অমিতাভ মিত্র এর কবিতাগুচ্ছ
অমিতাভ মিত্র এর কবিতাগুচ্ছ

কবি - অমিতাভ মিত্র


জলরঙে আঁকা নৌকোগুলো

জলরঙে আঁকা নৌকোগুলো রাত হলেই খুলে দেয় রশি ,
হেলতে দুলতে তারা বেড়িয়ে আসে নৈঃশব্দের হারেম ,
তন্ময় হয়ে থাকা অনুভব
পাতা উল্টে দেখে যায় স্বর্গীয় সূচীপত্র I

বাধ্যতাগুলো নিরুপায় রঙে রাঙ্গিয়ে নেয় নামাবলি ,
গলুই ভর্তি গোলাপ বেচে বৈধব্য জুঁই নিয়ে ফেরে নৌকোরা ,
শিশিরে চোখ ধুয়ে আবার ভোর দেয় আজান I

জলরঙের পোঁচে আবার নতুন নৌকোয় ভরে যায় পৃষ্টা ,
নোঙ্গর করে সারাদিন তারা অপেক্ষা করে জোয়ানমদ্দ জোয়ারের ,
অপেক্ষার শেষে রাত হলেই

দাবীদার

দাবী করতে গেলে কিছু যোগ্যতা তো লাগেই ,
থাকতে হয় মন কে নস্যাৎ করে দেবার মতো যুক্তি ,
ছিন্নভিন্ন করে দেবার মতো আক্রোশ ,

যাদের থাকে তারা প্রেমিক হয়
আর
যাদের থাকেনা তারা কবি বনে যায় I

হিতৈষীর মতো তুমিও চেয়েছ কবিই হোক আমার একমাত্র পরিচয় ,
অমিত্রাক্ষর ছন্দে আমি লিখে চলি প্রসবযন্ত্রনাহীন স্বপ্ন ,
কুপি জ্বলা প্রায়ন্ধকার ঘরের মধ্যে বসে চেয়েছো
পাঁজরে আগুন জ্বালিয়ে দধীচী হোক সূর্য্য ,
চেয়েছো মৌনব্রত পালন করুক বেলাশেষের ধ্রুপদ ,

প্রিয়তমা বলেই হয়তো চুমু সরিয়ে দাবীরা তোমার ঠোঁটে ,
কবি বলেই লিখে দিলাম দানপত্রের দলিল I

কিচ্ছুটি নেই

এমন কোনো সেতু নেই
যার শৈশব ছুঁয়ে কাটিয়ে দিতে পারি প্রহর ,

এমন কোনো স্মৃতি নেই
যার আধো-বুলিতে জেগে থাকবে মরু-উদ্যান ,

কেউ বোঝেনা
অপূর্ণতার ফেলে যাওয়া হলুদ পাতার ইতিহাস I

বর্ষাকালীন প্লাবনে বাঁধের গায়ে চোখ মেলে ফাটল ,
অপটু পলেস্তারার ওপর আবার পড়ে কলিচুন ,
মুখচুন করে থাকা ইচ্ছেরা জেনেবুঝেও বাদ দিতে পারেনা অসফলতার অধ্যায় I

এমন কোনো সিন্দুক নেই
যার মধ্যে গচ্ছিত আছে আলটুসি লহমা ,

এমন কোনো আকাশ নেই
যার কানে মেঘদূত বলে যায় কারুর উচাটন ,

কেউ বোঝেনা
অক্ষরহীন শব্দের নিস্ফল কর্ষণ I

ক্লান্ত বর্ষনের পর সোঁদমাটি থেকে ভেসে আসে সৌভাগ্যের সুবাস ,
ভারসাম্যহীন সুখেদের নিস্প্রাণ তকমাগুলো বড্ড বেশি প্রাঞ্জল ,

কেউ বোঝেনা ,
গন্তব্যে পৌঁছোতে শুধুমাত্র মন ছুঁতে চাওয়া একটা মন হলেই চলে I

অকথিত উপন্যাস

তখন কতোই বা বয়েস
দুই কিম্বা তিন
বিকেল হলেই দাদুর কোলে চেপে পাড়া বেড়ানো
একমুহূর্তের জন্য চোখের আড়াল হলেই
ঠাকুমা আমাদের খুঁজতে বের হতো
লুলুও ল্যাজ নাড়াতে নাড়াতে ঠাকুমার পাশে I

ঠিক এমনই একদিনে আমাদের ছেড়ে গেছিলো লোকটা
তখন তেমন কিছু মনে না হলেও
বুঝতে পারতাম হারিয়ে গেছে সবচেয়ে প্রিয় আদরগুলো
বিমর্ষ লাগতো সক্কলকে
তাকে নিয়ে প্রশ্ন করলেই চোয়াল শক্ত হয়ে যেতো মায়ের
একটু বড় হবার পর বুঝতে শিখলাম লোকটা আমার বাবা I

সংসার খরচ দিতে মাসে একবার আসে
দরজা ভেজিয়ে থাকে সারাক্ষণ
একমাত্র আমারই ছিলো অবাধ প্রবেশের অধিকার
বারবার ভাবতাম ডাকার আগেই নিজে গিয়ে বসবো পাশে
জানতে চাইবো আমায় ছেড়ে যাওয়ার কারণ
কিম্বা কোলে বসে শুনতে চাইবো রূপকথার গল্প
হয়তো শুনতে চাইবো আরো আরো অনেককিছু
কিন্তু সব কথা যেমন ইচ্ছে থাকলেও বলা হয়ে ওঠে না তেমনই জানা হয়ে ওঠেনি আমার অপরাধ I

নির্মম মনে হতো লোকটাকে
স্কুলে পড়া সেলফিস জয়েন্টের থেকেও জেদি
মনে হতো উদাসীন লোকটার মনে আমার জন্য কোনো যায়গাই নেই
অথচ ঠাকুমার মুখে শুনেছি লোকটা নাকি দারুণ গান গাইত
যদিও আমি শুনিনি কখনও
তবে মাঝেমধ্যে মনে হতো সুরের সাধক কি করে এতো নিষ্ঠুর হয়
আস্তে আস্তে সহ্য হয়ে গেলো দিনযাপন
স্কুলে ভর্তি হওয়ার দিন জানতে পারলাম লোকটা আসলে সত্যিই আমার বাবা I

মাঝেমধ্যে কথা হতো ফোনে
অনর্গল কতো কিছুই বলেছি সেসময়
মনে নেই কিছুই শুধু
ওপার থেকে শব্দময় নিস্তব্ধতা বুঝিয়ে দিতো খুব মন দিয়ে সবকথা শুনছে বাবা
তখন মেলাতে চাইতাম নিজের ভাবনার সাথে তাঁকে
বারবার হোঁচট খেয়ে ভেঙ্গে যেতো অপ্রাপ্তির আক্রোশ
তার বলা কয়েকটা শব্দে মাখা থাকতো তারও অনেক অপ্রাপ্তি
ওপারে শিশির হয়ে ঝরে পড়া স্নেহের শব্দ শুনতে পেতাম এপার থেকে I

স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজ এবং তারপর কর্মক্ষেত্র
ততদিনে অনেকটা সড়গড় হয়ে গেছে সম্পর্ক
সাবলীল ভাবে আমিও তখন আবদার করতে পারি নিশ্চিন্তে
আর সেও যেন অপেক্ষা করে থাকে মেটাতে
প্রথমে দাদু তারপর ঠাকুমা চলে গেছে ছেড়ে
এমনকি লুলুও
মা আর খাঁ খাঁ দোতলা বাড়ি নিয়েই আমার আমার প্রতিদিন I

প্রায় দুবছর হলো নিজের পছন্দের সংসার
মা প্রথমে বাধা দিলেও বাবা কিন্তু আপত্তি করেনি বরং নিজের হাতে সাজিয়ে দিয়েছে আমার আনন্দ
হয়তো অন্য পাওনাগুলোর মতো এটাও পূর্ব নির্ধরিত ছিলো
বুঝেছি বারবার ভুল মূল্যায়ন করেছি আমরাই
তার আত্মমগ্নতা কে ভেবেছি নির্লিপ্ততা
হয়তো আমাদের কারুরই ভেতরটা দেখার মতো চোখই ছিলো না I

বাবার মুখ থেকে কতোবার শুনেছি তার আপোষহীন লড়াইয়ের গল্প
আস্তে আস্তে নিজেও তৈরী হয়ে গেছি তার মতো
একপশলা বৃষ্টি নামলেই মনে হয় একছুটে চলে যাই তার অফিস
সারা দুপুর গল্পে মেতে থাকি বাপ বেটি
আর লুঠ করে আনি তার অনাবিল হাসি আর সচ্ছতা
এতো মনখারাপের সময় পেরিয়েও কেন জানিনা আজ মনে হয়
আমি বাবার মতোই হতে চাই I

আমার আমি

জোর গলায় নিজেই বলি
প্রয়োজনে প্রতিষ্টা করার জন্য করি তর্ক
শুধুমাত্র তোমার বেলাতেই খাটে না কোনো যুক্তি I

ভেজা চুলে এখনও যখন এসে দাঁড়াও সামনে ,
ঠোঁট ছুঁইয়ে উষ্ণ করে দাও চায়ের কাপ ,
আলতো হেঁসে এলোমেলো করে দাও চুল ,
না চাইতেই ফিরে যাই প্রথম দিনের ভোরে ,
কানের পাশ দিয়ে উঁকিমারা সোনালী তটে সূর্য্য এখনও ডুবে যেতে চায় সোহাগে ,
বয়সের কোনও জারিজুরি খাটেনা এমন ছেলেমানুষীপনায় I

বোঝো বলেই হয়তো তুমিও মেটাও দু-দন্ড পাশে বসার আবদার
তবু ,
শুরুর দিনগুলোর মতো ঘড়িটা এখনও পার্ট করে যায় সতীনের ,
অফিসের এ্যাটেনডেন্স খাতায় প্রতি সপ্তাহে পড়ে লেট-লতিফের চিক ,
কৌতূহলে মাঝেমধ্যেই বড়বাবু জিজ্ঞেস করেন সন্তানের সংখ্যা ,
সহকর্মীদের ঠাট্টায় এখনও রীতিমতো লাল হয়ে যাই লজ্জায় ,
মুহূর্তে পাল্টে যায় অফিসঘরের মরশুম I

ময়দানে তোমার কোলে মাথা রেখে আকাশ দেখার দিনগুলো ফিরে আসে অবলীলায় ,
মন চায় আনচান করা দুপুরগুলো ফিরিয়ে আনি
হাফছুটি নিয়ে ,
যখন তুমিও না উচ্চারনে মাখিয়ে দেবে হ্যাঁ -য়ের সম্মতি ,
মনে হয় .....
দুজনে অবশ্যই আটকে দিতে পেরেছি সময়ের রংবাজি ,
মনে হয় ....
নতুন করে আবিস্কার করার মতো সম্পদ এখনও রেখে দিয়েছো যত্নে ,
মনে হয়
জলদস্যু এখনও উথালপাথাল করে দিতে পারে দরিয়া I

জোর গলায় নিজেই বলি সর্বত্র
অথচ ,
তোমার ক্ষেত্রেই অতীত আর বর্তমান একই ফ্রেমে বাঁধা I

ডাক্তারী


ক্যাপসুলগুলোর পেটে বেঁচে থাকার প্রচেষ্টা ,
দু চামচ সিরাপে এক পাঁইট এ্যালকোহলের আগুন ,
স্টেথো-য় হাঁপড়ের তাল শুনে প্রেসক্রিপশনে সঠিক পথ্যের পরামর্শ I

সময় অন্তর অন্তরের কাটাছেঁড়ার নিদান ,
এতো কিছুর পরও .....
কোয়াক ডাক্তার গ্যারান্টি দিতে পারে না নিরুপদ্রব জীবনের ,
সে জানে না অধিক শুশ্রুষায় নিথর হয়ে যেতে পারে জিভ ,
চক্ষুলজ্জায় কপাট বন্ধ করে দিতে পারে ইচ্ছে ,
ভর সন্ধ্যায় ঝাঁপ পড়তে পারে মনে ,
তখন নেগেটিভ গুলো ডেভলপ করলেও উঠে বসবে না রুগী I

পরকীয়া


একদম চাইনা
খারাপ থাকা অন্য কারুর মন খারাপের আকাশ হয়ে থাকুক ,
ইদানীং তাই বেলেল্লেরাগ-কে সামলে রাখি রাখী পরিয়ে ,
ফাঁকফোকর দিয়ে তবুও তাতেই গ্লুকোজে টান পড়ে যায় জোছনার I

গ্ল্যামারহীন গ্লুকোমা আর তিলসর্বস্য পিঠ বাঁচাতে
রৌদ্রের আড়াল খুঁজতে হয় ছই-য়ের নিচে ,
পদ্মরাগ ঠোঁটের আজন্ম তৃষ্ণা কোল্ডক্রিমের আদরে রুখতে চায় রুক্ষতা ,
যদিও চাইনা মনেপ্রাণে তবুও ......
মুখ ফস্কে বেরিয়ে যায় শুভেচ্ছার অভিশাপ I

মাধবীও বোঝে ,
জোছনা হয়ে নিদ্রামগ্ন রৌদ্রধারণের মূল্যসূচক ,
হাড়-মাসে জানে দানাপানি দেয়া হাতেও লুকিয়ে থাকে নখ ,
প্রয়োজনে পাখীপড়ানো বৈষ্ণব ও সুর তুলে গাইতে পারে খেউড় ,
প্রাত্যহিক রাতের ফুলশয্যায় বোঝে ......
সপাং সপাং শব্দের সাথে কেমন করে ওঠানামা করে সিৎকারের গ্রাফ I

তবু ,
তবুও রৌদ্রজ্জ্বল সকালে নোনাধরা সময়কে সেঁকে নিতে
জোছনার অসীম অনীহা ,
মাধবীলতার সলাজ চোখে পারিজাত হাওয়ার সঙ্কুচিত সঙ্কোচ ,
অবশ্যই একদম চাইনা
স্বপ্ন ছুঁতে টালমাটাল হয়ে যাক কারুর পছন্দসই নিশুতি ,
তারচেয়ে বরং শুভেচ্ছা লেখা বিকেল সাজাই অন্য গোলার্ধের আকাশে I

মেঘমল্লার


যখনই আকাশে নেমে আসে ঘোর
কে যেন কানে কানে বলে যায় .....
সময় থাকতে রিপু করে নাও পাল ,
প্লেনাম ডেকে আগেভাগে ঢেউগুলোর সাথে করে নাও হ্যান্ডশেক ,
দূরবীনের দুর্বিনীত চোখ থেকে সরিয়ে দাও ফাঙ্গাসের ঠুলি ,
কে যেন গেয়ে যায় জয়যাত্রার গান I

তার্কিক রোদ্দুর খড়েরচালে লিখে দেয় আলবিদা ,
সময়ের কাছে দাবীসনদ পেশ করে কাঠামো ,
ছানিপড়া চোখে আকাশ দেখার স্বপ্ন তবু দখল করে রাখে মৌরসীপাট্টা ,
সোপার্জিত প্রাত্যহিক শুভেচ্ছা-স্তবকে ঝোলে
বর্ণহীন ভালবাসার ট্যাগ I

একচালার পোড়ামাটির দেয়ালে খোদাই করা বেদুইনের সৌখিন ইতিহাস ,
যখনই বিভূতি মেখে আওতায় নেমে আসে মেঘ
অভাবী বিষন্নতার কোনো আমন্ত্রণপত্র লাগেনা I

সড়কছাপ


হরবখত বিনা আমন্ত্রণে হাজির হয় দলবেঁধে
সারাদিন ধরে করে তুলকালাম
ফেলে ছড়িয়ে খেয়ে ফাঁকা করে দেয় ফ্রিজ
ঘরদোর গুছিয়ে পরিপাটি হতে হতেই পেরিয়ে যায় সন্ধ্যাপুজোর কাল I

প্রত্যেকবারই ভাবি ,
এলেই দুর দুর করে তাড়িয়ে দেবো দোর থেকে
শত অনুনয়েও খুলবো না খিল
মরার মতো পড়ে থাকবো চাটাই পেতে
কিন্তু পারিনা যে ,
মনে হয় সড়কছাপ শব্দগুলোরও তো অধিকার আছে আদর পাওয়ার I

তারাও তো চায় নিম সাবান দিয়ে স্নান করিয়ে কেউ উজ্জ্বল করে দিক ত্বক ,
তাদের নিয়েও কেউ সাজাক আবেগ
আওবাতালি মাখনো রসকদম তাইতো রাখি ফ্রিজে
আর অপেক্ষা করি ,
বুকনি ঝেড়ে কখন ওরা বকুনি পাল্টে দেবে প্রেমে I

আত্মদগ্ধ


বাহাত্তর ঘণ্টা না গেলে কিছুই বলতে পারছেন না ডাক্তাররা ,
মায়ের সাথে পেটের ন-মাসের কন্যা সন্তান বাঁচনোর জন্যও চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখছে না নার্সরা ,
রিসেপশনে বসে আছি দুবাড়ীর সকলেই
একটা অদ্ভুত নীরবতা কুরে কুরে খাচ্ছে সকলকেই I

অনর্গল কথা বলা বড় নাতনিটা মাঝেমধ্যে জানতে চাইছে কুট্টি বোনের খবর ,
উত্তরটা আমাদের কারুরই জানা নেই
রিসেপশনের মাইক বারবার ডাকছে কোনো না কোনো পেসেণ্টের পরিজনদের
অপেক্ষা করে আছি সকলেই সুখবরের আশায়
অপারেশন থিয়েটারের লাল বাতিটা এখনও জ্বলছে I

চাইল্ডকেয়ার ইউনিটে নিয়ে যাওয়ার আগে নার্স দেখিয়ে গেলো ফুটফুটে বাচ্ছাটাকে ,
চোখ ফোটে নি এখনও
একদম ছোট্টবেলার পরীর মতো হয়েছে দেখতে
ছোট্ট বোনকে দেখে তার দিদির সেকি আনন্দ
আমরা সবাই অপেক্ষা করে আছি দ্বিতীয় সুখবরের আশায় ,
হসপিটালের বড় দেওয়াল ঘড়ির কাঁটাদুটো নড়তেই চাইছে না যেন
নীল এ্যাপ্রন পড়া ডাক্তারবাবু এইমাত্র বলে গেলেন
ঈশ্বরের ওপর ভরসা রাখতে I

চোখ বন্ধ করলেই ভেসে উঠছে পরীর সেই স্কুলে যাওয়ার ছবি
মনের মতো কিছু না হলেই অভিমান করে ঠোঁট ফোলানো
আমাদের দুজনের মাঝে শুয়ে ঘুম না আসা পর্যন্ত্য বকবক
কলেজের ফেস্টে প্রথম শাড়ি পড়ার দিন
ম্যালে বাপমেয়ের ঘোড়ায় চাপা
বেশ মনে আছে পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করার জন্য ওর সেই যুক্তি সহকারে ভাষণ ,
শুনে ওর মায়ের সেই হাসি হাসি মুখ
বাসি বিয়ের পর আমায় জড়িয়ে ধরে কান্না
আশীর্বাদ করে বলেছিলাম .......
'' যখনই মন চাইবে চলে আসিস আমার কাছে '' I

আগুন কে লাগিয়েছিলো জানি না ,
সে নিজেই কিনা সেটাও প্রমাণ সাপেক্ষ ,
শুধু এটা মনে হচ্ছে ......
যে এগিয়ে দিয়েছে জ্বালানির জার সে আমারই খুব চেনা
সে একটু উদার হলেই হয়তো বেঁচে যেতো পরীর আঁকড়ে ধরার আর্তি
আশ্রয় নিয়ে বড়াই করা উচ্চারণটা হয়ে যেতো না মেকি
সংস্কার হয়তো কখনই পাল্টায় না কিছুতেই নিজেকে
আজীবন লালিত পালিত মনকেও স্বার্থপর করে দেয় নিজের মতো
নির্মম ভাবে আশ্রয়হীন করে দেয় স্নেহকে
অথচ এক নিঃশ্বাসে জাহির করে ভালবাসা I

পরীর সংসার পরিপাটি করে দেওয়ার শ্লাঘায় একদিন বড়াই করে করতাম আত্মপ্রচার
ভাবতাম ঈশ্বরের মতোই সহজেই লিখতে পারি ভাগ্য
তবু ভরসা কেন্দ্র থেকে বারংবার উচ্চারিত হয়েছে
'' একটু মানিয়ে নেওয়ার '' নিদান
পরীকে তো আশ্রয় দিতেই পারতাম সারাজীবনের জন্য I

খণ্ডিত সাগর চায়নি সে


আচঁল মোছা বিকেলে আকশি দিয়ে পেড়ে এনেছিলে তৃপ্ত দহন ,
গা সহা আবেগে অনন্ত ঘর্মাক্ত দুপুর চেয়েছিলো কমলিকা ,
অতৃপ্তির শাপমোচনে কৃষ্ণকলি হওয়া আজও হয়ে ওঠেনি তার I

মোমসুখী পরবে একফালি লজ্জানত চাঁদ হতে চেয়েছিলো সে ,
সুদে -আসলে কলঙ্কমাখা আস্ত কোজাগরি এনে দিলে উঠোনে ,
মেহেন্দিরাঙ্গা ক্ষতসুখে মন এখনও বনপলাশীর পদাবলী I

ঝাড়াই বাছাই তারায় গাঁথা একটা রহস্যময়ী ওড়নার খুব শখ ছিলো তার ,
বর্ণচোরা লগ্নে বোরখা দিয়ে বলেছিলে......
এটাই ভাবের আকাশ ,
খুনসুটিময় ইচ্ছে -চড়ুই দের জন্য বানিয়ে দিয়েছিলে নিশ্চিন্ত খাঁচা I

পাখনামেলা সুরেলা একটা সকাল ভেসে বেড়াতো সুপ্রতিম স্বপ্নে ,
নীলকান্ত ঢেউ ছুঁতে চেয়েছিলো সে শঙ্খচিল হয়ে ,
পা ভেজানো মুগ্ধতা মাখতে সহস্রযোজন কাঁটাপথ পেরিয়ে একদিন সে পৌঁছে ছিলো মৃতসাগরের পাড়ে ,
বাতিঘরের অহংকারে তখন ভূমধ্যসাগরের মধ্যমণি তুমি I

বুঝলে না
টুকরো সাগরের প্রলোভন পেরিয়ে সে এখন অনেকদূরের নাবিক ,
ঠুকরে দেয়া টুকরো সোহাগ নিয়ে খণ্ডিত সুবেদার হওয়াই তোমার ভবিতব্য I

থেকে যাবো


শেষ কন্ঠস্বর পর্যন্ত্য থেকে যাবো কান পেতে ,
স্তবে আবাহন করবো সৌভাগ্য ,
পৌষালী ভোরে মরুদ্যান মেখে নিয়েছে শিশিরের সোহাগ I

কাঁচকাটা হীরের মতো চিরে দিয়েছো স্বচ্ছতোয়া ,
কেড়ে নিয়েছো নূপুর হতে চাওয়া সদ্যজাত ইচ্ছেদের আবদার ,
নিস্তরঙ্গ অতলে সমাহিত করেছো কালবোশেখী মাতন I

লেবু-লঙ্কা ঝুলিয়ে রঙ্গিন ছবিতে বিজ্ঞাপিত সুখ ,
ক্লান্তিতে পলি পড়ে যাওয়া চোখে অপেক্ষার অনুনয় ,
এ্যানিমিয়ায় ভোগা " ভালো আছি "
প্রতিরাতে শিকল খুলে চুরি করে ভাব I

কথা দিলাম শেষাঙ্ক পর্যন্ত্য সাজিয়ে রাখবো রেণু ,
এক মুহূর্তের জন্য হলেও এক চিমটে ফাগুন হয়ে এসো I

ফিরে যাও


ময়দানের মখমল মাড়িয়ে অনেক অনেক দিন পর
নন্দিনী হেঁটে আসছিলো আমারই দিকে ,
কান্নার শব্দে অনুনয় নিয়ে গতকাল হটাত ফোন করেছিলো ও ,
কাঁচা হলুদ জমিতে সবুজ আর লাল কল্কার সিল্কে
ইষৎ ভারিক্কি চেহারায় বেশ একটা সুখী সুখী ভাব ,
কলেজের সেই ছিপছিপে ঝর্ণা আজ স্থিমিত প্রবাহ ,
আধুনিক সানগ্লাসে "আলো আমার আলো "ছবির
নায়িকার মতো ,
একরাশ অনভ্যাসী আফসোস নিয়ে ভাললাগা ফিরে আসে অতীত সরণী বেয়ে I

নন্দিনী অনেক পাল্টে গেছে ,
জিজ্ঞাসা করে এখন পাশে বসতে হয় তাকে ,
প্রশ্ন করে জানতে হয় কেমন আছি আমি ,
বাদামের খোসা ছাড়িয়ে বাড়িয়ে দেয়া হাতে কুণ্ঠিত লজ্জা ,
একসময় জ্যোতিষী হয়ে নিয়মিত সন্তানরেখা খুঁজেছি
ভাগ্যরেখার আশেপাশে ,
হাসতে হাসতে নন্দিনী বলতো ....
বিবাহরেখা না থাকলেও ও সারাজীবন থাকবে আমার হয়েই ,
কথা রেখেছে নন্দিনী ,
আজও স্মৃতি হয়ে শুধু আমার হয়েই রয়ে গেছে সে I

সাথীর দায়িত্বে ভালোথাকার খবর নিতে এসেছে
এক যুগ পার করা বিকেলের ময়দানে ,
দুই ছেলে মেয়ে আর দামী স্বামী নিয়ে পাখীর বাসায় সুখের সংসার তার ,
"ভালো স্বামী হলেই সে ভালো প্রেমিক হয়না "
এই তত্বটা অজানাই ছিলো তার এতোদিন ,
চে গুয়েভারার শিষ্যের কিন্তু প্রয়োজনই হয়নি নতুন ভালবাসার সন্ধান করার I

দশদিনের দাড়ি না কাটা গালে হাতবোলানোর মানুষটা
নিয়মকরে রাত্রে আসে ,
অভিযোগ না করেই শুধু মিটিমিটি হেঁসে চলে যায় ভোর হওয়ার আগেই ,
কফি হাউসের শ্যামদা একদিন জিজ্ঞেস করছিলো নন্দিনীর খবর ,
উত্তরহীন চোখের দিকে তাকিয়ে আর কোনোদিন প্রশ্ন করেনি ,
এবছর দেশ এর শারদীয় সংখ্যায়
তোমায় নিয়ে একটা কবিতা লিখেছি ,
অন্তত একবার পড়ে দেখো ,
স্মারক সংখ্যা উপহার দিয়ে লজ্জা দেবোনা I

যাক ,আমার প্রায় সব কথাই শুনলে এবার তোমার কথা বলো ,
প্রেমাংশু আছে কেমন ?
লেডি কিলার এর সুখ্যাতি এখনও আছে নাকি
আচলের ডগায় বেঁধে রেখেছো গিঁট দিয়ে ?
ছেলে মেয়েরা বোর্ডিং-য়ে !
ঠিক করোনি ,
স্নেহের বঞ্চনায় প্রতিশোধ দানা বাঁধে ,
লাল রং এর গাড়ি কিনেছো জানি ,
এখন নিজেই ড্রাইভ করো ,ভয় করে না ?
যাক ,
একদিন তোমার চাওয়া স্বপ্নই তো আজ পদানত , শরীরের ভাঁজে ভাঁজে যৌবন এখন অনেক বেশী লোভনীয় ,
কপালের লালটিপে অহংকার মিশে আছে সুখ-গরবিনী হয়ে ,
তবুও এক যুগ পর ভবঘুরে সাত্যকিকে মনে পড়লো কেন ?
সেটা কি দ্বিতীয়বার পোড়ানোর জন্য
নাকি ধাতবসুখে ক্লান্ত মনে আবেগীসুখের জিয়নকাঠির সন্ধানে ,
অব্যবহৃত ও দুটোই অনেকদিন আগে কবিতাকে দিয়ে দিয়েছি ,
ক্ষমা কোরো নন্দিনী
আজ আবার শূন্য হাতে তোমায় ফিরিয়ে দেয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই,
কবিতা যে তোমার থেকেও বেশী ভালবাসে আমায় I

জলপথ


বুনো কুয়াশায় অস্পষ্ট বাতিঘর
আপাত সরল জলস্তরের নিচে চোরা পাহাড়ের বাঘনখ
কর্মহীন দূরবীন সূর্য্যস্নাত ভোরের অপেক্ষায় জনমানবহীন ডেকে ,
রাত পাহারায় একা সারেঙ্গ ,
পতাকাবিহীন মাস্তুলে কাল আবার হয়ত উড়বে জলদস্যুর নিশান ,
পুরোনো মানচিত্রে আবার হয়ত নথিভুক্ত হবে নতুন কোনো বদ্বীপ ,
সোনালী তটে নোঙ্গর করবে জলদস্যুর সপ্তডিঙ্গা ,
হয়ত ,
হয়ত সবই অনিশ্চিত খোয়াবের খুনসুটি ,
হয়ত আবার মৃত-নুড়ির চরে অপেক্ষায় থাকবে
সর্বশান্ত সোহাগ I

জলমগ্ন ডেকে ডাই করা প্রাক্তন নীল খাম ,
মন পুড়িয়ে এখন যারা এক পাঁইট স্পিরিট আর
দেশলাই কাঠির অপেক্ষায় ,
ঢেউয়ের প্রার্থনায় ক্ষতবিক্ষত সারেঙ্গ সাগরে উৎসর্গ করে চলেছে না চেয়ে পাওয়া উপহার ,
রাজসিক কেবিনে নিভু নিভু মোমবাতি আরো একবার পেতে চায় তাজা বারুদের গন্ধ I

জলদস্যু রেলিং ছুঁয়ে জোয়ারের শব্দ শোনার অপেক্ষায় ,
জানে ,
একদিন নিশ্চিত বাঁধভাঙ্গা আলোয় দগ্ধ হবে কুয়াশার প্রতারণা ,
জলপরী আবার দেখাবে ছায়াঘেরা সবুজদ্বীপের পথ I


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান