এবিএম সোহেল রশিদের কবিতাগুচ্ছ
এবিএম সোহেল রশিদের কবিতাগুচ্ছ

মা যখন

পৃথিবীর প্রথম আলো ছোঁয় আমার নরম শরীর; নাড়ি কাটার ক্ষত, স্নেহের কাজলে আঁকে চোখ। শ্রাবণের কালো মেঘ ছিঁড়ে, উঁকি দেয় মায়ের মুখ; সে যে মায়াবি চাঁদের চেয়েও হাস্যোজ্জ্বল।
.
শিখিয়ে দেয়নি কেউ 'মা' উচ্চারণ, চিনিয়ে দেয়নি কেউ-ই মায়ের ওম, মায়ের কোল। চেনায়নি কেউ স্নেহ মুখর আশ্রয়, চেনায়নি কেউ সবচেয়ে নিরাপদ 'জননীর আঁচল'।
.
তোমরাই চিনিয়ে ছিলে সাদা ঝুঁটির কবুতর, চিনিয়ে ছিলে ব্যবচ্ছেদ করা রক্তাক্ত অন্তর। লেলিয়ে দিয়েছিলে হিংস্র শকুনের ভোর, তারায় তারায় রটালে বৃদ্ধাশ্রমের খবর।
.
সোহাগ করে বলতো মা, ' বোয়াম ভরে রাখবো আদর,' কপালে চুমু দিয়ে অভিমানী গলায় ' ভালো থেকো'। সারাটা বিকেল পায়চারী, কখন ফেরবো আমি, তেলের বোতল দিয়ে বলতো,' গায়ে মেখো।
.
শত চেষ্টায় ঘুম আসে না, তারাদের খুনসুটিতে। এপাশ ওপাশ, বিছানা কুরুক্ষেত্র! ঘামছি আমি প্রচণ্ড জ্বরে, এই শীতে। এমন সময় মা এসে, মাথায় বুলিয়ে দিত হাত। কপালে আলতো চুমোয় হেরে যেতো অসুখ, ঘুমাতাম সারা রাত।
.
মা যখন হাসপাতালের বিছানায়, মৃত্যুর প্রহর গোনে। মনটা চাইতো, বুকের সব গোলাপ, দেই সেখানে বোনে। কষ্টগুলো উড়ে উড়ে তেপান্তর দিক পাড়ি, থমে যাক পৃথিবীর সমস্ত মায়ের কষ্ট, আহাজারি।
.
এই প্রথম নিলাম কোলে তুলে, ঘুমন্ত চাঁদ; বরফ শীতল এক দেহ। সর্বস্ব হারিয়ে আমি এখন নিঃস্ব, দোহাই লাগে, বলো না কেউ, মা মৃত, নিয়ে যাও মরদেহ।
.
আতুর ঘরের শূণ্য ভিটায়, বড়ুই গাছের নীচে, ধানভানা ঘরে। এখনো মায়ের সুবাস, মায়ের ছায়া, দিব্বি নড়েচড়ে। জারুল ফুলের পাপড়িতে ভেসে, অপেক্ষার দাওয়ায় বসে। চাঁদের সাথে কানামাছি খেলতে যেয়ে স্বপ্নগুলো যায় ধ্বসে।

ভুলে যাই একাল সেকাল, ভুলে যাই জগৎ-সংসার, ডাকি মা, মা, মা। জানি খুলবে না অপেক্ষার দুয়ার, সবই এখন উপমা।

শৃঙ্খলের নোলক

.
আমার একটা কুঁড়েঘর ছিল
ঘরের ভেতর ছোট্ট নদী ছিল
নদীর দুটো ডালিমরাঙা পাহাড় ছিল
সে পাহাড়ের চূড়া, বাসন্তী উন্মাদনায়
ভ্রোমরের বৌচি খেলায় নীল হতো
টান টান নিশ্বাসে ভিসুভিয়াসের মতো
ঐশ্বরিক সুখের লাভা ঝরাতো।
.
একটি ছোট্ট উঠোন ছিল
ধনুক বাঁকা দিগন্তরেখার মাঝে
বারোমাস পূর্ণিমার চাঁদ থাকতো
ঘাটে বাঁধা মেঘনৌকায় বৃষ্টি ঝরতো
সে পানিতে ভিজিয়ে নিতাম স্বপ্নছবি
চিনে নিতাম নিভৃতে ব্যাথার পৃথিবী
.
গোলাপ পাপড়ির একটা বন্দর ছিল
এক চুমুকে পান করতাম দ্রাক্ষার কষ
ঘুচাতাম আড়ালে আবডালে আগুনতৃষ্ণা
পোড়াতাম হতাশার পরিত্যাক্ত চৌকাঠ
খুলে দেখতাম পাহাড় নদীর মধ্যবর্তী মাঠ
.
কিন্তু নদীটি ছিল অক্ষত এক মন্দির
প্রার্থণা হতো, উলুধ্বনি হতো, হতো না বিসর্জন
পাগল করা আগুন স্রোতে পদ্ম ফুটতো
ঢেউয়ের কুলকুল ধ্বনিতে কাশফুল হাসতো
রাজহাঁস ভেজতো না তার সোনালি পালক
পড়াতো না নদীর ভাজে শৃঙ্খলের নোলক

আমাকেই ভালোবাস
.
কুয়াশা ভেজা রাতে
ঝুলে থাকা বারান্দার এক কোনে
নিজের অস্থি-মজ্জা মেলে ধরে
বলতে চাই যে কথা
সে কথা তোমাকে স্পর্শ করবে?
নাকি তামাদি স্মৃতিকথা হয়ে
ঘুমুবে পুরনো বুকশেলফে।
.
তোমার টেলিপ্যাথির শুভাশিসে
বেশ ভালো আছি
একাকিত্বের পৃথিবীতে শুধু কি
দুজনারই বসবাস?
না-কী অন্য কারো ছায়া আছে!
.
বুকের ভেতর আগুন ঝড়ের তাণ্ডব
কেউ একজন খুব কাছে!
অথচ বাড়িয়ে দেয়নি বৃষ্টিমুখর হাত
সরিয়ে দেয়নি বিভীষিকাময় রাত
বলেনি একবারও ভালো থেকো
.
খুব জানতে ইচ্ছে করে এখনো কি
মেঘকালো চুলে চোখ দুটি ঢাকো
এখনো কি বজ্রপাতের ভীতিকর শব্দে
আমার পাষাণ বুক খোঁজ
না-কী নীল দীর্ঘশ্বাসের মালা গাঁথ
.
জানি না, সেদিনের আকুতি কী
এখনো সাদা বকের পলকে রাখ
সে চোখাচোখির দিনগুলো কী
ব্যথা সমুদ্রের নীচে, প্রাণভোমরাকে বলে
ভালোবাসো আমাকেই ভালোবাস।

হাসিমুখ

.
এসেছে নতুন শিশু, মুষ্টিবদ্ধ হাত
দেখ ঝলমলে চাঁদের আলোকিত রাত
আকাশে বাতাসে স্রষ্টার হাজারো নিয়ামত
সৃষ্টির সেরা মানুষ, নয় কোনো হীরে-জহরত।
.
মায়ের মুখে আলোর ঝিলিক, বুকে অমূল্য ধন
বাবার কোলে মেয়ে সন্তান, বেহেশতের আগমন
স্রষ্টার দান, চির অম্লান! তিনিই জগতের মালিক
সুখের সংসারে খুশির বন্যা, আনন্দ চারিদিক।
.
শতায়ু হোক, সুস্থ থাকুক, বয়ে যাক স্বস্তির উল্লাস
বাবা ও মা'য়ের হাসিমুখ, উজ্জ্বল থাকুক বারোমাস।


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান