THE POETIC THOUGHTS t IN THE PERSPECTIVE OF PHILLOSOPHIC MAGNITUDE
দ্বিধাদীর্ণ চিত্তসত্তা ঋদ্ধ মননের প্রকীর্ণতাকে মৃত্যুত্তীর্ণ করে স্বীয় সত্তায় শ্রদ্ধাশীলতার প্রশ্নে বিশ্বাসী থাকতে পারে না বিশেষ করে। যেহেতু দ্বিধা প্রথম অর্থেই দুর্বলতার রূপান্তরন এবং দুর্বলতা সর্বক্রমেই সন্দেহপ্রবণ আর তাকে অন্তরায়তনে আশ্রয় দান সত্তার নির্লজ্জ্ব কাপুরুষতা। সাহিত্যকে কেন্দ্র করে এর প্রাসঙ্গিকী নির্মাণ করা সম্ভব হতে পারে। এ প্রসঙ্গেই বিবেচনা করা যাকÑ
০১.
‘এসব কবিতা আমি যখন লিখেছি বসে নিজ মনে একা;
চালতার পাতা থেকে টুপ টুপ জ্যোৎন্সায় ঝরেছে শিশির;
কুয়াশায় স্থির হয়েছিল স্নান ধান সিঁড়িটির তীর;
বাদুড় আঁধারে ডানা মেলে হিম জ্যোৎন্সায় কাটিয়াছে রেখা
আকাক্সক্ষায়; নিভু দ্বীপ আগলায়ে মনোরমা দিয়ে গেছে দেখা
সঙ্গে তার কবেকার মৌমাছির------কিশোরীর ভীড়
আমের বউল দিল শীত রাতে; আনিল অতীব হিম ক্ষীর;
মলিন আমি তাহাদের দেখিলাম , এ কবিতা লেখা
তাহাদের স্নান চুল মনে ক’রে; তাহাদের কড়ির মতন
ধূসর হাতের রূপ মনে করে; তাহাদের হৃদয়ের তরে।
সে কত শতাব্দী আগে তাহাদের করুণ শঙ্খের মতো স্তন
তাহাদের হলুদ শাড়ী ক্ষীর দেহ তাহাদের অপরূপ মন
চলে গেছে পৃথিবীর সব চেয়ে শান্ত হিম সান্ত¦নার ঘরেঃ
আমার বিষন্ন স্বপ্নে থেকে থেকে তাহাদের ঘুম ভেঙে পড়ে।’
এসব কবিতা আমিঃ জীবনানন্দ দাশ।
অথবা
০২.
‘একদিন মনে হতো জলের মতন তুমি।
সকাল বেলার রোদে তোমার মুখের থেকে বিভা
অথবা দুপুর বেলা বিকেলের আসন্ন আলোয়
চেয়ে আছে চলে যায় জলের প্রতিভা।
মনে হতো তীরের উপরে বসে থেকে।
আবিষ্ট পুকুর থেকে সিঙ্গারার ফল
কেউ কেউ তুলে নিয়ে চলে গেলে নিচে
তোমার মুখের মতন অবিকল
নির্জন জলের রং তাকায়ে রয়েছে;
স্থানান্তরিত হয়ে দিবসের আলোর ভিতরে
নিজের মুখের ঠান্ডা জলরেখা নিয়ে
পুনরায় শ্যাম পরগাছা সৃষ্টি করে;
এক পৃথিবীর রক্ত নিপতিত হয়ে গেছে জেনে
এক পৃথিবীর আলো সব দিকে নিভে যায় ব’লে
রঙিন সাপকে তার বুকের ভেতরে টেনে নেয়;
অপরাহ্নে আকাশের রং ফিকে হলে ।
তোমার বুকের ’পরে আমাদের পৃথিবীর অমোঘ সকাল ;
তোমার বুকের ’পরে আমাদের বিকেলের রক্তিম বিন্যাস;
তোমার বুকের ’পরে আমাদের পৃথিবীর রাত:
নদীর সাপিনী, লতা, বিলীন বিশ্বাস।’
তোমাকেঃ জীবনাননদ দাশ।
এ কবিতা দুটোর কথা। প্রথম কবিতাটির সম্পূর্ণ শরীর মিলিয়েই যেন স্রোষ্টার সচলমান কল্পনার অমিত শক্তিশালী দয়িতার এক স্বপ্ন প্রচ্ছন্ন অথচ স্পষ্ট বিজড়ন। ‘নিভু দ্বীপ আগলায়ে মনোরমা দিয়ে গেছে দেখা’ যেন কল্পনার রক্তে হঠাৎ সমুদ্র পাতের মতো । আবার ‘সে কত শতাব্দী আগে তাহাদের করুন শঙ্খের মতো স্তন, তাহাদের হলুদ শাড়ী- ক্ষীর দেহ তাহাদের অপরূপ মন’ স্রষ্টাকে যেন ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সুদূর স্বপ্নলোকের গভীর অতলান্তে- যে কল্পলোকে স্বচ্ছন্দ বিচরণ করেই তিনি কল্পনা করতে পেরেছেন ‘ করুণ শঙ্খের মতো স্তন।’ কেননা শঙ্খের রং সাধারণতঃ শুভ্রই হয়ে থাকে এবং শুভ্র রংটিকে ক্ষেত্র বিশেষে করুণতার প্রতীক হিসেবেও বিবেচনা করা হয়ে থাকে। কবি সম্ভবতঃ এ কারণেই তাঁর নিজের কল্পনার অনুভবে তার পরম আরাধ্য স্তন দু’টিকে সফেদ শঙ্খের করুণতার সাথে তুলিত করতে চেয়েছেন এ কারণে যে, স্তন দু’টি কবির সান্নিধ্য কামনা করলেও কাছে আসবার সামর্থ্য হয়তো সেই মুহূর্তে তাদের ছিল না।
দ্বিতীয় কবিতাটিতে এ কল্পনাস্রোত আরো দূর্বার, অপ্রতিহত। ’সকাল বেলার রোদে তোমার মুখের বিভা’ অথবা ‘ দুপুর বেলা বিকেলের আসন্ন আলোয় চেয়ে আছে, চলে যায় জলের প্রতিভা । এ জলের প্রতিভা যাকে স্রষ্টা সুতীব্র অনুভূতি দিয়ে অবলোকন করেছেন- ‘তীরের উপরে বসে থেকে’ - নির্মল জলের মতো স্বচ্ছ তার একান্ত মনের মনিকোঠায়- সে যেন আর কেউই নয় তার একমাত্র অনুপম দয়িতা ছাড়া। আবার ‘ অপরাহ্নে আকাশের রং ফিকে হলে- রঙীন সাপকে তার বুকের ভেতরে টেনে নেয়’এ যেন তার নিজেরই অসম্ভব সকরুন অসহায় অন্তরার্তির ফুটিত রূপ। যেখানে ‘এক পৃথিবীর আলো নিভে যায়’ বলে সে নিভন্ত আলোর অস্বচ্ছতায় তার কল্পিত দয়িতার অস্তিত্ব ( নিজের মতো করে) ‘বিলীন বিশ্বাসের’ মতো সমর্পিত হয়ে যায় রাতের অন্তরে বলে স্রষ্টা ক্রন্দিত হয়েছেন অনায়াসেই। অথচ আবারÑ ‘স্থানান্তরিত দিবসের আলোর ভিতরে’ প্রত্যক্ষ করে উদ্বেলিত হয়েছেন ’ বিকেলের রক্তিম বিন্যাসে’র সুখময়তায়।
এখন ধারণা অনিবার্যভাবে বিশ্বাসিত হতে পারে যে, বর্তমান আলোচিত কবিতা দুটোর প্রতিটি শাব্দিক রন্ধের মধ্যেও যে ঋদ্ধ মনের প্রকীর্ণতা তার নিজেরই ব্যবহৃত ’ জ্যোৎস্নার শিশিরের’ মতো ব্যাপৃত হয়ে গেছে সারা দেহ মনে। এবং এ না হলে নিশ্চিত করে কখনই ‘ করুণ শঙ্খের মতো স্তন, জলের প্রতিভা ’ প্রভৃতি উৎপ্রেক্ষা তার আকাক্সক্ষার প্রতিরূপ হতে পারতো না। আর প্রসঙ্গতই তার প্রচুর মনের উন্মাত্তাল ব্যাপ্তির অন্তর্লোকে দ্বিধা-দীর্ণতার প্রশ্নও সেই অর্থে গ্রাহ্যতার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু দ্বিধাদীর্ণতাই অবশ্যম্ভাবী আকার নিয়ে মূর্তিত হতো, যদি উন্মুক্ত মনের ঋদ্ধতার উৎসমুখকে বিরুদ্ধতার আর্বতে নিপাতিত করবার প্রয়াস পেত। আর তাহলে কি কল্পনার সচলমানতা নিঃসন্দেহেই স্রষ্টার অনুভূতিকে বস্তু সত্তার মর্মের অতলে পৌঁছে দিতে সক্ষম হতো? কল্পনা কি পারতো সেই স্বাপ্নিক প্রতিবেশে বিচরণ করতে- যে প্রতিবেশের সাথে আত্মস্থতাকে অস্বীকার করেও শুধু তার চিত্রাঙ্কনই সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে সরাসরি অসম্ভবই নয় একেবারে অলীককেও ছাড়িয়ে যাবার মতো যুক্তিগ্রাহ্য দুঃস্বপ্নের সমধর্মী এবং সেক্ষেত্রে কি কল্পনা সহজেই ঈশ্বর নির্ভরতায় উন্মুখ হয়ে পড়তো না?
০১.
অনেক জেনেছে ব’লে আর কিছু হয় না জানিতে;
অনেক মেনেছে বলে আর কিছু হয় না মানিতে;
দিন রাত্রি গ্রহ তারা পৃথিবী আকাশ ধ’রে ধ’রে
অনেক উড়েছে যারা অধীর পাখির মতো করে,
পৃথিবীর বুক থেকে তাহাদের ডাকিয়া আনিতে
পুরুষ পাখির মতো,- প্রবল হাওয়ার মতো জোরে
মৃত্যুও উড়িয়া যায়! অসাড় হতেছে পাতা শীতে,
হৃদয়ে কুয়াশা আসে,- জীবন মেতেছে তাই ঝ’রে!
পাখির মতন উড়ে পায় নি যা পৃথিবীর কোলে
মৃত্যুর চোখের ’পরে চুমো দেয় তাই পাবে ব’লে।
প্রেমঃ - জীবনানন্দ দাশ।
০২.
‘সকল ক্ষুধার আগেই তোমার ক্ষুধায় ভরে মন
সকল শক্তির আগেই প্রেম তুমি, - তোমার আসন
সকল স্থলের পরে, - সকল জলের প’রে আছে !
যেইখানে কিছু নাই সেখানেও ছায়া পড়িয়াছে
হে প্রেম তোমার! অঙ্কুরের মত তুমি,- যাহা ঝরিয়াছে
আবার ফুটাও তারে! তুমি ঢেউ হাওয়ার মতন !
আগুনের মত তুমি আসিয়াছ অন্তরের কাছে!
আশার ঠোঁটের মতো নিরাশার ভিজে চোখ তুমি
আমার বুকের ’পরে মুখ রেখে ঘুমায়েছ তুমি!
প্রেম ঃ জীবনানন্দ দাশ।
“অলীক অপিচ সত্য, বাস্তব ধারণায় অলীক অথচ ‘ কবিতা-রস’ ধারণায়- সত্য, এই হচ্ছে ‘ কবিতা সত্য’। কবির মনোভূমিতেই কবিতা-সত্যের জন্মস্থান”। প্রকৃত অর্থে কবিতা বিশ্লেষণে এই যদি হয় চূড়ান্ত উলঙ্গ সত্য তবে অভিজ্ঞানের রক্ত সিঞ্চনে অবশ্যই ¯স্রষ্টাকে মাত্রাধিক শক্তির সাথে তুলিত করতে হবে। সামগ্রিক নিসর্গীকতায় আত্মার সংযোগ সাধন সম্ভব করে তুলতে হবে- (যেমনটি হয়েছে আলোচিত প্রথমোক্ত কবিতাদুটিতে) নইলে কবিতায় প্রযোজ্য ঐ কবিতা-সত্য হবে অসার প্রমাণিত।
দ্বিতীয়োদ্ধৃত কবিতাটির স্তবক দুটিও ঐ কবিতা-সত্যের গ্রন্থীভুক্ত। মনোভূমির পরিচর্যা করতে গিয়ে ¯ স্রষ্টা যেন অতি মাত্রায় আত্মমুখী হয়ে উঠেছেন, যেমন ‘ আশার ঠোঁটের মতো নিরাশার ভিজে চোখ তুমি’ বাস্তব সত্যে কখনই হৃদয় স্পর্শিক নয়। অথবা ‘মৃত্যুর চোখের ’পরে চুমো দেয় তাই পাবে বলে।’ কিন্তু তবুও গ্রাহ্য । এবং শুধু গ্রাহ্যই নয় প্রশংসিতও। কেননা ওই ‘ কবিতা-সত্য’ই বিষয়টিকে যথার্থভাবে প্রমাণিত করে দেয় । আবার ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করলে ঋদ্ধিমান মননের বিকীর্ণমানতা যেমন ‘কবিতাসত্য’কে উজ্জ্বলতর করে তোলে, ঠিক তেমনি সাহিত্যের অন্যান্য শাখা প্রশাখার নিরঙ্কুশ সত্যতাকে কিছুটা হলেও যেন নিরুৎসাহিত ক’রে দ্বিধাদীর্নতার অন্তর্জাত সন্দেহপ্রবণতাকে যদিও বাড়িয়ে তোলে তবুও সাহিত্যের অন্যান্য শাখা প্রশাখার প্রান্তরটির ওপরেও আলোকরশ্মি প্রক্ষেপ করে। তবে আপাততঃ যেহেতু কবিতাসত্যের বিষয়টিই মুখ্য সেইহেতু সে প্রেক্ষিত বিবেচনায় সাহিত্যের অন্যান্য শাখা প্রশাখার প্রেক্ষিতটিকে এ ক্ষেত্রে মুখ্য গণ্য না করে কেবলমাত্র কাব্যকে কেন্দ্র করে অগ্রসর হলেই সম্ভবতঃ এর স্বপক্ষ- যুক্তি আরও বলিষ্ঠ হয়ে উঠবে।
‘কবি অভাবনীয়কে দর্শন করতে চান। পৃথিবীতে সর্বত্রই একটি অভাবনীয় আছে, একটি বিপুল রহস্যে পৃথিবীর জীবন যেন সমাচ্ছন্ন- এমন একটি বোধ স্বল্প বয়সে সবার মনেই জেগে উঠে। বড় হয়ে বিজ্ঞান ও বিবেচনা যখন আমাদের জীবনকে ক্রমশ শাসন করতে থাকে তখন বুদ্ধির রাজত্বে এসে আমরা অভাবনীয়কে হারিয়ে ফেলি।’
‘শিশু বয়সে আমাদের মনে একটি আদিম পবিত্রতা থাকে, একটি নিস্কলুষ বিস্ময়ের জাগরণ থাকে। একমাত্র কবিই এ বিস্ময়কে জাগিয়ে রাখেন । কবির স্পর্শকাতর সংবেদনশীল মন হৃদয়ের জন্যে চিরকাল রাজ্য বিস্তার করে, যে রাজ্যে শুধু অভাবনীয়ের প্রতিষ্ঠা, যে অভাবনীয় প্রকৃতিতে, মানুষের কর্মে, সম্পর্কে এবং আনন্দ বেদনায় দ্বীপান্বিত প্রতিটি মুহুর্তে।’
কবিতার কথা ঃ সৈয়দ আলী আহসান।
পৃথিবীর এ অভাবনীয়ই কবির অবিষন্ন হৃদয় রাজ্যের অনন্ত আকর্ষণ- অসীম প্রেরণা নির্যাস। আর সেখানে এ নির্যাস আহবানের প্রধানতম অবলম্বনই নির্বাধ দ্বিধাহীন কল্পনাগামীতা- যেখানে ঈশ্বর নির্ভরতা ওই কল্পনাগামীতার লজ্জাহীন অসম্মান। এবং এ অসম্মানের সর্বশেষ প্রতিরোধী সত্তাই হলো মননের ঋদ্ধিমানতার প্রকীর্ণতা। কেননা মনোজগতের ঋদ্ধতাকে বিকীর্ণিত হতেই হবে এই অর্থে যে, ঋদ্ধতাকে কখনই অবগুন্ঠিত করে রাখা যায় না, বিকীর্ণতাই ঋদ্ধতার ধর্ম।
সংশ্লিষ্ট প্রসঙ্গে প্রখ্যাত ব্রিটিশ কবি P B Shelley -এর ‘এডোনিস’ কাব্য থেকে কয়েকটি পঙ্তি উদ্ধৃত করা যেতে পারেÑ
‘The one remains, the many change and pass,
Heaven’s light for ever shines, earth’s shadow fly,
Life like a dome of many coloured glass,
Stains the white radiance of Eternity,
Until death tramples if to fragments.’
‘মৃত্যুতে জীবন একটা রূপান্তর লাভ করে। প্রকৃতির মধ্যে যে শক্তি বিরাজমান সেই শক্তির সঙ্গে মিশে রূপান্তরিত জীবন চরাচরে ব্যাপ্ত হয়ে যায়।’
‘He is made one with nature, there is heard his voice in all her music; from the moan of thunder to the song of night’s sweet bird.’
এখানে যে কথা ক’টি বলা হলো তা একজন কবির নিঃসীম কল্পনাগামীতার ফল হিসেবে প্রাপ্ত ওই ‘ কবিতা-সত্য’কেই ইঙ্গিত করে যেখানে কবি একজন মানুষের মৃত্যুর পর তার রূপান্তরিত জীবনের অবস্থান সম্পর্কে এক ধরণের নিশ্চয়তা প্রদান করেছেন যে নিশ্চয়তার অভ্যন্তরে জীবনের স্থিতির বিষয়টিকে কবি চরাচরে ব্যাপৃত হয়ে যাবার প্রেক্ষিতেই বিবেচনা ক’রে সেটিকে আলোকিত করেছেন নিঃসন্দেহে।
আর একজন সমসাময়িক অসামান্য ব্রিটিশ কবি John Keats 1821 খৃষ্টাব্দের ফেব্রæয়ারী মাসে মৃত্যু বরণ করেন। একই বছরের এপ্রিল মাসে কবির মৃত্যু সংবাদটি অবহিত হবার পর কবি শেলী তারÑ ‘ এডোনিস’ কাব্যটি রচনা করেন। এখানে একটি বিষয় অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাইে উল্লেখ্য যে, কবি কীটস্ স্বাভাবিকভাবে মৃত্যু বরন করেননি, তাকে হত্যা করা হয়েছিল। এবং এই হত্যাকান্ডটিকে শেলী কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি। তাই তার এডোনিস কাব্যের এক থেকে সাইত্রিশ স্তবক পর্যন্ত কবি কীটসের প্রতি শেলীর তীব্র দুঃখ, দাহ, যন্ত্রণা এবং তার হন্তারকদের প্রতি চরম ঘৃণা প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু সাইত্রিশ স্তবকের পর থেকে কবি শেলী বিদ্রোহী হয়ে উঠেছেন, প্রতিবাদী হয়ে উঠেছেন। এবং কবি কীটসের মৃত্যুটিকে তিনি একটি রূপক হিসেবে গ্রহণ করবার পাশাপাশি নিজেকে তিনি এক অধিলৌকিক আধ্যাত্মিকতার স্তরে উন্নীত করেছেন। কবি শেলী তার অবিষ্মরনীয় কাব্য ‘এডোনিস’এর নায়ক এডোনিসকে জন কীটসের অনুকৃতি হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। ওই কাব্যে এডোনিস একজন মেষপালক। এডোনিসকে যখন হত্যা করা হয় তখন তার চারপাশে থাকা মেষগুলি এডোনিসের মৃত্যুশোকে মূহ্যমান। প্রকৃতিও যেন আকুল, এমন কি গোটা ইংল্যন্ডও যেন কবি-কল্পনায় শোকের আবেগ-মিশ্রিত উত্তেজনায় অধীর। এডোনিসের মৃত্যুকে যেন মানুষ, প্রকৃতি কোনো কিছুই কোনোভাবে মেনে নিতে পারেনি। কবি ইউরেনিয়াকে আহবান জানিয়েছেন এডোনিসের মৃত্যুতে শোক প্রকাশের জন্যে। ইউরেনিয়া সুদূর বন্ধুর পথ অতিক্রম করে এডোনিসের সমাধিতে আগমন করে এডোনিসের হত্যাকারীদেরকে তীব্র ভাষায় তিরস্কার করেন এবং তাদেরকে “Herded wolves”, “obscene ravens”, “vultures”, “dragon” ইত্যাদি আখ্যায় ভূষিত করে শোকে নীরব হয়ে যান। এরপর বিভিন্ন কবিবৃন্দ এক এক করে এডোনিসের সমাধিতে আগমন করে শোক প্রকাশ করতে থাকেন। এসব কবিদের শোক প্রকাশের ভেতর দিয়ে কবি শেলী তার নিজের ভেতর একটি আধ্যাত্মিক উপলব্ধির উদ্ঘাটন করেন। এই উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে কবি অনুভব করেন যে, এডোনিস মরতে পারে না, সে মৃত্যুঞ্জয়ী। এডোনিস যেমন মৃত্যুঞ্জয়ী ঠিক তেমনি কবি জন কীটস্ও মৃত্যুঞ্জয়ীÑ তারও মৃত্যু হতে পারে না। একজন কবিকে কতটা ভালোবাসলে আর একজন কবি এ ধরণের ভাবনা ভাবতে পারেনÑ তা অবশ্যই বিবেচনার অপেক্ষা রাখে।
‘তিনি এই উপলব্ধির মধ্য দিয়ে জগৎ ও জীবনের একটি মর্ম সত্য জানতে পারলেন তাহলো মৃত্যুর আলোকে আত্মার অমরত্ব এবং বিশ্বের মধ্যে যে শক্তি ক্রিয়াশীল তার নব নব বিকাশ। সৃষ্টির মূলীভূত কেন্দ্রে ঐশী শক্তিকে তিনি অনুভব করেছেন এবং বিচিত্র প্রকাশের মধ্যে সেই শক্তির মূর্তি কল্পনা করেছেন।’
এবং
‘শেলী এডোনিস কাব্যে মানুষকে এক অনন্ত শক্তির অংশ বলে মনে করেছেন। এবং আত্মার অমরত্বের বিশ্বাসে সান্ত¦না লাভ করেছেন। জীবন অবিনাশী, আত্মাকে আচ্ছাদিত করে রাখে। মৃত্যু তাকে মুক্ত করে অনন্তের সাথে যুক্ত করে দেয়। দুঃখবাদী কবি জীবনকে দুঃস্বপ্ন বলে মনে করেছেন। অবিনশ্বর অনন্তের অংশ জীবনের দুঃখ কষ্ট নৈরাশ্যের মধ্যে পড়ে তার নির্মল জ্যোতি হয় নিষ্প্রভ। তবে যতই ¤øান হোক আত্মার অবিনশ্বরতা তাতে বিনষ্ট হয় না। তাই এডোনিসের মৃত্যু নয়, তা স্বপ্ন হতে জেগে উঠা,
Peace, Peace, he is not dead, he doth not sleep
He hath awakened from the dream of life.’
‘মৃত্যুর পর আত্মা পরমাত্মায় বিলীন হয়ে যায়। এই পরমাত্মাই হল স্বয়ং ঈশ্বর। আত্মা অবিনশ্বর, অজর, অমর। তা ধ্বংস হতে পারে না। দেহের ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গেই আত্মার ধ্বংস হয় না। কারণ এই জাগতিক জীবনের পরও আর একটি জীবন আছে তা হল স্বর্গীয় জীবন। কবি বলেছেনÑ
‘The pare spirit shall flow Back to the burning fountain whence it came A portion of the Eternal..’ Ñইংরাজী সাহিত্যের ইতিহাসÑ ডঃ শীতল ঘোষ।
এখন, উপসংহারে এসে গোটা আলোচনাটিকে বিশ্লেষণ করে এ রকম একটি সিদ্ধান্তে নিশ্চিতভাবেই উপনীত হওয়া যায় যে, কবির কল্পনাগামীতার শেকড় যদি ঋদ্ধতায় আকীর্ণ না থাকে তাহলে ‘কবিতা-সত্য’ যেমন প্রতিষ্ঠিত হয় না ঠিক তেমনি কোনো কবির পক্ষেই কারও মৃত্যুর পর তার আত্মাটির পরমাত্মার সাথে বিলীন হয়ে যাবার সিদ্ধান্তটিও প্রদান করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কারণ একটি বস্তু তখনই ‘ বস্তু’ হয়ে ওঠে যখন তার আকৃতি, ভর এবং অবস্থান থাকে যা অবশ্যই দৃশ্যমানতার সীমায়তিতে অবস্থান করতে পারে। কিন্তু আত্মা কোনও বস্তুই নয় এবং যেহেতু আত্মা কোনও বস্তু নয় সেইহেতু তার কোনো দৃশ্যমানতাও নেই। অর্থাৎ উল্লেখিত সংশ্লিষ্ট উপাদানগুলির কোনোটিকেই আত্মা ধারণ করে না। সে কারণে কেবলমাত্র কল্পনাগামীতার মাধ্যমে অদৃশ্যকে নিজের উপলব্ধিতে ধারণ করে গভীর কল্পনার রঙ-এ আকৃতি প্রদান করে বিকীর্ণিত করা একমাত্র একজন কবির পক্ষেই সম্ভব যদি তার কল্পনাগামীতার শেকড় ঋদ্ধিমান হয়। এ প্রেক্ষিতে এখন একটি কথা অবলীলায় বলা যায় যে, একজন ঋদ্ধিমান কবিই কেবল নিখিল বিশ্বের ‘চৈতন্য-শক্তি’র মহিমা উদ্ধার করতে পারেন এবং এই চৈতন্য-শক্তির মধ্যেই আত্মার চিরকালীন অক্ষয় অবস্থান সুদৃঢ়ভাবেই স্থিত থাকতে পারে।