কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম, মৃত্যু এবং উত্তরসূরি
কবিগুরুর জন্ম এবং মৃত্যু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম হয়েছিল মঙ্গলবার, ৭ মে ১৮৬১ ইংরেজি, সোমবার ২৫শে বৈশাখ ১২৬৮ বঙ্গাব্দ ভোর রাত ২টা ৩০মিঃ থেকে ৩টার মধ্যে কলকাতার জোড়াসাঁকোস্থ ৬, দ্বারকানাথ ঠাকুর লাইনের তাঁর পৈত্রিক বাড়িতে। অন্যদিকে বৃহস্পতিবার ৭ আগস্ট ১৯৪১ ইংরেজি, ২২শে শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দে দুপুর ১২টার কিছু পরে কলকাতার জোড়াসাঁকোতেই তিনি ৮০ বছর ৩ মাস বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর মাত্র দুই সপ্তাহ আগে ২৫ জুলাই ১৯৪১ ইংরেজিতে তাঁকে শান্তিনিকেতন থেকে চিকিৎসার সুবিধার্থে কলকাতাতে নিয়ে আসা হয় এবং এখানেই ৩০শে জুলাই তিনি তাঁর শেষ কবিতাটি বর্ণনা করেন।
কবিগুরুর বিবাহ ও সহধর্মিণী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২২ বছর ৭ মাস বয়সে ৯ ডিসেম্বর ১৮৮৩ ইংরেজিতে জোড়াসাঁকোস্থ তাঁর পৈতৃক বাড়িতে ১০ বছরের ভবতারিণী দেবীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। লক্ষণীয় বিষয় হল বিয়ে কিন্তু কণের বাড়িতে হয়নি, হয়েছে বরের বাড়িতে এবং তাঁর বিয়েতে তাঁর পিতা, তাঁর মেঝ ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বড় বোন সৌদামিনী দেবী উপস্থিত ছিলেন না। তাঁর বিয়ের দিনেই তাঁর বড় বোন সৌদামিনী দেবীর বর সারদা প্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যু ঘটে।
ভবতারিণী দেবী ১৮৭৩ সালে অধুনা বাংলাদেশের যশোর জেলার ফুলতলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ঠাকুর এস্টেট এর এক জন সামান্য বেতনের কর্মচারী বেনীমাধব রায়চৌধুরীর কন্যা ভবতারিণী দেবীর নামটি ঠাকুর পরিবারের কাছে বেশ পুরনো ধাঁচের মনে হয়েছিল তাই বিয়ের পর পরই তাঁর নামটি পালটে রাখা হোল ‘মৃণালিনী দেবী’ আর এই নূতন বউয়ের এহেন নামকরণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের বড়দা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪০-১৯২৬)।
১৯০২ সালে শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন মৃণালিনী দেবী অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয় চিকিৎসার জন্যে কিন্তু ডাক্তার কিছুতেই তাঁর অসুস্থতা ধরতে পারছিলেন না যদিও তাঁর ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ধারনা তাঁর মায়ের এপেন্ডিসাইটিস হয়েছিল। এমতাবস্থায় তিন মাস রোগ ভোগের পর ১৯০২ সালের ২৩শে নভেম্বর মাত্র ২৯ বছর বয়সে মৃণালিনী দেবী মৃত্যুবরণ করে রবীন্দ্রনাথকে ৪১ বছর ৬ মাস বয়সেই বিপত্নীক করে দিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পর আর দ্বিতীয় বার পাণিগ্রহণ করেন নি।
কবিগুরুর উত্তরসূরি
মৃণালিনী দেবী ও রবীন্দ্রনাথ তিন মেয়ে ও দুই ছেলে সহ মোট পাঁচ সন্তানের জনক ও জননী ছিলেন। তাঁদের সন্তানেরা ক্রমানুসারে:
বড় মেয়ে মাধুরীলতা দেবী (বেলা), বড় ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর (রথী), মেঝ মেয়ে রেণুকা দেবী (রানী), ছোট মেয়ে মিরা দেবী (অতসী) ও ছোট ছেলে সমীন্দ্রনাথ ঠাকুর (সমী)।
মাধুরীলতা দেবী (বেলা):
১৮৮৬ সালের ২৫শে অক্টোবর রবীন্দ্রনাথের প্রথম সন্তান মাধুরীলতার জন্ম হয়। কবিগুরু তাঁকে ‘বেলা’ বলেই ডাকতেন আদর করে কখনওবা ‘বেলী’ ও বলতেন। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন লেখায় বিশেষত পত্র সাহিত্যে ‘বেলী’ নামের উল্লেখ দেখা যায়।
মাধুরীলতা মাত্র পনের বছর বয়সে কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর তৃতীয় পুত্র শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীর সাথে ১৯০১ সালের জুলাই মাসের কোন একদিন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী পেশায় একজন আইনজ্ঞ ছিলেন।
মাধুরীলতা দেবী নিঃসন্তান ছিলেন এবং ৩১ বছর ৬ মাস বয়সে ১৬ মে ১৯১৮ সালে যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর শ্বশুরালয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর (রথী):
রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় সন্তান এবং জ্যেষ্ঠ পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮৮ সালের ২৭ নভেম্বর। ২১ বছর ২ মাস বয়সে ১৯১০ সালের ২৭ জানুয়ারি প্রতিমা দেবীকে বিয়ে করেন। বিবাহকালে প্রতিমা দেবীর বয়স ছিল সতের বছর। প্রতিমা দেবী ১৮৯৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন।
প্রতিমা দেবী কিন্তু নীলনাথ মুখোপাধ্যায়ের বিধবা ছিলেন। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে প্রতিমা দেবীর এই বিয়ে বিধবা প্রথার বিরুদ্ধে ঠাকুর পরিবারে প্রথম বিধবা বিবাহ। যদিও রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর (রথী) ও প্রতিমা দেবী আলাদা হয়ে যান। তাঁরা নিঃসন্তান ছিলেন কিন্তু একটি কন্যা সন্তান দত্তক নিয়েছিলেন তাঁকে নন্দিনী বলেই ডাকতেন।
রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৪ মে ১৯৫১ থেকে ২২ আগস্ট ১৯৫৩ পর্যন্ত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। ১৩ জুন ১৯৬১ সালে ৭২ বছর ৬ মাস বয়সে দেরাদুনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। অন্যদিকে প্রায় ৭৬ বছর বয়সে ১৯৬৯ সালে প্রতিমা দেবী মৃত্যুবরণ করেন।
রেনুকা দেবী (রানী):
রেনুকা দেবী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৃতীয় সন্তান এবং দ্বিতীয় কন্যা। জন্মগ্রহণ করেন ২৩ জানুয়ারি ১৮৯১ সালে। তাঁর ডাক নাম ছিল ‘রানী’।
মাধুরীলতা দেবীর বিয়ের এক মাসের মাথায় ১৯০১ সালের আগস্ট মাসে মাত্র ১০ বছর ৬ মাস বয়সে সত্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যর সাথে রেনুকা দেবীর বিয়ে হয়। নিঃসন্তান রেনুকা দেবী ১৯০৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ২ বছরের বিবাহিত জীবনের শেষে মাত্র বার বছর সাত মাস বয়সে যক্ষ্মা রোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
মীরা দেবী (অতসী):
মীরা দেবী রবীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠা কন্যা। ১৮৯৪ সালের ১২ জানুয়ারী জন্মগ্রহণ করেন। তাঁকে অতসী নামেও ডাকা হত। ১৩ বছর ৪ মাস বয়সে ৬ জুন ১৯০৭ সালে নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁদের নিতীন্দ্রনাথ (নিতু) নামে একটি পুত্র সন্তান ও নন্দিতা (বুড়ি) নামে একটি কন্যা সন্তান ছিল।
মীরা দেবী পঁচাত্তর বছর বয়সে ১৯৬৯ সালে শান্তিনিকেতনে মৃত্যুবরণ করেন এর আগে ১৯২০ সালে নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের মাধ্যমে তাঁর দাম্পত্য জীবনের সমাপ্তি ঘটে।
সমীন্দ্রনাথ ঠাকুর (সমী):
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠ পুত্র সমীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন ১২ ডিসেম্বর ১৮৯৬। সমী তাঁর ডাকনাম। মীরা দেবীর বিয়ের ছয় মাস পর মাত্র দশ বছর এগার মাস বয়সে বিহারের মুঙ্গার-এ এক বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে কলেরাই আক্রান্ত হয়ে সমীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পাঁচ বছর আগে তাঁর মা মৃণালিনী দেবী যে দিনে মৃত্যুবরণ করেন সেই একই দিনে পাঁচ বছর পরে ২৩ নভেম্বর, ১৯০৭ সালে তিনিও মৃত্যুবরণ করেন।
কবিগুরুর নাতি-নাত্নি
রবীন্দ্রনাথের নাতি-নাত্নি কেবল তিনজন। একজন দৌহিত্র নিতীন্দ্রনাথ (নিতু), একজন দৌহিত্রী ও একজন পৌত্রী যথাক্রমে নন্দিতা (বুড়ি) ও নন্দিনী।
১) নিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর গঙ্গোপাধ্যায় (নিতু), মীরা দেবীর একমাত্র সন্তান ও রবীন্দ্রনাথের একমাত্র দৌহিত্র। তাঁর ডাকনাম ছিল ‘নিতু’। তিনি ১৯১২ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং জার্মানিতে উচ্চশিক্ষা নেয়ার সময় যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মাত্র ২০ বছর বয়সে ৭ আগস্ট ১৯৩২ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি অকৃতদার ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর সময় রবীন্দ্রনাথের বয়স একাত্তর বছর।
২) নন্দিতা ক্রিপালানি (বুড়ি), মীরা দেবীর একমাত্র কন্যা ১৯১৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখক কৃষ্ণ ক্রিপালানির সাথে তাঁর বিয়ে হয়। এই দম্পতি নিঃসন্তান ছিলেন। একান্ন বছর বয়সে ১৯৬৭ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
৩) নন্দিনী ঠাকুর, রথীন্দ্রনাথ ও প্রতিমা দেবীর একমাত্র ও দত্তক কন্যা সন্তান। ১৯২২ সালে জন্মেছিলেন এবং ৩০ জানুয়ারি ১৯৩৯ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাতান্ন বছর বয়সেই তিন তিনটি সন্তানের মৃত্যুশোক পান। তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর দৌহিত্রেরও মৃত্যু ঘটে। জানামতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সরাসরি কোন উত্তরসূরি বেঁচে নেই।
তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট।