একুশে মেলায় বিক্রি হয়েছে ৮০ কোটি টাকার বই
একুশে মেলায়  বিক্রি হয়েছে ৮০ কোটি টাকার বই

ছবি : বইমেলা

সেলিম আহমেদ

‘যেতে নাহি দেব হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়’- রবীন্দ্রনাথের এই বিরহের সুরে সুর মিলিয়ে অবশেষে বিদায়টা দিতেই হলো লেখক-প্রকাশক আর সাহিত্যপ্রেমীদের প্রাণের বইমেলাকে। পাঠকদের মাঝে হাজারো স্মৃতি রেখেই সাঙ্গ হলো বাঙালির নানা ইতিহাস আর ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক এ বৃহৎ মিলনমেলা। ‘বিজয়’: ১৯৫২ থেকে ১৯৭১, নবপর্যায় স্লোগান নিয়ে আয়োজিত এ মেলা রীতি অনুযায়ী ফেব্রুয়ারির শেষ দিনে মেলা সমাপ্ত হওয়ার কথা থাকলেও প্রকাশকদের দাবির প্রেক্ষিতে মেলার সময় দু’দিন বর্ধিত করা হয়। তাই গতকাল শনিবার ছিল মেলার শেষ যজ্ঞ। এবারের মেলার শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন শুরু হলো আরেক বইমেলার জন্য প্রতীক্ষার ক্ষণ গণনা। আগামী ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি আবারো ফিরে আসবে এই প্রাণপ্রিয় বইমেলা।

এবারের মেলার মাঝখানে ও শেষের দিকের প্রতিকূল আবহাওয়া মোকাবিলা করেও বিগত কয়েকবছরের সফলতার সব রেকর্ড ভাঙতে সক্ষম হয়েছে। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রকাশক ও বাংলা একাডেমির বিক্রি মিলিয়ে এবার মোট ৭৯ কোটি ৭০ লাখ টাকার বই বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে বাংলা একাডেমি বিক্রি করেছে ২ কোটি ১৫ লাখ টাকার বই। আর প্রকাশকরা বিক্রি করেছেন ৭৭ কোটি ৫৫ লাখ টাকার বই। গতবার বাংলা অ্যাকাডেমি বিক্রি করে ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকার বই। গতবারের তুলনায় বাংলা একাডেমি ৫০ লাখ টাকার বই বেশি বিক্রি করেছে। অন্যদিকে গতবারের তুলনায় এবারের মেলায় প্রকাশকরা ৭ কোটি ৫ লাখ টাকার বই বেশি বিক্রি করেছেন।

 মেলার শেষ দিনে মেলার দ্বার খুলে সকাল ১১টায়। দ্বার খুলার পর থেকেই আলো নিভে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ছিল বইপ্রেমীদের ভিড়। আলো নেভার পরপরই গুনগুনিয়ে উঠে মেলার দুই প্রাঙ্গণ বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। শেষ হয়েই গেল, বাঙালির প্রাণের এ মেলা। তবে শেষ মুহূর্তের ভালোলাগা আর আনন্দের নির্যাস নিতে ভুলেননি কেউই। বইপ্রেমীরা কিনে নিয়েছেন বাকির খাতায় জমে থাকা শেষ বইগুলো। আর দর্শনার্থীরা অন্যান্য দিনের মতোই শেষ দিনেও আড্ডা আর ঘোরাঘুরি করে কাটিয়েছেন সময়। সবমিলিয়েই লেখক-পাঠক-প্রকাশক আর দর্শনার্থীর সরব উপস্থিতিতে মুখরিত ছিল মেলার দুই প্রাঙ্গণই।

গত ২৮ তারিখ মেলায় যখন ভাঙার চূড়ান্ত আয়োজন চলছে তখনই প্রকাশকদের অনুরোধে প্রধানমন্ত্রী দুই দিন মেলা বাড়ানোর নির্দেশ দেন। এতে খুশি হন অধিকাংশ লেখক এবং প্রকাশক। তবে বর্ধিত দু’দিনের প্রথম দিনে মেলায় বিক্রি ছিল আশানুরূপ কম। যদিও এদিনও মেলায় লোক সমাগম কম ছিল না। তবে গতকাল বর্ধিত দুই দিনের শেষ দিন লোক সমাগমের পাশাপাশি জমে ওঠে বিক্রিও। এতে করে সবাই ছিল খুশি।

বই মেলার অতীত ইতিহাস থেকে জানা গেছে এর আগে আরো তিনবার বই মেলার সময় বৃদ্ধি বা কমানো হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৯১ সালে মেলা হয় ২৩ দিন। ১৯৯৫ সালে মেলার সময় বাড়ে সাত দিন। এবং ১৯৯৬ সালে বৃদ্ধি করা হয় ছয় দিন। আর সর্বশেষ এবার মেলার সময় বাড়ে দুই দিন। এর মধ্যে ১৯৯১ সালে ঈদের কারণে মেলার সময় কমানো হয়। তবে ৯৫ এবং ৯৬ সালে রাজনৈতিক কারণে সময় বাড়ানো হয়। আর সর্বশেষ এবার বৃষ্টির কারণে সময় বাড়ানোর এ ঘটনা ঘটে।

কবি মাহফুজা অনন্যা বলেন, মেলায় এবার আমার ‘সোনালী অসুখ’ ও ‘কামার্ত নগরের কামিজ’ নামের দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বই প্রকাশিত হওয়ার সুবাদে প্রায়ই মেলায় এসেছি। অনেক সুহৃদ ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের সঙ্গে দেখা হয়েছে। আগামী মেলায় আবারো এ মিলনমেলা হবে। এতদিন মিস করব সবাইকে।

বইমেলার লিটল ম্যাগ চত্বরে ‘ক্ষ্যাপা’ স্টলে গিয়ে কথা হয় সম্পাদক পাভেল রহমানের সঙ্গে। তিনি  বলেন, ‘দুই দিন মেলা বাড়ানোয় আমরা বেশ উপকৃত হয়েছি। কারণ এর আগের চার দিন বৃষ্টিতে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছিল। সে হিসেবে এ দুই দিন সে ক্ষতি অনেকটাই পুষিয়েছি।’

মেলায় ৪ হাজার ৮৩৪টি নতুন বই : এবার মেলার তথ্যকেন্দ্রে নতুন বই জমা পড়েছে ৪ হাজার ৮৩৪টি। এর মধ্যে ১ হাজার ১৫১টিকে মানসম্পন্ন বই হিসেবে ধরা হয়েছে। বিষয়ভিত্তিক বইগুলোর মধ্যে রয়েছে গল্প ৭৫৭টি, উপন্যাস ৬৯৮টি, প্রবন্ধ ২৭২টি, কবিতা ১৬০৮টি, গবেষণা ৮০টি, ছড়া ১৪৮টি, শিশুতোষ ১৫০টি, জীবনী ১৬৭টি, রচনাবলি ১৫টি, মুক্তিযুদ্ধ ১১০টি, নাটক ৪৩টি, বিজ্ঞান ৭৭টি, ভ্রমণ ৮৫টি, ইতিহাস ৭৭টি, রাজনীতি ৩৩টি, রম্য/ধাঁধা ৩৭টি, কম্পিউটার ৫টি, ধর্মীয় ২৫টি, অনুবাদ ৩৮টি, অভিধান ৬টি, সায়েন্স ফিকশন ৪৫ এবং অন্যান্য ৩৩০টি। গতবারের মেলায় নতুন বই এসেছিল ৪ হাজার ৫৯১টি। গতবারের তুলনায় এবার ২৪৩টি বই বেশি প্রকাশিত হয়েছে। এবারো প্রকাশনার দিকে এগিয়ে ছিল কবিতার বই।

আর ২৭তম দিন পর্যন্ত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মোড়ক উন্মোচন মঞ্চে ৮২০টি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে। ৭৭০টি স্টল নিয়ে এবারের মেলায় ৪৯৯টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। এর মধ্যে প্যাভিলিয়ন ছিল ২৪টি।

এবারের গ্রন্থমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পরিসর ছিল ৩ লাখ বর্গফুট। এই অংশটি বিন্যাস্ত ছিল ৪টি চত্বরে। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ১০৪টি প্রতিষ্ঠানকে ১৫০টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৩৯৫টি প্রতিষ্ঠানকে ৬২০টি ইউনিট; মোট ৪৯৯টি প্রতিষ্ঠানকে ৭৭০টি ইউনিট এবং বাংলা একাডেমিসহ ২৪টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে ২৪টি প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দেয়া হয়। লিটল ম্যাগাজিন চত্বরে ছিল ১৫৫টি স্টল।

এবারের মেলার সার্বিক বিষয়ে মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ  বলেন, এবারের মেলা পরিকল্পনা মাফিক করতে পারায় আমরা সবচেয়ে বেশি খুশি। মেলার সময়সীমা দু্ই দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় বইপ্রেমীরা আরো বেশি আসতে পেরেছেন মেলায়। সেই সঙ্গে বিক্রিও ভালো হয়েছে। এবারের ছোটখাটো যেসব ভুল-ত্রুটি ছিল, সেগুলোকে কাটিয়ে উঠে আগামীবারের মেলা আরো সুন্দরভাবে করার প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেন বাংলা একাডেমির এ পরিচালক।

সূত্র: মানবকণ্ঠ ।


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান