বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিমান কবি শহীদ কাদরী। তার কবিতায় নিজস্ব চিন্তা ও অনুভূতির বহিঃপ্রকাশের পাশাপাশি মানবজীবনের গভীরতর ভাব-সোকর্য এবং সংস্কৃতির নানা প্রসঙ্গ প্রকাশ পায়। একইভাবে তার শব্দ চয়ন ও নির্মিতিতে রূপায়ন ঘটে নাগরিক জীবন, মাতৃভূমির স্বাধীনতার স্বপ্নময় গভীর ভাবধারা। মাত্র চারটি প্রকাশিত গ্রন্থ এবং কিছু অপ্রকাশিত-অগ্রন্থিত কবিতার জন্য একটি দেশের কাব্যভুবনে কিংবদন্তিতুল্য খ্যাতি পেয়েছেন তিনি। – এমন কবির সংখ্যা আমাদের সাহিত্যে সত্যি বিরল।
আজ ২৮ আগস্ট বাঙালির অনন্য এই আধুনিক কবির দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। কবি শহীদ কাদরী ২০১৬ সালের ২৮ আগস্ট চিকিৎসাধীন অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে একটি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কবির মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন এবং তার নিজ উদ্যোগে কবির মরদেহ দেশে আনা হয়। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জাতির পক্ষ থেকে শেষ শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের পর কবিকে ঢাকায় দাফন করা হয়
কবি শহীদ কাদরী ১৯৪২ সালের ১৪ আগস্ট ভারতের কলকাতার পার্ক সার্কাসে জন্মগ্রহন করেন। দশ বছর বয়সে ১৯৫২ সালে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৮০ সালের দিকে তিনি প্রবাসজীবন কাটাতে শুরু করেন। চলে যান জার্মানিতে। সেখানে বেশ কয়েক বছর ছিলেন। তারপর যুক্তরাজ্যের লন্ডনে এবং পরে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাস জীবন কাটান।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক বছরসহ জীবনের প্রায় তিন দশক তিনি প্রবাসে বসবাস করেন। প্রবাস জীবনেও তিনি লেখালেখিতে সক্রিয় ছিলেন। লেখালেখির জীবনে দীর্ঘ ছয় দশক বাংলা কবিতায় নিজস্ব এক ঘরানা সৃষ্টির মধ্যদিয়ে এই কবি অসাধারণ কৃতিত্ব রাখেন। তিনি নাগরিক-জীবন-সম্পর্কিত শব্দ চয়নের মাধ্যমে বাংলা কবিতায় নাগরিকতা ও আধুনিকতাবোধের সূচনা করেছিলেন।
শহীদ কাদরী খুব একটা প্রথাগত ছন্দ-নির্ভর কবিতা লেখেননি। এখানেও তার একটা নিজস্বতা কাজ করেছে। তার কবিতার যে- উপলব্ধি, বলার যে-ভঙ্গি, শব্দ প্রয়োগের যেই মেলবন্ধন, সবকিছুই নির্দিষ্ট কোনো ছন্দছকে আবদ্ধ নই। সেটি কবি ইচ্ছা করেই করেননি। তবে মাত্রাবৃত্তে, স্বরবৃত্তে আর অক্ষরবৃত্তের সরল পথেও কিছু কবিতা লিখেছেন তিনি।
চৌদ্দ বছর বয়সে কবি বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত একটি সংকলনে তার লেখা প্রথম কবিতা ছাপা হয়। দেশ ভাগের পর আধুনিক বাংলা কবিতায় যে সব কবিদের রচনায় নবযুগের সূচনা ঘটে শহীদ কাদরী তাদের মধ্যে অন্যতম। কবি শহীদ কাদরীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উত্তরাধিকার’ প্রকাশ পায় ১৯৬৭ সালে। প্রথম গ্রন্থ প্রকাশ করেই পুরো সাহিত্যাঙ্গনে ঝাঁকুনি দিয়ে বসেন তিনি। গ্রন্থটি প্রকাশের মধ্য দিয়েই শহীদ কাদরী আধুনিক কবিতায় নিজস্ব অবস্থান সৃষ্টি করেন। এরপর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘তামাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’ দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে প্রকাশ পায় ‘ প্রেম বিরহ ভালবাসার কবিতা ’, ‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই’ এবং প্রবাসে লেখা কবিতা নিয়ে প্রকাশ পায় ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দিও।’
শহীদ কাদরী প্রবাসে থেকে যে কবিতাগুলো লিখেছেন, তার অধিকাংশই স্বদেশভূমির জন্য তার প্রবল আকুতি ও বিরহ কাতরতায় আবৃত। তিনি দেশ থেকে বহু দূরে থেকেও দেশকে কখনোই ছাড়েননি, তার কবিতায় বারবার সেই প্রমাণ মিলেছে। পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পালাবদলের পর যে নারকীয় যুগের আগমন, কবি তাকে কখনো মেনে নিতে পারেননি।
শুধু তাই নয়, মৌলবাদের ক্লেদাক্ত নখদন্ত তাকে প্রবলভাবে আহত করে। তাইতো তিনি ঘৃণাভরে তাদের প্রত্যাখ্যান করেন কবিতার অজস্র পঙক্তিতে।
শৈশবের মাত্র দশ বছর তিনি কোলকাতা শহরে কাটিয়েছিলেন। অথচ, সেই শহরের স্মৃতি তিনি আজীবন লালন করেছেন। অভিজাত মুসলিম পরিবারে তার জন্ম হলেও ভালোভাবে বাংলা শেখার আগে তিনি শিখেছেন উর্দু ও ইংরেজি। নাগরিক, শহুরে জীবনের আলো ও অন্ধকার দুটোই তার দেখা। তাইতো তার কবিতায় পাপ-চেতনার চরম উপলব্ধি ও প্রকাশ দেখা মিলে। সেটি সম্ভবত কলকাতার কারণেই। কবিতাই ছিল তার বাঁচার প্রেরণা এবং মূল সঞ্জীবনী শক্তি। শহীদ কাদরীর কবিতা আপাতত মনে হয় সহজ-সরল ও বর্ণনামূলক; কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে চমকে উঠতে হয় তার কবিতার পঙক্তির চমৎকারিত্বে! তার কবিতা আমাদের নিয়ে যায় সম্পূর্ণ আলাদা এক জগতে। যেখানে বিশ্ব-নাগরিকতাবোধ ও গভীর স্বদেশপ্রেমের মিশেলে শব্দ-উপমার অনবদ্য গাঁথুনির অভিনবত্ব মুগ্ধ করে সবাইকে।
শহীদ কাদরী তরুণদের মধ্যে অনেক বেশি জনপ্রিয়। তার মৃত্যুর খবরে পত্র-পত্রিকার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের কাতরতা, হাহাকার এবং শোকাবহ শোরগোল -এর আগে কখনো দেখা যায়নি। তিনি অনেক কম লিখেও অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়েছেন। এই তো কবির সার্থকতা।
শহীদ কাদরী আমাদের সাহিত্যভাণ্ডারে যা রেখে গেছেন, তা অসামান্য ও অতুলনীয়। প্রকাশক মফিদুল হক তার সম্পর্কে বলেছেন, ‘বাংলা কবিতার অতিসাম্প্রতিক সৃষ্টি-প্রাচুর্যের ভিড়ে তাকে কেউ খুঁজে পাবেন না। অথচ সাতচল্লিশ-উত্তর কবিতাধারায় আধুনিক মনন ও জীবনবোধ সঞ্চারিত করে কবিতার রূপ বদলে যাঁরা ছিলেন কারিগর, শহীদ কাদরী তাঁদের অন্যতম প্রধান। তাঁর কবিতা আমাদের নিয়ে যায় সম্পূর্ণ এক আলাদা জগতে, ঝলমলে বিশ্ব-নাগরিকতাবোধ ও গভীর স্বাদেশিকতার মিশেলে শব্দ, উপমা, উৎপ্রেক্ষার অভিনবত্বে তিনি যেন বিদ্যুৎ-চমকের মতো এক ঝলকে সত্য উদ্ভাসন করে পরমুহূর্তে মিলিয়ে গেলেন দূর দিগন্তের নিভৃত নির্জনতার কোলে।’
অপ্রিয় হলেও সত্যি যে, কথাসাহিত্যিক শহীদুল জহিরের মতো অতি কমসংখ্যক গ্রন্থ বা লেখার জন্য জাতির কাছে জীবদ্দশার চাইতে অনেক বেশি প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছেন শহীদ কাদরী। সেটি তার অনবদ্য সৃজনকর্মের আবেদন এবং গভীরতম শিল্পগুণের শক্তির জন্যই। তার কবিতার সংখ্যা, গ্রন্থের সংখ্যা আর এক গ্রন্থ থেকে অন্য গ্রন্থ প্রকাশের ব্যবধান ভাবিয়ে তোলার মতো। অবশ্য একজন কবির সৃষ্টি-সংখ্যা দিয়ে তার কৃতিত্ব বিচার্য নয়, তার সৃষ্টিটাই বিবেচ্য।
পৃথিবীবিখ্যাত অনেক কবি-সাহিত্যিক আছেন, যাঁদের গ্রন্থসংখ্যা খুবই অল্প। কবি শহীদ কাদরীও তেমনি একজন। কাব্যসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য শহীদ কাদরী ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। ২০১১ সালে তাকে রাষ্ট্রীয় অন্যতম সর্বোচ্চ সম্মাননা একুশে পদক প্রদান করা হয়।