জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি বেঁচে থাকাটাই জীবন। যদি তা হয় মানবজীবন, তবে তার অর্থ হয় আরও ব্যাপক । কারণ মানুষ তা যাপন করে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোর অধীনে থেকে। আশা-আকাঙ্ক্ষা, পাওয়া-না পাওয়া, প্রেম-ভালোবাসা, বিরহ-মিলন, আনন্দ-বেদনা, জাগতিক-মহাজাগতিক এবং আরও বিবিধ ব্যাপার-স্যাপার জড়িয়ে থাকে মানুষের জীবনচর্যায়। একজন কবি ঐসব অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে বেড়ে ওঠেন বিধায়, তাঁর বোধে-চিন্তনে-মননে-ক্রিয়া-কর্মে, অভিজ্ঞতালব্ধ অভিজ্ঞানের প্রতিফলন দেখা যায়। ফলে কবির জীবন ও কবিতার মধ্যে তৈরি হয় এক প্রকার সম্পর্ক।
কবিকে কবিতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার সুযোগ নেই। কবিতার সঙ্গেই তাঁর ঘরবসতি। কবির চিন্তা-চেতনা, আনন্দ-বেদনা, অনুরাগ-বিরাগ, স্বপ্ন, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি বিষয়াবলীও কবিতার সম্পদ। তাই কবির আনন্দে কবিতা আনন্দিত হয়, কবির কষ্টে কবিতা কাঁদে, কবির আনুরাগে কবিতায় আসে প্রেম। পৃথিবীর অভিকর্ষের মতো কবি ও কবিতার মধ্যে আছে পারস্পারিক মহাজাগতিক আকর্ষণ। এই আকর্ষণ থেকে পরস্পরকে বিযুক্ত করা মানে কবি ও কবিতার মৃত্যু। সুতরাং এ কথা অকপটে স্বীকার্য যে, কবির জীবন মানে কবিতার জীবন। তাঁরা এক আত্মা একটি জীবন। কখনও তাঁরা একটি গ্রাম, একটি দেশ, একটি পৃথিবী। আবার কখনও শত-শতাব্দীর ইতিহাস। "এই স্বপ্ন এই ভোর প্রভাতের আলো" কাব্যে কবি মোহাম্মদ রফিক নিজের জীবনকে এই আলোকে চিত্রিত করেছেন।
১৯৪৩ সালের মহামন্বন্তরের সন্ধিক্ষণে মোহাম্মদ রফিকের জন্ম। সাতচল্লিশের দেশভাগ, বায়ান্নের ভাষা-আন্দোলন, আইয়ুবের সামরিক শাসন, বঙ্গবন্ধুর ছয়-দফা, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুথান, মহান মুক্তিযুদ্ধ, ১৫ই আগস্টের ট্র্যাজেডি, স্বাধীন বাংলাদেশে সামরিক আইন জারী ও পরবর্তী রাজনৈতিক পটভূমি এবং উদ্ভূত সামাজিক অস্থিরতার দোলাচালে আরও অনেকের মতো রফিক বেড়ে ওঠেছেন। আমরা তাঁর কবিতায় দেখতে পাই, বেড়ে ওঠা কালের অভিজ্ঞতা ও কবি মানসের শৈল্পিক রসায়ন। এই কাব্যে তাঁর জীবনালেখ্যের ছায়াপাত দেখা গেলেও এটিকে নিরেট আখ্যানধর্মী কাব্য বলা যায় না। বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগকে বলা হয় আখ্যানধর্মী কাব্যের যুগ। প্রেম, ধর্ম-পুরাণ, দেবদেবী, ইতিহাস, লোককথাকে উপজীব্য করে ঐসব কাব্য রচিত হয়েছে। একটি স্থিরকৃত কাঠামো অনুসরণ ছিল এগুলোর আঙ্গিকগত বৈশিষ্ট্য। কাব্যের শুরুতে থাকত বন্দনাগীত ও কবি পরিচিতি, আর কাহিনিতে থাকত খন্ডভাগ। রফিক ঐ পথে হাঁটেন নি। তাঁর কাব্য-কাঠামোতে একটা ভিন্নতা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। সাম্প্রতিক কাব্য-কাঠামো বিচারে তা কতটুকু যুক্তিযুক্ত সে ব্যাপারে তাঁর সংশয়ও ছিল। স্বীয় মনোভাব প্রকাশ করতে গিয়ে রফিক বলেন, "কোন স্থির এবং প্রচলিত কাঠামো অনুসারে বেড়ে ওঠতে বা জীবন ধারনে ব্যর্থ হতে বাধ্য হল এই লেখা। আশা রইল, সে যদি কোন নতুন কালের দিশা বা নির্দেশনা অনুসারে কোনকালে আপন স্বভাবে বেড়ে ওঠতে সক্ষম হয়, ধরে নেব আমার অক্ষম প্রয়াস একটি দিকচিহ্ন হয়ে রইল।"
এই গ্রন্থে কবিতার ক্রম অনুসারে ২৩৩টি কবিতা আছে। ৩৮ নম্বর ক্রমিকে রয়েছে আরও ৩৩টি কবিতা। ব্যঞ্জনবর্ণ দ্বারা সেগুলো চিহ্নিত আছে। তবে বর্ণের ধারাবাহিকতা মানা হয় নি। 'ক' থেকে 'স' বর্ণ পর্যন্ত কবিতাগুলো একক পরিবারভুক্ত হলেও এদের মধ্যে একটা বিচ্ছিনভাব আছে। যদিও এগুলো খণ্ড খন্ড ঘটনার চিত্র, তদুপরি এক দুরাত্মীয় সম্বন্ধ নিহিত রয়েছে এদের মধ্যে। ৭৯ নম্বর ক্রমিকে আছে ১৩টি কবিতা। 'অ' থেকে 'ঔ' বর্ণ দ্বারা ১১টির নামকরণ আছে, বাকী দুটির শিরোনাম যথাক্রমে 'ঃ' ও 'ং'। ১১১ নম্বর ক্রমিকে কবিতা আছে দুটি, এদের শিরোনামে আছে সংখ্যা, যথাক্রমে '১' ও '২'। ২১৬ নম্বর ক্রমিকে কবিতা আছে ৪টি। এগুলোর শিরোনামে আছে ব্যঞ্জনবর্ণ। রফিক এখানে কবিতা নিয়ে বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। আসলে কবিতা হচ্ছে ধ্রুপদী সাহিত্য। এর রয়েছে কুলীন মর্যাদা। তাঁর জীবন কাহিনি ভিত্তিক এই মহাকবিতা সেই কৌলীন্যে যুক্ত করে এক নতুন প্রকরণ।
রফিক মন ও মননে আধুনিক। আধুনিকতার নবায়নেও তিনি অধিক মনযোগী। বিজ্ঞানমনস্ক বিধায় কবিতার প্রগতিতে বিশ্বাসী। অর্জিত অভিজ্ঞতার সাথে আপন মেধার সংযোগ ঘটিয়ে তিনি কবিতা সৃষ্টি করেন। প্রথম কবিতাতে আমরা দেখি ম্যাজিকের মতো নাটকীয় চমক, আর কবির কাজ হচ্ছে নতুন নতুন চমক সৃষ্টি করা। এই চমকের মধ্যে আছে রফিক পাঠককে কোথায় নিয়ে যেতে যান তার পূর্বাভাস। এখানে আমরা একটা জনপদের ধারনা পাই, যেখানে একটি তেঁতুল গাছ দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশ ঘেঁসে মানুষ যাতায়াত করে, নারী-পুরুষে দেখা হয়, কথা হয়। রফিক বলেন, তেঁতুল গাছটি মুক, আবার কথাও বলে। এই জায়গায় এসে পাঠকের মন একটা ধাঁধার মধ্যে উপনীত হয়। পাঠক পতিত হয় মুক ও বাকশক্তি সম্পন্ন তেঁতুল বৃক্ষের মাঝামাঝি এক দ্বান্দ্বিক আবহে। এই সহজ আয়েসে পাঠককে নাড়িয়ে দেয়ার কৃতিত্ব রফিককে দিতেই হয়।
আমরা জানি বৃক্ষের প্রাণ আছে, কিন্তু বাকশক্তি নেই। রফিকও তা ভালোভাবেই জানেন। কিন্তু কবি যখন বলেন এই বৃক্ষ কথা বলে, সেটি আর সাধারণ বৃক্ষ থাকে না। তখন তাকে মনে হয় এক মহাজাগতিক বৃক্ষ, যেটি কালের সাক্ষী, মানুষের সুখ-দুঃখের সাক্ষী, এমন কী সাক্ষী ইতিহাসেরও। এখানে এক পরাবাস্তব আবহ সৃষ্টি করেন রফিক।
"একটি প্রাচীন বৃক্ষ/মুক। কথা বলে না। বলে না। বলে।" (কবিতা-১)
রফিক বস্তুকে দেখেন নিরাসক্ত দৃষ্টিতে। তবু তাঁর সংবেদনশীল সত্তাতে এর ছায়াপাত ঘটে। তাই বস্তুজগতের সাথে তৈরি হয় তাঁর সম্পর্ক। সেখানে তিনি বেড়ে ওঠেন পায়ে হেঁটে, রিক্সা-নৌকায় চড়ে, গ্রামের পাশ ঘেঁসে চলে যাওয়া ট্রেনের শব্দ শুনে। তাঁর বালক মনে প্রশ্নও জাগে, এই ট্রেন কোথায় যায়, কত দূরে, তাদের গ্রামের মত সেখানেও কি ভোর হয়, কৃষকেরা চাষ করে জমি। কিন্তু এই দৃশ্য আসক্তি তাঁর মনে স্থায়ী নীড় বাঁধে না। দাদি এসে যখন অসুস্থ গোরুর সংবাদ জানায়, তৎক্ষণাৎ দিবানিদ্রা-ভেজাস্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে রফিককে দেখি এক দায়িত্বশীল বালকের ভূমিকায়। আসন্ন পরিস্থিতি সামাল দেবার একটা মানসিক প্রস্তুতিও লক্ষ্য করি।
"গোরুটা অসুস্থ খুব, দেখেছি ভোরেই/ মনে হয় মারা যাবে, তোর দাদা কীভাবে সামাল দেবে!/ চটে যায়, বালকের দিবানিদ্রা, ভেজাস্বপ্ন, দেখে,/ দাদি মুছে নিল চোখ, ধুতির কোনায়।" (কবিতা-২)
গ্রামীণ সমাজ-বাস্তবতা নির্মাণে রফিক সিদ্ধহস্ত। তিনি গ্রামকে গ্রামের মতই দেখেন। কোন প্রকার কৃত্রিমতা তাঁকে স্পর্শ করে না। গ্রাম তাঁর কাছে স্থবির। শতাব্দীর পর শতাব্দী এর তেমন পরিবর্তন নেই। গ্রামের অধিকাংশ মানুষের করার মত কাজও থাকে না। সময় সম্পর্কে তারা যথেষ্ট সচেতনও নয়। এক প্রকার গড্ডালিকা স্রোতে ভেসে ভেসে কেটে যায় তাদের জীবন। রফিকের দৃষ্টিতে এটা কোন জীবন নয়। তারা যেন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এক একটি পাথর খন্ড, যেখানে লাবণ্য নেই, এমন কি নেই কোন মহৎ কীর্তি। তারা কেবল বেঁচে থাকে মাত্র। রফিক তাঁর ভাইদের নিয়ে অনুরূপ একটি চিত্র এঁকেছেন।
"সময় বাড়ে না, থমকে আছে শতাব্দীও, ক্ষয়ে আসা তেঁতুলের ডালে/ চৌ-মাথায়; এক, দুই, তিন, চার দাদা পাশাপাশি রোদ্দুর পোহায়/ শীতের সকালে, এদের তো ঋতু নেই, নেই ঘন্টা, দিন রাত,/ অচিন প্রস্তর খন্ড, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ধরে আছে, এক একটি জীবন।" (কবিতা-৩)
রফিকের শিশু ও বালক বেলার কথা জানা যায় ৫ নম্বর কবিতা থেকে। বাবার অনুপস্থিতি ও আগমন প্রত্যাশা শিশুমনে কীরূপ প্রভাব পড়ে, তা চমৎকার ভাবে তুলে ধরেছেন তিনি। শিশু চিত্তের অস্থিরতা নির্মাণে তাঁর দক্ষতা প্রশংসার দাবী রাখে। কর্মসূত্রে তাঁর পিতা পিরোজপুর অবস্থান করতেন এবং সপ্তাহান্তে প্রত্যাবর্তন করতেন বাড়িতে। এই এক সপ্তাহ শিশু রফিকের মনে হত অনেক দীর্ঘ সময়। ফলে বেড়ে যেত তাঁর অস্থিরতা ও উৎকণ্ঠা। বারবার পুকুরঘাটে আসা-যাওয়া ছাড়াও উদগ্রীব হয়ে থাকতেন বাবার র্যালে সাইকেলের শব্দ শুনার জন্যে। এভাবেই রফিক শিশু থেকে বালক হয়ে ওঠেন। বেরিয়ে পড়েন পৃথিবীর পথে, বাবার সাইকেলে পিছনে চড়ে বসেন, বলেশ্বরের উত্তাল ঢেউ পেরিয়ে ইস্কুলে যান, ক্রমে তাঁর সামনে জেগে ওঠে একাত্তর। রফিক এইসব কিছুর মধ্য দিয়ে দাঁড়িয়ে যান অনাগত দিনের মুখোমুখি।
মানব ইতিহাসে মধ্যযুগ ছিল অন্ধকারের যুগ। রফিক স্থবির গ্রামের তুলনা টানেন মধ্যযুগের সাথে। কেননা তাঁর গ্রাম অনগ্রসর। এখানে নেই উন্নয়ন, নেই তেমন কোনো পরিবর্তন। গ্রামের মাঠে-ঘাটে, বট-তেঁতুলের শাখায়, পানাপুকুরের জলে, আকাশে, তেপান্তরে সন্ধ্যায় যে অন্ধকার নেমে আসে, রফিক তাতে দেখতে পান মধ্যযুগের ছায়া। শুধু তাই নয়, এখানকার পথে-ঘাটে, ঝোপেঝাড়ে তাঁর শৈশবও পড়ে থাকে। যদিও শৈশব তাঁর কাছে মৃত, তাই অতীত নয় তিনি বর্তমানে থির হতে চান। তবু মৃত শৈশবকে তিনি খোঁজে বেড়ান অতীতে, বর্তমানে এবং ভবিষ্যতে। অবশেষে তিনি দেখেন আকাশ মর্তের মাঝামাঝি তাঁর শৈশব ঝুলে আছে শূন্যতায়। রফিক বলেন, এ ছিল তাঁর জীবনের প্রমত্ত পরিহাস। কিন্তু জীবন থেমে থাকে না, এগিয়ে চলে। সন্ধ্যার শেষ লগ্নে তিনি শুনতে পান 'বউ কথা কও' পাখির ডাক।
সমাজ ও শ্রেণীচিন্তা রফিকের মানস জগতে সর্বদা ক্রিয়াশীল। বিভিন্ন শ্রেণীচরিতের মানুষ, তাদের পেশা ও জীবন-জটিলতা, সময়কাল সূত্রে অনুপ্রবেশ করে তাঁর কবিতায়। খালেকের বেটি চারু, তার ইতরবিশেষ বেশ্যার দালাল স্বামী, খালেকের চিরদুখিনী বউ জুরু মত নারীদের সাথে আমাদের পরিচয় ঘটে তাঁর কবিতার মাধ্যমে। রফিককে বলা যায় তাদের অভাব-অনটন, মিলন-বিচ্ছেদ, প্রেম, আত্মদান, ক্লেদ-ক্লান্তি, ভাঙ্গাগড়া জীবনের নান্দনিক রূপকার। তাঁর জীবন দর্শনের প্রকৃত উপলব্ধি হলো, এইসব মানুষেরা একে অপরের নিত্যসঙ্গী হলেও, তাদের মাঝে অসীম শূন্যতা বিরাজমান। তারা কেউ কারো নয়, তবু পরস্পর পরস্পরের খোঁজ নেয়, আবার ঘরও বাঁধে।
পাগল নূর আলির চরিত্রও আমাদের ব্যথিত করে। রফিক এই চরিত্রের আড়ালে সমাজের নৈতিক অধপতিত মানুষদের প্রতি এক সতর্ক বার্তা দিয়েছেন। নূর আলির বাবার নাম ঘোড়া কাসেম, পেশায় সিঁদেল চোর। জন্মের সময় নূর আলির মা মারা যায়। চুরিকর্মে ঘোড়া কাসেম শিশু পুত্রকেও সঙ্গে রাখত। একদিন গভীর রাতে চুরিকর্ম শেষ করে ফিরে আসার পথে নূর আলি শঙ্কিত হয়ে মাকে ডাকতে থাকে। এই ঘটনার সপ্তাহখানেকের মধ্যে নূর আলি পাগল হয়ে যায়। সে পথে পথে ঘুরে ডাক দিয়ে বলে যায়, হেইও, সাবধান। পুত্রের এমন করুণ বিপর্যয়ে মনকষ্টে পিতারও মৃত্যু ঘটে।
এই টুকরো গল্পটিতে নূর আলি কাকে সাবধান করে ; তার পিতাকে, না গ্রামবাসীকে ? রফিক আমাদের দাঁড় করিয়ে দেন এই প্রশ্নের মুখোমুখি। আসলে তিনি একটি ম্যাসেজ দিতে ছেয়েছেন সেইসব মানুষদের উদ্দেশ্যে, যারা সমাজে চরমভাবে অধপতিত। আমরা জানি, আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার শাখা-প্রশাখা ঘুষ ও দুর্নীতির ভারে জর্জরিত। সমাজে চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, গুম, খুন, ধর্ষণ দেদারছে ঘটে চলেছে। মানুষের মূল্যবোধ ক্ষয় হতে হতে তলানিতে নেমে গেছে। এই বাস্তবতায় রফিক নূর আলি চরিত্রকে নির্মাণ করেন সতর্ক সংকেত হিসেবে। কারণ কবিরাও সামাজিক জীব। সমাজের প্রতি রেয়েছে তাঁদের দায়িত্ববোধ। রফিক তাঁর দায়িত্ববোধ উপেক্ষা করেন না, বরং তাঁর কবিসত্তা নিবিষ্ট চিত্তে তা পালন করেন। তাঁর মধ্যে যে সমাজ-চেতনা ও দায় শোধের সুতীব্র প্রয়াস আছে, এখানে আমরা তাই লক্ষ্য করি। (কবিতা-৭)
রফিক লোকজ ঐতিহ্যকে ধারণ করেন স্বীয় আত্মায়। পুরাণ, লোক আখ্যান, ইতিহাস, উপন্যাসের চরিত্রগুলো বারবার ফিরে আসে তাঁর কবিতায়। কিন্তু তিনি অত্যন্ত সচেতনভাবে তাদের উপস্থাপন করেন নব-রূপে, নব-বিন্যাসে। তাঁর প্রয়োগ দক্ষতায় তারা হয়ে ওঠেন সমাজেরই অচ্ছেদ্য অংশ। রফিক বলেন, লখিন্দর-বেহুলা, চাঁদ সওদাগর, শিব, মা মনসা, মহুয়া-নদ্যার চাঁদ, বসন-নিতাই ও কুবের-কপিলা কোন একসময় তাঁদের গ্রামে বাস করত। কিন্তু ঝড়-প্লাবণ, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সমুদ্রের উম্মত্ততা এই গ্রামকে করেছে ছিন্নভিন্ন। সেই বর্ধিষ্ণু গ্রাম আর নেই, কেবল টিকে আছে তার নিশানাটুকু। রফিক সেখানে আত্মপরিচয় খোঁজে বেড়ান। (কবিতা-৩৮/ট)
প্রেম রফিককে স্পর্শ করে। তবে আত্মহারা নন তিনি। নিয়ন্ত্রিত সংযমের প্রকাশ দেখা যায় তাঁর মধ্যে। কিন্তু তাঁর প্রেমিকা নিতান্ত অবুঝ। গ্রীষ্মের অবকাশে প্রেমিকার সাথে দেখা করার প্রতিশ্রুতি দেয়ার পরও, এই সাময়িক বিচ্ছেদে তাঁর প্রেমিকা এনড্রিন খেয়ে মৃত্যুকে বেছে নেয়। তারপরও রফিক বিরহকাতর নন। বরং তাঁর ভেতরে জন্ম নেয় এক ধরনের আক্ষেপ। আবার তিনি স্মৃতিভ্রষ্টও নন। জনম জনম পার করেও তাঁর মনে পড়ে প্রিয়তমার কথা। (কবিতা-১১)
মোড়লের ছেলে ও দিনমজুরের মেয়ের প্রেমও রফিক অতি আবেগ-উচ্ছ্বাস দ্বারা অনুভব করেন নাই। প্রেমের টানে তারা ঘর ছাড়ার পর, তাদের প্রেমকাহিনি প্রকাশ হয়ে পড়ে এবং জীবন দানের মধ্য দিয়ে হয় উভয়ের শেষ পরিণতি। এখানে তিনি লাইলী-মজনুর প্রেমের তুলনা টেনে প্রশ্ন তুলেন, তারা 'লাইলী নয়, মজনুও নয়', তবে কেন তাদের জীবন দিতে হল। (কবিতা-১৬)
চূড়ান্তভাবে রফিক দেহ কিংবা আত্মাতে সমাধান দেখেন না। তিনি সমাধান খোঁজে পান প্রেমে। কেননা প্রেম তাঁর কাছে এক অপার রহস্য।
প্রেমের সাথে নারীর সৌন্দর্যের দিকটিও এসে পড়ে। কবি যদি আবেগ দ্বারা তাড়িত হয়ে নারী সৌন্দর্যের বর্ণনা দেন, তাতে এক প্রকার উচ্ছ্বাস ও অতিসজ্জ্য দৃশ্যমান হয়। পদ্মাবতীর রূপের বর্ণনায় আলাওলের মধ্যে সেই প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। করিমন্নেসার সৌন্দর্য বর্ণনায় রফিকের মধ্যে দেখা যায় পরিমার্জিত রুচির ছাপ। তিনি পরি, অপ্সরা, শুকতারা এই তিনটি শব্দ দ্বারা করিমন্নেসাকে অপরূপা করে তুলেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর শব্দ নির্বাচন ও প্রয়োগ দক্ষতা প্রশংসার দাবী রাখে। তিনি শুধু করিমন্নেসার সৌন্দর্য বর্ণনা করে থেমে থাকেন নি। তার সৌন্দর্যের বিপরীতে পুরুষ চরিতের এক সূক্ষ্ম দিকও স্পষ্ট করেছেন। করিমন্নেসা অবিশ্বাস্য সুন্দরী হলেও তার জন্ম-পরিচয় ছিল না। কিন্তু পুরুষদের মনে সুন্দরী নারীকে লাভ করার যে তীব্র বাসনা থাকে, তখন তাদের কাছে ঐ নারীর জন্ম-পরিচয় বিচার গৌন হয়ে পড়ে। রফিক বলেন-"কে বাপ কে বা মা অবিশ্বাস্য সুন্দরের/ থাকে না, গোনে না কেউ বংশ পরিচয়/ ফুটে ওঠে, একা-একা, গভীর জঙ্গলে, পাপড়ি মেলে/ জনমানুষের দীর্ঘশ্বাস ভর করে" (কবিতা-১৫)।
মানবজীবনের সাথে জড়িয়ে আছে বিভিন্ন উৎসব। রফিকের গ্রামেও উৎসব হয়। তিনি উৎসবকে দেখেন সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে। তাই তাঁর গ্রামে ফরিদা-মজিদ ও তাপস-কৃষ্ণার বিয়েতে লোকজ বাদ্যযন্ত্র ঢাক-ঢোল, কাড়া-নাকড়ার শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠে। শিশু-কিশোরদের হইচই, রঙ-তামাশাও চলে। এমন উৎসব আনন্দ পাখিও বোঝে, তাই আলো-অন্ধকার ভেঙ্গে ডেকে ওঠে বেনে বউ পাখি। রফিক বলেন-"আজ গাঁয়ে বিয়ের উৎসব।" (কবিতা-১৪)
রাখিবন্ধন উৎসবের বর্ণনা আছে ১২৪ নম্বর কবিতায়। এই উৎসবকে ঘিরে হিন্দুদের মহল্লায়, হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ছেলেমেয়ে, যুবক-যুবতী, এমন কি বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা পর্যন্ত ভিড় করে হৈ-হুল্লোড় করছে। নতুন নতুন সাজে, পায়েসের ঘ্রাণে সবাই মাতোয়ারা। রফিকের দৃষ্টিতে এটি শুধু রাখিবন্ধন নয়, এটি প্রাণের উৎসব। অসাম্প্রদায়িক বাঙালি মানস চরিত চমৎকারভাবে বর্ণিত হয়েছে এই কবিতায়। কিন্তু রফিক শংকামুক্ত নন। তাঁর আশংকা, অনাগত দিনে কুচক্রিমহলের ষড়যন্ত্রে এই সম্প্রীতি হয়ত থাকবে না।
"একদিন, অচিরেই, এই রাখি ভেসে যাবে রক্তস্রোতে,/ সেও প্রাণবন্যা এক, জিঘাংসার, বোধহীন নারকীয় হত্যাযজ্ঞ;/ অভিসার, অভিশাপ, আমি দেখি, আর ভেবে, কিনারা না পাই/ কালের খেয়াল, অভিশাপ, না অন্য কোনো বা গুটি চালাল কেউ,"
প্রকৃতির সাথে ঋতুর একটা সম্পর্ক আছে। আবার ঋতু কবির মনোজগতে বারবার দোলা দিয়ে যায়। বিশেষ করে বর্ষা কবি হৃদয়ে প্রবল প্রভাব বিস্তার করে আছে। আর বর্ষা মানেই তো বৃষ্টি। বৃষ্টির সাথে মানব মনের যে অদৃশ্য সম্পর্ক, তা কবির অনুভবে ধরা পড়ে বিভিন্ন উপমা-রূপকে। রবীন্দ্রনাথ বৃষ্টির সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক নির্মাণ করেন। বৃষ্টি ও রবীন্দ্রনাথ যেন এক আত্মা। নজরুল বৃষ্টিকে দেখেন 'বাদলের পরি' হিসেবে। আর রফিকের বৃষ্টি এক 'তরল আঁধার'। এই তরল আঁধারে যেমন আছে দুর্ভোগ, তেমনি আছে সুখানুভুতিও। রফিক তাদের নাম দেন 'অন্যসুখ', 'অন্যদুঃখ'। অর্থাৎ মানুষের স্বাভাবিক সুখ-দুঃখের সাথে বৃষ্টির কারনে অর্জিত সুখ-দুঃখের কোন তুলনা চলে না। মানবজীবনে বৃষ্টির প্রভাব এক সত্যবদ্ধ ফ্রেমে বাঁধাই করে রাখলেন রফিক। "একবার ছেয়ে যায়/ ধুম বৃষ্টি। একবার বান। ফের অন্যসুখ, অন্যদুখ,"(কবিতা-২৭)
রফিক একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি মনে করেন না মুক্তিযুদ্ধ হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোন ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধকে ইতিহাসের খন্ডিত অংশ বলেও তিনি বিবেচনা করেন না। তিনি মনে করেন সাতচল্লিশের পটপরিবর্তনের ভেতর মুক্তিযুদ্ধের বীজ নিহিত ছিল। রফিকের মধ্যে রেয়েছে প্রবল ইতিহাস চেতনা। তাই দেশভাগ পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনাবলীর উত্থান-পতনের ইতিহাস তিনি অপসৃত হন না। বরং তাঁর চেতনায় তা নিয়ত সঞ্চরণশীল। তিনি দেখেন মুক্তিযুদ্ধের হাওয়ায় তাঁর গ্রাম পাল্টে যেতে এবং মানববসতিতে পরিবর্তন ঘটতে। রফিক বলেন, "সাতচল্লিশ থেকে বা চুয়ান্ন/ বা চুয়ান্ন থেকে একাত্তর/ কালের বিচার নয় অনন্ত, অসীম/ দূর পাড়ি, আমি দেখি, শুনি, তবু যেন/ পাল্টে গেল এই গ্রাম, মানববসতি," (কবিতা-৭৯/আ)।
কিন্তু যুদ্ধ পরবর্তী কাঙ্ক্ষিত প্রত্যাশা অর্জিত না হওয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অবহেলা, অবজ্ঞা ও তাদের পরিণতি রফিককে ব্যথিত ও ক্ষুদ্ধ করে তুলে। তাঁর হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করে স্বপ্নভঙ্গের মনোবেদনা।
"পলাশিতে পরাজিত, একাত্তরে বিজয় মিছিলে"-এই বক্তব্য রফিকের। তাই যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের জন্য তাঁর হৃদয়ে ছিল এক ঢেউ শুভেচ্ছা। তাঁর স্বপ্নজুড়ে ছিল একটি স্বাবলম্বী বাংলাদেশ। কিন্তু ৮০ নম্বর কবিতাতে দেখা যায় তাঁর স্বপ্নভঙ্গ হতে। কালের পরিক্রমায় তিনি দেখলেন, মুক্তিযোদ্ধা সমিরের পোলা তার অস্ত্র পানাপুকুরের তলে লুকিয়ে রাখতে। রফিক উপলব্ধি করেন, হয়ত সেই অস্ত্র কোন একদিন আবার কাজে লাগবে। কিন্তু কি সেই কাজ ? তা কি কোন অনাগত বিপ্লব না মুক্তিযোদ্ধার আত্মবলিদান! তাঁর এই জিজ্ঞাসার ভেতর যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের বাস্তব চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
স্মৃতিরোমন্থনে আছে সুখানুভূতি, আছে দুঃখের অনুতাপও। আবার কেউ কেউ হয়ে পড়েন স্মৃতিকাতর। রফিক স্মৃতিকাতর নন। স্মৃতি তাঁর কাছে সুখের জীবন। তাঁর মধ্যে স্মৃতির তাড়না যেমন আছে, তেমনি আছে বিস্মৃতির অনুতাপ। তাই তিনি স্মৃতি হারাতে চান না। জোর করে ধরে রাখেন কিছু স্মৃতি, কিছু মানুষের মুখ। রফিকের স্মৃতিসুখ ওঠে আসে তাঁর কবিতায়। "স্মৃতি নয়, সুখের জীবন। জোর করে ধরে রাখি/ দু-একটা মুখ, আনোয়ারা, কৃষ্ণা, গীতা, সাঁঝবাতি, হ্যারিকেন,/ আলো-ছায়াতে ফেলে যাওয়া দূর চকিত হাসির মৃদুরেখা।" (কবিতা-৩০)
২১০ নম্বর কবিতায়ও দেখা যায় গভীর রাতে রফিকের মনে মা-বাবার স্মৃতির উদয় হতে। কিন্তু একটি মুহূর্তের জন্যও তিনি তাদের ধরে রাখতে পারেন না। তবু তাঁর মধ্যে কোন প্রকার কাতরতার লক্ষণ দেখা যায় না। শুধু নির্বিকার ভাবে চেয়ে থাকেন।
রফিকের কবিতা রূপকাশ্রয়ি। তবে এই কাব্যে প্রচুর চিত্রকল্পের কাজও আছে। আমরা দুটি চিত্রকল্প পাঠকদের উদ্দেশ্যে নিবেদন করছি।
১। "শব্দ হয়েছিল/ বন্ধুকের রাইফেলের/ কোন কালে, শতাব্দী পেরিয়ে/ গুলিবিদ্ধ ধলি বক/ উড়ে এসে, পড়ল আজ/ দক্ষিণের বাঁওড়ে!" (কবিতা-৩৮/ঘ)
২। "এইমাত্র শিয়াল দৌড়ে গেল/ আমার বুকের খাঁচা ভেঙ্গে/ মুখে মুরগির ছানা/ তড়পাচ্ছে তখনও প্রাণপণ" (কবিতা-৩৮/ঢ়)
রফিক বলেন, "কবির হৃদয় একটি গ্রাম"। গ্রাম কেবলই গ্রাম তা নয়। গ্রাম একটি দেশ, একটি পৃথিবী। রফিক নিজ গ্রামকে দেখেছে হৃদয় দিয়ে, এবং পর্যবেক্ষণ করেছেন বাস্তবতার আলোকে। তাঁর গ্রামে আমরা পেয়েছি মুখরিত লোকালয়, দেখেছি মানুষের জীবন-মৃত্যু, প্রকৃতির তান্ডব ঝড়, প্লাবণ, সমুদ্রের আক্রোশ, অভাব, দুর্ভিক্ষ ও ভুখা মানুষের আর্তনাদ। এই গ্রামের আছে গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, আবার মুক্তিযোদ্ধাদের অমাণবিক পরিণতি। এখানে আমরা দেখতে পাই মানুষের প্রেম-ভালোবাসা, বিয়ে, বিচ্ছেদ, উৎসব ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। আশা-হতাশা, স্বপ্ন এবং স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে এই গ্রামে মানুষের শত-শতাব্দীর বসবাস। এই শত-শতাব্দীর অন্ধকারে ঢাকা পড়া গ্রাম নিয়ে রফিক স্বপ্ন দেখেন, একদিন তাঁর গ্রামে নেমে আসবে ভোর প্রভাতের আলো।
২১৮ নম্বর কবিতাতে রফিক স্বীকারোক্তি করেন, এই কাব্য তাঁর জীবন কাহিনি। আমরাও এই কাব্য থেকে তাঁর জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অবগত হই। কিন্তু তাঁর যে একটা নাগরিক জীবনও আছে, সে সম্পর্কে কোন ধারনা অর্জিত হয় না। হয়ত এই তৃষ্ণা পাঠকের থেকে যাবে।