে। খেলাধুলা করবার মাধ্যমে তার অন্তর্দেশে পুলকিত বোধ সৃষ্টির এক অনুপম ক্ষমতা অনুভব করতে পারবে বলেই সেই খেলোয়াড় খেলাধুলা করবার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকবে। ঠিক একইভাবে একজন শিক্ষার্থী যখন সেই খেলোয়াড়ের মতো করে নিজের অধ্যয়ন থেকে প্রকৃত আনন্দ উপভোগ করতে সক্ষম হয়ে উঠবে ঠিক তখনই সে পড়াশুনার মাধ্যমে যে ধরনের কাঙিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছুবার কথা-সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হবে। এবং আপনা আপনি অধ্যয়নের কক্ষটিকে একটি kingdom of pleasure হিসেবে নিজের মননে স্থাপন করবে। অধ্যয়নের নির্দিষ্ট সময়টিতে যেখানেই যত ব্যস্ততা নিয়েই অবস্থান করুক না কেন, বার বার সে সেই নির্দিষ্ট kingdom of pleasure -এ ফিরে আসতে চাইবে।   

আর একটি উদ্ধৃতি প্রদানের মাধ্যমে বিষয়টিকে আরো সহজতর করে ব্যাখ্যা প্রদান করবার চেষ্টা করা যেতে পারে। ধরা যাক দু’জন শিক্ষার্থী - একজন বাংলা অথবা ইংরেজি বিষয়ে ৯০ শতাংশ নম্বর অর্জন করেছে এবং অপর শিক্ষার্থী অর্জন করেছে ৮০ শতাংশ। প্রথম শিক্ষার্থী সবসময়ই বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র এবং নম্বরভিত্তিক অধ্যয়নের ওপর গুরুত্ব প্রদান করেছে এবং কাঙ্ক্ষিত নম্বর পেয়েছে। কিন্তু, অপর শিক্ষার্থী প্রশ্নপত্র এবং নম্বর কেন্দ্রিক অধ্যয়নের দিকে নিজেকে প্রস্তুত না করে ব্যাকরণের মৌলিক বিষয়গুলোকে আত্মস্থ করবার দিকে তার মনোযোগ কেন্দ্রীভূত রেখেছিল। এখন দু’জন শিক্ষার্থীকে যদি একটি অনুষ্ঠানে বাংলা অথবা ইংরেজি ভাষায় উপস্থিত বক্তৃতা প্রদানের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয় তাহলে দ্বিতীয় শিক্ষার্থীটি প্রথম শিক্ষার্থীটিকে অবলীলায় উত্তীর্ণ করে যাবে। এমনকি তারা দু’জনই যদি কোনো বিষয়ে লিখবার ক্ষেত্রে বন্ধু কর্তৃক অনুরুদ্ধ অথবা শিক্ষক কর্তৃক আদিষ্ট হয় তবে ২য় শিক্ষার্থী প্রথম শিক্ষার্থীর তুলনায় রচনার উৎকর্ষ ও শৈলী বিবেচনায় নিশ্চিতভাবেই এগিয়ে থাকবে। কারণ দ্বিতীয় শিক্ষার্থী বাংলা এবং ইংরেজির মৌলিক বিষয়গুলোকে আত্মস্থ করবার জন্যে তার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টাটুকু গ্রহণ করেছে শুধু অধিক নম্বর অর্জনের জন্য নয়। আবার প্রশ্নের ধরন যদি পুরোপুরি পরিবর্তিত হয় অথবা প্রশ্নমালার জিজ্ঞাসিত প্রশ্নগুলোর প্রকৃতি যদি ভিন্ন হয় তবে অবশ্যই প্রথম শিক্ষার্থী পরীক্ষার হলে তীব্র মাত্রায় অস্বস্তি বোধ করবে, এমনকি তার অকৃতকার্য হবার সম্ভাবনাটিই প্রকটতর হয়ে উঠবে। পরন্তু, দ্বিতীয় শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতির অবতারণা কখনোই হবে না। কিন্তু, একই পদ্ধতিতে অধ্যয়নের ক্ষেত্রে যদি উভয় শিক্ষার্থী তাদের প্রচেষ্টা সঠিকভাবে চালনা করে তবে অপরিণত বয়স থেকে শুরু করে পরিণত বয়স পর্যন্ত সর্বাবস্থাতেই সাফল্যের মাত্রাটিকে উৎকর্ষের শীর্ষ চূড়ায় উন্নীত করতে সক্ষম হবে।

মাইক্রোসফট কোম্পানির সহ-প্রতিষ্ঠাতা বিল গেইটস লেকসাইড স্কুল এবং হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন গভীর অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে ব্যুৎপত্তি অর্জনে নিজেকে নিমগ্ন রেখেছিলেন বলেই অসামান্য সৃজনশীল একটি আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিলেন, আর সেটি হলো মাইক্রোসফট উইনডোজ নির্মাণ। শ্রেণিকক্ষে সবার থেকে বেশি নম্বর অর্জন করতে হবে এ ধরনের নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য তাঁর ছিল না, বরং সৃষ্টিটিকে কীভাবে সম্পন্ন করা যাবে সেটিই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য। তাঁর জন্য এটি অত্যন্ত প্রশান্তির ব্যাপার যে - অতি অল্প সময়ের মধ্যেই নিজের তীব্র প্রচেষ্টাটির সফল সমাপ্তি প্রত্যক্ষ করতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন। বিশ্বের শীর্ষ ধনী হিসেবে নিজের অবস্থানটি নিশ্চিত করলেও যে বিষয়টি এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য সেটি হলো- বিল গেইটস তাঁর শিক্ষিকা মা মেরি ম্যাক্সওয়েল- এর আদর্শ দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। বিশেষত ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে যখন তাঁর মা মৃত্যুবরণ করেন তখন বিল গেইটস তাঁর মায়ের আদর্শকেই ধারণ করে তাঁর অগ্রযাত্রা শুরু করেন। এই চলমান অগ্রযাত্রার এক পর্যায়ে গিয়ে তিনি গঠন করেন বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেইটস ফাউন্ডেশন। যে ফাউন্ডেশনটির মূল কাজ হলো-বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোর শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা। ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে মাইক্রোসফট কোম্পানির চেয়ারম্যানের পদ ছেড়ে দিয়েই সৃষ্টিশীল বিভিন্ন কাজে নিজেকে ব্যাপৃত রেখে সারা বিশ্বে একটি অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করে যাচ্ছেন বিল গেইটস। সৃজনশীলতার গুণটিকে নিজের ভেতরে গ্রন্থিত করবার কারণেই তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছে আজীবন ঔদার্যিক এই কাজে নিমগ্ন থেকে নিজের জীবনকে যাপিত করবার।     

আর বক্তব্য প্রদানের প্রেক্ষিতটিকে বিশ্লেষণ করলে এটি স্পষ্টতই উজ্জ্বল রৌদ্রালোকের মতো প্রতিভাত হয় যে- বক্তব্যের কাব্যিক, জ্ঞানিক অথবা ব্যবহারিক উপযোগিতা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এই গুরুত্বটিকে উপলব্ধির মুকুরে বিম্বিত করা সম্ভব হবে তখনই যখন বক্তব্যের অভ্যন্তরে প্রোথিত সৌন্দর্যটি অবলোকন করা বক্তার পক্ষে সম্ভব হবে। একজন শিক্ষিত ব্যক্তি যখন নির্দিষ্ট কোনো অনুষ্ঠানে বক্তৃতা প্রদান করবেন তখন তার বক্তৃতাটি সৃজনশীল ছিল কিনা, নাকি কৃত্রিমভাবে অলংকৃত ছিল তা নিয়ে ভাবনার প্রশ্নটি আপনা আপনি শ্রোতাদের মনোজগতে প্রশ্নের উদ্রেক ঘটাবে। বক্তব্য শুনবার পর শ্রোতারা কতটুকু উপকৃত হয়েছেন তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণের দাবি জিজ্ঞাসু হৃদয়কে ক্রমাগত আন্দোলিত করবে। সাধারণত বেশির ভাগ বক্তাই বক্তৃতা প্রদানের পূর্বে নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে পড়াশুনা করে সেই বিষয়গুলোর হুবহু প্রদর্শন বক্তৃতা প্রদানকালীন প্রকাশ করে থাকেন। অবশ্য সে ধরনের বক্তৃতা সমাজকে এগিয়ে নেবার ক্ষেত্রে একটি বিশেষ শ্রেণির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলে অনুভূত হয়। কিন্তু, একটি সৃজনশীল বক্তৃতা সকল শ্রেণির শ্রোতাদের জন্য প্রয়োজনীয় হয় সার্থকভাবেই। এ ধরনের বক্তৃতা প্রদানের ক্ষেত্রে বক্তা কখনোই বলতে পারবেন না যে-তিনি তার বক্তৃতায় কোন কথাগুলি ব্যক্ত করবেন। আজীবন সাধনায় অর্জিত জ্ঞান এবং হৃদিসরোবরে সুস্থ চিন্তার প্রবাহকে পুঁজি করে যে কোনো সময় যে কোনো মহূর্তে যে কোনো বিষয়ের ওপর বক্তৃতা প্রদানের জন্য কোনো সংগঠন অথবা ব্যক্তি কর্তৃক অনুরুদ্ধ হলে অবশ্যই তিনি মূল বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করে প্রকৃত মর্মকথা শ্রোতাদের সামনে উপস্থাপনে সক্ষম হবেন। ভবিষ্যতে সেই বক্তৃতাগুলো অনুলেখনের মাধ্যমে একটি বিখ্যাত সৃষ্টি হিসেবে জ্ঞানের জগতে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যাবে। এখানেই সৃজনশীল পদ্ধতি এবং গতানুগতিক পদ্ধতির পাঠগ্রহণ অথবা পাঠদানের মধ্যে মূল প্রভেদটি প্রবলভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

আমেরিকান ধ্রুপদী কবি ও প্রাবন্ধিক রালফ ওয়ালডো এমার্সন আমেরিকার কনকর্ড রাজ্যে অবস্থানকালীন অত্যন্ত আনুবীক্ষণিক দৃষ্টি প্রক্ষিপ্ত করে সেই সময়ের সমাজকে পাঠ করবার মাধ্যমে শনাক্ত করেছিলেন জীবন ও সমাজ সংশ্লিষ্ট অগণিত সমস্যার অন্তরসার। পরবর্তী সময়ে এই সমস্যাগুলির ওপর ভিত্তি করে তিনি অসমসাহসিকতার সাথে জনান্তিকে প্রায় দেড় হাজারের অধিক বক্তব্য প্রদান করেছিলেন এবং সব বক্তব্যই জনগণের দাবি আদায়ে প্রতিনিধিত্ব করেছিল। তিনি, তাঁর এই প্রদত্ত বক্তৃতাগুলো অলংকৃত করবার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিকতা অবলম্বন করেন নি বরং সৃজনশীল প্রতিভার সর্বোচ্চ প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন। অত্যন্ত আশার বিষয় হলো-এই বক্তৃতাগুলোর ওপর নির্ভর করেই জনসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সমস্যার সমাধানও ঘটেছিল। যদিও এই বক্তৃতাগুলো প্রদানের নেপথ্যে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে এসেছিল চরম হুমকি। কিন্তু, তিনি তাঁর আদর্শিক অবস্থান থেকে এক বিন্দুও সরে আসেন নি। পরবর্তীকালে জনকল্যাণ ও জীবন সংশ্লিষ্টতার গুরুত্ব বিবেচনায় বক্তৃতাগুলো অনুলেখনের মাধ্যমে সাহিত্যে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করেছিল, যে বক্তৃতাগুলো আজও রালফ ওয়ালডো এমার্সনের প্রখর রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তাকে উপস্থাপন করে। শুধু তাই নয়, বর্তমান সময়ের চিন্তাপ্রবণ ব্যক্তিত্বদের প্রভাবিত করে ভীষণভাবে। এখানে যে বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষ করবার মতো সেটি হলো -সৃষ্টি সবসময়ই সৃজনশীল ব্যক্তির মধ্যে অন্তরিত থাকে এবং সেই সৃষ্টিটিকে প্রসব করবার মাধ্যম হিসেবে যে বিষয় দুটি প্রথম শর্তেই অনিবার্যতা দাবি করে তা হলো-অধ্যয়ন এবং বিচিত্র ও বহুমুখী জীবনে বিচরণ। অতঃপর সেই জীবন প্রবাহের পারিপার্শি¦ক প্রতিবেশের ওপর তীক্ষ্ন দৃষ্টির প্রক্ষেপণ।

 

 

উপর্যুক্ত প্রেক্ষিতগুলো বিশ্লেষণের পর একজন শিক্ষার্থী যদি সৃজনশীল পদ্ধতিতে পাঠ গ্রহণে ব্রতী হয় তখন স্ব-প্রণোদিত হয়ে অবশ্যম্ভাবীরূপে অধ্যয়নে রত থাকবে। পাশাপাশি অভিভাবকবৃন্দেরও সন্তানের পড়াশুনার বিষয়টি নিয়ে অনর্থক চিন্তার যে ইন্দ্রজাল তাদের অন্তর্দেশে রচিত হবে তা পুরোপুরি নির্বাপিত হবে। শিক্ষার্থী তখন বুঝতে পারবে যে, নির্দিষ্ট প্রশ্নের উত্তরটি সে নিজেই সৃজন করছে। সেক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবে সেই শিক্ষার্থী উপভোগ করতে সক্ষম হবে সৃষ্টির প্রমিত সৌন্দর্য। হয়ত সে শিক্ষক অথবা অন্য কোনো গ্রন্থের সহায়তা নেবার মাধ্যমে নিজের প্রণীত উত্তরটি সঠিক কি না সেটি যাচাই করবে। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অনবরত চর্চায় নিবিষ্ট থাকলে তার আত্মবিশ্বাস অনেক গভীর হবে এবং সে আরও অনুসন্ধিৎসু হয়ে উঠবে-এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু, একজন শিক্ষার্থী যখন সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রোথিত অনিন্দ্যসুন্দর সৌন্দর্যটি এড়িয়ে স্বল্প সময়ে সংক্ষিপ্ত কোনো উপায়ে অধ্যয়নে প্রবৃত্ত হবে তখন সে তার অবচেতন মনেই তার ভেতরে সৃজনের যে প্রতিভা লুকিয়ে থাকবে সেটি বিকশিত হবার পথকে চিরদিনের জন্য রুদ্ধ করে দেবে। ভবিষ্যতে এই ধরনের শিক্ষার্থী ব্যক্তিগত জীবনে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে তাৎক্ষণিকতায় কোনো যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আড়ষ্ট হয়ে পড়বে। এবং পরগাছার মতো অন্যের ওপর নির্ভরশীল হবে। আবার এই ধরনের শিক্ষার্থী যদি ভবিষ্যতে শিক্ষকের ভূমিকার অবতীর্ণ হন তবে তার পক্ষে কখনোই সম্ভব হবে না শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল হিসেবে গড়ে তুলবার। একইসাথে কোনো শিক্ষার্থী যদি কোনো প্রশ্নের উত্তর অন্যান্য শিক্ষার্থীদের তুলনায় নান্দনিক এবং যুক্তিগ্রাহ্য উপায়ে ব্যাখ্যা প্রদান করে, সেক্ষেত্রে উক্ত উত্তরটির দ্বারা উক্ত মূল্যায়নকারীর সন্তুষ্টি অর্জিত নাও হতে পারে। এটিই স্বাভাবিক।

শিক্ষার্থীদের অন্তর্করণে অনুভবের এই বোধটি ধীরে ধীরে পরিণত হয়ে উঠবে তখনই যখন একেবারেই গোড়া থেকে তারা তাদের জন্য নির্ধারিত পাঠের বিষয়গুলোকে মুখস্থ না করে বুঝে বুঝে অধ্যয়নের চেষ্টা করবে। এ প্রেক্ষিত বিবেচনায় কোনো দ্বিধা ছাড়াই যাদের অবদান গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে প্রতীত হবে তারা হলেন অভিভাবক এবং শিক্ষক। অভিভাবকবৃন্দ যদি বাড়িতে শিশুদের প্রতিটি বিষয় বুঝে অধ্যয়ন করবার জন্যে জোর তাগিদের পরিবর্তে অনবরত উৎসাহ প্রদান করেন তবে শিশুরা ধীর গতিতে হলেও প্রতিটি বিষয় বুঝে বুঝে অধ্যয়ন করবার চেষ্টা করবে। এটি করবার পরিবর্তে অভিভাবকবৃন্দ যদি দ্রুত পাঠটি সম্পন্ন করবার জন্য অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করেন এবং মুখস্থবিদ্যার দিকে সন্তানদের ধাবিত করেন তবে মুখস্থ বিদ্যার প্রবণতাটি ধীরে ধীরে শিশুদের মননে সক্রিয়ভাবে গড়ে উঠবে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,“দশটা হইতে চারটে পর্যন্ত যাহা মুখস্থ করি, জীবনের সঙ্গে, চারি দিকের মানুষের সঙ্গে, ঘরের সঙ্গে, তাহার মিল দেখিতে পাই না। বাড়িতে বাপ মা ভাই বন্ধুরা যাহা আলোচনা করেন বিদ্যালয়ের শিক্ষার সঙ্গে তাহার যোগ নাই, বরঞ্চ অনেক সময় বিরোধ আছে। এমন অবস্থায় বিদ্যালয় একটা এঞ্জিনমাত্র হইয়া থাকে, তাহা বস্তু জোগায়, প্রাণ জোগায় না।’’ তিনি আরো বলেন,‘‘ অতএব আমাদের এখনকার প্রয়োজন যদি আমরা ঠিক বুঝি তবে এমন ব্যবস্থা করিতে হইবে, যাহাতে বিদ্যালয় ঘরের কাজ করিতে পারে, যাহাতে পাঠ বিষয়ের বিচিত্রতার সঙ্গে আপনার সজীবতা মিশিতে পারে, যাহাতে পুঁথির শিক্ষাদান এবং হৃদয়মনকে গড়িয়া তোলা দুই ভারই বিদ্যালয়ই গ্রহণ করে। দেখিতে হইবে আমাদের দেশ বিদ্যালয়ের সঙ্গে বিদ্যালয়ের চতুর্দিকের যে বিচ্ছেদ, এমনকি বিরোধ আছে, তাহার দ্বারা ছাত্রদের মন বিক্ষিপ্ত হইয়া না পায় ও এইরূপে বিদ্যাশিক্ষাটা যেন কেবল দিনের মধ্যে কয়েক ঘণ্টা মাত্র সম্পূর্ণ হইয়া উঠিয়া বাস্তবিকতাসম্পর্কশূন্য একটা অত্যন্ত গুরুপাক আবস্ট্রাক্ট ব্যাপার হইয়া না দাঁড়ায়।’ প্রকৃত প্রেক্ষিতে এই সমস্যাটির সমাধানকল্পে গোড়াতেই যে বিষয়টির দিকে গুরুত্ব দিতে হবে সেটি হলো-মুখস্থ করে নির্ধারিত বিষয়টিকে আয়ত্তে নিয়ে আসা যে অত্যন্ত কঠিন কাজ এবং মুখস্থনির্ভর বিদ্যার সাথে যে আমাদের স্বাভাবিক জীবনের কোনো যোগসূত্র নেই সেটির প্রকৃততা অভিভাবকবৃন্দের বোধগম্যতার আওতায় নিয়ে আসা। যেহেতু এই বোধগম্যতার ওপর নির্ভর করেই রচিত হবে তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধি। সুতরাং, শিক্ষার্থীদের বয়স বিবেচনা করে তার ওপর দায়িত্ব অর্পণের বিষয়টিকে গুরুত্ব প্রদান করা হবে শিশুটির জন্য অত্যন্ত মঙ্গলজনক। যে বিষয়টি একেবারেই অনভিপ্রেত সেটি হলো-অভিভাবকবৃন্দ অনেক ক্ষেত্রেই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের প্রতি ক্ষুব্ধ হন, এমনকি এই ক্ষুব্ধতার বহিঃপ্রকাশ শারীরিক নির্যাতনে গিয়ে পৌঁছোয়। ফলে শিশুদের ভেতরে সব সময়ের জন্যে একটি বিশেষ আতঙ্ক ক্রিয়াশীল থাকে এবং পড়াশুনা যে একটি কঠিন এবং দুর্বোধ্য কাজ, সেই ধারণা তাদের অভ্যন্তরে দৃঢ়ভাবে গ্রন্থিত হতে থাকে। অধিকন্তু, এই নেতিবাচক ধারণাটি যদি ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীর ভেতরে সক্রিয় থেকে সক্রিয়তর হতে থাকে তবে শিক্ষাজীবন তো অবশ্যই, জীবনের কোনো সময়েই সেই শিশুটি পরিণত বয়সে পাঠের অভ্যন্তরে নিজেকে অন্তরায়িত রাখবেন না। পড়াশুনা প্রত্যয়টির মতো একটি শোভিত ও চিত্তাকর্ষক প্রত্যয়ে নিমগ্ন থাকবার পরিবর্তে আত্মবিস্মৃত হয়ে সেই প্রত্যয়টির প্রতি তার আক্ষেপ প্রকাশ করবেন এবং অনিবার্যভাবেই নিরুৎসাহিত হয়ে পড়বেন, যা কখনোই এবং কোনোভাবেই রাষ্ট্রিক, ব্যক্তিক এবং জাতীয়ভাবে কাম্য হতে পারে না।

শিক্ষকবৃন্দ যে কাজটি করবার মাধ্যমে শিক্ষার্থী অথবা শিশুদের ভেতরে অধ্যয়নের ওপর ইতিবাচক ধারণা গড়ে তুলতে পারেন সেটি হলো-শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের পাঠের প্রতি সীমাহীন অনুরাগ সৃষ্টি এবং পাঠ প্রক্রিয়ায় আনন্দ প্রদানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। শিক্ষার্থী অথবা শিশুরা যে বিষয়গুলোর সাথে নিজেদের মননকে ভালোলাগার বুননে গ্রন্থিত রাখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে সেই বিষয়গুলোর ওপর শিক্ষক তার সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করে তার ভেতর দিয়ে শিক্ষা প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করবেন। শ্রেণিকক্ষের সেই সময়টুকুতে একজন শিক্ষককে অবশ্যই এই বিশ্বাস ধারণ করতে হবে যে-তিনিই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মানুষ। এক্ষেত্রে শিক্ষক যদি সীমাহীন মানসিক সমস্যায় জর্জরিত থাকেন তবুও সেই সময়টুকুর জন্য হলেও নিজের স্বতঃস্ফ‚র্ত মনোভাবটিকে শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থাপনের প্রাণপণ চেষ্টা করে যেতে হবে। যেহেতু, ওই সময়টুকুর জন্য তিনি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ কাজটিতে নিজেকে বিরাজিত রাখছেন। আর এটি করবার মাধ্যমে শিক্ষক শব্দটির মাহাত্ম্য ঔজ্জ্বল্যের দ্যুতিতে দীপ্যমান হয়ে উঠবে। কিন্তু উদ্ধৃত ত্রিমাত্রিক প্রচেষ্টা অর্থাৎ শিক্ষক, অভিভাবক এবং শিক্ষাপ্রশাসনের মধ্যে প্রত্যক্ষ করা না যায় তাহলে শিক্ষায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা না পেয়ে প্রতিষ্ঠা পাবে বৈষয়িক স্বার্থ পূরণের প্রত্যাশা।

“একাডেমিক শিক্ষা সম্পন্ন করবার পর মানুষের মননের গহীনে জ্ঞান নামীয় যে নির্যাসটুকু অবশিষ্ট রয়ে যায় তার নামই হলো শিক্ষা”- বিজ্ঞানী আইনস্টাইন কর্তৃক রচিত প্রবন্ধের উপর্যুক্ত উদ্ধৃতি থেকে এটি স্পষ্টতই উপলব্ধ হয় যে -পড়াশুনা সম্পন্ন করবার মাধ্যমে মানুষ মূল্যবোধের যে স্তরে উপনীত হয় সেই স্তরের উৎকর্ষের ওপর নির্ভর করেই নির্ণীত হয় প্রকৃত শিক্ষা অর্জনের মাপকাঠি। এই মূল্যবোধের স্তরের আদর্শিক মাত্রার ওপর ভিত্তি করেই মানুষের পরবর্তী জীবনের গতি নির্ধারিত হয়। শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে আদর্শিক এই মাত্রাটি নিশ্চিত করবার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ অক্টোবর নিউইয়র্কের অ্যালবেনি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমেরিকার উচ্চশিক্ষার ত্রিশতম বার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানে বলেন, “শিক্ষার গুণগত মানের উৎকর্ষ বৃদ্ধি পাবে তখনই যখন শিক্ষার্থী তার সংশ্লিষ্ট কাজটিকে উপভোগ করবে, নির্ধারিত কর্মটি সম্পন্ন করবার পর আনন্দ লাভ করবে এবং উক্ত কাজ দ্বারা সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে।” অ্যাকাডেমিক শিক্ষার পর্ব সম্পন্ন করবার পর মাত্রিকতা কেন্দ্রিক সবাই একটি সার্টিফিকেট অর্জন করে থাকেন। কিন্তু, দায়বদ্ধতার প্রশ্নে নিজের প্রগলভ ও স্বার্থান্বেষী মানসিকতাটি নির্মুল করে দায়িত্বশীলতার ক্ষেত্রে সবাই কি রাষ্ট্রিক উন্নয়নে সমান অবদান রাখতে পারেন? একই কারণে অনেক শিক্ষার্থীই তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হন, অনেকেই নিজেকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যাবেন সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সময় হারিয়ে ফেলেন। আবার অনেক শিক্ষার্থীই কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছে যান খুব সহজেই। তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক জ্ঞান নামীয় অমূল্য অদৃশ্য উপলব্ধির মাধ্যমে নিজের অন্তর্জগতটিকে ঢেলে সাজাতে পারেন বলেই বাস্তব জীবনে এগিয়ে যেতে সক্ষম হন। যে ধরনের অনুসন্ধিৎসু ও আগ্রহী মনোভাব নিয়ে শিক্ষাজীবনে বেড়ে ওঠা উচিত সেই ধরনের মানসিকতা ধারণ করবার গুণটি এর মূল কারণ। ভবিষ্যতে এ কারণেই বাস্তব জীবনে এসে তার প্রয়োগটি ঘটে থাকে খুব সহজেই। অর্থাৎ, প্রকৃত শিক্ষা অর্জনের নিশ্চিতি তার মনোজগতকে ইতিবাচকভাবে সবসময়ই তার অজান্তেই প্রস্তুত করে রাখে।       

এখন, এই যে ‘প্রকৃত শিক্ষা’-এই প্রকৃত শিক্ষার নির্যাসটুকু গ্রহণ করবার ক্ষেত্রে প্রফুল্ল চিত্তে পাঠদান ও গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। যে বিকল্পটি পূরণের ক্ষেত্রে অবশ্যই সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরিচালিত পাঠ কার্যক্রমের গভীরে প্রবেশ করবার মাধ্যমে প্রকৃত শিক্ষা অর্জনের মর্মোদ্ঘাটন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এবং জীবনের বহুমুখী দাবি যখন তার সফলতার পথটিকে কণ্টকাকীর্ণ করে তুলবে তখন তা মোকাবেলা করবার সামর্থ্য তার ভেতরে আপনা আপনি সৃষ্টি হবে। পুত্র সন্তানদের হারানোর অসহনীয় ব্যথা, স্ত্রীর পঙ্গুত্ব, দারিদ্র্যের নির্মম নিষ্পেষণে আত্মিক মৃত্যুর অবশ্যম্ভাবিতার কারণে এই যে বিপুল আর্থিক ঋণের দায়ভার-এই সব প্রবল অনিয়ন্ত্রিত সমস্যা নজরুলের সৃষ্টির পরতে পরতে সৃষ্টি করেছিল সীমাহীন বাধার। এটি কমবেশি সবারই জানা। যে বিষয়টি সবসময়ের জন্যই অনুমেয় সেটি হলো, আর্থিক দীনতা অথবা মানসিক স্থিতধীর অভাবে বেশির ভাগ সৃষ্টিশীল মানুষই তাদের সাংগ্রামিক জীবনকে বিদায় জানাতে বাধ্য হন। তাদের চিত্তপটে সৃজনের যে সামর্থ্য অটুট রয়ে যায় তা ধীরে ধীরে নিঃশেষিত হয়। কিন্তু, ম্রিয়মাণ আলোর নিচে দাঁড়িয়েও নজরুল তাঁর হৃৎপিণ্ডে র গভীরতম প্রদেশে এই ধ্রুব বিশ্বাসটিকে অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন যে-তাঁর ভেতরে জন্ম লাভ করা আগুনের ফুলকি দাবানলে রূপান্তরিত হয়ে তেজোদ্দীপ্ত সারগর্ভ সৃষ্টিকে অবশ্যই কোনো একদিন দাবানলের অগ্নিশিখার মতো চারদিকে আলোর রশ্মি বিচ্ছুরিত করে ঊর্ধ্বায়িত করতে থাকবে। চায়ের দোকানে যখন তাঁর গুণগ্রাহীরা কবিতা অথবা গান শুনবার বিনিময়ে চা ও পান খাওয়াতে চাইতো- তাৎক্ষণিকতায় মোহনীয় গান ও কবিতা লিখবার মাধ্যমে তাদের আবদার মেটাতেন। অপরিসীম তৃপ্তি বোধের অনুভবকে জয় করে নজরুলের কাছ থেকে তারা ভবিষ্যতের মুগ্ধতা ও বিস্ময় প্রত্যক্ষ করবার অপেক্ষায় উন্মুখ হয়ে থাকতেন। কিন্তু, তাৎক্ষণিকতায় সৃজিত সৃষ্টিগুলি নজরুলের মনঃপূত না হলে সেগুলোর প্রতি কোনো ধরনের মায়ার জাল বিস্তার করে সেই সৃষ্টিগুলোকে আগলে রাখবার চেষ্টা করতেন না, কখনো স্মরণ করবার চেষ্টায় নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন না চির বিদ্রোহী নজরুল। বিশাল জলরাশির প্রাচুর্য থেকে এক ফোঁটা জল হারিয়ে গেলে যেমন সমুদ্রের কিছুই এসে যায় না, ঠিক তেমনি নজরুলের বিশাল প্রতিভার ক্ষেত্রেও এই কথাটি সমভাবে প্রযোজ্য। এই যে নিজের প্রতি তাঁর প্রবল আত্মবিশ্বাস, এই আত্মবিশ্বাসের ভীত সৃষ্টির মূল কারণটিই হলো কষ্টার্জিত জ্ঞান ও বহুমুখী জীবনে বিচরণের অভিজ্ঞতা। এই আত্মবিশ্বাসের পালকের ওপর ভর করেই নজরুল নিজেকে মগ্ন রাখতেন নতুন কোনো সৃষ্টির নেশায়। আশ্চর্য হয়ে ভাবতে হয়-মাত্র ২৩ বছরের  সাহিত্য জীবনে (১৯১৯-১৯৪২) কী বিশাল অমূল্য সৃষ্টি উপহার দিয়ে গেছেন তিনি বাংলার জ্ঞানরাজ্যে। উদ্ধৃত প্রেক্ষিতটিকে কিঞ্চিৎ পরিমাণে হলেও যদি কোনো শিক্ষার্থী তার ব্যক্তি জীবনে উদ্ভূত সমস্যাকে জয় করে জ্ঞানের যে কোনো একটি শাখায় ব্যুৎপত্তি অর্জনে তার মনোযোগের মাত্রাটিকে অসীম উচ্চতায় উন্নীত করতে সক্ষম হয় তবে অবশ্যই তার যে কাঙ্ক্ষিত প্রাপ্তি সেই প্রাপ্তির সীমানাটি স্পর্শ করা অবশ্যই সম্ভব হয়ে উঠবে।

শিক্ষার্থীদের সেই নিশ্চিত প্রাপ্তিটুকু অথবা প্রকৃত শিক্ষা অর্জনের মর্মোদ্ঘাটন নিশ্চিত করবার নিমিত্তে একটি উদ্দীপক প্রদানের মাধ্যমে ব্যাখ্যা প্রদানের চেষ্টা করা যেতে পারে। ধরে নেয়া যাক, দুঃখের সায়রে অবগাহনরত একজন শ্রমিক তার কষ্টের বুনন দ্বারা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন কিছুটা সুখের সন্ধান প্রাপ্তির। সুখ নামীয় সেই অধরা অনুভূতিটির পেছনে ছুটতে ছুটতে প্রতিনিয়ত তাকে যোগ বিয়োগের হিসেবটি নানাভাবে পরিবর্তন করতে হচ্ছে। অবশ্য এই সুখ যে ব্যক্তিকেন্দ্রিক, তা নয়, পরিবারের সদস্যদের ইতিবাচকতার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। পরিবারের সদস্যদের মাঝে হাসির ফল্গুধারা প্রবাহিত হলেই তিনি কষ্টের ভেতরেও আনন্দের অনুভূতির স্বাদ পাবেন। সেই ধরনের একজন শ্রমিকের বাড়ি তার কর্মস্থল থেকে প্রান্তিক পর্যায়ের একটি সংকটাপন্ন জনপদে। সম্প্রতি স্বল্প সময়ের ছুটি শেষে তিনি তার কর্মস্থল গাজীপুরে যাত্রা করবেন। এখন, তিনি কীভাবে যাত্রা করবেন তা নিয়ে ওই যোগ-বিয়োগের হিসেবটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সম্পন্ন করবার নিমিত্তে ব্যস্ত রয়েছেন। তিনি যদি চেয়ার কোচ বাসের সিটে যাত্রা করেন তাহলে ভাড়ার পরিমাণটি বেশি হবে, আবার যদি সেমি-চেয়ার কোচে যাত্রা করেন, তাহলে ভাড়ার পরিমাণটি তুলনামূলক কম হবে। আবার কনকনে শীত কিংবা তপ্ত রোদের মধ্যে ছাদে বসে কিংবা বাসের ভেতরে দাঁড়িয়ে যাত্রা করবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তবে ভাড়ার পরিমাণটি আরো কমে আসবে। অপরের ওপর নির্ভরশীল সুখ নামের সেই অনুভূতিটি নিজের মননে মন্থন করবার লক্ষ্যে অবশেষে সেই শ্রমিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন কনকনে শীতকে উপেক্ষা করে বাসের ছাদে বসেই যাত্রা করবেন। তার এই যাত্রায় তিনি শুধু একা নন, সাথে রয়েছেন তার মতো আরো অনেকেই। সুতরাং, সব নেতিবাচক চিন্তাকে দূরে ঠেলে যে ইতিবাচক চিন্তাটি তার অনুভূতির কন্দরে গভীরভাবে রেখাপাত করলো সেটি হলো- বাসের ছাদে ভ্রমণ করবার মাধ্যমে সামান্য কিছু আর্থিক প্রাপ্তি। যে আর্থিক প্রাপ্তি তার কর্মস্থলে গিয়ে কিছুদিনের জন্যে হলেও তিন বেলা খাবারের সংস্থান জোগাবে। অন্য কোথাও থেকে অর্থ ব্যয়ের প্রয়োজন পড়বে না। আর মাস শেষে যে উদ্বৃত্ত অর্থ থাকবে তা পরিবারে প্রেরণের মাধ্যমে ওই আনন্দের অনুভূতিটিকে কাছে টানবে-যাকে তাৎক্ষণিকভাবে আপেক্ষিক হলেও অনেকই সুখ হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন।

উপর্যুক্ত উদ্ধৃতিটিতে বর্ণিত একজন শ্রমিকের বাস্তব জীবনে যাপিত জীবনপ্রবাহ কিংবা শ্রমকে ব্যবচ্ছেদ করলে বহুমাত্রিক দিকের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। প্রথমত-জীবন, সুখ কিংবা শ্রমের ইংরেজি প্রতিশব্দ কি? দ্বিতীয়ত জীবন, সুখ কিংবা শ্রম বলতে কী বোঝায়? তৃতীয়ত-উদ্ধৃত শ্রমিক তার শ্রমের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় উৎপাদনে কতটুকু অবদান রাখছেন? চূড়ান্ত অর্থে, শ্রমিকের প্রদেয় শ্রমের বিপরীতে রাষ্ট্র তার প্রত্যাশার প্রদীপটিকে কীভাবে আদর্শিক মাত্রায় প্রজ্বলিত করতে পারে?

এখন প্রথম প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করবার উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীর স্মৃতিশক্তির প্রখরতা যাচাই করা অর্থাৎ শিক্ষার্থীর নির্দিষ্ট অধ্যায়ের প্রতিটি বিষয় ঠিকমতো পড়েছে কিনা। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে একজন শিক্ষার্থীকে অবশ্যই অনুধাবন প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে জীবন, সুখ কিংবা শ্রমের প্রকৃত সংজ্ঞা অন্বেষণে নিমগ্ন থাকতে হবে এবং যে অনুভবটি হবে একান্তই তার নিজের। এক্ষেত্রে পাঠ্যবইয়ে অধীত বিষয়সমূহ তার উত্তরের যথার্থতা নিশ্চিত করবার ক্ষেত্রে কাজে লাগতে পারে। তৃতীয়ত, বর্ণিত শ্রমিক তার কর্মের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেই তা সুস্পষ্ট। তার মতো লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমেই রাষ্ট্র জাতীয় প্রবৃদ্ধির মাত্রাকে বৃদ্ধি করতে পারে সেটিই স্পষ্ট হয়ে উঠবে। অর্থাৎ শ্রমিকের উৎপাদন প্রচেষ্টা এখানে সরাসরি প্রায়োগিক। সর্বশেষ, এই যে শ্রমিকের উৎপাদন প্রচেষ্টা এবং এই প্রচেষ্টার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সমৃদ্ধি, এটি নিশ্চিত হবার পরে তার জীবনমানের অবস্থান কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে অথবা সেটির উন্নয়নে কোন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত তা একজন শিক্ষার্থী তার স্ব-স্ব মনন দ্বারা মূল্যায়ন করবে। এই সব শ্রমিকদের উন্নয়নে রাষ্ট্রযন্ত্র অথবা রাষ্ট্রের উদ্যোক্তাগণ কী ধরনের ভূমিকা পালন করতে পারবেন সে বিষয়ে তাদের সুচিন্তিত পরামর্শ প্রদান করবেন। যেটি তাদের চিন্তন দক্ষতার উৎকর্ষকে প্রমাণ করবে। শিক্ষার্থীরা স্ব স্ব বিষয়ে যদি তাদের উদ্ভাবিত ইতিবাচক ভাবনার আধারকে একটি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উত্থিত করে সেই ভাবনার গভীরে প্রবেশ করে তাদের নিজের মতো করে প্রস্তুতকৃত একটি গ্রহণযোগ্য ভাবনা তৈরি করতে পারে, তাহলে ভবিষ্যতেও শিক্ষার্থীরা যুগোপযোগী ভাবনা নির্মাণের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে নিজের অবদানটুকু নিশ্চিত করবার ক্ষেত্রে নিজেদের প্রস্তুত করতে সক্ষম হবে।

 

এখন যে বিষয়টি এখানে বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে সেটি হলো- এই যে শিক্ষার্থীদের চিন্তন দক্ষতা অথবা চিন্তন দক্ষতার পাশাপাশি অন্যান্য দক্ষতা এবং সেই দক্ষতার মাত্রাটিকে আদর্শিক মাত্রায় উন্নীত করতে পারাই সৃজনশীল পদ্ধতিতে পাঠদানের প্রধান লক্ষ্য। বস্তুত, শিক্ষাবিজ্ঞানী বেনজামিন স্যামুয়েল ব্লুমের সৃজনশীল পদ্ধতি উদ্ভাবনের মুখ্য উদ্দেশ্যই হচ্ছে- শিক্ষা গ্রহণের বিষয়টি হবে আনন্দপূর্ণ এবং সে আনন্দপূর্ণ পরিবেশে শিক্ষার্থীরা নিয়ত অনুশীলনের মাধ্যমে নানামুখী সমস্যার সমাধান করবে এবং তাদের ভেতরের সুকোমল বোধকে কাজে লাগিয়ে বাস্তব জীবনে সফল হবে।  প্রকৃত পাঠাভ্যাস গড়ে তুলবার মাধ্যমে যদি শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক পর্যায় থেকে নানা মাত্রিক উদ্দীপক অনুশীলনের মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে আহূত সমস্যার সমাধানে যুক্তিপূর্ণ সুচিন্তিত মতামতটিকে সৃষ্টি করা যায় তবে ভবিষ্যতে যে কোনো বিষয়ে নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সচলমানতার সাথে তা সম্পন্ন করা সম্ভব হতে পারে। উদ্ধৃতি থেকে এ বিষয়টি অবশ্যই স্পষ্ট হয়েছে যে-অগণন শ্রমিকের সমন্বিত পরিশ্রমের মাধ্যমেই জাতীয় প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পেয়েছে। একই ভাবে যদি লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী সমন্বিতভাবে পাঠের মাধ্যমে নিজেদের সুকুমার বৃত্তির স্ফুরণ ঘটাতে পারে তবে জাতীয় চিন্তন দক্ষতাটিও বৃদ্ধি পাবে। এবং অবশ্যম্ভাবীভাবে তা রাষ্ট্রিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সরাসরি একটি প্রভাব সম্পাতি ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে।

 

কিন্তু, যে সমস্যাটি সৃজনশীলতার গুণটিকে শিক্ষার্থীদের মননে প্রবিষ্ট করবার ক্ষেত্রে সবসময়ের জন্যই প্রতিবন্ধকতার কারণ হিসেবে প্রতিভাত হয় তা মূলত পাঠের নিরন্তর চর্চার প্রবাহে স্থবিরতা। আর এই নানামুখী প্রতিবন্ধকতা এড়াতে যে বিষয়ের দিকে মনোযোগী হওয়া অবশ্যম্ভাবী তা হলো- বৃক্ষের শেকড়ের পরিচর্যা করা। স্পষ্ট করে বললে- শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের শুরুতেই যে কোনো মূল্যে মুখস্থ বিদ্যার নেতিবাচক দিকটিকে উপস্থাপন করা এবং পাঠের আনন্দময় দিকটিকে উন্মোচিত করা। পাঠের প্রাথমিক অবস্থায় একজন শিক্ষার্থী যদি শেখ সাদী, লিও তলস্তয় অথবা ঈশপ কিংবা সমমানের প্রথিতযশা গাল্পিকের গল্পের সাথে পরিচিতি লাভ করতে পারে তবে সেটি তাদের নীতিগত দিকটিকে দীপান্বিত করে তুলবে। যেহেতু উদ্ধৃত লেখকবৃন্দের উপযুক্ত বিষয়ে রচিত গল্পের অবয়ব অনেক সংক্ষিপ্ত এবং অল্প বয়সী শিক্ষার্থীদের জন্য উপযোগী সেহেতু পাঠ গ্রহণ এবং চিন্তা করবার ক্ষেত্রে তাদের ভেতরে তৈরি হবে মসৃণ সরলতা। পাশাপাশি জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিচরণের মাধ্যমে যখন তাদের মৌলিক ভিত্তিটি মজবুত হবে তখন তাদের ভেতরে অধ্যয়নের আগ্রহটি আপনাআপনি বৃদ্ধি পাবে। পাঠের অভ্যাসটিকে যখন নিরেট আনন্দ হিসেবে এই সব অল্প বয়সী শিক্ষার্থীরা গ্রহণ করতে সক্ষম হবে তখন আপনা আপনি তারা তুলনামূলক দীর্ঘ গ্রন্থ পাঠে আগ্রহ বোধ করবে। সেই মুহূর্তটিতে যদি ডেনিয়েল ডিফো, জুলভার্ন, চার্লস ডিকেন্স অথবা আর্নেস্ট হেমিংওয়ে কিংবা এই মানের লেখক কর্তৃক রচিত অভিযানভিত্তিক রচনাগুলোর সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দেয়া যায় তবে অবশ্যই তারা পাঠের মাধ্যমে আসমুদ্রহিমাচল মন্থনের মতো বিশাল কর্মযজ্ঞটি সম্পন্ন করতে সক্ষম হবে। পাশাপাশি ভবিষ্যতে সেই কল্পিত বিশ্বকে জয় করবার ক্ষেত্রে তাদের ভেতরে তৈরি হবে ভিন্ন এক উদ্দীপনা, উন্মাদনা এবং প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হবার সক্ষমতা। এই উদ্দীপনাই পরবর্তীকালে শিক্ষার্থীদের ধাবিত করবে পাঠের গভীর থেকে গভীরতম প্রদেশে। শিক্ষার্থীরা তখন তাদের অবচেতনাতেই উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে যে- কেবল পাঠের সাথে মননকে সম্পৃক্ত করবার মাধ্যমে সৃষ্টির আনন্দকে অনুভব করা সম্ভব। এবং শিক্ষা জীবনে সাফল্য লাভের ক্ষেত্রে যে প্রতিবন্ধকতাগুলো তাদের সামনে দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর হয়ে দাঁড়াবে সেই প্রতিবন্ধকতাগুলো তাদের আকাশচুম্বী উদ্দীপনার কাছে কোনো বাধারই সৃষ্টি করতে পারবে না। যেহেতু পাঠের মাধ্যমেই শিক্ষার্থীরা তাদের ভাবনাগুলোকে নিজেদের মতো করে প্রকাশ করতে সক্ষম হবে যা তাদের পাঠ প্রক্রিয়ায় নিশ্চিতভাবে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। 

পত্রিকায় প্রতিবেদিত উদ্ভাবনীমূলক এবং স্ব-দেশীয় শিক্ষার্থীর সৃজন প্রতিভার সুবৃত্তান্ত শিক্ষার্থীর মনন বিস্ময়াবিষ্ট ভাবের দ্বারা আবৃত করবার পাশাপাশি সৃষ্টিশীল হবার ক্ষেত্রে তাকে তাড়িত করবে। এক্ষেত্রে শৈক্ষিক মানদণ্ডের কোনো একটি ক্ষেত্রে যদি কোনো ধরনের সমস্যা গোচরীভূত হয় তবে সেই মুহূর্ত থেকে সেই সমস্যার সমাধানে সে আপনা আপনি সক্রিয় হয়ে উঠবে। তার ভেতরে অনুসন্ধিৎসু মনোভাবটি প্রবলভাবে অগ্নিশিখার মতো জ্বলে উঠবে। সবচাইতে যে বিষয়টি সদর্থক হিসেবে স্বীকৃত হবে সেটি হলো, পাঠের সাথে হৃদ্যতা গড়ে উঠবে এবং আজন্ম লক্ষিত পাঠ ভীতি দূরীভূত হবে। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে রাজকুমার লোহানী পরিচালিত এবং আমির খান অভিনীত ‘থ্রি ইডিয়টস’ চলচ্চিত্রটি প্রকৃত শিক্ষা নিশ্চিতির ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলোর প্রতি গভীর দৃষ্টি আরোপ করেছে সেগুলো মূলত-মুখস্থবিদ্যেকে যে কোনো মূল্যে নিরুৎসাহিতকরণ, বাস্তব প্রেক্ষিতে বিষয়বস্তকে সহজভাবে বিশ্লেষণের মাধ্যমে অনুধাবন, শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত পছন্দকে অগ্রাধিকার প্রদান এবং চূড়ান্ত অর্থে মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবার ক্ষেত্রে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর নিরন্তর প্রচেষ্টাটির অব্যাহতকরণ। একইভাবে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে মার্ক এ্যাটকিনস পরিচালিত এবং আনা রাসমুসসেন রচিত ’জুরাসিক স্কুল’ চলচ্চিত্রটিরও কথা ব্যক্ত করা যায়। চলচ্চিত্রটিতে পরিচালক শিশু শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনুসন্ধিৎসু মনোভাবটি জাগ্রত রাখবার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবার অসীম প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন যা বিশ্বের প্রত্যেক কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষণীয়। এগুলি ছাড়াও আমাদের দেশেই সাহিত্য ভিত্তিক গ্রন্থ অবলম্বনে নির্মিত ‘পুরস্কার’, ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’ কিংবা ‘দীপু নাম্বার টু’ চলচ্চিত্রের প্রকৃত বার্তাই হলো-শিক্ষার্থীদের বুদ্ধিভিত্তিক, মানবিক এবং অনুসন্ধিৎসু চিন্তার দিগন্তকে উন্মেচিত করা। 

একজন শিক্ষার্থী যখন প্রকৃত অর্থেই শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে উপর্যুক্ত বিশিষ্টতাগুলি নিজের মধ্যে ধারণ করতে সক্ষম হতে পারবে তখন একাধারে সে যেমন সাবলম্বী হতে পারবে, পাশাপাশি নিজের যাপিত জীবনটিকে কোনো ধরনের দ্বিধা ব্যতীত সাবলীলভাবে যাপন করতে সক্ষম হবে। এবং অবশ্যম্ভাবীরূপে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত শিক্ষা প্রত্যয়টিকে একটি আনন্দদায়ক বিষয় হিসেবে নিজের মননের সাথে গেঁথে নেবে। তবে শিক্ষার্থীদের পাঠের প্রক্রিয়াটির সাথে অভ্যস্তকরণের ক্ষেত্রে গৃহের পরিবেশটিকে পাঠ বান্ধব করে তুলবার কোনো বিকল্প নেই। যেহেতু পরিবারই সর্বপ্রথম শিক্ষক হিসেবে কোনো শিশুকে জ্ঞানদানের কাজটি শুরু করবে। আর্জেন্টাইন সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ ও ন্যাশনাল পাবলিক লাইব্রেরির তৎকালীন পরিচালক জর্জ লুইস বোর্জেস তাঁর সমগ্র সৃষ্টির পেছনে যে প্রতিষ্ঠানটির গুরুত্ব অকপটে স্বীকার করেছিলেন সেটি হলো, তাঁর বাবার হাতে গড়া গ্রন্থাগারটি। যে গ্রন্থাগারটিই ছিল তাঁর কাছে তাঁর বাড়িতে সময় কাটানোর সর্বোৎকৃষ্ট স্থান। তিনি বলেছিলেন- “আমার প্রধান সৌভাগ্য এই যে, আমি শিক্ষিত হয়েছি আমার পিতার গ্রন্থাগারে। আমার শৈশবের স্মৃতিতে যত না উজ্জ্বল হয়ে ভেসে ওঠে সেদিনকার পরিবেশ তার অধিক ভেসে ওঠে আমার পিতার গ্রন্থাগারটি। আমার মনে জেগে ওঠে তাঁর গ্রন্থাগারের সেই সব বইয়ের কথা যারা আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল গোটা পৃথিবীর সঙ্গে।” ইতিহাস পর্যালোচনা করলে পৃথিবীতে অজস্র বিজ্ঞানী, দার্শনিক কিংবা মহৎ ব্যক্তিত্বের সন্ধান পাওয়া যাবে যাদের প্রথম পাঠ শুরু হয়েছিল এমন ইতিবাচক আবহেই। সুতরাং, পাঠের প্রক্রিয়াটি যখন পরিবারে অন্যান্য মৌলিক চাহিদাগুলোর মতো স্বাভাবিকভাবে অনুসৃত হবে তখন একজন শিক্ষার্থী অনুসৃত ওই বিষয়টিকে খুব স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করবে। অভিভাবকবৃন্দ যদি পুস্তক সংগ্রহ এবং পঠনের গুরত্ব সত্যিকারভাবেই উপলব্ধি করতে সক্ষম হন তবে যে কল্পিত পৃথিবী সবার প্রত্যাশা সেই প্রত্যাশাটি পূরণ করা  কঠিন কোনো বিষয় হিসেব পরিগণিত হবে না।

আলোচনার উপান্তে দাঁড়িয়ে যে বিষয়টি গুরুত্ব বিবেচনায় অগ্রাধিকার পাবার যোগ্য সেটি হলো, শিক্ষক এবং অভিভাবকবৃন্দ যখন শিক্ষার্থীদের অনুভূতির জানালা দিয়ে এই বোধটিকে প্রবেশ করাতে সক্ষম হবেন যে- মুখস্থ বিদ্যা নয় বরং যে কোনো বিষয় আত্মস্থ করবার ক্ষেত্রে পাঠের গভীর অভ্যন্তরে প্রবেশের কোনো বিকল্প নেই এবং এই বোধটিকে ধারণ করবার পাশাপাশি শিক্ষার্র্থী যখন প্রত্যক্ষ করবে তার শিক্ষক, বাবা-মা অথবা অভিভাবক থেকে শুরু করে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা পাঠের মাধ্যমে জীবন প্রবাহে আহূত সমস্যাগুলো সমাধানে সর্বাধিক নির্ভরশীল হচ্ছেন তখন সেই সব অতি কোমলমতি শিক্ষার্থী আপনা আপনি পাঠে মনোনিবেশ করবে তারই প্রয়োজনে। তার এই অর্জিত পাঠের প্রকৃত অভ্যাসটি যখন নৈমিত্তিক হবে প্রতিষ্ঠিত জীবনে তখন সময়ের পরিক্রমায় প্রত্যক্ষভাবে অর্জিত হবে শিক্ষা গ্রহণের প্রকৃত উদ্দেশ্যটি এবং যে উদ্দেশ্যটি অর্জনই যেকোনো ব্যক্তি অথবা ব্যাপক পরিধিতে রাষ্ট্র এবং জাতির প্রধান লক্ষ্য। এবং তখনই বুদ্ধির জড়তা, চিন্তার বৈকল্য, মননের জাড্য ও স্বপ্নের দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেয়ে খোলা হাওয়ার নিচে দাঁড়িয়ে শিক্ষার্থীরা একটি উন্নত ভবিষ্যৎ উপহার দিতে সক্ষম হবে ( আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ, ২০১০)।                     

তথ্যসূত্র: 

১. আলবার্ট আইনস্টাইন, শিক্ষা প্রসঙ্গে, অনুবাদক আবুল কাসেম ফজলুল হক, নভেম্বর, ২০১২, নবযুগের প্রত্যাশা, জাগৃতি প্রকাশনী।। ঢাকা। পৃষ্ঠা নং ৮৪-৯১।

2. Ralph Waldo Emerson, Fifth edition 1996, Rama Brothers, New Delhi, Page no-01.

৩. গ্যারেথ লুইস, এক সপ্তাহে সফল সৃজনশীলতা, অনুবাদ মো. মামুনুর রহমান, একুশে বইমেলা, ঢাকা-২০০৪, ফ্রেন্ডস বুক কর্ণার।। নীলক্ষেত। ঢাকা। পৃষ্ঠা নং-১৪, ২১।

৪. শ্রেষ্ঠ নজরুল-সংকলিত ও সম্পাদিত -আবদুল মান্নান সৈয়দ, এপ্রিল, ২০০৬, অবসর প্রকাশনা সংস্থা, ঢাকা পৃষ্ঠা নং ৬১৭, ৬২১।

৫. র‌ল্ফড সি স্টাইগার- পাঠ প্রসঙ্গে, অনুবাদ কবীর চৌধুরী, ডিসেম্বর ২০০৫, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা । পৃষ্ঠা নং ৬৫।

6. Bill Gates From Wikipedia The Free Encyclopedia.

৭. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শিক্ষা, জুন ২০১১, বিভাস, ঢাকা, পৃষ্ঠা নং-৩৭,৩৮।

8. Three Idiots, release 2009, Director, Rajkumar Lohani.

9. Jurassic School, release January 31, 2017, Director, Mark Alkins.

10. David R. Krathwohl,  A Revision of Blooms Taxonomy, autumn, 2002, Volume 41, Number 4, College of Education, The Ohio State University.

১১. আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ, যুগান্তরের প্রতীক্ষায়, সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি, আশি^ন ১৪২১, অক্টোবর, ২০১৪, প্রথমা, ঢাকা, পৃষ্ঠা নং-১৬-২০।

 

 

 

 


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান