০১.১.
একজন দীর্ঘদেহী মধ্যবয়স উত্তীর্ণ পুরুষ প্রচণ্ড অন্ধকারাচ্ছন্ন ঝড় বৃষ্টির একটি রাতের প্রায় শেষ দিকে সমান্তরাল দু’টি রেললাইনের মাঝ দিয়ে প্রবল বেগে দৌড়ে চলেছে সামনের দিকে, শুধুই সামনের দিকে।ডান, বাম অথবা পশ্চাৎ- কোনো দিকেই তাঁকাবার প্রয়োজন মনে করছে না, এমন কি রেল লাইনের মাঝ দিয়ে বেছানো রাশি রাশি পাথরের টুকরো আর স্লিপার গুলির দিকেও মোটেই ভ্রুক্ষেপ করছে না- অথচ যেগুলি যে কোনো মুহুর্তে ওর জন্যে মারাত্মক দূর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে, মুখ থুবড়ে পড়ে যেতে পারে ও ওই পাথর গুলির ওপর।সে ক্ষেত্রে আহত হতে পারে ও, ক্ষত বিক্ষত হয়ে যেতে পারে, অধিকন্তু দ্রুতগতির ট্রেনও এসে পড়তে পারে যে কোনো মুহুর্তে- বিচিত্র কিছুই নয়।তবুও ও শুধু দৌড়–চ্ছেই।মাঝে মাঝে চমকিত বিদ্যুতের আলোতে যতটুকু দেখা যায় সে টুকুই যেন ওর খুব বড় ভরসা।এবং এ ভরসা টুকুর ওপর ও যে দারুণ আত্মবিশ্বাসী সেটি ওর দৌড়োনোর ভঙ্গি দেখেই বোঝা যায়।মুষলধারে অব্যাহত বৃষ্টিপাত, এর ওপর বাতাসের একটানা প্রচণ্ড গতিবেগ, বিদ্যুত চমকের পরপরই মেঘের ভয়ংঙ্কর আকাশ বিদীর্ণ করা গর্জন- কোনো কিছুই যেন ওর দৌড়োনোর গতিকে রোধ করতে পারছে না।বরং কখনও কখনও মনে হচ্ছে দৌড়োনোর গতি যেন ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে ওর।কোথাও কোনো জন মানবের চিহ্ন নেই, নেই কোনো হিংস্র জীব জন্তুর অস্তিত্ব- যারা কিনা ওকে অকস্মাৎ আক্রমণ করে বসতে পারে- তারপরেও ও ভীত, ভীষণ রকমের ভীত- কিন্তু এসব কারণে নয়, ওর ভীতির জায়গাটি অন্যখানে।এত ঝড় বৃষ্টির উন্মাদ তা-ব, বাতাসের এত প্রবল তোড়, কোথাও নিশ্চিত বিদ্যুত পতনের ধ্বংসলীলা- এ সবের কোনো কিছুতেই ওর বিন্দুমাত্র ভীতি নেই।ভীতি কেবল ওর পশ্চাৎ-তাড়নাকে।ওর মনে এ বিশ্বাস স্থির হয়ে গেঁথে গেছে যে, পেছন থেকে দুর্বার গতিতে ওকে তাড়া করে ধেয়ে আসছে অশরীরি একটি ভয়াল ‘মৃত-আত্মা’- ওরই মৃত্যুদূত হয়ে- যে কিছুতেই বাঁচতে দেবে না ওকে।কিন্তু কেন মৃত্যু ওকে তাড়া করছে, কেন ওকে বাঁচতে দেবে না- সেটি কেবল লোকটিই জানে।আর কারও পক্ষেই সেটি জানা সম্ভব নয়।আত্মাটি নারী কি পুরুষের তা-ও জানা সম্ভব নয় লোকটি নিজে থেকে না জানালে।
লোকটি পঞ্চাশোর্ধ।সুঠাম দেহ, দীর্ঘকায়।শরীরের রং একেবারে ফর্সা না হলেও কালো তো নয়ই, শ্যামলও নয়।বলা যায় মোটামুটি শ্যামল আর ফর্সার মাঝামাঝি।লোকটির পড়নে সাদা ফুলপ্যান্টের সাথে ম্যাচ করে কালো শার্ট ইন করা।শার্টের ওপর হাটু অবধি প্রলম্বিত অর্ধ-হাতা একটি সাদা এ্যাপ্রন।এ্যাপ্রনটি ইঙ্গিত করে লোকটি একজন চিকিৎসক।হ্যাঁ, আসলেও তাই- লোকটি প্রকৃতই একজন উচ্চ শিক্ষিত চিকিৎসক এবং Surgery and Medicine Specialist.Operation Theatre থেকে অতিদ্রুত বেরিয়ে কাউকে কিছু না বলে, ডান বাম কোনো দিকেই না তাঁকিয়ে কতকটা যেন উদভ্রান্তের মতো সোজা সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করেছে।চোখে মুখে স্পষ্ট একটি ভীতির ছাপ।হাঁটতে হাঁটতে ভীতিসঙ্কুল দৃষ্টি নিয়ে পেছন ফিরে দু’বার তাকাবার চেষ্টা করেছে লোকটি।এরপর হাঁটার গতি বৃদ্ধি পেয়েছে ক্রমান্বয়িকভাবে।এক পর্যায়ে এসে হাঁটার গতিটি দৌড়ের গতিতে রূপান্তরিত হয়েছে।কিন্তু আর পেছন ফিরে তাকায়নি লোকটি।বলা যেতে পারে উর্দ্ধ-গতির দৌড়ের কারণে পেছন ফিরে তাকাবার আর কোনো সুযোগই জোটেনি ওর।
এক সময় ধীরে ধীরে দৌড়ের গতি স্তিমিত হয়ে আসে লোকটির।শ্বাস প্রশ্বাসের গতিও একটু একটু করে স্বাভাবিক হয়ে আসে।লোকটি পৌঁছে যায় একটি Ship-Yard-G| IB Yard এ সাধারণতঃ জাহাজ মেরামত করা হয়।আবার অর্ডার থাকলে অর্ডার অনুযায়ী নতুন জাহাজ নির্মাণও করা হয়।আকাশে প্রভাতী সূর্যের উদিত হবার সময়ও হয়ে গেছে।কিন্তু অবিরাম বৃষ্টি আর মেঘাচ্ছন্ন আকাশের কারণে প্রভাতী সূর্যের অপরূপ মোহনীয় মাধুর্যটি প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব হয় না লোকটির।যতবার তাঁকাবার চেষ্টা করে পূব আকাশের দিকে ততবারই ব্যর্থ হতে হয় লোকটিকে।দেখা মেলে না পূব আকাশের শেষ কোণে সুপ্রভাতের আগমনী বার্তা নিয়ে ফুটিত সেই চিরায়ত রক্তিম আলোক সম্ভারের।
০১.
এই Ship-Yard GB Ship-Yard জাহাজ ঘাটের দূরত্ব প্রায় চার কিলোমিটারের কাছাকাছি।লোকটি ওইShip-Yard--এ খুব বেশীক্ষণ থাকলো না।শুধু চারদিকটি একটু ভালো করে দেখে নিয়ে বৃষ্টির ভেতর দিয়েই আবার হাঁটতে শুরু করলো জাহাজ ঘাটের দিকে।সর্বাঙ্গ শরীর ভেজা।পরনের কাপড় চোপড় ভিজে একেবারে জবুথবু।বৃষ্টির পানিতে ভিজে গায়ের এ্যাপ্রনটির ওজনও বোধকরি কয়েকগুণ বেড়ে গেছে।ওটিকে বহন করাই যেন এখন লোকটির কাছে অতিরিক্ত আর একটি সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।প্রগাঢ় প্রতিভাধর এ লোকটি এখন সকরূণ দৃষ্টি মেলে শুধু একটি লঞ্চের দিকে এগিয়ে আসছে- হয়তো কোথাও যাবার জন্যে, যদিও কোথায় যাবে নিজেই জানে না লোকটি।আর আরও আশ্চর্যের- কোনোক্রমেই যার এভাবে লঞ্চের দিকে হেঁটে আসবার কথা নয়।অথচ হেঁটে আসছে সেই অপরিমেয় প্রতিভার অধিকারী এ মানুষটি- যেখানে এখন সে একেবারেই অসহায়।
সবার ভেতর সমান মাত্রার প্রতিভা থাকে না।‘প্রতিভা’কে আমরা সাধারণভাবে ঈশ্বর প্রদত্ত অতিউচ্চ মানের জ্ঞানের পরিধিকে বুঝে থাকি।যা সাধারণতঃ ব্যক্তি বিশেষের মননে সুপ্ত অবস্থায় থাকে এবং যাকে সেই ব্যক্তিবিশেষ কর্তৃক বিকশিত করতে হয় তার চিন্তারাশির সঞ্চরণশীল ক্ষমতাকে সর্বোচ্চ মাত্রায় স্থাপিত করে- আর এ লোকটি সে প্রতিভারই একজন জান্ত্যব প্রতিনিধি।এতক্ষণ ধরে অতি দ্রুত হেঁটে আসা এ লোকটি যাত্রী বোঝাই একটি লঞ্চের সামনে এসে দাঁড়ালো।কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে প্রচ- ভীড় ঠেলে যাত্রীদের লঞ্চে উঠবার মরণ-পণ যুদ্ধের মর্মটি উপলব্ধি করবার চেষ্টা করলো।তারপর নিতান্তই একজন দীনহীন অসহায় মানুষের মতো লঞ্চটিতে উঠবার লক্ষ্যে ধীর পায়ে লঞ্চটির দিকে এগুতে থাকলো।লঞ্চটির গন্তব্য কোথায়, কোন ঘাটে ভিড়বে, কখন ভিড়বে অথবা আদৌ ভিড়বে কি না- কিছুই জানে না লোকটি।তবুও এক সময় অতীব কষ্টে লঞ্চটিতে উঠে পড়লো লোকটি।লঞ্চটিতে উঠে সোজা ডেকের ওপর গিয়ে ডেকের রেলিং ধরে দাঁড়ালো।কেটে গেলো অনেকটা সময়।জানবার প্রয়োজনও বোধ করলো না লোকটি- কতটা সময় কেটে গেছে এর মধ্যে।
০১.২.
কিছু আগে লঞ্চটি চলতে শুরু করেছে।এর মধ্যে গতিও বৃদ্ধি পেয়েছে বেশ কিছুটা।পুরুষ আর মহিলা যাত্রী দিয়ে লঞ্চটির ডেক পরিপূর্ণ।এ যেন ঠিক রবীন্দ্রনাথের- ‘ঠাঁই নেই ঠাঁই নেই ছোট সে তরী’র মতো বাস্তবতা।এরই মধ্যে কেউ কেউ জটলা পাকিয়ে ডেকের মেঝের ওপর বসে উচ্চৈস্বরে কথাবার্তা বলছে, কেউবা ডেকের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত খুবই উদ্বিগ্নতার সাথে মানুষের প্রচণ্ড ভিড় ঠেলে দ্রুত গতিতে ছুটোছুটি করে কাউকে হয়তো খুঁজে পাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে কান্না শুরু করে দিয়েছে।কান্না জড়ানো কণ্ঠে এর ওর কাছে ওর কাঙিক্ষত মানুষটির খোঁজটি জানাবার আকুতি জানাচ্ছে।পাশাপাশি এক বাদাম বিক্রেতার সাথে এক যাত্রীর কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে যাত্রীটি কর্তৃক বাদাম বিক্রেতার গালে একটি চড় মারবার পরপরই যাত্রীদের ভেতরও তীব্র উত্তেজনা, কেউ বাদাম বিক্রেতাটির পক্ষে আবার কেউ বা বিপক্ষে।চূড়ান্ত পর্যায়ে যাত্রীদের মধ্যেই সংঘর্ষ বেধে যাবার উপক্রম।কেউ কেউ বা আবার সে সবকে গুরুত্ব না দিয়ে ডেকের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নদীর সৌন্দর্য দেখছে।বিপরীত গতির বাতাসের প্রবল তোড়ে ওদের শরীরের সাথে লেপ্টে থাকা জামা কাপড়ও যেন উড়ে যেতে চাইছে।তবুও ওরা এই বাতাসের পৃষ্ঠে আরোহণ করে নিজেরাও ভেসে যেতে চাইছে কোন সুদূরের নীলিমার ওপারে।ডেকের ওপরে অসংখ্য মানুষের চিৎকার, চ্যাচামেচি, ঝগড়া ঝাটি আর হাসি, কান্নার বিচিত্র শব্দের সাথে মিশে গিয়ে লঞ্চের ইঞ্জিনের ভয়াবহ বিকট শব্দ যেন এক অভূতপূর্ব অসহ্য সচলমানতা যা মুহুর্তের জন্যেও থামছে না।বরং বৃদ্ধি পাচ্ছে অতি দ্রুত মাত্রায়।
কিন্তু সে সবের দিকে ডেকের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই বিশেষ ব্যক্তিটির বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই।রেলিং-এর ওপর দু’হাতে নিজের ভেজা এ্যাপ্রনটি ধরে রেখে পলকহীন তাঁকিয়ে আছে সম্মুখের মহাশুন্যতার দিকে।বিপরীতমুখি বাতাসের গতিতে এ্যাপ্রনটি উড়ছে।কিছু পরেই হয়তো এ্যাপ্রনটিসহ তার গায়ের জামা কাপড়ও শুকিয়ে যাবে।কিন্তু ওর চোখের দৃষ্টিতে এবং কর্ণের শ্রবণে নদীর জলের প্রবাহ, সে প্রবাহে সে জলের তরঙ্গ, মূহর্মূহু তরঙ্গ-সমূহের ভেঙ্গে পড়বার উচ্ছ্বসিত শব্দ, বিপরীত দিক থেকে বেয়ে আসা দু’একটি ইঞ্জিন চালিত ছোট নৌকো- কিছুই যেন কোনো প্রতিক্রিয়াই সৃষ্টি করছে না ওর মধ্যে।ওর শুন্য-দৃষ্টি চোখের দিকে তাঁকিয়ে কোনো কিছুই বুঝবার উপায় নেই।তবুও অনেকক্ষণ তাঁকিয়ে থাকলে শুধু এটুকুই বোঝা যায়- লোকটি হয়তো প্রচ- হতাশায় আক্রান্ত।
লোকটি যেখানে দাঁড়িয়ে ঠিক তার পেছনে কিছু দূরে নিজেদের মধ্যে একটি বৃত্ত রচনা করে একজন মধ্য বয়সী পুরুষ এবং চারজন তরুণী নিজেদের মধ্যে কিছুটা নীচু স্বরে কি যেন কথাবার্তা বলছে।কিন্তু লোকটি যখন লঞ্চের ডেকের ওপর উঠে
০২.
রেলিং-এর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ঠিক তখন থেকেই ওই চারজন তরুণীর মধ্যে থেকে একজন তরুণী ওই লোকটির দিকে বার বার করে তাঁকাবার চেষ্টা করছে।কিন্তু লোকটির পেছন থেকে কিছুতেই বোঝা যাচ্ছে না লোকটি কে আর কোত্থেকেই বা এসেছে ? অথচ কেন জানি মেয়েটির মনে হচ্ছে লোকটিকে ও চেনে।কোথায় যেন লোকটিকে দেখেছে।কিন্তু স্মৃতির ফ্রেম থেকে কোনোভাবেই তুলে এনে স্থাপন করতে পারছে না লোকটির পূর্ণাঙ্গ অবয়বটিকে ওর দৃষ্টির ফ্রেমটিতে।বারবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে।এভাবেই কেটে গেছে বেশ কিছুটা সময়।সময় যতটা অতিক্রান্ত হয়েছে ততটাই অস্থির হয়ে উঠেছে মেয়েটি।বিষয়টি ওর সাথে থাকা অন্য চারজনও লক্ষ্য করেছে, প্রশ্নও করেছে ওকে।মেয়েটি কোনো উত্তর দেয় নি।কিন্তু লোকটির কাছে যাবার সাহস হয়নি মেয়েটির; কাছে গেলে যদি হিতে বিপরীত হয়ে যায়, যদি অনাকাক্ষিত কিছু ঘটে যায় ! দ্বিধা দ্বন্দের দোদুল্যমানতার ভেতর দিয়ে আরও কিছুটা সময় অতিবাহিত হয়েছে।আর দেরী করেনি মেয়েটি, সিদ্ধান্ত নিয়েছে লোকটির সামনে গিয়ে ও দাঁড়াবেই।মেয়েটির নিম্নাঙ্গে আঁট্ সাঁট্ একটি জিন্সের প্যান্ট এবং উর্দ্ধাঙ্গে একই রকমের আঁট্ সাঁট্ লাল টিক্ টিকে অর্দ্ধ-হাতা লিলেনের গেঞ্জি।মেয়েটি দেখতে প্রকৃত সুন্দরী বলতে যা বোঝায় তাই।একবার ওর দিকে তাঁকালে দ্বিতীয়বার আবারও তাঁকাতে ইচ্ছে করে।দীর্ঘ শরীর, সুঠাম দেহ, উজ্জ্বল ফর্সা রং-এ আবৃত, পুরু ঠোঁট, উন্নত বক্ষ আবরিত লাল গেঞ্জিটিকে অগ্রাহ্য করে যেন বাইরে বেরিয়ে আসবার জন্যে আকুলি বিকুলি করছে, ভারী পশ্চাদ্দেশ ওর স্বাভাবিক সৌন্দর্যের সাথে বুঝি অতিরিক্ত সৌন্দর্য-সুষমার ব্যতিক্রমী একটি মাত্রা দান করেছে, আজানু লম্বিত কেশদাম দু’ভাঁজ করে মাথার পেছনে লাল ফিতে দিয়ে আটকানো- যা ওকে আরও অপূর্ব করে তুলেছে।ঠোঁটে লিপষ্টিক নেই তারপরেও ঠোঁট দু’টি লাল টিক্ টিকে, পায়ের আঙ্গুলগুলি দেখবার উপায় নেই, কারণ পা দু’টি কেড্স পরিহিত।অনিন্দ্য সুন্দর প্রিয়দর্শিনী এ তরুণীটি আর তিনজন প্রায় সমবয়সী তরুণী এবং চল্লিশোর্ধ একজন পুরুষের সাথে কোথায় যাচ্ছে, কি-ই বা ওদের উদ্দেশ্য- তা-ও জানবার উপায় নেই, যতক্ষণ পর্যন্ত না ওরা নিজেরাই ওদের গন্তব্য এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কিত কথাটি প্রকাশ করছে।
০১.৩.
সিদ্ধান্ত গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই উঠে দাঁড়িয়ে চারদিকটি একবার ভালো করে দেখে নিয়ে লোকটির পেছনে গিয়ে রেলিং-এর ওপর রাখা লোকটির ডান হাতটির ওপর ওর ডান হাতটি রেখেছে।লোকটি ওর হাতের উপরে আর একটি হাতের ষ্পর্শ অনুভব করে মুহুর্তেই বিদ্যুতষ্পৃষ্ঠের মতো ঘুরে দাঁড়িয়েছে মেয়েটির দিকে, কোনো কথা বলে নি, শুধুই তাঁকিয়ে থেকেছে মেয়েটির মুখের দিকে।
চাপা আর্তনাদ করে উঠেছে মেয়েটি।অতিকষ্টে অস্ফুট স্বরে শুধু উচ্চারণ করেছে- ‘বাবা !’
কিন্তু কোনো কথাই বলে নি লোকটি, নিষ্পলক তাঁকিয়ে থেকেছে মেয়েটির মুখের দিকে।কতকক্ষণ কেটে গেছে বুঝতে পারেনি মেয়েটি।এক পর্যায়ে বাবার এ রকমের
অসহায় দৃষ্টির সামনে কিছুতেই দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে লোকটির হাতে ধরা এ্যাপ্রনটি নিজের
কাঁধে নিয়ে লোকটির দু’টি হাত নিজের দু’হাতের মুঠোতে ধরে আকুল কণ্ঠে বলেছে- ‘বাবা, আমি অঙ্গনা, তোমার মেয়ে, তোমার কন্যা।চেয়ে দেখো ভালো করে-
ঠিক চিনতে পারবে।’ - এই বলে বাবার দু’হাত ধরে বাবাকে ঝাঁকি দিয়েছে কয়েকবার মেয়েটি।ঝাঁকুনির পর ভীষণ উত্তেজিত
হয়ে উঠেছে লোকটি।চোয়াল দু’টি অস্বাভাবিক রকমের শক্ত হয়ে উঠেছে, কিছু আগের শান্ত শুণ্য-দৃষ্টি চোখের তারা দু’টি রক্তিম আকার ধারণ করেছে এবং শ্বাস প্রশ্বাসের গতি দ্রুততর হয়েছে।বোঝা যাচ্ছে লোকটি ঘামতে
শুরু করেছে।এ রকম একটি অবস্থায় নিজেকে সামলাতে না পেরে অত্যন্ত ক্রোধান্বিত কণ্ঠে বলেছে লোকটি-
‘কে অঙ্গনা ? কে আমার মেয়ে ? কই আমি তো তাকে চিনি না।কেন আমাকে বিরক্ত করা হচ্ছে ?
আমি মুক্তি চাই।শুধুই মুক্তি।এই অবরুদ্ধ কারাগার থেকে
কেবলই মুক্তি!- এরপর একেবারে অসহায়ের মতো কিছুটা অস্ফুট কান্না জড়িত কণ্ঠে ধীরে ধীরে
ইংরেজীতে উচ্চারণ করেছে-ÔI want to have my Total Freedom, and an Infinite
বুঝতে পেরেছে মেয়েটি অসহনীয় কোনো প্রচ- মানসিক আঘাতে বাবা ওর স্মৃতিশক্তির কিছুটা হয়তো হারিয়ে ফেলেছেন।সম্পূর্ণ স্মৃতিশক্তি এখনও লুপ্ত হয়ে যায় নি।পুরোপুরি লুপ্ত হয়ে গেলে এভাবে এত পরিচ্ছন্ন ইংরেজীতে কথা বলতে পারতেন না তিনি।Proper Treatment দেয়া গেলে হয়তো...........।বুঝবার পর ধৈর্য না হারিয়ে আবার বলেছে- ‘বাবা, তুমি আহমেদ অম্লান কুসুম পল্লব, সিএমএইচ-এর পরিচালক Retired Colonel ড. আহমেদ অম্লান কুসুম পল্লব, Surgery and Medicine Specialist. Zzwg Medicine-G PhD K‡iQ. তুমি Surgery and Medicine Specialist. Zzwg Medicine-G PhDকরেছ।আমি তোমার মেয়ে অঙ্গনাপল্লব।আহমেদ অঙ্গনা কুসুম পল্লব।তোমার তো এখন সিএমএইচ-এ থাকবার কথা! এই ঝড় বৃষ্টি মাথায় করে কোথায় বেরিয়েছ তুমি ?’
‘সিএমএইচ ! সিএমএইচ কী !! ওই নাম আমি কখনই শুনতে চাই
না।কেন এসব কথা বারবার বলা হচ্ছে আমাকে ? আমি শুধু মুক্তি চাই।মুক্তি।³| SimplyA Great Perpetual Freedom and
০১.৪.
এগুতে থাকে ওরা দু’জন মেয়েটির সাথী আর চারজনের দিকে- যেখান থেকে মেয়েটি ওর বাবার কাছে এসেছিলো এবং যেখান থেকে ওই চারজন ওদের দু’জনের সবকিছু লক্ষ করছিলো এতক্ষণ; দারুণ উদ্বিগ্নতা নিয়ে শুনছিলো বাবা মেয়ের কথোপকথন।ওরা দু’জন এসে কারো সাথে কোনো কথা না বলে অঙ্গনা বাবাকে বসিয়ে দিয়েছে ওদের পাশে, নিজেও বসেছে বাবার সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে।কেউ কোনো প্রশ্ন করবার আগেই অঙ্গনা নিজেই বাবাকে ওদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।ওদেরকে লক্ষ্য করে অঙ্গনা বলেছে- ‘আমার বাবা, সিএমএইচ-এর পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ড. আহমেদ অম্লান কুসুম পল্লব।’- সবাই আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলো।আশ্চর্য হয়েই চোখ বড় বড় করে সবাই একযোগে তাঁকিয়ে ছিলো অঙ্গনার দিকে।
প্রথম কথাটি বলেছিলো সিনিয়র- ‘সে কি ? আমাদের গত রাতের Operation -টি তো সেখানেই ছিলো।দুর্ভাগ্য বশতঃ
Operation-wU Succeed -করেনি।করলে এবং সে সময় তোমার বাবা On Dutyথাকলে উনি তো না-ও বাঁচতে পারতেন ! বিষয়টি নিশ্চিত হয়েও তুমি Operation -টি তে অংশ গ্রহণ করেছিলে ?’
‘করেছিলাম।কারণ...........................
‘থাক, আর বলতে হবে না।সত্যিই, এটিই তো প্রকৃত দেশপ্রেম।আসলেই আমরা সবাই কি পারবো তোমার মতো করে এত স্বার্থহীনভাবে দেশকে, দেশের মাটিকে ভালোবাসতে ? আমরা তো সবাই স্বার্থপর............. !’- সিনিয়রসহ সবাই কথাগুলি বলছিলো খুবই নীচু স্বরে- যাতে আশেপাশের কেউই ওদের কথা শুনতে না পায়।হঠাৎ যেন ওরা সম্বিত ফিরে পেলো।চুপ হয়ে গেলো সবাই।হয়তো বুঝতে পারলো- এভাবে এখানে এখন কথা বলা মোটেই সঠিক নয়।বুঝতে পারলো- ওরা পাঁচ জনই ভীষণভাবে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলো।ওরা ভুলে গিয়েছিলো- ‘আবেগ বলে কিছুই ওদের থাকতে পারে না- তা সে যে কোনো পরিস্থিতিতেই হোক না কেন।এটিই ওদের বিধান।সতর্ক হয়ে গেলো চারজনই।চারপাশটা এবার খুবই সতর্ক তীক্ষ্ন দৃষ্টি দিয়ে দেখে নিলো বারবার।না, কোথাও কেউ ওদেরকে লক্ষ করছে না।
এরপর ওর সাথের চারজনকে দেখিয়ে দিয়ে বাবাকে বলেছে অঙ্গনা-‘বাবা, এই যে মেয়ে তিনটিকে দেখছ- ওরা আমার বন্ধু, আমরা উযধশধ Dhaka Medical College -থেকে M.B.B.S করেছি, এখন Intern-ship করছি। আর ওই যে ফ্লাইং কালো সার্ট গায়ে দেয়া ভদ্রলোকটিকে দেখছ- উনি আমাদের সবার সিনিয়র।উনিও ডাক্তারÑ আমাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।আমরা সবাই ঢাকায় এসেছিলাম একটি বিশেষ Mission নিয়ে।এখন আমরা ফিরে যাচ্ছি।’- বলে বাবার এ্যাপ্রনটি বাবার হাতে তুলে দিলো।সবাই সালাম জানালো অঙ্গনার বাবাকে এবং সবাই ওদের ডান হাতগুলি বাড়িয়ে দিলো ওর দিকে করমর্দন করবার উদ্দেশ্যে কিন্তু অঙ্গনার বাবা কোনো প্রত্যুত্তর করলেন না।শুধুই কতকটা যেন বিবস আর ক্লান্তিতে ভেজা দৃষ্টি দিয়ে তাঁকাতে থাকলেন ওদের দিকে।ওরাও ওদের হাতগুলি গুটিয়ে নিয়ে ভাবতে থাকলো- ‘নিশ্চয়ই ওর কোনো জটিল মানসিক সমস্যা রয়েছে।’- কোনো কথা না বলে সবাই অঙ্গনার মুখের দিকে ওদের কৌতূহলী দৃষ্টি স্থির
করলো।অঙ্গনাও বিষয়টি বুঝতে পেরে কিছু বলবার আগেই ওদের দলের সিনিয়র পুরুষ সদস্যটি অঙ্গ.াকে প্রশ্ন করলো-
০৪.
‘আচ্ছা অঙ্গনা, তোমার বাবা কি কোনো মানসিক অথবা শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত ? উনি কি প্রকৃতই স্বাভাবিক নন ?’- উত্তরে অঙ্গনা শুধু বললো- ‘আমি সব কিছুই বলবো, তবে এখানে নয়।আগে আমরা গন্তব্যে পৌঁছে নিই, তারপর ওখানে পৌঁছেই সবকিছু আলোচনা করবো।এখানে এখন এই সময়টি আমাদের জন্যে খুবইCritical. আগে আমাদেরকে গন্তব্যে পৌঁছুতে হবে।’-ওর কথা শুনবার পর আর কেউ কিছু বললো না।তবে অত্যন্ত সতর্ক এবং অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি দিয়ে আবার পর্যবেক্ষণ করতে থাকলো ডেকের চারদিক।এর মধ্যে ওদের দলের আর এক সদস্যা- নীলিমা নামের মেয়েটি একজন ভ্রাম্যমান চা-বিক্রেতাকে ডেকে ছ’কাপ চা দিতে বললো।চা-বিক্রেতার হাতে একটি বড় আকারের ফ্লাস্ক।ফ্লাস্কে করেই গোটা ডেক ঘুরে ঘুরে লোকটি চা বিক্রি করে।যেমন করে বিক্রি করে বাদাম, সেদ্ধ ডিম অথবা ঝালমুড়ি বিক্রেতারা।
০১.৫.
লঞ্চটি এখন মাঝ নদীতে।অনেক দূরের পথ পাড়ি দিয়ে আসছে লঞ্চটি।সময় মধ্যাহ্ন অতিক্রম করেছে অনেক আগেই।সূর্য ঢলে পড়েছে পশিচম দিকে।আর কিছুক্ষণের মধ্যেই নিশ্চিত সন্ধ্যে নেমে আসবে।আর সন্ধ্যের পরেই লঞ্চটির নির্দিষ্ট ঘাটে পৌঁছুবার কথা।এই নির্দিষ্ট ঘাটে পৌঁছুবার অপেক্ষাতেই ক্ষণ গুনছে অঙ্গনাদের দলটি।কিন্তু এর মধ্যেই ঘটে গেলো একটি আকষ্মিক ঘটনা।নদীটির অপর পাড়ে শুরু হলো প্রচ- গোলাগুলি।গোলাগুলির শব্দই বলে দিচ্ছে গোলাগুলিটি একপক্ষীয় নয় দ্বি-পাক্ষিক।অঙ্গনার দলটি বুঝে নিলো কী ঘটছে আর এরপর কী ঘটতে যাচ্ছে।কারণ ওদের কাছে এ ধরনের ঘটনা ঘটবার বিষয় সম্পর্কে AdvanceInformationছিলো।খুব দ্রুত ওরা পাঁচজন আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে ফিস্ ফিস্ করে সিনিয়রের সঙ্গে কিছু কথাবার্তা বলে খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেললো। সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরপরই সিনিয়র উঠে গেলো লঞ্চটির সারেং-এর কক্ষে।লঞ্চের গতি আরও বাড়িয়ে দিয়ে সামনে বাম দিকে বাঁক নিয়ে আরও দ্রুতগতিতে সামনের দিকে লঞ্চটিকে চালাতে নির্দেশ দিলো সারেংকে- যাতে এখান থেকে খুব কাছাকাছি সামনের ‘দক্ষিণ দৌলত খাঁ’- ঘাটে লঞ্চটিকে ভেড়ানো যায়।এবং এ কথাটিও সারেংকে জানিয়ে দিলো সিনিয়র- ‘নির্দেশিত ঘাটে অতিদ্রুত ভেড়াতে ব্যর্থ হলে তোমার জীবনটিকেই সবার আগে দিতে হবে।’ সম্মতি জানালো সারেং। সিনিয়র সারেং-এর কর্তৃপক্ষ না হলেও সম্মতি না জানিয়ে উপায়ও ছিলো না, কারণ সারেংও বুঝতে পারছিলো কী ঘটতে যাচ্ছে কিছক্ষণের মধ্যে।বেরিয়ে এলো সিনিয়র সারেং-এর কক্ষ থেকে।গোলাগুলির শব্দ ধীরে ধীরে তীব্র হচ্ছে।বোঝা যাচ্ছে প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়েছে ওরা।আর সে কারণেই প্রতিরোধ গুড়িয়ে দিয়ে নদীটির তীরে এগুবার লক্ষ্যে গুলি বর্ষণের মাত্রা
মূহুর্মূহু বাড়িয়ে দিচ্ছে।প্রতিপক্ষও জবাব দিচ্ছে সমান সমান।প্রতিপক্ষের গুলিবর্ষণেও কোনো বিরতি নেই।সিনিয়র এবং ওদের দলটি জানে প্রতিপক্ষ কে এবং কারা জবাব দিচ্ছে।যারা প্রতিরোধ করছে তাদের সংখ্যা তিন প্লাটুন।এক একজনের অধীনে এক প্লাটুন করে মুক্তিযোদ্ধা বিভিন্ন দিক থেকে প্রতি-আক্রমণ করে যাচ্ছে যে কারণে পাকিস্তান বাহিনী শত চেষ্টা করেও, সার্বিক শক্তি প্রয়োগ করেও কোনো মতেই নদী তীরে পৌঁছুতে পারছে না, বরং যেখানে অবস্থান নিয়েেিলা সেখান থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিবর্ষনের জবাব দিচ্ছে।কোনোমতেই এগুতে পারছে না সামনের দিকে।আর সার্বিক দিকের চুলচেরা বিশ্লেষণ এবং বিবেচনা করে সেভাবেই মুক্তিযোদ্ধা হাই কমান্ড আক্রমনের পরিকল্পনাটি একেবারে নিখুঁতভাবেই সম্পন্ন করেছে যাতে পাকিস্তান আর্মি কোনো অবস্থাতেই নদীটি পার হওয়া তো নয়ই এমন কি নদী তীরের কাছাকাছি পর্যন্তও যাতে আসতে না পারে।সে লক্ষ্যের সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করে সাথে সাথে নেতৃত্বের বিষয়টিও নির্ধারণ করেছে মুক্তিযোদ্ধা হাই কমা-।পাকিস্তান সেনা কর্তৃপক্ষের কাছে Signal -ছিলো এই লঞ্চটিতে করেই একদল চৌকস মুক্তিযোদ্ধা আজকে সন্ধ্যের পর যেকোনো সময় মেঘনা নদীটি পাড়ি দিয়ে এপাড়ে এসে এপাড়ে ওদের সুরক্ষিত সেনা ক্যাম্পটিকে আক্রমণ করবে এবং দখল করে নেবে।আর এ কারণেই ক্যাম্পটিকে রক্ষা করবার লক্ষ্যে অতিরিক্ত সতর্কতা হিসেবে ওরা লঞ্চটিকে ধ্বংস করে দেবার জন্যে দু’টি Speed Boat -এ তিনজন তিনজন করে দু’টি দলে বিভক্ত করে একজন Lieutenant -এর অধীনে অগ্রগামী দল হিসেবে মেঘনার বুকে পাঠিয়েছিলো।পেছন ওদেরকে Covering -দেবার জন্যে ছিলো ক্যাম্পে অবস্থানরত পাকিস্তানী সেনাদের পুরো চারটি Platoon. ইতোমধ্যে বিভিন্ন স্থানে ওরাও ওদের Position সংহত করে নিয়েছিলো।কিন্তু দুর্ভাগ্য ওদের যে, ওদের ওই Signal -টি মুক্তিযোদ্ধা হাইকমান্ডও ঠিক সময়েই Tap করতে পেরেছিলো।আর এই Signal -টি পাবার কারণেই রাতের গভীর অন্ধকারে তিনPlatoonমুক্তিযোদ্ধার একটি চৌকস দলও ওদের ঠিক মুখোমুখি অবস্থানে Position গ্রহণ করাতে সক্ষম হয়েছিলো।
সারেং-এর কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে ওর ব্যাগে থাকা ইরহড়পঁষধৎ-টি বের করে ডেকের শেষ মাথার দিকের কোণদাঁড়িয়ে Binocular -চোখে লাগিয়ে লঞ্চের পেছনের দিকের ফেলে আসা গোটা নদীর দিকে সামান্য সময়ের বিরতি দিয়ে দিয়ে বারবার তাঁকাতে লাগলো।সর্বশেষবার সিনিয়র লক্ষ করলো অনেক দূর থেকে অতি দ্রুতবেগে দু’টিSpeed Boat ওদের লঞ্চের দিকেই এগিয়ে আসছে।সঙ্গে সঙ্গে ওদের দলের সবাইকে ওর কাছে ডেকে কিছু নির্দেশ দিয়েPosition গ্রহণ করতে বললো।ওরাও নির্দেশ পাবার পর কাল বিলম্ব না করে ডেকের নির্দিষ্ট স্থানে রক্ষিত বড় আকারের একটি ব্যাগ থেকে সবগুলি আগ্নেয়াস্ত্র বের করে যার যার মতো করে Position গ্রহণ করলো।অঙ্গনা শুধু সাথে নিলো ওর বাবাকে।ওদের কাছেও অন্যান্য অস্ত্রের সাথে দু’টি Sub-Machinegun এবং শক্তিশালী Granade -ও ছিলো।সিনিয়র ডেকের ওপরে থাকা যাত্রীদেরকে নির্দেশ দিলোÑ‘আপনারা সবাই ডেকের ওপর শুয়ে পড়–ন এবং ডেকের নীচে যারা রয়েছে তাদেরকেও ডেকের ওপর আসতে বলুন,Ñ লঞ্চটি পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আক্রমনের মুখে পড়েছে।ওরা লঞ্চটি ডুবিয়ে দেবার চেষ্টা করবে, যদি ওরা লঞ্চটি ডুবিয়ে দিতে সফল হতে পারে তাহলে আপনারা যারা ডেকের ওপর থাকবেন তারা অন্ততঃ সাঁতরে অথবা Life Boat -এর Support নিয়ে যেভাবেই হোক বেঁচে থাকবার চেষ্টা করতে পারবেন।আমরা জীবন দিয়ে হলেও পাকিস্তানী বাহিনীকে রুখে দেবো।’Ñ এই নির্দেশ দিয়ে সিনিয়র নিজে একটিSub-Machinegun নিয়ে Position গ্রহণ করে আবার Binocular -টি চোখে লাগিয়ে Speed Boatদু’টিকে লক্ষ করতে লাগলো।
যাত্রীদের মধ্যে প্রবল আতঙ্ক, ভীতি, টান টান উত্তেজনা, হতাশা থাকলেও সবাই নীরব।কারো কারো চোখ থেকে অবিরাম অশ্রু ঝরছে, কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো শব্দ উচ্চারিত হচ্ছে না।যেন পিন-পতন নীরবতা।বাচ্চাদের কান্নাকাটিও এই আতঙ্ক আর উত্তেজনায় কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে।বাবা মা’রা আপ্রাণ চেষ্টা করছে বাচ্চাদের সামলে নিতে।এর মধ্যে ডেকের নীচে থেকেও উঠে আসছে অনেক যাত্রী, এসেই যে যেমন করে পারছে, গাদাগাদি করে হলেও ডেকের ওপর শুয়ে পড়ছে।সিনিয়র বারবার করে সবাইকে ধৈর্য ধারণ করে কোনোভাবেই উত্তেজিত এবং হতাশ না হবার পরামর্শ দিচ্ছেন।বলছেনÑ ‘আমরা আপনাদেরকে রক্ষা করবোই, আপনারা শুধু ধৈর্য ধারণ করে সাহস সঞ্চয় করুন, শান্ত থাকুন।’Ñ সিনিয়র আবার Binocular -টি চোখে লাগালো।লক্ষ করলোÑ ঝঢ়ববফ ইড়ধঃ-দু’টি আরও কিছুটা এগিয়ে এসেছে।এভাবে আরও কিছুক্ষণ তাঁকিয়ে থাকবার পর ঠিক যে মুহূর্তে ও বুঝতে পারলো Speed Boat -দু’টি ওর Sub-Machinegun এর Range -এর ভেতর ঢুকে পড়েছে ঠিক তখনই চিৎকার করে ওর দলটিকে নির্দেশ দিলোÑ ‘Start Fire’ Ñ নির্দেশ দিয়েই একসাথে শুরু করলো তিন দিক থেকে প্রচ- গুলিবর্ষণ Speed Boat দু’টিকে Target করে।লঞ্চটি থেকে অত্যন্ত আকস্মিকভাবে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণে একটি Speed Boat - যেটি একটু এগিয়ে ছিলো সেটির ওপর থাকা তিনজন সেনাই গুলিবিদ্ধ হলো এবং Boat - টি নিমেষেই মেঘনার অতল পানিতে ডুবে গেলো।
এরকম অবস্থা দেখে অপর ইড়ধঃ-টি তাৎক্ষণিকভাবে অতি-দ্রুত দিক পরিবর্তন করে উল্টোদিকে ফিরে যেতে চাইলেও সেটি আর হলো না।প্রথম Boat -টির ভাগ্যই বরণ করতে হলো এটিকেও অবশেষে।পাকিস্তানী সেনা কর্তৃপক্ষ ভাবতেও পারে নি যে, মুক্তিযোদ্ধাদের এত প্রবল প্রতিরোধের মুখে ওদেরকে পড়তে হবে।মেঘনার তীরে পৌঁছোনো তো দূরের কথা নিজেদের অবস্থান থেকে এক ইঞ্চিও সামনে এগুতে পারে নি ওরা।সে কারণে অগ্রগামী Signal -হিসেবে পাঠানো Speed Boat -দু’টিকে Cover -করতেও পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে নিজেদের ক্যাম্পেই নিজেদেরকে গুটিয়ে নিতে বাধ্য হতে হয়েছিলো ওদেরকে শেষ পর্যন্ত।কিন্তু ডুবে যাবার আগে দ্বিতীয় Boat - টি থেকে সর্বশেষ চেষ্টা হিসেবে যে গুলিবর্ষণ করা হলো সেই গুলিবর্ষণে আহত হলো অঙ্গনা।একটি গুলি এসে অঙ্গনাকে বিদ্ধ করলো।গুলিটি অঙ্গনার বুকের ডানদিকে আঘাত করেছে।গুলিটি লাগবার পর গুলিবিদ্ধ স্থানটিকে একহাত দিয়ে চেপে ধরে লুটিয়ে পড়লো অঙ্গনা।ডেকের মেঝে রক্তাক্ত হতে শুরু করলো।অস্থির হয়ে উঠলেন ওর বাবা ড. পল্লব।কেমন যেন বিচলিত হয়ে পড়লেন, কি যেন বলতে চেয়েও বলতে পারলেন না।শুধু নিজের এ্যাপ্রনটি অঙ্গনার গুলিবিদ্ধ স্থানে চেপে ধরে অনেক কষ্টে দু’বার উচ্চারণ করলেনÑ ‘‘Fast Aid’, ‘Fast Aid’, ‘‘Fast Aid’, -এটি বলে আবার বললেন- ‘‘Operation’’. ওরা সবাই বুঝতে পারলো চোখের সামনে এই মর্মান্তিক ঘটনাটি হয়তো ওর স্মৃতিতে ভীষণভাবে আঘাত করেছে এবং মনস্তাত্ত্বিকভাবে তার মনোবিকলনের ওপর একটি বিশেষ মাত্রার প্রভাব প্রক্ষেপ করেছে।আর এ কারণেই ওর মধ্যে হয়তো কিছুটা হলেও স্বাভাবিকতা ফিরে আসবার উপক্রম করছেÑ তারই লক্ষণ ফুটে উঠেছে ওর উচ্চারণে, চোখে মুখে।সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি নীলিমা সিনিয়রকে ওহঃবৎ-পড়হহবপঃড়ৎ-এর মাধ্যমে অবহিত করলো।ঙঢ়বৎধঃরড়হ-এ বের হলে এসব যন্ত্রপাতি ওদের সঙ্গে থাকতেই হবেÑ এটাই ওদের নিয়ম।
সিনিয়র ওকে যত দ্রুত সম্ভব Fast Aid Kit - এবং আনুষঙ্গিক Injection -সহ অন্যান্য ওষুধপত্র নিয়ে অঙ্গনার কাছে আসবার নির্দেশ দিয়ে নিজেও উঠে দাঁড়ালো অঙ্গনার কাছে যাবার জন্যে।
০৬.
০১.৬.
ইতোমধ্যে সন্ধ্যে নেমে এসেছে।নদীর ওপাড়ের গুলিবর্ষণের তীব্রতাও অনেকটাই স্তিমিত হয়ে এসেছে।অঙ্গনার গুলিবিদ্ধ হওয়া এবং গুলিবর্ষণের মাত্রা স্তিমিত হবার সঙ্গে সঙ্গে ডেকের ওপরে থাকা যাত্রীদের মধ্যে চ্যাচামেচি, চিৎকার, কান্না, আর্তনাদ আর ভীতির মাত্রা হঠাৎ করেই যেন অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে।এ রকম একটি অবস্থায় কেউ কারও কথা শুনবার প্রয়োজনই বোধ করছে না।সব মিলিয়ে যেন একটি চরম অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে গোটা ডেকের ওপর।আর সময় নষ্ট করলো না সিনিয়র, চিৎকার করে সবাইকে কঠোরভাবে নির্দেশ দিলোÑ ‘একটি কথাও কেউ বলবেন না।কেউ চিৎকার বা কান্নাকাটি করলে তাকেই গুলি করে মেরে ফেলা হবে।আমার এই নির্দেশের যেন এতটুকু এদিক ওদিক না হয়।This is the last warning to all of you. Remember it for all time, untill the operation be completed.’Ñ সিনিয়রের এই কথা ক’টি উচ্চারিত হবার পর সবাই একেবারে চুপসে গেলো।কারও মুখে একটি টু’শব্দও আর রইলো না।সবাই যেন হিম-শীতল বরফে আচ্ছাদিত হয়ে শব্দ-শুন্য হয়ে গেলো।এর মধ্যেই ডেকের বাল্ব গুলি জ্বলে উঠলো।আলোকিত হয়ে উঠলো চারদিক।সিনিয়র তাৎক্ষণিকভাবে বহ্নিকে পাঠালা সারেং-এর কাছে আলোগুলি নিভিয়ে দিয়ে দ্রুত ‘দক্ষিণ দৌলত খাঁ’ ঘাটে লঞ্চটি ভেড়াবার নির্দেশ দিয়ে।এরপর বসে পড়লো অঙ্গনার পাশে।অঙ্গনা তখনও পুরোপুরি জ্ঞান হারায় নি।ড. পল্লব অঙ্গনার আহত স্থানে এ্যাপ্রন চাপা দিয়ে ধরে রেখেছে এবং অঙ্গনার মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাঁকিয়েই রয়েছে।আর এই তাঁকিয়ে থাকা অবস্থাতেই ড. পল্লবের দু’চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পরতে শুরু করেছে।একই সাথে ভীষণ চাঞ্চল্যও ফুটে উঠছে ড. পল্লবের চোখে মুখে।বোধকরি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠছে ড. পল্লব।সিনিয়র অঙ্গনার কাছে আসতেই কথা বলে উঠলেন ড. পল্লবÑ ÔLocal Anesthesia- Do you have the Proper Arrangement of it?Õ
Of course sir.
ড. পল্লবের কথার উত্তর দিয়ে খুব দ্রুত বহ্নিকে ‘ÔLocal Anesthesia -এর দু’টি Injection এবং অন্যান্য Instruments Ready করতে বললো।বহ্নি প্রস্তুত হয়েই ছিলো।ও জানতো ÔLocal Anesthesia--ছাড়া এ মুহূর্তে Operation -করে অঙ্গনার শরীর থেকে Bullet -টি বের করে আনা সম্ভব হবে না।বহ্নি বললোÑ’ jvÑÕEverything is ready sir.ÕÑ.’Ñ বলে দু’টি Syringe এগিয়ে ধরলো সিনিয়রের দিকে।সিনিয়র ড. পল্লবকেই Injection -দু’টি Push - করতে অনুরোধ করলো।এর আগেই অনেকক্ষণ ধরে সিনিয়র ড. পল্লবকে পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পেরেছিলোÑ ড. পল্লব এখন পুরোপুরি স্বাভাবিক।অঙ্গনার গুলিবিদ্ধ হবার ঘটনাটির মর্মান্তিকতাই সম্ভবতঃ ওকে স্বাভাবিক হতে চিকিৎসকের মূল ভূমিকাটি পালন করেছে।আর এই স্বাভাবিক হবার আগে ড. পল্লব একবারে সম্পূর্ণ অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যান নি।একজন চিকিৎসক হিসেবে ড. পল্লবের আচরণে তাই-ই ধারণা করেছিলো সিনিয়র।এখন সিনিয়রের ধারণাই সঠিক বলে প্রমাণিত হলো।যা কিছুই হোক না কেন নিজেরই তো কন্যা ! তবে এটি ঠিক যে, ড. পল্লবের স্বাভাবিকতায় ফিরে আসতে হয়তো এ ধরনের একটি প্রচ- আঘাতের প্রয়োজন ছিলো অনিবার্য।কারণ এ ধরনের কিছু কিছু মানসিক Patient -এর ক্ষেত্রে Patient -কে সুস্থ করে তুলবার জন্যে কখনও কখনও একটি প্রবল Mental Shock--এর প্রয়োজনীয়তা সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের কাছে একটি বিশেষ Factor -হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
ড. পল্লব অঙ্গনার শরীরের গুলিবিদ্ধ স্থানের দু’পাশে Injection -দু’টি Push - করলেন।তিনটি টর্চের আলোতে Bullet -টি বের করে এনে পুরো Operation -টি শেষ করতে সময় লাগলো এক ঘণ্টার কিছু বেশী।Operation -শেষে আরও দু’টি InjectionPush - করলেন ড. পল্লব অঙ্গনার শরীরে।এক মিনিটের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লো অঙ্গনা।
কিছু আগেই লঞ্চটি দক্ষিণ দৌলত খাঁ ঘাটে এসে পৌঁছেছে।কিন্তু লঞ্চটি ঘাটে এসে পৌঁছুলেও কোনো যাত্রীই লঞ্চটি থেকে নেমে যাবার সাহস পায়নি সিনিয়রের নির্দেশ ছাড়া।সবাই লঞ্চ থেকে নেমে যাবার জন্যে উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে তাঁকিয়ে আছে সিনিয়রের দিকে, অস্থির হয়ে উঠেছে সব যাত্রীই।এবার সিনিয়র লঞ্চটি থেকে যাত্রীদেরকে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে ধীরে ধীরে নেমে যাবার নির্দেশ দিলো।যাত্রীরাও অক্ষরে অক্ষরে সিনিয়রের নির্দেশ মেনে নিয়ে ধীরে ধীরে লঞ্চটি থেকে নেমে গেলো।
মেঘনার এ পাড়টি এখনও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে।পর পর কয়েকদিন উপুর্যপুরি Air strike - এর মাধ্যমে তুমুল বোমা বর্ষণ করেও পাকিস্তানী সেনারা এ এলাকাটিতে প্রবেশ করতে পারে নি।মেঘনার এ পাড় অর্থাৎ পূর্ব পাড় থেকে বেশ কিছুটা পশ্চিম দিকে একটি ছোট্ট শহরÑ‘রাজমল্লিক’।এ শহরটিই মূলতঃ এ এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান এবং শক্তিশালী ঘাটি।যতবারই পাকিস্তানীরা শহরটিতে প্রবেশ করবার চেষ্টা করেছে ততবারই মুক্তিযোদ্ধারা তাদের শক্তিবৃদ্ধি করে নিজেদের অবস্থানকে সংহত করে নিয়েছে।আর এ কাজটিতে সবচাইতে বেশী সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে মেঘনার
০৭.
দক্ষিণপূর্ব পাড় থেকে বেরিয়ে উত্তর পশ্চিম দিকে বেয়ে চলা মেঘনার একটি সরু শাখানদীÑ‘লালকাঞ্চি’।নদীটির দু’পাড় জুড়ে দীর্ঘ প্রলম্বিত কাশ আর ঝাউ বনের মাতামাতি।র্শি শিরে বাতাসে সাদা সাদা কাশ ফুল আর শ্যামল ঝাঁউ শাখার দোলায়িত ছন্দ যেন নিবিড় করে কাছে ডাকে।ঝাঁউ শাখার শীর্ষে বসে দোল খায় দীর্ঘ লেজের ঘনকালো মিষ্টি রং-এর পাখি ফিঙ্গে, দোল খায় প্রাণ ভ’রে।লালকাঞ্চির লাল রং-এর পানিতে যুতবদ্ধ অশ্ব-কুলের মতো ঝাঁক ঝাঁক ঝুটি-মাথা কৃষ্ণ-ঠোঁট মনোলোভা বুলবুলি ডানা ঝাপটিয়ে ¯œান করে।কোলাহল করে তোলপাড় করে তোলে ওদের চারদিকসহ পুরো এলাকাটিÑ সৃষ্টি হয় এক সম্পূর্ণ পৃথক অসাধারণ ভালোলাগার হৃদয় ভাঙ্গা আহ্বান ! এ আহ্বানে সাড়া না দিয়ে কোনোমতেই থাকা যায় না। ইচ্ছে করে কাশবন আর ঝাঁউ বিথীর গভীর অরণ্যে হারিয়ে গিয়ে চিরদিনের জন্যে নিখোঁজ হয়ে যেতে, পাখিদের কোলাহলে মিশে গিয়ে ওদেরই একজন হয়ে যেতে।
এ শীর্ণ নদীটির পানির রং সব সময়ই লালচে এবং ঘোলাটে থাকে।ওই নদীটির অনেকটা উত্তরে যে গ্রামটির অবস্থান সে গ্রামটির নাম- ‘কাঞ্চি’।এ কারণেই নদীটির নাম গ্রামবাসীরাই দিয়েছেÑ ‘লালকাঞ্চি’।এই নদীটিতে কোনো লঞ্চ প্রবেশ করতে পারে নাÑ এতটাই অপ্রশস্ত।শুধু কিছু কিছু ডিঙ্গি নৌকো চলাচল করতে পারে।মুক্তিযোদ্ধা হাই কমান্ড এই নদীটির ওপর দিয়েই যুদ্ধের জন্যে প্রয়োজনীয় অস্ত্র সস্ত্র, গোলা বারুদসহ অন্যান্য রসদপত্র রাজমল্লিক শহরটিতে সরবরাহ করে থাকে।যে কারণে মুক্তিযোদ্ধারা এখনও এই শহরটির নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে।শহরটির চারদিকে এবং লালকাঞ্চি শাখা নদীটির দু’পাড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ষা ব্যুহ অসম্ভব শক্তিশালী।কারণ এ শহরটিকে রক্ষা করতে না পারলে শহরটিসহ গোটা এলাকাই পাকিস্তানী সেনাদের দখলে চলে যাবে।এ বিষয়টি মাথায় রেখে কৌশলগত কারণেই শাখা নদীটির রক্ষণভাগকে সর্বোচ্চ মাত্রায় নিñিদ্র করে তুলেছে মুক্তিযোদ্ধা হাইকমান্ড।
০১.৭.
এই রাজমল্লিক শহরটিতে একটি পঁচিশ শয্যার হাসপাতাল এবং দু’টি ছোটো আকারের বেসরকারী ক্লিনিক রয়েছে।পাকিস্তানীদের বিমান হামলায় হাসপাতালটির অর্দ্ধাংশসহ দু’টি বেসরকারী ক্লিনিকের একটি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে।তবে হাসপাতালটি বন্ধ হয়ে যায় নি এবং অবশিষ্ট ক্লিনিকটি কোনোমতে টিকে আছে।লঞ্চ থেকে নামিয়ে এই ক্লিনিকটিতেই অঙ্গনাকে নেয়া হয়েছে।অঙ্গনাকে ক্লিনিকটিতে নেবার পর সে রাতেই মুক্তিযোদ্ধাদের আর একটি Unit -ভারী অস্ত্র সস্ত্র নিয়ে ক্লিনিকটির চারদিকে অবস্থান গ্রহণ করেছে ।মেঘনার অপর পাড়ের Unit -গুলিকেও সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় থাকতে বলা হয়েছেÑ যাতে কোনোক্রমেই পাকিস্তানীরা মেঘনার এ পাড়ে পৌঁছুতে না পারে।ক্লিনিকটির ছাদের ওপরেও মুক্তিযোদ্ধারা দু’টি Anti-Aircraft Heavy machinegun - নিয়ে নিজেদেরকে প্রস্তুত করে রেখেছেÑক্লিনিকটিকে অক্ষত রাখবার প্রয়োজনে।ড. পল্লবসহ অঙ্গনাদের Team -এর অবশিষ্ট সদস্যরা ক্লিনিকেই রয়ে গেছে।
দু’রাত দু’দিন পর অঙ্গনার জ্ঞান ফিরেছেÑ ঠিক সন্ধ্যের পরপর।এই দু’রাত দু’দিনের পুরো সময়টি জুড়ে ড. পল্লব অঙ্গনার পাশেই থেকেছে।এক রাত একদিন অতিক্রান্ত হবার পরও যখন অঙ্গনার জ্ঞান ফেরে নি তখন ড. পল্লব খুবই আশঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন।সিনিয়রকে ডেকে বারবার পরামর্শ করেছেন।আবার নিজেই স্বগোতক্তির মতো সিনিয়রকে বলেছেনÑ ’ঋড়ঁৎ পপ ÕFour cc sleeping drug inject করা হয়েছে ওর শরীরে, সে কারণেই জ্ঞান ফিরতে হয়তো একটু বেশী সময় নিচ্ছে।’Ñ এ কথার উত্তরে সিনিয়র ড. পল্লবের ধারণাকে সমর্থন করে বলেছেÑ ‘Right sir, জ্ঞান ফিরে আসবার পর ওর শারীরিক প্রতিক্রিয়া যাতে তীব্র অথবা অস্বাভাবিক না হয় সে কারণেই তো Four cc inject করা হয়েছিলো।কিছুটা বেশী সময় নিলেও জ্ঞান ঠিকই ফিরে আসবে।এ মুহুর্তে ওর Heart-bit, Pulse-bit -সবই Normal sir. আমার মনে হয় আমাদের আতঙ্কিত না হওয়াই উচিত।’Ñ সিনিয়রের কথা শেষ হবার পর ড. পল্লব আর কিছু বলেন নি।নীলিমাকে ডেকে শুধু বলেছেনÑ ‘আমাকে এক কাপ চা দিতে বলো তো।’Ñ নির্দেশটি এমনভাবে দিলেন ড. পল্লব যেন CMH -এর পরিচালক তার কোনো SubordinateStaff -কে নির্দেশ দিচ্ছেন।অনেকদিন ওখানে কাজ করেছেন; নির্দেশ দেবার ভঙ্গিটি এখনও বদলাতে পারেন নি।এ নির্দেশের পর সিনিয়র এবং নীলিমা কক্ষটিতে আর থাকে নি, একসঙ্গে দু’জনই বাইরে বেরিয়ে গেছে।নীলিমা গেছে চায়ের কথা বলতে আর সিনিয়র গেছে বাইরের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে।
এর মধ্যে আরও এক রাত এক দিন কেটে গেছে।চরম অস্থির এবং উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন ড. পল্লব।বারবার অঙ্গনার Heart-bit, Pulse-bit - পরীক্ষা করছেন, হাতের আঙ্গুল দিয়ে অঙ্গনার দু’চোখ মেলে ধরে দু’চোখের অবস্থা Observe -করছেন।একটু সময় কি যেন ভেবে নিয়ে নতুন দু’টি Injection -এর নাম কাগজে লিখে Nurse–এরহাতে দিয়ে বলেছেন Injection -দু’টি পর পর অঙ্গনার শরীরে লাগানো Saline-bag -এ Push -করতে।Nurse -চলে যাবার পর আর একজন Nurse - চায়ের একটি ট্রে হাতে নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে চায়ের কাপটি অঙ্গনার Bed-table--এ রেখে ড. পল্লবকে বলেছেÑ‘Sir আপনার চা।’Ñ বলে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেছে।কিছুক্ষণ পর নির্দেশিত Nurse -টি Injection -দু’টি নিয়ে এসে অঙ্গনার Saline-bag -এ পরপর Push -করেছে ড. পল্লবের সামনেই।Injection -দু’টি Push -করে সে-ও চলে গেছে।
কয়েক কাপ চা ছাড়া আজ সারাদিন কিছু খান নি ড. পল্লব।Injection -দু’টি Push -করবার পর থেকে আরও যেন বিমর্ষ হয়ে পড়েছেন ও।কক্ষটি জুড়ে পায়চারি করে কি যেন অবিরাম ভেবে চলেছেন।মাঝে মাঝে অঙ্গনার মাথার কাছে এসে বসেছেন; অঙ্গনার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেছেন নির্ণিমেষ, কখনও বা অঙ্গনার কপালে হাত রেখেছেন বেশ কিছু সময় ধরে।এক হাত দিয়ে অঙ্গনার বাম হাতটি নিজের হাতে নিয়ে হাত দিয়েই Pulse-bit - বোঝার চেষ্টা করেছেন।আবার উঠে দাঁড়িয়ে বিষণœ মনে খুবই শ্লথ গতিতে পায়চারি করেছেন কক্ষের ভেতর।Nurse -খাবার টেবিলে যেতে বললেও খেতে যাননি ড. পল্লব।এভাবেই একটি দিন পুরো শেষ হয়ে গেছে।
০১.৮.
ঠিক সন্ধ্যের পর একটু ন’ড়ে উঠেই চোখ মেলে তাকিয়েছে অঙ্গনা।তাঁকিয়েই ঝাঁপসা চোখে দেখেছে ওর বাবা ড. পল্লবকেÑ বসে রয়েছেন ওর চোখের সামনেই।বিছানা থেকে উঠে বসবার চেষ্টা করেছে অতিকষ্টে কিন্তু বাবা-ই ওকে উঠতে দেন নি, শুইয়ে দিয়েছেন আবার বিছানায়।বলেছেনÑ‘এখনও সময় হয় নি।সময় হলে আমিই তোকে বসিয়ে দেবো আমার চোখের সামনে।আরও কিছুটা বিশ্রামের প্রয়োজন তোর এখন।’Ñবালিশে মাথা রেখে বাবাকে দেখেছে আর অঝোর ধারায় চোখের পানি ফেলেছে।অনেক কিছুর মধ্যে এ-টিও হয়তো ভেবেছেÑ CMH -এর Operation -টি সফল হলে বাবা হয়তো আর না-ও বেঁচে থাকতে পারতেন ! অদ্ভুত রকমের আশ্চর্য মনে হয়েছে নিজেকে নিজের কাছে।বাবা যদি না থাকতেন তাহলে আজকে কার কাছ থেকে এত মমতা মাখা সান্ত¦না পেতো অঙ্গনা ! এভাবে ভাবতে ভাবতে আবার উঠে বসবার চেষ্টা করেছে অঙ্গনা।এবার বাবাই ওকে বসিয়ে দিয়েছেন বিছানার ওপর একেবারে নিজের মুখোমুখি করে।এর পর বাবাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরেছে অঙ্গনা, বাবাও বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়েছেন মেয়েকে।দু’জনের চোখের পানিতে ভিজে গেছে বিছানা চাদর আর বাবা মেয়ের বুক।সে যে পিতা কন্যার অপত্য ¯েœহ আর মমতার কী এক বেদনা-বিধুর স্বর্গীয় সুখের আবহÑ যাকে কখনই শব্দের কারুকাজ দিয়ে ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।এ মুহুর্তটি শুধু হৃদয়ের অন্তজঃ গভীরতা দিয়ে অনুভব করবার, ভাষা দিয়ে বর্ণনা করবার নয়।আবেগের উত্তাল প্লাবনের ঝঞ্ঝা কিছুটা শিথিল হলে বাবা-ই প্রথম কথা বলেছেনÑ ‘এতদিন আমি রাজাকার ছিলাম।রাজাকার হয়ে CMH -এর পরিচালকের দায়িত্বে থেকে প্রতি মুহুর্তে নিজেকেই হত্যা করে চলেছিলাম।আমার দুর্ভাগ্যÑ আমি তোর মতো মুক্তিযোদ্ধা হতে পারি নি।আমি আমার ছাত্র জীবন থেকে যেভাবেই সম্ভব হয়েছে সেভাবেই আজীবন জাতীয় মুক্তির আন্দোলন করেছি, সংগ্রাম করেছি, আর আমার এই আদর্শের শিক্ষাই আমি তোদেরকে দিয়েছি।কিন্তু যখন সবচাইতে বেশী প্রয়োজন ছিলো তখনই আমি ব্যর্থ হয়েছি।আমার কোনো উপায় ছিলো না মা, আমাকে ওরা যেতে দেয় নি।আমাকে খাঁচায় আবদ্ধ করে রেখে দু’বেলা দু’টি উচ্ছিষ্ট দানা দিয়েছেÑ যা ভক্ষণ করে আমি জীবিত থেকে ওদের স্বার্থ সিদ্ধ করতে পারি।কিন্তু আমি তা করি নি; মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে এ পর্যন্ত প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও CMH -এর পরিচালকের প্রশাসনিক দায়িত্বটুকুই আমি যা পালন করেছি কিন্তু চিকিৎসা সেবা আমি কাউকে দিই নি।কোনো রাজাকারের চিকিৎসা আমি করিনি।আর এই করিনি বলেই তিনবার আমাকে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়েছে।তিনবারই কীভাবে যে আমি বেঁচে গেছি আমি জানি নাÑ এখনও আমি বেঁচে রয়েছিÑ আর এ-টিই আমার কাছে সবচাইতে বেশী অলৌকিক মনে হয়েছে।এ-ই বুঝি আমার বিধিলিপি ছিলো মা।প্রতিদিন আমি নতুন করে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জন্ম নিতে চেয়েছি।কিন্তু আমি পারি নি, আমি ব্যর্থ হয়েছিÑ এই ব্যর্থতা আমার অপরাধ।এ অপরাধের গ্লানি বহন করবার শক্তি আমার নেই মা।এ জঘন্য অপরাধের যে শাস্তি তোরা আমাকে দিবি- আমি প্রশ্নহীন মেনে নেবো মা।’Ñ
কথাগুলি শুনবার পর বাবার বুক থেকে মাথা তুলে বাবার চোখর ওপর চোখ রেখে বাবার চোখের পানি দু’হাতে মুছে দিয়ে বলেছেÑ ‘শাস্তির কথা বলছো ? হ্যাঁ, একদিক থেকে কথাটি তুমি ঠিকই বলেছো।শাস্তি তোমাকে অবশ্যই পেতে হবেÑ এবং যে শাস্তির বোঝা তোমাকে আজীবন বহন করে চলতে হবে।আমার জীবনের ভারটি যে তোমাকেই নিতে হবে বাবাÑযতদিন তুমি বেঁচে থাকবে।এটি-ই তো হবে তোমার সবচাইতে উৎকৃষ্ট শাস্তি।’Ñ বলে আবার বাবাকে জড়িয়ে ধরেছে অঙ্গনা।এভাবে কিছুক্ষণ থাকবার পর বাবা বিছানা থেকে উঠে গিয়ে বসেছে বেডটির পাশের চেয়ারে।কন্যাও ওর
বালিশে হাত রেখে বসেছে বাবার মুখোমুখি।অঙ্গনা যে আহত, ওর বুকে যে Operation -হয়েছেÑ সে সবের কোনো চিহ্নই নেই আর ওর চোখে মুখে।কোনো যন্ত্রণাই যেন নেই ওর এখন।একেবারেই স্বাভাবিক।চেয়ারে বসে রুমাল বের করে চোখ মুখ মুছে নিয়েছে।এরপর সরাসরি অঙ্গনার মুখের দিকে তাঁকিয়ে আবার বলেছে বাবাÑ ‘আমি অনুপমকে হত্যা করেছি।আহমেদ অনুপম কুসুম পল্লবকে আমি নিজ হাতেই হত্যা করেছি।’
‘কী বলছো বাবা ! অনুপম তোমার প্রথম সন্তান, আমার বড় ভাই।’
‘না।ও পাকিস্তান আর্মির Lieutenant. অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে ও হত্যা করেছে।CMH -এর পরিচালকের দায়িত্বে থেকে একটি Operation-ই আমি করেছি।আর সেটি অনুপম কুসুম পল্লবের।কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে আমি হত্যা করি নি, আমি হত্যা করেছি একজন রাজাকারকেÑ যাকে সবাই আমার প্রথম পুত্র বলে জানে।’Ñ বাবার কথা শুনে হতবাক হয়ে গিয়ে কিছু সময় শুধু ভেবেছে।ভেবেছেÑ ‘এমন পিতাও পৃথিবীতে হয় !’ গৌরবে, অহঙ্কারে বুক ভরে গেছে অঙ্গনার।বলেছেÑ
‘তুমিই তো শ্রেষ্ঠতম মুক্তিযোদ্ধা বাবা।তোমার যথার্থ সম্মান জাতি কি দিতে পারবে ?’
‘না পারলেও আমার এতটুকু দুঃখ নেই।আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি মাত্র।এর জন্যে আমার পৃথক কোনো সম্মানেরও প্রয়োজন নেই।আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা কন্যার পিতাÑ এ-ই আমার একমাত্র Identity. আর কিছুর প্রয়োজন আমার নেই।এখন আমি আমার জীবনের অন্তিম প্রান্তের সর্বশেষ একমুঠো মাটির ওপর দাঁড়িয়ে আছি মা।যে কোনো মুহূর্তে আমার পায়ের নীচের সর্বশেষ ওই মাটিটুকু সরে যাবে মা।আমি আর বাঁচবো না।CMH -এর Operation-Table - থেকে আমি পালিয়ে এসেছি।এখন আমি অন্তিমÑ একজন অন্তিম পলাতক।কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো আমার জীবনের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে।তবে এ গৌরবটুকু আমার কোনোদিনই হারিয়ে যাবে না যে, তোর মতো একজন মুক্তিযোদ্ধাকে আমি জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছি।এটি-ই আমার দুর্লভ সান্ত¦না।’Ñইচ্ছে করেই বাবার এসব কথার কোনো উত্তর দিলো না অঙ্গনা।কারণ এসব কথায় অঙ্গনা স্পষ্টভাবেই বুঝতে পরলোÑ বাবা মানসিকভাবে একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছেন।ওর ভেতর এখন শক্তি সঞ্চারের প্রয়োজনটিই বেশী।তাই প্রসঙ্গ পাল্টে বাবাকে সাহসী করে তুলবার জন্যে বললোÑ‘বাবা তুমি আমাদের দু’ভাই বোনের নামকরণ বাংলাতে করেছোÑ এতে অনেক আগেই আমি বুঝতে পেরেছিলামÑ বাংলা ভাষা তোমার কাছে কী ? স্বাধীন বাংলাদেশের সম্ভ্রম, বাংলাদেশের মর্যাদা তোমার হৃদয়ের কোন্ মনিকোঠার গহিন কোণে স্থিত ?’Ñ অঙ্গনার কথা শেষ হয়।বাবাও আর কিছু বলে না।
সিনিয়র কখন যে ওদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পারেনি ওরা কেউই।বুঝেছে তখনই যখন সিনিয়র ওদেরই মতো আবেগে আপ্লুত হয়ে বলেছেÑ ‘যথার্থ উত্তরই তুমি দিয়েছো অঙ্গনা।একজন মুক্ত-মনন পিতার মুক্ত-মননা কন্যার উত্তর তো এ রকমেরই হওয়া উচিৎ।নয় কি Sir?’Ñ চমকে গিয়ে দু’জনই তাঁকিয়েছে পেছন ফিরেÑ দেখেছে আবেগাপ্লুত সিনিয়র দাঁড়িয়ে রয়েছে ওদের পেছনে।কাছে এসেছে সিনিয়র, বসেছে ওদের পাশে।নিগুঢ় আশ্চর্যান্বিত হয়ে শুধুই তাঁকিয়ে থেকেছে পিতা কন্যার দিকে।এক পর্যায়ে যেন নিজেই নিজেকে বলেছেÑ ‘এই বাংলাদেশই তো আমাদের জাতির কামনা।’
০১.
CMH-Gi Operation Theatre. Operation Theatre -এর টেবিলে শায়িত পাকিস্তান আর্মির Lieutenant -আহমেদ অনুপম কুসুম পল্লব।বক্ষে গুলিবিদ্ধ, আহত, জ্ঞানহীন অনুপম কুসুম পল্লবÑ ড. অম্লান কুসুম পল্লবের প্রথম সন্তান।মুখে Oxygen Mask লাগানো।Heart-bit, Pulse-bit, Blood circulation -এর পর্যায়ক্রমিক অবস্থা Computer -এর মাধ্যমে Observe -করবার জন্যে কয়েকটি যন্ত্রের Cable -লাগানো Patient-এর শরীরে।সব কিছুই প্রতি সেকেন্ডে একই সঙ্গে ভেসে উঠছে তিনটি Computer-Monitor-Gi Screen এ।ড. পল্লবের নেতৃত্বে চারজন ডাক্তার এবং তিনজনNurse Gi একটি Medical Team Operation -এর জন্যে পুরোপুরি প্রস্তুত।একজন সসস্ত্র পাকিস্তানী মেজর Operation -এর সার্বিক বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছেন।এ দায়িত্বটি তার উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ তাকে প্রদান করেছে।Operation Theatre -এর বাইরে প্রচুর সংখ্যক পাকিস্তানী সেনা টহল দিচ্ছে।
ড. পল্লব Patient -এর বুকের কাছে।অন্য চারজন ডাক্তারের মধ্যে দু’জন টেবিলের অপর প্রান্তে।অবশিষ্ট দু’জন ড. পল্লবের দু’পাশে।Nurse -রা তাদের স্ব স্ব স্থানেÑ ড. পল্লবের নির্দেশ অনুযায়ী।দেহের যে স্থানটিতে Operation -করা হবে সে স্থানটি ঢেকে দেয়া সাদা কাপড়টি সরিয়ে দেয়া হলো।রক্তক্ষরণ হচ্ছে তবে সীমিত আকারে।ড. পল্লব
Computer-Monitor -এর Screen -এ একবার দৃষ্টি দিয়ে পরপরই দৃষ্টি স্থির করলেন Patient -এর ক্ষত স্থানটির ওপর।সেখান থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে তাঁকালেন Patient -এর মুখের দিকে।এবং শুধু দেখতেই থাকলেন Patient -এর মুখটি।আর কিছু করলেন না।মুখটি কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।মনে হচ্ছে মুখম-লটিতে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।পুত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে শুধুই ভাবছেন ড. পল্লব।কিছুই বলছেন না।এ Operation -টি তিনি করতে চান নি।যতবারই ওকে Operation -টি করবার প্রস্তাবটি দেয়া হয়েছে ততবারই তিনি নাকচ করেছেন।কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে পাকিস্তান সেনা কর্তৃপক্ষের প্রবল হুমকির মুখে Operation Theatre -এ এসে Operation টেবিলের সম্মুখে দাঁড়াতে হয়েছে।পাকিস্তান আর্মি কর্তৃপক্ষ ভেবেছে পুত্রের Operation -টি পিতার মাধ্যমে সম্পন্ন করলে নিশ্চয়ই পুত্র বেঁচে উঠবে।পিতা পুত্রের রক্তের সম্পর্কের কারণেই পিতা বাধ্য হবেন পুত্রকে বাঁচিয়ে তুলতে।আর সে জন্যেই তারা বাধ্য করেছে ড. পল্লবকে।কারণ Lieutenant - অনুপম কুসুম পল্লব একজন নিবেদিত-প্রাণ পাকিস্তানী বাঙ্গালী আর্মি অফিসার এবং সে বাঙ্গালী অফিসারকে দিয়ে বাঙ্গালী মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নিধন করবার জন্যেই অনুপম কুসুম পল্লবের বেঁচে থাকাটি ভীষণ রকমের প্রয়োজন পাকিস্তানীদের কাছে।বিষয়টি অনেক আগেই বুঝে নিয়েছিলেন ড. পল্লব।আর Operation Theatre -এ প্রবেশ করবার ঠিক পূর্ব মুহুর্তে চুড়ান্ত সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করেছিলেন তিনিÑ Operation Theatre-এ প্রবেশ করবার পর তার সর্বশেষ কাজটি কী হবে।
Patient -এর বুকের কাছে দাঁড়িয়ে ভেবেই চলেছেন ড. পল্লব।কিছুই বলছেন না।মগ্ন ভাবনার মুক্ত ডানা মেলে মুক্ত স্বাধীন মানুষের মতো কোনো বাধা না মেনে প্রচ- বেগে Operation Theatre -থেকে বেরিয়ে ধাবিত হয়েছেন ভিন্ন কোনো গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে।আবার কখনও ফিরে এসেছেন এই লোকালয়েÑ প্রবল ঝড় বৃষ্টি অগ্রাহ্য করে উর্দ্ধশ্বাসে দৌড়ে চলেছেন কঠিন পাথরের টুকরো বেছানো সমান্তরাল দু’টি রেল লাইনের মাঝ দিয়ে, পায়ের জুতো ছিড়ে গিয়ে পায়ের তলা রক্তাক্ত হয়েছে তবুও থামেন নি তিনি।কখনও বা বৃষ্টিতে ভিজে Ship-Yard -এ দাঁড়িয়ে থেকে বৃষ্টির মেলা দেখেছেন।আবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে জাহাজ ঘাটে গিয়ে কোনো একটি অজানা গন্তব্যগামী লঞ্চের ডেকের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে শুন্য দৃষ্টি মেলে দিগন্তের ওপাড়ে ভেসে গেছেন।আকস্মিক গোলা গুলির শব্দে আবার ফিরে এসেছেন লঞ্চের ডেকে।শত্রু পক্ষের গুলির আঘাতে নিজের অজান্তে নিজ কন্যা মুক্তিযোদ্ধা অঙ্গনাকে চোখের সামনেই গুলিবিদ্ধ হতে দেখেছেন।ডেকের ওপরেই কন্যার Operation -করেছেন।Clinic -এ নিয়ে কন্যাকে চিকিৎসা আর শুশ্রুষা দিয়ে সুস্থ করে তুলেছেন।আবার কখনও বা কন্যার মুখোমুখি বসে নিজের অসহায়ত্বের কথা, মুক্তিযোদ্ধা হতে না পারার অপরাধের কথা অকপটে কন্যাকে বলে কন্যার কাছ থেকে সে অপরাধের শাস্তি পেতে চেয়েছেন।এ চাওয়ার পাশাপাশি অপরিমিত গর্ব বোধ করেছেন তিনি, অবিমিশ্র সুখ বোধ করেছেন নিজের অন্তরেÑ তিনি একজন অসম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা কন্যার পিতা।এর চাইতে বড় প্রাপ্তি তার কাছে আর কী হতে পারে!!
নির্বাক নিথর যেন ড. অম্লান কুসুম পল্লব।শুধুই দাঁড়িয়ে রয়েছেন।কিছুই বলছেন না।কোনো Operating Apparatus--ও হাতে নিচ্ছেন না।শুধুই ভাবছেন।এভাবে কতটা সময় কেটে গেছে জানেন না ড. পল্লব।| Patient -এর অবস্থা আশঙ্কাজনকভাবে Deteriorate-করেছে।ভয়ানকভাবে অস্থির এবং বিচলিত হয়ে উঠেছেন অন্যান্য ডাক্তাররা সঙ্গে Nurse -রাও।মেজর ক্রোধান্বিত হয়ে উঠেছেন।টক্ টকে রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে ওর অক্ষি-গোলকের তারা দু’টি।সবাই বুঝতে পারছে এই মুহূর্তে Operation -টি না হলে Patient -কে বাঁচানো যাবে না।সবাই একবার Computer-Monitor -এর Screen -এর দিকে তাঁকাচ্ছে আবার ফিরে তাকাচ্ছে Patient -এর দিকে।ইতোমধ্যেই Patient এর কিছুটা ঝাঁকুনির মতো শুরু হয়েছে।এরকম অবস্থায় একজন ডাক্তার জোরে ঝাঁকুনি দিলেন ড. পল্লবকে।ঝাকুনির পর হঠাৎ করেই যেন কল্পনার বিশাল গ্রহে বিচরণ ভেঙ্গে ফিরে এলেন বাস্তব লোকালয়ে।প্রসন্ন ভাবনার পাল তোলা নৌকোয় চড়ে মুক্ত স্বাধীন মানুষের মতো অপরিচিত ভিন্ন কল্পনা-গ্রহে কতটা সময় বিচরণ করেছেন ড. পল্লবÑ জানেন না।এবার তাকালেন চারদিকে।এরপর হাত বাড়ালেন Operating Apparatus -এর জন্যে।অস্ত্রপচার করলেন ড. পল্লব পুত্রের বুকে।বুলেটটিও বের করে আনলেন।সবার মধ্যে একটি স্বস্তির চাঞ্চল্য ফিরে এলো।পাকিস্তানী মেজরও আশ্বস্ত হলো বুঝি কিছুটাÑ যেটি ওর মুখের দিকে তাকিয়েই বোঝা গেলো।পুরো ক্ষত স্থানটিকে Medicinize -করে Steaching -এর জন্যে ডাক্তার Nurse -রা প্রস্তুতি গ্রহণ করতে শুরু করলো।ঠিক এ মুহূর্তেই ঘটে গেলো বিস্ফোরণটি।ড. পল্লব ইচ্ছে করেই Patient -এর হৃৎপি-ে রক্ত সরবরাহকারী মূল Nerve -টিকে অত্যন্ত শান্ত এবং স্থির মস্তিষ্কে কেটে দিলেন অকম্পিত হাতে।
১১.
চারজন ডাক্তারই একযোগে চিৎকার করে উঠলেনÑ ‘ÔSir,, কি করলেন! ‘ÔSir, কি করলেন !Patient -তো আর বাঁচবে না।কেন এমন করলেন Sir, কেন এমন করলেন ?’Ñ এসব কথাবার্তার মধ্যেই Patient -তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো।স্থির হয়ে গেলো Patient -এর দেহটি।একজন ডাক্তার কতকটা চিৎকার করেই যেন বললেনÑ ‘নিজের পুত্রকে হত্যা করলেনSir?’Ñ কোনো উত্তর না দিয়ে স্থির, অচঞ্চল স্থানুর মতো অবিচল দাঁড়িয়ে থাকলেন তিনিÑ সম্পূর্ণ নির্বিকার যেন।কয়েক সেকেন্ড কেটে যাবার পর প্রচ- রকমের উচ্চৈস্বরে চিৎকার করে উঠলেন ড. পল্লবÑ ‘হ্যাঁ, করলাম।কারণ আমি কোনো ঘৃণ্য পাকিস্তানী রাজাকারের পিতা হয়ে নিজের পরিচয় দিতে চাই না এবং বাঁচতেও চাই না।আমি বাঙ্গালী এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা।বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার দেশ।বাঙ্গালী আমার দীন দুখী অসহায় জনগণÑ আমি তাদেরই একজন।’Ñ চরম উত্তেজিত কণ্ঠে কথাগুলি উচ্চারণ করলেন ড. পল্লব।ওর কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে ওর মাথায় জবাড়ষাবৎ-ঠেকিয়ে পরপর দু’টি গুলি করলো সেই পাকিস্তানী মেজর।লুটিয়ে পড়লেন ড. কর্নেল আহমেদ অম্লান কুসুম পল্লব ঈগঐ-এর মেঝেতে।মুহূর্তেই ধব্ ধবে সাদা টাইলস দিয়ে মোড়ানো ঈগঐ-এর মেঝে ভিজে গেলো পিতা পুত্রের রক্তের গাঢ় রং-এ।
দু’জনই বাঙ্গালী।একজন পাকিস্তানী সারমেয়, বিশ্বাসহন্তা রাজাকার, পাকিস্তান আর্মির Lieutenant - অনুপম কুসুম পল্লব।আর একজন বিশ্বস্ত মুক্তিযোদ্ধা অঙ্গনা কুসুম পল্লবের আদর্শ পিতা নিজের জীবন উৎসর্গকারী মুক্তিযোদ্ধা-শ্রেষ্ঠ অবসর প্রাপ্ত কর্নেল ড. আহমেদ অম্লান কুসুম পল্লব।একজন পুত্র আর একজন পিতা।দু’জনই দু’জনের পরস্পর বিরোধী আদর্শের মানুষ।ইতিহাস দু’জনকে সে ভাবেই ধারণ করবে।কারণ ইতিহাসে মিথ্যের কোনো স্থান নেই।ইতিহাস কখনও মিথ্যে বলে না।
CMH -এর অবরুদ্ধ কারাগার থেকে চিরদিনের মুক্তি হয়ে গেলো ড. আহমেদ অম্লান কুসুম পল্লবের।একই সাথে তিনি হয়ে গেলেন ইতিহাসের উজ্জ্বলতম নীহারিকা।
লেখকঃ সরদার মোহম্মদ রাজ্জাক