লেখক -
১.
যশস্বী সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও সম্পাদক কবি আহসান হাবীব। কবি আহসান হাবীব
বাংলাদেশের বিশিষ্ট আধুনিক কবি যিনি দেশ বিভাগের আগেই সমকালীন কবিদের
দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। মধ্যবিত্তের সংকট ও জীবনযন্ত্রণা আহসান হাবীবের
কবিতার মুখ্য বিষয়। সামাজিক বাস্তবতা, মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংগ্রামী চেতনা
এবং সমকালীন যুগ যন্ত্রণা তার কবিতায় শিল্পসম্মতভাবে পরিস্ফুটিত হয়েছে।
তাঁর ভাষা ও প্রকাশ ভঙ্গিতে নাগরিক মননের ছাপ আছে। ১৯৮৫ সালের ১০ জুলাই
ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি। প্রয়াণ দিনে কবির স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র
শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, কবি আহসান হাবীব ১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারি
পিরোজপুর জেলার শংকরপাশা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। আহসান হাবীবের পেশাগত জীবন
কেটেছে সাংবাদিকতায়। কিন্তু মননে তিনি ছিলেন গভীর শিল্পানুরাগী কবি। তাঁর
কবিতায় খুঁজে পাওয়া যায় আত্মমগ্নতা ও গীতিময়তা। একপ্রকার স্নিগ্ধতার পরশে
তিনি পাঠক চিত্তকে আকর্ষণ করেন। গভীর জীবনবোধ তাঁর কবিতার আরেকটি
বৈশিষ্ট্য।
২.
কবির পুত্র স্বনামধন্য সাহিত্যিক মঈনুল আহসান সাবের তাঁর পিতার স্মৃতিচারণ
করে লিখছেন, ‘আব্বা যখন কলেজে পড়েন, দাদা বললেন, লেখাপড়া অনেক হলো। এবার
চাকরি হোক। আব্বা চাকরি নেবেন না। কবি হবেন। এদিকে কিছু সাংসারিক টানাটানি
আছেও। দাদা তাই নাছোড়বান্দা। ছেলে চাকরি নেবে, তিনি ঘুরেফিরে ও বলে
বেড়াবেন, ছেলেই এখন উপার্জন করছে। শেষে অবস্থা এমন হলো, আব্বা বাড়ি থেকে
পালালেন। বরিশালের পিরোজপুর, সেখানকার শঙ্করপাশা থেকে তিনি চলে গেলেন
কোলকাতা। সেটা সম্ভবত ১৯৩৫ কি ৩৬। একদমই অচেনা কোলকাতায় তার প্রথম দিনগুলো
ছিল প্রচন্ড কষ্টের। কোথায় থাকবেন কী পরবেন কী খাবেন, এর কিছুই ঠিক ছিল না।
কিন্তু তিনি ফিরেও যাননি। ফুটপাথে ঘুমিয়েছেন, বৃষ্টি হলে উঠে গেছেন কোনো
বাড়ির বারান্দায়। গলার মাফলার বন্ধক রেখে হোটেলে খেতে চেয়েছেন , পুরনো
পত্রপত্রিকা জোগাড় করে হকারি করার চেষ্টা করেছেন। তবে কঠিন লড়াই শেষে অচেনা
কোলকাতায় পায়ের নীচে মাটি তিনি ঠিকই তৈরি করে নিয়েছেন।পরে, আমরা যখন বড়
হয়েছি, আমাদের কখনো সেই দিনগুলোর গল্প শোনাতেন। হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করতেন,
ওই যে আমার জীবন, তার জন্য কি তোমাদের লজ্জা লাগে? আমরা চার ভাইবোন বলতাম,
কক্ষনো না। তোমার জন্য আমাদের গর্ব হয়। তুমি শুধু বড় কবি ছিলে না, লড়াইয়ে
জয়ী ছিলে না, সম্পূর্ণ ও সম্পন্ন পিতাও ছিলে। গর্ব আমাদের হতেই পারে।’
৩.
বাংলা কবিতার ক্রমবিকাশের পথ ধরে তিরিশোত্তরকালের কবিতার ধারায় কবি আহসান
হাবীব এক অনিবার্য নাম। প্রথম প্রকৃত আধুনিক কবি হিসেবে তিরিশের কবিদের
আধুনিক চিন্তাশৈলী, স্বতন্ত্র ভাষার অধিকারী কবিদের পথ ধরে কবিতায় নিজস্ব
দর্শন ও কাব্যের আধুনিক মননশৈলী নির্মানে আহসান হাবীব নতুন পথ নির্মাণ
করেছেন। পঞ্চাশের কাব্য আন্দোলনের উত্তর সাধক হিসাবে আধুনিক কবিতার
উত্তরাধিকারের পথকে অনিবার্য করে তুলেছিলেন আহসান হাবীব। কবিতায় জীবন
দর্শনের শিল্পরীতি, চৈতন্য জুড়ে তীব্র দহন, অস্তিত্বের সংকট, মধ্যবিত্ত
জীবনের আকাংখার স্বরূপ নির্মাণে নিজস্ব শক্তিমত্তায় ঋদ্ধ করেছেন আহসান
হাবীব। কবি ও ভাষাবিজ্ঞানী হুমায়ুন আজাদ এক মূল্যায়নে আহসান হাবীবের কবিতা
নিয়ে বলেছেন- “আহসান হাবীবের কবিতাই আমাদের আধুনিকতা চর্চার প্রকৃত সোপান
তৈরি করেছেন। তিরিশের কবিরা কবিতায় যে রবীন্দ্রত্তোর ধারা প্রবাহিত করেছেন
আহসান হাবীব তাতেই অবগাহন করেছেন। প্রকৃতপক্ষে আহসান হাবীব তার রচনাকর্মে
আশাবাদ, সচেতনতা, পুনঃমানবিকীকরণের উদ্ধোধন ঘটিয়ে আধুনিকতার সংজ্ঞাকে মুক্ত
ও সম্প্রসারিত করেছেন। এ সত্য প্রথম উপলদ্ধি করেছেন আহসান হাবীব। কবি
হিসেবে আমাদের কাছে বরেণ্য কেবল ঐতিহাসিক পরিবর্তনের কারণেই নয়
ত্রিশোত্তরকালে আবির্ভুত তিনিই আমাদের শ্রেষ্ঠ কবিদের একজন।”
৪.
আহসান হাবীবের পিতার নাম হামিজুদ্দীন হাওলাদার৷ মাতা জমিলা খাতুন৷ তাঁর
পাঁচ ভাই চার বোন৷ অর্থনৈতিক ভাবে অসচ্ছল পিতা মাতার প্রথম সন্তান তিনি৷
পারিবারিক ভাবে আহসান হাবীব সাহিত্য সংস্কৃতির আবহের মধ্যে বড় হয়েছেন৷
সেই সূত্রে বাল্যকাল থেকেই লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত হন তিনি৷ সেইসময় তাঁর
বাড়িতে ছিল আধুনিক সাহিত্যের বইপত্র ও কিছু পুঁথি৷ যেমন আনোয়ারা,
মনোয়ারা, মিলন মন্দির প্রভৃতি৷ এসব পড়তে পড়তে একসময় নিজেই কিছু লেখার
তাগিদ অনুভব করেন৷ সাহিত্যের অনুকূল পরিবেশ নিয়ে পিরোজপুর গভর্নমেন্ট
স্কুল থেকে ১৯৩৫ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করে কিছুদিন বিএম কলেজে আইএ
ক্লাসে অধ্যয়ন করেন, কিন্তু আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে লেখাপড়া ত্যাগ করে
কলকাতা গিয়ে সাংবাদিকতার পেশা গ্রহণ করেন এবং আজীবন ওই পেশাতেই নিয়োজিত
ছিলেন। কলকাতায় তিনি তকবীর (১৯৩৭), বুলবুল (১৯৩৭-৩৮) ও সওগাত (১৯৩৯-৪৩)
পত্রিকায় কাজ করেন। কয়েক বছর (১৯৪৩-৪৮) তিনি আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের
স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবেও কাজ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ঢাকায় এসে তিনি
বিভিন্ন সময়ে আজাদ, মোহাম্মদী, কৃষক, ইত্তেহাদ প্রভৃতি পত্রিকায়
সাংবাদিকতা করেন। ১৯৫৭-৬৪ পর্যন্ত তিনি ফ্রাঙ্কলিন পাবলিকেশনস-এর প্রডাকশন
অ্যাডভাইজার ছিলেন। পরে তিনি কিছুদিন দৈনিক পাকিস্তানে কাজ করেন এবং
মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত দৈনিক বাংলার সাহিত্য-সম্পাদকের দায়িত্ব পালন
করেন।
৫.
আহসান হাবীব আধুনিক কাব্যধারার কবি ছিলেন। তাঁর কাব্যচর্চার শুরু বাল্যকাল
থেকেই। সপ্তম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে ১৯৩৩ সালে স্কুল ম্যাগাজিনে তাঁর প্রথম
লেখা একটি প্রবন্ধ ‘ধর্ম’ প্রকাশিত হয়। ১৯৩৪ সালে তাঁর প্রথম কবিতা
‘মায়ের কবর পাড়ে কিশোর’ ছাপা হয় পিরোজপুর গভর্নমেন্ট স্কুল ম্যাগাজিনে।
তখন তিনি দশম শ্রেণীর ছাত্র। এভাবেই তাঁর সাহিত্যিক জীবনের শুরু। পরে দেশ,
মোহাম্মদী, বিচিত্রা প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়। আহসান
হাবীবের প্রথম কবিতার বই ‘রাত্রিশেষ’ প্রকাশিত হয় ১৯৪৭ সালে। কাব্যগ্রন্থ,
বড়দের উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, ছোটদের ছড়া ও কবিতার বই সব
মিলিয়ে আহসান হাবীবের বইয়ের সংখ্যা ২৫টির মতো। তাঁর উল্লেখযোগ্য
কাব্যগ্রন্থ ছায়াহরিণ (১৯৬২), সারা দুপুর (১৯৬৪), আশায় বসতি (১৯৭৪), মেঘ
বলে চৈত্রে যাবো (১৯৭৬), দুহাতে দু আদিম পাথর (১৯৮০), প্রেমের কবিতা
(১৯৮১), বিদীর্ণ দর্পণে মুখ (১৯৮৫) ইতাদি। তাঁর দুটি বিশিষ্ট উপন্যাস হলো
অরণ্য নীলিমা (১৯৬০) ও রাণীখালের সাঁকো (১৯৬৫)। শিশু-কিশোরদের জন্য তিনি
প্রচুর ছড়া ও কবিতা লিখেছেন। তাঁর কবিতায় ছন্দ ও শব্দ সহজেই পাঠকের মন
কাড়ে। তার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য শিশুতোষ গ্রন্থ হলো- জোৎস্না রাতের গল্প
(১৯৬৭), বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর (১৯৭৭), ছুটির দিন দুপুরে (১৯৭৮) ইত্যাদি।
৬.
মধ্যবিত্তের সংকট ও জীবনযন্ত্রণা আহসান হাবীবের কবিতার মুখ্য বিষয়।
সামাজিক বাস্তবতা, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সংগ্রামী চেতনা এবং সমকালীন
যুগযন্ত্রণা তাঁর কবিতায় শিল্পসম্মতভাবে পরিস্ফুটিত হয়েছে। তাঁর ভাষা ও
প্রকাশভঙ্গিতে নাগরিক মননের ছাপ আছে। আহসান হাবীবের কবিজীবন রোমান্টিকতার
অনুসারী। তবে তা সমাজ ভাবনাবিচ্ছিন্ন নয়। সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে তাঁর
খ্যাতি ছিল প্রায় প্রবাদতুল্য। এ দেশের বহু লেখক ও কবির জীবনের প্রথম রচনা
তাঁর হাত দিয়েই প্রকাশিত হয়। সাহিত্যক্ষেত্রে তাঁদের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার
ব্যাপারে তাঁর প্রচেষ্টা ছিল দৃষ্টান্তস্থানীয়। গভীর জীবন বোধ ও আশাবাদ তার
কবিতাকে বিশিষ্ট ব্যঞ্জনা দান করেছে। তার কবিতার স্নিগ্ধতা পাঠকচিত্তে এক
মধুর আবেশ সৃষ্টি করে। তিনি সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে এবং আর্ত-মানবতার
পক্ষে বক্তব্য রেখেছেন। মানুষের জীবনে চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে নানা বৈচিত্র্য ও
আনন্দ। এ আনন্দময় বিচিত্র জীবন থেকে বেঁচে থাকার সুখ ও সার্থকতা খুঁজতে
হবে। কবি আহসান হাবীবের 'আনন্দ' কবিতায় আনন্দের নানা উৎসের কথা বলা হয়েছে-
‘আনন্দ রে আনন্দ বল, কোথায় রে তোর বাসা,
তুই কি আমার মা, নাকি তুই মায়ের ভালবাসা?
বাবার হাতে তুই কি উথাল মাটিতে ধান বোনা?
মায়ের হাতে কুলোয় ভরা ধানের মত সোনা?
তুই কি আমার ঘরের চালে ফুরিয়ে যাওয়া রাত?
তুই কি আমার সানকি ভরা ফুলের মত ভাত?’
৭.
কবি আহসান হাবীব সাহিত্য সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ইউনেস্কো সাহিত্য
পুরস্কার (১৯৬১), বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬১), আদমজী সাহিত্য পুরস্কার
(১৯৬৪), নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক (১৯৭৭), একুশে পদক (১৯৭৮), আবুল মনসুর আহমদ
স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮০) এবং আবুল কালাম স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮৪) লাভ করেন। এ
ছাড়াও তিনি কবিতালাপ সাহিত্য পুরস্কার, লেখিকা সংঘ পদক, অলক্ত সাহিত্য
পুরস্কার, পদাবলী পুরস্কার, কবি আবুল হাসান স্মৃতি পুরস্কারেও ভূষিত হন।
৮.
আহসান হাবীব ১৯৪৭ সালের ২১ জুন বিয়ে করেন বগুড়া শহরের কাটনারপাড়া নিবাসী
মহসীন আলী মিয়ারকন্যা সুফিয়া খাতুনকে। দুই কন্যা ও দুই পুত্রের জনক ছিলেন
আহসান হাবীব। তার দুই কন্যা হচ্ছেন, কেয়া চৌধুরী ও জোহরা নাসরীন এবং তাঁর
দুই পুত্র হচ্ছেন, মঈনুল আহসান সাবের ও মনজুরুল আহসান জাবের। পুত্র মঈনুল
আহসান সাবের একজন স্বনামখ্যাত বাংলা ঔপন্যাসিক। যশস্বী কবি, সাংবাদিক ও
সাহিত্য সম্পাদক কবি আহসান হাবীব ১৯৬৪ সাল থেকে মৃত্যুর পূর্বদিন পর্যন্ত
দৈনিক পাকিস্তান থেকে দৈনিক বাংলায় রূপান্তরিত পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক
হিসেবে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন।দৈনিক বাংলার সাহিত্য সম্পাদক
থাকাকালে ১৯৮৫ সালের ১০ জুলাই ঢাকায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল
৬৮ বছর।
৯.
আহসান হাবীবের কবিতায় একদিকে রয়েছে গভীর সংবেদনশীলতার স্নিগ্ধ সুর,
অন্যদিকে রয়েছে বিনয়ী প্রতিবাদময় সমাজ মনস্কতা। একপর্যায়ে কবি বেশ কিছু
সাড়া জাগানো ব্যঙ্গ কবিতা লিখেছেন। সব মিলিয়ে তার কবিতায় রয়েছে শান্ত,
নিরুপদ্রব জীবনের জন্য মমতা ও আর্তি। আহসান হাবীবের কবিতায় জীবন ও গতির
প্রতীক হয়ে আসে নদী, মিছিল এবং জোয়ার। মেঘ বলে চৈত্রে যাবো কাব্যে আহসান
হাবীবের কাব্যদর্শন যেমন মানবিক সমগ্রতাবোধে স্পন্দিত, তেমনি প্রচণ্ড
আশাবাদও ব্যক্ত হয়েছে এখানে : ‘আমি এই পথ থেকে ফিরবো না, কেননা,/ মানুষকে
কোথাও না কোথাও যেতেই হয়/ অকাল সমৃদ্ধ এক সুস্থির আবাস তাকে/ অবশ্যই গড়ে
নিতে হয়/ কোনোখানে’। আবার তাঁর 'সারা দুপুর' কাব্যগ্রন্থের 'আলো আঁধারের
দর্শন' কবিতার অংশবিশেষ নিম্নরূপ-
‘ওরা এখন পার হতে চায় দুর্গম দীর্ঘ পথ,
শোনো ওরা বলে, রাত শেষ হয়ে এল!
পূর্বাশার আলো ঐ দেখা যায়!
আহা অবুঝ ওরা বোঝে না।
ওদের ফিরিয়ে দাও তুমি,
ফিরিয়ে দাও আমাদের বাহুবন্ধনে_
সামনে ওদের কী গভীর অন্ধকার।
ওদের অপরাধ তুমি নিও না।
ওরা বলে, রাত শেষ হয়ে এল আমাদের পেছনে
আমরা বলি, সামনে তোমাদের রাত নামছে
তোমরা ফিরে এসো।
আশা-সে ত মরীচিকা, আমরা বলি।
ওরা বলে, আশাই জীবন, জীবনের শ্রী।
ওরা এগিয়ে যায় স্বচ্ছন্দে,
আমরা অবাক হই।’
১০.
আহসান হাবীবের শেষ পর্যাযের কাব্যগ্রন্থ দু’হাতে দুই আদিম পাথর
সময়-সমকাল-জীবন ও স্বদেশ চিন্তার শিল্পসফল সমন্বয়ে ঋদ্ধ। জীবনের সঙ্গে তিনি
লেপ্টে থাকেন মাছির মতো। মানব সভ্যতার বহমান ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে নিজেকে
তিনি সংলগ্ন করেন। তাঁর পক্ষে এ-জন্যেই খুব সহজে আবহমান মানবজীবনের
বেদনা-আনন্দ-অভিলাষ ও বিষাদের সঙ্গে সম্পর্ক রচনা করা সহজ হয়ে ওঠে।
‘আবহমান’ কবিতায় ইলিশ শিকারী খালেক নিকিরির জীবনের সঙ্গে কবির নিজস্ব জীবন
একাকার হয়ে যায়। মহৎ শিল্পী আহসান হাবীব নিজেকে আবিষ্কার করেছেন স্বদেশের
চিরচেনা জীবনপটেণ্ড শিল্প ও জীবন তাঁর কবিতায় অঙ্গাঙ্গীসূত্রে আবদ্ধ। নিজের
দাবি প্রকাশের ক্ষেত্রে তিনি যে কেমন নাছোড়, 'দু'হাতে দুই আদিম পাথর'
কাব্যগ্রন্থ থেকে কিছুটা তুলে ধরা যাক-
‘আসমানের তারা সাক্ষী
সাক্ষী এই জমিনের ফুল, এই
নিশিরাইত বাঁশবাগান বিস্তর জোনাকি সাক্ষী
সাক্ষী এই জারুল জামরুল, সাক্ষী
পুবের পুকুর, তার ঝাঁকড়া ডুমুরের ডালে স্থিরদৃষ্টি
মাছরাঙ্গা আমাকে চেনে
আমি কোনো অভ্যাগত নই
খোদার কসম অমি ভিনদেশি পথিক নই
আমি কোনো আগন্তুক নই!'
১১.
ম্যাক্সিম গোর্কি বলেছেন, ভাষার সবচেয়ে মূল্যবান ঐশ্বর্য দেশের লোকসাহিত্য
এবং সাধারণ মানুষের প্রতিদিন ব্যবহৃত সংলাপের মধ্যে। এ-বিশ্বাস তাঁর
সমসাময়িক অন্য কবিদের মতো আহসান হাবীবকেও আলোড়িত করে। এই ঐতিহ্য মূল্যায়ন ও
রূপায়ণে তাঁর ব্যাপক প্রয়াস দেখা যায়। তাঁর দুই হাতে দুই আদিম পাথর
গ্রন্থে এই প্রয়াস সবচেয়ে বেশি। যেমন :
আসমানে তারা সাক্ষী
সাক্ষী এই জমিনে দুল, এই
নিশি রাইতে বাঁশ বাগান
বিস্তর জোনাকী সাক্ষী
সাক্ষী এই জারুল
জামরুল সাক্ষী
(‘উৎসর্গ’, দুই হাতে দুই আদিম পাথর)
১২.
‘রাত্রিশেষ’ গ্রন্থটি তাঁর জন্য বিশেষ খ্যাতি বয়ে আনে। গ্রন্থটি সে-সময়
(১৯৩৭ থেকে ’৪৭ সাল এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্র, যখন বিশ্বযুদ্ধ এবং
স্বাধীনতা-আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহে একটি বিশেষ তাৎপর্যের বাহক) রচিত তাঁর
কবিতায় পরাধীনতার প্রতিক্রিয়া, স্বাধীনতা সংগ্রাম, বিশ্বযুদ্ধের প্রভাবের
পাশাপাশি শ্রেণিচেতনা হয়ে ওঠে প্রধান উপজীব্য। কিন্তু এই রাত্রিশেষ
কাব্যগ্রন্থটির পাঠকপ্রিয়তার কেন্দ্রীয় আকর্ষণ ‘এই মন – এ-মৃত্তিকা’
কবিতাটি। এই কবিতায় কবি একটি চিরায়ত মানবিক আবেগকে ধারণ করেছেন।
‘চেনা পৃথিবীকে ভালোবাসিতাম জানাজানি ছিলো বাকী
জানতাম না তো সে পরিচয়েতে ছিল অফুরান ফাঁকি’
(‘এই মন – এ-মৃত্তিকা’, রাত্রিশেষ)
কিংবা,
রাতের পাহাড় থেকে খসে যাওয়া
পাথরের মতো অন্ধকার ধসে ধসে পড়ছে
দু’হাতে সরিয়ে তাকে
নির্বিকার নিরুত্তাপ মন এগোলো।
(‘রেড রোডে রাত্রিশেষ’, রাত্রিশেষ)
১৩.
শেষের আগে বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক, ভাষাসংগ্রামী কবি আহমদ রফিকের একটি উদ্ধৃতি
উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক মনে করি। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত আহসান হাবীব
রচনাবলি-১-এর ভূমিকায় তিনি লিখেছেন- তিরিশের শেষ দিকে লেখা শুরু করা
সত্ত্বেও তিরিশ দশকীয় কবিতার আত্মরতি বা নান্দনিকতার প্রভাব তিনি রক্তে
ধারণ করেননি। বরং চল্লিশের সমাজচেতনার যুগধর্মকেই আত্মস্থ করে নিয়েছিলেন।
এর প্রমাণ মেলে তার সর্বশেষ কবিতাগ্রন্থটির (১৯৮৫) মুখবন্ধে উপস্থাপিত
বক্তব্যে : 'ক্ষুধাই সেই হননকারী শত্রু যে মানবজীবন থেকে কবিতা কামনা হরণ
করে। ... ক্ষুধা মানুষই তৈরি করে মানুষের মধ্যে। ... ক্ষুধার সেই রাজ্যে
কবিতা কিছু বলবার দায়িত্ব নিতে থাকে। উত্তর-তিরিশ কবিতার সমাজসচেতন অধ্যায়ে
সংলগ্নতা আমি এভাবেই আবিস্কার করি। শ্রেণিবৈষম্যের অভিশাপ, মধ্যবিত্ত
জীবনের কৃত্রিমতা এবং উদ্ভ্রান্ত উদ্বাস্তু যৌবনের যন্ত্রণা আজও পর্যন্ত
আমার কবিতার বিষয়বস্তু।' আর তাই পাঠক মাত্রেরই বুঝতে কষ্ট হয় না চল্লিশের
রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশে আহসান হাবীবের কবিতার চরিত্রগঠন।
১৪.
চিরকালের আধুনিক কবি আহসান হাবীবের প্রয়াণদিনে আবারো তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।