আবদুল কাদির কম চেনা বড় মানুষ -ইমরান মাহফুজ
আবদুল কাদির কম চেনা বড় মানুষ -ইমরান মাহফুজ

বাংলায় এ ধরনের চচার্ বিরল। হুমায়ুন আজাদের শামসুর রাহমান বিনিমার্ণ কিংবা পিএইচডির প্রয়োজনে যেসব উদ্দেশ্যমূলক চচার্ হয়ে থাকে, তার থেকে কাদিরের নজরুল-চচার্ ও নিবেদন ভিন্নতর। আবদুল আজীজ আল আমান কিংবা আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রমুখ কাদির সমালোচক-উত্তর সময়ে সেটির স্বঘোষ উচ্চারণ অন্তত আরও একবার জরুরি বলেই মনে করি।

বাংলাসাহিত্যে কম চেনা বড় মানুষের মধ্যে অন্যতম আবদুল কাদির। তিনি একাধারে কবি, সমালোচক, গবেষক, সম্পাদক ও ছন্দবিজ্ঞানী। তার জীবন ও কমের্ বলা যায় কবিতাচচার্, ছন্দবিশ্লেষণ, সমালোচনা, গবেষণা ও সম্পাদনায় তার যোগ্যতা ছিল অসাধারণ। অত্যন্ত নিষ্ঠা ও একাগ্রতার সঙ্গে কাজ করতেন তিনি।

ঢাকা কলেজে ইন্টারমেডিয়েট পড়াকালে কলেজ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত প্রথম কবিতা ‘মুক্তি’। ‘মোহাম্মদী’-তে প্রকাশিত হয় তার কবিতা ‘হযরত মোহাম্মদ’, এটিই কাদিরের প্রথম উল্লেখযোগ্য কবিতা। বলা যায়, ছাত্রাবস্থায়ই ঢাকা এবং কলকাতার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় গদ্য-পদ্য লিখে খ্যাতি অজর্ন করেছিলেন। তার কিছুকাল পরেই ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলিম সাহিত্যে সমাজের ‘বুদ্ধিরমুক্তি’ আন্দোলন। কাজী আবদুল ওদুদ ও আবুল হোসেনের নেতৃত্বে পরিচালিত এই আন্দোলনের একনিষ্ঠ সংগঠক ও কমীর্ ছিলেন আবদুল কাদির। যার ফলে অদম্য সাহস আর কমোর্দ্যামে এগিয়ে যান সামনে।

পরে দেখা যায়, গবেষক হিসেবে আবদুল কাদিরের নিষ্ঠা ও যোগ্যতার পরিচয় পাওয়া যায় নজরুল, আবুল হুসেন, ইমদাদুল হক, লুৎফর রহমান, সিরাজী, রোকেয়া রচনাবলি সম্পাদনাসহ ব্যতিক্রম কাজ ও আলোচনায়। তার ছন্দ-সমীক্ষণ, মতিউর রহমান বক্তৃতামালারূপে প্রদত্ত বাংলা ছন্দের ইতিবৃত্ত ও আধুনিক কবিতার ছন্দÑ এই গ্রন্থগুলো ছন্দ বিষয়ে আবদুল কাদিরের অধ্যয়ন ও প্রজ্ঞার স্বাক্ষর উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া তার ছন্দ-কৃতিত্বের জন্য রবীন্দ্রনাথের অকুণ্ঠ প্রশংসা অজর্ন করেছিলেন। তিনি যে শুধু একজন ছন্দকৃতী কবি তা নয়, সুদক্ষ ছান্দসিক হিসেবেও তার স্থান সবোর্চ্চ পযাের্য়। বস্তুত উভয় বাংলায় তার সমকক্ষ কৃতী ছান্দসিক অতি বিরল। জনশ্রæতি আছে ছন্দ-রচনা ও ছন্দ-বিশ্লেষণ, এই উভয় ক্ষেত্রে সমান দক্ষতার বিচারে সত্যেন্দ্রনাথের পরেই তার স্থান।

আর কবিতা নিয়ে কবি জসীমউদ্দীনের কথাটি বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য : “কবি আবদুল কাদিরের ভাষার গঁাথুনি যে-কোনো ভালো কবির অনুসরণীয়। ভাষার সুকঠোর বঁাধুনির অন্তরালে কবি তঁার কাব্যখানি লুকাইয়া রাখেন, যঁাহারা এই বমর্ ভাঙ্গিয়া ভিতরে প্রবেশ করিতে পারিবেন তঁাহারা কবির কাব্য মুশায়েরার রঙ্গিন বাতিটির আলোকে উদ্ভাসিত হইবেন এ-বিষয়ে সন্দেহ নাই।”

আবদুল কাদির রেজাউল করিমের সঙ্গে ‘কাব্য-মালঞ্চ (১৯৪৫)’ সম্পাদনায় সংকলিত প্রবন্ধে লিখেন : ‘বাঙ্গলার মুসলমান-সমাজে ওহাবী আন্দোলনের প্রভাব, আলীগড়-আন্দোলনের প্রভাব ও কামাল-পন্থীদের প্রভাব যে ভাবে নানা প্রতিক্রিয়ার সূচনা করে, সে সম্বন্ধে সচেতন হওয়া আমাদের বহু অতি-আধুনিক লেখক বিশেষ প্রয়োজন মনে করেন না। ঐতিহ্যের জন্য কিছুমাত্র পরোয়া না করিয়া অধুনা ইহাদের কেহ কেহ মাক্সীর্য় গঁাথা বা পাকিস্তানি পুঁথি রচনার জন্য উদ্দীপিত হইতেছেন। মাত্রাহীন উন্মাদনা এবং আত্মবিশ্বাসের অভাব দুই-ই মারাত্মক।”

বাঙালি, বিশেষত বাঙালি মুসলমানকে ক্রিয়াশীলরূপে উপস্থাপন কঠিন, বরং ঐতিহাসিক পযাের্লাচনায় এর তুমুল প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রটি পরিষ্কার বলে মনে হয়েছে। বিশেষত বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের সন্ধান, তার যাত্রা, এমনকি বাঙালি মুসলমানের একটি স্বাধীন দেশের অন্বেষাও সে প্রতিক্রিয়াশীলতার অংশ।

উল্লিখিত লেখাটি কিন্তু ‘প্রতিক্রিয়াশীলতা’ নয়, বরং প্রতিক্রিয়া ও সত্য উচ্চারণ। এর সত্যটিকে আমরা ‘প্রতিক্রিয়াশীলতা’র গভের্ জন্ম নেয়া ‘সৃষ্টিশীলতা’র শাখা হিসেবে দেখি। ১৯১১ সালের ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’কে যদি বঙ্গীয় প্রতিক্রিয়াশীলতার প্রথম বৃক্ষ হিসেবে ধরে নেয়া যায়, তবে ১৯২৬ সালের ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ ও ১৯৪২ সালের ‘বঙ্গীয় মুসলিম রেনেসঁা সোসাইটি’ সে বৃক্ষের দুটি শাখা। দেখা যায় বাংলায় ‘সৃষ্টিশীলতা’, ‘মুক্তচিন্তা’ কখনই মুক্ত হয়ে উঠতে পারেনি। বরং প্রগতির মুখোশে উনিশ শতকীয় ধমাের্ন্দালনের অনুক‚ল হাওয়ায় ব্রাহ্মণ ও মোল্লাদের রাষ্ট্রচিন্তা ‘মাত্রাহীন উন্মাদনা’ তো বটেই ভ‚খবহিভূর্ত ওয়াহাবী ও আলিগড়ের সঙ্গে ‘কামাল পন্থা’রও নয়, প্রতিযোগিতা গড়ে উঠছে ‘খেলাফতি মাতলামো’র, মুসলিম জাতীয়তাবাদ। আর তাতে চাপা পড়েছে বুদ্ধিবৃত্তি, মুক্তচিন্তা এমনকি শুদ্ধ করে বাংলাদেশের স্বাথির্চন্তাও!

প্রসঙ্গে অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের কথা মনে করি ‘বাঙালি মুসলমানের সমাজ সচেতনতা আর রাজনৈতিক সচেতনতা সমান্তরাল নয়। পাকিস্তান আন্দোলন, স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠায় বাঙালি মুসলমান সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণির যে তাৎপযর্পূণর্ ভ‚মিকা, সংস্কারে বা আধুনিক সমাজ গঠনে তা পরিলক্ষিত হয় না। বাঙালি মুসলমান সমাজে বেগম রোকেয়া, কাজী নজরুল ইসলাম, সৈয়দ আবুল হুসেন বা কাজী আব্দুল ওদুদের উত্তরসূরি নেই বললেই চলে। এ সমাজের বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরা পযর্ন্ত সামাজিক সমস্যাগুলোকে এড়িয়ে যান ধমর্ব্যবসায়ীদের ভয়ে। তাই বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে এসেও সমাজ প্রগতি দূরাগত স্বপ্ন মাত্র। বস্তুত রাষ্ট্রবিপ্লবের চেয়ে সমাজবিপ্লব দুরূহ; মুসলমান প্রধান দেশগুলোর মধ্যে তুরস্ক ছাড়া আর কোথাও রাষ্ট্রবিপ্লবের পরপর সমাজবিপ্লব ঘটেনি কারণ আর কোনো দেশে মোস্তফা কামাল আতাতুকের্র মতো আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়কের আবিভার্ব ঘটেনি।’

বস্তুত, রুটি ও রাষ্ট্রের চিন্তায় দিন কাটানো বাঙালি, ব্রাহ্মণ ও বাঙালির নেতারা বোধ করি এখনো ‘সমাজ প্রগতি’র প্রয়োজনীয়তা ও পদ্ধতি সম্পকের্ ভেবে উঠতে পারেনি। বাঙালির লড়াই ও অজের্ন বুদ্ধিবৃত্তি একেবারে অনুপস্থিত ছিল। কিন্তু সে যাকে বলে ‘রুধির ধারার মতো’। আবার দৃশ্যত বুদ্ধিবৃত্তিক নয়, বরং নিছক প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত অনেক সময়ই বাংলার সমাজচিন্তনকে, সমাজসংঘটনকে প্রভাবিত করেছে। বলা চলে ইতিহাসের গতিপথ নিধার্রণ করে দিয়েছে।

আমরা জানি, জাতি নিমাের্ণর সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সে ক্ষেত্রে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভাষা, ধমর্, সমাজচিন্তন-প্রশ্নহীনভাবে কেন্দ্রীয় সাম্প্রদায়িকতা, বণর্বাদ, মেরুকরণ দূরীকরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ভিন্নমত, ভিন্নরূপ, ধমর্চচার্ সমাজেরই অংশ। এখানে বিরোধী বা ব্যতিক্রম বলে কিছু নেই। একটি অসাম্প্রদায়িক জাতি নিমাের্ণ সমাজ প্রগতি অবশ্য প্রয়োজনীয় আর সমাজ প্রগতির জন্য ওয়াহাবী, আলিগড়, মুসলিম রেনেসঁা নয়, বাংলার বহুবণর্ সমাজের প্রতিনিধিত্বের সঙ্গে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ চচির্ত সমাজচিন্তন ১৯২৬-এর চেয়ে ২০১৭ সালে বেশি প্রাসঙ্গিক। সে প্রাসঙ্গিকতাই আবদুল কাদিরের চেতনা, জীবনবোধ ও কমর্ আমাদের সামনে একটি আলোকবতির্কাস্বরূপ। প্রাত্যহিক কাজের হিসেবে দেখা যায়, কঠোর পরিশ্রমী ও দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন লেখক ছিলেন আবদুল কাদির। এ বক্তব্যের নিঃসন্দেহ পরিচয় রয়েছে তার প্রতিটি সাহিত্যকমের্। মৃত্যুর মাত্র কয়েক বছর আগে বাংলাদেশের সাহিত্যের সমস্যা ও সম্ভাবনা সম্পকের্ তিনি বলেছেন :‘একটা দেশের সাহিত্য বিশ্ববাসীর শ্রদ্ধা আকষর্ণ করে অসামান্য সৃষ্টিধর প্রতিভার বিপুল অবদানে সমৃদ্ধ হয়ে। বতর্মানে এদেশের সাহিত্য-উদ্যানে অনেক সুগন্ধ পুষ্পবৃক্ষের সাক্ষাৎ মিললেও বিরাট বনস্পতির উদগম দেখা যাচ্ছে না। তবে নতুন প্রতিশ্রæতিশীল লেখকদের অনলস পদচারণা মনে আশার উদ্রেক করে। এই উন্নয়নশীল দেশের মানুষের জীবন আজ বহু সমস্যায় ও দ্বদ্ধে বিপযর্স্ত এবং অস্থির। এই বিপযর্য় ও অস্থিরতা দূরীভ‚ত হয়ে সমাজে যদি আসে স্বস্তি ও স্থিতিশীলতা; জনমনে যদি আসে ভারসাম্য, তা হলে কোনো সমস্যার সমাধানই জনসাধারণের অসাধ্য থাকবে না এবং শিল্প-সাহিত্যে নতুন সম্ভাবনার পথ হবে অবধারিত ও বিচিত্রমুখী।’ (শামসুজ্জামান খান কৃত সাক্ষাৎকার, মে ১৯৭৯)

যে সময়ে আবদুল কাদিরের বেড়ে ওঠা, সে সমকালের প্রয়োজন ও জোয়ারের পাশাপাশি ‘রুধির ধারা’টি লক্ষ্য করার মতো। তাছাড়া যে সম্প্রদায়টির তিনি প্রতিনিধিত্ব করতেন, তা ছিল পিছিয়ে পড়া, উল্টো পথের যাত্রী। এবং তারা ছিল চরম সাম্প্রদায়িক, বিভক্তি ও অসাম্যের প্রতিভ‚। যে রাজনীতিটি মূলধারা হিসেবে পরিগণিত ছিল তা ছিল হুজুগ, খেলাফতি মাতলামো পরবতীর্ অবসাদ ও ভ‚খ বহিভ‚র্ত শক্তিনিয়ন্ত্রিত। কিন্তু তার প্রবণতা ছিল মুক্তাকাশে ওড়ার শক্তি যাচাইয়ে দিলখোলা, দৃষ্টি প্রসারিত। ‘সওগাত’, ‘নবযুগ’-এর সঙ্গে কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল হুসেন, মুজাফ্ফর আহমদসহ নজরুলের সঙ্গ তার চিন্তনকে পাখনা দিয়েছিল সন্দেহ নেই। ফলত তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি মুক্তি লাভ করেছিল সেকালেই। শুধু যে তিনি ‘প্রতিক্রিয়া সম্পকের্ সচেতন’ ছিলেন, তা-ই নয়, তার ‘জয়তী’তে জাতি, সাম্প্রদায়িকতা, জাতীয়তা, জাতীয় রাষ্ট্র, রাষ্ট্রীয় স্বাতন্ত্র্য, জাত ও জাতির প্রশ্ন, হিন্দু-মুসলমান যুদ্ধ, স্বাদেশিকতা ও মুসলমান, স্বাধীনতা আন্দোলন, এমনকি ‘সওগাত’ ও ‘সম্মিলনী’ প্রভৃতি সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা খেয়াল করলে বোঝা যায়, তিনি তৎকালীন বিতকির্ত বিষয়গুলো সম্পকের্ কতটা নিমোর্হ থাকতে পেরেছিলেন। তার পরিণত বয়সের ‘মুসলিম রেনেসঁা’র তুমুল আকষর্ণ থেকে নিজেকে বিযুক্ত রাখতে পেরেছিলেন। তার প্রায় শতবষর্ পুরনো প্রতিটি চিন্তা আজও কী ভীষণভাবে সমকালীন নয়! আজকের বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সমস্যাগুলো একটু তলিয়ে ও আবদুল কাদিরের ‘পঁাজি’র সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে যে ওই চরম সাম্প্রদায়িককালে আবদুল কাদির যা ভাবতেন, তা স্বপ্ন দেখার সাহস রাখেন না প্রায় শতবষর্ পরের রাষ্ট্রনায়কেরা।

‘সওগাত’ থেকে নিজস্ব ‘জয়তী’ হয়ে ‘মাহে নও’ পযর্ন্ত পত্রিকা সম্পাদনার দীঘর্ যাত্রায় তিনি যে অপরাপর ঐতিহাসিক কতর্ব্য ভুলে যাননি, তার পবর্তপ্রমাণ সিরাজী রচনাবলি সম্পাদনা, কাজী ইমদাদুল হক রচনাবলি সম্পাদনা, ডা. লুৎফর রহমান রচনাবলি সম্পাদনা, রোকেয়া রচনাবলি সম্পাদনা, লোকায়ত সাহিত্য সংকলন ও সম্পাদনা, বাংলা সনেট সংকলন ছাড়াও ৮০টির মতো ছন্দবিষয়ক প্রবন্ধ রচনা, বাংলা ছন্দের ইতিবৃত্ত, ‘ছন্দ-সমীক্ষণ’ প্রভৃতি কমপক্ষে তিনটি ছন্দবিষয়ক গ্রন্থরচনা, নজরুল রচনা সংগ্রহ (১ম-৫ম খ), নজরুল-স্বরলিপি সংকলন। আজকের যে নজরুল ইসলামকে আমরা জানি, সে জানার অনেকখানি তার বিনিমার্ণ। নজরুল-সখা শৈলেন্দ্র কিংবা কাজী আবদুল ওদুদের বিচ্ছিন্ন প্রয়াসের বাইরে তিনিই নজরুল-চচার্র পথিকৃৎ, সে কথা এ সংখ্যার লেখাগুলো পাঠ করলে কিংবা নজরুল-বিশেষজ্ঞ যে কারোর লেখা পাঠ করলেই বোঝা যাবে।

বাংলায় এ ধরনের চচার্ বিরল। হুমায়ুন আজাদের শামসুর রাহমান বিনিমার্ণ কিংবা পিএইচডির প্রয়োজনে যেসব উদ্দেশ্যমূলক চচার্ হয়ে থাকে, তার থেকে কাদিরের নজরুল-চচার্ ও নিবেদন ভিন্নতর। আবদুল আজীজ আল আমান কিংবা আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রমুখ কাদির সমালোচক-উত্তর সময়ে সেটির স্বঘোষ উচ্চারণ অন্তত আরও একবার জরুরি বলেই মনে করি। পাশাপাশি মধুসূদনের সময় থেকেই বাংলার ঐতিহ্যবাহী ছন্দচিন্তন ও চচার্র পাশাপাশি বিদ্রোহের, নতুনের যে ঝা উচ্চকিত; একই সঙ্গে কলকাতাকেন্দ্রিক চচার্র বৃত্তের বাইরে থেকে বাংলা ছন্দের ভেতর-বাহির এমন দশের্নরও যে তিনি পথিকৃৎ, আজকের প্রজন্ম সে সম্পকের্ অনবহিত তো বটেই, তার ছন্দ-ধারণার সঙ্গেই পরিচিত নয়। ছন্দচচার্র ইতিহাস সম্পকের্ আবদুল কাদিরের অধ্যয়ন ও জ্ঞান ছিল বেশি ব্যাপক ও গভীর। ছন্দ-সমীক্ষণ গ্রন্থে ছন্দবিজ্ঞানের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের একটি তথ্যনিভর্র বিবরণ দিতে গিয়ে অষ্টম শতকের আরবি ছন্দ-বিশারদ খলিল বিন আহমদের ইলম্ অল্ আরুজ ও খলিল বিন্ আহমদের কথা উল্লেখ করেছেন আবদুল কাদির। বলা যায় বিশের দশকে কবিতায় যাত্রা শুরু করে আশির দশকে চলে যাওয়ার পূবর্মুহূতর্ পযর্ন্ত দীঘর্ ছয় দশক জীবন সমপির্ত কবিতাকমীর্, যিনি সারা জীবন মাত্র দুটি কাব্যরচনা করেন, এমন দুলভর্ কবির প্রতি শ্রদ্ধাঘর্ নিবেদন অবশ্যই করতে হয়। প্রসঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মন্তব্যটি এরকম “কাব্যসাহিত্য সম্বন্ধে তোমার আজীবন রসবোধ একেবারে চিত্তগত। তোমার কবিমন আজও অক্ষুণ এবং অব্যাহত রয়েছে। তুমি বাঙালী লেখকের গবের্র বস্তু।...যে-কাজ তুমি নিয়েছ এ তোমারই উপযুক্ত। তুমি সাফল্য লাভ করলে বাঙালীমাত্রই উপকৃত হবে।” সবোর্পরি আবদুল কাদিরের জীবন ও কমর্ বিশ্লেষণে বলা যায়, দেশের যে আথর্-সামাজিক অস্থিরতা দেশবিভাগের আগ থেকেই বিরাজ করছে, ভারত ভেঙে পাকিস্তান-বাংলাদেশ হলেও সামাজিক অবকাঠমো পরিবতর্ন হলে ছাড়া মানবিক উন্নয়ন কারোরই হয়নি। আর এই সঙ্কট দূর না হলে শিল্প-সাহিত্যের স্বাভাবিক বিকাশ সম্ভব হবে না একথা তিনি বিশ্বাস করতেন। আমৃত্যু সাধনাও করেছেন এই সামাজিক অস্থিরতা ও বিপযর্য় থেকে মুক্তির লক্ষ্যেই। মৃত্যুর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পূবের্ লিখিত কবিতায় তিনি বলেছেন, ‘অজস্র সংকট মাঝে গত প্রায় পঞ্চাশ বছর/ ভাবিয়াছি; আমরণ জ্ঞানের অন্বেষা এ জীবন’ এই সংকট থেকে মুক্তির লক্ষ্যেই তিনি আজীবন জ্ঞানের সাধনা করেছেন। কারণ তিনি জানতেন, এবং বিশ্বাস করতেন যে, ‘জ্ঞানই মুক্তি।’ যৌবনের প্রারম্ভেই তিনি যে আদশের্র আন্দোলন শুরু করেছিলেন তারও লক্ষ্য ছিল একটাই সংকট মুক্তি। মৃত্যুর পূবর্ মুহূতর্ পযর্ন্ত সে আদশর্ থেকে তিনি বিচ্যুত হননি। আমরা অসামান্য চিন্তকের জীবনকে জেনে নিজেরাই উপকৃত হতে পারি।


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান