সন্ধ্যায়, তারা
সন্ধ্যা, মানুষজন আধো অন্ধকারে ভেসে ভেসে কোথায় কোথায় যাচ্ছে!
এই তো দেখা যাচ্ছে লাল নিয়নের উপর সাদা করে লেখা ‘জিপিও’।
খুব নিঃসঙ্গ, স্ত্রীর মৃত্যুর পর মানুষ যেমন নিঃসঙ্গ হয়ে থাকে,
সেরকম নিঃসঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জিপিওর সামনে একটি গাছ।
ব্যস এটুকু হলেই মনে হয় বেঁচে যাই সন্ধ্যায়
একটি গাছ আছে এই দৃশ্যটি পুড়িয়ে বেঁচে যাই
দীর্ঘ নিঃসঙ্গতার কাঁপুনি থেকে।
আচ্ছা, পৃথিবীর গভীরতম বেদনার নাম কী? সেকি কোন নারীর উষ্ণ
ওড়না বা আঁচলের নীচেই থাকে? যেন স্নেহশীল সন্তান। একটু একটু
করে বড় হচ্ছেÑ অনেকের সঙ্গে মিশছে, সময় দিচ্ছে, নিচ্ছে।
নিঃসঙ্গ সন্ধ্যায় একটি সকাল এসে যদি হাজির হয়Ñ
যদি সকালের নাম হয় সবুজ ঘাসের সকাল অথবা
সে সকালের মুখে লেগে থাকে সমুদ্রের ফেনিল সৈকত;
তাহলে গভীর বেদনার ক্ষতে জাগবে গাঢ় সীমারেখা?
পৃথিবীর সকল নিঃসঙ্গতা থাকে সন্ধ্যার আধো অন্ধকারে?
সকল বেদনা কি কোন নারীর উষ্ণ ওড়না বা আঁচলের নীচেই থাকে?
আমার পিতার মৃত্যুসংবাদ
চালের জন্য লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে অনেক মানুষ
এই দৃশ্য বিড়ির মতো আমার কানে গুঁজে রেখে
অনেকটা পথ হেঁটে যাই। মনে হয় আমার পিতার
মৃত্যুর আশঙ্কা এরকমভাবে কানে গুঁজে অনেক পথ-উপপথ
পেরিয়েছি। বহু বহু দিন-রাত মনে হয়েছে আমার কানে
একটা বিড়ির মতো ঝুলে আছে আমার পিতার মৃত্যুসংবাদ।
কৃষকরা চারা রোপন শেষে কানের উপর গুঁজে রাখা বিড়িটা
পুড়ায়। পুড়িয়ে উপভোগের পায়তারা করে। এ উপভোগ
না ক্রোধ তা কে জানে। কে বলবে আমার পিতার মৃত্যুর
আশঙ্কা কানে ঝুলে থাকা আমার জন্য বেদনার ছিল, নাকি
তাকে হারিয়ে আমি অধিকতর বেদনায় ডুবে গেছি।
কোনকিছুর প্রকৃত উত্তর অন্বেষণ বাতুলতাই বোধ হয়।
তবু আমার পিতার মৃত্যুসংবাদ আমার কানে ঝুলে থেকে
সবসবময় শঙ্কায় ভাসিয়ে রাখতো অনেক দূর চলে যাওয়ার
পরও যেমন পাখিরা দিব্বি সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে আসে,
তেমনি আমার পিতার মৃত্যুর আশঙ্কা আমার কাছে ফিরে আসতো।
এখন আসে চালের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের মুখ।
ঘাড় নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক কবিতা
তোমার শরীর আমার ঘাড় নিয়ন্ত্রণ করে।
বারবার মনে হয় তুমি আমার ঘাড়কে ইচ্ছামাফিক
একবার ডানে, একবার বামে ঘুরাচ্ছ।
তোমার শরীর নকশীকাঁথার মতো এক বর্ণিল
আবহমানতা এঁকে, তাতে সবুজ, হলুদ, লালচে
বা এরকম নানা রঙ চারদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছ।
কোথাও মনে হয় একটি সাদা জুঁইফুলের মতো
একটি পুঁটিমাছ লাফ দিয়ে উঠলো। কোথাও
মনে হয় লাল সূর্য বা রূপালী চাঁদের মতো
ভিন্ন রঙের দুটা দুল তোমার দু’কানে দোল খাচ্ছে।
আচ্ছা, নদীর দুটা ব্যাপার আছে না, ঢেউ আর স্রোত
কিভাবে এগুলোর সৌন্দর্য শনাক্ত করা যায়। ঢেউ মানে কী...,
স্রোত মানে লাফিয়ে ওঠা কালো চুলের মনোহর বাগান।
অরণ্য মানে তোমার রহস্যময় এবং সঙ্কুল হৃদয়, নাকি?
সকালে তোমাকে দেখে মনে হয় আমি শুভ্রশরতে আছি,
তারপরই ঘুরে আসে বসন্তের বিপুল রঙ। তারপর কি?
বিকাল শেষে যখন সন্ধ্যা নেমে আসে তখন ফাঁকা মাঠে
নেমে আসা কুয়াশার মতো শুষ্ক শীত টের পাওয়া যায়
আর রাতে কখনও বৈশাখিঝড় বা বর্ষার ঝরঝর।
তাহলে হেমন্ত? ঐশ্বর্যের এ ঋতু যেকোন সময়ের।
অর্থাৎ তোমাকে ঘিরে ঋতুগুলো গোল্লাছুট খেলে
আর আমার ঘাড় নিয়ে তুমি খেলো হা-ডু-ডু।
সাদা পালকউড়ানো পাখি পানি ঘেঁষে যেমন উঠে যায়
তেমন তোমার শ্বেত ওড়না আমার মুখের উপর দিয়ে
অম্পর্শে অথচ স্পর্শের সম্ভাবনা ছড়িয়ে উড়ে যায়।
আমি বেদনাবিধূর হৃদয় নিয়ে ভাবি কতদিন
প্রকৃত তোমাকে পাই না, কতদিন প্রকৃত তোমাকে
মুগ্ধতা ও আকাঙক্ষা একসঙ্গে মালা বানিয়ে গলায়
জড়িয়ে দিই না।
তোমার বিছানার নাম সবুজ, তুমি সবুজ জড়িয়ে থাকো।
আমি সেই সবুজের কথা শুনে অবুঝের মতো
তোমার দিকে ছুটে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠি।
তুমি ঘাড় নিয়ন্ত্রণ করো মানে, তোমার ঐশ্বর্য
আমার ঘাড় নিয়ন্ত্রণ করে। একবার ডানে, একবার বামে।
আমি এভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করি
আমার পিতার ঘাড় তোমার শরীর নিয়ন্ত্রণ করতো,
আমার পিতামহের ঘাড় তোমার শরীর নিয়ন্ত্রণ করতো,
আমার পিতামহের বাবার ঘাড়ও তোমার শরীর নিয়ন্ত্রণ করতো।
ফলে আমি সানন্দে সবাইকে বলি, হে বাংলাদেশ
তোমার শরীর আমার ঘাড় নিয়ন্ত্রণ করে।
একবার ডানে, একবার বামে।
অপূর্ণতায় বেষ্টিত
পৃথিবীতে নীল অপরাজিতা নামে একটি উঠোন আছে
মনোহর, যার নীল গাঢ় হতে হতে কালচে হয়ে যায়;
যেন আলো খেলতে খেলতে সন্ধ্যার অন্ধকারে ডুবে গেল।
পৃথিবীতে পাতাঝরার ঋতু বলে এক সৌন্দর্য আছে
পাতা ঝরে ঝরে, ঝরে ঝরে, পাতা মরে মরে, মরে মরে
গহীন অরণ্যের ভেতর সৌন্দর্যের সৌধ বানিয়ে রাখে।
পৃথিবীতে ঢেউ নামে একটি আলোড়ন আছে, এই আলোড়নের
কথা মনে এলে সমুদ্রের প্রসঙ্গ আসে। মনে হয় সমুদ্রের ভূত্যের
নাম ঢেউ। বাসনা জাগে বলি, তুমি আমার কাছে আসো। দরজায়
ঠুকা দিয়ে বলো, এলাম। কেননা মুক্তির স্বাদ তো এখানে।
এইভাবে আমার অনেক মুগ্ধতম দৃশ্যের কথা মনে পড়ে এবং
তুলনার চেষ্টা করি তোমার মুখের নাম কি তাহলে মুগ্ধতর?
ওই যে কালো দুটা ঠোঁট, তা তো কোমরে ঝুলে থাকা কালো খাপ
তার থেকে কখন জানি ঝলকে ওঠে রূপালি হাসির তলোয়ার।
উপমা দিতে গিয়ে থামি, দৃশ্য সাজাতে গিয়ে থামি। মনে হয়
ওই যে নীল গাঢ় হতে হতে কালচে হয়ে যায়, পাতা
মরে মরে ঝরে বা ঢেউ দরজায় আসে না এর নাম অপূর্ণতা।
উপমা দিয়ে সাজানোর চেষ্টা করা যেতে পারে, কিন্তু
তাতে আসলে কতটুকুইবা চোখের প্রকৃত অবয়ব দাঁড়ায়?
তখন মনে হয় কবি হলো সেই বৃক্ষ, যে বৃক্ষ ঘিরে থাকে পাখির ঝাঁক।
কেউ মুগ্ধতা ছুড়ে মারলে একঝাঁক পাখি গান গেয়ে উড়তে থাকে
কেউ বেদনা ছুড়ে মারলে একঝাঁক পাখি উড়ে আর্তনাদ করে ওঠে।
কিন্তু এই তো শেষ নয়, এই তো পরিবেষ্টিত সকল পাখি নয়।
এইভাবে যত চেষ্টাই করো, সকল পাখিকে উড়ানো যায় না,
কবি মানে এক বৃক্ষ, যা পরিবেষ্টন করে রাখে একখাঁক পাখি
সুতরাং অপূর্ণতা থাক সব নয়, উড়ছে যেহেতু একঝাঁক পাখি।
কৈশোরকে, দর্জি দোকানে
বন মর্মরের ডাক। গহীন বনের ভেতর যে শান্তি ছড়িয়ে থাকে, তাই মৌমাছির মতো তোমাকে ঘিরে ধরে। তুমি ডুবে থাকো ঘিরে রাখা এক অমলধবল শান্তির প্রস্রবণে। এটুকু লেখার পর থামিয়ে দিলে। বললে এ কথাগুলো তোমার কৈশোরসংশ্লিষ্ট। তোমার কৈশোরকে নাকি আমি একটা সবুজ ট্রেতে করে সবার সামনে হাজির করলাম। তাই যদি হয়, তাহলে আমার কৈশোর; সে কোথায়? সে কি মগড়া নদী পেরুতে গিয়ে সাঁতার ভুলে হারিয়ে গ্যাছে? সে কি গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফিরে আসেনি? সে কি সবুজ কার্পেটের মতো মাঠের পোকা হয়ে সেখানেই রয়ে গ্যাছে? এমন সব প্রশ্ন লাউয়ের ডগার মতো মাথা তুলে তাকিয়ে থাকে।
এসব নিয়ে দর্জির দোকানে হাজির হই। গিয়ে বলি হেমন্তের ফাঁকা মাঠ, টুপটুপ শব্দে শিশির পড়ার রাত, তাল পরা ভাদ্রের দুপুর, পানিতে ভেসে বেড়ানো কলাগাছের ভেলা আর ধানগাছের ডগায় থাকা শিশির একসঙ্গে সেলাই করে দিতে। বলি এই টুকরো টুকরো দৃশ্যগুলো দিয়ে আমাকে একটা কৈশোর বানিয়ে দিতে। বলি আর ভাবি এমন একটা কৈশোর, যা আমার হয় আবার হয় তোমারও।