১.
অন্তরের গভীর থেকে উঠে আসা তোমার সমস্ত কথা ভুলে যাবে, আর আমি মাতালের মতো
চষে ফিরব সেইসব পথ ঘাট আঘাটা ও অন্ধকার। গন্তব্যে বিপরীত দিকে হেঁটে
কয়লাকুঠিতে গিয়ে চুমু খাব গোয়েন্দার পায়ে।
২.
আমার তো ফেরা নেই আমি
শুধু যেতে জানি, যাই। মধ্যাহ্নভোজনে দেরী হলে মাথা ধরে, শিরঃপীড়া নিয়ে
রাত্রির গভীরে যাই। আর মহাজন আমাকে ডেকে নিয়ে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রাখে। আমি
অপেক্ষায় অপেক্ষায় শুষ্ক এক বৃক্ষকাণ্ডে পরিণত হই, স্বপ্নের ভেতরে শুনি,
খাবে কখন? কখন? হুঁ?
৩.
যে-ভালোবাসা জোয়ারের মতো ধেয়ে আসে, তাকে
ফেরানো অন্যায়। তাকে অন্তত গ্রহণ করতে হয় হৃদয়ে। এই ভেবে আমি ডেকে এনেছি
সর্বনাশ; দেখি, আমার সমস্ত অস্তিত্ব তুমিময়।
৪.
যদি আর খুঁজে না
পাই তোমাকে, কিংবা যদি খুঁজে না পাও আমাকে প্রান্তরে বা পেভমেন্টে আকাশে বা
জলের কল্লোলে— যদি কোন লুণ্ঠন সংঘটিত হয় কিংবা অন্তর্ঘাত বা আত্মঘাত--
আমরা বেঁচে থাকব অনন্তকাল পরস্পরের বুকে। কিংবা আমরা বেঁচে থাকব পরস্পর অনন্তকালের বুকে।
৫.
যে-কোনো রেস্তোরাঁয় বসলেই আমার চোখ হয়ে ওঠে লুণ্ঠন-প্রবণ, ওকে তুমি
প্রশ্রয় দাও, প্লিজ! আমার চোখ দুটি এখনও আদিম সারল্যে টলমল করে, গিরিখাত
বেয়ে মদির পাতালে যেতে চায়, ভালোবাসে নদীর সূচনা আর মানবিক ঘ্রাণ। চকিত
লুণ্ঠনের দায়ে তাকে তুমি দণ্ডিত করো না--
আমার দু-দুটি চোখ
নিকোবর-আন্দামানে গেলে অজস্র নক্ষত্র হয়ে ফিরে আসবে রাত্রির আকাশে, শাস্তি
দিয়ো না তাকে, প্রশ্রয় দাও— প্রত্যন্তে বা শ্যামদেশে কিংবা মহাকাশে।
৬.
কার দেয়া স্কেচবুকে কাকে নিয়ে কবিতা লিখছি, তাই ভাবি। যে যায়, সে ফিরে আসে
না। মত্ত নীল ডানায় বাতাস পিছলে যায়, আর আমি এক ঘুমঘোর থেকে অন্য ঘুমঘোরে,
একটি প্রত্যূষ থেকে রাত্রির গভীরে পুনর্বিবেচনার মতো বিদ্ধ হই, দগ্ধ হতে
থাকি— ভাদ্রের বিদগ্ধ বাতাস টের পায় রক্তের ঘ্রাণ।
৭.
সোনার শিকলে আমার পা বাঁধা। তবু আমি তোমার কাছে যাব। শিকল যদি না-ও ছিঁড়তে পারি, পা দুটি কি ছিঁড়তে পারব না?
বুকে ভর দিয়ে আমি তোমার কাছে এলে সরীসৃপ ভেবে তুমি তাড়িয়ে দিয়ো না।
৮.
সহজ কবিতার মতো কঠিন এক পাথর আমার বুকে চেপে আছে, আমি চশমা খুলে রেখে
তোমাকে দেখতে থাকি, আবার চশমা পরে তোমাকে দেখতে থাকি। হাতে এলার্জির দাগ—
চোখের পাতার চামড়া উঠে আসছে, আমার চোখেই পড়ে না— তুমি যেন জলধারা, আমি শুধু
তোমাকেই দেখি।
আমার বুকে চেপে থাকা জগদ্দল পাথর কুয়াশা হয়ে রৌদ্রের আলোয় মিলিয়ে যায় যেন কোনো অজ্ঞাত পুষ্পঘ্রাণ— সমুদ্রের পাড়ে কোনো শঙ্খের ধ্বনি।
৯.
সে যদি তোমাকে সমুদ্রে না নিয়ে যায়, আমি তোমাকে নেব। প্রস্তুতির জন্যে
পাবে একটি জীবন। সবকিছু গুছিয়ে নাও সোনা, নির্বাণ পেয়ে গেলে আমি আর ফিরে
আসব না।
নির্বাণ চাই না তাই, পাপে ডুবি পাপের পাতালে কিছু শালুক কুড়াই মদোগন্ধ সোঁদাগন্ধ মিলেমিশে ঘুম নিয়ে আসে—
তোমাকে সমুদ্রে নেব পরজন্মে ভোরের বাতাসে।
১০.
তুমি প্রতারণা জান, আমি তাই প্রতারণা শিখতে নেমেছি— লোহার বাসর কেটে
বানিয়েছি একটি জানালা— জানালায় রোদ আসে, আলো আসে, দূরের বাতাস-স্মৃতি আসে।
এই মেয়ে কী লিখেছ কবিতার ক্লাসে? বাইরে যদিও রোদ— জীবনানন্দ হাসে।
১২.
আমার মুখটাকে মুখগ্রন্থ বলা যাবে না, তোমারটাকে যাবে। আমি তা পাঠ করি
নিজস্ব স্বভাবে। বর্ণনামূলক হয়তো, ইঙ্গিতের অভাব। এটা সত্যি। কত সত্যি
মহাকাল দিবে হয়তো তাহার জবাব।
১৩.
সাধুও চলিত হয়, যদি তুমি
চালাও ঠিকভাবে। চলিতও সাধু হয়, কিংবা ধরো সাধ্বী হতে পারে। সপ্তাহে অন্তত
একদিন বুধবারে অথবা শনিবারে। অলঙ্কার নেই দেখে রেগে যাবে হয়তো শাহজাদা, তার
অলঙ্কার মানে হীরা-পান্না; গোলাপ বা গাঁদা তাকে স্পর্শ করে না।
সংসারের জটিল আগুনে পুড়ে পুরোটাই হয়ে গেল ছাই; ছিল না তাহলে তাতে এক-কণা সোনা!
সাধু তো ছিলাম দেবী আমাকে চলিত করে দাও।
১৪.
অনভ্যাসে হস্তাক্ষর বড় হয়ে গেছে। অন্য-কোথাও নয়, কপালেই চুমু দিয়ো তুমি,
চোখের পাতায় দিয়ো, কানের লতিতে আর নাকের ডগায়। অন্য কোথাও নয়, চুমু দিয়ো
আমার হৃদয়ে।
একটি মানব-জন্ম কেটে যাক স্বচ্ছতায় আর নির্ভয়ে।
১৫.
ভয় মানে ভয় নয় অস্বস্তির ভার, ভয় মানে সামাজিক লৌহ-কারাগার। তার থেকে মুক্তি দিয়ো তুমি। কেননা তোমার হৃদয় আমার স্বদেশভূমি।
১৬.
ভালোবাসা প্রণয় হয়েছে
মথ হয়ে গেছে প্রজাপতি
আমাকে যথার্থ দীক্ষা
তুমি শুধু দিতে পার দেবী
দিয়েছ তা—তাই এ আচ্ছন্ন প্রণতি—
তোমার প্রশস্তিহীন কেটে গেলে একটি প্রহর
হৃৎপিণ্ড ধরে দেখ, কাঁপে থর থর।
১৭.
যা-খুশি লেখার রাত এসে গেছে
তুমিই এনেছ
সত্যি করে বল তুমি তার সঙ্গে শুয়েছিলে কী-না
দূরে এক ছোট ঘর জতুগৃহ হয়ে গেল
ছাইভস্ম দেখে বলবে কি, ভালোই বাসি না?
১৮.
এখন কী করবে তুমি আমি যদি দূরে বসে কাঁদি? অন্য কারো সান্নিধ্যের বিদ্যুতে
তুমি গলে যাও যদি, ভেবো না সবকিছু হয়ে যাবে সুদূর— তামাদি।
জন্ম:
২০ অক্টোবর ১৯৬৪
একজন কবি, লেখক এবং শিক্ষক।
জন্ম নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার ফাজেলপুরে। বাবা গোলজার হোসাইন এবং মা সুফিয়া খাতুন।
স্ত্রী আইরীন পারভীন, মেয়ে রোদেলা সুকৃতি ও ছেলে অভীপ্সিত রৌদ্র।
উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন নারায়ণগঞ্জে। এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করছেন।
প্রকাশিত গ্রন্থ :
কবিতা :
১. ইলা মিত্র ও অন্যান্য কবিতা, ষ্টুডেন্ট ওয়েজ, ঢাকা, ২০০০
২. শিকার-যাত্রার আয়োজন, সাহিত্য বিকাশ, ঢাকা, ২০০৫
৩. জলছবির ক্যানভাস, লোক-নালন্দা, ঢাকা, ২০০৬
৪. পাতাদের সংসার, স্বরাজ প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০৭
৫. এক দুপুরের ঢেউ, স্বরাজ প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০৮
৬. পায়ের তলায় এসে দাঁড়িয়েছে পথ, অনিন্দ্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০০৯
৭. চিরকাল আমি এখানে ছিলাম, অনিন্দ্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০১০
৮. পথ ঢুকে যায় বুকে, অনিন্দ্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০১১
৯. চলে যেতে পারি, অনিন্দ্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০১২
১০. কবির ব্রত আছে, তাকে বিব্রত করো না, অনিন্দ্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০১৩
প্রবন্ধ :
১. মীর মশাররফ হোসেন: জীবন ও পরিবেশ, শিল্পতরু প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯২
২. আধুনিক বাংলা সাহিত্য প্রসঙ্গ, আফসার ব্রাদার্স, ঢাকা, ২০০০
৩. মীর মশাররফ হোসেনের ‘জমীদার দর্পণ’: বিষয় ও শৈলী, শোভাপ্রকাশ, ঢাকা, ২০০৪
৪. কবিতা-প্রবন্ধ, অনিন্দ্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০১৩
গল্প :
১. চিড়িয়াখানা, এশিয়া পাবলিকেশসনস, ৩৬/৭ বাংলাবাজার, ঢাকা, ২০০০
ছড়া :
১. হাউ মাউ, প্যাপিরাস, নারায়ণগঞ্জ, ১৯৯০
২. ঠাট্টা, শিল্পতরু প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯৩
৩. হলদে পাখি আয়, সুচয়নী, ঢাকা, ১৯৯৮
৪. বিষ্টি যদি আসে, সুচয়নী, ঢাকা, ২০০২
৫. লেজ, বই পড়া, ঢাকা, ২০০৩
৬. একা একা বানান শেখা, ঢাকা, ২০০২
৭. পায়রা উড়ে যায়, কাগজ প্রকাশন, ঢাকা, ২০০৪
৮. ১০০ ছড়া, ভাষাচিত্র, ঢাকা, ২০১১
৯. ছড়ায় নতুন রূপকথা, অনিন্দ্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০১২
১০. ছড়াসমগ্র : খালেদ হোসাইন, অনিন্দ্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০১২
১১. ছন্দে ছড়ায় প্রজাপতি, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন, ঢাকা।
সম্পাদিত :
১. কবিতাসমগ্র: জীবনানন্দ দাশ, টুম্পা প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০০
২. সমর সেন, (যৌথ), দিব্যপ্রকাশ, ঢাকা, ২০০০
৩. রূপকথার আনন্দ: কাগজ প্রকাশন, ঢাকা, ২০০৪
৪. বাংলা ছন্দের মানচিত্র, অনিন্দ্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০১১
৫. বাংলা প্রেমের কবিতা, অনিন্দ্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০১২
পুরস্কার :
আবুল হাসান স্মৃতি পুরস্কার ১৯৮৮
শ্রুতি সম্মাননা : ২০১২