প্রবন্ধকার : মোঃ ইসরাফিল আলম এমপি
সারসংক্ষেপ:
বাঙালি জাতির পরিচয়ের ঐতিহাসিক যুগ শুরু হয় গুপ্তযুগ (৩২০ খ্রি.-৬৫০ খ্রি.) থেকে এবং এ যুগেই প্রথম ক্ষুদ্র রাজ্যপুঞ্জগুলিকে নিয়ে গঠিত হয় বিশাল রাজ্য। শশাঙ্ক (খ্রিস্টপূর্ব আনু ৬০০ খ্রি.-৬২৫ খ্রি.) তাঁর দক্ষ শাসনের মাধ্যমে বাংলা ও বাঙালিকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেন। তখন থেকেই বাঙালি জাতিসত্তার যাত্রা শুরু এবং পাল ও সেন আমলে এসে সে সত্তা আরো বিকশিত হয়ে প্রস্ফূটিত হয়। প্রাচীন বাংলার ভূখ- খ্যাত অঞ্চলগুলো বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল-যা বর্তমানে বাঙালি জাতির পরিচয় বহন করে। এ ভূখণ্ড-গুলিতে যে জনগোষ্ঠির বসতি গড়ে উঠেছিল সহজ-সরল, সাদামাটা ও সংক্ষিপ্তভাবে তারাই বাঙালি জাতির আসন অলংকৃত করেছে। বাঙালি জাতি যেভাবেই গড়ে উঠুক কিন্তু তাকে বিশ্বের দরবারে সভ্য জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার যে ভিত নির্মাণ করা হয়েছিল তার কারিগর ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ। তিনি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার হিসেবে খ্যাত সাহিত্যে নেবেল পুরুস্কার পেয়েছিলেন তাঁর গীতাঞ্জলি কাব্যের জন্যে। এই গীতাঞ্জলি কাব্যই বাংলা ও বাঙালি জাতিকে সভ্য জাতির পরিচয় প্রদানে প্রথম পথপ্রদর্শক। আলোচ্য প্রবন্ধের মাধ্যমে অতি সংক্ষেপে রবি ঠাকুরের গীতাঞ্জলি’র আলোকে বাঙালির বিশ্বদর্শন ওঠে আসবে।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশে আদিম মানব সভ্যতার ও জাতিসত্তার বিকাশ যেভাবে ঘটেছিল বাঙালি জাতির ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হয়নি। বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডে বসবাস কখন হয়েছিল তা আলোচনা করতে গেলে বোঝা যায় প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলার পার্বত্য সীমান্ত থেকে মানব বসতি ও জীবন-জীবিকার তাগিদে তা বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। বৈদিক গ্রন্থাদিতে বাংলার নর-নারীকে অনার্য ও অসভ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ তারা সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে এমনকি শিক্ষা-দীক্ষায় অনেক পিছিয়ে ছিল। উল্লেখ্য আর্যপূর্ব বাঙালি উত্তরসূরী হিসেবে এখনও বাংলাদেশে যারা আছে তারা হলো- কোল, শবর, পুলিন্দ, হাড়ি, ডোম, চ-াল, যারা আদিবাসী হিসেবে পরিচিত। ভারতবর্ষের মধ্যেও এ জাতির উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ পাওয়া যায়। বর্তমানে বাঙালি জাতির জনজীবন প্রায় ১৫০০ বছর ধরে নানা জাতি-ধর্ম ও বর্ণের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে।
বাঙালি জাতি সম্পর্কে নৃবিজ্ঞানীদের ধারণা, এটি একটি মিশ্রিত জাতি এবং এ ভূ-খণ্ডে বসবাসকারী আদিতম মানবগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে অন্যতম। বন্যার জলধারার মত পৃথিবীর বহু জাতি বাংলায় অনুপ্রবেশ করেছে, অনেকে আবার বেরিয়েও গেছে, তবে পেছনে রেখে গেছে তাদের আগমনের অকাট্য প্রমাণ। বৃহত্তর বাঙালির রক্তে মিশ্রিত আছে বহু এবং বিচিত্র সব মানবগোষ্ঠীর অস্তিত্ব। দীর্ঘকাল বিভিন্ন জনগোষ্ঠিতে বিভক্ত হয়ে আদি মানবগোষ্ঠী বাংলার বিভিন্ন এলাকায় বসবাস করে একে অপরের সঙ্গে মিশ্রিত হয়েছে হাজারো বছর ধরে। জাতিতাত্ত্বিক নৃবিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীর চারটি প্রধান মানবগোষ্ঠীর কোন না কোন শাখার আগমন ঘটেছে বাংলায়। মানবগোষ্ঠীরা হলো নিগ্রীয়, মঙ্গোলীয়, ককেশীয় ও অস্ট্রেলীয়। মনে করা হয় যে, বাংলার প্রাচীন জনগোষ্ঠীর মধ্যে অস্ট্রিক ভাষাভাষিরাই সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের সাঁওতাল, বাশফোড়, রাজবংশী প্রভৃতি আদি অস্ট্রেলীয়দের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই আদি জনগোষ্ঠী দ্বারা নির্মিত সমাজ ও সামাজিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটে আর্যদের আগমনের পর। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতবর্ষকে অগণিত জাতির মিলনকেন্দ্র হিসেবে কল্পনা করতে গিয়ে বলেছিলেন-
কেহ নাহি জানে কার আহবানে, কত মানুষের ধারা,
দূরবার- স্রোত এলো কোথা হতে সমুদ্রে হলো হারা।
১৯১২ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজি গীতাঞ্জলি প্রকাশের ফলেই রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। কিন্তু ইংরেজি গীতাঞ্জলি এবং বাংলা গীতাঞ্জলির মধ্যে পার্থক্য দুস্তর। গীতাঞ্জলিতে মোট কবিতার সংখ্যা ছিল ১৫৭টি, কিন্তু ইংরেজি গীতাঞ্জলিতে ১০৩টি কবিতা রয়েছে, যার মধ্যে একটি কবিতা দুইটির মিলিত অনুবাদ। বাংলা গীতাঞ্জলি মূলত কয়েকটি গানের সংকলন এবং পদ্যে রচিত। ইংরেজি গীতাঞ্জলির অনেকটাই রবীন্দ্রনাথের নিজের মূল কবিতাগুলোর ভাবানুবাদ ছিল গদ্য আকারে কবিতা হিসেবেই সমাদৃত। ওই গদ্যের বক্তব্য ও তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্যেও ছন্দপতন ঘটেনি। বাংলা গানগুলোর যথার্থ ইংরেজি অনুবাদ কষ্টকর হলেও রবীন্দ্রনাথের অনুবাদের যে ভাব-ভাষা-ভাবনা ও চিত্রকল্প তা তৎকালীন পাশ্চাত্য জগৎকে চমকিত করে করেছিল। ইংরেজি অনুবাদের ভূমিকা লিখেছিলেন ইয়েটস। গীতাঞ্জলি সম্পর্কে এজরা পাউন্ড অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছিলেন যা সাধারণত তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ছিল না। অথচ যে এজরা পাউন্ড কবিতায় সংহতি, সংক্ষিপ্ততা ও মেদবাহুল্য বর্জন করতে চেয়েছেন গীতাঞ্জলি সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত হননি। কাজেই গীতাঞ্জলি ইংরেজি ভাষাভাষি পাঠকের কাছে যেমনভাবে উপস্থিত এবং তার যে সংবেদনশীলতা ও ব্যঞ্জনা তার চেয়ে সম্ভবত আমরা অনেক বেশি পাই ওই গানগুলোতে। কিন্তু তারপরেও গীতাঞ্জলি ইংরেজি ভাষার সৃষ্টি হিসেবেই পাশ্চাত্যকে গভীরভাবে আপ্লুত করেছিল।
বিদেশে তৎকালীন পত্র-পত্রিকা এবং বিখ্যাত সাহিত্যিকদের লেখার মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ-এর নাম চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত হয়। রবীন্দ্র-প্রতিভার নানাবিধ বিচ্ছুরণের মধ্যে একটি হলো তাঁর ব্যক্তিত্বের বিরল আকর্ষণ ও সম্মোহনী শক্তি যা তাঁর লেখার মধ্যেও স্বতঃপ্রকাশমান। পাশ্চাত্য জগৎ তাই সেদিন তাঁকে আবিষ্কার করে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করেছিল। আমাদের প্রাচ্য ভূখণ্ডে ভারতবর্ষে, বিশেষত, বাংলাদেশে (তৎকালীন পশ্চিম ও পূর্ববঙ্গ মিলিতভাবে) তাঁর নোবেলপ্রাপ্তির পর যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হয় তাতে তিনি দুঃখ পেয়েছিলেন এবং একথা বলেছেন যে, পাশ্চাত্যের অনুমোদনের পরেই তাঁর নিজের দেশের লোকেরা অত্যধিক আনন্দ ও স্ফূর্তি করেছেন। সেই সময় পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) কালীগ্রাম পরগনার রাতোয়ালের জমিদার তাঁকে প্রথম নোবেল বিজয়ের কারণে সংবর্ধনা প্রদান করেন। আবার অনেকে কটাক্ষ করতেও ছাড়েননি। অথচ এশিয়ার প্রথম নোবেল পুরস্কার বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ কেবল ভারতবর্ষকেই নয়, প্রকৃতপক্ষে বাংলার সংস্কৃতি ও তার পরিশীলিত চৈতন্যকে আপন মেজাজে বিশ্বের কাছে পরিচিতি করেছিলেন। আমাদের কাছে নোবেলপ্রাপ্তির বিষয়টি এ-কারণে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলা গীতাঞ্জলির প্রকাশকাল ৩১ শ্রাবণ ১৩১৭ সন। সেখানে সূচনায় ‘বিজ্ঞাপন’ শিরোনামে তিনি বলেন, ‘এই গ্রন্থের প্রথম কয়েকটি গান পূর্বে অন্য দুই-একটি পুস্তকে প্রকাশিত হইয়াছে। কিন্তু অল্প সময়ের ব্যবধানে যে-সমস্ত গান পরে রচিত হইয়াছে তাহাদের পরস্পরের মধ্যে একটি ভাবের ঐক্য থাকা সম্ভবপর মনে করিয়া তাহাদের সকলগুলিই এই পুস্তকে একত্রে বাহির করা হইল।’ মোট একত্রিত গানের সংখ্যা ১৫৭টি এবং এর সবই প্রায় বাংলা ১৩১৭ সনে লেখা। কেবল শুরুর কয়েকটি গান বাংলা ১৩১৩ থেকে ১৩১৬ সনের মধ্যে লেখা হয়েছিল। এই গানগুলো তাদের গীতরূপে এখন আমাদের সকলের নিত্যপরিচিত।
প্রতিটি গানেই রবীন্দ্রনাথের সীমা থেকে অসীমের দিকে অভিযাত্রায় পর্যবসিত। তাঁর প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভক্তি রসাত্মক আধ্যাত্মিক চিন্তা ও চেতনার উপস্থিতি চোখে পরার মতো। একটা গভীর অস্তি ও পরমাত্মার প্রতি জীবের নিবেদন গানগুলোর আদ্যোপান্ত উচ্চারিত তো বটেই তাদের বাণী, তাদের সুরারোপিত যে অনন্য উপস্থাপনা তা আজকের বাঙালির অন্তরতম চিত্তে শাশ্বতভাবে স্বয়ংক্রিয়। সেখানে খুঁজে পাওয়া যায় বাঙালির অভাব-অভিযোগ, অত্যাচার-অনাচার থেকে পরিত্রাণের চিরন্তন পথ। বিভিন্ন মত ও পথের সমাহারে একের মধ্যে বহুর সন্নিবেশ উপলব্ধি করতে সবাই পারেনি। প্রথম কয়েকটি গান মনের মধ্যে বারবার গুমরে ওঠে না এমন শিক্ষিত বাঙালি আজকের দিনে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু বাংলায় এটি প্রকাশনার মুহূর্তে বা তার স্বল্পকাল পরেও রবীন্দ্রনাথের অন্য অনেক রচনার মধ্যে গীতাঞ্জলির তেমন কোনো স্বতন্ত্র মূল্যায়ন তৎকালীন বাঙালি কেন আজও হয়না।
গীতাঞ্জলি বিশ্বময় ছড়িয়ে গেল ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে। তখন তাঁর বয়স ৫৪ বছর। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ তৃতীয়বারের মতো ব্রিটেনযাত্রা করেন। পুত্র রথীন্দ্রনাথকে সঙ্গে নেবার কথা ছিল। কিন্তু কবি হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে তাঁকে পূর্ণ বিশ্রাম নিতে হয় শিলাইদহে ও কালীগ্রাম পরগনার পতিসরে কয়েক মাসের জন্যে। বিশ্রামের মধ্য দিয়েই মাঝে মাঝে তিনি কিছু হালকা কাজ করেন চিন্তা ও চেতনাকে ব্যস্ত রাখবার জন্য। এই হালকা কাজগুলোর একটি ছিল গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ। শেষ পর্যন্ত ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসের প্রথম দিকে তিনি তৃতীয়বারের মতো ব্রিটেনে উপস্থিত হন। যেতে যেতে জাহাজে বসে গীতাঞ্জলির আরো কয়েকটি গানের অনুবাদ তিনি করেছিলেন।
ইতিপূর্বে ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে চিত্রশিল্পী স্যার উইলিয়াম রদেনস্টাইনের সঙ্গে কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ঘটে। সে-সময় শিল্পী রদেনস্টাইন শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন। এবারে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সঙ্গেই যোগাযোগ করলেন। রদেনস্টাইন রবীন্দ্রনাথের অনুবাদগুলো টাইপ করে তার কপি কয়েকজনের কাছে প্রেরণ করেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস, স্টপফোর্ড ব্রুক এবং এন্ড্রু ব্র্যাডলি। ৩০ জুন রদেনস্টাইন রবীন্দ্রনাথের এই কবিতাগুলো পাঠের ব্যবস্থা করেন তাঁর স্বগৃহে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন অনেকে। তাদের মধ্যে রদেনস্টাইন ও ইয়েটস ছাড়াও ছিলেন মে সিনক্লেয়ার, আর্নেস্ট রাইস, চার্লস ট্রেভেলিয়ান ও চার্লস ফ্রিয়ার এন্ড্রুজ। এন্ড্রুজ পরবর্তীকালে শান্তিনিকেতনে শিক্ষকতা করেন। এরপরে কয়েকটি নৈশভোজের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ বেশ কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মিলিত হন। এঁরা ছিলেন জর্জ বার্নার্ড শ, এইচ জি ওয়েলস, বার্ট্রান্ড রাসেল, জন গলসওয়ান্দি, রবার্ট ব্রিজেস, জন মেস ফিল্ড, স্টার্জ মুর এবং ডাব্লিউ এইচ হাডসন। ইয়েটস গীতাঞ্জলি থেকে কয়েকটি কবিতা পড়েছিলেন যা উপস্থিত সবাইকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। এখানেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে চার্লস ফ্রিয়ার এন্ড্রুজের দেখা হয়। এর পরে রবীন্দ্রনাথকে উপলক্ষ করে কয়েকটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় যার মধ্যে একটি হয় ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট ক্লাবে ৮ জুলাই এবং অপরটি ইন্ডিয়া সোসাইটি কর্তৃক আয়োজিত হয় ১০ জুলাই ট্রুকেডেরো রেস্টুরেন্টে। এ আয়োজনটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ এবং এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী হয়েছিল। এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন রদেনস্টাইন। এ উপলক্ষে একটা লিফলেট ছেপে বিলি করা হয়েছিল। তাতে সভাপতিত্ব করেছিলেন ডব্লিউ বি ইয়েটস। সেই নৈশভোজে ৭০ জন উপস্থিত হয়েছিলেন। যার মধ্যে ছিলেন ইয়েটস ও রদেনস্টাইন ছাড়াও এইচ জি ওয়েলস, জে ডব্লিউ ম্যাকেইল (অক্সফোর্ডের প্রফেসর), হার্বার্ট ট্রেনচ (আইরিশ কবি ও নাট্যকার), জে ডি এন্ডারসন (কেমব্রিজের বাংলা প্রভাষক), টি ডব্লিউ আরনল্ড (ইন্ডিয়া অফিসে কর্মরত এবং ইংল্যান্ডে ভারতীয় ছাত্রদের উপদেষ্টা), আর ভন উইলিয়ামস (রয়াল কলেজ অফ মিউজিকের প্রফেসর), টি ডব্লিউ রলস্টন (ডাবলিন ইউনিভার্সিটি রিভিউয়ের এডিটর) এবং এরকম আরো অনেকে। সেখানে রবীন্দ্রনাথের সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে সবাই গভীরভাবে প্রভাবিত হন।
গীতাঞ্জলি প্রথম প্রকাশ করে লন্ডনের ইন্ডিয়া সোসাইটি ১ নভেম্বর ১৯১২-তে। ৭৫০টি কপি সেই সংস্করণে ছাপা হয়েছিল। এর মধ্যে ২৫০ কপি বিক্রির জন্যে রাখা হয়। এরপরের সংস্করণ প্রকাশ করে ম্যাকমিলান অ্যান্ড কোম্পানি ১৯১৩-তে এবং সেই সংস্করণ ১০ বার পুনর্মুদ্রিত হয় ১৯১৩-এর নভেম্বরের আগেই। ১৩ নভেম্বর ১৯১৩-তে তাঁকে নোবেল প্রাইজে ভূষিত করা হয়। রয়াল সোসাইটির ফেলো স্যার টমাস স্টার্জ মুর তাঁর নোবেল প্রাইজপ্রাপ্তির জন্য প্রথম প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ইংরেজি গীতাঞ্জলি, যার আধ্যাত্মিকতায় পাশ্চাত্য জগৎ বিমোহিত হয়েছিল সেটার সঙ্গে বাংলা গীতাঞ্জলির ব্যবধান অনেকখানি। ইংরেজি গীতাঞ্জলিতে বাংলা গীতাঞ্জলি থেকে নেওয়া হয়েছে ৫৩টি কবিতা, গীতিমাল্য থেকে নেওয়া হয়েছে ১৬টি, নৈবেদ্য থেকে ১৬টি, খেয়া থেকে ১১টি, শিশু থেকে ৩টি, কল্পনা থেকে ১টি, স্মরণ থেকে ১টি, চৈতালী থেকে ১টি, উৎসর্গ থেকে ১টি ও অচলায়তন থেকে ১টি, এই মোট ১০৪টি। ইংরেজি সংস্করণে নৈবেদ্যের ৭৯ এবং ৯০ নম্বর কবিতা এক হয়ে ইংরেজি গীতাঞ্জলির ৯৫ নম্বর কবিতায় রূপান্তরিত হয়েছে। ইংরেজি গীতাঞ্জলি যেভাবে পাশ্চাত্য চোখে ধরা পড়েছে তাতে কবিতাগুলোর ভেতরে সঞ্চারিত যে আধ্যাত্মিকতা, দর্শন ও আত্মার অধিবিদ্যামূলক উন্মোচন তাতেই তারা বিমোহিত ও চমকিত হয়েছিলেন। অনুপুঙ্খভাবে পড়লে দেখা যায়, প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি গীতাঞ্জলি বা সং অফারিংস ইংরেজিতে তাঁর মৌলিক রচনা যার সঙ্গে বাংলা গীতাঞ্জলির একটা গভীর সাদৃশ্য থাকলেও এই ইংরেজি সৃষ্টিগুলো আলাদাভাবে তাদের নিজের মতো করেই নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। সেই ইংরেজি কবিতাগুলোই নোবেল প্রাইজ প্রাপ্ত হয়েছে। ইংরেজিতে যে ১০৩টি কবিতা বা গান নেওয়া হয়েছে তার মধ্যে ৫৩টি নেওয়া হয়েছে গীতাঞ্জলির মূল বাংলা বই থেকে। বাকি ৫০টি নেওয়া হয়েছে অন্যান্য প্রকাশনা থেকে, যেমন- গীতিমাল্য, নৈবেদ্য, খেয়া, শিশু, কল্পনা, স্মরণ, চৈতালী, উৎসর্গ; এবং একটি গান নেওয়া হয়েছে অচলায়তন নাটক থেকে। ইংরেজি গীতাঞ্জলির লেখাগুলো প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথের ১৯১২ পূর্ববর্তী এক দশকের লেখার ভেতর থেকে চয়ন করা।
লেখাগুলোকে যেভাবে সাজানো হয়েছে তাতে কোনো কালানুক্রম অনুসৃত হয়নি, এবং কবিতাগুলোর মধ্যে তেমন কোনো পরম্পরাও নেই আর সে জন্যে প্রতিটি কবিতাই আলাদাভাবে বিবেচ্য। যে সমস্ত চিত্রকল্প এখানে উপস্থিত সেগুলো আমাদের তৎকালীন পূর্বাঞ্চলের পরিচিত জীবন ও জগৎ থেকে আহরিত এবং যে ভাব ও চিন্তাচেতনা সেখানে প্রকাশিত হয়েছে তাতে গভীর একটি ছাপ উৎকীর্ণ হয়েছে ঔপনিষদিক ভগবৎ চিন্তার। মধ্যযুগীয় চিন্তায় কেন্দ্রে যে ভক্তিবাদের গভীর প্রভাব ছিল তার প্রতীকী দ্যোতনা এবং বাংলা বাউল-বৈষ্ণবের গানের যে রস সেটাও সঞ্চারিত হয়েছে সর্বত্র; কিন্তু গানগুলো কোনো তাত্ত্বিকতার ভারে কখনই জর্জরিত হয়নি। রবীন্দ্রনাথের মন্ত্রহীন ব্রাত্য রূপটিও ইংরেজি কবিতাগুলোতে বিদ্যমান।
পশ্চিমা জগৎ যদি আমাদের মতো রবীন্দ্রসংগীত শুনতে পারত তার পরিপূর্ণতায় তার গভীর অধ্যাত্মবোধসহ এবং তাকে উজার যে ভাব ও সুরের খেলা, যা আমাদের অন্য একটি লোকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, তার পরিচয় পেলে রবীন্দ্রনাথের সত্যকার মূল্যায়ন তাদের চোখে ধরা পড়তে পারত। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সামগ্রিকতায় ওই ইংরেজি গীতাঞ্জলির অনেক ঊর্ধ্বে অথচ ওই ছোট কয়েকটি সৃষ্টি দিয়েই রবীন্দ্রনাথ সেদিন বিশ্ব জয় করেছিলেন।
ইংরেজি গীতাঞ্জলি নিয়ে নোবেল প্রাইজপ্রাপ্তির অব্যবহিত পর স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বজুড়ে যে কৌতূহল এবং রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত জীবনের ওপর সংবাদ মাধ্যম ও উচ্চাকাক্সক্ষী মানুষের যে আগ্রহ ও আগ্রাসন, এবং তা অনেক সময় তাঁকে ব্যবহার করবার জন্যে, তাতে তিনি দারুণভাবে আহত হয়েছিলেন এবং তা বিভিন্ন সময়ে প্রকাশও করেছেন জোরালো ভাষায়। কিন্তু সাহিত্যকর্মী ও কবিকর্মীর কাছে রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির তথাকথিত অনুবাদকর্ম ও তার যে প্রক্রিয়া সেটিও কম আকর্ষণের বিষয় নয়। এই কবিতা অনুবাদের বিষয়ে অজিত চক্রবর্তীকে লেখা একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন যে, তিনি প্রকৃতপক্ষে সচেতনভাবে কবিতাগুলো ভাষান্তর করেননি বরং মূল লেখাগুলোর ভাব এবং গঠন ধারণায় রেখে প্রায় এক ধরনের ভাবের মধ্যে ভেসে যাওয়া এবং সেটা তাঁকে যেখানে নিয়ে গিয়ে উপনীত হয় সেটা অনেকটা তার অজ্ঞাতসারেই প্রায় অবচেতনায়। এমন একটা অবস্থার মধ্যেই ইংরেজি অনুবাদ বিভিন্ন সময়ে সাধিত হয়েছে।
একজন মহৎ কবি নিজের পদ্য অন্য ভাষায় অনুবাদের যে মানস প্রক্রিয়া গীতাঞ্জলির ক্ষেত্রে সেটাও পাঠক ও সমালোচকের জন্যে একটি গভীর তাৎপর্যপূর্ণ পর্যবেক্ষণের বিষয়। ইংরেজি কবিতাগুলো প্রকৃতপক্ষে তাঁর বিভিন্ন বাংলা কবিতার আলোকে একেবারে নতুন সৃষ্টি অন্য একটি ভাষায়। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি কবিতা মিলিয়ে দেখা যায় মূল বাংলা থেকে ইংরেজি কবিতাগুলো কতখানি দূরে অবস্থান করে। বাংলা কবিতাটি শুরু হয়েছে ‘আমার মিলন লাগি তুমি আসছ কবে থেকে’ এই দিয়ে। এখানে ‘আমি’ এবং ‘তুমি’ এই দুই সত্তার মধ্যে মিলনের যে উদগ্রীবতা এবং নিশ্চয়তা আবার কিছুটা এই দীর্ঘ প্রতীক্ষার সংশয় এর সঙ্গে সঙ্গে যদি সুরারোপিত গানটি শোনা যায়, যা বাগেশ্রি রাগাশ্রিত, তাহলে ইংরেজি প্রথম বাক্যটি এই বাক্যের মধ্যে ‘আমি’ এবং ‘তুমি’ যে-সত্তা এবং ভগবৎচিন্তার সঙ্গে সঙ্গে এর যে গভীর প্রেমাপ্লুত মানবিক আবেদন তার পুরোটাই একেবারে মি¤্রয়মান। এখানে কিন্তু প্রবল হয়ে উঠেছে একটি ঐশ্বরিক প্রতিরূপ। এই তুমিটি নিঃসন্দেহে ভগবৎচিন্তায় পর্যবসিত হয়েছে, যা উপনিষদ-ভারাক্রান্ত এবং আমির মধ্যে যে মানবিক প্রেমিকার জন্যে প্রতীক্ষা এবং প্রেমিককে পাওয়ার যে প্রবল আর্তি তা এই ইংরেজি চরণটি থেকে সম্পূর্ণভাবে ওঠে এসেছে। কাজেই আমাদের কাছে ইংরেজি গীতাঞ্জলির আবেদন কখনই তেমন গভীর হবে না। এর পরের পঙ্কিতে ‘তোমার চন্দ্র সূর্য তোমায় রাখবে কোথায় ঢেকে’ এই অনুভূতির মধ্যে যে থরথর কম্পমান অনিশ্চয়তা, বিশেষত এর কথা ও সুরে, ইংরেজি অনুবাদে দেখা যাবে তা একটা নিশ্চিত বিশ্বাসের মধ্যে দিয়ে উপস্থাপিত হয়েছে। বিশেষ করে শব্দদুটি প্রয়োগের ফলে এমনটি ঘটেছে।
কাজেই ব্যাপারটি দাঁড়িয়েছে নিশ্চিত বিশ্বাসের। প্রতিটি অনুবাদ বিশ্লেষণ করলে এই বিষয়টি পাওয়া যায় এবং সেটাই তৎকালীন পশ্চিমাদের মারাত্মকভাবে আবেগাপ্লুত হয়ে আকর্ষণীয় করে। রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্ব এবং ১৯১২-১৩-এর ঘটনাবলি আকস্মিকভাবে রবীন্দ্রনাথকে বিশ্বের দরবারে উপস্থাপিত করে তৎকালীন ভারতবর্ষকে যতখানি তার চেয়েও বেশি বাংলা ভাষা ও বাংলা সংস্কৃতিকে বিশ্বের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছিল। কৃতিত্ব সম্পূর্ণই রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি ও তার ব্যক্তিত্বের। স্মরণীয় যে, নোবেল গ্রহণের বক্তৃতায় (যা ১৯২১-এ তিনি সুইডিস একাডেমিতে পড়েছিলেন। অর্থাৎ নোবেলপ্রাপ্তির বেশ পরে লেখা) একটা বিরাট অংশ জুড়ে ছিল বোলপুরের শিক্ষাকেন্দ্রের জন্যে তার চিন্তাভাবনা। রবীন্দ্রনাথ যে চৈতন্যের রূপ দিতে চেয়েছিলেন তাঁর শিক্ষাকেন্দ্রের মধ্যে দিয়ে তা এই উপমহাদেশের সর্বত্র কখনই ছড়িয়ে পড়েনি ঠিকই কিন্তু বাঙালি সংস্কৃতির ওপর তার যে অনেকান্ত প্রভাব তাকে স্বীকার করতেই হবে। রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি গীতাঞ্জলি নিয়ে পরবর্তীকালে অনেক বাকবিত-া হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে গীতাঞ্জলি প্রকাশনার পরপরই বিভিন্ন সময়ে ইংরেজি রূপটির পরিবর্তন নিয়ে কথা ওঠে। রবার্ট ব্রিজেস, যিনি রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বয়সে কিছু বড় ছিলেন, ১৯১৫-তে রবীন্দ্রনাথের কিছু কবিতা সংকলিত করতে ইচ্ছা প্রকাশ করে তাঁর কিছু কবিতা সম্পাদনা করবার অনুমতি চেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের প্রকাশনা সম্পর্কে কোনো আপত্তি ছিল না, কিন্তু পরিবর্তনের বিষয়ে আপত্তি করেছিলেন। অবশ্য ব্রিজেস, যিনি ইংরেজি ভাষার একজন অসামান্য কবি ছিলেন, রদেনস্টাইন, ইয়েটস এবং বিলেতে রবীন্দ্রনাথের প্রকাশক ম্যাকমিলান কোম্পানিকে এ বিষয়ে প্রভাবিত করবার চেষ্টা করেন। ব্রিজেস কিছু কবিতার ভাষায় লক্ষযোগ্য পরিবর্তন করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ এ বিষয়ে মনে করতেন যে গীতাঞ্জলি যেভাবে প্রকাশিত ও সাধারণ পাঠক কর্তৃক সমাদৃত হয়েছে সেটা অন্য কারো পরিবর্তন না করাই ভালো, বিশেষত প্রথম প্রকাশনা যেহেতু ইয়েটস সম্পাদনা করেছিলেন কাজেই তাঁর বা প্রকাশকের অনুমতি ছাড়া আর কোনো সম্পাদনা করা উচিত নয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত বিনয়ী মানুষ ছিলেন এবং ইংরেজি তাঁর নিজের ভাষা নয় বলে ইংরেজি ব্যাকরণ ও তার স্বাভাবিক বাক্-প্রতিমার ওপর তাঁর বড় ধরনের দখল আছে তেমন দাবি তিনি কখনই করেননি। কিন্তু তারপরেও গীতাঞ্জলির অনেক সংস্করণ প্রকাশিত ও বিশ্বে আদৃত হওয়ার পর সেগুলোর কোনো পরিবর্তনের বিষয়ে তাঁর রুচি সায় দেয়নি স্বাভাবিকভাবেই। মূল যে কবিতাটি নিয়ে ব্রিজেসের এত আপত্তি সেটি ইংরেজি গীতাঞ্জলির ৬৭-নং কবিতা। মূল ইংরেজি গীতাঞ্জলিতে কবিতাটি নৈবেদ্য থেকে নেওয়া হয়েছিল যা ছিল বাংলায় এরকম :একাধারে তুমিই আকাশ, তুমি নীড়। হে সুন্দর, নীড়ে তব প্রেম সুনিবিড় প্রতিক্ষণে নানা বর্ণে নানা গন্ধে গীতেমুগ্ধ প্রাণ বেষ্টন করেছে চারি ভিতে। সেথা উষা ডান হাতে ধরি স্বর্ণথালা নিয়ে আসে একখানি মাধুর্যের মালানীরবে পরায়ে দিতে ধরার ললাটে; সন্ধ্যা আসে নম্রমুখে ধেনুশূন্য মাঠে চিহ্নহীন পথ দিয়ে লয়ে স্বর্ণঝারি পশ্চিম সমুদ্র হতে ভরি শান্তিবারি। তুমি যেথা আমাদের আত্মার আকাশ,অপার সঞ্চারক্ষেত্র সেথা শুভ্র ভাস-দিন নাই, রাত্রি নাই, নাই মানুষজন, বর্ণ নাই, গন্ধ নাই, নাই নাই বাণী। ব্রিজেস যেভাবে রবীন্দ্রনাথের মূল ইংরেজি পরিবর্তন করেন তা এখন মূল বাংলা কবিতাটির পাশাপাশি ইংরেজি দুটি অনুবাদ যদি রাখা যায় তাহলে দেখা যাবে যে, প্রকৃতপক্ষে ব্রিজেস যে পরিবর্তনগুলো এনেছেন তাতে সম্পূর্ণ কবিতাটির চিত্রকল্প ও ছন্দস্পন্দ ইংরেজি বাচনের দিক থেকে নিঃসন্দেহে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য এবং উচ্চৈঃস্বরে পাঠ করলে দেখা যাবে ব্রিজেসের পরিবর্তিত কবিতাটি ইংরেজি ভাষায় অনেক বেশি জীবন্ত হয়ে উঠেছে। রবার্ট ব্রিজেসের ভাষা ব্যবহারের ক্ষমতা ও যোগ্যতা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গভীর উচ্চমানের। কবিতাটিতে নিশ্চিতভাবে মনে হয়, রদেনস্টাইন এবং সঙ্গে সঙ্গে ইয়েটস পছন্দ করেছিলেন এবং ইয়েটস রবীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন এরপর ইয়েটস ব্রিজেসকে জানিয়েছিলেন যে রবীন্দ্রনাথকে তিনি এ-বিষয়ে লিখেছেন এবং তিনি আশা করেন যে তিনি তাঁকে প্রভাবিত করতে সমর্থ হবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তা হয়নি। প্রাথমিকভাবে পরিবর্তন না করার যে কারণটি তিনি জানিয়েছিলেন সেটি ছিল ইয়েটসের প্রাথমিক সম্পাদনা; কাজেই তাঁর অনুমতি ও তাঁর প্রকাশক ম্যাকমিলান কোম্পানির অনুমতির প্রয়োজন।
ব্রিজেস বিষয়টি ছাড়েননি। তিনি সম্ভবত তাঁদের অনুমতি আদায় করেও ফেলেছিলেন কিন্তু রবীন্দ্রনাথ রাজি হননি। তিনি ব্রিজেসকে জানিয়ে দিয়েছিলেন এই মর্মে যে, রবীন্দ্রনাথ কিন্তু কোনো এক সময় হয়ত ব্রিজেসকে পরিবর্তিত রূপে কবিতাটি ছাপবার অনুমতি দিয়ে ফেলেছিলেন এবং ব্রিজেসের সংকলনে কবিতাটি পরিবর্তিত রূপেই প্রকাশিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ যুক্তিবাদী মানুষ ছিলেন এবং তাঁর চরিত্র ছিল ইস্পাত কঠিন। ইয়েটস এবং রোদেনস্টাইনের সঙ্গে তিনি যে অবস্থান নিয়েছিলেন তার পেছনেও যথেষ্ট যুক্তি ছিল এবং তাতে তাঁর চরিত্রের দৃঢ়তাই প্রকাশিত হয়েছে। আবার অন্যদিকে তিনি ছিলেন বিরাট হƒদয়ের অধিকারী এবং ব্রিজেসের ব্যাপারটি তিনি হয়তো যথার্থ পরিপ্রেক্ষিতে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। গীতাঞ্জলি প্রকাশিত হওয়ার পরে এ-ধরনের ঘটনা বিলেতে যেমন ঘটেছে তেমনি নানা ধরনের গুজব তাঁর দেশের মানুষের মধ্যেও কম রটানো হয়নি। রদেনস্টাইন তাঁর স্মৃতিকথায় স্পষ্টভাবেই বলেছেন যে, ইয়েটস কোন কোন জায়গায় খুব সামান্য পরিবর্তনের কথা বললেও মূল টেক্সট রবীন্দ্রনাথের নিজের লেখা থেকে যেভাবে এসেছিল ঠিক সেভাবেই প্রকাশিত হয়। তৎকালীন ভারতে ছড়িয়ে যাওয়া গুজব সম্পর্কে রদেনস্টাইন এক জায়গায় বলেছেন যে, নোবেল প্রেজেন্টেশন বক্তৃতায় তৎকালীন নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান : এই বইটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন কিন্তু সঙ্গে ওই সময় তাঁর মূল লেখার কিছু ইংরেজি অনুবাদের প্রকাশনা তাঁদের সামনে উপস্থিত ছিল। সেগুলো ছিল এর মধ্যে কবিতার সঙ্গে তাঁর কিছু ছোট গল্প, তাঁর বাল্যস্মৃতি ইত্যাদির অনুবাদ, এবং বেশ কয়েকটি বক্তৃতা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। চেয়ারম্যানের বক্তৃতাটি শেষ হয় গীতাঞ্জলির ৮২নং কবিতা দিয়ে। এগুলো থেকে এটা স্পষ্ট যে রবীন্দ্রনাথের গানগুলোর যে অনুবাদ এবং সেগুলোর মধ্যে যে জীবনদর্শন উপস্থাপিত সেটাকে তাঁরা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এবং সম্পূর্ণ রবীন্দ্রনাথের বিরাটত্ব হয়ত খানিকটা অনুভবও করেছিলেন। তৎকালীন সময়ে আলফ্রেড নোবেলের দেওয়া কতগুলো শর্তকেও তাদের মানতে হয়েছে। এই সমস্ত মিলিয়ে খুব নিশ্চিতভাবেই রবীন্দ্রনাথকে সেইবার নোবেলে ভূষিত করা হয়। এমনকি ইংরেজ ঔপন্যাসিক টমাস হার্ডিকে বাদ দিয়ে। টমাস হার্ডি কিন্তু পরবর্তী সময়ে আর নোবেল পুরস্কার পাননি।
সুইডিস কবি, যিনি ১৯১৬-তে নোবেল প্রাপ্ত হন, দ্ব্যর্থহীনভাবেই বলেছিলেন যে, রবির কয়েকটি মাত্র কবিতা পড়েই বোঝা যায় যে তাঁর বিরাটত্ব কত যদিও আমরা তাঁর অন্যান্য লেখা পড়িনি। ঠিক একইভাবে নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে গীতাঞ্জলির কবিতার মধ্যে দিয়ে আমরা আমাদের যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ একজন কবিকে আবিষ্কার করি। আমাদের দিক থেকে গীতাঞ্জলির নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির একটা প্রধান তাৎপর্য হলো এই যে, কেবল ভারতবর্ষের সংস্কৃতিকে নয়। বিশেষত বাংলা ও বাঙালি সংস্কৃতিকে তিনি সেদিন বিশ্বের মঞ্চে নিয়ে গিয়েছিলেন। ইয়েটস ইংরেজি গীতাঞ্জলির ভূমিকার দ্বিতীয় অংশে বলেছেন এই কবিতাগুলোর মধ্যে তিনি এমন একটি জগৎকে আবিষ্কার করেন, এমন একটি ভুবন যা তার মর্মবাণীর মধ্যে দিয়ে তাঁর কাছে উপস্থাপিত করে এমন একটা ভাব-জগৎ যার স্বপ্ন তিনি সমস্ত জীবনধরে নিজের মধ্যে লালন করেছেন। তাঁর মনে হয়েছিল একটি অনন্য কৃষ্টির ফসল হচ্ছে ওই কবিতাগুলো। কিন্তু সেই উন্নত জীবনবোধ খুব সাধারণ ঘাস এবং কাশবনের ভেতর দিয়ে নিজেদের প্রকাশ করছে।
তাঁর মনে হয়েছে যে কবিতাগুলো এমন একটি ঐতিহ্যে জর্জরিত যাতে কাব্য ও বিশ্বাস যেন একাকার হয়ে গেছে এবং সে শিল্পকর্মটি শত শত বছর ধরে অধীত ও অনধীত উপমা রূপকে আবেগে বহুযুগের বহু মনীষীর বহু মহৎ চিন্তার ভেতর থেকে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে। তিনি আরো বলেছেন যে ঘটনাটি অবশ্য এখনো সংঘটিত হয়নি। তবু আশা করা যায় যথার্থ শিক্ষাদীক্ষার মধ্য দিয়ে বাঙালি একদিন সে পর্যায় পৌঁছতে পারে। ফরাসি গীতাঞ্জলির ভূমিকায় আঁদ্রে জিদের কাছে একেবারে প্রথমেই যেটা ভালো লেগেছিল তা হলো গীতাঞ্জলিতে বাহুল্য-বর্জন এবং এতো ক্ষুদ্র পরিসরে একটি বিশাল জীবনবোধকে ধারণ করা।
কবিতাগুলির অন্তর্নিহিত ভাবের মধ্যে মানব-মানবীর প্রেমের আড়ালে যে ভগবৎ প্রেম ও উপনিষদের ধর্মতত্ত্ব কাজ করেছে তার চেয়েও তাঁদের অনেক বেশি মোহিত করেছে শিল্পী রবীন্দ্রনাথের আবেগ সঞ্জীবিত অনন্য উপস্থাপনা। আঁদ্রে জিদ তাই বলতে পারেন, ‘জীবনের তাৎপর্য সম্পর্কে ঠাকুর মশাইয়ের কি মতামত সে তথ্য উদ্ঘাটিত করবার যোগ্যতা আমার নাই এবং থাকিলেও আমি চেষ্টা করিতাম না- সংক্ষেপেও নহে। তাহার একটি বিশেষ কারণ এই যে, তিনি উপনিষদের ধর্মতত্ত্বের কোন প্রকার বদল করিতে বা তাহাতে কোন প্রকার অভিনবত্ব আরোপ করিতে সম্পূর্ণ নারাজ। এবং সে ধর্মতত্ত্ব আর যাহাই হোক নূতন একেবারেই নহে। সুতরাং এ স্থলে আমি সে-তত্ত্বের প্রতি ভক্তি প্রকাশ করিতে বসি নাই। কিন্তু ঠাকুর মহাশয় যে আবেগ দ্বারা তাহা সঞ্জীবিত করিয়াছেন ও যে নিখুঁত নৈপুণ্যের সহিত তাহা প্রকাশ করিয়াছেন, তাহাতেই আমি মুগ্ধ।’
কবি ও শিল্পী রবীন্দ্রনাথ এইভাবে তাঁর কাছে একটা বিরাটত্বের মহিমায় উপস্থিত হয়েছেন। এজরা পাউন্ডের মতো কট্টোর সমালোচকের কাছেও এই কবিতার ছন্দসৌকর্যের শিল্পকর্ম ও তার সংগীতই প্রধান বলে প্রতিভাত হয়েছিল। ‘এ কবিতা পড়তে হবে আস্তে আস্তে, নিস্তব্ধ শান্তিতে, চেঁচিয়ে। কারণ এর ইংরেজি অনুবাদ লিখেছেন একজন বিরাট সংগীতকার, একজন ওস্তাদ শিল্পী যার কারবার আমাদের চেয়ে অনেক সূক্ষ¥ সংগীত নিয়ে।’ এজরা পাউন্ড বাংলাদেশের কথা নিয়েই কিন্তু শুরু করেছেন, ‘কোথায় আরম্ভ করবো ভাবছি। বাংলাদেশে পাঁচ কোটি লোক। বাইরে থেকে মনে হয় রেলগাড়িতে আর গ্রামোফোনে এরা বুঝি ডুবেছে। কিন্তু এর তলায় আছে একটা সংস্কৃতি, যার সঙ্গে তুলনীয় বারো শতকের প্রভোজঁ।’ তিনি আরো বলেন, ‘তাঁর সোনার বাংলা আমি শুনেছি। তার সুর সম্পূর্ণ প্রাচ্য, কিন্তু অদ্ভুত তার যাদু, ভিড়কে জমানোর মতো।’ তিনি রবীন্দ্রনাথের মধ্যে মহাকাব্যের বিরাটত্ব প্রত্যক্ষ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বাংলাভাষা সম্পর্কে তার পর্যবেক্ষণও দিয়েছেন। ‘পশ্চিমের মধ্যে মুক্ত-ছন্দের সবচেয়ে আধুনিক বিকাশের সঙ্গেই বাংলা ছন্দবৃত্ত তুলনীয়। ভাষাটাও সংস্কৃত। এর আওয়াজ আমার কানে শুদ্ধ গ্রিক ভাষার কাছাকাছি লাগে।’ এই প্রসঙ্গে বাংলা ভাষা সম্পর্কে তাঁর আরো পর্যবেক্ষণ হলো, ‘ বাংলাভাষা বিভক্তিমূলক, তাই এতে মিল সহজ। গ্রিক বা জার্মানের মতো বাংলাতে সমাস বা সন্ধি চলে। ঠাকুরমশায় বললেন তিনি এর ব্যবহার প্রায় সব কবিতাতেই করেন।’ এই কথাগুলো বলে নিয়ে বাংলা ভাষা সম্পর্কে তিনি একটি গভীর বক্তব্য দিয়েছেন, ‘ এসব দিয়ে দেখাতে চাই যে বাংলা ভাষার কবিতার সহায়, এর তারল্য এবং ব্যাকরণের নমনীয়তায় শব্দের সার্থক তীক্ষèতা আনা যায়। এ ভাষায় কথার পারম্পর্য এদিকওদিক করা যায়, ইংরেজির মতো অর্থের গোলমাল না করে।’
বাংলাভাষা ও বিশেষ করে কাব্যভাষার এই অন্তর্নিহিত শক্তিগুলি এজরা পাউন্ডের চোখে ধরা পড়েছিল। রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির অনূদিত কবিতাগুলোর মধ্যেই এজরা পাউন্ড অত্যন্ত উৎকৃষ্ট গদ্য ছন্দের ব্যবহার দেখেছিলেন এবং তার ভেতর দিয়ে বাংলার সংস্কৃতি তাঁর কাছে যেমন মনে হয়েছে তাই বলেছেন, ‘কিন্তু এর ভেতরে আর একে ঘিরে আছে একটা বিচিত্র শান্ত স্থিরতা। হঠাৎ আমরা খুঁজে পেলুম আমাদের নতুন গ্রীস।’ এভাবে নানান দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলার কৃষ্টি পাশ্চাত্যের চোখে ধরা পড়েছে রবীন্দ্রনাথের প্রাচ্য বিষয়ের ঊর্ধ্বে। তাঁর যে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য সে সম্পর্কে এজরা পাউন্ডের উপসংহারের উক্তি, ‘তাঁর কবিতার সৌন্দর্য স্পষ্টতই প্রাচ্যের কিন্তু সংহত কঠিন। অধিকাংশ দক্ষিণ প্রাচ্যের শিল্পের অতিপ্রাচুর্য এতে নেই, আমাদের মন এতে ব্যাহত হয় না। তাঁর রচনা শান্ত, ধীর, রৌদ্রদীপ্ত, বসন্তময়।’ বিগত শতকের শুরুতে রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি গীতাঞ্জলি এভাবে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে ইউরোপ তথা পাশ্চাত্যকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছিল এবং সেই কৌতূহল ও উদগ্রীবতার মধ্যে দিয়ে পাশ্চাত্য কেবল রবীন্দ্রনাথকে দেখে নাই সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ও বাংলার সংস্কৃতিকেও প্রত্যক্ষ করেছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর অনন্য প্রতিভা দিয়ে সেদিন আমাদের সংস্কৃতিকে বিশ্বের পরিমন্ডলে পরিব্যাপ্ত করে দিয়েছিলেন। এখনো আমাদের চৈতন্যে রবীন্দ্রনাথকে দিয়েই আমরা বিশ্বের অনেকখানি অবলোকন করি। আমাদের জাগরণে, তন্দ্রায়, স্বপ্নে তাই তাঁরই চরণধ্বনি শুনতে পাই অনবরত।
সহায়ক গ্রন্থাবলি
১. মোঃ ইসরাফিল আলম, বাংলাদেশ: রাষ্ট্র-রাজনীতি, সরকার ও সংবিধান
২. রবীন্দ্র জার্নাল , খ--৩৩, সংখ্যা-১, সেপ্টেম্বর, ২০১৫
৩. ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী, আঁন্দ্রে জিদের ফরাসি গীতাঞ্জলির ভূমিকা
৪. বিষ্ণু দে , এজরা পাউন্ডের নিবন্ধ ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’
৫. মিহিরকান্তি চৌধুরী , ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, ঢাকা
৬. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর , গীতাঞ্জলি
৭. Rabindranath Tagore, GITANJALI
৮. প্রশান্ত কুমার পাল, রবীজীবনী
২৪. হক ও রহমান, ধন বিজ্ঞানের কথা, (দ্বাদশ সংস্করণ, ঢাকা: বাংলাদেশ বুক করপোরেশন, ১৯৮৬), পৃ. ২৯৫.
২৫. ডক্টর মুহম্মদ আবদুর রহিম, বাংলাদেশের ইতিহাস, (ঢাকা: নওরোজ কেতাব বিতান, ১৯৭৭), পৃ. ৪৭৯.
২৬. তদেব।