০ আপনি ঠিক কবে থেকে লেখালেখি শুরু করেন?
নবারুণ ভট্টাচার্য : আমি লেখালিখি শুরু করি ষাটের দশকের শেষ থেকে।
০ ছাপার অক্ষরে আপনার প্রথম লেখার প্রকাশ কীভাবে হয়? সেটি কবিতা না গল্প?
নবারুণ ভট্টাচার্য : গল্প। কবিতা বেরিয়েছিল কিনা মনে নেই। হয়তো বেরিয়ে থাকতেও পারে। তবে ১৯৬৮ সালে ‘পরিচয়’ পত্রিকায় ‘ভাসান’ নামে আমার একটি ছোটগল্প বের হয়। তখন ‘পরিচয়’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। গল্পের নামকরণটা উনিই করে দেন। ছাপার অক্ষরে এটাই আমার প্রথম প্রকাশিত গল্প।
০ কোনো পিতা তাঁর সন্তানকে বলছেন, ‘বড়ো হয়ে তুমি লিখবে।’ এরকমটা তো প্রায় দেখাই যায় না। কিন্তু সেটা আপনার ক্ষেত্রে ঘটেছিল। সেই পিতার সম্বন্ধে যদি কিছু বলেন?
নবারুণ ভট্টাচার্য : টোট্যাল পারসোন্যালিটি বলতে যা বোঝায় আমার বাবা ছিলেন সে রকমই একজন মানুষ। ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক জীবন পর্যন্ত অনেক রকম গুণের সমাবেশ ঘটেছিল তাঁর মধ্যে। স্নেহ-ভালোবাসার একটা দিক ছিল, আর একটা দিক ছিল সাংস্কৃতিক জগতের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটিয়ে দেওয়া। থিয়েটার জিনিসটা তিনি একেবারে আমাকে ধরে ধরে হাতে কলমে শিখিয়ে দিয়েছিলেন। ভালো ভালো লেখার খোঁজ অবশ্য মা-ই আমাকে এনে দিতেন। জীবনটাকে যাঁরা খুব গভীরভাবে জানেন অর্থাৎ একজন ভবিষ্যৎ দ্রষ্টার মতোই বাবা আমাকে বলেছিলেন যে, আমি লিখব। সমাজে কোন ধরনের চরিত্রদের নিয়ে থাকতে হবে সেটা বাবার কাছ থেকেই শিখেছি এবং সেইভাবে নিজেকে তৈরিও করে নিয়েছি। বাবার সঙ্গে আমার প্রথম অভিনয় ‘গত্যান্তর’ নাটকে। ওই নাটকে একটা ছাত্রের চরিত্রে আমি অভিনয় করি। ১৯-২০ বছর বয়সে তাঁর ‘দেবী গর্জন’ নাটকে একটা বড়ো চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছিলাম। এছাড়া আরও অনেক নাটকে বাবার সঙ্গে থেকেছি। বাবার মধ্যে যে কত গুণের সমাবেশ ঘটেছিল তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। তিনি বাজনা বাজাতে পারতেন, গান গাইতে পারতেন। জীব-জন্তুদের প্রতি তাঁর একটা অদ্ভুত প্রেম ছিল। কখনও কখনও দেখেছি তিনি তাদের সঙ্গে কথা বলছেন। শিল্পীকে যে ক্রয় করা যায় না এটা আমি বাবার কাছ থেকে শিখেছি। সাম্প্রতিক রাজনীতি, বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে বাবার সঙ্গে অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। বাবার কিছুু লেখা অসমাপ্ত আছে সেগুলো নিয়ে পরে কাজ করার ইচ্ছা আছে। বাবা আর মায়ের আলাদা আলাদা দুটো জলচৌকি ছিল লেখার জন্য, সেগুলো আমি যত্ন করে রেখে দিয়েছি। এছাড়াও বাবার ব্যবহৃত কলম, নাটকের পোশাক সব আমার সংগ্রহে আছে। সব দিক থেকেই বাবা ছিলেন আমার আদর্শ।
০ আজকের নবারুণ ভট্টাচার্য হয়ে ওঠাতে আপনার মা মহাশ্বেতী দেবী এবং বাবা বিজন ভট্টাচার্যের ভূমিকা কতখানি?
নবারুণ ভট্টাচার্য : আমি খুব ছোটবেলা থেকেই নাটক, লেখালিখি ছাড়া আর কিছু জানি না। কাজেই যে সমস্ত কাজ নিয়ে আমি ব্যস্ত থাকতে ভালোবাসি, পারিবারিক পরিম-ল আমাকে সেইদিক থেকে ভীষণভাবে সাহায্য করেছে। আমরা বড়োলোক ছিলাম না ঠিকই, কিন্তু আমাদের সম্পদ বলতে ছিল বইপত্র, সাংস্কৃতিক পরিম-ল ইত্যাদি। কাজেই এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
০ আপনি তিনটি বড়ো পুরস্কার_ বঙ্কিম, নরহিংস দাস, আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন। একজন সৃষ্টিশীল মানুষের জীবনে পুরস্কারের প্রয়োজন কতটা?
নবারুণ ভট্টাচার্য : পুরস্কার জীবনে যদি আমি কোনোদিন নাও পেতাম তাহলেও আজকে যেমন লিখছি ঠিক লিখে যেতাম। পুরস্কার পেতে অবশ্য খারাপ লাগে না কিন্তু পুরস্কারটাকে জীবনে আমি কোনোদিন বড়ো করে দেখিনি। পুরস্কারেরর আশায় তো আর কেউ লেখে না, পরে সেটা এসে যায়।
০ সাহিত্য জীবনের গোড়াতে আপনি কবিতা লিখতেন না গল্প লিখতেন?
নবারুণ ভট্টাচার্য : দুটোই সমানতালে লিখে গেছি। অবশ্য আমি নিজেকে কবি বলেই পরিচয় দিই। আমি কোনোদিন কোনো লেখাকে বিচ্ছিন্ন করে দেখি না। যখন যেটা মনে আসে তখন সেটা লিখে ফেলি।
০ এবার ‘হারবার্ট’ প্রসঙ্গে আসি। এই ধরনের একটা উপন্যাস কীভাবে লিখে ফেললেন?
নবারুণ ভট্টাচার্য : অবচেতনে অনেকদিন ধরেই মাথার মধ্যে ছিল। বহু টুকরো-টুকরো ঘটনা, অনুষঙ্গ স্মৃতি আস্তে আস্তে যেন দানা বেঁধেছে মাথার ভেতর। আসলে কোনো একটা বিষয় আমার মাথার মধ্যে ঘোরে অনেকদিন ধরে, তারপরে সেটাকে নিয়ে আমি লিখতে বসি। হঠাৎ ভাবলাম আর হঠাৎ লিখে ফেললাম এটা আমার ক্ষেত্রে হয় না। ‘হারবার্ট’ আমার নিজস্ব জীবনের অভিজ্ঞতা। সবমিলিয়ে ‘হারবার্ট’-এর স্ট্রাকচার, তার মধ্যে কৃৎকৌশলগত ব্যাপার যেগুলো একটা লেখকের মধ্যে অবশ্যই থাকা দরকার, সবকিছুরই একটা মেলবন্ধন ‘হারবার্ট’-এর মধ্যে ঘটেছে বলে আমার ধারণা।
০ আপনি যখন কোনো গল্প বা উপন্যাস লিখতে শুরু করেন তখন শেষটা কি আগে থেকে ভেবে নেন বা লিখতে লিখতে এসে যায়?
নবারুণ ভট্টাচার্য : শেষটা মোটামুটি একটা ভাবা থাকে। তবে অনেক সময় আমি আগে পরে করে লিখি। হয়তো শেষ দিকটা অনেক আগে থেকেই লিখে রাখলাম। পরে আবার একসঙ্গে মিলিয়ে দিলাম। এতে আমার কোনো অসুবিধা হয় না।