লেখক পরিচিতি
২০১২ সালের 'বঙ্গ শিরোমণি' সম্মানে ভূষিত সিদ্ধার্থ সিংহের জন্ম কলকাতায়। ১৯৬৪ সালে। ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ই তাঁর প্রথম কবিতা ছাপা হয় 'দেশ' পত্রিকায়। প্রথম ছড়া 'শুকতারা'য়। প্রথম গদ্য 'আনন্দবাজার'-এ। প্রথম গল্প 'সানন্দা'য়। যা নিয়ে রাজনৈতিক মহল তোলপাড় হয়। মামলা হয় পাঁচ কোটি টাকার। ছোটদের জন্য যেমন সন্দেশ, আনন্দমেলা, কিশোর ভারতী, চির সবুজ লেখা, ঝালাপালা, রঙবেরং, শিশুমহল ছাড়াও বর্তমান, গণশক্তি, রবিবাসরীয় আনন্দমেলা-সহ সমস্ত দৈনিক পত্রিকার ছোটদের পাতায় লেখেন, তেমনি বড়দের জন্য লেখেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ এবং মুক্তগদ্য। 'রতিছন্দ' নামে এক নতুন ছন্দের প্রবর্তন করেছেন তিনি। এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দুশো চুয়াল্লিশটি। তার বেশির ভাগই অনুদিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়। বেস্ট সেলারেও উঠেছে সে সব। এ ছাড়া যৌথ ভাবে সম্পাদনা করেছেন লীলা মজুমদার, রমাপদ চৌধুরী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, মহাশ্বেতা দেবী, শংকর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, নবনীতা দেবসেন, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়দের সঙ্গে। তাঁর লেখা নাটক বেতারে তো হয়ই, মঞ্চস্থও হয় নিয়মিত। তাঁর কাহিনি নিয়ে ছায়াছবিও হয়েছে বেশ কয়েকটি। গান তো লেখেনই। মিউজিক ডিরেক্টর হিসেবেও কাজ করেছেন বেশ কয়েকটি বাংলা ছবিতে। তাঁর ইংরেজি এবং বাংলা কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কয়েকটি সিনেমায়। বানিয়েছেন দুটি তথ্যচিত্র। তাঁর লেখা পাঠ্য হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদে। ইতিমধ্যে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ শিশু সাহিত্য সংসদ পুরস্কার, কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পুরস্কার, কাঞ্চন সাহিত্য পুরস্কার, সন্তোষকুমার ঘোষ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা লোক সাহিত্য পুরস্কার, প্রসাদ পুরস্কার, নতুন গতি পুরস্কার, ড্রিম লাইট অ্যাওয়ার্ড, কমলকুমার মজুমদার জন্মশতবর্ষ স্মারক সম্মান, কবি সামসুল হক পুরস্কার, সুচিত্রা ভট্টাচার্য স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, অণু সাহিত্য পুরস্কার, কাস্তেকবি দিনেশ দাস স্মৃতি পুরস্কার, শিলালিপি সাহিত্য পুরস্কার, চেখ সাহিত্য পুরস্কার, মায়া সেন স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ছাড়াও ছোট-বড় অজস্র পুরস্কার ও সম্মাননা। পেয়েছেন ১৪০৬ সালের 'শ্রেষ্ঠ কবি' এবং ১৪১৮ সালের 'শ্রেষ্ঠ গল্পকার'-এর শিরোপা।
বোড়়কি
না। বোড়কিকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। ছলছল চোখে শিবকুমার এ
কথা বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়ল তার বউ। আর তার কান্না শুনে বইপত্র ফেলে
পাশের ঘর থেকে ছুটে এসে মায়ের কাছ ঘেঁষে দাঁড়াল তাদের বাকি দুই ছেলেমেয়ে—
মেজকি আর ছোটকা।
কান্না জড়ানো গলাতেই শিবকুমারের বউ বলল, তা হলে ও বোধহয় আবার পালিয়েছে। যাও, থানায় যাও। একবার গিয়ে বলো...
এর আগেও চার-চার বার ও পালিয়েছে। প্রথম বার যখন ওকে খুঁজে
পাওয়া গেল না, তখন গ্রাম থেকে অনেক দূরে, কালিন্দী থানায় মিসিং ডায়েরি করার
সময় পুলিশ অফিসারটি বলেছিল, তেরো বছর বয়সেই পালিয়েছে! কার সঙ্গে?
শিবকুমার হাঁ করে তাকিয়ে ছিল। সেটা দেখে ওই পুলিশটি অফিসারটি বলেছিল, ও তো
আর দুধের বাচ্চা নয় যে, কোনও তান্ত্রিক তুলে নিয়ে গিয়ে আর সব বাচ্চাদের মতো
ওকেও মায়ের সামনে বলি চড়িয়ে দিয়েছে...
হ্যাঁ, এখানে মাঝে মাঝেই বাচ্চা খোয়া যায়। এবং খুঁজে পাওয়া না গেলে লোকেরা
ধরেই নেয়, তাকে কেউ তুলে নিয়ে গিয়ে বলি দিয়ে দিয়েছে। শোনা যায়, বহু বছর আগে
ইংরেজ আমলে ছোট, মেজ, বড়, আরও বড় কর্তাকে বারবার অনুরোধ-উপরোধ করা
সত্ত্বেও যখন হল না, তখন আশপাশের গ্রামের লোকেরা সবাই এককাট্টা হয়ে বড়
রাস্তায় যাওয়ার একমাত্র বাধা, শীর্ণ নদীটার উপরে কাঠের পোল তৈরি করেছিল,
সেটা যাতে ভেঙে না পড়ে এবং টেকসই হয়, সে জন্য নাকি ব্রিজ তৈরির আগেই ভাল
দিনক্ষণ দেখে খুঁটি পোঁতা হয়েছিল। সেই খুঁটি পোঁতাকে ঘিরে পুজোআচ্চা,
যাগযজ্ঞও হয়েছিল। এবং পূজারির বিধান অনুযায়ীই ধরিত্রী মাকে খুশি করার জন্য
নাকি বিভিন্ন জায়গা থেকে তেরোটি বাচ্চাকে চুরি করে এনে রাতের অন্ধকারে বলি
দেওয়া হয়েছিল। এখানকার লোকেদের বিশ্বাস, সেই জন্যই নাকি ওই ব্রিজটা এখনও এত
শক্তপোক্ত।
তাই আজও অনেকেই বাড়ি তৈরি করার আগে ভিত পুজোর সময় যেমন পুজো করে, সেটা তো
করেই, রাতের অন্ধকারে লোকচক্ষুর আড়ালে নাকি নরবলিও দেয়। তাই মাঝে মাঝেই
হঠাৎ হঠাৎ করে নিখোঁজ হয়ে যায় এক-একটা বাচ্চা। তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায়
না। আশপাশের লোকেরা তাই সদা সতর্ক। কোনও বাচ্চাকেই একা ছাড়ে না। ছাড়লেও
চোখে চোখে রাখে। কারণ কোনও বাচ্চাকে চোখের আড়ালে ছাড়াই মানেই নাকি ঘোরতর
বিপদ ঘনিয়ে আসা। কিন্তু সে সব বাচ্চাদের বয়স অনেক কম হয়। চার-পাঁচ কিংবা
ছয়। বারো-তেরো বছরের বাচ্চাদের সাধারণত কেউ বলি দেওয়ার জন্য নেয় না। ফলে ওই
পুলিশ অফিসারটি ভ্রু কুঁচকে শিবকুমারকে জিজ্ঞেস করেছিল, আপনার কি মনে হয়? ও
কার সঙ্গে পালিয়েছে?
শিবকুমার বলেছিল, তা তো জানি না।
— তা হলে যান। গিয়ে খোঁজ করুন আর কে পালিয়েছে...
শিবকুমার বলেছিল, আমি ওর সব ক’টা বন্ধুর বাড়িতেই গিয়েছিলাম। দেখলাম সবাই
আছে। শুধু ও-ই নেই। সবাইকেই জিজ্ঞেস করেছিলাম। কিন্তু কেউই বলতে পারল না, ও
কোথায় গেছে। ও নাকি কাউকেই কিছু বলে যায়নি।
— তা আবার হয় নাকি? কাউকে কিচ্ছু বলে যায়নি? এ সব ব্যাপারে জানবেন বন্ধুরাই সাঁটে থাকে। আচ্ছা বলুন তো, ও কার কার সঙ্গে মিশত?
— ও মিশত... ওই তো... বিন্দি, চান্দি, বুড়িয়া... এই তিন জনই তো ওর বন্ধু।
— আরে, আমি তা বলছি না। বলছি, ও কোন ছেলের সঙ্গে মিশত?
— ছেলে! শিবকুমার একেবারে আকাশ থেকে পড়েছিল।
হ্যাঁ, ওদের গ্রাম থেকে মাঝে মাঝেই ছেলেমেয়েরা পালায়। এই তো
ক’বছর আগেই, সতেরো-আঠারো বছরের দু’-দুটো ছেলে বাবার মুদিখানা দোকান থেকে সব
টাকা পয়সা নিয়ে কেউ কিছু টের পাওয়ার আগেই রাতের অন্ধকারে চম্পট দিয়েছিল
সুরাটে। অনেক খোঁজখবর করার পরে পুলিশ যখন তাদের তিন মাস পরে উদ্ধার করে
বাড়ি নিয়ে এসেছিল, তারা বলেছিল, আমরা ভাগ্যের সন্ধানে গিয়েছিলাম।
পরে জানা গিয়েছিল, কে নাকি তাদের বলেছিল সুরাটে গেলেই চাকরি পাওয়া যায়।
পড়াশোনা কিছু লাগে না। ওরাই শিখিয়ে পড়িয়ে নেয়। প্রচুর টাকা মাইনে। তাই
গরিব বাবা-মায়ের হাতে প্রতি মাসে মাসে কিছু টাকা তুলে দেওয়ার জন্যই নাকি
ওরা সুরাটে যাবার জন্য পালিয়েছিল। কিন্তু ভুল করে অন্য ট্রেনে উঠে পড়ায়
ওরা মজফ্ফরপুরে চলে গিয়েছিল। অচেনা-অজানা জায়গায় গিয়ে মহাবিপাকে পড়েছিল।
যে ক’টা টাকা ছিল তা দিয়ে চার-পাঁচ দিন কোনও রকমে চলেছিল। কিন্তু তার পরেই
দেখা দিয়েছিল বিপদ। কী খাবে, কোথায় থাকবে, কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না। শেষ
পর্যন্ত একটা ফাস্টফুডের দোকানে কাজে ঢুকেছিল তারা। এঁঠো থালাবাসন মাজা,
দূরের টিউবওয়েল থেকে জল তুলে আনা, আনাচ কাটাই শুধু নয়, বাড়ির টুকিটাকি
কাজ, মনিবের ছেলেকে স্কুলে দিয়ে আসা, বাজারের ব্যাগ বয়ে নিয়ে আসা থেকে
ফাইফরমাস খাটা, কিছুই বাদ যেত না। এমনকী রাত্রিবেলায় যতক্ষণ না মনিব ঘুমিয়ে
পড়ত, ততক্ষণ তার হাত-পা টিপে দিতে হত, মাথা ম্যাসাজ করে দিতে হত।
কেবল ছেলেরাই নয়, এই তো কিছু দিন আগে একসঙ্গে দল বেঁধে তেরো-চোদ্দো বছরের
চার-চারটে মেয়েও উধাও হয়ে গিয়েছিল। চোখের ঘুম ছুটে গিয়েছিল গোটা গ্রামের।
নড়েচড়ে বসেছিল লোকাল থানাও। সে দিনই মধ্যরাতে যখন তাদের রেল স্টেশন থেকে
উদ্ধার করে নিয়ে আসা হল, তারা বলেছিল, আমরা মুম্বই যাচ্ছিলাম। সিনেমায়
নামার জন্য।
শুধু কোনও বন্ধুর সঙ্গে কিংবা দল বেঁধেই নয়, একবার তাদের গ্রামেরই ষোলো
বছরের একটি মেয়ে স্কুলে যাওয়ার পথে বেমালুম ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছিল। থানায়
মিসিং ডায়েরি করতে গিয়ে তাদের বাড়ির লোকেরা জানতে পেরেছিল, পাশের গ্রামের
বছর উনিশের একটি ছেলেকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তখনই পুলিশ দুয়ে দুয়ে চার
করেছিল। এবং তখনই জানা গিয়েছিল, পুলিশের সন্দেহ খুব একটা অমূলক নয়। কারণ,
বহু লোকই তখন জানিয়েছিল, ওদের দু’জনকে নাকি প্রায়ই এ দিকে ও দিকে ঘুরতে
দেখেছে তারা। কিছু দিন আগে নাকি দু’জনে মিলে সিনেমা দেখতেও গিয়েছিল। অগত্যা
সবাই নিঃসন্দেহ হয়েছিল, ওরা দু’জনে পালিয়েছে। কিন্তু অনেক খোঁজ করেও আজ
অবধি তাদের কোনও হদিশ পাওয়া যায়নি।
মেয়ের বাড়ির লোকেরা অবশেষে দু’ক্রোশ দূরের নাবিক গ্রামের এক নামকরা বৃদ্ধ
গুনিনের কাছে গিয়েছিল। আলো বাতাস-হীন দমবন্ধ হয়ে আসা একরত্তি ঘরে বসে সেই
গুনিন নাকি বলেছিল, ওরা আছে। একসঙ্গেই আছে। ভাল আছে। ওদের একটা ফুটফুটে
মেয়েও হয়েছে। এই দ্যাখ, বলে, একটা মন্ত্রপূত আয়না বের করে ওদের সামনে
ধরেছিল। বলেছিল, সবাই নয়, যে কোনও একজন দ্যাখ। ওদের দেখতে পাবি। ওরা এখন
কোথায় আছে। কী করছে। কে দেখবি, তোরা নিজেদের মধ্যে ঠিক কর।
তখন মেয়ের মা বলেছিল, আমি দেখব। আমি।
সেই আয়নায় ছায়া-ছায়া মতো সে নাকি কী একটা দেখেওছিল। স্পষ্ট কিছু দেখা না
গেলেও গুনিন যখন বলেছে, ওটা তার মেয়ে, তা হলে নিশ্চয়ই ওটা তার মেয়েই। সে
উপরের দিকে তাকিয়ে ঠাকুরের উদ্দেশে প্রণাম করে বিড়বিড় করে বলেছিল, ও
যেখানেই থাক, ভাল থাক। ওকে ভাল রেখো ঠাকুর। ওকে ভাল রেখো…
ওই মেয়েটা ওই রকমই ছিল। কিন্তু তাদের মেয়ে বোড়কি তো ও রকম নয়। সে তো
বাচ্চা। সবে সেভেনে পড়ে। ও কি ও সব বোঝে! তবু কেবল নিজেদের গ্রামেই নয়,
আশপাশের সব ক’টা গ্রামে, এমনকী দূর-দূরান্তের স্কুলে গিয়েও শিবকুমার খোঁজ
করেছিল, আর কেউ পালিয়েছে কি না...
কিন্তু না। সে রকম কোনও খবর জোগাড় করতে না পাড়ায় ফের থানায় গিয়েছিল সে।
এবং থানাও সত্যি সত্যিই খোঁজখবর শুরু করেছিল। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই
বোড়কিকে খুঁজে বের করে নিয়ে এসেছিল। ও নাকি রেল স্টেশনের একটা বেঞ্চে
একা-একা বসেছিল।
তা হলে কি ওই মেয়েটার মতো ও-ও কারও সঙ্গে ট্রেনে করে পালিয়ে যাওয়ার মতলবে
ছিল! তাই প্ল্যাটফর্মে বসে কারও জন্য অপেক্ষা করছিল! পুলিশ অফিসারটি অনেক
জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। পুলিশ চলে যাওয়ার পরে তার বাবা-মাও। কিন্তু ও সেই একই
কথা বলে যাচ্ছিল। বললাম তো, আমি ট্রেন দেখতে গিয়েছিলাম…
ওর বাবা অনেক বুঝিয়েছিল। বলেছিল, তুই যে ভরদুপুরে একা একা ঘুরে বেড়াস। তুই
কি জানিস, এই দুপুরবেলায় বড় বড় গাছের মগডালে ভূত-পেত্মী-ব্রহ্মদত্যিরা
মানুষের রক্ত খাওয়ার জন্য কী ভাবে ওত পেতে বসে থাকে। একবার পেলে একেবারে
ঘাড় মটকে খায়, জানিস না? এই ভাবে কাউকে কিছু না বলে একা-একা কেউ বেরোয়? আর
কোনও দিন এই ভাবে কোথাও যাস না, বুঝেছিস? বলেই, ওর বাঁ হাতের বালাটা
দেখিয়ে বলেছিল, যদি না যাস, ভাল ভাবে থাকিস, তা হলে গত বার যেমন তোর নাম
খোদাই করা রুপোর এই বলাটা বানিয়ে দিয়েছিলাম, ঠিক সেই রকম আর একটা বালা তোকে
বানিয়ে দেব…
হ্যাঁ, বোড়কি বায়না করেছিল বলে বিয়েতে পাওয়া বউয়ের রুপোর টিকলি, গলার মোটা
হার আর পাশের গ্রামের রথের মেলা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া বাচ্চাদের পায়ের এক
পাটি তোরা ভেঙে গড়িয়ে দিয়েছিল ওটা।
বোড়কি বলেছিল, ওটার মধ্যে আমার নাম লিখে দিয়ো। না হলে, ওটা যদি হারিয়ে
যায়, তা হলে তোরা হারানো মেয়েটার মতো আমিও আর ওটা ফেরত পাব না।
ওর বাবা বলেছিল, ঠিক আছে, তাই হবে। স্যাকরাকে বলব, তোর বালার মধ্যে বড় বড় করে ‘বোড়কি’ লিখে দিতে। কী? খুশি তো?
বোড়কি খুশি হয়েছিল। কিন্তু আজ ও রকমই আর একটা বালা গড়িয়ে দেওয়ার কথা
বললেও, বোড়কির মুখে কিন্তু সে রকম কোনও খুশির ঝলক দেখতে পেল না শিবকুমার।
শুধু ফ্যালফ্যাল করে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সে।
দ্বিতীয় বার যখন ওকে খুঁজে পাওয়া গেল না, তখন তার বাবা প্রথমেই গিয়েছিল রেল
স্টেশনে। এর আগের বার যেটায় বসেছিল, শুধু সেই বেঞ্চটাতেই নয়, গোটা
স্টেশনের এই প্ল্যাটফর্মে ওই প্ল্যাটফর্মে যতগুলি বেঞ্চ ছিল, সিমেন্টের
বাঁধানো বেদি ছিল, সব ক’টা তন্ন তন্ন করে খুঁজেছিল। কিন্তু না। বোড়কিকে সে
পায়নি। অগত্যা কোনও উপায় না দেখে শেষ পর্যন্ত থানায় ছুটে গিয়েছিল।
সে বারও থানার লোকেরাই তার মেয়েকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছিল। ওকে নাকি একটা পুকুরের পাড়ে তন্ময় হয়ে বসে থাকতে দেখেছিল তারা।
— ওখানে কী করছিলি? জিজ্ঞেস করায় ও বলেছিল, আমি কচুরিপানার ফুল দেখতে
গিয়েছিলাম। প্রতিটা পাপড়িতে কী সুন্দর ময়ূরের পেখমের মতো রং। চোখ ফেরানো
যায় না...
— কচুরিপানার ফুল দেখতে গিয়েছিলি! তুই কি পাগল? জানিস, কত রকমের লোক ঘুরে
বেড়ায়? তারা বাচ্চাদের বস্তায় ভরে নিয়ে গিয়ে হাত-পা ভেঙে, অন্ধ করে শহরের
রাস্তায় রাস্তায় তাদের দিয়ে ভিক্ষে করায়। তুই কি সেই লোকগুলির খপ্পড়ে
পড়তে চাস? তা হলে? অনেক বুঝিয়েছিল শিবকুমার। তবুও...
তৃতীয় বার যখন পালিয়ে গেল, প্রথমেই শিবকুমার গেল সেই পুকুরের পাড়ে। তার
পরে রেল স্টেশনে। তার পর ওর বন্ধুদের বাড়িতে। কোথাও না পেয়ে অবশেষে থানায়।
তখনই পুলিশ অফিসারটা তাকে ধমকে বলেছিল, আপনারা কি ইয়ার্কি পেয়েছেন? আমাদের
আর কোনও কাজ নেই? আপনাদের মেয়ে রোজ-রোজ পালিয়ে যাবে, আর তাকে খুঁজে খুঁজে
আমাদের নিয়ে আসতে হবে? একটা মেয়েকে সামলে রাখতে পারেন না? যান, নিজেরা
খুঁজে নিন।
কাঁচুমাচু মুখ করে থানা থেকে বেরিয়ে এলেও পুলিশ অফিসারটি যে ওগুলো শুধু
কথার কথা বলেছিলেন, বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, আসলে সে থানা থেকে বেরিয়ে আসা
মাত্রই মেয়েটিকে খুঁজে বের করার জন্য ফোর্স পাঠিয়েছিলেন, সেটা সন্ধে হওয়ার
অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিল শিবকুমার।
সে বার স্কুলে যাওয়ার সময় রাস্তার পাশে বাঁদরখেলা দেখার পরে গ্রামের আরও
অনেক বাচ্চাদের মতো সেই বাঁদরওয়ালার পিছু পিছু সেও নাকি গ্রাম ছাড়িয়ে
অনেকটা পথ চলে গিয়েছিল। কিছুটা যাবার পরে বাকি বাচ্চারা ফিরে এলেও সে আর
ফেরেনি। বাঁদরওয়ালার পিছু পিছু হেঁটেই যাচ্ছিল। সেটা দেখে নাকি বাঁদরওয়ালা
বলেছিল, কী রে বেটি, আর কত দূর আসবি? এ বার যা।
বোড়কি নাকি বলেছিল, আমি যাব না। আমি তোমার সঙ্গে যাব।
বাঁদরওয়ালা নিতে চায়নি। তবুও পিছন ছাড়েনি ও। হাইওয়ের উপরে বাস স্টপেজের
ধারে একটা ছোট্ট চায়ের দোকানে আড্ডা মারছিল কয়েকটি স্থানীয় ছেলে। তারা
বাঁদরওয়ালার পিছনে পিছনে স্কুলের পোশাক পরা একটা মেয়েকে ওই ভাবে যেতে দেখে
ভেবেছিল, বাঁদরওয়ালাটা নিশ্চয়ই ছেলেধরা। মেয়েটাকে নিয়ে যাচ্ছে। তাই তারা
বাঁদরওয়ালাটাকে ধরে জিজ্ঞেস করেছিল, এই মেয়েটাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে কোথায় নিয়ে
যাচ্ছিস?
বাঁদরওয়ালা বলেছিল, আমি নেব কেন? ও-ই তো আমার পিছু ছা়ড়ছে না।
ওরা যখন বোড়কিকে জিজ্ঞেস করল, তুই কোথায় থাকিস?
ও সব বলেছিল। গ্রামের নাম। পাড়ার নাম। বাবার নাম। এমনকী স্কুলের নামও।
তখন ওই ছেলেদের মধ্যে থেকেই একজন তার বাইকে করে ওকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার
জন্য রওনা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের সড়ক খাতে বরাদ্দ টাকায় সদ্য তৈরি
হওয়া কালো পিচের চওড়া হাইওয়েটা যতই মসৃণ হোক না কেন, হুসহাস করে ছুটে যাক
না কেন দূরপাল্লার এক্সপ্রেস বাস, মাল-বোঝাই বড় বড় ট্রাক, তার পাশ দিয়ে
নেমে যাওয়া গ্রামে ঢোকার সরু রাস্তাগুলি কিন্তু এখনও যে কে সে-ই। খোয়া
বেছানো। গর্ত-গর্ত।
দু’ধারে কোথাও বড় বড়় গাছ, কোথাও আবার ঝোপঝাড়। জঙ্গল জঙ্গল মতো। সেই
রাস্তার পাশেই কোথাও হিন্দুপাড়া, কোথাও মুসলমানপাড়া, কোথাও কৈবর্তপাড়া,
নাপিতপাড়া, কোথাও আবার ব্রাহ্মণপাড়া।
এক সময় বেশির ভাগ বাড়িই মাটির ছিল। কিন্তু হাইওয়ে হওয়ার আগে থেকেই শুধু
রাস্তার ধারের জমিই নয়, ভিতরের, আরও ভিতরের জমির দামও হু হু করে বাড়তে
শুরু করেছিল। বাইরে থেকে লোকজন এসে বাড়িঘর করে বসে পড়ছিল। কেউ কেউ
দোতলা-তিনতলাও হাঁকাচ্ছিল। আর তারা বাইরে থেকে এলেও, এখানে বাড়ি করার সময়
কিন্তু এখানকার চিরাচরিত ধ্যান-ধারনা অনুযায়ীই কেউ কেউ বলিও চড়াতে শুরু
করেছিল।
পিছনে বোড়কিকে বসিয়ে সেই রাস্তা দিয়েই ঝাঁকুনি খেতে খেতে ধুলো উড়িয়ে বাইক
নিয়ে যাচ্ছিল ছেলেটা। কিন্তু তাকে আর বোড়কিদের বাড়ি পর্যন্ত যেতে হয়নি।
মাঝপথেই দেখা হয়ে গিয়েছিল, বোড়কির খোঁজে বেরোনো কালিন্দী থানারই এক পুলিশ
অফিসারের সঙ্গে। ওই পুলিশ অফিসারটিই তার জিপে করে বোড়কিকে শিবকুমারের হাতে
তুলে দিয়ে বলেছিল, মেয়েকে দেখেশুনে রাখুন। ভাল করে বোঝান। কখন কোন বিপদে
পড়ে যাবে, বলা যায়! সব ছেলে তো আর সমান নয়… দরকার হলে ভাল কোনও
সায়ক্রিয়াটিস্টের কাছে নিয়ে যান। ও কেন বার বার বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে
চাইছে, কাউন্সেলিং করান। এর পরে ও যদি আবার কোথাও চলে যায়, আমাদের কাছে আর
আসবেন না। বুঝেছেন?
শিবকুমার বুঝেছিল। মেয়েকেও বুঝিয়েছিল, তুই কি জানিস এখন কত রকমের লোক
রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়? তারা তোর বয়সি ছেলেমেয়েদের তুলে নিয়ে গিয়ে কিডনি,
চোখ, হার্ট— সব বের করে বিক্রি করে দেয়। এখনও সময় আছে। সাবধান হ। না হলে
কিন্তু বিপদে পড়ে যাবি। আর তোর বিপদ মানে আমাদেরও বিপদ। তুই কি তোর
বাবা-মাকে কাঁদাতে চাস, বল?
কিন্তু তার মেয়ে বোঝেনি। পর দিন স্কুল থেকে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরেছিল।
সঙ্গে ছিল তার বোন মেজকি আর ছোট ভাই ছোটকা। ওরা তিন জন একই স্কুলে পড়ে।
বোড়কি এ বার ক্লাস নাইনে উঠেছে। মেজকি ক্লাস সিক্সে পড়ে আর ছোটকা
থ্রি-তে। বাকি দু’জন ঠিক থাকলেও বোড়কিটাই যেন একটু কেমন কেমন…
শিবকুমার জোগাড়ের কাজ করে। তার বউ নতুন গজিয়ে ওঠা কয়েকটা বাবুর বাড়িতে।
কোথাও সপ্তাহে তিন দিন কাপড়় কাচার কাজ, কোথাও ঘরদোর মোছা-বাসন মাজার কাজ।
কোথাও আবার রান্নার কাজ। তাদের কারও কারও বাড়ির মূলত কার্ড এন্ট্রি করার
জন্যই রেশন তুলে দেয়। সবার বাড়িতেই গ্যাস আছে। তাই অনেকেই প্রতি সপ্তাহে
নিয়ম করে কেরোসিন তোলে না। সেটা সে ধরে। এবং বেশ কিছুটা জমে গেলে
পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছে অনেক বেশি দামে বিক্রি করে। ফলে ফিরতে ফিরতে তার
দুপুর গড়িয়ে যায়। এসে রান্নাবান্না করে।
সে দিন রান্নাবান্না করার পর হাতের কাজ নিয়ে বসেছিল। কক্ষনো চুপচাপ বসে
থাকতে পারে না সে। গরম যাওয়ার আগেই নানান নকশার সোয়েটার বুনতে শুরু করে।
মেয়ের জামায় নানা রঙের সুতো দিয়ে কলকা তুলে দেয়। স্বামীর রুমালে তো বটেই,
নিজের রুমালেও চেকনাই সুতো দিয়ে নামের অদ্যাক্ষর লেখে। কারণ রুমালের প্রতি
খুব ছোটবেলা থেকেই তার দুর্বলতা। সব সময় কোমরে একটা গোঁজা থাকে।
বড় মেয়েকে কাঁদতে দেখে সে ভেবেছিল, নিশ্চয়ই বোন বা ভাইয়ের সঙ্গে তার ঝগড়া
হয়েছে। এক্ষুনি হাতাহাতি লেগে যাবে। তাই হাতের কাজ ফেলে ত়ড়িঘড়ি উঠে এসে
জিজ্ঞ়়েস করেছিল, কী হয়েছে রে?
বোড়কি কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, আমি আর স্কুলে যাব না।
মা বলেছিল, এ আবার কী অলুক্ষুণে কথা! কেন? স্যার মেরেছে?
— না।
— কেউ কিছু বলেছে?
— না।
— তা হলে?
বোড়কি বলেছিল, আমার স্কুলে যেতে ভাল লাগে না। আমি আর স্কুলে যাব না।
— কেন যাবি না, সেটা তো বলবি।
— না। আমি আর স্কুলে যাব না।
ওর মা বলেছিল, তা হলে কি আমার মতো লোকের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করবি? তোর বাবা
তোদের জন্য মুখে রক্ত তুলে কাজ করে। আর তুই বলছিস… আসুক তোর বাবা।
ওর বাবা বড় মেয়েকে ভীষণ ভাল বাসে। শত অন্যায় করলেও বকে না। বউ মারতে গেলেও
আটকায়। সব সময় বলে, বড়় হোক। সব ঠিক হয়ে যাবে। সে-ই বাবাও বুঝতে পারছে,
এই মেয়ে তার বাকি দুই ছেলেমেয়ের মতো নয়। তাই ওকে কাছে ডেকে আদর করে পাশে
বসিয়ে বোঝাতে লাগল, এ রকম করতে নেই মা। তুই কেন বারবার পালিয়ে যাস?
বোড়কি বলেছিল, আমার বাড়িতে থাকতে ইচ্ছে করে না।
— কেন?
কোনও উত্তর না দিয়ে ও চুপ করে ছিল। তাতে আরও মেজাজ চড়ে যাচ্ছিল
শিবকুমারের। তাই গলা চড়়িয়ে ফের জিজ্ঞেস করেছিল, কেন? কেন? কেন থাকতে
ইচ্ছে করে না তোর?
বোড়কি বলেছিল, জানি না।
— তোর ভাইবোনেরা তো এ রকম নয়। তুই এ রকম করিস কেন?
বাবার কথার উত্তর না দিয়ে, উল্টে ও-ই প্রশ্ন করেছিল, সবাইকে কি একই রকম হতে হবে?
— তুই কি চাস?
— যে দিকে দু’চোখ যায়, আমি সে দিকে যেতে চাই।
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে গলার স্বর একেবারে খাদে নামিয়ে শিবকুমার বলেছিল, এ রকম বললে হয় মা বল? তুই তো মেয়েমানুষ।
— আমি ছেলে মেয়ে বুঝি না। আমার যা মন চায় আমি তাই করব। আর কিছু বলবে?
মেয়ের বেয়াদব কথা শুনে মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল শিবকুমারের। মনে হচ্ছিল ঠাসিয়ে
একটা চড় মারে। শেষ পর্যন্ত নিজেকে কোনও রকমে সামলে নিয়েছিল। সরে গিয়েছিল
ওর সামনে থেকে।
না। সে দিন নয়। তার পর দিনও নয়। তার পর দিন ফের বেপাত্তা হয়ে গিয়েছিল
বোড়কি। সব জায়গায় খুঁজেছিল শিবকুমার। কিন্তু কোত্থাও পায়নি। বউ বলেছিল,
একবার থানায় যাও। ওরা ঠিক আমার মেয়েকে খুঁজে এনে দেবে।
সে বলেছিল, কী করে যাব? এর আগের বার মেয়েকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে উনি কী বলে গিয়েছিলেন তোমার মনে নেই?
— আমার সব মনে আছে। তবু তুমি যাও।
— না। আমি যাব না।
— এই বারই শেষ বার। এর পরে ও গেলেও আমি আর কক্ষনো তোমাকে থানায় যেতে বলব না। যাও।
শিবকুমার গিয়েছিল। সে থানায় ঢুকতেই ওই পুলিশ অফিসারটি বলেছিল, কী হল? আবার
থানায় কেন? আপনাকে বলেছিলাম না, থানায় আসবেন না। মেয়ে হারানো ছাড়া অন্য
কিছু বলার থাকলে বলুন…
কোনও কথা নয়। ঝপ করে বসে তার পা জড়িয়ে ধরেছিল শিবকুমার। হাউহাউ করে কান্না
জুড়ে দিয়েছিল। পুলিশ অফিসারটি বলেছিল, আরে, ছাড়ুন ছাড়ুন। পা ধরছেন কেন?
ঠিক আছে ঠিক আছে, বলুন, কখন থেকে পাওয়া যাচ্ছে না?
শিবকুমার বলেছিল। এবং অবাক কাণ্ড, সে বারও সন্ধে নামার আগেই… না। মেয়েকে
পৌঁছে দেয়নি। থানা থেকে লোক পাঠিয়ে তাকে আর তার বউকে ডেকে পাঠিয়েছিল ওই
পুলিশ অফিসারটি।
মেয়েকে দেখে শিবকুমারের চোখ আনন্দে চকচক করে উঠেছিল। বলেছিল, কোথায় পেলেন ওকে?
পুলিশ অফিসারটি বলেছিল, আমাদের এক অফিসার গ্রামে টহল দিচ্ছিলেন। উনি হঠাৎ
দেখেন, সুনসান রাস্তার ধারে ঢালু জমির নীচে একটি বাচ্চা কী যেন করছে।
বাচ্চাটি কে! দেখতে গিয়ে দেখে— ও।
— কী করছিল?
— উবু হয়ে বসে এক হাত এক হাত করে রাস্তা মাপছিল।
— রাস্তা মাপছিল? শিবকুমার অবাক।
— তা হলে আর বলছি কী… ও নাকি ওই ভাবে হাত মেপে মেপে দেখতে চেয়েছিল আপনাদের বাড়ির সীমানা থেকে হাইওয়েটা কত হাত দূরে।
— সে কী!
— সে কী, সেটা আপনারাই বুঝুন। বলে, তাদের হাতে বোড়কিকে সঁপে দেওয়ার আগে
রীতিমত বেশ কড়া ভাষাতেই ধমকেছিল সে। বলেছিল, একটা মেয়েকে দেখে রাখতে পারেন
না? দেখুন তো, শুধু আপনাদের গ্রামেই নয়, আশপাশের কোনও গ্রামে এ রকম আর
একটাও মেয়ে আছে কি না। তা হলে আপনাদের মেয়ে এ রকম কেন?
সে দিন দু’জনেই পুলিশ অফিসারটিকে কথা দিয়েছিল, এ বার থেকে মেয়েকে চোখে চোখে
রাখব। ভাল করে বোঝাব। দরকার হলে দুটো বাড়ির কাজ ছেড়ে দেব। মেয়েকে আর
পালাতে দেব না।
বাড়ি নিয়ে এসে মা-বাবা দু’জনেই খুব করে বুঝিয়েছিল। বোড়কিকে বলেছিল, তুই
যদি এ রকম করিস, তা হলে তোর ভাইবোনেরা তোর কাছ থেকে কী শিখবে বল? তা ছাড়া,
তুই বড় হয়েছিস। কোন ছেলে কী রকম তুই জানিস? চারিদিকে কত কী হচ্ছে। যদি সে
রকম কোনও বিপদ হয়! তখন? তোকে বিয়ে দিতে পারব? না, আমরা কাউকে মুখ দেখাতে
পারব? আমরা গরিব মানুষ মা। এ রকম করিস না।
সে দিন রাত্রে ওর দুই ভাইবোনকে পাশের ঘরে ঘুম পাড়িয়ে বোড়কিকে মাঝখানে
শুইয়ে দু’পাশ থেকে দু’জন অনেক বুঝিয়েছিল। বোঝাতে বোঝাতে কখনও কখনও রেগে
যাচ্ছিল ওর মা। রাগ সামলাতে না পেরে থেকে-থেকেই মেয়ের উপরে হাত ওঠাতে
যাচ্ছিল। আর প্রতি বারের মতোই বউকে বিরত করছিল শিবকুমার। কারণ, আরও দুটো
বাচ্চা থাকলেও এই বড় মেয়েটাই ছিল তার প্রাণ।
তবু মেয়েকে আগলে রাখা গেল না। পালিয়ে গেল। না। অনেক খোঁজ করেও তাকে কোথাও
পাওয়া গেল না। ছলছল চোখে শিবকুমার এ কথা বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়ল তার বউ।
আর তার কান্না শুনে বইপত্র ফেলে পাশের ঘর থেকে ছুটে এসে মায়ের কাছ ঘেষে
দাঁড়াল তাদের বাকি দুই ছেলেমেয়ে।
ফের কান্না জড়ানো গলায় বউ বলল, যাও না… থানায় গিয়ে একবার বলো না… দরকার হলে হাতে-পায়ে ধরো। আমি যাব?
ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেও শিবকুমার নিজেকে কোনও রকমে সামলে নিয়ে এই প্রথম বার একটু কড়া গলাতেই বলল, না।
নিজে তো গেলই না। বউকেও যেতে দিল না।
বিকেল হল। সন্ধে হল। রাত্র হল। না। মেয়ে ফিরল না। সারা রাত স্বামী-স্ত্রী
দু’জনেই খাটের উপর ঠাঁয় বসে রইল। সকাল হল। শিবকুমার কাজে বেরোল না। বউও না।
এমনকী তাদের যে আরও দুটো বাচ্চা আছে, সে কথাও যেন তারা বেমালুম ভুলে গেল।
ভুলে গেল, নিজেদের জন্য না করলেও ওদের জন্য রান্নাবান্না করতে হবে। রেডি
করে স্কুলে পাঠাতে হবে।
ছোটকা এসে মাকে বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগল, মা, দিদি কোথায়?
মেজকি ঘুরে ঘুরে এসেই তার বাবাকে বলতে লাগল, দিদিকে খুঁজতে যাবে না?
কিন্তু কারও কথাই যেন তাদের কানে ঢুকছে না। তারা যেন কেমন পাথর হয়ে গেছে।
সে দিন না। তার পর দিনও না। এমনকী তার পর দিনও তাদের মেয়ে বাড়িতে ফিরল না। চার দিনের দিন এল পুলিশ।
তারা যখন থানায় পৌঁছল, যে তাদের কখনও বসতে বলেনি, বরং দূর দূর
করে প্রায় তাড়িয়ে দিত, সেই পুলিশ অফিসারটিই তাদের সঙ্গে অত্যন্ত ভাল
ব্যবহার করল। টেবিলের উল্টো দিকের চেয়ারে বসতে বলল। তার পর জিজ্ঞেস করল,
আপনাদের মেয়ে কোথায়?
— পেয়েছেন?
— না। আমি জিজ্ঞেস করছি, আপনাদের মেয়ে কোথায়?
স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইল।
— কী হল? তাকান আমার দিকে।
ওরা যখন মুখ তুলল, পুলিশ অফিসারটি দেখল, ওদের দু’জনের চোখই ছলছল করছে। তাই একটু থেমে ওদের কাছে জানতে চাইল, কবে পালিয়েছিল?
কাঁদো কাঁদো গলায় বোড়কির মা বলল, আজ চার দিন হয়ে গেল…
— থানায় মিসিং ডায়েরি করেননি কেন?
— আপনি বারণ করেছিলেন, তাই…
ড্রয়ার থেকে এক চিলতে কাপড়ে মো়ড়া একটা পুটুলি বের করে সামনের টেবিলে
রেখে কাপড়টা খুলতে খুলতে ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, দেখুন তো, এটা চিনতে পারেন
কি না…
শিবকুমারের বউ দেখল, যেটা সে তার বিয়েতে পাওয়া রুপোর টিকলি, গলার মোটা হার
আর পাশের গ্রামের রথের মেলা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া বাচ্চাদের পায়ের এক পাটি
তোরা ভেঙে নিজের পছন্দ করা ডিজাইনে গড়িয়ে দিয়েছিল, স্যাকরাকে বলে যার
মধ্যে বড় বড় করে ‘বোড়কি’ লিখে দিয়েছিল, এটা সেই বালা। সঙ্গে সঙ্গে সে
বলল, এটা কোথায় পেলেন?
— আমরা আজ রাস্তার ধারের একটা ঝোপের আড়াল থেকে মুণ্ডুহীন একটা লাশ পেয়েছি।
বারো-চোদ্দো বছর বছরের একটা মেয়ের। কিন্তু তার মুণ্ডুটা এখনও পাইনি।
তল্লাশি চলছে। শরীরটাও এমন ভাবে ঝলসে গেছে যে, শনাক্ত করা মুশকিল। মনে
হচ্ছে, বাচ্চা কাউকে না পেয়ে, একটু বড়় বয়সের মেয়েকেই বলি দেওয়া হয়েছে।
— বলি! আঁতকে উঠল স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই।
— হ্যাঁ, বলি। প্রাথমিক তদন্তে সেটাই মনে হচ্ছে। কারণ, ডেডবডির পাশে বিশাল
ব়ড় একটা ফুলের মালাই শুধু নয়, অনেক কুঁচো ফুলও পাওয়া গেছে। আর যারা তাকে
বলি দিয়েছে, সে যে কে, সেটা যাতে কেউ চিনতে না পারে, সে জন্যই সম্ভবত তার
গায়ে কেরোসিন তেল ঢেলে জ্বালিয়ে দিয়েছে।
শিউরে উঠল শিবকুমার। এই ভাবে একটা বাচ্চাকে মেরেছে…
চোখ মুখ কুঁচকে শিবকুমারের বউ জিজ্ঞেস করল, কিন্তু তার সঙ্গে আমার মেয়ের নিখোঁজ হওয়ার কী সম্পর্ক?
— কারণ, ওই ডেডবডির হাতেই এই বালাটা ছিল…
দু’জনেই থরথর করে কেঁপে উঠল। শিবকুমারের মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এল, মানে?
— চলুন, মর্গে যাই। দেখুন, আইডেনটিফাই করতে পারেন কি না…
উঠেপ়ড়ে লাগল পুলিশ অফিসারটি। যে ভাবেই হোক এর খুনিকে খুঁজে
বের করতেই হবে। সে নানান সোর্স মারফত খবর নিতে লাগল, তিন-চার দিনের মধ্যে
কারও বাড়িতে কোনও ভিত পুজো হয়েছে কি না… কেউ কোনও মানসিক পুজো দিয়েছে কি
না… প্রথমে মনে হয়েছিল, যেখানে মৃতদেহ পাওয়া গেছে, তার আশপাশেরই কোনও
বাড়িতে ওকে বলি দেওয়া হয়েছে। কারণ, বলি দেওয়ার পর সেই দেহ বেশি দূর থেকে
বয়ে নিয়ে এসে ওখানে ফেলা চাট্টিখানি কথা নয়। তা ছাড়া, দূর থেকে নিয়ে এলে
বস্তায় ভরে নিয়ে আসতে হত। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা হয়নি। তবু চার-পাঁচ দিনের
মধ্যে পুজো হয়েছে, কাছাকাছি এ রকম একটাও বাড়ি যখন পাওয়া গেল না, তখন খোঁজ
শুরু হল এলাকার বাইরেও।
তল্লাশি করতে করতে পাওয়া গেল তিনটে বা়ড়ি। প্রথম বাড়িটির কর্তার রোগ
কিছুতেই সারছিল না। তাকে রোগমুক্ত করার জন্যই বাড়িতে মহাধুমধাম করে যজ্ঞ
করা হয়েছে। এবং সেখানে নাকি বলিও দেওয়া হয়েছে।
সঙ্গে সঙ্গে থানায় তুলে নিয়ে আসা হল সেই বাড়ির বড় ছেলেকে। জিজ্ঞাসাবাদ
করে জানা গেল, বলি দেওয়া হয়েছে ঠিকই, তবে নরবলি নয়, এমনকী ছাগ বলিও নয়, বলি
দেওয়া হয়েছে একটা চালকুমরোকে।
দ্বিতীয় বাড়িটাতেও পুজো হয়েছিল। ধুমধাম করেই হয়েছিল। তবে সেখানে নাকি কোনও বলি-টলি দেওয়া হয়নি।
কিন্তু তৃতীয় বাড়িটার লোকজনদের সঙ্গে কথা বলে সন্তুষ্ট হতে পারেনি সেই
পুলিশ অফিসারটি। তারা জানিয়েছিল, হ্যাঁ, আমরা বলি দিয়েছিলাম। তবে কোনও
প্রাণ নয়, কাম-ক্রোধ-ঈর্ষা-লোভ-ভয়ের প্রতীক হিসেবে মাটি দিয়ে বানানো কয়েকটা
পুতুলকে।
ওরা ও কথা বললেও, পুলিশ অফিসারটির কাছে কিছুতেই যখন সেটা বিশ্বাসযোগ্য মনে
হচ্ছিল না, তখন আর এক ইনভেস্টিগেশন অফিসার বলল, আচ্ছা, বডির উপরে যে মালাটা
পাওয়া গেছে, সেটা কিন্তু সব দোকানে সচরাচর পাওয়া যায় না। অত মোটা গোরের
মালা! আমার মনে হয়, অর্ডার দিয়ে বানানো। এখানে তো ফুলের দোকান মাত্র
কয়েকটা। হাতে গোনা। একবার খোঁজ করে দেখলে হয় না?
মাথা কাত করেছিল পুলিশ অফিসারটি।
ওরা যখন আলোচনা করছে, তখনই, যেখানে মৃতদেহটি পাওয়া গিয়েছিল, তার আশপাশে
কাটা মুণ্ডুর তল্লাশি করতে থাকা তদন্তকারী এক অফিসার রাস্তার ধার থেকে
কুড়িয়ে পেল একটা লেডিস রুমাল। আর ওটা দেখেই তার সন্দেহ হল, এই খুনের সঙ্গে
কোনও মহিলা জড়িত। কোনও মহিলাই তাকে ফুঁসলে নিয়ে এসেছিল। আর সেই মহিলার
সঙ্গে ও এসেছিল মানে, ও তাকে খুব ভাল করেই চিনত। সে তার মায়ের কোনও বন্ধু
হতে পারে। কোনও আত্মীয়া হতে পারে। আবার তাদের পরিবারের কোনও পরিচিতাও হতে
পারে। তবে যে-ই হোক, সে একজন মহিলাই। কারণ, রুমালটা কোনও পুরুষের নয়,
মহিলার।
এ ক’দিন আর রান্নাবান্না হয়নি শিবকুমারের বাড়িতে। মুড়ি খেয়েই কাটিয়েছে
বাচ্চা দুটো। কিন্তু কত দিন আর ওদের মু়ড়ি খাইয়ে রাখা যায়! তাই চুল্লি
ধরিয়ে ভাতের সঙ্গে সেদ্ধ দেওয়ার জন্য আলু ফালি করছিল শিবকুমারের বউ। মেয়ের
মৃতদেহ শনাক্ত করে আসার পর থেকে আর বা়ড়ির বাইরে বেরোয়নি সে। ক’দিন যাবদ
বাড়িতেই আছে।
হঠাৎ কড়া নাড়ার শব্দ শুনে দরজার কাছে এসে দেখে শুধু ওই পুলিশ অফিসারটিই
নয়, তার সঙ্গে আরও তিন-চার জন পুলিশ। তার মধ্যে দু’জন মহিলা পুলিশও আছে।
গলির মধ্যে পুলিশের ভ্যান ঢুকতে দেখে আশপাশ থেকে বেরিয়ে এসেছে লোকজন। এত জন
পুলিশ একসঙ্গে দেখে হকচকিয়ে গেল শিবকুমার। জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে বাবু?
— আপনার বউ কোথায়?
— ও তো ভিতরে। রান্না করছে।
ওটা শোনামাত্রই ধুপধাপ করে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল তারা। দু’জন মহিলা পুলিশ রান্নাঘরে ঢুকে শিবকুমারের বউকে বের করে নিয়ে এল।
শিবকুমার আকাশ থেকে পড়়ল। হকচকিয়ে গিয়ে পাগলের মতো বারবার একই প্রশ্ন করে
যেতে লাগল, কী হয়েছে বাবু, কী হয়েছে? ও কী করেছে? ওকে ধরছেন কেন?
মুখ ঝামটা দিয়ে উঠেছিল পুলিশ অফিসারটি। কেন? ও একটা খুনি। বোড়কিকে ও-ই খুন করেছে।
— না বাবু, না। ও খুন করতে পারে না।
পুলিশ অফিসারটি বলল, আমাদের কাছে প্রমাণ আছে। বোড়কির মৃতদেহের পাশে যে
ফুলের মালা পাওয়া গিয়েছিল, সেটা আপনার বউই কিনে নিয়ে গিয়েছিল। আমরা
ফুলওয়ালার কাছ থেকে জানতে পেরেছি। আর ও-ই যে গিয়েছিল, তার প্রমাণ— ওই
মৃতদেহের খুব কাছেই পাওয়া গেছে আপনার বউয়ের একটা রুমাল।
— রুমাল? ওটা যে আমার বউয়েরই, সেটা বুঝলেন কী করে?
— ওটার এক কোনায় ছোট্ট করে লেখা রয়েছে আপনার বউয়ের নামের প্রথম অক্ষর।
— তবু আমি বলছি, ও খুন করেনি। বেশ জোরের সঙ্গেই বলল শিবকুমার।
— ও খুন করেনি?
— না। ও খুন করেনি।
পুলিশ অফিসারটি জিজ্ঞেস করল, তা হলে কে করেছে? কে?
শিবকুমার খুব ধীর-স্থির হয়ে বলল, আমি।
থানায় এনে জবানবন্দি নেওয়া হল শিবকুমারের। কেন আপনি মেয়েকে
মারতে গেলেন? আপনি তো আপনার ছেলেমেয়েদের মধ্যে ওকেই সব থেকে বেশি
বাসবাসতেন?
মাথা নামিয়ে ছলছল চোখে শিবকুমার খুব ধীরে ধীরে বলল, ভালবাসতাম দেখেই তো মেরেছি।
— মানে?
— আপনারা তো সবই জানেন, চারিদিকে কী হচ্ছে। এই তো সে দিন একটা মেয়েকে
রাস্তার মধ্যে একা পেয়ে কতগুলো ছোকরা তুলে নিয়ে গিয়ে কী করল। তার পর তার
রক্তমাখা দেহ পাওয়া গেল কাছেরই একটি নির্মীয়মান বাড়ির ভিতরে।
তেলেনি পা়ড়ার একটা বা়ড়িতে মা-বাবা না থাকার সুযোগে পা়ড়ারই একজন বাবার
বয়সি মানুষ, ঘরে ঢুকে… সে সবাইকে বলে দেবে বলেছিল দেখে, হেঁসো দিয়ে তাকে
কোপাতে শুরু করেছিল। তার পর তার চিৎকারে পা়ড়া-প্রতিবেশীরা ছুটে আসায় তাকে
ওই রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে রেখেই সে চম্পট দেয়… পাড়ার লোকেরা ধরাধরি করে
স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার পরেই তার মৃত্যু হয়।
বুড়ো বটতলার ঘটনাটা তো আরও ভয়াবহ। মায়ের পাশে ঘুমিয়েছিল একরত্তি মেয়েটা।
পর দিন সকালে তার বাবা বাড়ির বাইরে বেরিয়ে দেখে, সামনের আমগাছে তার মেয়ের
দেহ ঝুলছে। পরনে কিচ্ছু নেই। পরে জানা গিয়েছিল, কারা নাকি রাতের অন্ধকারে
মুখ চাপা দিয়ে তার মায়ের পাশ থেকে তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। তার পর… পোস্ট
মর্টেম রিপোর্টে নাকি বলা হয়েছিল, ওকে কয়েক জন মিলে পর পর… ছিঃ… আর তার
ফলেই নাকি তার মৃত্যু হয়েছে।
তাই অনেকেই সন্দেহ করেছিল, মরে গেছে বুঝতে পেরেই ওই ছেলেগুলি তার গলায়
গামছা বেঁধে ওই ভাবে আমগাছে লটকে দিয়েছিল। কেউ যদি দেখে ফেলে! সেই ভয়ে
তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে তারা খেয়ালই করেনি, তার পা
মাটি ছুঁয়ে আছে। যা সহজেই বুঝিয়ে দেয়, ওটা আত্মহত্যা নয়, খুন।
এ সব ওকে বলতে পারিনি। নিজের মেয়েকে কি এ সব বলা যায়! তবু নানা রকম ভাবে ভয়
দেখিয়েছিলাম। যাতে ও ভুলভাল খপ্পড়ে না পড়ে। কিন্তু ও শোনেনি।
— কিন্তু ওকে মারলেন কেন? কী হয়েছিল?
— সে দিন ও স্কুলে যাওয়ার সময় দেখি ওর বইয়ের ব্যাগটা একেবারে ঢাউস হয়ে ফুলে
আছে। দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল। তাই বেরোবার আগে ও যখন খেতে বসেছিল, তখন
চুপিচুপি ওর ব্যাগের চেন খুলে দেখি, তার মধ্যে বেশ কয়েকখানা সালোয়ার-কামিজ ।
বুঝতে পারলাম, ও আজ পালাবে।
ও বেরোতেই আমিও বেরোলাম। ওর পিছনে পিছনে খানিকটা গেলাম। হঠাৎ ও পিছন ফিরতেই
আমাকে দেখে ফেলল। বলল, বাপু, তুমি আমার পিছু পিছু আসছ কেন?
আমি তখন ওকে বললাম, তোর সঙ্গে ক’টা কথা আছে মা। চল, ওই গাছতলায় গিয়ে একটু বসি।
ও বলল, আমার স্কুলের দেরি হয়ে যাবে।
আমি বললাম, তুই যে স্কুলে যাবি, তোর বইখাতা কোথায়— তোর ব্যাগে তো শুধু ক’খানা সালোয়ার-কামিজ।
ও খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি স্কুলে যাব না।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন?
ও বলল, আমার ভাল লাগে না।
আমি জানতে চাইলাম, তা হলে তোর কী ভাল লাগে?
ও বলল, যে দিকে দু’চোখ যায়, সে দিকে চলে যেতে।
আমি ফের জিজ্ঞেস করলাম, তুই চলে যাবার জন্য বেরিয়েছিস?
ও বলল, হ্যাঁ। একেবারে চলে যাওয়ার জন্য। তোমরা কিন্তু আমাকে আর খুঁজো না।
আমি অনেক কাকুতি-মিনতি করে বললাম, মা, আমার কথাটা শোন…
ও বলল, না। আমি তোমাদের কারও কোনও কথা শুনব না। আমার ভাল লাগে না। দম বন্ধ হয়ে আসে। আমাকে আটকিয়ো না।
আমি আবার জানতে চাইলাম, তা হলে তুই ঠিকই করে নিয়েছিস, চলে যাবি?
ও বলল, হ্যাঁ, চলে যাব। চিরদিনের জন্য চলে যাব।
আমি আর মাথা ঠিক রাখতে পারলাম না। আমার চোখের সামনে একের পর এক ভেসে উঠতে
লাগল এই বয়সি মেয়েদের উপরে ঘটতে থাকা একের পর এক ন্যক্কারজনক ঘটনা। ভাবলাম,
মরার যখন জন্যই বেরোচ্ছে, তখন মরুক। আমি ওকে বললাম, যা। যাবিই যখন, যা।
চিরদিনের জন্যই যা।
ও হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। আমিও উঠে দাঁড়ালাম। ও আমার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে বলল, যাব?
আমি বললাম, হ্যাঁ। যা। একেবারে যা। বলেই, আমার মধ্যে হঠাৎ কী হল বুঝতে পারলাম না, ও কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমি ওর গলা টিপে ধরলাম।
তদন্তকারি অফিসারটি জিজ্ঞেস করল, গলা টিপে? তা হলে ওর ধ়ড় থেকে মুণ্ডুটা আলাদা করল কে?
— আমিই।
— কখন?
— মারার পর আমি বুঝতে পারলাম আমি কী করে ফেলেছি। কিন্তু তখন আর কোনও উপায়
নেই। নিজেকে পুলিশের হাতে সঁপে দিতেই পারতাম। কিন্তু দিলে, আমার সংসারটা
ভেসে যাবে। আমার আরও ছোট ছোট দুটো বাচ্চা আছে। তারা না খেতে পেয়েই মরে
যাবে। তাই নিজেকে কোনও রকমে সামলে ঝোপের আড়ালে ওর দেহটা লুকিয়ে রেখে বাড়ি
ফিরে এলাম। বউকে সব বললাম। ও সব শুনে হাউহাউ করে কাঁদল। তার পর ও-ই বলল,
পুলিশে ধরা পড়লে মুশকিল হবে। এমন একটা কিছু করতে হবে, যাতে তুমি ধরা না
পরো। আমাদের কিন্তু আরও দুটো বাচ্চা আছে।
সে দিনই ঠিক করি, ধড় থেকে ওর মুণ্ডুটা কেটে ফেলব। যাতে লোকেরা ভাবে, আরও
অনেক বাচ্চাদের মতো ওকেও কেউ তুলে নিয়ে গিয়ে বলি দিয়ে দিয়েছে।
— মুণ্ডুটা আপনিই কাটলেন?
— হ্যাঁ। রাত্রিবেলায় ও দিকে খুব একটা কেউ যায় না। তাই রাতের অন্ধকারে আমিই
কাটারি দিয়ে এক কোপে ওর দেহ থেকে মুণ্ডুটা আলাদা করে ফেলি।
— তা হলে মু্ণ্ডুটা কোথায়?
— ওর মুণ্ডু কাটার পর সেই মুণ্ডুটা খানিকটা দূরে নিয়ে গিয়ে একটা গর্ত করে তার মধ্যে আমি পুঁতে দিই।
— তা হলে ওর শরীরটা পোড়াল কে?
— ওর মা। মেয়েকে শেষ বিদায় জানানোর জন্য ওর মা-ই দুপুরবেলায় অর্ডার দিয়ে ওই
মালাটা বানিয়েছিল। সন্ধ্যার পর ওটা দিতে গিয়ে দেখে, মেয়ের দেহটা অনেকখানি
ফুলে গেছে। কতগুলো পোকামাকড় ওকে খুবলে খুবলে খাচ্ছে। ও সেটা সহ্য করতে
পারেনি। তাই বেশি দামে বিক্রি করার জন্য তিল তিল করে জমানো দশ লিটারেরও
বেশি কেরোসিন ভর্তি জারিকেনটা নিয়ে ও হাঁটা দিয়েছিল। মেয়ের গায়ে পুরোটা
ঢেলে দিয়ে দেশলাই জ্বালিয়ে কোনও রকমে ছুটে পালিয়ে এসেছিল।
— ও… তা হলে পালাবার সময়ই বোধহয় ওর রুমালটা পড়ে গিয়েছিল, না?
— হতে পারে। কারণ, ওর শরীরে আগুন লাগানোর সময় শক্ত থাকলেও তার পরেই ও খুব
ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ছুটতে ছুটতে বাড়ি ফিরে এসেছিল। এসেই, আমার বুকের উপরে
ঝাঁপিয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ও ভীষণ কেঁদেছিল। মাঝে মাঝেই আঁচল দিয়ে
চোখ-মুখ মুছছিল। ওর হাতে তখন কোনও রুমাল দেখিনি…
— প্রথমে যখন জেরা করেছিলাম, তখন এগুলো বলেননি কেন?
— বলিনি, কারণ, আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না এটা ঘটেছে। এবং আমিই সেটা
ঘটিয়েছি। তাই ওই ঘটনাটা আমরা দু’জনেই আমাদের জীবন থেকে একদম মুছে
ফেলেছিলাম। এতটাই নিখুঁত ভাবে মুছেছিলাম যে, আমাদের মাথা থেকেই ওটা উবে
গিয়েছিল। তাই ওই ঘটনা ঘটার পর দিনই, ও পালিয়ে গেছে মনে করে অন্যান্য বারের
মতো ওকে খুঁজতে পর্যন্ত বেরিয়েছিলাম। এবং তার পরও, প্রতিদিনই, আজ এখানে কাল
সেখানে ওকে খুঁজতে বেরোতাম। আর প্রত্যেক বারই বাড়ি ফেরার সময় দেখতাম,
মেয়ের জন্য তার মা দরজার সামনে একরাশ উদ্বেগ নিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে।
আমাকে আসতে দেখলেই ও ছুটে এসে জিজ্ঞেস করত, ও কোথায়?
আমি ছলছল চোখে বলতাম, না। বোড়কিকে কোথাও খুঁজে পেলাম না।
কেন জানি না, আমার বারবারই মনে হত, এটা একটা দুঃস্বপ্ন। যে কোনও সময় ভেঙে
যাবে। ঘুম থেকে উঠে দেখব, বোড়কি ছুটতে ছুটতে আমার বুকে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে…
ওই তো বোড়কি… ওই তো… ওই তো ছুটতে ছুটতে আসছে… ওই তো…
শিবকুমার যখন জবানবন্দি দিচ্ছে, ওর বউ তখন ভাঙা রেকর্ডের মতো একটাই কথা বার বার বলে যাচ্ছে, সব দোষ আমার… সব দোষ আমার… সব দোষ আমার…