ওয়াহিদ জালাল এর গুচ্ছকবিতা
ওয়াহিদ জালাল এর গুচ্ছকবিতা
আমার দাসত্বরীতি


আমি তো ভূমিহীন নই,
আমার জমিন তোমার বুক।
বিশ্বাসের লতা লকলক করে বাড়ছে,
কাঁচা কুয়াশার মাঝে দীর্ঘ হয় ইচ্ছের সকাল-বিকাল,
দৃষ্টি পাখির মতো উড়ে যায়।
তখন হিসেবের মতো ভুল হয় আমিত্বে।

আচ্ছা বলো তো, দেহের গতিভঙ্গি
প্রাণের আর্তির কাছে কেন অসহায়?
বেদনার উপশমেও যে বেদনা লুকানো থাকে,
সে খবর তোমার মতো ভালো আর কে জানতে পারে?
আমার মাঝে যে তুমি অবসানেে
একটু খাতিরও বুঝি করতে নেই ভিখিরীকে?

তবু ব্যর্থ এক ধারনা জাগে মনে,
তোমার প্রশংসার সান্নিধ্য যখন
মাটির আয়নায় নিজের মুখ দেখতে এসে
আমার ছায়াকে স্পর্শ করে,
তখন আমার দাসত্বরীতি যথেষ্ট মুগ্ধ হয়
সেদিনের হারিয়ে যাওয়া সর্বস্বের মাঝখানে।

আমি জানি,প্রণীর জিহ্বায়
আশার চেয়ে ভেসে যাওয়ার স্বাদই বেশি,
উদয় ও বিলয় শুধু দৃষ্টির বৈকুণ্ঠে চিরচেনা এক ইতিহাস,
অন্ধকার বলে কিছু নেই,
যদি বলি, তুমি আমাকে ভুল বুঝবে না,তাও জানি,
কেননা প্রতিদিনের অন্ধকারই শিক্ষা দেয়
অন্তের মোমবাতিটি অনন্তকাল জ্বালিয়ে রাখার।

বিনাশের জীর্ণ উপমা


তুমি প্রেমের চাঁদ, মনের আসমান
তোমাতে স্থায়ী, অন্ধকার কাছে বসে আছে
দেখে, চাঁদ খুব আশ্চর্য হওয়ার ভাণ করলো !
মাছের ঠোঁটে জমে থাকা চিরকালের কথার
মতোন রূহের পিপাসা অনুভবে মধুর ।

চাঁদ আঁধারের খড়ম পায়ে পরে হাঁটে
অত্যন্ত টেকসই মিহি বিরহের বাতাসে,
মাঝে-মাঝে যেমন করে শররতের বাতাস
কাঙাল করে দেয় ভিনদেশি স্বরের প্রতিধ্বনি,
তবু সারাংশের সুন্দরে জয়ী হয়নি প্রবাস ।

আমি চাঁদের আলো কুড়াব
বকুল ফুলের তাজা খুনে লিখবো ভালবাসি ।
আমি নদীর চরের কাঁচা পেক দিয়ে
তোমার নাম লিখবো মায়ের মমতার আদলে
দূরেত্বর কঠিন মাঝখানে ।

বাসনার মালায় ভাষার ফুলদ বড়োই অদ্ভুত
আন্দুয়া পুকুরের জলের মত তার মুখ !
মনে রেখো, স্হলকমল সেখানেই ফুটেছে
যেখানে পড়েছে তোমার দেহজ্যোতি, শুধু
আমিই গতিভঙের কারণে বিনাশের জীর্ণ উপমা ।

বাবার মাখা আতরের সুবাস


বাবা, আমি কোথায় যাবো? কার কাছে যাবো? বুকের ভেতর হু হু করে কান্না করছে তোমার মায়ায় ভেজানো সান্তনা।
এতোটা একা আমি খুব কমই হয়েছি তোমার শেষ নিদ্রার পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত, যতটুকু আজ সময়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বিচলিত করছে বর্তমান। সড়কের পাশে কষ্টের তসবিহ্ হাতে দাঁড়িয়ে ছিলাম, হঠাৎ নাকে এসে লাগল তুমি যে আতর মাখতে, সেই সুবাস। মাথা ঘুরিয়ে অসংখ্য মানুষের ভিড়ে তাকালাম, তোমাকে তো দেখিনি বাবা! তখন চোখ থেকে জল ফোঁটা ফোঁটা হয়ে পড়তে লাগলো। আমি তোমার বয়েসী মানুষের মুখের উপর চোখ রাখছি আর ভাবছি,তুমি বেঁচে থাকলে এই মানুষদের মতো এগিয়ে আসতে আমার দিকে। মলিন মুখটির দিকে তাকিয়ে বলতে, কি হয়েছে ওয়াহিদ, বাবা আমার? আর আমি তোমার বুকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে বলতাম, বাবা, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। মায়ের ও অসুখ,সব কথা বলতে পারিনা মাকে, তার অসুখের কথা ভেবে।তা হলে আমি আজ আর কার কাছে কষ্টের কথা বলবো মাবুদ?
বাবা.. ও বাবা...বাবা আমার খুব কষ্ট হচ্ছে ।

আত্মকাব্য

বৃক্ষের ছায়াপড়া ঘাসে
কবরটি শিশুর মতো ঘুমায়-
মাটির অসীম গ্রহণ ক্ষমতায়।
আমার পথও হেঁটে আসছে দেখো,
গন্তব্য জানালা দিয়ে দেখা যায় ।

দুই

আমি দুঃখকে সজ্ঞানে খুঁজি,
বিষপাত্র হই চির দুঃখ ছাড়া,
আপন হারানোর যন্ত্রণা ভালোবেসে
কষ্টকে বলি,তুই একটু নিজের হাতটা বাড়া।


সমবয়েসী কষ্টের চাদর


কেনো যে ফিরে আসি এখানেে?
উত্তর জানতে গিয়ে পায়ের তলায়
হুমড়ি খেয়ে পড়ে দীর্ঘশ্বাসটি,
সময় কতো কাত হয়ে তাকায়
আমার মুখের দিকে,
পরিস্থিতি ওলট-পালট হয়ে যায়,
শব্দের মতো আপন হয় শূন্যতা।

ভাবি, এখানে আসলে
পাখি কিংবা অন্যদের কাছ থেকে
পৃথক হলেও তোমার খবর জানতে পারবো।
এখানে এসেও এতো নিঃস্ঙ্গতা!
কি ব্যাকুল প্রতীক্ষা তবু মানুষের জন্য।
বেলা অনেকটা সর্বনাশ ঘটিয়ে ফিরে যায়।

কেন যে ফিরে আসি এখানে?
সমুদ্রের পিছনে প্রকৃতি দাঁড়িয়ে আছে,
স্বপ্নে প্রত্যাখ্যাত হবার বেদনা
জাগরণের কাছে গিয়ে দহনের জ্বালা
বহন করে নিয়ে আসে।
তাকে বিচ্ছেদ ভেবে মনের গভীরে
যে বাঁশিটি বেঁজে উঠে, তার নাম কি ভালোবাসা?
বাতাসের আলিঙ্গনে কেঁপে উঠে সবুজ ঘাস।

ভাবি, সময়ের উরু বেয়ে যে স্মৃতি ঝরে পড়ছে
তাাকে একবার স্পর্শ করে
সমবয়েসী কষ্টের উপর চাদর করে রাখি।
যদিও আজ আমরা চিরকালের জন্য নির্বাসিত,
এই মন শুধু তোমাকে ঘিরেই অজস্র কল্পনার
ইন্দ্রধনু রচনা করে গেলো,
অথচ আজ বেশি মনে পড়ে মানস সরোবরের গল্প।


তোমার হাসিতে মুগ্ধ আমি


হাজার মানুষের ভিড়ে যে স্টেশনটি
শূন্যতার স্রোতে ভেসে বেড়ায়
তার কাছে ভালবাসা বেতালে বেঁজে ওঠা সুর,
কতকাল আর ঘরে ফেরা হয় না ।
ছেলেবেলায় দেখা স্বপ্নগুলো পাখির পালকের মতোন
ঝরে পড়ে বুকের উঠোনে ।

তোমরা অন্যরকম ভাবো শূন্যতাকে!
মেহেদীর রঙের ওপর চোখের জল পড়লে
সে ও লাল হয়ে যায়,
একসময় ঝড়কে বিমূর্তভাবে হলেও আমরা ধরতে শিখি,
চোখ থেকে যে জল বেরিয়ে আসে তা কান্না নয়।
কান্না হলো, যে জল আত্মায় জোয়ার আনে।

এই বিষয়গুলো যতোই ভাবছি,
আমার ছায়ায় তখন বিলীন হচ্ছে অনন্তকাল,
ভূলুন্ঠিত হচ্ছে খুব চেনাজানা প্রিয়জনদের হামাগুড়ি!
ডাক দেয় মমতায় ব্যাকুল এক ফেরিওয়ালা,
তনুর ঝাঁপি খুলতে-খুলতে বলে;

মাটির নৌকারে.....
তোর কপাল বড় ভালো,
একটি ঢেউ একই ঠেলায় তোরে
এপার থেকে ওপার করে দিলো।

সৌরভে চিরকাল ভাসে


এভাবে বুঝি মনের পথে
পড়ে থাকে মানুষের ছায়া?
এভাবে বুঝি অভিমানী রাতে
মনে পড়ে কারো মায়া!

জলের গভীরে ভেঙ্গে যায় ঘুম,
সেই রাত্রির ভেজা বালিশে আজো
উঁঁকি মারে কারও চুলের গন্ধে অবুঝ শান্তনা,
ঘুম ভেঙ্গে যায় স্মৃতির পিঠে বসে।
দূর দিগন্ত ভুল করে যাওয়া,
তবু একটি মানুষের কামনা।

এভাবে বুঝি দূরের পথে
জল ভরা চোখে তাকায় কেউ?
এভাবে বুঝি নড়ে না আর
ভুলে যাওয়া প্রেম নদীটির ঢেউ!

দুই হাতে অরাজিগুলোকে ঢেকে রাখি,
মানুষজন্ম পেরিয়ে এসে শূণ্যতার ক্ষুৎপিপাসা
নিজের মতোন বুকে বাঁধে ঘর।
একাকীত্বের ঠোটের নিচে নগর ভেসে যায়।
ক্রমশ উজ্জল হয় অমলিন একটি হাসি,
বিখ্যাত শূন্যতায় যে আমারে করেছে অমর।


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান