আক্রান্ত নীলাচল : এক প্রবীণ কবির আত্মোপলব্ধি - মনজুরুল ইসলাম
আক্রান্ত নীলাচল : এক প্রবীণ কবির আত্মোপলব্ধি  - মনজুরুল ইসলাম
                                             ‘‘কবিতারা জানে,

কবিতাকে নিষিদ্ধ করবার ক্ষমতা কারুর নেই,                                                দণ্ড দেবার ক্ষমতাও কারো নেই।         লিখিত কবিতাকে হয়তো বা দণ্ডিত করা যেতে পারে;                                                কিন্তু অলিখিত কবিতাকে দণ্ডিত করবে কে?                                                নগর বন্দর অরণ্য আর                                                মাঠ ঘাট সমুদ্র প্রান্তর জুড়ে চিৎকৃত হবে                                                এক একটি কবিতা লক্ষ কোটি হয়ে                                                ক’টি কবিতাকে দণ্ডিত করবে ওরা?                                                কবিতা যে মৃত্যুত্তীর্ণ---                                                চিরকালের।’’   সুন্দরের সাহচর্য সকলেরই অভিপ্রায়। সৌন্দর্যের সাথে লীন হয়ে সবাই পেতে চায় স্বর্গীয় অনুভূতি। বস্তুত, সুন্দরের সংজ্ঞা একেক জনের কাছে একেক রকম। তবে, সেই সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশকে যে শব্দ ও ভাবের বুননেই সর্বোচ্চ মাত্রায় সৃজন করা যায় সে বিষয়ে হয়ত সবাই একমত। পার্থিব জগতে আমাদের অনুভূতির সকল পাপড়িই সময়ের হাত ধরে একসময় ঝরিয়ে পড়ে। হয়ত অতীতের শ্রেষ্ঠ অনুভূতি জাগানিয়া কোনো ব্যক্তি অথবা কর্মটিকেও অন্তর্জগতের কোনো স্মৃতির খামে আগলে রাখা সম্ভব হয় না। তবে গভীর ভাব ও আন্দোলিত মসৃণ শব্দের মিলনে কবি কর্তৃক সৃষ্ট পংক্তিই যে এক্ষেত্রে যুগ থেকে যুগান্তরব্যাপী অমর হয়ে থাকে এটি সুনিশ্চিত। একসময়ে কবির ব্যক্তিগত ভাবের ক্ষেত্রটি ব্যক্তিক সীমানা পেরিয়ে অবস্থান করে গণমানসের অভ্যন্তরে। সাধারণ দৃষ্টিতে, কিছু ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে একজন কবি এবং একজন সাধারণ মানুষের মধ্যে কমবেশি স্বাভাবিক জীবনের প্রবাহটি একই রকম। কবি তার জীবনে ঘটে যাওয়া তীব্র যন্ত্রণাদায়ক মুহূর্তগুলিকে শব্দের ফ্রেমে বাঁধার নিমিত্তেই জীবনকে যাপন করেন আলাদা করে। একই সাথে প্রকৃতিগতভাবেই ভাবের প্রসবণ বেশী হওয়ায় তিনি তার অধ্যয়নঅর্জিত জ্ঞান ও স্বাভাবিক জীবনাচরণের ওপর তীক্ষ্ম দৃষ্টি প্রক্ষেপণের মাধ্যমেই সাজান শব্দের শর্বরী। অতঃপর সেই শর্বরীতে সবাই যখন তাদের নিজেদেরই জীবনে ঘটে যাওয়া চিত্রটি প্রত্যক্ষ করতে পান তখন অবলীলায় সেখানে অবগাহন করতে থাকেন। কোনোদিনই কিম্বা কখনই হয়ত সেই কবির সাথে সাধারণ মানুষের দেখা হয় না। তবুও হাজার বছর পেরিয়েও সেই কবি তার শব্দের আকর্ষণে বেঁধে রাখতে সক্ষম হন অগণিত পাঠককে, আদর্শের বটবৃক্ষ হয়ে বেঁচে থাকেন তাদের মাঝে।

    এটিই নিয়ম। এটিই চিরাচরিত। জীবদ্দশায় লেখককে নিয়ে যত প্রচারণাই করা হোক না কেন, প্রকৃত সৃজনশীলতা নিরূপিত হয়  মহাকাল দ্বারা। সমালোচক অথবা সাধারণ মানুষ ধারণা করতে পারেন বটে, কিন্তু কখনোই নির্দিষ্ট করে বলতে পারেন না কোনো সৃষ্টির অবিনশ^রতা। সেক্ষেত্রে কবিতা থেকে শুরু করে সাহিত্যের যে কোনো শাখার প্রতি একজন কবির অনুরাগ সৃষ্টি সম্ভবত সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। অন্তত গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ কিম্বা নাটকের সাথে সত্যিকার অর্থেই যখন একজন লেখক ভালোবাসার বন্ধন সৃষ্টিতে অভ্যস্ত হবেন তখন লেখালেখির প্রাথমিক স্তরের যোগ্যতাটুকু তিনি অর্জন করতে পেরেছেন বলে ধরে নেয়া যাবে। সবাই ভালো লিখবেন না, লিখতে পারবেনও না। কিন্তু ন্যূনতম মানসম্পন্ন লেখা লিখবার ক্ষেত্রে অনেকেই পারঙ্গম হয়ে উঠবেন বলে প্রত্যাশা করা খুবই সঙ্গত। এবং এভাবে প্রত্যেক লেখকই যখন লেখার সেই ন্যূনতম মানটিকে স্পর্শ করতে দক্ষ হয়ে উঠবেন তখনই সমাজের সভ্য হয়ে উঠবার আবদ্ধ দরজাটি খুলে যাবে। একই সাথে গতানুগতিকভাবে লেখকবৃন্দের মাঝে হতাশার যে সুরটি বেজে উঠবে সেটিও আর কখনো বেজে উঠবে না, দৃশ্যত চোখেও পড়বে না। কারণ, জ্ঞানের সাথে যিনি একবার সুদৃঢ় সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হবেন তখন তার কাছে জনপ্রিয়তা অর্জনের বিয়য়টি ঠুনকো হয়ে দাঁড়াবে। লেখালেখিকে কেন্দ্র করেই বৈষয়িক প্রাপ্তিগুলি তার কাছে কোনাভাবে মূখ্য হয়ে উঠবে না। তার মানস পড়ে থাকবে শব্দ ও ভাবের সীমাহীন আকাশে। নিয়তই সৌন্দর্যের সেই আকাশকে স্পর্শের স্বপ্ন তার মস্তিষ্কের প্রতিটি তন্ত্রীতে অবস্থান করবে।   

জীবনানন্দ দাশের জীবন প্রবাহে জনপ্রিয়তা অথবা বৈষয়িক প্রাপ্তির প্রাধান্যটি যে ছিল না তা সম্পর্কে কমবেশি সকলেই অবগত। শব্দ ও ভাবের শক্তিশালী সমন্বয়ের ওপর ভর করে তিনি যে সৃজনশীলতার অবলুপ্ত আকাশকে ছুঁতে চেয়েছিলেন তা সুস্পষ্ট। সমসময়ে কোনো পুস্তকের পান্ডুলিপি প্রস্তুত হবার পূর্বেই যখন লেখকবৃন্দকে ফেসবুকে পোস্ট দিতে দেখা যায় তখন জীবনানন্দ দাশের স্যুটকেসের মধ্যে রয়ে যাওয়া কবিতার পাণ্ডুলিপির কথা ভীষণভাবে মনে পড়ে। শুধুমাত্র কবিতার বিনির্মাণে সৌন্দর্যের পেছনে অশ্বরোহীর মতোই যে তিনি নিরন্তর ছুটেছিলেন তার প্রমাণ অপ্রকাশিত অজ পাণ্ডুলিপি। অবশ্যই এমন পোস্ট দেয়ার বিষয়টিকে ইন্টারনেটের কল্যাণ হিসেবে আখ্যা দেয়া যেতে পারে, কিন্তু কবির সংযমী মনোভাবের বিষয়টিকে কীভাবে এড়িয়ে যাওয়া যায়? কবিতার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক সৃষ্টি করেই কেবল সেই ধরনের সংযমী মনোভাব সৃজন করা সম্ভব বলে মনে হয়।  

সরদার মোহম্মদ রাজ্জাক, সৈয়দ শামসুল হকের দেশের একজন প্রান্তিক কবি। পেশাগত কারণেই সৈয়দ হক হাইস্কুলে অধ্যয়নকালীন পাড়ি জমিয়েছিলেন ঢাকায়। সমৃদ্ধ সাহিত্য রচনা করে কুড়িগ্রামকে চিনিয়েছেন বিশেষভাবে, কুড়িগ্রাম সাহিত্যঙ্গণকে করেছেন আলোকিত। বিশেষত, ব্রিটিশদের হাতে নির্মমভাবে অত্যাচারিত হওয়া কৃষক নুরলদীনের বাস্তব জীবনকে মঞ্চের মাধ্যমে তুলে ধরে সৃজন করেছেন একটি অসাধারণ নাটক। যদিও নুরলদীন কৃষক ছিলেন কিনা এ বিষয়ে রয়ে গেছে অস্পষ্টতা। তবে কৃষক আন্দোলনের সময় তার পরিবার যে প্রভাবশালী গৃহস্থ ছিলো তা জানা যায়। আর তিনি যে কৃষকদের সংগঠিত করেই কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তা নিশ্চিত। এবং এ কারণে কৃষকরাই তাকে তাদের নেতা হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন।  যাই হোক, উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ ও উন্নত শহরে অবস্থানের স্বাদ কোনেটিই আস্বাদন করতে পারেন নি সরদার রাজ্জাক। প্রায় ৭৫ বছর ধরেই অবস্থান করছেন কুড়িগ্রামেই। লোকচক্ষুর আড়ালে থেকেই চেষ্টা করেছেন সাহিত্যের সংজ্ঞাটিকে উপলব্ধির। উপলব্ধি করতে পেরেছেন বলেই এতটা কাল পেরিয়েও সাহিত্যচর্চার উঠানে নিজের পথচলাকে দীর্ঘায়িত করতে পেরেছেন সাবলীলভাবেই। আর কবিতার প্রতি অসীম দায় ও কর্তব্যবোধের কারণেই সৃজন করতে সক্ষম হয়েছেন কবিতার ওপর রচিত উপর্যুক্ত পংক্তিগুলি।  

  বস্তুত, সরদার রাজ্জাকের কাব্য চরিত্র বিশ্লেষণ করলে যে ইতিবাচক বিষয়গুলি সহজেই প্রতিভাত হয়ে ওঠে সেগুলি মূলত- প্রতীকের (Symbol) যথোপযুক্ত ব্যবহার, চিত্রকল্পের সার্থক রূপায়ণ (Imagination) এবং কবিতার অন্তর্নিহিত দর্শন (Subjectivity)। একটি কবিতায় যে ধরনের সাবলীলতায় পাঠক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন ঠিক তেমন করেই যেন তার শব্দগুলো একের পর এক সাজানো। একটি পংক্তি পাঠ করা শুরু করলেই চৌম্বকীয়ভাবে যেন পরের পংক্তিগুলির দিকে ধাবিত হওয়া যায়। এবং পুরো কবিতাটি পাঠ করবার পর সৌন্দর্যের বোধ দ্বারা পুলকিত হবার পাশাপাশি এক ধরনের জীবনঘনিষ্ঠ দর্শন তার কবিতাকে উপযোগী করে তোলে। এর কারণ হয়ত গীতিকাধর্মী( Ballad) কবিতার বৈশিষ্ট্য। ঘটনাপ্রধান দীর্ঘ কবিতাগুলির ঘটনাপ্রবাহটিকে তিনি সমন্বয় করেছেন বিশেষ দক্ষতার মাধ্যমে।পাঠকের মূল প্রবাহ থেকে সরে যাওয়ার কোনো প্রতিবেশ সৃষ্টি হয় নি কবিতাগুলিতে।

বরং আগ্রহ নিয়ে পাঠক যে পরবর্তী ঘটনার জন্য অপেক্ষা করবেন সেই সম্ভাবনাটিই প্রবল হয়েছে। পাশাপাশি তার কবিতায় কাব্যিক শব্দ-সম্ভার (Poetic Diction) একটি অনন্য সংযোজন। প্রতিটি কবিতাতেই উচ্চমার্গীয় শব্দ শৈলীর মাদুর যেন বিছিয়ে রাখা হয়েছে যেখানে এসে নবীন প্রবীণ কবিরা শব্দের সৌন্দর্য উপভোগ করবেন। কিছু কিছু ব্যালাডধর্মী কবিতায়  মূল চরিত্রের মাঝে ন্যায্যতার ( Poetic Justice) বিষয়টিও মূর্ত হয়ে উঠেছে প্রবলভাবে। মূল চরিত্রের যে কর্মফলটি প্রত্যাশিত সেটিই অঙ্কিত হয়েছে কবিতাগুলিতে।

  হয়ত শুরুতেই কবিতাগুলি পাঠের সময় পাঠকের মনোজগতে  জীবনানন্দ দাশের স্পষ্ট প্রভাবের বিষয়টি নেতিবাচক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। বিশেষত সরদার রাজ্জাক তার অনেক কবিতাতেই জীবনানন্দের উক্তি ব্যবহার করেছেন। পাশাপাশি শব্দ বুননের ক্ষেত্রে তিনি যে জীবনানন্দ দাশকে অনুসরণ করেছেন কিম্বা তাঁর প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেন নি তাও স্পষ্ট। এছাড়াও কবি অনেক ক্ষেত্রে চলিত ও সাধু ভাষার সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন যা পাঠকের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক মনে হতে পারে। তবে এটিও ঠিক যে সাধু ভাষা ব্যবহৃত হলেও তা বিষয়বস্তু অনুধাবনের ক্ষেত্রে খুব একটা বিঘœতার সৃষ্টি করে নি। সার্বিক বিবেচনায় যে বিষয়টি স্পষ্ট সেটি হলো, কবি তার পূর্ণ স্বাধীনতাকে ব্যবহার করে কবিতায় অন্তরিত দর্শনটিকে পাঠকের অন্তর্জগতে প্রবিষ্ট করাতেই মনোযোগী ছিলেন।   

  একজন কবির মনোজগতে অন্য একজন কবির প্রভাব থাকতে পারে। অথবা সেটি থাকা খুবই স্বাভাবিক। জীবনানন্দ দাশের মাঝেও পৃথিবীর অনেক কবিরই প্রভাব ছিলো। বিশেষত, তাঁর বেশ কিছু কালজয়ী কবিতায়  টি, এস এলিয়টের প্রভাবের কথা প্রায় সবার জানা। স্পষ্ট করে বললে, বনলতা সেন, নির্জন স্বাক্ষর, আট বছর আগের একদিন কবিতাগুলিতে এলিয়টের মনোভাবের সঙ্গে তার মনোভাবের সাযুজ্য পরিলক্ষিত হয়। বাংলা সাহিত্যের অমর সৃষ্টি কাজী নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটিতেও মার্কিন কবি ওয়াল্ট হুইটম্যানের ‘ সং অব মাইসেলফ’ এর সরাসরি প্রভাব লক্ষ করা যায়। বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতায় রবীন্দ্রনাথের প্রভাব স্পষ্ট। এবং বিষয়টিকে স্বীকার করে নিয়েই তাঁরা কবিতা লিখেছিলেন এবং বাংলা সাহিত্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছেন। গুরুত্পূর্ণভাবেই, স্বয়ং ররীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলাইদতে অবস্থানকালীন বাউল শিল্পী গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাব তারে’ গানটির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত সোনার বাংলার সৃষ্টি করেন। পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন বক্তৃতায় তার সৃষ্টির অভ্যন্তরে বাউল গানের প্রভাবের কথা অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করেন। প্রকৃতপক্ষে একজন লেখকের সৃজনসৌন্দর্য দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আর একজন লেখকের সৃজনশীলতার বীজ বুননের মাধ্যমেই সাহিত্য এগিয়ে যায়। চিরায়ত শিল্পীরা সেটি করেই সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যান। তাছাড়া একজন লেখক যত পরিমাণেই অধ্যয়নের মাধ্যমে সাহিত্যের গভীরে প্রবেশ করতে পারবেন ঠিক তার অবচেতনাতেই তিনি অপর লেখকের সৌন্দর্যবোধ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এমন কিছু সৃষ্টি করবেন তা হয়ত সেই সৃষ্টির থেকেও উচ্চ মার্গীয় হয়ে উঠতে পারে। অথচ সেই সৃষ্টির সাথে তার সৃষ্টিটির মোটা দাগের কোনো সাযুজ্য থাকবে না। তারপরও লেখক যখন তার প্রভাবের কথা স্বীকার করবেন তখন তার উদারতাই প্রকাশ পায়। প্রাসঙ্গিকভাবেই একটি বিষয় বারবার মননে নাড়া দেয়। ব্যক্তিগতভাবে যখন প্রথমবার আলমগীর কবির পরিচালিত ‘সীমানা পেরিয়ে’ চলচ্চিত্রটি দেখেছিলাম তখন আপনা আপনি ডেনিয়েল ডিফো রচিত ‘রবিনসন ক্রশোর’ চিত্রকল্পটি ভেসে উঠেছিলো। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের খ্যাতিমান পরিচালক আলমগীর কবির যদি রবিনসন ক্রশো অথবা এমন কোনো উপন্যাস দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সীমানা পেরিয়ে নির্মাণ করেন তবে সেটিকে অবশ্যই সভ্যতার উৎকর্ষে কোনো শিল্পীর অগ্রযাত্রাকেই বিবেচনা করা প্রাসঙ্গিক ।

          মূলত একজন লেখক যখন অন্য কোনো লেখকের ভাবনা চুরির মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশের ঔদ্ধত্য প্রকাশ করবেন, অন্য লেখকের গদ্যকে স্বীকারোক্তি না দিয়েই নিজের লেখা বলে চালিয়ে দেবার অপচেষ্টা করবেন, অথবা বিদেশী কোনো অপরিচিত লেখকের লেখার অনুবাদ করে নিজের বলে প্রকাশের চেষ্টা করবেন তখনই সমস্যাটির সৃষ্টি হবে। এমনটি দৃষ্ট হলে সাধারণ পাঠকও আর সেই সব অন্ত:সারশূণ্য লেখকবৃন্দকে গ্রহণ করবে না। সময় তো নয়ই। তবে সমসময়ে নিজ ভাষায় ভাষান্তরের (চধৎধঢ়যৎধংব) বিষয়টিও আধুনিক অনেক পাঠক হয়ত লক্ষ করতে পারেন। সেক্ষেত্রে সেটি করা থেকে বিরত থাকা একজন কবির সততারই বহি:প্রকাশ।  অবশ্য এমন বিবেকবর্জিত মানসিকতাকে ধারণ করে একজন কবির পক্ষে আত্মতৃপ্তি অর্জন করা অসম্ভব। অপরের প্রশংসা হয়ত স্বল্প সময়ের জন্য তাকে মেকি সন্তুষ্টি প্রদান করতে পারে। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে, তৃপ্ততার ছিটেফোঁটাও তার সৃজনশীলতার উঠানে এসে পড়ে না। অথবা সেই উঠানটিই সৃষ্টি হয় না। 

  সরদার রাজ্জাক মূলত জীবনানন্দের পাশাপাশি ধ্রæপদী অনেক লেখকের শব্দ শৈলীকে অনুসরণ করে নিজের সৃজনশীলতার আঙিনাকে সমৃদ্ধ করবার চেষ্টা করেছেন। একই সাথে স্ব-মননে অন্তরিত প্রতিভার সমন্বয় ঘটিয়ে তার কাব্যের শব্দ সম্ভারকে উচ্চ থেকে উচ্চতর স্তরে উন্নীত করার চেষ্টা করেছেন।  তবে ভাবনার সজ্জায়নে সচেতনভাবেই নিজেকে রেখেছেন স্বতন্ত্র একটি অবস্থানে। আধুনিক সময়ের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ, পুঁজিবাদী রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন এবং বিশ^মানবতা তার কবিতার মূল বিষয়। আক্রান্ত এই নীলাচলের সংকটগুলিকে তিনি তুলে ধরেছেন কখনো রোমান্টিসিজমের আলোকে , কখনো সাংগ্রামিক আবহে কখনোবা আধুনিক জীবনের জটিল সমীকরণে। এক্ষেত্রে সমস্যাকে তিনি যেভাবে তুলে ধরেছেন ঠিক একইভাবে সমাধানের পথটিও চিত্রায়ন করেছেন। বাস্তব প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় নিয়েই একান্ত তার মতো করেই উপস্থাপন করেছেন এক একটি কবিতা যে কবিতার উদ্দেশ্য মূলত শ্রমজীবীসহ সকল মানুুষের অর্থনৈতিক ও মানসিক মুক্তি। যতদিন পর্যন্ত না সেই মুক্তি আসে এই আক্রান্ত নীলাচলে ততদিন পর্যন্তই তার যূথবদ্ধ প্রতিজ্ঞা-    

                                      ‘‘ তোমরা সৃষ্টির শপথ হারিয়ে ফেলেছো                                         

আমরা হারাই নি সে শপথের কথা---                                                        আমরা এসেছি পৃথিবীতে আমাদের অধিকার নিয়ে                                                                 যে অধিকার তোমরা কেঁড়ে নিয়েছো আমাদের কাছ থেকে                             ফিরিয়ে দাও সে অধিকার                                                আমাদের হাতে আমাদের বেঁচে থাকবার।’’                                                                                                 


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান