কবি: রহমান হেনরী
বাংলাদেশের কবিতাচর্চার বাঁকবদলের কবি রহমান হেনরী । আজ তার জন্মদিন । তার জন্মদিনে সাহিত্যবার্তার পক্ষ থেকে ফুলেল শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা ।
কবি, বিশ্বকবিতার বাঙলায়ন কর্মী, ‘পোয়েট ট্রি’ নামক কবিতাকাগজের সম্পাদক।
জন্ম: ১৪ জানুয়ারি ১৯৭০, তদানীন্তন রাজশাহী জেলার নাটোর মহাকুমায়। ষোল বছর
বয়স পর্যন্ত শৈশব কেটেছে নাটোর শহরে। পড়াশুনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের নির্বহিী বিভাগে কর্মরত হেনরী বর্তমানে স্থায়ীভাবে
ঢাকায় বসবাস করছেন।
উল্লেখযোগ্য কবিতাগ্রন্থ:
বনভোজনের মত অন্ধকার (১৯৯৮), গীতঅনার্য(১৯৯৯), প্রকৃত সারস উড়ে যায়(২০০০), সার্কাসমুখরিত গ্রাম(২০০১), খুনঝরা নদী (২০০৫), তোমাকে বাসনা করি(২০০৫), গোত্রভূমিকাহীন(২০০৯), দুঃখ ও আরও কিছু আনন্দ(২০১১), ব্রজসুন্দরীর কথা(২০১২), প্রণয়সম্ভার (২০১৪);
বাঙলায়নকৃত কবিতাগ্রন্থ:
আদোনিসের কবিতা(২০১২), অধিকৃত ভূখণ্ডের কবিতা (২০১২), কবিতার ত্রিভুবন (২০১২), নোবেলজয়ীদের কবিতা(২০১৪);
রহমান হেনরী'র কবিতা
শ্রী চণ্ডীর মাঠ
নদীর নিম্নাঙ্গে জল, ভাঁজে গুপ্ত বাঁকও;
বাঁকে বাঁকে স্তন পাতা, স্তনে স্তনে সাঁকো।
এ হেন দৃশ্যের ছবি, করে যাচ্ছো পাঠ—
বুকের ভেতরে খোলা শ্রী চণ্ডীর মাঠ।
মাঠের কিনারে আছি: ব্যবহৃত, একা।
সেইখানে গৌড়দেশ, কন্যাটির দেখা;
দেখামাত্র আমি এক মন্ত্রপাঠ করি—
আচানক দেখি, তুমি: নগ্ন স্থলপরী।
গোস্বা যদি করো! সেই গোস্বা বিমোচন
করিতে চাহিয়া, শিখি: মেয়েলি বচন।
বচনের বহু অর্থ। মেলে না সন্ধানে।
সব অর্থ থাকিবে কি বাংলা অভিধানে?
সন্ধান দ্বিবিধ; তার ত্রিবিধ কারণ।
সর্ব-বচনের মানে থাকা তো বারণ!
কেন কন্যা, অর্থ খোঁজো সকল কথার?
এ ঘোরে, বেঘোর হচ্ছে: নাঙা-অবতার।
অবতার বসে আছে মাঠের কিনারে—
কী মহার্ঘ খোঁজো তুমি ভাবের মিনারে?
খুঁজিতে খুঁজিতে দিন গড়ালো সন্ধ্যায়,
আমার আঙিনা দিয়া, কার বঁধু যায়?
পাড়াগাঁয়ে থাকি আমি, প্রতিবেশীহীন;
তোমার কাঁচুলি দেখি, বেশ তো রঙিন!
রঙিন না-বলে যদি বলা হতো লাল—
মেঘে ঢাকা ভোর হতো: রোদেলা সকাল।
তেমন রঙের লোভ সামলাতে কে পারে?
বসে আছো— উদাসিন, মেঘের সংসারে।
পাটে বসে, সূর্য সেই রঙ নিচ্ছে লুটে—
তাকে তুমি ধরেছিললে বাম করপুটে।
.
________
২.
সূর্য-সহোদরা কন্যা, গৌড়দেশে ঘর;
বিল্বস্তনবৃন্ত কাঁপে: সন্ধ্যার ভিতর।
আবার আরেক মন্ত্র করি যে-ই পাঠ—
মুহূর্তে অদৃশ্য সেই শ্রী চণ্ডীর মাঠ;
মাঠের নেপথ্যে তবু নদী দৃশ্যমান—
আমাকে দিতেছো কেন কবির সম্মান?
তোমার রূপের শুধু এক চিলতে ছবি
আঁকতেই, জোড়াসাঁকো আর সেই রবি—
পদ্মায় অস্ত গেল। আজকে রাত্তিরে,
নদীর নিম্নাঙ্গ-জলে নেমে যাচ্ছি ধীরে...
আমার রহে না নৌকা; তুমি স্থলপরী।
দু’জনাই সমলিঙ্গ— স্তনে স্তন ধরি
নাচিয়া উঠেছি মাঠে: দর্শকমণ্ডলী।
তুমি-আমি নগরীর মহা চিপাগলি।
গলির ভেতরে ঘর: ঘরে কন্যা শোয়া:
ফর্সা ঊরু, গাত্রবর্ণ— খাঁটি দুগ্ধধোয়া।
ঊরুসন্ধি কামহীন; তুমি যাচ্ছো কামে—
কর্তারা কিনেছে ঘাম বহু কম দামে।
আমি যদি কাম খুঁজি: বেকার জীবনে,
দেখা তার যথাসাধ্য মিলিবে কি বনে?
বন তো ছিলো না! ছিলো: শ্রী চণ্ডীর মাঠ—
তোমাকে খুঁজিয়া ফিরি নদীর তল্লাট।
তবে নগ্ন স্থলপরী, রহো— কোনখানে?
পানাহার শেষ হলে, যাবো কিন্তু স্নানে!
ফাঁদে বসা পাখি। তাকে ধরি কী ধরি না—
অতটা সহজে স্নান আমি তো করি না!
কিন্তু যদি স্নানে যাই— যদিও যাবো না;
কী করি, কী করি শেষে, সেই তো ভাবনা!
স্নান থেকে ফিরে, মাঠে, বানাবো মন্দির।
পুজার প্রসাদ জল— তের শ’ নদীর...
.
________
৩.
মাঠ যদি: তীর্থ; তবে নিকটেই বন—
তৃতীয় মন্ত্রের বলে করি আয়োজন।
মন্ত্রপাঠে ত্রুটি হলে, কত না বিভ্রাট!
পুড়ে, খাক হয়ে যাবে: শ্রী চণ্ডীর মাঠ।
তখন, চতুর্থ মন্ত্র পেতে চাই যদি,
উল্টাতেই জলপৃষ্ঠা; খুনঝরা নদী—
সে নদীর উৎসে যারা করে বসবাস,
তারা যদি টের পায়, মহা সর্বনাশ!
তবু সেই স্রোতে আমি পেতেছি সংসার—
সেথা এসে, খোলো তুমি উপাসনাগার।
তোমার ভজনে করি নগ্নদেহ পাঠ,
বুকের ভেতরে খোলা শ্রী চণ্ডীর মাঠ।
সেই মাঠে বসা আরও ছয় পুরোহিত,
তারাও বন্দনা করে— চেতনারহিত।
তখন পঞ্চম মন্ত্র যদি মনে আসে,
নদী হবে গ্রন্থ; যার মুদ্রা জলে ভাসে।
ভাসার মুদ্রায় জাগে: চিন্তাকল্পরাশি,
সকল দৃশ্যের পাঠ হবে কিন্তু বাসি!
বাসিকথা নিয়ে তবু তীর্থে বারোমাস—
তোমার সন্ধানে গড়ি একেলা নিবাস।
নিবাসে কি বাস করে তোমার বাসনা?
তুমি তো ভ্রমরাভ্রম। সহসা আসো না!
মন্ত্রপাঠে করিয়াছি তোমাকে হাজির;
অথচ গজালো দেশে: চারশত পীর!
শ্রী রূপার রূপ নিয়ে, তবু তুমি স্থির—
মাঠের কিনারে আমি গড়েছি মন্দির।
তুমি যদি শতরূপা, মাজারে-মন্দিরে—
নদীর নিম্নাঙ্গ-জলে নেমে যাচ্ছি ধীরে,
কত মন্ত্র, কত সূরা করে যাচ্ছি পাঠ!
বুকের ভেতরে খাঁ খাঁ: শ্রী চণ্ডীর মাঠ...
.
________
৪.
স্রোতার্ত নদীর কষ্টে ভেসে যাচ্ছে মাঠ,
উপসর্গ নিমজ্জিত শীর্ণ কড়িকাঠ—
অরণ্যে জন্মেছি একা; ভ্রমি শীর্ষদেশ।
এ ভাবে জন্মালো প্রাণে: ভক্তির আবেশ।
পাষাণে বেঁধেছো হিয়া, কন্যা-পাষাণিয়া,
ক্ষমার আনন্দ গেল অমাতে ভাসিয়া—
নিশ্চেতনে শুয়ে আছো: শ্রী চণ্ডী-মন্দিরে;
নদীজলে ডুবে যাচ্ছি— ধীরে ধীরে ধীরে...
ডুবে যেতে যেতে তবু উঠেছি ভাসিয়া।
ধরো তো নদীয়া-গীত, আমাতে আসিয়া!
গীতের ভেতরে যদি পুজার ছলনা—
জেনেও, এ মূর্খজনে, কেন তা বলো না?
ছলনা ছলনা বড়, ছলনার ছল;
নদী তো সামান্য, তবে এত কেন জল?
জলশীর্ষে বসে আছো: নগ্ন স্থলপরী,
শ্রী চণ্ডীর মাঠে ভাসে: মেঘের কস্তুরী।
ভক্তিতে ভক্তিতে রস, রসে রসে কাম,
কী সাধনে আজ তবে যত মনোষ্কাম
তোমাকে জানাই; আর না-জানিয়ে মরি!
দৃষ্টি ফেরাতেই, তুমি: চঞ্চলা কিশোরী।
নিঃসঙ্গ মাঠের পাশে: একেলা মন্দির।
মন্দিরের জানুছোঁয়া স্বপ্ননদীতীর।
সেই নদীতীরে বসে, যুগ যুগ কাটে—
আমি তো যাবো না কন্যা, পসরার হাটে!
পরবর্তী মন্ত্র যে-ই পাঠ করে উঠি,
মন্দির শোভাতে ফুল— প্রস্ফুটিত, দু’টি;
সে ফুলের দৃশ্যে, দেহ কেঁপে কেঁপে ওঠে—
কী কথা গোপন করো কুমকুম ঠোঁটে?
ঠোঁটেই ভক্তির কথা। ঠোঁটে রতিরস।
আমি তো হবো না কন্যা, বাসনার বশ!
.
________
৫.
তুমি যদি— ভগ্নি, বধূ; তুমি যদি মাতা।
দুর্গতিনাশিনী দেবী, বিষে পরিত্রাতা;
এসো, তবে এই মাঠে, মুগ্ধ-ধরিত্রীর
সাজাই বাসররূপী সাধন-মন্দির!
মন্দিরে কিসের পূজা? চলবে বিহার—
বীরণ শয্যায়, আমি: নাঙা-অবতার।
তুমি আমি সমলিঙ্গ; স্তনে স্তন ধরি
মাঠে বসে পান করি— গৌড়ী-কাদম্বরী।
তখন বরষা-মাস। মাঠভরা জল।
তুমি তো বসনা নও! কোথায় আঁচল?
নদী-মাঠে ভেসে যাচ্ছে: স্রোতেলা ধরণি
আমাদের নৌকা নাই। আঁচলই তরণী।
তাতে বসে, মন্ত্র পড়ি— জলদসংকুল;
মাথার উপরে ওড়ে: কাদম্বের কুল।
অথচ মন্ত্রের ঘোরে, মহাধন্দে পড়ি:
আচানক, জনাকীর্ণ জঘন্য নগরী—
তুমি নাই, আমি নাই, দৃশ্যের ভেতরে;
ধূলি-ধ্বনি-হাহাকার, একাকার ওড়ে...
এ হেন রহস্যমতে, কী করি, কী করি?
পুনরায় পুরোহিত মন্ত্রপাঠ করি—
আর দেখি, দেবী শোয়া ভক্তের শরীরে;
শীতার্ত নদীর স্রোত উষ্ণ হলো, ধীরে—
স্নান শেষে: সংকুচিত, নম্র-পুরোহিত,
আবারও মন্দিরে গাই: শ্রী চণ্ডী-সংগীত।
উপাসনা-মাঠে বাজে লুব্ধ হাহাকার—
প্রায়শ্চিত্য-লোভে, কবি: নাঙা-অবতার!
আমার সুন্দর
.
বয়স হয়েছে, আজ— বিশ্রাম প্রয়োজন আছে;
নির্ঘুমে তো অনেক বছর গেল— নিদ্রার প্রয়োজন আছে।
এ শহরে আমি কিছু লাগাতার শুক্রবার চাই।
শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঝাণ্ডা ওড়ানো গাড়ি
আমার তো দরকার নাই!
খালিপায়ে হেঁটেহেঁটে যাবো— সব রাস্তা যেখানে মিলেছে,
সেই আরাফাতে— রৌদ্রে ও বৃষ্টিতে দাঁড়াবো;
সমস্ত সড়ক থেকে স্বচালিত যানে, শুধু
তুমি একা ছুটে আসছো—
এই অভিবাস্তবতা আবারও চাক্ষুষে চাই;
এই দৃশ্য প্রয়োজন আছে। শোনো, সুনীল হরিণী!
এ শহরে আরও একবার শুধু তোমাকেই অধিষ্ঠানে চাই,
আমার সুন্দর, আজও তোমাকেই চাই— সম্ভ্রমলুণ্ঠিত স্বদেশে—
কালার প্যাডে
.
কথা তো এমনই ছিলো। কিছু
কথা চিরকাল ধ্রুব হয়ে থাকে; নিষেধের অজগর তোমার ওদিক থেকে ছুটে এসে, আমাকে
পেঁচিয়ে রাখবে সংকোচের বাঁকে— এ আর তেমন কিছু নতুনের থাপ্পর কোথায়? নদীর
প্রশ্রয় পেলে, বেগানা মাছের ঝাঁকও দূরে চলে যায়... নদীও তা জানে; জানে বলে
নির্বিকার থাকে—
কথা তো এমনই ছিলো: বন্ধুত্ব গড়াবে মাঠে, হৃদি-কুরুক্ষেত্র ফের রক্তে যাবে ভেসে;
পুষ্পে যদিও ফুটছি— দুর্গন্ধই পৌঁছে যায় বৈরী নাকে নাকে! অমিও বিবাহ করবো: এই মৌন নির্জন-সন্ধ্যাকে
.
.
২.
নিজেরই চুলের গন্ধ টের পাচ্ছি— মনে হচ্ছে, সাতসমুদ্র-মরু হৃদয়ের দেশে,
ডুবে যেতে যেতে আজও ভেসে আছি; সাঁতারু ভাল্লুক এসে শুঁকে ভাবছে— মৃত; এরকম
অলৌকিকে, শরীরের অখণ্ডতা এখনও সম্ভব হয়ে আছে।
বিজন মোটেল-কক্ষে শুয়ে
আছি এবং বাহন নিকটেই বিশ্রাম-সুস্থির; দুর্যোগের রাত শেষে, বাইরে বেরিয়ে
দেখছি: জংধরা নাটবল্টু; ব্যবস্থাপকের দাঁত সম্ভবত বত্রিশাধিক
ইঙ্গিতে আমাকে বলছে: —‘‘এরই মধ্যে তিন-যুগ পার হয়ে গেছে’’—
.
.
৩.
নিদ্রাপ্রিয় পৃথিবীর রাত্রিকুসুম, জেগে থাকো স্মৃতিজ-জ্যোৎস্নার কুয়াশায়;
শীতের সিথানে ক্লান্ত পড়ে থাক— বাবলার, খয়েরের কাঁটা।
বসন্তপূর্ণিমা-স্বপ্নে ঢুলুঢুলু চোখ, জেগে থাকো মাঘের মুল্লকে; টুপটুপ ঝরে
পড়ছে খেজুরের রস, চোরও আছে সুযোগসন্ধানে। স্বাদ-লালসার চোর সকল বংশেই জন্মে
থাকে। জাতে-অভিজাতে কোনও পার্থক্য কোরো না। ক্ষতিকর পোকায় ও বিষধরে চোখ
রেখো; (যদিও বিজ্ঞানে লেখা) সমস্ত শীতলরক্ত ঋতুঘুম পরোয়া করে না; আর আছে
সুচতুর জিরাফের গ্রীবা, পাহারার প্রাচীর ডিঙিয়ে যেতে পারে—
আরও একটু জাগো, ও চেতন! সতর্ক-অনিদ্রচোখে, আর কটা দিন জেগে থাকো— এক বাঘ দুইবার তোমাকে খাবে না; এক মাঘ বারবার উঠে দাঁড়াবে না—
.
৩.
তুমি আমার নামটি শুনেই প্রীত—
আমিও তোমার শিরোনামে: দ্বন্দ্ব-মুখরিত।
.