কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত চলনে-বলনে, ছিলেন ইউরোপিয়ান। তিনি বাংলা ভাষায় কবিতা লিখবেন এ কথা ব্রিটিশভারতের (বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশের ) যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি কপতোক্ষ নদ তীরের সম্ভ্রান্তকায়স্থ এবং ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান মাইকেল মধুসূদন দত্ত কখনও ভাবতেন না।পাশ্চাত্যসাহিত্যেরএক দুর্নিবার মোহ-আকর্ষণ কিশোর কালেই তাঁর মন ও মননে প্রোথিত হয়েছিল।কবি মধুসূদন দত্ত (তখনও নামের আগে মাইকেল যুক্ত হয়নি) ১৮৪২ খ্রী: হিন্দু কলেজে পড়ার সময় এক প্রবন্ধ প্রতিয়োগিতায় ইংরেজিতে প্রবন্ধ লিখে স্বর্ণপদক লাভ করেন।তাঁর এই প্রবন্ধটি ছিল অবরুদ্ধ নারীদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের শিক্ষায় শিক্ষিত করার বিষয়ে।
সাহিত্য-শিল্প ইতিহাসের এক আধুনিক বিবর্তনকালে কবি মধুসূদন দত্তের জন্ম। বাংলা সাহিত্য মধ্যযুগীয় সাহিত্য বলয় থেকে বেরিয়ে আধুনিক রূপায়নের দিকে যাত্রা শুরু করেছে।চর্যাপদের কবিতার বহমান স্রোত ক্ষীণ হয়ে আসছে। বাংলা ভাষা এক আধুনিক রূপ নিচ্ছে। মধ্যযুগীয় সাহিত্যকে কোনো কোনো সমালোচক-আলোচক অন্ধকারচ্ছন্ন বলেছেন। আমারা অন্ধকার বলবো না, অন্ধকারের নিচেই তো আলো থাকে। তাদের ধারাকে অনুসরণ-অনুকরণ করেই কালক্রমে বাংলা সাহিত্য একটি আধুনিকরূপ পরিগ্রহ করেছে এবং এখনও করছে।
যেমন: চর্যাপদ কাব্য-সাহিত্যে প্রাচীনতম। খ্রিষ্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময় কালে রচিত। এর রচনাকারীরা ছিলেন সহজিয়া বৌদ্ধ। শ্রী গৌতম বৌদ্ধের অনুসারী। এই ধর্মের গুরুতত্ব অর্থ এক সাংকেতিক রূপের আশ্রয়ে তাঁরা এগুলো রচনা করেছিলেন। এটি একটি ধর্মাবলম্বীর ভাষা হলেও এর সাহিত্যমূল্য আছে। সেই সময়ের সামাজিক অবস্থা ও প্রাকৃতিক দৃশ্যের বর্ণনা পাওয়া যায়। বাংলা সাধন সঙ্গীত শাখার শুরু চর্যাপদ থেকেই ।
‘ টালত মোর ঘর, নাহি পড়বেশী।
হাড়িত ভাত নাহি , নিতি আবেসী।,
(চর্যাপদ কবিতা)
এর অর্থ হলো- টিলার উপর আমার ঘর। প্রতিবেশী নেই। হাড়িতে ভাত নেই; প্রতিদিন অতিথি। এ থেকে সেই সময়ের দারিদ্র পরিবারের একটি স্পস্ট চিত্র পাওয়া যায়। এ রকম অনেক কবিতা আছে চর্যাপদে লেখা।পরবর্তী সময়ে আমরা চর্যাপদের অর্থ উদ্ধার করতে পেরেছি এবং সেখান থেকে আধুনিক রূপায়নে সাহিত্যধারায় আসতে সাহায্য নিয়েছি। তাই এই সব সাহিত্যকে মূল্যহীন, অযৌক্তিক বলা ঠিক হবে না। যে কথা আমি কাব্য আলোচনা করার ক্ষেত্রে বলে থাকি, তা হালো, জ্ঞানের শিরোমণি মহামতি আরিস্টটলের সেই কথা ,‘ কাব্য হলো অনুকরণ কলা। চর্যাপদ এক ধর্ম বিশ্বাসীদের রচিত হলেও এখান আমরা অনেক শিক্ষা লাভ করছি। মানুষকে আপনি তো আর এখন গুহাবাসী হতে বলবেন না। কিন্তু এই গুহাবাসী মানুষ এক সময় আগুন জ্বালাতে শিখেছিলেন। তাঁদের অনুকরণে আমরা কালক্রমে আগুন জ্বালাতে শিখেছি। কিন্তু মূল সূত্রটা ওই গুহাবাসী মানুষদের।
শ্রী রাজনারায়ণ দত্ত ও তাঁর প্রথমা স্ত্রী জাহ্নবী দেবীর এক মাত্র সন্তান মধুসূদন দত্ত জন্মগতভাবেই প্রতিভাবান ছিলেন।তাঁর মধ্যে বিলেতে যাওয়া এবং ইংরেজী সাহিত্যে খ্যাতি লাভ করার প্রবল আকাঙ্কা ছিল।১৮৪৩ সালে তিনি ধর্মান্তারিত হয়ে খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মধুসূদন দত্তকে ত্যাজপুত্র হিসেবে ঘোষণা করেন। মধুসূদন দত্তের হিন্দু কলেজের শিক্ষা জীবন সমাপ্ত হয়ে যায়।সব কিছু হারিয়েও কবি মধুসূদন দত্ত তাঁর ইচ্ছার উপর অটল ছিলেন।প্রকাশ্যে তাহাকে ত্যাজ করলেও পিতা-মাতার অন্তর আত্মা সন্তানকে ত্যাগ করতে পারেনি। বিদ্রোহী মনের শিশু মধুসূদনের শিক্ষা ও তাঁর নিজ পায়ে দাঁড়ানোর সক্ষমতার জন্য ব্যয়ভার করতে তাঁরা পিছু হননি। ১৮৪৩ সালে বিশপস কলেজে নতুন করে কবি মধুসূদন দত্তের শিক্ষা জীবন শুরু হয়ে ১৮৪৭ সালে শেষ হয়।
কবি মধুসূদন দত্তের পিতা-মাতার মনে হয়তো এই আশা জেগে ছিল তিনি এক সময় স্বধর্মে প্রত্যাবর্তন করবেন।
কবি মধুসূদন দত্তের অন্তরে বঙ্গদেশ থাকলেও উচাকাঙ্কা দুর্নিবার টান তাঁকে বিদেশগামী করে তোলে।ইতালীর বহু স্থান পরিভ্রমণ করেছেন কবি মনের একজন পরিব্রাজক হিসেবে।অনেক খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিকদের সাথে তাঁর পরিচয় হয়েছে। তিনি নিজেও ইংরেজী ভাষায় কবিতা রচনা করেছেন। ইংরেজী সনেটকে নিজ প্রতিভায় আয়ত্ত করেছেন।পিতার অর্থানাকূল্য বন্ধ যাওয়ায় কষ্টের জীবন পার করেছেন। এমন হয়েছে, তাঁর বন্ধুরা তাঁকে দেখলে ভিন্ন পথে চলে গেছেন এই ভেবে কবি মধুসূদন দত্ত’র সাথে দেখা হলে তিনি আবার অর্থ কর্জ চাইতে পারেন বলে।
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন বহু ভাষাবিদ, উচ্চাঙ্গের একজন কবি-সাহিত্যিক-প্রাবন্ধিক । আমরা তাঁকে কোন দিক হতে বিচার করবো । কোন দিকে তিনি ছিলেন না। সব দিকেই তাঁর বিচরণ । কিন্তু ত্রিশংঙ্কু অবস্থা ছিল তাঁর। দরিদ্র পরিবারের সন্তান না হয়েও স্বধম ত্যাগ করায় তিনি দারুণ অর্থ কষ্টে নিপতিত হন। এর মধ্যেও নিজের প্রতিভা বিকাশে ছিলেন অবিচল-অটল। কোনো কোনো পন্ডিত তাঁকে নিয়ে লিখতে গিয়ে অনেকটা ছোট করে দেখেছেন। এটা তাঁদের উদারতার অভাব। আমরা ক্ষুদ্রজন , ওই সব অনুদার পন্ডিতদের মত প্রতিভার অধিকারী নই। তবে আমরা উদার। ধম ত্যাগ করে তিনি ভুল করেছিলেন, নাকি ঠিক করেছিলেন সে বিচার করার ক্ষমতা আমাদের হাতে নেই। সেই বিচারের ন্যায়ভার সৃষ্টিকর্তার হাতে । ধম ত্যাগ করা কারণে তাঁকে হেয় করা অনুচিত।যাঁরা সেটা করেছেন, আমাদের বিশ্বাস তাদের ধর্ম বিশ্বাস যাই হোক না কেন ? তাঁরা গোঁড়া। গোঁড়ামী আর ঈর্ষা দিয়ে কোন প্রভিবানকে হেয় করার চেষ্টা পরিহার করা দরকার। তা না হলে একজন মানুষের প্রতিভার সঠিক মূল্যায়ন হয় না, বরং ওই সব পন্ডিতজনের লেখা যাঁরা পাঠ করেন , তাঁরা শুধু বিভ্রান্তই হন না, নিজেদের মধ্যে গোঁড়ামীকে লালন করেন।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও কটাক্ষ করেছেন অনেকে। তবে তাঁরা রবীন্দ্রনাথ হতে পারেননি। কবি মাইকেলকে যাঁরা কটাক্ষ করেছেন, তাঁরা পন্ডিত হতে পারেন, কিন্তু কবি মাইকেল হতে পারেননি। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত একজনই হয়েছেন।
আমরা এ নিয়ে আর কথা বাড়াতে চাই না। সরাসরি কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতার রূপায়নের দিকে এগিয়ে যেতে চাই। তাঁর আগে বলে নেওয়া ভাল কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাল্য শিক্ষা শুরু হয় তাঁর মায়ের কাছেই। মাতা জাহ্নবী দেবীর মহা-ভারত, রামায়ণে দখল ছিল।তিনি তাঁকে এ বিষয়ে দক্ষতা দান করেন।সাগরদাঁড়ি গ্রামের নিকটবর্তী শেখপুরা মসজিদের বিদ্বান ইমাম মুফতি লুৎফুল হকের কাছে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। এই ইমাম সাহেবের কাছে মধুসূদন দত্ত বাংলা , আরবী ও ফারসি ভাষা অধ্যায়ন করেছেন। দেখা যায়;শিশু বয়সেই তিনি হিন্দু ধর্ম, বাংলা, আরবী ও ফারসী ভাষায় প্রাথমিক জ্ঞান লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি স্বীয় প্রতিভার জোরে ল্যাতিন, ইতালিয়ান হিব্রু,গ্রিক, তেলেগু, তামিল ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেছেন।ইংরেজীতে তাঁর দক্ষতার কথা আমরা আগেই বলেছি। হিন্দু কলেজে অধ্যায়নকালে ইংরেজী ভাষায় প্রবন্ধ লিখে তিনি স্বর্ণপদক লাভ করেন।
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তর কাব্য প্রতিভার মূল্যয়ান বিচার করা খুব সহ কাজ নয়। তিনি ইংরেজী এবং মাতৃভাষা বাংলায় কবিতা রচনা করে এক নব রূপায়ন করেছেন । তিনি এক স্বর্ণযুগের সৃষ্টি করেছেন। ইংরেজী সাহিত্য থেকে সনেট গ্রহণ করে বাংলা ভাষায় এই ছন্দের পয়ার ভেঙ্গে নতুন ছন্দ দিয়েছেন। তিনি অমিত্রাক্ষর ছন্দের দাতা এবং সনেটের জনক। মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা ভাষায় কবিতা রচনা করবেন এ কথা আগে কখনও ভাবতেন না। পরে অবশ্য তাঁকে সুজল-সুফলা, শ্যামল বর্ণ-এর অপরূপ রূপের বাংলা মায়ের মধুর বংলা ভাষার কাছেই ফিরে আসতে হয়েছিল। তিনি ইউরোপিয়ান ভাব-ধারায় চলতে চেয়ে ছিলেন। কিন্ত জন্মগতভাবে ইউরোপিয়ান ছিলেন না। ছিলেন বাংলা মায়ের এক অসাধারণ প্রতিভাবান পুত্র। মা তাঁকে ডেকে ছিলেন । যে ক্রিয়া-করণের মধ্য দিয়ে বাংলা মায়ের কোলে ফিরে আসুন না কেন ? এতো তাঁর মায়েরই ক্রিয়ার ইশারা।
উনিশ শতককে বাংলা সাহিত্যে এক নতুন রূপধারণ করছে ।আধুনিক সাহিত্য ধারা সূচনা শুরু হয়েছে। ইউরোপিয়ারন কবিরাও আধুনিক সাহিত্যের যুগ সৃষ্টি করছেন সর্বত্র সাহিত্যে নব জাগরণের সূচনা শুরু হয়েছে। বঙ্গ মাতার সন্তনরাও বসে থাকেননি। বাংলা সাহিত্যকে আধুনিক রূপায়নে নিয়ে যাওয়ার কাজে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁদের মধ্যে একজন।
আমরা আগেই বলেছি, কবি মধুসূদন দত্তের ইংরেজী কবিতার সংখ্যা কম নয়। হিন্দু কলেজে অধ্যায়নের সময় তাঁর শিক্ষক মি: রিচার্ডসনের কাছে ইংরেজী সাহিত্যের পাঠ গ্রহণ করেন ।কবি বায়রন মধুসূদন দত্তের প্রিয় কবি হয়ে উঠলেন। কিশোর থেকে যৌবনের পদার্পণের মুহুর্তে কবি বায়রনের কবিতা মধুসূদন দত্তের অন্তরে প্রোথিত হয়। অনেক পন্ডিতজনের মতে, কবি বায়রনের কবিতা তাঁকে ইংরেজীতে কবিতা লিখতে অনুপ্রাণিত করে তোলে । সেই সময় বাঙালীদের অগ্রণ্য কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত । কিন্ত কবি মধুসূদন দত্তের সেকসপীয়র, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, বায়রন পড়া কবি মনের যে আবেদন তার কাছে কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত-এর কবিতা কোন আবেদন সৃষ্টি করতে পারেনি।
মাইকেল মধুসূদন দত্তের লালিত স্বপ্ন ইংরেজী কবিতা রচনা করা ;হয়তো তাঁর মনের মধ্যে আরো বড় আকাংখা লুকায়িত ছিল। যে আকাংখা তিনি ছিনিয়ে আনতে পারেননি।পরবর্তী সময়ে বাঙালী কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যা লাভ করে ছিলেন নোবেল পুরষ্কার লাভ করে। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত না হলেও তিনি খুব ছিলেন উচুঁ মানের একজন কবি-সাহিত্যিক এবং একটি যুগের সূচনা হয়েছিল তাঁর মাধ্যমে ।
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ইংরেজী কবিতার রূপায়ন নিয়ে আমাদের আলোচনা নয়; তারপরও এ বিষয়ে সামান্য আলোকপাত করা আবশ্যক । তাঁর ইংরেজী কবিতার সবটা রচনার সময়কাল পাওয়া যায়নি। পন্ডিত-বিদগ্ধজনেরা তাঁর ইংরেজী কবিতার যে সময়কাল উদ্ধার করেছেন ইতোপূর্বে তা হলো : কবি মধুসূদন দত্ত কলকাতায় এবং শ্রীরামপুরে ১৮৪১-৪৮ সালের মধ্যে বহু সংখ্যক ইংরেজী কবিতা রচনা করেছেন। মাদ্রাজে অবস্থানকালে ১৮৪৮-৫৬ সালে এবং পরবর্তীকালে ইউরোপ ও কলকাতায় ১৮৫৬-৬৭ সালের মধ্যে।
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ইংরেজী কবিতা বিশেষ করে সনেট , প্রবন্ধ, অনুবাদকর্মে একজন সিদ্ধহস্তই ছিলেন না ; এ বাক্যে বলা যায় তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার সুপার নোভা । তিনি অভিনয়ও করেছেন। ইংরেজী কবিতাতে তিনি খ্যাতি অর্জন করতে চেয়ে ছিলেন। যশখ্যাতি পেয়েছেন। আমরা এখানে তাঁর একটি ইংরেজী কবিতা উল্রেখ করলে সুধি পাঠক বুঝতে পারবেন , তাঁর ইংরেজী কবিতা ইউরোপের খ্যাতিমান কবিদের চেয়ে কোন অংশে কম ছিল না ।
কবি মধুসূদন দত্ত প্রথম বয়সে অন্ধকার মেঘাচ্ছন্ন রাত্রির তারাকে অনুকরন করে কবি মনের কল্পনায় রচিত হলো কবিতা –
`Shine on, sweet emblem of Hope’s lingering ray !
That while the soul’s bright sun-shine is o’er cast,
Gleams faintly thro’ the sable gloom, the last
To meet beneath Despair’s dark night away !
‘দূর আকাশ অন্ধকার মেঘাচ্ছন্ন আকাশে ঐ তারাকে আশা ও আনান্দের এক প্রতীক বলে মনে হলো কবির কাছে।’
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের এই যে, কাব্য-সাহিত্য প্রতিভা কোথা হতে আসল তা বিবেচনার দাবি রাখে। তাঁর জীবনী লেখকগণ অনেকেই এ নিয়ে হিমশিম খেয়েছেন। এক সূত্রে বলা হয়েছে, তাঁর এক পিতৃব্যের নাকি সামান্য কাব্য প্রতিভা ছিল। এই বক্তব্য জেনেটিক ধারাকে নির্দেশ করে বটে। আমরা বলি, তাঁর মাতা জাহ্নবী দেবীর রামায়ণ, মহা-ভারত শিশু মধুসূদন দত্তের মনে প্রোথিত হয়। তারপর ইমাম মুফতি লুৎফুল হকের কাছে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। এই ইমাম সাহেবের কাছে মধুসূদন দত্ত বাংলা , আরবী ও ফারসি ভাষা অধ্যায়ন করেছেন।পরবর্তী সময়ে হিন্দু কলেজে অধ্যায়নের সময় তাঁর শিক্ষক রিচার্ডসনের কাছে বায়রন, শেকসপিয়ার ইংরেজী কবিতা, নাটক-সাহিত্য তাঁকে সমৃদ্ধ করে তোলে। সর্বোপরি কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের নিজ গ্রাম যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি । যে গ্রামটিকে বেষ্টন করে প্রবাহিত কপোতাক্ষ নদ। সুজলা-সুফলা, শ্যামল বাংলার অপরূপ রুপ অনুকরন এবং পরবর্তী সময়ে ইতালী-বিলাতে গমন এবং নিজ অধ্যায়ন এই সবগুলো যুক্ত হয়ে তাঁকে এক উজ্জল নক্ষত্রসম কবিত্ব শক্তি দিয়েছে।
কবি মধুসূদন দত্তের প্রবল আকাংখা ছিল ইংরেজী কবিতা লিখে নিজের অবস্থানকে একটি বিশেষ স্থানে নিয়ে যাওয়ার। সেই কাব্য শক্তি তাঁর মধ্যে ছিল।ইউরোপের প্রবল টানে ইংরেজী কবিতা লেখার জন্যে তিনি নিজ ধর্মত্যাগ করলেন। যার কারণে ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান মধুসূদন দত্তের পিতার হৃদয় এক ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়। তিনি তাঁকে ত্যাজ্য করে এক পর্যায়ে অর্থ প্রদান বন্ধ করে দিলেন। ফলে ধনির পুত্র মধুসূদন দত্ত কর্পদক শুন্য হয়ে দরিদ্রসীমার নিচে চলে এলেন।
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বিলাতে পাঁচ বছর ১৮৬২ থেকে ১৮৬৭ পযন্ত ছিলেন। তাঁকে সহায়তা করবে এমন বন্ধুরা এক সময় দুর্ব্যবহার শুরু করে। অন্নকষ্ট, অর্থকষ্ট এবং মনকষ্ট তাঁকে ঘিরে এক মানসিক প্রবল যন্ত্রণার কারণ হয়ে উঠে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এই প্রতিভবান কবিকে সহায়তা করায় কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ব্যরিষ্টারী পাসের সার্টিফিকেট লাভ করে নিজ বঙ্গভূমে ফিরে আসেন। এখানে আমাদের সামনে একটি প্রশ্ন আসে তিনি ব্যরিষ্টার পড়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন কেন ? সহজ করে বললে , তাঁর পিতা ছিলেন কলকাতা আদালতের একজন নামকরা আইনজীবী পিতার সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করে মাইকেলের মনের কনে জমা হওয়া পিতার আচরণ তাঁকে ব্যথিত করায় তিনিও ব্যারিষ্টারী পড়েন।বাঙালী সন্তানরা পিতাকে তাদের সবচেয়ে বড় আশ্রয়স্থল মনে করে শিশুকাল থেকেই ।সেই পিতা যখন কঠিন হোন, সন্তানের মনও এতে ব্যথিত হয় বটে। আমারা কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের রূপায়ন আলোচনা করতে কিছুটা প্রাসিঙ্গতার মধ্যেও সামান্য অপ্রাসঙ্গিক আলোচনা করলাম। এটুকুর প্রয়োজন ছিল বলে আমরা মনে করি।আমরা ফিরে যাচ্ছি, বাংলা মায়ের প্রতিভাবান সেই সন্তান কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতার রূপায়নের দিকে।
তাঁর সব কবিতা আলোচনা করা সম্ভব নয় সল্প পরিসরে এই প্রবন্ধে। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত জীবনকাল খুব লম্বা ছিলনা । সল্পকালে তিনি তা যা দিয়েছেন, তা বাংলা সাহিত্য শুধু নয়, ইংরেজী সাহিত্যকেও সমৃদ্ধ করেছে। মৃত্য তাঁর দ্বারে কড়া নাড়চ্ছে বুঝতে পেরে শেষ মুহুর্তে লেখা কবিতাটি দিয়ে। কলকাতার মল্লিক বাজারে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের সমাধিস্থলে যাঁরা গিয়েছেন, তাঁরা এই কবিতাটি দেখেছেন এবং ক্ষণকাল দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁর সমাধির কাছে- ‘ দাঁড়াও, পথিকবর, জন্ম যদি তব
বঙ্গে। তিষ্ঠ ক্ষণকাল । এ সমাধিস্থলে
( জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি বিরাম)
মহীর পদে মহানিদ্রাবৃত
দত্ত কুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন!
যশোরে সাগর-দাঁড়ি কপোতাক্ষ-তীরে
জন্মভূমি, জন্মদাতা দত্ত মহামতি
রাজনারায়ণ নামে, জননী জাহ্নবী।’
কবির এই আহ্বান পড়ে কোন বঙ্গ সন্তান তাঁর সমাধির কাছে ক্ষণকাল দাঁড়াবে না?
কোন পটভূমিকায় কোনো সাহিত্যিকের কাব্য দৃষ্টি, নিজস্ব স্বকীয়তা এবং তাঁর সাহিত্য মূল্য-বিচার নিরুপণ করে নবরূপায়ন নিয়ে আলোচনা করা খুব সহজসাধ্য নয়। আর মাইকেল মধুসূদন দত্ত যিনি কাব্যধারাকে এক নুতন রূপ দিয়ে একটি স্বর্ণযুগের শুরু করে নিজেকে উর্ধে তুলে ধরেছেন, তাঁর কাব্যমূল্য বিচার করা কষ্টসাধ্য। তারপরও আমরা আমাদের ক্ষুদ্র প্রাজ্ঞতার উপর ভরসা করে সেদিকে এগিয়ে যেতে চাইছি। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর কবি প্রতিভার এক মহাবিপ্লবী। তিনি সনেটের জনক। অমিত্রাক্ষর ছন্দের দাতা। তিনি বাংলা কবিতায় এই ছন্দ নিয়ে পরীক্ষা করেন এবং এক নব প্রেরণা নিয়েই বাংলা কবিতায় এই ছন্দের প্রয়োগ করেন এবং এই ছন্দের মূল কাঠামো ঠিক রেখে এর উপর নির্মাণ করেন নতুন ছন্দ। যদিও অমিত্রাক্ষর ছন্দ আমাদের আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় নয়; তারপরও নতুন ছন্দের দাতার এই ছন্দ’র উপর সামন্য আলোচনা করা প্রয়োজন।‘ সাধারণ নিয়মে চোদ্দ মাত্রা বিভক্ত হয় দু’ভাগে শ্বাসযতি দ্বারা। আটমাত্রার পর আসে অর্ধ শ্বাসযতি এবং প্রতি চরণে শেষ ছয় মাত্রার পরে একই সঙ্গে আসে পূর্ণ শ্বাসযতি ও অর্ধযতি। যেমন:
‘মহাভারতের কথা। অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে। শুনে পুণ্যবান।’
(অর্ধ শ্বাসযতি;।। পূর্ণ শ্বাসযতি; =অর্ধযতি ’
এই নিয়মে ভাব প্রকাশ ব্যাহত হচ্ছিল। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর অমিত্রাক্ষর ছন্দে এই যতি স্থাপনের নিয়ম ভেঙ্গে দিয়ে সৃষ্টি করলেন, ভাবের প্রবাহ।
তিনি লিখলেন অমিত্রাক্ষর ছন্দে:
‘ উঠিল গগনে রথ গম্ভীর নির্ঘোষে ।
শুনিনু ভৈরব রব, দেখিনু সম্মুখে
সাগর নীলোর্ম্মময় । বহিছে কল্লোলে’
অতল, আকূল জল, অবিরাম গতি।’
তিনি যে কাব্য দৃষ্টি মেলে কবি মনের গভীরতা দিয়ে কবিতায় যে প্রবাহ নব প্রবাহ সৃষ্টি করেছেন; সেটাই তাঁর কবিতার রূপায়ন।
‘সতত হে নদ, তুমি পড় মোর মনে
সতত তোমার কথা ভাবি বিরলে;
সতত( যেমতি লোক নিশার স্বপনে
শোনে মায়া-যন্ত্র ধ্বনি০ তব কলকলে
জুড়াই এক কান আমি ভ্রান্তির ছলনে!
বহুদেশদেখিয়াছিবহুনদদলে
কিন্তুএস্নেহেরতৃষ্ণামেটেকারজলে
দুগ্ধস্রোতরূপিতুমিমাতৃভূমিস্তনে।
আরকিহেহবেদেখাযতদিনযাবে
প্রজারূপেরাজরূপসাগরেরেদিতে
বারিরূপকরতুমিএমিনতিগাবে
বঙ্গজজনেরকানেসখে-সখারিতে।
নামতারএপ্রবাসেমজিপ্রেমভাবে
লইছেযেনামতববঙ্গেরসঙ্গীতে।
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই কবিতায় প্রবাসজীবনকালে তাঁর নিজ গ্রাম সাগরদাঁড়ির কপোতাক্ষ নদকে ভুলতে পারেননি। তাঁর তৃষ্ণা কপোতাক্ষ নদ-জলে যে ভাবে প্রাণ জুড়িয়ে দিয়েছে, প্রবাসের নদ-নদী জল তেমনটি হয়নি। এখানে কবি মনের মাতৃভূমির প্রতি টান প্রবলভাবে ফুঠে উঠেছে। কবি চিন্তিত হন, মাতৃভূমির সাথে তাঁর আর কখনও দেখা হবে কিনা এ কথা ভেবে।
অথবা আমরা আর এক কবিতায় দেখতে পাই:
হে বঙ্গ, ভান্ডারে তব বিবিধ রতন;-
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন লোভে মত্ত, করিনূ ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
……………………………………
‘‘ ওরে বাছা মাতৃকোষে রতনের রাজি,
এ ভিখারী –দশা তবে কেন তোর আজি ?
যা ফিরি অজ্ঞান তুই , যা রে ফিরি ঘরে!’’
……………………………………………..
মাতৃ-ভাষা-রূপে খনি , পূর্ণ মণিজালে ।।’
চতুর্দশপদী এই কবিতায় কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বিদেশে নানা দুর্ভোগ, বন্ধুদের অবহেলার পর তার কবি মনে মাতৃভূমির অফুরন্ত রত্ন ভান্ডারের কথা মনে আসে।
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত মাতৃভূমিতে ফিরে আসা এবং বৈবাহিক জীবন নিয়ে আলোচনার শেষার্ধে উল্লেখ করবো।
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের হাতে কবিতার আধুনিক রূপায়নে ‘মেঘনাদবধ’ মহাকাব্য অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। ‘মেঘনাবধ’ ব্যাতিরেকেও ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’সহ বহু কবিতায় আধুনিক রূপায়ন ঘটেছে।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত ‘মেঘনাবধ’ কাব্যে রাবণ চরিত্রের বিনির্মাণ করে তাঁর বিদ্রোহী শক্তির সাহসী প্রকাশে স্বকীয়তা দেখিয়েছেন। তিনি ‘ বাল্মীকিকে বন্দনা করে তাঁর রচনা শুরু করেন। রচানাকালে বারংবার স্মরণ করেছেন, হোমার, মিল্টন. দান্তে, ভাজিলের মতো পাশ্চাত্যের কবিকুল শিরোমণিদের কথা।’
‘মেঘনাবধ’ কাব্য রচনাকালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত তখন একজন যশস্বী লেখক।
মোহিতলাল মজুমদার ‘মেঘনাবধ’ কাব্য প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘ আমি এই গ্রহ্ণে মেঘনাদবধ কাব্যের বিস্তারিত আলোচনা করিয়াছি, তার কারণ উহাই মধুসূদনের একমাত্র কাব্যকীর্তি-যাহা শুধুই তাঁহার কবি প্রতিভার নয়, তাঁহার কবি-জীবনের, বা তাঁহার অন্তরস্থ সেই কবি-পুরুষের পূর্ণ পরিচয় বহন করিতেছে। আবার তিনি অন্যত্র বলেছেন, ‘ মধুসূদনের মেঘনাদবধই তাঁহার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক কীর্তি্ তাহার পূর্বে ও পরে তিনি যাহা কিছু রচনা কয়িাছিলেন, তাহাতে তাঁহার কবি-মানসের কাব্যকলা-কুতূহল প্রকাশ পাইয়াছে।….এই দুই কাব্যের ( অর্থাৎ ব্রজাঙ্গনা ও বীরাঙ্গনার) ভাব-কল্পনা খুব গভীর নহে—কাব্যকলার সংষ্কার ও সমৃদ্ধিসাধনই ইহাদের একমাত্র সার্থকতা।’
একজন যশস্বী কবি ও কাব্য সমালোচক মোহিতলাল মজুমদারের মাইকেল মধুসূদন দত্তের কাব্যসমূহ নিয়ে সমালোচনা এবং মতামত। তবে অধিকাংশ বিদগ্ধজন কবি মধুসূদন দত্তের বাংলা-ইংরেজী কবিতার অনেক প্রশংসা করেছেন।তাঁর কবি আত্মার বিদ্রোহী রুপের কথা বলেছেন। সব সমালোচকদের আমাদেরে এই আলোচনায় উল্লেখ করলে এটি প্রতিপাদ্য বিষয়ে একটি বড় বই লেখা যায়। আমরা সেই দিকে আর যাবো না। তবে অধিকাংশই আলোচক-সমালোচক ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যকেই শ্রেষ্ঠ হিসেবে তুলে ধরেছেন।
এই মহাকাব্যে কবি প্রচলিত মিথ ভেঙ্গেছেন অনেকস্থানেই। তাঁর সবটা আলোচনা করা নিষ্প্রয়োজন মনে করছি। বোদ্ধা পাঠক এটি জানেন অথবা জেনে নেবেন।
মেঘনাদবধ ১৮৬১ খ্রী: প্রকাশিত হয়। মাইকেল মধুসূদন দত্তের এই কাব্য অমিত্রাক্ষরছন্দে রামায়ণ উপাখ্যানঅবলম্বনেরচিত।চরিত্র-চিত্রহিসেবেরয়েছেন : রাবণ, ইন্দ্রজিৎ, সীতা, সরমা, প্রমীলাপ্রমুখ।তিনিতাঁরকাব্যকেঅষ্টাধিকসর্গেবিভক্তকরেছেনএবংসংস্কৃতঅলঙ্কারশাস্ত্রঅনুযায়ীএতেনগর, বন, উপবন, শৈল, সমুদ্র, প্রভাত, সন্ধ্যা, যুদ্ধ, মন্ত্রণাপ্রভৃতিরসমাবেশওকরেছেন।এই কাব্য প্রকাশিত হওয়ার পরে বহু বছর পার হয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। দুই বাংলার কাব্য-প্রেমী , সুধি পাঠক, সমালোচকেরা ‘মেঘনাদবধ’ –কে অবেহলা করতে পারেননি। যতদূর জানা যায়, শ্রী কালীপ্রসন্ন সিংহ, রাজনারায়ণ বসু ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যের প্রথম সমালোচক ।সমসাময়িক সময়ে সমালোচকরা দুই বাংলার ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করতে গিয়ে দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। এই মহাকাব্যের প্রশংসা এবং নিন্দা দেশের পাঠক সমাজে এক কৌতুহলে এবং কাব্যটি পাঠে অধিক আগ্রহ সৃষ্টি করে। এখানেই কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের অনেক বড় প্রাপ্তি। তিনি আমাদের মাঝে নেই। মৃত ব্যক্তির কোনো গ্রন্হ নিয়ে সমালোচনা (রিভিউ ) করা যুক্তিসংগত নয়। সেই সময়ে দুইভাগে বিভক্ত সমালোচকদের মধ্যে অধিকাংশই এই কাব্যের প্রশংসা করেছেন। অধিকাংশের মতামতই গ্রহণযোগ্য। শ্রী কালীপ্রসন্ন সিংহ মহাশয় এই কাব্যেকে অভিনন্দিত করে লিখেছেন, ‘ ‘‘ বাঙ্গালা সাহিত্যে িএক প্রকার কাব্য উদিত হইবে, বোধহয়, সরস্বতীও স্বপ্নে জানিতেন না। ….লোকে অপার ক্লেশ করিয়া জলধি-জল হইতে রত্ন উদ্ধারপূর্বক বহু মানে অলঙ্কারে সন্নিবেশিত করে। আমরা বিনা ক্লেশে বিনা ক্লেশে গৃহমধ্যে প্রার্থনাধিক রত্ন লাভে কৃতার্থ হইয়াছি।এক্ষণে আমরা মনে করিলে তাহারে শিরোভূষণে ভূষিত করিতে পারি এবং অনাদর প্রকাশ করিতেও সমর্থ হই।’
এ কথা হয়তো সবাই জানেন, কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য রচনাকালে অনেক বন্ধুকে চিঠি লিখেছিলেন। তাঁদের মধ্যে শ্রী রাজনারায়ণ বসুকে, যে চিঠিগুলো লিখেছিলেন, তার বিচার-বিশ্লেষণ করলে কবি মনের মানসিক অবস্থার পরিচয় বেশ ষ্পষ্ট হয়ে দেখা দেয়। তিনি রাজনারায়ণকে ১৮৬০ খ্রী: ১৪ জুলাই লিখলেন, ‘ It is not that I am more industrious than my neighbours, I am at times as lazy a dog as ever walked on two legs, but I have fits of enthusiasm that come on me occasionally, and then I go like the mountain-torrent!..... I never drink when engaged in writing poetry, for if I do, I can never manage to put two ideas together.
‘মেঘনাদবধ’ কাব্যের দ্বিতীয় স্বর্গের দুইশত পংক্তি লেখা শেষ করেছেন, এই সংবাদও তিনি তাঁকে দিয়েছিলেন।
ষষ্ঠ স্বর্গের সমাপ্তির সংবাদ দিয়ে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত রাজনারায়ণ বসুকে, লিখেছিলেন, ‘ A few hours after we parted, I got a severe attack of fver and was laid up for six or seven days. It was a struggle whether Meghnad will finish me or I finish him. Thank Heaven, I have triumphed.
এই পত্রগুলো বিশ্লেষণ করলে সুধি পাঠক খুব সহজেই ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য রচনার সময় কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত’র মনো জগতের এক গভীর অনুরনন অনুধাবন করতে পারছেন।‘মেঘনাদবধ’ কাব্য রচনাকালে তিনি প্রবলভাবে আবেগ তাড়িত হয়েছেন। মেঘনাদের মৃত্যুর বর্ণনা কবি’র মন –মননে , কবি সত্তাকে কিভাবে নাড়িয়েছিল তার পরিচয় পাওয়া যায়।
‘মেঘনাদবধ’ কাব্যের প্রথম স্বর্গ শুরু করেছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই ভাবে-
(তৃতীয় সর্গ -সমাগম)
প্রমোদ-উদ্যানেকাঁদেদানব-নন্দিনী
প্রমীলা, পতি-বিরহে-কাতরাযুবতী।
অশ্রুআঁখিবিধুমুখীভ্রমেফুলবনে
কভু, ব্রজ-কুঞ্জ-বনে, হায়রেযেমনি
ব্রজবালা, নাহিহেরিকদম্বেরমূলে
পীতধড়াপীতাম্বরে, অধরেমুরলী।
[................................]...........
.............................................।
ষষ্ঠ সর্গ
কুশাসনেইন্দ্রজিৎপূজেইষ্টদেবেনিভৃতে; কৌশিকবস্ত্র,কৌশিকউত্তরি, চন্দনেরফোঁটাভালে, ফুলমালাগলে।পুড়েধূপদানেধূপ; জ্বলিছেচৌদিকেপুতঘৃতরসেদীপ; পুস্পরাশিরাশি, গন্ডারেরশৃঙ্গেগড়াকোষাকোষী, ভরাহেজাহ্নবি, তবজলে, কলুষনাশিনীতুমি; পাশেহেম-ঘন্টা, উপহারনানাহেমপাত্রে ; রুদ্ধদ্বার ;— বসেছেএকাকীযমদূত, ভীমবাহুলক্ষণপশিলামায়াবলেদেবালয়ে।ঝনঝনিল
[………………………………………………………………………..].........
অষ্টমসর্গ
ভূপতিতযথায়সুরথী
সৌমিত্রি,বৈদেহীনাথভূপতিততথা
নীরবে;নয়নজল,অবিরলবহি
ভ্রাতৃলোহসহমিশি,তিতিছেমহীরে.
গিরিদেহেবহিযথা,মিশ্রিতগৈরিকে,
পড়েতলেপ্রস্রবণ; শূন্যমনাঃখেদে
রঘুসৈন্য,-- বিভীষণবিভীষণরণে,
কুমুদ,অঙ্গদ,হনু,নল,নীল,বলী,
শরভ,সুমালী,বীরকেশরীসুবাহু,
সুগ্রীব,বিষন্নসবেপ্রভুরবিষাদে;
নবমসর্গেরনাম ‘সংক্রিয়া’।
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ’ মহা কাব্যের সমস্ত কবিতা নিয়ে আলোচনা সল্প পরিসরে সম্ভব নয়। আমাদের আলোচনায় মেঘনাদবধ কাব্যকে প্রাধান্য দিয়ে তাঁর কবিতার নব রূপায়নের প্রতি আলোকপাত করাই মূখ্য উদ্দেশ্য।
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত শ্রী রাজনারায়ণ বসুকে ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য নিয়ে পত্র অনেক লিখেছেন। এর কারণ সুষ্পস্টভাবে জানা যায়নি।তবে রাজনারায়ণ বসু এই কাব্যটির দোষ-গুণ ‘খুঁটিয়ে’ বিচার করেছেন।সমালোচনার শুরুতে তিনি সাদামাটাভাবে প্রশাংসা করেছেন-
‘‘ বর্ণনার ছটা, ভাবের মাধুরী, করুণ রসের গাঢ়তা, উপমা ও উৎপ্রেক্ষার নির্বাচন-শক্তি ও প্রয়োগ-নৈপুণ্য অনুধাবন করিলে, তাঁহার ‘ মেঘনাদবধ’ বাঙ্গালা ভাষার অদ্বিতীয় কাব্য বলিয়া পরিগণিত হইবে।’
‘ মেঘনাদবধ’ কাব্যের দোষ-গুণ বের করতে গিয়ে শ্রী রাজনারায়ণ বসু যে পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন, তা বর্তমান সময়ে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে না। ‘ তাঁর বিস্তৃত আলোচনায় মেঘনাদবধ কাব্যটির ক্ষেত্রে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কাব্য কল্পনা শক্তি, অভিনবত্ব এবং কবির জীবনবোধের আধুনিকতা বিষয়ে একটি মন্তব্যও করেননি। তিনি এই কাব্যের প্রধান যে কয়টি দোষের উল্লেখ করেছেন, তা উল্লেখ করলেই দেখা যাবে কাব্যটির গভীরে না গিয়ে তিনি একান্তভাবে বাইরের দিক থেকে কাব্যটির বিচার করেছেন, অবহেলা করেছেন বাঙ্গলা কাব্যের নক রূপায়নের শুরু, মৌলিকত্ব, কবি কল্পনার অসাধারণ শক্তিকে অবহেলা করেছেন।বিজ্ঞজনেরা তাঁর এই সমালোচনা মনে করেননি। এটি আসলে নিন্দালোচনায় পরিনত হয়েছে । শ্রী রাজনারায়ণ দত্ত মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্যে সনাতন হিন্দু শাস্ত্রের মিথকে ভেঙ্গে দেওয়ায় তাঁর প্রতি রুষ্ট হয়ে এই নিন্দা করেছেন। কবি-কল্পনার একটি কাব্য রচনা হিসেবে মূল্যায়ন করেননি।
শ্রী রাজনারায়ণ বসু এই কাব্যটি নিয়ে ‘ বাঙ্গালাভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক বক্তৃতায় এই কাব্যটিকে দু দিক থেকে আক্রমণ করেছিলেন-
এক। ‘‘ জাতীয় ভাব বোধহয় মাইকেল মধুসূদনেতে যেরূপ অল্প পরিলক্ষিত হয়, অন্য কোন বাঙালী কবিতে সেরূপ হয় না। তিনি তাঁহার কবিতাকে হিন্দু-পরিচ্ছদ দিয়াছেন বটে, কিন্তু সেই হিন্দু পরিচ্ছদের নিম্ন হইতে কোট পান্টুলন দেখা দেয়। আর্যকুলসূর্য রামচন্দ্রের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ না করিয়া রাক্ষসদিগের প্রতি অনুরাগ ও পক্ষপাত প্রকাশ করা, নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে হিন্দু জাতির শ্রদ্ধাস্পদ বীর লক্ষণকে নিতান্ত কাপুরুষের ন্যায় আচরণ করানো,খর ও দূষণের মৃত্যু ভবতারণ রামচন্দ্রের হাতে হইলেও তাহাদিগকে প্রেতপুরে স্থাপন, বিজাতীয় ভাবের অনেক দৃষ্টান্তের মধ্যে এই তিনটি এখানে উল্লেখিত হেইতেছে।’
দুই। ‘‘ মাইকেল মধুসূদনের রচনাতে প্রাঞ্জলতার অত্যন্ত অভাব। কবির রচনাতে প্রাঞ্জলতা না থাকিলে তাহা মধুর হয় না। সকল শ্রেষ্ঠতম কবির রচনা অতিশয় প্রাঞ্জল….।’
এই অভিযোগ গুরুতর। হিন্দু সনাতন মতে বিশ্বাসীদের মনে আঘাত করেছেন, কবি মাইকেল মধুষূদন দত্ত ।‘ কোন মনোভাব নিয়ে কেন তিনি রামচন্দ্রের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন না করে রাবণ-ইন্দ্রজিৎ প্রমুখ রাক্ষসদের বর্ণনায় উল্লসিত হয়েছেন তা ভেবে দেখবার মত।
‘ কবি আপন জীবন-জিজ্ঞাসা ও কল্পনার বিশিষ্টতার সহযোগে তার যে রূপদান করেন তাই সাহিত্য।’
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত একটি মিথকে ভেঙ্গেছেন, ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যে এ কথা ঠিক। ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য ব্যাতিরেকেও তাঁর আরো রচনা আছে। সব মিলিয়ে বিশেষ করে বাংলা কবিতায় এক রূপায়ন করে গেছেন। আধুনিক সাহিত্য যুগের সূচনা হয়েছে। আমরা আলোচনা শেষ করেছি। উল্লেখ করেছিলাম, কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের বৈবাহিক জীবন নিয়ে শেষার্ধে আলোকপাত করবো ।
বৈবাহিক জীবন: মাদ্রাজেআসারকিছুকালপরেইমধুসূদনরেবেকাম্যাকটিভিসনামেএকইংরেজযুবতীকেবিয়ে করেন।তাঁদের দাম্পত্য জীবনআটবছরস্থায়ীহয়েছিল।রেবেকারগর্ভেমধুসূদনেরদুইপুত্রওদুইকন্যারজন্মহয়।মাদ্রাজজীবনেরশেষপর্বেরেবেকারসঙ্গেবিবাহবিচ্ছেদহওয়ারঅল্পকালপরেমধুসূদনএমিলিয়াআঁরিয়েতাসোফিয়ানামেএকফরাসিতরুণীকেবিবাহকরেন।আঁরিয়েতামধুসূদনেরসারাজীবনেরসঙ্গিনীছিলেন।১৮৫৬সালেমধুসূদনকলকাতায়ফিরেআসেন।পত্নীকেসেইসময়তিনিসঙ্গেআনেননি।
কবি মাইকেল মধুসূধন দত্ত শুধু একজন যশস্বী কবি ছিলেন না; তিনি নাট্যকার, অভিনেতা, প্রাবন্ধিক এবং একজন সমাজ সংষ্কারক ছিলেন। বিদ্যার শিরোমনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত নারীদের চার দেওয়ালে বন্দী না রেখে তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞানে শিক্ষিত করে তোলার জন্য কাজ করেছেন।
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারী তৎকালীন বৃটিশ শাসিত ভারতের বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশের যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর ১৯৬তম জন্ম বার্ষিকী উপলক্ষে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি ।