আল মাহমুদ
জামায়াত এমন এক ট্রিকি সংগঠন- যা করার জন্য অনেককে প্রাণ দিতে হয়েছে, না করার জন্যও অনেককে।
এ দেশের স্বাধিকার আন্দোলনে যেমন তারা ঘাতকের পক্ষে ছিল; আবার স্বাধীনতার পরে কেউ তাদের সাথে নিয়ে ক্ষমতায় ছিল, কেউ তাদের বিরোধিতার কথা বলে ক্ষমতায় থাকতে চায়।
খুব কম কবি-সাহিত্যিকের পাছ ছেড়েছে এই বিতর্কিত দলটি; এক শ্রেণির উন্মূল বজ্জাত কবি-সাহিত্যিক আড়ালে-আবডালে এই প্রচার জারি রাখতে চেয়েছে সর্বদা; কারো কারো গায়ে নাকি রয়েছে এর গন্ধ। কারণ জামায়াত খুব লাভজনক ব্যবসায়, এ কথা বললে সাতখুন মাফ; কাউকে আর তার যোগ্যতা, কর্ম ও সততার পরীক্ষা দিতে হয় না। এক কথায় অন্যের সকল কীর্তি ধূলিসাৎ করে দেয়া যায়। তখন বিশ্বকর্মার চেয়ে অকর্মা বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকে।
বিশ শতকের বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী কবি আল মাহমুদ জামায়াতের সার্থক শিকার। জামায়াতের মতো একটা দলের আল মাহমুদের মতো একজন কবির প্রয়োজন কেবল কৌশলগত কারণে। সোনালি কাবিন লেখার জন্য যদি আল মাহমুদ গুরুত্বপূর্ণ কবি হয়ে থাকেন- তাহলে এই কাব্য দিয়ে জামায়াতে ইসলাম কি করবে। জামায়াতে ইসলামী যে ধরনের রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখে আল মাহমুদের অধিকাংশ কবিতা সেখানে শয়তানের কাব্য হিসাবে বিবেচিত হবে। তবে আল মাহমুদ যতটা জামায়াত করেছে তার সমকালীন এদেশের অধিকাংশ কবি-সাহিত্যিক ততটাই কুতর্কে বিদ্ধ হয়েছে।
সাহিত্যের একটা নোংরা রাজনীতি আছে, বিশেষ করে কবিদের মধ্যে। একটা কবিতার লেখকও একশো কবিতার লেখক চেয়ে বেশি, কিংবা নিকৃষ্ট কাব্যের লেখকও উৎকৃষ্ট কাব্যের লেখকের মতো সমীহ পেতে চায়; আর এই না-পাওয়ার যন্ত্রণায় তাদের ঈর্ষাতুর অপপ্রচারকারীতে পরিণত করে। কিন্তু তারা একবারও ভেবে দেখে না- সংঘ ও শক্তির মুখপাত্র হওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো কৃতিত্ব নেই। এদের অধিকাংশ জামায়াত ক্ষমতায় থাকলে প্রতিযোগিতায় রোকন হতো- এমনকি ধর্ম আলাদা হলেও।
কবিতায় আজ জামায়াতের পাপ আদিপাপে রূপ নিয়েছে- কবি ও রাজনীতিবিদরা এই পাপ থেকে পুরো মুক্ত নয়। কোনো দল জামায়াতকে কোলে তুলে নেবে এই ভয়ে অন্যদল কোল থেকে নামাতে রাজি নয়। জামায়াতও সিন্দাবাদের ভুতের মতো কোলে কোলে আছে মহাসুখে। আল মাহমুদ অনেকবার ইনিয়ে বিনিয়ে চেষ্টা করেছেন- তিনি বুঝেসুঝে কখনো জামায়াতের সঙ্গে ছিলেন না। এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে জামায়াতকে ব্যবহার করেছেন- আল মাহমুদ তারচেয়ে বেশি করেছেন বলে মনে হয় না। কারণ ভালোবাসা যৌনতা ফেলে-আসা সহজ সরল গ্রামীণ জীবন অল্প-স্বল্প সাম্যের কথা বলা- জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যায় না। অর্থাৎ তিনি নিজের রাজনীতি অক্ষুন্ন রেখেই জামায়াতের সমর্থন ব্যবহার করেছেন নিজের প্রয়োজনে। যেমন কবি সাহিত্যিকদের অনেকেই জীবনভর নয়া-দিগন্ত ইনকিলাবে লিখে চাকরি করে জামায়াত বিরোধী থেকেছেন; আল মাহমুদের জামায়াত ব্যবহারের ধরণ অনেকটা তেমনই- তবে প্রকট। কবিতা নির্মাণে দক্ষতা থাকলেও রাজনৈতিক কূট-কৌশলে তিনি অজ্ঞ।
জামায়াত করার কারণে আল মাহমুদের বিরোধিতা অনেকটা কালের বিরোধিতা। তাকে অস্পৃশ্য রেখেও তার কাব্যপাঠে কেউ বিরোধ করছে বলে মনে হয় না। খনার জিভ কেটে দিলেও তার অমৃত-বচন সর্বকালে অম্লান, ঈশপকে পাহাড় থেকে ফেলে দিলেও তার গল্পের শিক্ষা নিতে বাধা নেই। বাণীর দুলালদের কালে হত্যা করলেও তার বাণীর গুরুত্ব কমে যায় না। বরং তার যাতনার তীব্রতার সঙ্গে শিল্প থেকে খাদগুলো ঝরে পড়ে।
কে তাকে দয়া দেখাল আর ক দেখাল না- তাতে আল মাহমুদের কবিতার কিচ্ছু আসে যায় না। তার তথাকথিত রাজনৈতিক বিশ্বাসের বিরোধীরা যেমন ব্যক্তি-কবিকে উপেক্ষা করেছে; ঠিক একই পাপ করেছে জামায়াতে ইসলাম- তারা বলতে পারেনি- আল মাহমুদ আমাদের কবি নন। তাদের কবি গলায় গুঞ্জার মালো পরে বাউলের বিধবার সঙ্গে যায় না।
আমি নিঃসন্দেহে প্রভুর কাছে প্রার্থনা করব না- আল মাহমুদ এই স্বজনহীন সংসারে আরো বেঁচে থাকুন- মিথ্যাবাদি পক্ষগুলোর মাঝখানে আরো কষ্ট পান। বাংলা মায়ের জন্য তার তো আর কিছু দেয়ার নেই; আর তার সাহিত্য ঝুলিতে এমন কোনো মোহর নেই যে, তাঁর মৃত্যুর পরেও জামায়াত রাজনীতিতে ব্যবহার করতে পারবে। তখনই তিনি হয়ে উঠবেন- খাঁটি বাঙালি কবি।
মজিদ মাহমুদ: কবি ও লেখক