অনিকেত শামীমের কবিতা: প্রণয় ও দ্রোহ কেন্দ্রিক উপলব্ধির উৎসার  ♦ ফারুক সুমন 
অনিকেত শামীমের কবিতা: প্রণয় ও দ্রোহ কেন্দ্রিক উপলব্ধির উৎসার  ♦ ফারুক সুমন 
"মাথায় অগ্নিপিণ্ড
চুপচাপ বসে আছি পিনপতন স্তব্ধতায়
আলোর ফেরিওয়ালা
সবকিছু ধরা পড়ে আমার এন্টেনায়
----    ------    -------     ------      -------
আমাকে দেখে না কেউ, দেখতে পায়না
ত্রিকালদর্শী অন্ধদেবতা তোমাদের মাঝে আলো ছড়াই
------       -------       -------       ------
অন্ধকারে হারায় হাহাকার
আর আমি কষ্ট পুষে পুষে গুটিয়ে থাকি
তোমাদের আলোকিত করে বসে থাকি অন্ধকারে" (পিলসুজ) 
কবি অনিকেত শামীম এভাবেই তার কবিস্বভাবের স্বরূপ উন্মোচনে প্রয়াসী। নিজের কবিসত্ত্বাকে আড়ালে রেখেই কবিতার আরাধনা সাঙ্গ করতে চান। সবার সম্মুখে থেকেও তিনি যাপন করেন নিজস্ব কবিজীবন। যেখানে তিনি একাই আনন্দ বেদনার ভাষা নিয়ে মেতে ওঠেন। তার একান্ত জীবনের প্রতীকী নাম অন্ধকার। যে অন্ধকার কখনো কখনো আলোর সমার্থক।  অন্ধকারে যুক্ত হয়েছে ব্যক্তি ও সমকালীন হাহাকার। কবি যে অন্য সাধারণের মতো নয়। চিন্তা ও মননে কবি যে স্বতন্ত্র। তার উচ্চারণ দেখি কবিতায়-
"কবিও মানুষ বটে, অন্যরকম
ভেঙে গড়ে
গড়ে ভেঙে
কবি তৈরি করে শ্রেষ্ঠতম শিল্প" (ঈশ্বর, মানুষ ও কবি)

কবি অনিকেত শামীম। নব্বই দশকের বাংলা কবিতায় কবি হিসেবে তার আত্মউন্মোচন।  যদিও দশক দিয়ে একজন কবির কবিত্বকে সুনির্দিষ্ট করার পক্ষে আমি নই। আমার দৃষ্টিতে "দশকধারণা" কেবল সময়কে সুচিহ্নিত করার উপায় মাত্র। কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের মতো আমিও মনেকরি, "দশক গৌণ কবিদের আশ্রয়"। নানাকারণে অনিকেত শামীম আলোচিত নাম। কারণ কবিতা লেখার সমান্তরালে একজন নিবিষ্ট সাহিত্যকর্মী ও সম্পাদক হিসেবে সমকালে তার চেষ্টা ছিল চোখে পড়ার মতো। শিল্প-সাহিত্যে সদা সমর্পিত এই কবি একই সাথে নবীন ও প্রবীণ লেখকদের ঘনিষ্ঠজন হয়েই তার কাব্য-তরণী কাব্যতীর্থ অভিমুখে ভাসিয়েছেন। স্বাধীনতা-উত্তর  কালখণ্ডে বাংলাদেশের সাহিত্যপথরেখায়  লিটলম্যাগ-কেন্দ্রিক সাহিত্য চর্চার যে উর্বর জমিন তৈরি হয়েছে। সেই জমিনের স্বতঃস্ফূর্ত একজন অংশীদার তিনি।  তার সম্পাদনায় প্রকাশিত "লোক"।  এই সাহিত্য পত্রিকা বাংলা ভাষাভাষী মানুষ এবং সাহিত্যানুরাগীর কাছে সমান আগ্রহের। যা এখনো সচল রয়েছে। তরুণ কবি ও লেখক বরাবরই তার আনুকূল্য পেয়ে এসেছেন। 


কবিতার আলোচক যিনি, কখনো কখনো তাকে স্বৈরাচারী হতে হয় বৈকি। কারণ একজন কবি ঠিক কখন, কোন ভাব ও আবেগের খোড়ল থেকে কবিতার পাখিকে ভাষাবন্দি করেছেন, তা আলোচক জানেন না। কিংবা এ-ও জানার উপায় নেই যে, কোন অন্তর্গত দহনে কবি লিখতে বাধ্য হয়েছেন অন্তর-অনলে পোড়া আবেগমমথিত পঙক্তিমালা! ফলে কবির ধ্যান-অভিজ্ঞান এবং যাপিত জীবনের ওপর চিন্তাবিন্দু স্থির করে নিয়ে তবেই আলোচক তার আলোচনায় অগ্রসর হন। দৃষ্টিভঙ্গির বৈপরীত্য এখানেই তৈরি হয়। আর এটাকে স্বাভাবিক ধরেই কবিতার আলোচনায় অবতীর্ণ হতে হয়। কবিতা ভাবঘনিষ্ঠ শিল্পমাধ্যম।
ফলে বিষয় উপস্থাপনের ভঙ্গী যেমন কবিতায় জরুরি। তেমনি বিষয়কে ভাবের পাত্রে উত্তপ্ত করে তবেই কবি আবিষ্কার করেন হৃদয়গ্রাহী ব্যঞ্জনাবহ বাণী। অনিকেত শামীমের কবিতায় বিষয়ের বৈচিত্র্য বহুমাত্রিক হলেও ব্যক্তিকবির প্রণয় ও দ্রোহের উন্মুখ উৎসারণ চোখে পড়ার মতো।

♦ কবিমাত্রই প্রণয়ের কারবারি। মুহূর্তের অনুভবের মতো কবি অনিকেত শামীমের প্রণয় হঠাৎ "আলোর ঝলকানি"। তার প্রণয়প্রকাশ কুয়াশাময়  কোনো ক্যানভাস। যেখানে মান অভিমানের ফুল ফুটে থাকে হাসিমুখে। কষ্ট আছে; অথচ কবির সেই হাসি অবিনাশী। কবি স্মৃতির বাতায়নে হাত রেখে আলতো করে ছুঁয়ে যান হারানো শৈশব-

" আজও পাহাড় দেখার তীব্র বাসনার কথা মনে হলে 
চুপিচুপি তোমাদের গ্রামে যাই।
......    ........    .......   ........
শস্য কাটা হয়ে গেলে পড়ে থাকে হাহাকার
বিরান মাঠে আমাদের প্রেমপর্ব
গোল্লাছুট দাড়িয়াবান্ধা
দীর্ঘশ্বাস বুকে নিয়ে পড়ে থাকে শূন্যমাঠ
.......  ........   .......   .......  .......  ......
শৈশবের আরেক নাম হাহাকার-
হারিয়ে যাওয়া পথ" (দূরাগত পাহাড়ের গান)

কিংবা,

"কুলপিতে জমানো বরফ
সে তো শুধুই বরফ, প্রাণ নেই কোনো
পাথরে খোদিত কষ্ট দহনে দহনে খাক হয়ে যায়
পাথরের দুঃখ তো নয় জড়জীবন।' (কষ্ট কোলাজ)

♦ প্রণয়ে সন্দিগ্ধ মন চিরন্তন প্রেমেরই ধরণ। সন্দেহ ও প্রতীতির দোলাচলে কখনো কখনো মানুষকে বড় বেশি পর মনে হয়। অচেনা লাগে সবকিছু।  মানুষের আড়ালে পড়ে থাকে মৃত অনুভব। কবি অনিকেত শামীমের কবিতায় এরকম অন্তর্গত অভিপ্রায় বেশ কিছু কবিতায় লক্ষণীয়-

"ক্রমশ সন্দেহ থেকে বিচ্ছেদযাত্রার পদাবলি, অনন্তপুর
ক্রমশ সন্দেহ থেকে ভালোবাসার জয়ধ্বনি, নিশ্চিন্তপুর" (জীবনের সারবত্তা)

কিংবা,

"ও মানুষ, চির রহস্যময় মানুষ
তোমার ঘূর্ণায়মান বৃত্তে বিনাশী আয়োজন
রহস্যঘেরা জটিল বৃত্তে হা-হুতাশ
তুমি কীভাবে ভেদ করবে অনঙ্গ রহস্য
বোধের গভীরে আছে কি কোনো চাবিমাস্টার?" (উত্তর আধুনিক)

প্রেমের বেদনায় বিষাদাক্রান্ত হতে দেখা যায় বেশ কিছু কবিতায়। অভিমানে প্রেয়সীর কাছে ভীষণ নিবেদিত কবি। অবুঝ শিশুর সরলতায় উচ্চারণ করেন-
'জ্বালাতে জ্বালাতে কতটুকু পোড়াবে তুমি
আমি তো পুড়ে পুড়ে বিষনীল ছাই
এই বুকে হাত রেখে দেখো
পিলসুজের মতো কতটা কষ্ট পুষেছি সংবর্তিকা আমি
কষ্ট-উত্তাপে গলে গলে যাবে তোমার সাগ্নিক হৃদয়' (অনির্বাণ দাহ)

♦ কবি যখন কবিতার ঘোরে সমর্পিত থাকেন, তখন তিনি অন্য মানুষ। কিছুটা অপ্রকৃতস্থও বলা যায়। ব্যক্তিক ও পরিপার্শ্বিক ঘটনাপ্রবাহের তোড় তাকেও স্পর্শ করে। কবিমনকে আচ্ছন্ন রাখে নানামাত্রিক সংবেদন। চাইলেও সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে বাঁচা যায় কি! যায় না। দেশকাল ও সময়ের আবর্তের কিনার ছুঁয়ে মৌলিক কবি খুঁজে নেন তাঁর কাব্যসরণি। তাঁর কাব্যভাষায় উচ্চকিত হয় সময়ের স্বর। সেই স্বর ব্যক্তিকবিকে ছাপিয়ে হয়ে ওঠে সমষ্টির স্বর। প্রথাগত দ্রোহের প্রকাশ যেমন জ্বালাময়ী ভাষণনির্ভর। কবি অনিকেত শামীমের দ্রোহ প্রকাশের ধরণ ঠিক তেমনটি নয়। দ্রোহ প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি শ্লোগানমুখর কবিতা লেখেননি। ধীরস্বভাবে কবি তার পুঞ্জিভূত ক্ষোভকে কবিতার ভাষাবোধে বপন করেছেন-

"নৌকার গলুইয়ে পড়ে থাকে সোনালি সকাল
এইখানে বারবার ছিঁড়ে যায় রুপোলি পাল
গহীন সাগরে দুরুদুরু কাঁপন শুরু হয়
ছিঁড়ে যায় ছিঁড়ে যায় মায়াবী পর্দার আলয়" (ছিঁড়ে যাওয়ার বিরুদ্ধতা)

কিংবা, 

"একটি সকাল, অভিমানী যুবকের গলায় ফেটে পড়ুক সাম্যের গান; 
একজন বন্ধ্যা নারী ঘোষণা করুক: 
'আজ থেকে ফুলে ফুলে সুশোভিত হবে পৃথিবী'
একজন খেতমজুর ভেঙে ফেলুক জমির সীমানা
একটি সকাল, কমরেড এই নিরালায় বসে
ঘামের তৈজস দিয়ে লেখো একটি বিশুদ্ধ কবিতা" (একজন সাহসী যুবকের কাছে প্রার্থনা)

♦ কবিতার বিষয় যদিও দৃষ্টিগ্রাহ্য দৃশ্যপট থেকে আহরিত। সাধারণের কাছে যা কিছু স্বাভাবিক এবং ভাবলেশহীন অপ্রয়োজনীয়। কবির কল্পনায়  তা ধৃত হয় অসম্ভব কাব্যিক মুখরতা নিয়ে। জীবনের বহুরঙ ও ঢঙ কবিতাকে দেয় শৈল্পিক উপস্থাপনের উন্মাদনা। তাঁর দ্রোহ স্বপ্নচেতনায় লীন। আশাবাদী উদারতায় তার কবিতা মুখরতা পেয়েছে। তিনি 'সভ্যতার নোতুন আবাসভূমি'র স্বপ্নে বিভোর।  জীবনবিমুখ বন্ধুদের উদ্দেশে তিনি লিখেন-
'হয়তো কোনো একদিন
সভ্যতার সিঁড়ি বেয়ে
হাঁটতে হাঁটতে
যেতে যেতে
পৌঁছে যাব নোতুন সভ্যতার কোনো আবাসভূমিতে' (সভ্যতার নোতুন আবাসভূমি)

♦ কবি আব্দুল মান্নান সৈয়দ তাঁর 'করতলে মহাদেশ' গ্রন্থের এক জায়গায় লিখেছেন, 'ব্যাকরণ মেনে লেখা হয় গদ্য, গদ্যের চারিত্র্যই ব্যাকরণের মান্যতায়, আর কবিতার স্বভাব ব্যাকরণের অস্বীকারে।'(পৃষ্ঠা-৬০) অনিকেত শামীম কবিতার ভাবকে বিরামচিহ্নের স্বল্পতায়  প্রয়োগে প্রয়াসী হয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি ব্যাকরণ মান্যতার ক্ষেত্রে একধরণের ঔদ্ধত্য দেখিয়েছেন বৈকি? তাঁর কবিতায় বিরামচিহ্নের প্রয়োগ যৎসামান্য। নেই বললেই চলে। বিরামচিহ্নে অভ্যস্ত পাঠকের কপালে ভাঁজ পড়তে পারে। সম্ভবত, কবি তার কাব্যবোধে বিষয়ের গভীরতাকে উন্মুক্ত প্রান্তরে শস্যবীজের মতো ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন এই আঙ্গিকে। কবিতার প্রকরণ পরিচর্যায় একরকম প্রথাসিদ্ধ অঙ্গীকার অস্বীকার করেছেন তিনি। 

♦ কবিতা শুধু পাঠের শিল্প নয়। পাঠের সাথে প্রয়োজন নিবিড় মনোনিবেশ। পাঠক নিজেই  অনুভব ও উপলব্ধির প্রগাঢ়তায় কবিতার রূপসৌন্দর্য্য আবিষ্কার করেন। কবিতায় জীবনের অন্তর্গত বোধকে অন্বেষণ গড়পড়তা পাঠকের পক্ষে সবসময় সম্ভব হয়ে ওঠেনা। ব্যক্তিক অনুভূতির স্বাতন্ত্র্য কবিতার উপলব্ধিকে স্বতন্ত্র মাত্রায় নির্দেশ করে। অনিকেত শামীমের কবিতায় উপলব্ধি প্রসঙ্গে অনুরূপ অভিনিবেশ প্রয়োজন। সময় ও প্রকৃতির সমান্তরাল বুনন তার কবিতায় স্বতন্ত্র স্বর ও সৌন্দর্যের ইঙ্গিতবাহী। তাঁর কবিতায় এমন বেশ কিছু পঙক্তি পাঠকের মনকে আন্দোলিত করবে। যেমন-

. আমাদের দুঃখগুলো বুকের কষ্টরেল হুইসেল বাজিয়ে চলে যায় (সুখ দুঃখের কড়চা)

. তুমি যতবার বলো ঘৃণা করি ঘৃণা করি
ভালোবাসা ততবার ন্যাপথলিন গন্ধ ছড়ায়, এই বুকে ( পঙক্তিমালা : তোমার জন্য)

. দহন হতে হতে হয়ে আসে হিম
  হিম হতে হতে হয়ে যায় লীন (হেরোইন সময়)

. একাকী ভাসানের দিকে গেলে ফেরে না চাকা (ফিরে আসে কবিতা)

♦ শিল্প হিসেবে কবিতাকে নান্দনিক অবয়ব দেয় অলঙ্কার। একটি নিরাভরণ সাধারণ কথাও কেবল আলঙ্কারিক উৎকর্ষে অসাধারণ কাব্যরসে অভিষিক্ত হয়। কবিতায় আলঙ্কারিক সৌকর্যে সৃষ্টি হয় অনির্বচনীয় আনন্দ। অলঙ্কার সমৃদ্ধ কাব্যগুণে বিমুগ্ধ সমজদার পাঠক মুহূর্তে মুচকি হেসে কবিতার ঘোরে নিজেকে সমর্পণ করেন। অনিকেত শামীম তাঁর কবিতায় কাব্যালংকার প্রয়োগে সচেষ্ট ছিলেন। 'উপমাই কবিত্ব' কিংবা 'চিত্রকল্পই কবিতা' ঠিক একধরণের একরৈখিক মনোভাব পোষণ করেননি তিনি। ফলে তার কবিতায় অলঙ্কারের উপস্থিতি সাবলীল। উপমা, চিত্রকল্প, প্রতীক কিংবা অর্থালঙ্কার তাঁর কবিতায়  দুর্লক্ষ্য নয়। 

চিত্রকল্প:
. অন্ধকারে সমর্পিত অনঙ্গ আলোঢেউ
অদৃশ্য দৃশ্যাবলির লিবিডো সময়
এখানে ঘরময় ছায়াদের অবিরাম উৎসব (ছায়াসঙ্গম) 

উপমা:
. সরীসৃপের মতো এঁকেবঁকে চলে যায় অন্ধকার (ভোর)
. বালিয়াড়ি পাখিদের মতো উড়ে উড়ে চলে যাই দূরদেশ (শব্দ-নৈঃশব্দ্যের অনুরণন)

সর্বোপরি, কবিতা মূলত বিশ্লেষণের বাইরে বোধের গভীরতায় উপভোগের ব্যাপার। কবিতার অনুভব পাঠকের একান্তই নিজস্ব বলে কবিতার আলোচনা পাঠককে কৌতূহলী করে মাত্র।  অনিকেত শামীমের কবিতার প্রতি পাঠকের এই  কৌতূহল উস্কে দেয়াই এই লেখার অবতারণা। কবি ও কবিতার জয় হোক।


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান