১.১ অনুভূতির অভিজ্ঞানে কবিতার জন্ম। অন্তরঙ্গ উপলব্ধির শব্দপুষ্ট প্রকাশ। রুদ্ধবাক আবেগের ভাবনির্ঝর প্রস্রবণ মুক্তবাক কবিতায়। উপলব্ধির প্রগাঢ়তা কবিতার প্রাণ প্রতিষ্ঠার প্রথম শর্ত। দ্বিতীয় অভিজ্ঞতার শীর্ষ বোধ্যতা। এবং এ বোধ্যতার মাধ্যমিক প্রতিকী অবলম্বন শব্দ। বাঙ্ময় শব্দের উচ্চারণ তরঙ্গের ভেতর দিয়ে লব্ধ অভিজ্ঞতাটি তখনই আত্মার নিবিড় গভীর প্রদেশে স্থিত হয় যখন বোধটির অখন্ডতা অভিজ্ঞতাটিকে ধারণ করবার যোগ্যতা অর্জনে পরিপূর্ণ সফলতা লাভ করে।
শব্দের নান্দনিক সীমা অতিক্রমী সমগ্রতায় মৌল বিষয়ের বহুবিচিত্র ভাব ব্যঞ্জণার প্রকাশ বি¯তৃত, ভাবের ঘনীভূত সমাবেশ প্রাণময়Ñযা ব্যঞ্জনার সীমাবদ্ধতাকে উত্তীর্ণ ক’রে উৎকীর্ণ করতে চায় আত্মার অসীম আয়োতনের মধ্য বিন্দুতে বিপুল আয়োজনে মূর্ত হ’য়ে আকাক্সক্ষার পূর্ণতায় তীব্র প্রাণময়োতার স্পন্দন সৃষ্টি ক’রে। যে প্রাণময়োতার চরমোৎকর্ষিত উপাদান আবার কেন্দ্রীত অন্তরাত্মরই বিশাল কর্মযজ্ঞের প্রাণচাঞ্চল্যে। এখানে এই নিগুঢ় প্রাণচাঞ্চল্যের বিপরীত যে কোনো অন্তরায় সম্পূর্ণ বোধশক্তির উপলব্ধ নির্যাসকে কোনোভাবেই প্রতীকজ্ঞানে সম্পূর্ণতার প্রাচুর্য্যে অপূর্ব ক’রে তুলতে পারেনা। যেহেতু আত্মার চাঞ্চল্য বস্তুতঃ জীবন-নির্ভর, জীবন-রহিত নয়। জীবনের প্রতিভাস স্পষ্টতঃ প্রাণবন্ত চিত্তবৃত্তির বিকশিত চিন্তামগ্নতা সত্যদীপ্তির আঙ্গিককে পূর্ণরূপে ধারণ করেই। আর সত্যদীপ্তি যা জীবনেরই ‘ প্রতিরূপ-সৃষ্টি’- প্রেরণার অখন্ড মৌলিক ভিত্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে অনায়াসেই।
ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সৃষ্টির খন্ডিত রূপ অথবা ভগ্নাংশের বিকৃতি একান্তই যদি বহন করে জীবন-নির্যাতন তবুও সে নির্যাতনই পরোক্ষভাবে আবার নির্মাণ করে এক ধরণের খন্ডাংশ-বিকৃতি, যে বিকৃতিই আবার ভিন্নভাবে সে খন্ডিত রূপেরই চারিত্রিক দৃঢ়তা হয়ে দাঁড়ায় এবং এক অর্থে নির্যাতন লাভ করে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য খন্ডিত রূপেরই বহু ব্যাঞ্জনা লভিত দৃঢ়তার বিশিষ্টতা। অর্থাৎ খন্ডিত রূপের অংশটিও হ’য়ে ওঠে ওই খন্ডের মধ্যে সীমায়িত পূর্ণ একক সৌন্দর্যতা।
আত্মগত কল্পনার প্রসারণ যা কেবলই ব্যক্তিক অনুভবের মাত্রা দিয়েই উপলব্ধ- যে মাত্রাটি আবার শব্দ কাঠামোর প্রস্তাবনা এবং দ্যোতনার চমৎকারিত্বে অবশ্যই বাঙময় হওয়া একান্তই বাঞ্ছনীয়তার তুলাদন্ডের মাধমেই নিরূপিত। যদি সেটি না হয় তাহলে কল্পনার প্রসারণ বিঘিœত হবার দিকটিকেই ইঙ্গিত করে। এবং অবশ্যম্ভাবীরূপে আত্মগত কল্পনার চৈতন্যহীনতা দিয়ে অবধাবিত রসাশ্রিত চিত্র সৃষ্টির পরিকল্পনায় বিপর্যয়কে শুধু চিহ্নিতই নয় বরং নিশ্চিহ্নতাকেই অবধারিত ক’রে তোলে। যাকে অনুভূতিপ্রবণ অন্তর্জ্ঞানলব্ধ অভিজ্ঞতাও অস্বীকার করতে পারে না। স্থিতিশীল আবেদন রূপান্তরিত হয় বিচ্ছিন্ন অপভ্রংশে এবং ভাষা সৃষ্টিতে শব্দমন্ডলের যতটা অঞ্চল পরিক্রমণ প্রয়োজন সে তুলনায় পদক্ষেপ হয় জড়তাযুক্ত, মন্থর ও স্থবির। শব্দ বিন্যাসের প্রকৃতি কবিতার ঐশ^র্য্য আর প্রকৃতি-সৌকর্য্য কবিতার অলংকার।
অথচ প্রগাঢ় উপলব্ধির আয়তনে সূ² অনভূতির বিসর্পণÑ যা শব্দ শৈলীর সুগঠিত বিন্যাসকে অবধারিতরূপে আহবান জানায়- সে বিন্যাসের পদ্ধতিগত প্রশ্ন বিন্যাসটিকেই যদি জটিলতর অবয়বে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় সে ক্ষেত্রে উপলব্ধির প্রগাঢ়তা প্রকৃতিটিকেই করে তোলে প্রতিমুখী। ফলতঃ রসাশ্রিত কবিতার আবেদনও হয়ে পড়ে বিক্ষিপ্ত। সমগ্র বক্তব্যের ভাবমূর্তি নিরুক্ত হয় খন্ডাংশে। প্রাসঙ্গিকভাবেই তখন সামগ্রিক বক্তব্যের খন্ডিত চেহারা দ্যুতিমান হলেও গ্রহণযোগ্যতার নিরিখে প্রশ্নবিদ্ধ হ’য়ে যায়। কারণ খন্ডাংশ কখনই সমগ্রতায় রূপ লাভ করতে পারে না।
শুধুমাত্র নিবিড় চৈতন্যোদয়ের আনুভূতিক মর্মবোধ কবিতার কণ্ঠস্বরকে যতটা মাধুর্য্যমন্ডিত ক’রে বিষয়ের অন্তর্গুঢ় গাম্ভীর্য্য এবং সুখসিক্ত তাৎপর্য্যরে উদঘাটন সম্ভব ক’রে তুলতে পারে, অন্য কোনো মাধ্যম সম্ভবতঃ তা পারে না। আনুভূতিক মর্মবোধও কবিতার কন্ঠস্বরকে ততটা মাধুর্যমন্ডিত করতে পারে না যদি তাতে শাব্দিক সুষমার সমন্বয় না ঘটে এবং সে সুষুমা মন্ডিত শাব্দিক তরঙ্গাবলীর মাধ্যমে পরিবৃদ্ধ না হয়।
এই পরিবৃদ্ধিই কবিতার কন্ঠস্বরকে ব্যাপকতার ভিত্তিতে সার্বজনীন ক’রে তুলতে এক অবিনাশী ভূমিকা পালন করে। ‘সমস্ত শিল্পই বস্তুনির্ভর উপাদানের মাধ্যমে প্রকাশিত বোধের সামগ্রী মাত্র।’ এখন প্রশ্ন উত্থিত হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে, বস্তুনির্ভর উপাদানটি কী এবং বোধের সামগ্রী হিসেবে গৃহীত এবং প্রকাশিত হবার যোগ্যতা সেটির আদৌ আছে কিনা?
এক কথায় উত্তর- আছে। কেন এবং কিভাবে আছে? এই প্রশ্নটির উত্তরে যেতে হলে দু’টি বিষয়কে অবশ্যই বিবেচনায় আনতে হবে
০১. ‘সমস্ত শিল্প’।
০২. ‘গৃহীত হবার যোগ্যতা’।
যদিও একথা অনঃস্বীকার্য যে, ‘বোধ’-এর বিষয়টি বিবেচনায় আসবার সঙ্গে সঙ্গে ‘ চিন্তাশীলতা’র প্রশ্নটিও আপনা আপনি সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। শুধু এসে দাঁড়ায়ই না বরং বোধকেই আক্রান্ত করে। যেহেতু চিন্তাশীলতার জরায়ুতেই বোধের উৎপত্তি। যদি চিন্তাশীলতার জরায়ুর জ্বালামুখটি রূদ্ধ হ’য়ে যায় তাহলে ‘বোধ’-এর অস্তিত্ব ব’লেই কিছু থাকে না। কিন্তু যেহেতু বহুমাত্রিক চিন্তাশীলতার অনিঃশেষ দূরগামী প্রগাঢ়ত্বের ভেতরেই যে কোনো শিল্পের বস্তুনির্ভর উপাদান অন্তরিত থেকেই অস্তিত্ববান সেইহেতু বোধ সে উপাদানকে ধারণ করে প্রকাশ করে মাত্র। যখনই বোধ উপাদানটিকে প্রকাশিত করে তখনই উপাদানটি বোধের সামগ্রীতে রূপান্তরিত হয়ে যায়।
অন্য কথায় বোধের সামগ্রীরূপে বস্তুনির্ভর উপাদান যেকোনো শিল্পের স্ফটিক-স্বচ্ছ আর্শির মতন। সেদিক থেকে গোটা সাহিত্য শিল্পে যেহেতু কবিতা একটি আংশিক আকৃতি হিসেবেই গ্রাহ্য সেইহেতু ওই আংশিক বা খন্ডিত অংশটির ‘ শিল্প-আঙ্গিকে’- কবিতা একটি একক সত্বার অদ্বিতীয় স্ফুরণ মাত্রÑ যদি সে সত্ত¡ার অভ্যন্তরে বস্তুনির্ভরতার উপাদান স্থিত থাকে। যদি না থাকে তাহলে চিন্তাশীলতার পরিধিও সঙ্কুচিত হ’য়ে আসে এবং বোধের ধারণ এবং প্রকাশ ক্ষমতাও সীমিত হ’য়ে পড়ে। সে প্রেক্ষিতে চিন্তাশীলতার বি¯তৃতায়ন অক্ষুন্ন থাকলে নির্ভরিত বস্তুর উপাদান-ষ্টতা থেকে কবিতা তার আত্ম-উজ্জ্বলতাকে প্রখর থেকে প্রখরতর মাত্রায় উন্নীত করে। আর উপাদানও সেই অর্থে বিষয়েরই সমতুল্য এবং সে ‘ বিষয়-অনুভূতি’ অনিবার্যরূপে অভিজ্ঞানের প্রতিনিধি হিসেবেই গণ্য হয়। বোধায়ত্ত জীবনের পরিমন্ডলে এ প্রতিনিধি তাই অসম্ভব ইঙ্গিতবাহী। অবশ্যই শিল্পের পরিসীমায়। শিল্পের অঙ্গে এ প্রতিনিধির নির্বাধ চলাচল সৃষ্টিকে মহিমান্বিত ক’রে সৃষ্টির স্থায়ী আধার রচনায় দুর্বার ক’রে তোলে।
১.২. আত্মা-জাত যা কিছুÑ সবই আধ্যাত্মিক। আত্মদর্শন লাভ কল্পে সমগ্র সাধনা দিয়ে অর্জিত আত্মদর্শনের মাধ্যমে যা অনুভূত ভিন্ন অর্থে মানুষের চৈতন্য পরিধিতে যা সৃষ্ট তাই-ই আধ্যাত্মিকতার পর্যায়ভুক্ত। আর এ আধ্যাত্মিক শব্দটি থেকেই জন্ম লাভ ‘ আধ্যাত্মবাদ’- এর। ইংরেজীতে যাকে বলা হয়Ñ ঝঢ়রৎরঃঁধষরংস. এবং এই আধ্যাত্মিকতার অন্তর্লোক অথবা আন্তর্জাগতিক সৃষ্টির অস্তিত্বের প্রকাশ এবং ধারণের ক্ষমতা সাধারণ এবং প্রাথমিক স্তরে বোধকরি শব্দাবলীর সুগঠিত ব্যঞ্জনায় একমাত্র কবিতারই আত্মগত। ওই অর্থে আধ্যাত্মিকতাকে আত্মদর্শনের মৌল উপকরণের মর্যাদায়ও অভিষিক্ত করা যায়।
কবিতার সঙ্গে আত্মচৈতন্যের সম্পর্ক বড় তীব্র, ঘনিষ্ঠ এবং বিনীত। চিন্তাবৃত্তিতে উদ্ধারিত স্বপ্ন যা অবশ্যই আত্মাজাত এবং বিকাশ বুদ্ধিবৃত্তিক বিচক্ষণতা। এ দু’য়ের মিলিত ফলাফলই আত্মদর্শন এবং প্রকারান্তরে আধ্যাত্মিকতা। যেহেতু আত্মদর্শন ব্যতীত আধ্যাত্মিকতার প্রশ্ন অবান্তর। আত্মা-জাত সৃষ্টিকে দর্শনের ক্ষেত্রে চিন্তাবৃত্তির অতি সূ² তীক্ষèতা এবং প্রগাঢ় গভীরতা যেমন একটি অপরিহার্য অনিবার্যতা ঠিক তেমনি আধ্যাত্মিকতার উৎপ্লবনের ক্ষেত্রে ওই চিন্তাবৃত্তির তীক্ষèতার সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক বিচক্ষণতার সর্বব্যপকতা অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। অর্থাৎ আত্মা-জাত পরিশুদ্ধ মননশীল চিন্তাবৃত্তির তীক্ষèতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক বিচক্ষণতার সর্বব্যাপকতার যৌগিক ফলাফলই হলো আত্মদর্শণ। এবং প্রকৃত অর্থে আধ্যাত্মিকতার অথৈ পানিতে সঞ্চরণের মৌলিক শর্ত আত্মদর্শন। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এ শর্ত পূরিত না হলে আত্মার চৈতন্যিক উদ্ভাসন যেমন সম্ভব নয় একই অর্থে বুদ্ধিবৃত্তিক অধিবাস্তব স্বপ্ন নির্মাণেও সক্ষমতা অর্জন করে না। যেহেতু অধিবাস্তব স্বপ্ন নির্মিতির ক্রমান্বয়িকতার ভেতর দিয়েই কেবল আত্মদর্শন-জাত আধ্যাত্মিকতার চলাচল। তাহলে এখানে স্থির নিশ্চিত যে, আত্মদর্শন ব্যতীত আধ্যাত্মবাদ শুন্যগর্ভ।
চেতনার বিশালতায় আত্মার সূ² অনুভূতির চরম অভিব্যক্তির মুক্তি কবিতার বিষয় সৃষ্টি এবং প্রকৃতি নির্মাণ তথা নির্ধারণের চূড়ান্ত সমাধান এবং সাধারণ অর্থে কবিতা তার আঙ্গিক সৌষ্ঠবে ছান্দিক লাবণ্যে আর শব্দের বিন্যাসে এক বিশিষ্টার্থক বিচিত্রতার মূল্যে বিবেচিত হতে পারে। কিন্তু প্রকৃত মূল্যমান বিচারে সে বিবেচনাই চূড়ান্ত জ্ঞানে পুরোপুরি গ্রাহ্য নয় বোধকরি। কেননা শুধুমাত্র কবিতার বিষয়বস্তু ভিত্তিক নির্মাণ শৈলী এবং নান্দনিক অঙ্গ-লাবণ্যের সীমিত আবর্তেই কবিতার মর্মাথের ব্যাপক বিস্তৃতি সম্ভব নয়।
বিপুল, বিশাল বি¯তৃতায়নের গোটা প্রান্তরই কবিতার নিগুঢ় মর্মার্থ বিচরণের পরিধি। এই পরিধিকে সসীমে আবদ্ধ করতে চাইলে মর্মাথটি হয়ে পড়ে একেবারেই শিথিল। সম্ভবতঃ এ কারণেই কবিতা এই সসীমের রূদ্ধতামুক্ত এবং মানসলোকের আত্যন্তিক চৈতন্যের বাণীরূপ প্রকাশ ব’লেই কবিতায় আত্মদর্শনের অবকাশ পর্যাপ্ত। ফলে আধ্যাত্মিকতার প্রতিবেশে আপন অস্তিত্বের অবস্থিতি এবং সে অবস্থিতি দর্শনের পথটিও অনায়াসেই হ’য়ে ওঠে অনাচ্ছন্ন।
কিন্তু এর বিপরীতেও অবস্থান করে একটি অতি স্বাভাবিক প্রশ্নচিহ্ন। এই অর্থে যে, জীবনের প্রতিরূপ অবলোকনে কবিতাই যে হবে শেষ কথা এমন ধারণাও নির্বিরোধ হবার যোগ্যতা রাখে না। যেহেতু জীবন বহুমুখী, বহুবিচিত্র বিরোধের পারস্পরিক অপূর্ব নিবিড় আলিঙ্গনেই জীবনের উদ্ভাসন- এ উদ্ভাসন অন্তহীন। কিন্তু এই অন্তঃহীনতার প্রেক্ষিতাশ্রয়ী উদ্ভাসনটি যদি কখনও খন্ডায়িত হয়, খন্ডাংশে রূপান্তরনের এক বিনাশী স্বত্ত¡ার কাছে আত্মসমর্পণ করে তাহলে নিশ্চিতভাবেই কবিতা তার সমগ্রতা হারিয়ে ফেলবে। কেননা জীবনের উদ্ভাসনও তখন পরিপূর্ণতা অর্জন করতে সক্ষম হবে না। তখন কি বলা যাবে- জীবনের প্রতিরূপ অবলোকনে কবিতাই শেষ কথা? যদিও বলা যাবে না তবুও কবিতার একটি প্রভাব অনিঃশেষিত থেকে যাবে। দেহাত্মবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মূল সূত্রটিও এই অন্তহীন উদ্ভাসন থেকে উৎপাদিত। যদিও তা প্রকৃতিগতভাবে চিরন্তন জীবনের বিশেষ একটি দিককেই মাত্র ইঙ্গিত করে সব চাইতে বেশী। তার পরেও ভিন্নমাত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষায়িত হ’লে অবশ্যই দেখা যাবে ‘আত্মদর্শন’- এর কল্পভূমিতে আধ্যাত্মবাদ এবং দেহাত্মবাদ-পারস্পরিকভাবে একটি অপরটির ভেতর লীন। এই লীন হবার বিষয়টিকে যদি এভাবে ভাবা যায়Ñ
মানব দেহ কল্পভূমি
যতœ করলে রতœ ফলে
আমার আশা তবে পূর্ণ হবে
শুভযোগে চাষ করিলে।’ ( বাউল সঙ্গীত)।
উদ্ধৃত পঙ্তি ক’টিতে শুভযোগে কর্ষণ সাপেক্ষে যে দৈহিক কল্পভূমিতে মহামূল্যবান রতেœর জন্ম সম্ভবের বিষয়টিকে নিশ্চিত করা হয়েছে- তা উদ্গত হয়েছে নিতান্তই মানুষের জৈবিক তাড়না লব্ধ নারী পৃরুষের অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি নির্ধারিত প্রক্রিয়ার ভেতর থেকে। কিন্তু কবিতার পঙ্তি ক’টিতে দু’টি শর্ত আরোপ করা হয়েছেÑ ‘ শুভযোগ’ এবং ‘ যতœ’। যে নারী দেহকে শষ্যভূমি কল্পনা ক’রে শস্য উৎপাদনের মূল উপাদান হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে সে শস্যভূমিটিকে অবশ্যই একজন পূরুষ কর্ষণকারী কর্তৃক কর্ষণ করতে হবে শুভযোগে। অর্থাৎ এখানে ‘সময়’-কে একটি অপরিহার্য শর্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। ঠিক একইভাবে বিবেচনা করা হয়েছে ‘ যতœ’- এর বিষয়টিকেও। ‘মানব’ নামীয় কর্ষনকারীটি যদি কর্ষনযোগ্য ‘মানবী’-নামীয় শষ্যভূমিটিকে শুভযোগে বা যথোপযুক্ত সময়ে কর্ষণ না করে, ভিন্নভাবে- মানব মানবীর দৈহিক মিলন ক্ষণটি যদি শুভ না হয় তাহলে উৎপাদিত শষ্যটি পূর্ণাঙ্গ না-ও হতে পারে। অশুভ লগ্নে মানব মানবীর দৈহিক মিলনের ক্রিয়া থেকে যে শস্যটি অর্থাৎ যে শিশুটির জন্ম লাভ সম্ভব হবে সে শিশুটির বিকলাঙ্গ হবার সম্ভাবনাই থেকে যাবে অধিক মাত্রায় যেখানে পূর্ণাঙ্গ মানের ফসল উৎপাদিত হবে না। কিন্তু এখানেও একটি প্রশ্ন থেকে যায়Ñ শুভ লগ্নটি নির্ধারিত হবে কিভাবে?
আর একটি শর্তÑ যতœ। কর্ষিত হবার পর কর্ষিত ভূমিটির যতœটি যদি পরিপূর্ণ না হয় তাহলেও কাক্সিক্ষত শস্যটি প্রত্যাশিত মাত্রায় পৌঁছুতে ব্যর্থও হ’তে পারে। ভূমিটিতে যদি প্রয়োজনীয় জল সিঞ্চণ করা না হয়, যদি যথাযথ সময়ে ভূমিটির ওপর আশ্রিত আগাছা নির্মুল করা না হয় এবং ভূমিটির ওপর অন্যান্য অনুষঙ্গ গুলিকে সঠিক পদ্ধতিগতভাবে ব্যবহার ক’রে প্রয়োগ করা না হয় তাহলেও ফসলের শস্যদানাটি অপূর্ণাঙ্গই থেকে যাবে। অর্থাৎ যে মানবীটি পূর্ণাঙ্গ শষ্যদানা প্রসব করবে- কর্ষিত হবার পর থেকে সেই মানবীকে প্রয়োজনীয় যতœ, চিকিৎসা এবং অন্যান্য আনুষাঙ্গিক উপাদানগুলিকে প্রদান করতে হবে। তাহলেই কেবল পূর্ণাঙ্গ শষ্য প্রাপ্তির সম্ভাবনাটি উজ্জ্বলতর হ’য়ে উঠবে।
লক্ষ্যণীয়, বাউল তত্তে¡র মূল কেন্দ্র থেকে যে তত্ত¡টি জন্মিত সে তত্ত¡টি মূলতঃ ‘ দেহাত্মবাদ’। বাউল তত্ত¡ দেহতাত্তি¡কতার ভেতর দিয়েই অন্বেষণ করেছে মানুসি জীবনের মনুষ্যত্ববাদকে যা কোনো প্রকার শর্ত ব্যতীতই ‘আধ্যাত্মবাদ’-এর ঘণিভূত রূপ। আর দেহাত্মবাদী মতবাদের কেন্দ্রমূলটিও ঠিক এখানেই প্রোথিত। বাউল তত্ত¡ বিশ্বাস করে- মানব দেহের ভেতরেই পরমাত্মা বসবাস ক’রে নিয়ত সৃষ্টি ক’রে চলেছে লক্ষ, কোটি বস্তু-নির্ভর উপাদান। অর্থাৎ আত্মাজাত হচ্ছে অসংখ্য সৃষ্টি। যেহেতু স্রোষ্টার আলয় মনুষ্য দেহ এবং মনুষ্য দেহের ভেতরেই স্রোষ্টা আত্মগত সেইহেতু সেই আত্মাই ঈশ্বর। ঈশ্বর সান্নিধ্য লাভ করতে গেলে সর্বাগ্রেই লাভ করতে হবে আত্মার সান্নিধ্য। এ উদ্দেশ্যেই বাউল তত্ত¡ মনুষ্য দেহকে ঈশ্বর নিবাস বিবেচনা ক’রে ঈশ্বর আরাধনায় মগ্ন থাকে দেহ ভিত্তিক সংগীত রচনা এবং সে সঙ্গীত সাধনার ভেতর দিয়ে। তাদের বিশ্বাস দেহ-ভিত্তিক সঙ্গীত সাধনার মধ্যে দিয়েই আত্মার দর্শন সম্ভব। বাউল সংগীতের উদ্ধৃত পঙ্তি ক’টিতে যার প্রমাণ নিঃসন্দেহে প্রকাশিত। যেখানে মানব দেহকেই শস্যভূমি হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। যদি আত্মাকে প্রখর চিন্তাশীলতার সর্বোচ্চ মাত্রার গভীরতা দিয়ে আত্মশক্তির গুঢ় চৈতণ্যগত উপলব্ধিতে স্থাপন করা যায় কেবল তাহলেই ঈশ্বর তাদের কাছে লভিত হ’তে পারে ব’লে তারা অতি নিগুঢ়ভাবে বিশ্বাস করে। এবং এ বিশ্বাসটিই প্রকারান্তরে তাদের ধর্ম। এবং এই আত্মাকে দর্শন এবং আত্মার সান্নিধ্য লাভই ‘আত্ম দর্শন’Ñ যে ধারণাটিতে তারা স্থির নিশ্চিত।
অবশ্য যদিও দৈহিক তাড়নার আয়ত্তাগত মত্ততাকে স্বীকার করেই দোহাত্মবাদ অনিঃশেষে ধাবিত হয়েছে মূল লক্ষ্যের দিকে। অর্থাৎ ঈশ্বর সান্নিধ্য প্রাপ্তির আকাক্সক্ষা পূরণের অনির্বচনীয় এক সুখাশ্রিত আনন্দ অর্জনের সাধনার কেন্দ্রবিন্দুটিকে আয়ত্তে আনবার জন্যে। তবুও লক্ষনীয় ভিন্ন বোধে জীবন দর্শনের তৃপ্তিহীন অন্বেষাকেই বাউল তত্ত¡ বিশেষ এক অর্থে বিধৃত করেছে সঙ্গীতের মাধ্যমে।
যে অন্বেষার অনির্ণেয় তৃষ্ণা ফুটে উঠেছে সঙ্গীতের আকারে শাব্দিক কাঠামোর সংগীতিক পরিধিতে একটি মাত্র বিশেষ লক্ষ্যকেই চিহ্নিত ক’রেÑ যা ‘ দেহাত্মবাদ’ এর মর্মমূলে অধিগমন। সে কারণে ওই অন্বেষণ-তৃষ্ণার অবয়ব একটি নির্দিষ্ট পরিসরে সীমায়িত হ’য়ে যায়। আকাক্সক্ষার সর্বব্যাপকতাকে ধারণ করবার ক্ষেত্রে অন্বেষণ-তৃষ্ণা খন্ডিত হ’য়ে পড়ে।
আর ঠিক সে কারণেই দেহাত্মবাদ আপেক্ষিকতার ঘূর্ণাবর্তেই বৃত্তায়িত হ’তে থাকে। তখন সামগ্রিক জীবনদর্শনের তাৎপর্য ওই আপেক্ষিকতার কারণে মূল্যহীনতার অসারত্বে নিক্ষিপ্ত হবার লক্ষণকে স্পষ্ট ক’রে তোলে। এবং আধ্যাত্মবাদকেও তার মৌলিক উপযোগ থেকে বঞ্চিত করে। অথচ কবিতায় তা নয়। কবিতায় জীবনের এক স্তর থেকে ধারাবাহিকভাবে বহু স্তরে উত্তরণ অনায়াস সাধ্য। এই দূর্গমতা থেকে উৎসারিত বলেই কবিতা মৃত্তিকার সর্বশেষ স্তর থেকে নির্বাধ ক্রমান্বয়িকতায় মহাশুন্যের সর্বশেষ স্তর পর্যন্ত বিচরণশীল। এবং এই স্তর থেকে স্থানান্তরই জীবন তথা আত্মদর্শনের অন্তনির্হিত দীপ্তি।
মরণ রে তুঁ হুঁ মম শ্যাম সমান
মেঘ বরণ তুঝ, মেঘ জটা জুট
রক্ত কমলকর
রক্ত অধর পুট।’-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
জীবনের সর্বশেষ স্তরের উদঘাটন কবিতার গভীরে। মৃত্যুহীন জীবনের মুক্তিলাভ চৈতন্যের মানসপটে জীবনের অনুকৃতি রূপে। মরণেই জীবন স্পষ্টবাক- জীবনের গভীরতা প্রগাঢ়। শুধু প্রগাঢ়ই নয় সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যয়দীপ্তও। আর এ প্রত্যয়দীপ্তিই আনুক্রমিক ‘ স্তর-উত্তরণের’- প্রবণতা।
কবিতার শরীরে এ প্রবণতার মূল্যায়ন যতটা সম্ভব আধ্যাত্মিকতার দ্বারোন্মোচনের মাধ্যমেই করা সম্ভব। এ প্রবণতার প্রভাব ও স্থিতি শক্তি এত বেশী অমোঘ এবং দীর্ঘস্থায়ী যে বস্তুনির্ভর শিল্পের অন্যান্য পল্লবিত শাখায় যা সম্ভব নয় এবং সেই সব শাখায় এর উপস্থিতি আকস্মিক এবং ক্ষণস্থায়ী।
ফলতঃ যেহেতু কবিতায় আত্মদর্শনের পথ নিশ্চিতরূপে বহুমুখি দুর্গমতা থেকে উৎসারিত, সেইহেতু দুর্গমতা অতিক্রম-উত্তর আত্মদর্শনের মাধ্যমে যে প্রাপ্তি তা অবিনশ্বর। এবং একমাত্র কবির পললিত মনোজ ভূমিতে যা চিরস্থায়ী।
১.৩ সঙ্গীত, চিত্র এবং তৎসম বহুবিধ শিল্প মাধ্যমে জীবন অথবা আত্মার আকুতি অংকন হয়তো বা সম্ভব হয় কিন্তু, প্রগাঢ়তা এবং সমগ্রতা লাভে ততটা সৌভাগ্যবান হয় না যতটা হয় কবিতায়। আর এ জন্যেই কবিতা আত্মদর্শনের প্রকৃষ্ট মাধ্যম। জীবনকে খুঁজতে গিয়ে মরণকে স্বাগত জানাবার প্রস্তুতিপর্বের সর্বশেষ অনুপম দ্বিধামুক্ত সাহসিকতা- কবিতা। একমাত্র কবিতাই সক্ষম মৃত্যুর মহান্ধকার প্রদেশে মহাজীবনের অসাধারণ ঔজ্জ্বল্য আবিস্কারে।
বাউল তত্ত¡ যেমন কল্পতরুর মতো ‘কল্প-দেহাত্ববাদ’-কে মৌলিক ভিত্তিভূমি বিবেচনা ক’রে সেই ভিত্তিভূমির ওপর দÐায়মান থেকে সাঙ্গীতিক মাধ্যমে সেই ভিত্তিভূমির গর্ভ থেকে আত্মাকে দর্শন প্রচেষ্টায় পূর্ণরূপে নিমগ্ন থাকে, কবিতা তখন ‘ কল্প কল্প ধরি’- কবি-কল্পনার সূক্ষাতিসূ² চৈতন্যলোক থেকে আহরিত শব্দ নিচয়কে গ্রন্থির পর গ্রন্থিভুক্ত ক’রে তার শরীরে অসীম চিন্তাশীলতার প্রলেপকে ধারণ ক’রে উচ্চ মাত্রার এমন একটি স্তরে পৌঁছে যায়- যে স্তর থেকে পরমাত্মার সান্নিধ্য লাভ এবং সে আত্মাকে দর্শনের বিষয়টি অপেক্ষাকৃত সহজসাধ্য হ’য়ে যায় যা বাউল তত্তে¡র দেহাত্ববাদে অবশ্যই দূরলভ্য। কারণ কবিতার সমগ্রতা এবং বাউল তত্ত¡ীয় সঙ্গীতের সমগ্রতা এক নয়। বাউল সঙ্গীতের কথা যেখানে নির্দিষ্ট এবং সীমিত কবিতার কথা সেখানে সীমাহীন, অনিরুদ্ধ।
অন্তর্ধ্যান আত্মলয়ের প্রকরণ-নিগুঢ়জ্ঞানে দর্শন। নিরঙ্কুশভাবে আত্মলয়ের গভীরাশ্রিত নিকুঞ্জে অন্তর্ধ্যানের মধ্যে দিয়ে অন্তর্লীন হ’য়ে যাওয়াটিই কবিতার বিন্যস্ত ছান্দিক মাত্রায় আত্ম-অনুসন্ধানের দূরস্পর্শী সান্নিধ্যকেই প্রকটতর ক’রে বিশাল চিৎকারে ফেটে পড়ে- আহŸান জানায়। নৈসর্গিক পরিবেশে প্রকৃতির ঘনিষ্ট সান্নিধ্যে এসে স্বতঃসিদ্ধ প্রেমজ কামনার কল্পনাগামীতা যেমন দুর্বারতা লাভ করে ঠিক তেমনি অন্তর্ধ্যানের নিমগ্নতায় আত্মার সমগ্রতা মানুষের কাছে দুর্নীরিক্ষ তার অধিলৌকিক আলোকোজ্জ্বলতার মাধ্যমে নিজেকে উন্মুক্ত ক’রে দেয়। কিন্তু সাধারণ মানুষের দৃষ্টি সীমায় তা প্রত্যক্ষতা লাভ করে না। কিন্তু ঠিক তখনই একজন কবি ওই অলোকোজ্জ্বলতার ভেতরে আত্মার সমগ্রতাকে তার সুদূরচারী চিন্তাশীলতার তীক্ষè আত্মিক শর প্রয়োগ ক’রে উদ্ধারের সুযোগ পান। এবং কবির মননশীলতায় উদ্ধারিত কল্পবস্তুটিই ‘আত্মদর্শন’-এর অভিধায় অভিহিত হয়। এরপর একজন কবি তার প্রবল চিন্তাস্রোতে বিরামহীন ভেসে যেতে যেতে চূড়ান্ত মোক্ষ অর্জন করতে সক্ষম হন। এবং আত্মদর্শন থেকে লভিত অভিজ্ঞানকে কবি তার সৃষ্ট কর্মে প্রয়োগ করেন।
‘দেশশুন্য কালশুন্য জ্যোতিঃশুন্য মহাশুন্য-’পরি
চতুর্মুখ করিছেন ধ্যান।
সহসা আনন্দসিন্ধু হৃদয়ে উঠিল উথলিয়া,
আদিদের খুলিলা নয়ান।
চারিমুখে বাহিরিল বাণী,
চারি দিকে করিল প্রয়ান।
সীমাহারা মহা অন্ধকারে
সীমাশুন্য ব্যোমপারাবারে
প্রাণপূর্ণ ঝটিকার মতো,
আশাপূর্ণ অতৃপ্তির প্রায়,
সঞ্চরিতে লাগিল সে ভাষা।Ñ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর- (সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়) ।
এখানেও উদ্ধৃত কবিতার পঙ্তি ক’টিতে চৈতন্যের পারাবার পাড়ি দিয়ে দেশ, কাল, আলোশুন্য সীমাহীন মহা-অন্ধকারে কবির হৃদয়ে আকস্মিক আনন্দ-সিন্ধুর যে মহাউৎরোল কবির হৃদয়কে উথাল পাথাল ক’রে ‘ প্রাণপূর্ণ ঝটিকার মতো’Ñ অতৃপ্তির সমুদ্রে যে ভাষা সঞ্চরনে নিমগ্ন হলোÑ সে ভাষাই ‘আত্মদর্শন’-এর বাণী ব’য়ে এনে সৃষ্টির উৎসমুখ উন্মুক্ত ক’রে দেবার সঙ্গে সঙ্গে চারদিক থেকে সে বাণীর আহŸান মুহুর্মূহু উচ্চারিত হ’তে থাকলো। এই বাণীর আহŸান ক্ষণিক দন্ডে নিখিল বিশ্বের বায়ু প্রবাহে উৎকীর্ণ ক’রে দিয়ে অনন্ত প্রয়ানেই অন্তর্ধ্যান করলো আত্মদর্শনের সমগ্রতা। ক্ষণিক দন্ডের এই বাণী কবি-কল্পনায় স্থিতধী হলো যদিও, কিন্তু সাধারণ মানুষের এ বাণীকে ধারণ করবার মতো সক্ষমতা না থাকার কারণে তাদের শ্রবণ পর্যন্ত পৌঁছুতে ব্যর্থ হলো। কিন্তু সে প্রেক্ষিতে একজন কবিই কেবল সাধারণ মানুষের ধারণ-অক্ষম মনোলোককে তার কবিতার মাধ্যমে ওই বাণীকে ধারণ করবার উপযোগী ক’রে তুলে বাণীটিকে তাদের মানসলোকে প্রোথিত করতে পারেন। ফলশ্রæতিতে সাধারণ মানুষও কবি-প্রেরণাজাত এবং প্রদর্শিত পথে এগিয়ে যাবার উৎসাহ বোধ করবেন।
এ কারণেই একজন কবি তার কল্পনাগামীতাকে লোক থেকে লোকান্তরে প্রসারিত ক’রে যে দুর্লভ আত্মদর্শনকে সম্ভব ক’রে তুলে তারই সৃজিত কবিতায় সে আত্মদর্শনের নির্যাসকে গ্রন্থিভুক্ত শব্দাবলীর অনুতে পরমানুতে বিধৃত ক’রে মানুষের জ্ঞানপূর্ণ দৃষ্টির সম্মুখে উন্মোচিত করতে পারেন বিশেষ অর্থে তা অন্য কারো পক্ষেই সম্ভব হয় না।
গ্যেটে-এর কবিতা থেকে
(জার্মান কবি, নাট্যকার, গল্পকার এবং ঔপন্যাসিক গ্যেটে-এর সম্পূর্ণ নাম জোহান উলফ্গ্যাং ফন গ্যেটে। জন্ম ঃ২৮ আগষ্ট, ১৭৪৯ খৃষ্টাব্দ। জন্মস্থান ঃ তৎকালীন জার্মান নগর রাষ্ট্র- ফ্রাংকফুর্ট)।
০১.
‘এইভাবে যখন শীতল হয়ে উঠবে আমার অন্তরাত্মার উত্তাপ
তখন আপনা থেকে গান বেরিয়ে আসবে আমার কন্ঠ থেকে!
যে গান কোন কবির হাতে পড়লে নিরাবয়ব জলও হয়ে উঠবে মূর্ত। ( কবিতা ঃ- কাব্য ও রূপাবয়ব)।
০২.
‘হে দৈব, তুমি একা থাক না, মানুষের সমাজে থেকে
তুমি খাপ খাইয়ে নাও সবার সঙ্গে। জীবনে আমাদের
কোন কোন ঘটনা হয় অনুকূল কোন কোন ঘটনা হয় প্রতিকূল।
আমরা কেউ কেউ ঘটনা নিয়ে পুতুলের মত খেলা করি।
হে দৈব, তুমি হচ্ছো সেই আলোক শিখা যার পথ চেয়ে
বসে আছে আমাদের অসহায় জীবনের বাতিগুলো। (কবিতা ঃ- দৈব)।
এখানে অসামান্য কবি এবং দার্শনিক গ্যেটে-এর দু’টি কবিতার কিছু অংশ উৎকলন করা হলো। লক্ষ্যণীয়, উৎকলিত কবিতার পঙ্তি ক’টিতে বলা হয়েছে ‘যে গান কোন কবির হাতে পড়লে নিরাবয়ব জলও হয়ে উঠবে মূর্ত।’ এবং ‘হে দৈব, তুমি হচ্ছো সেই আলোক শিখা যার পথ চেয়ে বসে আছে আমাদের অসহায় জীবনের বাতিগুলো।’ এখন এ পঙতিগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে কবি তার অসামান্য আত্মিক শক্তি দিয়ে আকার বিহীন জলরাশিকেও আকৃতি প্রদান ক’রে জীবন্ত ক’রে তুলতে পারেন। পাশাপাশি আমাদের জীবনের বাতিগুলির আলো পর্যাপ্ত এবং স্বচ্ছ না হবার কারণে দৈবের আলোক শিখার দিকে তাঁকিয়ে থাকবে ততক্ষণ, যতক্ষণ না সে দৈবের অতি-উজ্জ্বল প্রজ্জ্বলিত আলোক শিখা এসে আমাদের জীবনের নিভু নিভু বাতিগুলিতে নতুন আলোকের মাধ্যমে প্রাণের সঞ্চার করবে। নতুন আলোকের উজ্জ্বলতায় উদ্ভাসিত ক’রে তুলবে। অর্থাৎ আমাদের জীবনগুলি সজীবতর হ’য়ে উঠবে। কবি নিজেই বলেছেন দৈব একা নয, মানুষের সমাজে বসবাস ক’রে মানুষের সাথেই খাপ খাইয়ে নেয়। সুগভীর চিন্তাশীলতায় অর্থটি এরকম দাঁড়ায় যে, দৈব মানুষের আত্মার অভ্যন্তরেই সুপ্ত থাকে। তাকে উদ্ঘাটন করবার এবং উন্মোচন করবার ক্ষমতা কেবল কবিরইÑ আত্মদর্শনের মধ্যে দিয়ে। যেমনটি কবি নিজেই আত্মদর্শনের আকাক্সক্ষা নিয়ে প্রহরের পর প্রহর গণনায় ব্যাপৃত থেকেছেন সর্বক্ষণ।
বস্তুতঃ প্রাসঙ্গিকভাবেই মানুষের অনুসন্ধিৎসায় স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্নের সৃষ্টি হবে, আসলে দৈবটি কী ? এর আকৃতি আছে কি নেই? এবং এর সঙ্গাটিই বা কী? এটি কি দৃষ্টিযোগ্য নাকি অদৃশ্য? যদি দৃষ্টিযোগ্য না হয় তাহলে অবশ্যই কবির কথাতেই ফিরে যেতে হবে। কবি নিরাকার জলরাশিকেও মূর্ত ক’রে তুলতে পারেন। এবং মূর্ত করনের এ কাজটি কবি কোন্ ক্ষমতা বলে করতে পারেন? এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর পেতে হলে আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে কবির কাছেই। কবি অসাধারণ কল্পগামীতার মাধ্যমে অর্জিত আত্মিক ক্ষমতার উৎসমুখের দিকে ধাবিত সর্বক্ষণÑ এবং উৎসমুখে পৌঁছে গিয়ে সে উৎসমুখ থেকে উত্থিত ক্ষমতাকে নিজে অর্জন করে সেই ক্ষমতার মাধ্যমে তিনি অধিলৌকিক আত্মদর্শনকে অর্জন করতে সক্ষম।
এবং এই আত্মদর্শনের ভেতরেই ‘দৈব’- এর অবস্থান। পরমাত্মাটিই দৈবে রূপান্তরিত হ’য়ে অনবরত সৃষ্টি এবং ধ্বংশ দু’টিই ক’রে চলেছেন। এই পরমাত্মাটিকে একজন কবি তার চিন্তাশীলতাকে অসীমেরও উর্দ্ধে সঞ্চালিত ক’রে নিজ আত্মায় প্রতিস্থাপিত করনের মাধ্যমে দৈবকে আত্মগত ক’রে নেন। আর এখানেই একজন কবি তার কবিতার শব্দপুঞ্জ দিয়ে এক বিশাল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা সম্ভব ক’রে তোলেন। এবং এখানেই একজন কবির পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য। অন্যের থেকে কবি সর্বদিক বিবেচনায় নিঃসংশয়ে পৃথক।
অতিসূ² দূরস্পর্শী অনুসন্ধানের ভেতর দিয়ে কবিতাই আত্মার সান্নিধ্য লাভের বিষয়টিকে প্রকটতর ক’রে তুলে বিশাল চিৎকারে ফেটে প’ড়ে কাছে আসবার আহŸান জানায়। অপরূপ নৈসর্গিক পরিবেশে স্বতঃসিদ্ধ প্রেমজ কামনা নিসর্গের স্পর্শধন্য হযে যেমন দুর্বারতা লাভ করে ঠিক তেমনি অন্তর্ধ্যানের নিমগ্নতায় মহাশুন্যে স্থিত নীহারিকাসম আত্মা- সমগ্রতায় পরিপূর্ণ নক্ষত্রের আলো হ’য়ে একজন কবির অপরিমেয় চিন্তাশীলতা থেকে উপ্ত অত্যন্ত চৈতন্যবান ‘ বোধ’-এর কাছাকাছি আসবার সুযোগ পায়। এবং সুযোগটিকে কবি তার অঞ্জলীপুটে গ্রহণ করবার সঙ্গে সঙ্গে নিজ অন্তরে প্রবিষ্ট ক’রে অসাধারণতার বেদীতে নিজেকে স্থাপন করতে সক্ষম হন।
‘এসেছি সে পৃথিবীতে যেথা কল্প কল্প ধরি
প্রাণ পঙ্ক সমুদ্রের গর্ভ হতে উঠি।
জড়ের বিরাট অঙ্ক তলে
উদঘাটিল আপনার নিগুঢ় আশ্চার্য্য পরিচয়
শাখায়িত রূপে রূপান্তরে।’Ñ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আত্মা এখানে পূর্ণাঙ্গ, বিরাট। এই বিরাটত্বের ফ্রেমে জীবন আবিষ্কৃতÑ প্রাণপঙ্ক সমুদ্রের গর্ভ থেকে জড়ের অঙ্ক তলেÑ যেখানে কবির ভাবনায় আত্মপরিচয় উদ্ধারিত পাঁকপূর্ণ সমুদ্রের গর্ভাশ্রিত জড়ত্বের জীবনহীন স্থবিরতা থেকে। অথচ এ স্থবির জড় পাঁকের মধ্যেও কবি প্রাণের অস্তিত্ব উদ্ধার করেন। একই সাথে কবি-কল্পনায় জীবন বিকশিত হয় সেই জড়ের শাখা প্রশাখায় বিভিন্ন রূপে রূপান্তরনের মধ্যে দিয়ে। অন্তহীন জীবনের যে বিচিত্র গতি বিচিত্র ধারায় প্রবহমান তারই পদচারণার সুস্পষ্ট উপলব্ধি কবির আত্মার অনুভূতিতে- আত্মার তেজদৃপ্ত চৈতন্যে।
সমুদ্র গর্ভে সঞ্চিত ক্লেদাক্ত পাঁকের জড় পিন্ডের ভেতর থেকে জীবনের নিগুঢ় উদ্ঘাটনকে সম্ভব ক’রে তোলা কেবল একজন কবির আত্মার অফুরন্ত সৃজনশীল শক্তির মাধ্যমেই সম্ভব। সে কারণেই কবি-সৃষ্ট কবিতার বহুদর্শিতার পাশে সীমাবদ্ধ সঙ্গীতের দর্শনশক্তি গৌন হিসেবেই বিবেচিত এবং গৃহীত হ’তে পারে। তবে এ প্রেক্ষিতে এখানে একটি প্রশ্নের উত্থানও অনিবার্য হ’য়ে ওঠে। তাহলে কি সঙ্গীতের শব্দাবলী কবিতার পদবাচ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়? অস্বীকার করবার উপায় নেই য়ে, গ্রহণযোগ্য নয়। অবশ্যই গ্রহণযোগ্য তবে কবিতাটির ওপর যখন সুরারোপ ক’রে বিভিন্ন প্রায়োগিক অনুষঙ্গের মাধ্যমে সঙ্গীতে রূপান্তরিত করা হয় তখন ওই সঙ্গীতটি একটি সীমার ফ্রেমে আবদ্ধ হ’য়ে যায় এ কারণে যে, কবিতার শাব্দিক দ্যোতনার চাইতে কবিতায় আরোপিত সুরের ঐন্দ্রজালিক মোহময়োতাই হ’য়ে ওঠে মূখ্য। কবিতা হিসেবে কবিতাটির যে আবেদন এবং আবেদনের দূরগামীতা সেটি সংকীর্ণ হ’য়ে পড়ে; সঙ্গীতের ব্যঞ্জনায় অবিকল সে কবিতাটির দূরগামী আবেদন এবং দর্শন থাকে না। যা থাকে তা হলো সুরের আবেগাচ্ছন্নতা।
যেখানে জীবনের চপলতা, গাম্ভীর্য্যতা থেকে শুরু করে সমগ্র চিন্তাশীলতা আশ্রিত বোধের পরিমন্ডলে। সেখানে যদি থেকেও থাকে সে বোধে চরম দূর্বোধ্যতা তবুও সে দূর্বোধ্যতাই কি বোধের স্বার্থকতা নয়? যদি তাই হয় তাহলে সহজেই অনুমেয় কত সুন্দর ভাবে হৃদয়ের মর্মোত্থিত নিঃসরণ ফুটিত করেছে চৈতন্যকে অসম্ভব আস্থাশীল সর্বসুন্দর কল্যাণজাত মূল্যবোধের অংকুরে। যে অংকুরের দ্যুতিমান স্পর্শন-সঞ্জাত সম্মোহন কবিতার অস্তিত্বে। কবিতা আত্মার সমর্পণে ধন্য, আত্মার মুক্তিতে দর্শন। এবং এই দর্শনেই অতি প্রসন্ন অন্তরের আর্তিতে জীবনের অন্তরবৃত্তির অসংযত আবেগ গতিশীল হ’য়ে জীবন বৃত্তিকেই লংঘন করবার বিস্ময়কর প্রয়াস পায়। জীবনের সমগ্র সত্ত¡ার অনুবিদ্ধ আকুতিই ঋদ্ধ করে অবশ্যই আত্মিক উৎসকে। যার ফলে আত্মার উত্তরণ হ’য়ে ওঠে সর্বাতীত থেকে সর্ব-ভবিষ্যতে।
এখন উদ্ধৃত গোটা আলোচনার চরিত্র বিশ্লেষণ ক’রে স্থিরচিত্ত হওয়া যায়- যে অনুভূতি অভিজ্ঞানের প্রতিনিধিত্বকারী চৈতন্যের চরম বোধ্যতা কবিতার উপাদান, যে উপাদান জীবন সমৃদ্ধ। অতএব জীবন-সমৃদ্ধ উপাদানে নির্মিত কবিতার অন্তর্লোক আত্মদর্শনের ক্ষেত্র ভূমি, আত্মলয়ের সূতিকাগার আধ্যাত্মিকতার মানসপট। এবং আত্মদর্শন সাধারণ জীবন বোধের পাশাপাশি আর এক নতুন অনন্য-সাধারণ জীবনের বহুমাত্রিক উদ্দীপন।
তাহলে নিশ্চিত ক’রে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, আত্মার অধিলৌকিক পূর্ণাঙ্গতার দর্শন সম্ভব অবশ্যই একমাত্র কবির কল্পনাগামীতার তুলি দিয়ে এক সাথে পাশাপাশিভাবে মিলিত বহুবর্ণ পটভুমির ওপর আরও বহুবিচিত্র রং দিয়ে অঙ্কিত কবিতার সমগ্রতাতেই।