সায়েম অনিন্দ্য
চিঠিখানা পড়ে আনমনা হয়ে যায় কাশফ । তার মনের ক্ষতে ফের বিষ ছোঁয় । কিন্তু ব্যথা নেই । চোখ জলে ভরে না । তার জানাতে ইচ্ছেও হয় না যে, লীনা তুমি বিশ্বাস কর আমি প্রপঞ্চক নই । তোমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না আমি । শুধু মায়ের কথা রাখতে গিয়ে মিতাকে বিয়ে করতে হয়েছে আমাকে । তুমি তোমার প্রেমের মোরাকাবায় বসে আমার এই অসহায়ত্বটুকু ক্ষমা করতে পারলে না ! এই গুগলের কালে বিয়েটাকেই প্রেমের পরিসমাপ্তি হিসেব মেনে নিলে !
ততক্ষণে মিতা এসে কাঁধে হাত রাখে । কাশফকে চিঠিহাতে পাথরের স্ট্যাচুর মত বসে থাকতে দেখে উৎকণ্ঠা তার চোখেমুখে ।
কিসের ? কার চিঠি এটা?
কারোরই না,বলে চিঠিখানা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে শূন্যে উড়ায়ে দেয় কাশফ । হাত ধরে মিতার । ধরাগলায় শান্ত ভঙ্গিতে বলে, তুমি আমার লাইফম্যাট ,মিতা । ভালোবাসো আমাকে শীতল করো ।
মিতা হাত ছুটাতে চেষ্টা করে । পারে না । কাশফ আরও শক্ত করে ধরে । কাছে টেনে নেয় মিতাকে । শরীরের কাছে । সিনার খুব কাছে ।মিতা এবার আর প্রতিবাদ করে না । কারণে অকারণে আদর না পেলে নারীর শরীর কাঠখাট্টা হয়ে যায় । গ্রহণ করার জন্য শরীর নরোম করে দেয় মিতা । কাশফ মিতার ঠোঁটে ঠোঁট রাখে । মিতা দু'চোখের চারপাতা নিভায়ে দেয় ।কাঁপতে থাকে সে ।হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায় । কেউ তা ঠাহর করে না । কী দরকার ঠাহর করার ? এখন এবাদত হবে । ঈশ্বর স্বীকৃত শুদ্ধতম এবাদত ।
রাত বাড়ে । আদিমসুখের পোশাক পড়া রাত । সঙ্গমসুখি দু'টি মানুষ ক্লান্ত দেহে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় একসময় ।
বাইরে তীব্রঅন্ধকার । সুনসান নীরবতা । অথচ চাঁদের হিসেবে আজ পূর্ণিমা । হেসেহেসে চাঁদ ওঠার কথা আকাশে । জ্যোৎস্নার আলোয় আলোয় আগুন লাগার কথা রাতের শরীরে । তারা জ্বলার কথা সারা আকাশের এখানে সেখানে জুড়ে ।
ঘড়ির কাটা যত এগিয়ে যায় তত বেড়ে ওঠে রাতের গভীরতা । একসময় ফিঁকে হয়ে আসে অন্ধকার । আলো আসবে বলে অন্ধকারকে বিদায় অভিবাদনে আমন্ত্রতিত করে সুবহে সাদিক । গাছে গাছে কিচিরমিচির করে এই পাখি সেই পাখি । মসজিদ হতে ভেসে আসে ,আস্সালাতু খাইরুম মিনান নাওম.....
হালকা হয় মিতার ঘুম। তারপরও কেটে যায় মিনিট বিশেক ঘুমঘোরেই । জানালার ফাঁক দিয়ে কিঞ্চিৎ আলো কক্ষে প্রবেশ করে । মিতা শেষমোচর দিয়ে শরীরটাকে এপাশ ওপাশ করে । তার আধোউদোম ডান হাঁটু কাশফের উরুতে আছড়ে পরে । তার মনে পড়ে যায় একটু আগে গত হওয়া সঙ্গমসুখের মদিরা সুখ ।
কাশফ পুরুষ । সুন্দর সুপুরুষ । যথার্থ সুপুরুষ । যে পুরুষ নারীর মনোদেহ জয় করে ভালোবাসা আদায় করে নিতে জানে পুরোটুকু । যে পুরুষ নারীর মনোদেহে মনোজ্ঞভঙ্গিতে জাগাতে পারে সুখের কাঁপন।
ধীরেধীরে কক্ষের সবটুকু অন্ধকার আলো এসে শুষে নিচ্ছে । জানালার ফাঁক দিয়ে এক ফালি তীব্র সূর্যালো মিতার শরীরে চিকচিক করতে থাকে । সারারাত যে লজ্জা তার ধারধারে ছিল না নিজের আধোউদোম শরীর দেখে সে লজ্জা মিতাকে পেয়ে বসে । শাড়ির আঁচল টানতেই দেখে কাশফের পীঠের নিচে জটলা পাকিয়ে আছে । টান দেয় মিতা ।ইস ! কী ভারীরে শরীরটা ! পাথর যেন !মিতা শক্ত করে আবার আঁচলখানি টান দেয় । কিন্তু আঁচল আসে না । আঁচলের সাথে কাশফের সারা শরীরটাই যেন মিতার কাছে চলে আসার উপক্র্ম । এবার কিছুটা বিরক্তি নিয়ে মিতা ডাকে , এ-ই । উঠো । আর কত ঘুমুবে?
কাশফের ঘুম ভাঙ্গে না । মিতা আঁচল ছেড়ে দিয়ে পীঠের এলোমেলো চুল ঠিক করে খোঁপা বাঁধে । চুলগুলো বেশ লম্বা তার ।কোমর ছাড়িয়ে যায় । খোঁপা বাঁধলে অনেকটা বড় হয় ।
কাল রাতে কাশফ মিতার খোঁপায় আলতো চুমু খেয়েছিল । অজান্তেই মিতার একটা হাত খোঁপার চুমুর স্থানে চলে যায়। খোঁপায় হাত রেখে চোখ বন্ধ করে মিতা ভাবে, সর্ব প্রথমে কাশফ খোঁপায় চুমু খেলো কেন? কপালে নয় কেন? ঠোঁটে নয় কেন? সে ভাবে,কাশফকে তা করবে ? জিজ্ঞেস করলে ,কী উত্তর দিতে পারে কাশফ ? বান্ধবীদের কাছ থেকে শুনেছে,ছেলেরা তাদের প্রেমিকাদের গালে চুমু খায়,ঠোঁটে চুমু খায়। তাদের কোনো প্রেমিক কী কখনো তাদের খোঁপায় চুমু খেয়েছে ? হঠাৎ একটা চড়ুই উড়ে এসে জানালার গ্রীলে বসে ধুন্দুমার ডাকাডাকি শুরু করে দেয় । সম্বিত ফিরে পায় মিতা ।
কাশফের পীঠের নিচে আঁচল রেখেই উঠে দাঁড়ায় মিতা।
আলমারির কাছে যায় । তারপর ওয়াশরুমে ।
মিতা ওয়াশরুম থেকে এসে দেখে কাশফ জানালার দিকে মুখ করে সিগারেট টানছে। গন্ধটা প্রথমে উৎকট লাগলেও কয়েক মুহুর্ত পরে অন্যরকম একটা ভালো লাগছে । তার ইচ্ছে করছে,কাশফের কাছ থেকে সিগারেটটি নিয়ে টানবে কিছুক্ষণ । আচ্ছা,এই ইচ্ছেটার কথা কাশফ জানলে কী মনে করবে সে? - ভাবছে মিতা । আচ্ছা ,ডাক দিয়ে কাশফের সিগারেট টানার এই মগ্নতা কি ভাঙ্গা উচিৎ ?- ভাবছে সে । আচমকা সেই চড়ুইটি আবার কক্ষের ভেতরে উড়ে এসে তীব্র কিচিরমিচির করে ফুড়ৎ করে বের হয়ে যায় । কাশফ ঘাড় ফিরে তাকাতেই দেখে মিতা খাটের কার্ণিশ ঘেষে দাঁড়ায়ে আছে ।
লালপাড় ওয়ালা শাড়ি পড়েছে মিতা। মাথার চুল পীঠে ছাড়িয়ে দেওয়া । ফোঁটা ফোঁটা পানি ঝড়ছে। লিপিস্টিকহীন গোলাপী ঠোঁট । স্বর্ণের ভারী চেইন তার লকেটটিকে বুকের ভেতরে ঠেলে দিতে চাইছে ।আর বুক চাইছে লকেটটিকে গলার দিকে ঠেলে দিতে ।
কী দেখছ এমন করে? স্মিত হেসে জানতে চাইল মিতা ।
নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল কাশফ,আমার সোনালিমেঘের রমনীকে ।
সোনালিমেঘের রমণী ?
হ্যাঁ,সোনালিমেঘের রমণী । যার সোনা সোনা মেঘের তুমুলবৃষ্টিতে আটাইশ খরার শেষে আমি শীতল হলাম । হ্যাঁ,তুমি আমার সোনালিমেঘের মেয়ে । পরাণের খুব গভীরের গোপন লাভায় মেঘ ছুঁইয়ে দেওয়া সোনালিমেঘের মেয়ে ।
তাহলে লীনা?
মিতার মুখে লীনার নামটি শুনে ধাক্কা খেল কাশফ ।অপ্রস্তুত অব্স্থায় ফ্যালফ্যাল করে তাকায়ে রইল মিতার মুখের দিকে । পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেয়। খুব স্বাভাবিক এবং নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,লীনা আমার বন্ধু । আমার দোযখজীবনের সাদামেঘ। তার ছায়ায় বসে আমি সবুজনিঃশ্বাস নিই,সেই নিঃশ্বাস পান করে করে আমার বেনাল শব্দগুলো পয়ারপদ্য হয়ে উঠে ।
তার চোখের পানি তোমাকে বিচলিত করে না ?
করে । খুব করে। আমার ভেতরবাড়ি জলগলা হতে হতে শীতলজলের সমুদ্রে রূপ নেয় । সেই সমুদ্রে একলা আদম আমি চারুজস্রষ্টা হয়ে উঠি । বলতে বলতে মিতার মুখের দিকে তাকায় কাশফ । দেখে,মিতার দুইচোখ জলে টলমল । কাশফ উঠে দাঁড়ায় । মিতার মুখোমুখি হয়ে দুইহাতের তালুতে দুইচোখের পানি মুছে দেয় । মিতা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করে উঠে । কাশফ মিতাকে বুকে টেনে নেয় । মিতা কান্নাভেজা কণ্ঠে বলে,আমাকেই লীনা কিরে নাও । আমি স্রষ্টার বেনালজীবনে লীনা হয়ে থাকতে চাই ।
কাশফ স্মিত হেসে বলল,না মিতা । তুমি মিতা না থাকলে আমি লীনাকে ধারণ করে স্রষ্টা হয়ে সমুদ্রবাস করতে পারবো না ।
তারপর মিতাকে রেখে গোসল করতে যায় কাশফ । দ্রুত গোসল সেরে শার্ট প্যান্ট পড়ে দ্রুত বের হয়ে যাচ্ছিল সে । মিতা চোখে মুখে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করল,মানে কী এসবের ?
প্লিজ,আমি জানি ঠিক হচ্ছে না ।কিন্ত উপায় নেই । যেতেই হবে । যাব আর আসব । মিনিট পাঁচেকের কাজ । আর যাওয়া আসায় যতক্ষণ লাগে ।
না ।যত গুরুত্বপূর্ণ কাজই থাকুক আজ যাওয়া যাবে না । তুমি বসো । আমি নাস্তা নিয়ে আসছি । - এই বলে চলে যাচ্ছিল মিতা । তার পথ আটকে ডান হাতটি দুই হাতের মুঠোয় ভরে বিষন্নভঙ্গিতে বলল,মিতা । আমারও খুব ইচ্ছে করছে আজ বের না হতে। কিন্ত যেতেই হবে ।সময় খুব বেশি নেই হাতে । এক কাজ করো তাহলে ,তুমি নাস্তা রেডি করে রাখো ।আমি ফিরে এসে দুজনে মিলে এক সাথে নাস্তা করব।
এতোই গুরুত্বপূর্ণ কাজ তোমার ?
হ্যাঁ ,মিতা । মিনিট পাঁচেকের কাজ ।
ঠিক আছে যাও ।
এইত লক্ষিটি । শোকরিয়া ।
তা কোথায় যাবে ?
বনানি- আর এস টাওয়ারে ।
মিতার কপালে আলতো চুমু খেয়ে বের হয়ে যায় কাশফ ।বেলা সকাল দশটা ।
মিতা টেবিলে নাস্তা গুছিয়ে রাখে ।বিছানা পত্র ঠিকঠাক করে সোফায় বসে ফোন দেয় কাশফকে ।
হ্যালো..
হ্যাঁ,হ্যালো ।
কোথায় আছো এখন?
এইত কাছাকাছি প্রায় । আর দশ মিনিট লাগবে ।
আচ্ছা । যাও । অন্য কোথায় যাবে না কিন্তু । কাজ শেষ করে তাড়াতাড়ি ফিরে এসো ।
ঠিক আছে । তুমি ভেবো না । রাখি ।
মিতা মোবাইল রেখে আয়নার সামনে দাঁড়ায় । তার চোখ হাসছে । ঠোঁট হাসছে । গুনগুন করে গান আসছে ভেতর থেকে । হালকা সেজে আবার সোফার উপর বসল।
বেশ কিছুক্ষণ ধরে মোবাইলে ফেইসবুকিং করার পর হঠাৎ একটা পোস্ট চোখে পড়ল তার ।
বনানিতে আর এস টাওয়ারে আগুন।
সারা শরীর কেঁপে উঠে মিতার । মুহুর্ত কাশফের নাম্বারে ডায়াল করে সে ।নাম্বার বন্ধ । বলছে,এ মুহুর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না । নিজের ভারসাম্য হারায়ে অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পরে যায় মিতা ।