কবি : আচার্য মিলন
বেঈমানের কৈফিয়ৎ
এ জীবনে শপথ ভেঙেছি বহুবার
গর্ভধারিণীকে যে কথা দিয়েছিলাম
তা ভেঙেছি অবলীলায়
ধূমপানের সাথে নিয়তি জুড়েছি
জীবনটাকে তিরের মতো ছুঁড়েছি
ভাবিনি কখনো পরিনাম
অই যে মহান ঈশ্বর
তাকেও বুড়ো আঙুল দেখিয়েছি বহুবার
তাকে বলেছিলাম, এটা দাও, আমি ওটা দেবো
আমার ছেলেভোলানো কথায় ঈশ্বর ভুলেছিল
আমার দাবি মিটিয়েছিল সে
কিন্তু দেখো
একটা এক নম্বরের হারামি আমি
ঈশ্বরকে হাবা বানিয়ে আমি চলে গিয়েছি
বিকারহীন...
তোমার কাছে, তোমাদের কাছে দেওয়া শপথ
তাও ভুলে গিয়েছি
একবার, দুইবার, বহুবার
এসব থেকে প্রমাণিত হয়
আমি একটা খাঁটি বেঈমান বটে
কিন্তু জেনে রাখো এক বেঈমানের স্বীকারোক্তি
আমার চিন্তার সাথে
আমার ভেতর জাগ্রত স্বপ্নের সাথে
আমারে বোধের ভেতর লালিত মানুষ শব্দটির সাথে
আমার প্রিয়তমা বাংলার সাথে
আমি কোনো বেঈমানি করিনি
এই খাঁটি বেঈমান নিজের সাথে শতবার বেঈমানি করতে পারে
কিন্তু তার জাগ্রত স্বপ্ন, লালিত বোধ আর প্রিয়তমার সাথে
শতবার, দুইবার, একবার কিংবা কখনোই
বেঈমানি করতে পারে না
প্রতুত্তর
কল্যাণীয়েষু,
হ্যাঁ, অতঃপর তুই এসেছিস।
আমার অপেক্ষার দীর্ঘ প্রহর ঘোচাতে
সময়কে হাতের মুঠোয় আটকে রেখে
তুই এসেছিস।
মিঠাজল হাতে তৃষ্ণায় কাতর হয়েছিলাম
সমুদ্রবিলাসী তোর কাছে চেয়েছিলাম
একটুখানি নোনা বাতাস।
আমার কাতরায় মুগ্ধ হয়েছিলি তুই।
বঙ্গোপসাগরকে তুলে এনেছিলি বোতলে ভরে।
তুমুল সাগরের বুক ছিন্নভিন্ন করে তুলে এনেছিস
অদ্ভুত প্রবাল ও অপূর্ব শৈবাল।
আমাকে অনন্ত প্রেমের জলে ভাসিয়ে
তুই চলে গিয়েছিলি সাগর আর পাহাড়ের কাছে।
আমার দিনরাত্রিগুলি আঁধারে ঢেকেছিল।
দিনগুলি হয়েছিল বিবর্ণ।
আমার বিবর্ণ দিনগুলি বর্ণিল করতে
বাক্সবন্দী করে এনেছিস সাতরঙা রামধনু।
আঁধার কাটাতে পোষ মানিয়ে এনেছিস জোনাকি।
আমার দীর্ঘ অপেক্ষার ক্লান্তি কাটাতে তুই পাড়ি দিয়েছিস
বিস্তীর্ণ পথ।
রাত্রির জঘন্য অন্ধকার কেটেছিস ফালি ফালি।
ঘোর অমানিশায় চাঁদটাকে প্রদীপ করে
হেঁটে এসেছিস গহীন অরণ্য পথে।
আজ সেই তুই
আমাকে উত্তপ্ত মরুর বুকে একা রেখে
নষ্ট অভ্যাসের প্রতি অনুগত হয়ে
এগিয়ে চলেছিস অসম্মানকে সাথী করে।
যাবার সময় নিভে দিলি চাঁদের প্রদীপ
উড়ে গেল পোষমানা জোনাকি।
বাক্স খুলে মুক্ত হলো সাতরঙা রামধনু।
আমার ক্ষণিক আলোকিত ভুবন
আবার অন্ধকারে ঢেকে
দিনগুলি আবার বিবর্ণ করে
তুই অসামান্য পথে।
তোর চলে যাওয়ায় বঙ্গোপসাগরও শুকিয়ে যায়।
নোনা বাতাস হারিয়ে যায় মিঠাজলের তাণ্ডবে
আমি আবার অথৈ প্রেমের জলে।
এই শহরে
এই শহরে কোনো ধানক্ষেত নেই।
নেই শিশির ভেজা ঘাস কিংবা ঘাসফুল।
শহরের গনগনে পিচঢালা পথ,
কখনো ভঙ্গুর, কখনো মসৃন
আমরা এগিয়ে চলি আবেগহীন অনুভূতিবিহীন
আমরা ভালোবাসার কথা বলি,
অথচ আমরা ভালোবাসতে ভুলে গেছি।
আমরা বৃক্ষ, ফুল আর পাখিদের কথা বলি।
কিন্তু দেখো, এই শহরে কাক আর শালিক ছাড়া কাউকে দেখি না।
ফুলগুলো দোকানে শোভা পায়। বৃক্ষরাজি নিষ্ফল।
এই শহরে আমি কোনো কবিতা শুনি না।
এই শহরে আমি কোনো কবি দেখি না।
এই শহরে আমি কোনো প্রেমিক দেখি না।
প্রেমিক হলে ভালোবাসা জানতে হয়।
প্রেমিক হলে কবিতা বুঝতে হয়।
প্রেমিক হলে বৃক্ষ-ফুল-পাখির সখা হতে হয়।
এই শহরজুড়ে মৃতদের কোলাহল।
এই শহর আজ হেলে পড়া শহর।
এই শহর আজ শশ্মানের শহর।
এই শহর আজ গোরস্তানের শহর।
এই শহরে মানুষ দেখি না।
শুধু কতগুলো ছায়ামানুষ দেখি।
সংলাপ
প্রিয়তমা, এসো সংলাপে বসি।
তোমার আমার যতো মান অভিমান
তোমার উচ্ছৃঙ্খল আচরণ
আমার গোঁ ধরে থাকা
সব দেখে পেরেশান বড় দাদাবাবুরা
ওরা চায় আমরা সংলাপে বসি
এসো তবে মুখে নিয়ে হাসি
প্রিয়তমা, এসো সংলাপে বসি।
বসন্ত বিলাপ
ওরা দুজন এমনি করেই থাকে
গায়ের সাথে গা লাগিয়ে বসে
ওরা দুজন হাত জড়িয়ে হাঁটে
চলতে থাকে অনন্ত সুখের আশে
তোরা কেউ দিস না বাধা ওদের
ওরা দুজন সুখি হতে চায়
তোরা কেউ চাস ওদের পানে
ওরা দুজন দিগন্ত পানে ধায়
দিগন্তরেখায় ফুল ফোটানো বন
সেই বনেতে ছোট্ট একটা ঘর
অই ঘরেতে দুজন মিলেমিশে
অপেক্ষা করে যাবে তেপান্তর
তোরা কেউ দিস না ওদের বাধা
ওরা দুজন তেপান্তরে যাবে
তেপান্তরের বিরান ভূমি জুড়ে
ওরা তখন প্রেমের দেখা পাবে