গল্পকার: ইমতিয়াজ সুলতান ইমরান
বর্ষার ভারি বৃষ্টিতে জলে টইটুম্বুর বাড়ির ধারের খরস্রোতা নদীটি।বিপদসীমা লঙ্ঘন করেছে নদীর জল।সবাই আতংকে, কখন কোন্ পার ভাঙে।রাত জেগে চলছে জানমাল রক্ষার আগাম প্রস্তুতি।
-
আমাদের গ্রামকে দু'ভাগ করে চলে গেছে রেললাইন।রেললাইনর পূর্বপাশে নদী।নদী ভাঙলে গ্রামের পুর্বপাশটাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে বেশি।তাই গ্রামের পূব্ পারের বাসীন্দারা জানমাল রক্ষার আশ্রয় হিসেবে উঁচু রেললাইনর দু'পারকেই বেছে নিয়েছেন।
-
গভীর রাত।সবাই খুব ভয় পাচ্ছে।কিন্তু আমি ভয় পাইনি। ভয়ের কী আছে? যে ভরা গাঙে ঝাপ দেই রোজ।স্রোতে গা ভাসাই আনন্দে।যে গাঙের জলের সাথে আমার এতো মিতালি।সেই জলকে ভয় পাবার কী আছে?
-
ভয় না পেলেও ভাবনার অন্ত ছিলোনা আমার।আমার ভাবনা শুধু বন্যাকে নিয়ে।বন্যাদের বাড়ি নদীর পার ঘেষা।দু'দিন ধরে ওদের বাড়ি বরাবর লিক করছে নদীর পানি।আজ ছিদ্রপথ আরো বড় হয়েছে।সবার ধারণা, স্রোতের ঠেলায় হঠাৎ ভেঙে যাবে।আর যদি ভাঙে, এক নিমিষেই ওদের বাড়িটা নদী হয়ে যাবে।
-
আমার মানসপটে শুধু বন্যাকেই দেখছি।বন্যার সাথে একদিন দেখা না হলে ঘুম হয়না আমার।ক'দিন আগেও ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কলেজ পার্কের নির্জন নিমতলায় সারাদিন কাটালাম দু'জন।কতো হাসি।কতো কথা।গান কবিতা।
- জানো বন্যা, তোমাকে না! আমি খুব ভয় পাই!
- কেনো?
- তোমার নাম যে বন্যা।বন্যা মানুষের জানমাল ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
- ভয় পেওনা সাগর।বন্যার শেষ ঠিকানা কীন্তু সাগরের বুকেই।
- তাই? সুন্দর বলেছো তো! আহ্! কী আনন্দ আকাশে বাতাসে! তাই যেনো হয় বন্যা! এই, এই বন্য! তোমার মাথাটা রাখো না আমার বুকে! প্লিজ একবার রাখো!
- ধর্য্য ধরো সাগর! আমিতো তোমার বুকেই শেষ আশ্রয় নেবো!
- একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনাও না! শুনাও প্লিজ! তুমি তো ভালো রবীন্দ্র সঙ্গীত গাও।
- পাগল হয়েছো? এই গাছতলায় বসে গান? কেউ শুনলে কী বলবে?
- আমার কানে-কানে গাও!
- ঠিক আছে গাইবো।আমাকে কবিতা আবৃত্তি শুনাতে হবে।
- ওকে লক্ষ্মীটি! শুনাবো! এবার গাও প্লিজ!
বন্যা আমার বাম বাহুতে মাথা রেখে কানে-কানে গাইলো,
"সখি ভাবনা কাহারে বলে,
সখি যাতনা কাহারে বলে,
তোমরা যে বলো, দিবস ও রজনী
ভালোবাসা ভালোবাসা
সখি ভালোবাসা কারে কয়,
সেকি কেবলই যাতনাময়----------।"
- এই, বিরহের গান শুনালে কেনো?
- ভালোবাসা মানেই বিরহ!
- এইতো মনটা খারাপ করে দিলে!
- এবার আবৃত্তি শুনাও মন ভালো হয়ে যাবে!
- কোন্ কবিতা শুনবে?
- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের "কেউ কথা রাখেনি।"
- হুম, আবার বিরহ? ওকে ম্যাডাম যাহা বলিবেন তাহাই করিবো।
"বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে বরুণা বলেছিলো,
যেদিন আমায় সত্যিকারের ভালোবাসবে
সেদিন আমার বুকেও এরকম আতরের গন্ধ হবে!
ভালোবাসার জন্য আমি হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়েছি
দুরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়
বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮টি নীলপদ্ম
তবু কথা রাখেনি বরুণা--------------!"
-
রাতের গভীরতা যতো বাড়ছে।ততোই বাড়ছে, বন্যাকে নিয়ে আমার ভাবনার গভীরতা।জানিনা বন্যাদের বাড়ি বরাবর নদীপারের ছিদ্রটি আরো কতোটা বড় হয়েছে?বন্যাদের পরিবার কোথাও আশ্রয় নিলো কী না? শুধু ভাবনা আর ভাবনা! কতো ভাবনা! কতো দুশ্চিন্তা! কতো মানুষের দুশ্চিন্তা!
-
হঠাৎ গ্রামের পূর্বাঞ্চল থেকে কিছু মানুষের হাঁকডাক ভেসে আসছে রাতের নিরব বাতাসে! সমুদ্রের গর্জনের মতো পানির কলকল শব্দ আসছে কানে।সবাই বুঝতে পারলো, নদীর পার ভেঙে গেছে।কীযে ভয়াল আর্তনাদ! জানিনা কতো প্রাণ কেঁড়ে নেবে এই ভাঙন? কতো ধন লুটে নেবে নিষ্টুর বানের জল! কতো নিরীহ মানুষ হবে নিঃস্ব! মুহুর্তের মধ্যেই নদীর উত্তাল জলস্রোত রেলপারে এসে ছলাৎছলাৎ বাড়ি খাচ্ছে।জলের ভয়ানক শব্দে আমার মনটা আরো ব্যাকুল হয়ে ওঠে।আমার দু'কানে যেনো শুনতে পাচ্ছি বন্যার গান,
"সখি ভাবনা কাহারে বলে,
সখি যাতনা কাহারে বলে-----!"
পাগলের মতো ছুটে চলি রেললাইন দিয়ে।হাঁটতে হাঁটতে রেলব্রীজে যাই।ব্রীজ থেকে নদীর পারমুখী হয়ে হাঁটছি।কিছুটা এগুতেই দেখি সামনে শতশত মানুষের ভীড়।ভীড় ঠেলে সামনে এসেই দেখি, বন্যাদের বাড়ি নেই! ওদের বাড়ির উপর দিয়ে প্রবাহিত আরেকটা খরস্রোতা নদী! উল্কা গতিতে ছুটে চলেছে আরো শত বাড়িঘর মাড়িয়ে!
-
ভাবনা আর বেদনায় কখন জানি কেটে গেলো রাত! ওপারের গ্রামের মসজিদ থেকে ভেসে আসছে ফজরের আজান! মুয়াজ্জিনের সুরেলা কণ্ঠে ধ্বণিত হলো, "আসসালাতু খাইরুম মিনান্নাউম!" আমি নির্বাক! হৃদয় ভাঙা কান্নায় অশ্রুসিক্ত! ঠায় দাঁড়িয়ে ভাবছি, বন্যারা কোথায় আশ্রয় নিলো? আশ্রয় নিয়েছে কী? নাকি ----? আমার বুকের ভেতরটা চিৎকার করছিলো, বন্যা! বন্যা!! বলে।ভাঙ্গা নদীর বিধ্বংসী স্রোতের ভাটি থেকে বন্যা যেনো আমাকে ডাকছিলো, সা-গ-র! সা-গ-র----!!