কবি : আবদুল হাসিব
নিশিতের খুলা জানালা
সারা দিন জানালাটি বন্ধ থাকে;
খুলা থাকলে তরুণ ছেলেদের
হাঁটতে দেখে বুকে প্রচন্ড কষ্ট হয়।
সন্ধ্যায় পৃথিবীর গাঁ গুলো
আধারে ডুবে যায় যখন
জানালার কপাট খুলা হয় তখন,
মায়ের প্রতিক্ষিত চোখ দৃষ্টির সীমানায়
অপলক অধীর ব্যাকুল
যদি বা তার ছেলে উঠে আসে ঐ পথে!
বুকের ভিতর আর্তনাদ
চোখের পাতায় টলমলে জল
ঝাপসা ছোখে ভেসে উঠে ছেলের অগণিত স্মৃতি;
রাতের অন্ধকার বিদীর্ণ করে
পূর্বাচলে উঠে চাঁদ মাটির মায়ায়
উদ্ভাসিত আলোয় ভরে যায় রাতের
মায়াবী শরীর আর খুলা জানালাটি ।
অসহ্য যন্ত্রণাময় তীব্র প্রতিক্ষিত রাত
শেষান্তে বয়বৃদ্ধ হয় যখন,
পুত্র শোকাবিভুত মায়ের কান্না
রাতের স্তব্ধতাকে মুখরিত করে দেয় তখন;
অশান্ত সমুদ্রসম অস্থির সেই মা
অভিশ্রান্ত কাঁদে আর তার কন্ঠে কষ্টের ভিতর
উচ্চারিত হয়,
সেই যে একাত্তোরে সাতই মার্চের মধ্য দুপুরে
মহান পুরুষটির উদার্ত আহ্বানে
আমার ছেলেটি গেল ঘর থেকে চলে
আর এলো না, এখনও এলো না।
পশ্চিম দিগন্ত চুমে অস্ত গেল
কত আরক্তিম সূর্য; কত পূর্ণিমার চাঁদ,
স্বাধীনতার আটচল্লিশ বছর পূর্ণ হলো; এরই মধ্যে
কত মানুষ কত ভাবে স্বাধীনতার নিল সাধ,
কেবল আমারই জন্যে হে স্বাধীনতা,
রয়ে গেলে নির্মম বিষাদ; রয়ে গেলে
নিশিতের খুলা জানালায় পথ চেয়ে থাকা।
স্বাধীনতা জ্বল জ্বল করে উঠেছিল
ছাব্বিশে মার্চের কালো রাত
স্তব্ধতার বুক বিদীর্ণ মানুষের ভয়ার্ত আর্তনাদ!
অলিতে গলিতে অগণিত লাশ
পিচঢালা কালো পথে রক্তেস্রোত
ধর্ষিতার কন্ঠছিড়ে আসা অসহায় চিৎকার
মা-বোনদের ক্ষত-বিক্ষত বিবস্ত্র শরীর
আর কঁচি শিশুর ব্যানেট বিদ্ধ নগ্ন বুক থেকে
তপ্ত রক্ত যখন ঝরছে
ঠিক তখনই সেই রক্ত ছুঁয়ে
মাতৃমৃত্তিকার পবিত্রতা রক্ষা আর
প্রিয় প্রত্যাশিত স্বাধীনতা আনবার জন্যে
সে দিন হিমাদ্রি কঠিন প্রতিজ্ঞা ছিল আমাদের।
সূর্যসেন, তিতোমীর, সালাম, রফিক,
বরকত আর জব্বারের রক্তের অস্থিত্ব
সে দিন আগ্নেয়গিরির অগ্নোৎপাতের মতই
জ্বলে জ্বলে উঠেছিল বাঙালী সত্তায়।
আমাদের সর্বস্ব নিয়ে মত্ত-মাদল রোষে
শত্রু নিধনে পাগল ছিলাম কাল-বৈশাখী বেগে।
জাতি ধর্ম গোত্র নির্বিশেষে, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে
দু’লক্ষ মা-বোনের ইজ্জত হারানোর
করুণ কান্নায় বাংলার বাতাস ভারি করে
ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তে তেরশো নদী প্লাবিত করে
পেয়েছিলাম আমাদের কাঙ্খিত স্বাধীনতা;
আমরা পেয়েছিলাম রক্তমাখা প্রাণের প্রিয় পতাকা।
বিজয়ের উচ্ছ্বসিত আনন্দের উর্মিমালা
সে দিন বাঙ্গালীর অস্তিত্বে
উন্মাতাল হয়েছিল অসম্ভব বিস্ময়কর শক্তিতে।
বিধবা বধুদের চোখের জল
সে দিন স্বাধীনতার সূর্য-রশ্মিতে হীরের টুকরোর মত
জ্বল জ্বল করছিল; স্বাধীনতাকে পেয়ে তারা যেন কিছুই হারায়নি।
সন্তানহারা মায়ের চোখ
জলে ভরে গেলেও জ্যোৎস্নায় হরিণের চোখের মত
ঝিক্মিক করে ওঠেছিলো
স্বাধীনতার মহানন্দে সে দিন।