
.
কবিতা বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় রস-সঞ্চারী শিল্প। যখন মলাটবন্দি হয়ে কবিতাগুলো পাঠকের হাতে আসে, তখন কবির মনোভূমি গৌণ হয়ে যায়। পাঠক তার নিজস্ব বোধ ও অভিজ্ঞতার আলোকে কবিতাকে নানাভাবে বিশ্লেষণের প্রয়াস পেয়ে থাকেন। ফলে শিল্প হিসেবে কবিতা কেমন, এই জিজ্ঞাসার জবাব ব্যক্তিভেদে স্বতন্ত্র। একজন সংবেদি পাঠক কেবল অনুভবের সরোবরে নিমগ্ন থেকেই কবিতার রূপ-রস-গন্ধ আস্বাদন করতে পারন।
সম্প্রতি কবি মতিন রায়হানের কবিতা পাঠ করতে গিয়ে অনুরূপ উপলব্ধির খেয়ায় ভেসেছি। বারবার পাঠেও যেন তাঁর কবিতার আবেদন ফুরিয়ে যায় না। স্বপ্ন-কল্পনা ও আবেগের স্তর পেরিয়ে তাঁর কবিতায় প্রতিভাত হয় বোধের বিন্যাস। ব্যক্তির মনে অন্তরঙ্গ ভাবতরঙ্গ সৃষ্টির প্রয়োজনে কবিতায় প্রযুক্ত হয়েছে নৈসর্গিক উপকরণ। বাংলা কবিতায় ধ্রুপদী ও সহজিয়া কাব্যধারার যে প্রবাহ আবহমান কাল ধরে প্রবহমান, বোধকরি মতিন রায়হান সে-পথের সচেতন সারণিক। তাঁর কবিতা পাঠকের মনে সৃষ্টি করে অলৌকিক আনন্দের অভাবিত অনুরণন। ফলে কবিতা ও কবিচৈতন্যের নিকটবর্তী থাকে এক নির্মোহ নির্লিপ্ত বাউলমন। বাংলার জলহাওয়ায় লোকজ অনুষঙ্গকে সঙ্গী করে তাঁর কবিতা নির্মিতি পেয়েছে। যেখানে দেশকাল, সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি, প্রেম ও মানবতাসহ জীবনের বিচিত্রপথের কৌতূহলী ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
কালের বিবেচনায় নব্বই দশেকের বাংলা কবিতায় মতিন রায়হানের (১৯৬৭-) আবির্ভাব। সাহিত্যের নানাশাখায় তাঁর কাজ থাকলেও কবিতার প্রতি তিনি অধিক সমর্পিত। গদ্য-পদ্য মিলে এযাবৎ তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ১৫টি। তন্মধ্যে কাব্যগ্রন্থ ৬টি। যেমন: তিতাস পুরাণ (১৯৯৬), পাতাকাহিনীর খোঁজে (২০০২), আগলে রাখি নদীর সম্ভ্রম (২০১২) নদীমগ্ন বাউলের গান (২০১৯), ও প্রেম মায়াগন্ধা (২০২১) এবং উড়ে যায় বসন্তের পাখি (২০২২)।
বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত মতিন রায়হানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'তিতাস পুরাণ' (১৯৯৬)। প্রথম হলেও প্রকাশের পর এই কাব্যগ্রন্থ সচেতন পাঠকের মনোযোগ পেয়েছে। কেউ-কেউ তাঁকে 'তিতাস পুরাণের কবি' অভিধায় ভূষিত করেছেন। ২৭ বছর আগে প্রকাশিত এই বইয়ে একজন তরুণ কবিকে আমরা আবিষ্কার করি। যিনি বয়সে তরুণ হলেও কবিতার ভাবসম্পদে মোটেও তরুণ ছিলেন না। বইটির শুরুতে দুটি ভূমিকা আছে। প্রথমটি লিখেছেন বাংলা একাডেমির ত ৎকালীন মহাপরিচালক মনসুর মুসা এবং দ্বিতীয়টি লিখেছেন 'তরুণ লেখক প্রকল্প'-এর প্রকল্প পরিচালক (বর্তমানে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক) কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। এই গ্রন্থে সর্বমোট ৪০টি কবিতা সন্নিবেশিত হয়েছে। কবিতাগুলো বিষয় ও প্রকরণে স্বতন্ত্র। বিশেষ করে কাব্যভাষায় অলঙ্কার প্রয়োগের অভীপ্সা লক্ষণীয়। গ্রন্থভূক্ত কবিতায় ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ, প্রেম-প্রকৃতি-মানবিকতা, স্বদেশ ও সমাজের নানা অসঙ্গতি মিথ-পুরাণের বাতাবরণে উপস্থাপিত হয়েছে। যৌবনে প্রকাশিত 'তিতাশ পুরাণ'-এর প্রথম কবিতায় কবি নিজেকে 'কালের অশোক' বলে ঘোষণা করেছেন। যেমন:
'তোমার যৌবনের দোলে আমার পৌরুষ
পৌরাণিক চাষা এক চষে যাই চুপ
লাঙল জোয়াল কাঁধে পৃথিবীর বুক
ইতিহাস-জমি চষি কালের অশোক।'
(প্রত্নগাথা/ তিতাস পুরাণ)
তিতাস নদীর আবহ গ্রন্থভূক্ত বেশকিছু কবিতায় ভিন্ন ব্যঞ্জনায় এসেছে। উপমা, রূপক কিংবা বাকপ্রতিমার আদলে কবি নিজের অন্তর্গত তাড়নাকে প্রকাশের অবকাশ পেয়েছেন। সন্দেহ নেই, 'তিতাস নদী'র তীরবর্তী জীবনপ্রবাহ তাঁকে প্রভাবিত করেছে। বাঙালির কৃষিভিত্তিক হাজার বছরের যে ইতিহাস, কবি সেই ইতিহাসকে সমীহ করে ভাসিয়েছেন তাঁর কবিতার ভেলা। নদীবিধৌত বাংলার চিরচেনা রূপ, চাষাবাদ প্রণালী ও শস্য উৎপাদনের প্রত্যাশায় মতিন রায়হান যেন এক স্বাপ্নিক কবি। অনাগত দিনের উজ্জ্বল সম্ভাবনা মেনে নিয়ে তাঁর কবিতা ক্রমশ এগিয়েছে। পরবর্তীসময়ে প্রকাশিত তাঁর কবিতাগুলো অনুরূপ বৈশিষ্ট্য ধারণ করেছে। 'জলকন্যা ও দূরন্ত আঙুল', 'একটি কাঙ্ক্ষিত সুদিনের স্বপ্ন', তন্মধ্যে অন্যতম। 'প্রত্নগাথা' কবিতার দ্বিতীয় স্তবকে কবি বলেন:
'ফসলকুমারী কন্যা তিতাসের তীর
বাজে গান ভাটিয়ালি গোমতী নদীর
আদিবাস হিমালয় হিমালয় রাণী
গোপন ঘুঙুর বাজে কুমার খঞ্জনি।'
মতিন রায়হানের কবিতার একটি বিশেষ প্রবণতা হচ্ছে, কবিতায় ব্যক্তিত্বারোপ করে কাব্যিক ব্যঞ্জনা তৈরি করা। সমালোচনার পরিভাষায় যাকে বলে 'personification'। নিসর্গশোভা থেকে উপমা ও রূপক অলঙকারের মাধ্যমে ব্যক্তিত্বারোপ করে তিনি বক্তব্য উপস্থাপনে প্রয়াসী হয়েছেন। তাঁর কবিতার পঙক্তিতে ব্যক্তিগত দুঃখবোধ ঝরে পড়ে। যদিও ব্যক্তিগত দুঃখবোধ শেষপর্যন্ত কবির নিজের থাকে না। কবির সঙ্গে পাঠকও দুঃখবোধে একাত্ম হয়ে যান। কবিতায় অপ্রাপ্তি, বৈষম্য কিংবা শোষণ-পীড়নে বিপর্যস্ত কবির মতো পাঠকও বিচলিত হবেন। যেমন:
'আমার নিজস্ব কোনো কষ্ট নেই
কসাইদোকানে তবু মাংস ঝুলে আছি
বাদুড়ও ঝুলে থাকে, নিশাচর পাখি,
… … … …
ডানা নেই ইচ্ছে হলে উড়ে যেতে পারি কোন বনের গভীরে
বৃক্ষরাণী বনদেবী পেতে দেবে পাতার আসন
যোগাসনে বসে যাবো, পাতার জিগিরে যাবে বিনিদ্র রজনী'
(কষ্টের কোলাজ/ তিতাস পুরাণ)
কিংবা,
'একটি সুদিন আসবে জানি
দুঃখ সেদিন থাকবে না আর
একটি গোলাপ ফুটবে জানি
আলতো ছোঁয়ায় প্রজাপতির'
(একটি কাঙ্ক্ষিত সুদিনের স্বপ্ন/ তিতাস পুরাণ)
'দুঃখবতী মেয়ে দুঃখবতী রাত' কবিতায় পতিতা শহরে দুঃখবতী নারীর অসহায়ত্ব উপস্থাপিত হয়েছে। 'লোলুপ নগর নেশানীল রথে' চড়ে ছুটতে থাকে। অগণন হাত নারীর শরীর খাবলে খেতে চায়। 'জলছবি' এই গ্রন্থের অনবদ্য একটি কবিতা। সন্দেহ নেই, এখানেও কবিতায় বর্ণিত দুঃখবোধের সঙ্গে পাঠক লীন হয়ে যাবেন। কবি মতিন রায়হান নিজেকে 'এক জন্মান্ধ দেবদারু' হিসেবে চিহ্নিত করেছন। বোধকরি এটি মতিন রায়হানের একটি উৎকৃষ্ট কবিতা। কবিতার কিয়দংশ উল্লেখ করা যেতে পারে:
'তোমার আছে অসংখ্য সবুজ বৃক্ষ
ভালোবাসায় নুয়ে পড়ার প্রবল প্রত্যয়ে
দাঁড়িয়ে সারি সারি
আমার তো তেমন কিছুই নেই
আমি এক জন্মান্ধ দেবদারু
নেই কোনো মোহন ডালপালা
ইচ্ছে হলেই যেখানে বসাতে পারি কোন গায়ক পাখি
সুরের সানন্দ উল্লাসে ভাসাতে পারি
… … … …
শরীরে-মননে, ভাবনার শিরা-উপশিরায়
আলোর ঔজ্জ্বল্য খোয়াতে খোয়াতে
মোহন কবিতা যেন হয়ে যাই
কোনো এক শিল্পীর আঁকা প্রিয়তম জলছবি।'
(দুঃখবতী মেয়ে দুঃখবতী রাত/ তিতাস পুরাণ)
মতিন রায়হানের কবিচৈতন্যে বাস করে এক নিমগ্ন বাউল। তাঁর সবকটি কাব্যগ্রন্থে এই নিমগ্ন বাউলের অন্তর্লোক উন্মোচন করার প্রয়াস লক্ষণীয়। বোধকরি প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'তিতাস পুরাণ'-এর 'একাকী বাউল' কবিতাটি এই নির্মোহ বাউলসত্তার প্রথম দৃষ্টান্ত। কবিতাটি পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। 'কোন উৎসের দিকে, কোন অস্তিত্বের দিকে' মানুষের নিরন্তর ছুটে চলা– কবিতায় তিনি তার উত্তর খুঁজেছেন। দ্বিধান্বিত কবির ভাষায়:
'আমার ভেতরে এক বাউল আছেন
ভেতরবাউল
আমাকে টানেন
প্রবল প্রতাপে নাড়ান, আমূল নড়ে উঠি
অদৃশ্য ইঙ্গিতে তার
হেঁটে যাই
একা একা যাই' (একাকী বাউল/ তিতাস পুরাণ)
'তিতাস পুরাণ' গ্রন্থের শেষদিকে 'তিতাসকন্যা' শিরোনামে একটি সিরিজ কবিতা রয়েছে। সনেটের আঙ্গিকে লেখা মোট ১৪টি কবিতা অন্ত্যমিলহীন। প্রতি লাইনে ১৪ মাত্রা আছে। তবে প্রচলিত সনেটের মতো এখানে অষ্টক ও ষটকের বিভাজন নেই। টানা ১৪ লাইনের এই সনেটবিন্যাস মতিন রায়হানের স্বতন্ত্র প্রয়াস। কবিতাগুলো ভাব ও প্রকরণের দিক থেকে অত্যন্ত সংহত। বোধকরি এই সিরিজ কবিতার ওপর ভিত্তি করে লেখক 'তিতাস পুরাণ' গ্রন্থের নামকরণ করেছেন। বইয়ের অন্য কবিতাগুলোর চেয়ে এই সিরিজ কবিতার ভাষাভঙ্গি আলাদা। কবি এখানে লোকজ ভাষায় লোকজ অনুষঙ্গের অলঙকার প্রয়োগ করেছেন। সিরিজের কবিতাগুলো 'তিতাসকন্যা'কে নিবেদিত বিধায় পঙক্তির ভাঁজে প্রণয়ের আকুতি ঝরে পড়ে। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের 'পরাণের গহীন ভিতর' পড়ার পর ঠিক অনুরূপ কবিতার স্বাদ পেলাম মতিন রায়হানের এই সিরিজ কবিতায়। কবিতাগুলো এতই অনবদ্য মুগ্ধকর যে, কিছু পঙক্তি এখানে উদ্ধৃত করছি।
ক.
চক্ষু বন্ধ কইরা দ্যাহো, ব্যাধের তীরের
লাহান বিন্ধা রইছে তোমার আঘাত
এই বুকে- তীরবিন্ধা পইখের পরান! ('তিতাসকন্যা'-এক/ তিতাস পুরাণ)
খ.
যতই সরাইতে চাও চক্ষের আড়ালে
ততই আসুম কাছে, ল্যাংরা কাঁটা হইয়া
বিন্ধা থাকুম তোমার শাড়ির আঁচলে; ('তিতাসকন্যা'-চার/ তিতাস পুরাণ)
গ.
তোমারে পাওয়ার জন্যি করছি মানত
অই দরগা খরমপুর, কল্লাসৈয়দ
বাবা কও তারে কও ইশারায়, য্যান
সে আমার ষোলআনা পরান বান্ধব
হয়্যা যায়, নইলে যাদুটোনা করমু কিন্তু ('তিতাসকন্যা'-সাত/ তিতাস পুরাণ)
'পাতাকাহিনীর খোঁজে' (২০০২) মতিন রায়হানের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। উৎসর্গপত্রে উল্লেখ রয়েছে অসংখ্য কবি-সাহিত্যিকের নাম। যাঁদের কাছে তিনি ঋণস্বীকার করেছেন। 'তিতাস পুরাণ' গ্রন্থের তুলনায় এই গ্রন্থে তাঁর কাব্যবিন্যাস যেন আরও পরিণত। বিশেষ করে কবিতার ভাষা নিয়ে তাঁর সচেতন প্রয়াস লক্ষণীয়। গ্রন্থের ফ্ল্যাপে উল্লিখিত লেখাটি মতিন রায়হানের কবিতা ও কবিসত্তা শনাক্ত করার ক্ষেত্রে যথার্থ উচ্চারণ বলে মনে করি। এখানে সময়ের অন্য কবিদের সঙ্গে তাঁর তফাৎ ও কাব্যযাত্রার ধরন সম্পর্কে জানা যাবে। যেমন:
'মতিন রায়হান কবি---আশির নখর কবি, নিভৃতচারী। বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকের কাব্য-আন্দোলনের শীর্ষ সারিতে তাঁর অবস্থান। জটিল যুগযন্ত্রণা ও প্রযুক্তিবিশ্বের ডামাডোলেও তিনি স্থিত, মিতবাক ও ঐতিহ্য-সন্ধানী। বাংলা কবিতার হাজার বছরের অর্জিত অহঙ্কারকে ধারণ করেও তিনি এক স্বতন্ত্র কাব্যভাষার স্রষ্টা'।
দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি দায়বদ্ধ কবির অনবদ্য উচ্চারণ 'পাতাকাহিনীর খোঁজে'। এই গ্রন্থে মতিন রায়হান আরও বেশি নৈর্ব্যক্তিক হয়ে ওঠেছেন। কবিতায় শিল্পসৌন্দর্যের দীপ্তি ছড়াতে চেয়েছেন। গ্রন্থভূক্ত কবিতাগুলোয় পাঠক শেকড়সন্ধানী কবিকে আবিষ্কার করেবেন। গ্রন্থের নামকবিতা 'পাতাকাহিনী'-তে পাতার প্রতীকী উপস্থাপনে কৌতূহলী পাঠক খুঁজে নিবে অতীত ও অধরা জীবনের গোপন বাতায়ন। যেমন:
'ভেতরে কী নাম লেখা সে-কথা জানা কি খুব প্রয়োজন?
পাতার আশ্রয়ে কবি ত্রস্ত হাতে লিখেছেন জানি
চর্যার আগের ইতিহাসে তার সাক্ষ্য বহমা;
পাতাও পাখির মতো উড়ালের স্মৃতিকথা ভাবে' (পাতাকাহিনী/ পাতাকাহিনির খোঁজে)
'আগলে রাখি নদীর সম্ভ্রম' (২০১২) মতিন রায়হানের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ। 'তিতাস পুরাণ'-এ আমরা যে নদীমগ্ন কবিসত্তার প্রকাশ দেখেছি, এই গ্রন্থে নদীকেন্দ্রিক তাঁর নিবিড় অনুধ্যান আরও বেশি হার্দিক, আরও বেশি পরিণত। কবিতায় ক্রমশ 'নদী' এক গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ হয়ে ওঠেছে। নদীকে নানামাত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি অর্থবহ করে তুলেছেন। কবির চোখে প্রবহমান নদী জীবনের ভিন্ন-ভিন্ন রূপবৈচিত্র্য নিয়ে ধরা দিয়েছে। নদীকেন্দ্রিক উপলব্ধি কখনো উপমায়, কখনো রূপক, কখনো চিত্রকল্প কিংবা প্রতীকের দ্যোতনায় স্বতন্ত্র চরিত্র হয়ে পাঠকের মনোযোগ পেয়েছে। 'জ্যোৎস্নার জোয়ারে ধাবমান ডিঙি'র বাকপ্রতিমায় কবি জীবনের মর্মার্থ অন্বেষণের প্রয়াস পেয়েছেন। যেমন:
'সাধুসন্তের জীবন খুঁজিনি কখনো, শ্রমে আর ঘামে-ভরা জীবন/
টিম টিম জ্বলে। জ্যোৎস্নার জোয়ারে ধাবমান ডিঙি/
কোনো এক গেরিলার সতর্ক দু'চোখ; রাত আর দিন ব্যবধানহীন!/
ছুড়তে ছুড়তে জীবনকে করেছি জীবনের কাছে ঋণী…'/
(একটি পুরনো গল্প/ আগলে রাখি নদীর সম্ভ্রম)
কিংবা,
'একেকটি নদীকে বুকপকেটে পুরে আমি কতবার ছুটে গেছি/
সমুদ্রের কাছে; সমুদ্র আমাকে শুনিয়েছে/
পলাশ শিমুল আর বর্ণমালার গান
উত্থান ও ভাঙনের দৃশ্য দেখতে দেখতে
আমিও আছড়ে পড়েছি সমুদ্রের নোনা তটে
যেন এক দূরন্ত সী-গাল'
(নদী ও সমুদ্রের গান/ আগলে রাখি নদীর সম্ভ্রম)
চতুর্থ গ্রন্থ 'নদীমগ্ন বাউলের গান' (২০১৯)। এই গ্রন্থের শিরোনামেও নদীমগ্ন বাউলের উদ্ভাস লক্ষণীয়। আদতে নদীমাতৃক বাংলার বিস্তারিত রূপসৌন্দর্য্য, জীবনযাপন ও সংস্কৃতিনির্ভর অনুষঙ্গ মতিন রায়হানের কবিতায় বিশেষ প্রবণতা হিসেবে ধরা দিয়েছে। বলা যায়, এই বিশেষ প্রবণতা তাঁর কবিতাকে ভাষা ও বোধের জায়গায় স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত করেছে। নদীর প্রতি সমর্পিত কবির উচ্চারণ:
'নদীর কাছে মন রেখেছি জমা
ও নদী তুই কোন খেয়ালে থাকিস?
মাছের মতো আগলে কাছে রাখিস
ভালোবাসি, তুই যে প্রিয়তমা!'
(নদী/ নদীমগ্ন বাউলের গান)
কিংবা,
'তোমরা যারা দু'চার পঙক্তি লিখে এই মহানগরে বসে
মহা উচ্ছ্বাসে ডুগডুগি বাজাও
কখনো কি ভাবো এর বাইরেও আছে
বিশাল এক বাংলা
যেখানে নদীর ঢেউয়ের মতো অগণন শব্দরাশি
কলকল ধ্বনি তোলে রোজ
যেখানে বাউলের একতারা প্রতিদিন রচনা করে
সুরের বিবিধ ব্যঞ্জন'
(এক প্রান্তজনার গান/ নদীমগ্ন বাউলের গান)
বাউল যেমন নির্মোহ সহজিয়া জীবনপ্রবাহে জীবনের আসল সত্যকে উপলব্ধি করেন। 'নদীমগ্ন বাউলের গান' গ্রন্থে আমরা অনুরূপ অনুভূতিসঞ্জাত কবিতার দেখা পাই। যেখানে কবি মতিন রায়হানের অধ্যাত্মচেতনাও দুর্লক্ষ্য নয়। 'প্রভুর সঙ্গে এক অধম বান্দার বোঝাপড়া' কবিতাটি তার উজ্জ্বল উদাহরণ।
'ও প্রেম মায়াগন্ধা' (২০২১) পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ। বিভিন্ন কারণে এই গ্রন্থের কবিতাগুলো বিশিষ্টতা পেয়েছে। বিষয় ও শৈলীগত দিক থেকে এই গ্রন্থ পাঠকের মনে নতুন অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির জন্ম দিবে। প্রবহমান মুক্ত অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত কবিতাগুলোয় আখ্যানের ইঙ্গিত রয়েছে। প্রতিটি কবিতার শুরুতে একটি স্বতন্ত্র পঙক্তি সংযোজন করে পৃথক পর্ব নির্দেশিত হয়েছে। শুরুর পঙক্তিটি যেমন সংবেদি তেমনই চিত্তাকর্ষক। যেমন:
'আমি রোদের সকাল থেকে তুলে আনি জীবনের মধু!
পাঠসূত্রে নদীকে রেখেছি, পাঠ নিতে পারো বৃক্ষেরও;
নদী-বৃক্ষে, কোমলে-কঠোরে, খুব মেশামেশি; আগন্তুক
… … … …
পৌঁছে দাও পাতার সবুজে! এলো পরাগায়নের দিন
ডানা মেলে ফুল্লসখা, ছন্দে ছন্দে নাচে প্রজাপতি-বধূ'
(ও প্রেম মায়াগন্ধা/ ও প্রেম মায়াগন্ধা)
গ্রন্থভূক্ত অধিকাংশ কবিতা প্রেমনির্ভর। তবে ব্যক্তিক অনুভূতির বাতাবরণে এই গ্রন্থেও রয়েছে বিচিত্র বিষয়ের সমাহার। স্মরণীয় ব্যক্তিদের প্রতি নিবেদিত কিছু কবিতা তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য। যেমন- 'বঙ্গবন্ধু', বোনের গল্প', 'রবীন্দ্রনাথ', 'লালন সাঁই', ও 'সাধক মনোমোহন দত্ত'।
মতিন রায়হানের প্রতিটি কাব্যগ্রন্থে সচেতন অভিনিবেশ লক্ষণীয়। তাঁর কবিতার উপজীব্য স্বদেশ ও সমকালের বৃহৎ ক্যানভাস হলেও প্রকাশের অভিজ্ঞতা আলাদা। শব্দচয়ন ও পঙক্তিবিন্যাসে তিনি ছন্দকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। তাঁর সর্বশেষ প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ 'উড়ে যায় বসন্তের পাখি' (২০২২)। এই গ্রন্থের কবিতাগুলো তিনটি পর্বে স্বতন্ত্র শিরোনামে সন্নিবেশিত হয়েছে। যেখানে একজন সমকাল সচেতন কবির অন্তর্দাহ প্রকাশের পাশাপাশি 'প্রেম, প্রকৃতি, স্বপ্ন, সম্ভাবনা' উচ্চকিত হয়েছে। প্রথম পর্বের শিরোনাম 'বিশ্রম্ভালাপ'। শিরোনাম থেকেই আন্দাজ করা যায় এই পর্বের কবিতাগুলো প্রণয়ালাপ নির্ভর। কবির স্মৃতিকাতরতার বাতাবরণে এসেছে অভিজ্ঞতালব্ধ অনুভূতি। প্রেম ও কামের কৌশলী বয়ান কবিতাকে ভিন্ন ব্যঞ্জনায় দাঁড় করিয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে এই পর্বের কিছু পঙক্তি উদ্ধৃত করছি:
ক.
'তোমার সাফল্যে কোনো খেদ নেই আমার
কেবল আনন্দ আর আনন্দ…
আমি তো বিনা মেঘে বজ্রপাতে এক আহত মানুষ! তবুও ক্লেদাক্ত জীবনের রঙিন ফানুস ওড়াই! আপাতত চুম্বনেই সীমারেখা টানো!'
(তোমার চুমুর গন্ধ/ উড়ে যায় বসন্তের পাখি)
খ.
এই হাত শুধু শাখা-প্রশাখা নয়
ছুঁতে চায় মূলকাণ্ডসহ সমগ্র শরীর
শরীরের জন্যে কাঁদে শরীরের শিরা-উপশিরা
রহস্য আড়ালে থাকুক
জীবনের গোপন ইচ্ছের মতো
সন্ধ্যাভাষার সমূহ পদাবলি
হে রাজ্ঞী, পাঠ করো বিনিদ্র রাতে
নিবিড় অধ্যয়ন ছাড়া সবকিছু রসাতলে!
(এই হাত/ উড়ে যায় বসন্তের পাখি)
গ্রন্থের দ্বিতীয় পর্বের শিরোনাম 'করোনা-কুহক'। একজন সচেতন কবি সময়ের অভিঘাত এড়িয়ে যেতে পারেন না। ২০১৯ এর শেষদিকে বিশ্বজুড়ে অতিমারী করোনার কারণে অসংখ্য মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। সেসময় মানুষকে সম্পূর্ণ নতুন এক অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। কবি মতিন রায়হান বিভীষিকাময় সেইসময়ের অনুভব ও চিত্র কাব্যভাষায় তুলে ধরেছেন। মৃত্যুর কাছে মানুষের অসহায়ত্বের উপলব্ধি কবিতায় এসেছে। করোনার কবলে পড়ে মানুষের যে অবর্ণনীয় উৎকণ্ঠা, সেটা কবিতায় গুরুত্বপূর্ণ দলিল হয়েছে বৈকি। এই পর্বের কবিতাকে 'মৃত্যুচিন্তাসহ জীবন ভাবনার বিচিত্র উপলব্ধির কবিতা' হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। যেমন:
ক.
গভীর কান্নার পর ঝিম মেরে আছে সভ্যতা!
অদৃশ্য আগুন, জ্বলছে দাউ দাউ
করুণ কান্নায় গলে যায় পিচ
সড়কে সড়কে মড়কের ঢেউ
একটা স্বপ্ন উড়তে উড়তে পাখি হয়ে যায়!'
(কফিনের কান্না/ উড়ে যায় বসন্তের পাখি)
খ.
পৃথিবীর কঠিন অসুখ আজ। এই সঙ্গনিরোধকালে
কী করে তুমুল চুম্বনে শুশ্রূষার গল্প বুনি?
নলখাগড়ার বনে ঢুকে পড়েছে বিষাক্ত ফণী
চিঁচিঁ রবে ডাকছে পক্ষীশাবক
কে বাঁচাবে? তুমি না আমি?
নগরের রাজপথগুলো মৃগী রোগীর মতো ঝিমুচ্ছে!
যেন জমাটি অন্ধকার ভর করে আছে গ্রহটিকে!
পৃথিবীর কঠিন অসুখ আজ!
(এই সঙ্গনিরোধকালে/ উড়ে যায় বসন্তের পাখি)
তৃতীয় পর্বের শিরোনাম 'বোধিবৃক্ষের ডালপালা'। এই পর্বের কবিতাগুলো চলমান জীবনের শিল্পভাষ্য। দৈনন্দিন জীবনে ঘটে যাওয়া সাধারণ ঘটনাপ্রবাহের ভেতর যে অসাধারণ উপলব্ধি লুকিয়ে থাকে। কবিতাগুলোয় তার স্বরূপ বাঙময় হয়ে ওঠেছে। 'কুরচিগাথা' 'নগরতত্ত্ব' 'আফগানিস্তান' 'সম্পর্ক' 'ছায়াকাহিনী' ও 'বিজয় দিবসের গান' এই পর্বের উল্লেখযোগ্য কবিতা। সম্প্রতি শুভ উদ্বোধন হলো পদ্মাসেতু। এই পর্বে 'পদ্মা' ও 'পদ্মা থেকে গড়াই' শিরোনামে লেখা অনবদ্য দুটি কবিতা স্থান পেয়েছে। যেমন:
'নদীও সমুদ্রে মেশে; দ্বিধাগ্রস্ত আমরা কেবল!
পদ্মা পাড়ি দিয়ে কারা যায় লালনের দেশে? গগন
হরকরার কণ্ঠে আজও তবে ঢেউ খেলে বাউলা
বাতাস! মনে মনে ছেপে যাই 'গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা';
আমি যেন কাঙাল হরিনাথের উত্তর-প্রজন্ম, জ্ঞাতি।' (পদ্মা থেকে গড়াই)
সর্বোপরি, মতিন রায়হান কাব্যচর্চার শুরু থেকেই নিজস্ব কাব্যস্বর নির্মাণে অন্বেষী ছিলেন। তাঁর কবিতার বিষয়ে যেমন দর্শনবোধ প্রযুক্ত হয়েছে, তেমনই স্বতন্ত্র কাব্যভাষা নির্মাণের ভেতর দিয়ে তিনি কবিতায় পৃথক পথ তৈরিতে সচেষ্ট ছিলেন। বিশেষ করে তাঁর কবিতায় বাঙালি ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিসংলগ্ন প্রচুর অনুষঙ্গ অলঙ্কার হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। উপমা, রূপক ও চিত্রকল্পসহ বিভিন্ন শব্দালঙ্কার ও অর্থালঙ্কারের প্রয়োগ তাঁর কবিতাকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। একজন কবি যদিও পাঠক কিংবা সাহিত্যসমালোচকের হাততালি পাওয়ার প্রত্যাশায় কাব্যচর্চা করেন না, তবুও আমরা পাঠক হিসেবে তাঁকে অভিনন্দিত করি। মতিন রায়হান, আপনাকে অভিনন্দন। আপনি আমাদের ধ্রুপদী সহজিয়া কাব্যধারার অন্যতম রূপকার।
……
ফারুক সুমন
কবি-প্রাবন্ধিক