পরিচিতি
শিহাব শাহরিয়ার। লেখালেখির শুরু ১৯৮০ সালে। নিয়মিত কবিতা, প্রবন্ধ ও মাঠ পর্যায়ে ফোকলোর বিষয়ে গবেষণা ও দীর্ঘ সাড়ে ৩ যুগ ধরে বেতার ও টেলিভিশনে অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করছেন। ২০০৫ সাল থেকে সম্পাদনা করছেন লোকনন্দন বিষয়ক পত্রিকা বৈঠা। বৈঠা’র বেরিয়েছে : ‘জ্যোৎস্না’ ও ‘বৃষ্টি’ সংখ্যা। বেরুচ্ছে : ‘গ্রাম’ সংখ্যা।
শিহাবের প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ হলো : কবিতাগ্রন্থ ১. হাওয়ায় রাত ভাসে ভাসে নিদ্রা ২. ফড়িঙের পাখা পোড়ে ৩. নদীর তলপেট ফোঁড়ে উড়ে যায় রোদ ৪. নির্বাচিত কবিতা: আমি দেখি অন্য আকাশ। ৫. মাতাল মেঘের ওড়াউড়ি ৬. যখন ভাঙে নক্ষত্র ৭. খড়ের খোঁয়াড় ৮. কথোপকথন: দূরে ওড়ে শঙ্খচিল ৯. প্রেমের কবিতা ১০. রাত পৌনে চারটা ১১. পড়ে থাকে অহংকার ১২. অদৃশ্যগুচ্ছ, ১৩. কবিতা সংগ্রহ। প্রবন্ধগ্রন্থ ১৪. নরম রোদের আলোয়। গল্পগ্রন্থ ১৫. ঘাটে নদী নেই। গবেষণাগ্রন্থ ১৬. বাংলাদেশের পুতুলনাচ ১৭. বাংলাদেশের হাজং জনগোষ্ঠী ১৮. বাংলাদেশে কোচ জনগোষ্ঠীর সমাজ ও সংস্কৃতি ১৯. বাংলা একাডেমি বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা শেরপুর। ভ্রমণগ্রন্থ ২০. মেঘের আলোয়। সম্পাদনা ২১. আমার বাংলাদেশ ২২. রূপকথার এই বাংলাদেশ। ২৩. স্মৃতিগদ্যগ্রন্থ: স্মৃতিসুধা ধরা থাক। ২৪. কবিতা সংগ্রহ ২৫. নিঃসঙ্গ নদীছায়া।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স এবং এম. এ করেছেন। ২০১০ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ. ডি. ডিগ্রি লাভ করেছেন। ড. শিহাব শাহরিয়ার সাংবাদিকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। ২০০০ সাল থেকে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে কর্মরত রয়েছেন। বর্তমানে জাদুঘরের জনশিক্ষা বিভাগের কীপারের দায়িত্ব পালন করছেন।
তিনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, শ্রীলঙ্কা, বাহরাইন, কাতার, মালয়েশিয়া, জার্মানী, ফ্রান্স, চেক রিপাবলিক, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, ভুটান, আর্জেটিনা ও চিলি প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করেছেন। তাঁর পছন্দ ভ্রমণ করা, নদীতে বৃষ্টি দেখা, পূর্ণিমার রাতে সমুদ্রে সৈকতে বসে থাকা। তাঁর জন্ম : ১৯৬৫ সালে। জন্মস্থান: শেরপুর। বিবাহিত। তিনি প্রাচুর্য শাহরিয়ার ও সমৃদ্ধ শাহরিয়ার এই দুই পুত্রের জনক । একান্ত আলাপনে দেশের অন্যতম কবি, গবেষক, প্রাবন্ধিক, গাল্পিক, সমালোচক, সম্পাদক, উপস্থাপক, আবৃত্তিকার, নির্মতা ও আড্ডাবাজ বলেছেন নিজের লেখালেখি ও সাহিত্যের নানা প্রসঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আরিফুল ইসলাম ।
আরিফুল ইসলাম: একেবারে শুরু থেকেই শুরু করি—আপনার ছেলেবেলার কথা শুনতে চাই।
শিহাব শাহরিয়ার: মানুষের সবচেয়ে স্মৃতিময় সময় হল ছেলেবেলা। আমার ছেলেবেলা স্মৃতিময় কিনা জানি না, তবে আনন্দে-বেদনায় কেটেছে এটা বলতে পারি। জন্ম নানার বাড়ি, তৎকালীন শেরপুর মহকুমায়—১৯৬৫ সালে। নদী দশানির পাড়ে, একটি নিবিড় গ্রামে। পরবর্তীতে—যে গ্রামে মা’র সঙ্গে কখনো গরুর গাড়ি, কখনো মহিষের গাড়ি, কখনো রিকশা দিয়ে যেতাম। আমাকে নানি দারুণ আদর করত। বিকেলবেলা বেতের সেরের মধ্যে সচপিনের জ্বাল দেয়া দুধের সর নলা পাকিয়ে খেতে দিতো। দশানি নদীতে মামার সঙ্গে মাছ ধরতেও যেতাম। অসংখ্য তাজা মাছ দেখে চোখে আনন্দ ধরত। সেখানে সম-বয়সীদের সঙ্গে গ্রামের নানান খেলা-ধুলায় দিন কাটিয়ে দিতাম। শেরপুর শহরে ছিল আমার ছোট মামার বাসা। মামার একটি ওষুধের দোকান ছিল। ঘুম থেকে উঠেই দোকানে মামা আমাকে তার পাশের চেয়ারে বসাতেন। সেই ছোটবেলায়ই ওষুধের গন্ধ কেমন যেন লাগত। দেখতাম সকাল থেকে—রাত পর্যন্ত আশে পাশের গ্রাম থেকে অসংখ্য মানুষ এসে নানা প্রকারের ওষুধ নিয়ে যেত। কেউ কেউ এসে বলত—ডাক্তার সাব পেটের ব্যথা অথবা জ্বর অথবা পেটে কৃমি হইছে ইত্যাদি ইত্যাদি। মামা কিন্তু ডাক্তার নন, তবু সঠিক ওষুধ দিতেন—অভিজ্ঞতায়, এছাড়া মামার চাচাত ভাই ডাঃ শাহাদাত হোসেন বিকেলে দোকানের এক কোনে চেম্বারে বসতেন। সকাল বেলাতেই দেখতাম—মামার বাসার সামনে ইয়া ভুড়িওয়ালা হিন্দু ব্যবসায়ীরা সাদা লুঙ্গি পরা ও খালি গায়ে গদিতে বসতেন, কেউ সরিষার ব্যবসা, কেউ অন্যান্য ব্যবসায়। তাদের বাসায় পূজা হতো, সেখানে যেতাম, পরে শুনেছি ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় অধিকাংশ মারোয়ারী এই বড় ব্যবসায়ীরা স্বর্ণ-টাকা-পয়সা সব নিয়ে রাতের অন্ধকারে ভারতে পালিয়ে গেছে। এই তো নানার বাড়ির কিছু সময়ের কিছু কথা বললাম—তবে আমার শৈশব আর কৈশোরের পুরো সময় কেটেছে—নিজের গ্রাম সাতানী পাড়ায়। এটি অজপাড়া গাঁ। ব্রহ্মপুত্র বিধৌত এই গ্রাম—পাখি ডাকা, ধূলিমাখা, ছায়াময়, মায়াময় গ্রাম। অবারিত শস্যখেত আর শাখা নদীর স্পর্শে ধন্য এক স্বাধীন বালক আমি। বাবা প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক, যাঁকে চৌদ্দ গ্রামের মানুষ মাস্টার সাহেব হিসেবে চিনে, যিনি একজন আদর্শ পিতা, যিনি উদার, ধর্মনিরপেক্ষ, মানবিক মানুষ। তাঁর অধীনেই প্রাথমিক বিদ্যাপিঠ পার করেছি এবং সহ-শিক্ষকদের স্নেহও ছিল অনন্য। এঁদের একজন তবারক আলি স্যার আমাকে সুন্দর হাতের শিখিয়েছেন। আরবির শিক্ষক আরবী ও কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন। আর গ্রাম ছিল আমার অবাদ বিচরণ ক্ষেত্র। প্রচুর বন্ধু-বান্ধব ছিল। দাদির দেয়া জমিতে আব্বা স্কুল করে দিয়েছিলেন, যে স্কুলের মাঠে সকাল-বিকাল পড়ে থাকতাম ফুটবল নিয়ে। খেলেছি গ্রামের সব ধরনের খেলা, দাড়িয়াবান্ধা, বৌচির, হা-ডু-ডু, ডাংগুলি, কানামাছি ইত্যাদি। অ্যাথলেটে গ্রামের সেরা ছিলাম, যেমন—দৌড়, লংজাম্প, হাইজাম্প, পুলজাম্প ইত্যাদি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে থানা, মহকুমা ও পরবর্তীতে জেলা পর্যায় থেকে অনেক পুরস্কার পেয়েছি। আমাকে সাঁতার শিখেছেন আব্বা—নদীতে নিয়ে কোমর পানিতে নামিয়ে আমাকে মাছের মত করে ধরে দিনের পর দিন শিখিয়েছেন। এরপর সাঁতার কেটে পাশের বেতমারী বিল, ব্রহ্মপুত্রের শাখা, মৃগী নদী ও মূল ব্রহ্মপুত্রে সাঁতার কেটে পাড় হয়েছি। একবার ভরা বর্ষায় নান্দিনা স্কুল থেকে ক্লাস শেষে ফিরার সময় ব্রহ্মপুত্র নদীতে নৌকা ডুবে গেলে আমরা বন্ধুরা সবাই সাঁতার কেটে তীরে উঠেছিলাম। এই যে নদী ও বিলের কথা বললাম—এতে গোছল করেছি, মাছ ধরেছি আর বর্ষা ও শীত ঋতুতে এদের নানা রূপ দেখেছি। ১৯৭৪ সালে ভরা বর্ষায় নদী-বিল ভরে গ্রামে ঢুকে যায় পানি। আমাদের বাড়ির আঙিনাও ডুবে যায়। বন্যার পানির রূপ—আহা কী যে ভয়াবহ! মানুষ-পশু-পাখি-জন্তু সবাই এক সাথে সহাবস্থান করেছে। বন্যার পানি নেমে যাবার সাথে সাথে গ্রামে দেখা দিল—ভয়াবহ আকাল। মানুষ কচুর ডগা, আটার জাউ আর কত কিছু খেয়ে যে জীবন ধারণ করেছে—আহা দুর্ভিক্ষ! আব্বার কাছে আসতো রিলিফের বিস্কিট-গুড়া দুধ। তিনি কত মানুষকে দিয়েছেন, আমার ছোট চোখে অবাক বিস্ময়? আমরাও কোনো কোনো দিন একবেলা খেয়ে জীবন ধারণ করেছি। তখন সহস্র বছরের পরাধীন পুরনো বাংলাদেশ অনেক রক্তক্ষয়ের মাধ্যমে স্বাধীন হয়ে গেছে। এই ছোট্ট এক কিশোরের চোখে ভয় আর আনন্দানুভ‚তির মধ্যেই ছিল মুক্তিযুদ্ধের গাঁথা। শীতের কনকনে ঠাণ্ডায় বা ভরা বর্ষায় ডিঙি নৌকায় করে মুক্তিযোদ্ধাদের চুপিচুপি আগমন এবং এক নিমিষে খেয়ে নীরবে বিজয়ের জন্যে পলায়ন আমার কিশোর মনকে নাড়িয়ে দিয়েছে বৃক্ষশোভিত শাখা নদীটির তীরে। ভয়ের পর জয়ের আনন্দে যখন কেঁপে কেঁপে উঠল প্রিয় বাংলাদেশ, তখনও দেখলাম স্বদেশের সবুজ ও প্রথম দেখা সূর্যের লাল গোলচিহ্ন সম্বলিত পতাকারা পত্ পত্ উড়ছে। তারপর আমি নির্ভয়ে হারিয়ে যাই অবারিত শ্যামলিমা, অনিন্দ নীলাকাশ আর জলাঙ্গীর ঢেউয়ে। গ্রামে থেকেই দেখেছি—ষড়ঋতুর অপরূপ চেহারা। কখনো প্রকৃতির নিটোল, কখনো ভয়াবহ গ্রাস দেখেছি। বসন্তে সবুজ পাতার মান্দার, শিমুল গাছে লাল টকটকে ফুল দেখে যেমন অভিভূত হতাম, তেমনি শরতে নদীর তীরে কাশফুল দেখেও মনে দোলা লাগত, শীতের সকালে মিষ্টি রোদে বসে আম্মার হাতে তৈরি নানা ধরনের পিঠা—আহা কী যে মজা! আর একইসঙ্গে আনন্দ ও বিষাদে ভরে যেত বর্ষার রূপে। সেই তখনই আব্বা আমার কানে কানে বলেছিলেন—রবীন্দ্রনাথের কথা। তাই আমাদের টিনের ঘরের কাঠের জানালার পাশে বসে দেখতাম বৃষ্টির অপরূপ রূপ। দেখতাম আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে, মাঠ থেকে গরু-ছাগল-মহিষ নিয়ে ফিরছেন কৃষক, ধেয়ে আসছে মেঘ—তখন আমার বালক মন গেয়ে উঠেছে—‘নীল নব ঘনে আষাঢ় গগনে/ তিল ঠাঁই আর নাহিরে/ ওগো আজ তোরা যাছনে ঘরের বাহিরে’। রবীন্দ্রনাথের পর জীবনানন্দ দাশও কী আমাকে ভর করেছিল তখনই? বোধহয় না—তবে গ্রামের প্রকৃতির মধ্যে বেড়ে উঠতে উঠতে আমার মন তৈরি হয়েছে বিভূতিভূষণের অপুর মতো। সেই সময়ই মকবুল বয়াতির পালাগান শুনেছি, পুঁথিপাঠ শুনেছি, কাবলিওয়ালার হাঁক শুনেছি, নাটক দেখেছি, নৌকা বাইচ দেখে, নৌকা নদীতে মাইকে গান বাজিয়ে নদীভ্রমণ করেছি, গরু দিয়ে হাল চাষ করা শিখেছি, সন্ধ্যায় গ্রামের হাটে গিয়ে দেখেছি নানান পসরার—বেচা-কেনা। আব্বা ভোর বেলা উঠে বিল থেকে তাজা মাছ নিয়ে আসতেন, দুধ নিয়ে আসতেন। গ্রামে যত ধরনের ফল ছিল তা বিভিন্ন সময়ে খেয়েছি—আহা কী যে আনন্দ। আম ভর্তা, জাম ভর্তা, বড়ই ভর্তা, কামরঙ্গা ভর্তা সেই সময় দারুণ স্বাদের ছিল। আব্বার হাতের আঙুল ধরে হেঁটে হেঁটে নান্দিনা, শেরপুর, জামালপুর গিয়েছি। মামা আমাকে ট্রেনে উঠিয়ে নান্দিনা থেকে জামালপুর নিয়ে গেছেন। প্রথম ঝিকঝিক ট্রেনে উঠার অনুভূতি কী বলে বুঝানো যাবে? ঝিকঝিক সেই ট্রেনের ডাকেই একদিন বকুল ফুলের মৌ মৌ ঘ্রাণ করা মফস্বলে এলাম। পিছনে থাকল শাখা নদী, বিল আর ব্রহ্মপুত্রের রাশি রাশি বালি। ফেলে এলাম¬—হেলেনা, মজনু, জমিলাকে—যারা আমার ছেলেবেলার সহপাঠি হিসেবে কৈশোরের রূপ-রসকে পরতে পরতে ভরে দিয়েছে। ফেলে এলাম—সরিষার হলুদ রং, আমের সাদা বৌল, বৈঠক ঘরের পাশের পিয়ারা গাছ, সাইকেল চালানো প্রিয় ধূলি-সড়ক। ফেলে এলাম—আব্বা ও বড় ভাই কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের কাছে আসা হলুদ খামের অসংখ্য চিঠি, কলকাতা ও ঢাকা থেকে আসা সাহিত্য পত্রিকা, ম্যাগাজিন। হারিয়ে গেল অসংখ্য সকাল, ঘুঘুডাকা দুপুর, কুপিবাতি ও হারিকেনের ম্রিয়মান সন্ধ্যা এবং জ্যোৎন্সামাখা গভীর রাত। চোখে চোখে বেসে উঠবে নতুন পানিতে পুঁটি মাছ, স্রোতজলে ধঞ্চা পাতার খুনসুটি। এরপর লিখেছিলাম: বকুলতলা, রেল লাইন/ ছোট ছোট গলি / সুখ সুখ মফস্বল, কিশোরী আঁচল/ অথচ মায়ের ছায়ারা বুকের ভেতর / বাড়িয়েছে কেবল দুঃখজল
কিন্তু দ্যাখ, কত সহজেই/ ছোঁয়া যেতো ব্রহ্মপুত্রের অথৈ জল...’। আমার আত্মার অংশ হয়ে আছে নদ ব্রহ্মপুত্র।
আরিফুল ইসলাম: লেখালেখির ভূতটা কখন মাথায় চাপল? সুন্দরের কাছে শর্তহীন আত্মসমর্পণের বিষয়টি কি উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়েছেন?
শিহাব শাহরিয়ার: লেখালেখি করবো, এটা কখনোই ভাবনায় ছিল না। বলেছি, আগে খুব খেলাধূলা করতাম, যেমন নান্দিনায় এসে ফুটবল, বাস্কেটবল, ভলিবল, সাঁতার, ক্যারাম, ব্যডমিন্টনসহ অনেক ধরনের খেলা। এরপর যখন জামালপুর আশেক মাহমুদ সরকারি কলেজে ভর্তি হলাম, তখন জেলা স্টেডিয়ামে একটি কাঠি দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করি। প্রতিযোগিতায় আমার দল প্রথম হয়, কিন্তু এপ্রিল মাসের কড়া রোদে দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার পরের দিন থেকে আমার টাইফয়েড হয়। বেশ কিছু দিন অসুস্থ ছিলাম। তারপর সব ধরনের খেলাধূলা ছেড়ে দিলাম। তো আশেক মাহমুদ কলেজের ছাত্র-সংসদের তখন জিএস ছিলেন কবি বাকী বিল্লাহ। তিনি ছিলেন আমার অগ্রজ সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের বন্ধু। এসময় সংসদ থেকে বের হবে ‘ কলেজ বার্ষিকী’। বাকী তুখোড় একজন বক্তা, চেহারা সুদর্শন এবং সাদা ধবধবে পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে কলেজ ক্যাম্পাসে আসতেন, তখন খুব ব্যক্তিত্ববান মনে তাঁকে। এই মেধাবি ছাত্রনেতা হঠাৎ একদিন আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন ক্যাম্পাসের পুকুরপাড়ের পাশের একটি কৃষ্ণচূড়ার কাছে। বললেন. মনে করো—কিশোর কুমারের সেই গানটি—‘এই সেই কৃষ্ণচূড়া, যার তলায় দাঁড়িয়ে...’। ধরো—ই গাছের নিচে একটি প্রেমিক-জুটি বসে জীবনের রস পান করছে। এটিই তোমার প্লট—তুমি এই প্লট নিয়ে একটি গল্প লিখো আমাদের বার্ষিকীর জন্য। আমি মনে মনে থ মেরে গেলাম। এও কী সম্ভব? তবে মুখে বললাম, চেষ্টা করে দেখি। তিনি বললেন, তুমি পারবে, কারণ তোমার পরিবারে যেহেতু লেখক আছে, তুমিও পারবে নিশ্চিত। আমি দুরু দুরু বুকে হোস্টেলে ফিরে গেলাম এবং সন্ধ্যায় খাতা কলম নিয়ে বসলাম। বুঝতে পারছি না—কীভাবে শুরু করব? একটি প্রেমের রচনা হয়ে যাবে না তো? এক রকমের শুরু করে পরের দিন তাঁকে দেখালাম—তিনি উৎসাহ দিয়ে বললেন, হয়ে উঠবে তোমার গল্প। মনে আছে—প্রায় পনের দিনের প্রচেষ্টায় একটি অবয়ব দাঁড় করাতে পেরছিলাম, যেটি কাটাকুটি করে উপযুক্ত বানিয়ে বাকী ভাই ছেপেছিলেন তাঁদের বার্ষিকীতে। এই হল শুরু। বলে রাখি, সেই ছাত্র ইউনিয়ন করা কলেজের সিনিয়র দুই ভাই মেহেদী ইকবাল ও সাজ্জাদ আনসারী সবচেয়ে ভাল কবিতা লিখতেন। এর আগের প্রজন্ম ছিলেন মাহবুব বারী, আহমদ আজিজ, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, মীর আনিসুল হাসান, নজরুল ইসলাম বাবু, রুমি কবির প্রমুখ। যাঁদের অধিকাংশই তখন ঢাকায় চলে গেছেন এবং মূল সাহিত্য চর্চার সাথে যুক্ত হতে চেষ্টা করছেন। এদিকে রুমি কবিরের ছোট ভাই আমার ক্লাসমেট মুরশেদুল কবীর, কবিতা লিখত সাদী আশরাফী নামে—তার সঙ্গে আমার লেখালেখি নিয়ে সখ্য গড়ে উঠল। আমরা কবিতা নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। কলেজ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর কৃষি খামার, ব্রহ্মপুত্রের পাড়, পাবলিক লাইব্রেরিসহ বিভিন্ন জায়গায় আড্ডা ও চর্চায় নিবিষ্ট হলাম। লিখলাম—প্রথম কবিতা, যার প্রথম চারটি চরণ—‘এই শহরে এখন আমি সুখেই থাকি/ তোমার স্মৃতি মনের ভেতর লুকিয়ে রাখি/ বাইরে যখন গোলাপ ফুলে বৃষ্টি ঝরে/ তুমি তখন একলা থাকো অই নগরে’। কবিতার এই অভিযাত্রা এখনো থামেনি। তবে এটা ভূত না পেত্নি নাকি উত্তরাধিকার, নাকি ব্রহ্মপুত্রের কাছে আত্মসমর্পণ বলতে পারবো না।
আরিফুল ইসলাম: শুরুতে আপনার অনুপ্রেরণা কারা ছিলেন? এমন কি হয়েছে যে, আপনি অমুকের মতো লিখতে চান?
শিহাব শাহরিয়ার: অনুপ্রেরণা কেউ দেয়নি। তবে কেউ বাঁধাও দেয়নি। তবে অনুপ্রেরণা বললে, একমাত্র অগ্রজ কবি ও সাংবাদিক সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল। তিনি নানানভাবে উৎসাহ, সহযোগিতা দিয়েছেন। ঢাকায় লেখা প্রকাশের ক্ষেত্রে, বেতারে কবিতা পড়ার ক্ষেত্রে অতি মাত্রায় সহযোগিতা করেছেন। মনে আছে—১৯৮১ সালে বাংলাদেশ বেতারে তারুণ্য কণ্ঠে সরাসরি কবিতা পড়ার জন্য তিনি ব্যবস্থা করে ছিলেন। সেদিন ৫ জানুয়ারি ১৯৮১ সাল। আমি জামালপুর থেকে সকালে ট্রেনে এসে দুপুর সাড়ে তিনটায় শাহবাগে বেতার কেন্দ্রে ঢুকে দুটো কবিতা পড়ি। আসর পরিচালনায় ছিলেন কথাসাহিত্যি সেলিনা হোসেন, সেদিন তাঁর সঙ্গে প্রথম পরিচয়। কবিতা পড়ে পঁয়ত্রিশ টাকার একটি চেক পাই—যেটি বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়ে ভাঙিয়ে এলিফ্যান্ট রোডে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর একটি ফ্রেমে বাঁধানো পোর্টেট কিনে সন্ধ্যার ট্রেনেই আবার ফিরে যাই জামালপুর। বড়ভাই ঢাকায় আমার প্রথম কবিতা ছাপানোর ব্যবস্থা করেন সচিত্র বাংলাদেশে এবং এর কিছুদিন পর দৈনিক ইত্তেফাকে। আমি কারোর মত লিখিও না, লিখতে চাইও না। তবে লেখা শুরুর পরে আমার কাছে জীবনানন্দ দাশের কবিতা হয়ে উঠেছে---জীবন সঞ্জিবীনি। বাঁকে বাঁকে ফাঁকে ফাঁকে—তাঁর কবিতার প্রতিটি বাক্য, শব্দ, অক্ষর, উপমা আমাকে নিবিড় রাত্রির ঘুমের মত সুখ দেয়। এরপর ষাটের আবুল হাসান, সত্তরের সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, আশির শামস আল মমীন, নব্বইয়ের চঞ্চল আশরাফ, জুয়েল মুস্তাফিজের কবিতা আমাকে বেশ টানে আর পশ্চিমবঙ্গের শক্তি-সুনীল, জয় গোস্বামী আর প্রয়াত বন্ধু জয়দেব বসুর কবিতা। আসলে আমি আমার মতো করেই লিখি। কিছু সময় বাদ দিয়ে—গত চল্লিশ বছর তো কবিতা লিখছি, মনে করি আমার কবিতা আমারই হয়ে উঠেছে; আবারও বলছি—অন্য কারোর মতো নয়। বলতে পারি এটি আমার কবিতা, এমন কি আমার পাঠকরাও। যদিও আমি নীরবে লিখি, আমি প্রচারমুখী নই। কবিতার প্রচারে আমি বিশ্বাসীও নই।
আরিফুল ইসলাম: কবিতার সাথে আপনার প্রেম ও উন্মাদনার দিনগুলো সম্পর্কে বলুন।
শিহাব শাহরিয়ার: নারী-পুরুষ, যারা প্রেম করে, তারাই জানে প্রেমে কতটা সুখ, কতটা আগুন? আর উন্মাদনা মানে কী? মানে হলো উত্তেজনা বা চিত্তের বিক্ষোভ। সুতরাং প্রেম ও উত্তেজনা আমাকে দিয়ে কবিতা লিখিয়ে নেয়নি। যা লিখেছি, বা লিখছি স্বতঃস্ফূর্তভাবে। কোন চাপ নিয়ে নয়। তবে প্রথম দিকে এক ধরনের আবেগ ছিল, ছিল এক ধরনের শংকাও—কারণ কবিতা হচ্ছে কিনা? কতদিন টিকে থাকবো? কবিতা লিখে ভবিষ্যত কী? আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশি ও পরিচিত জনের কীভাবে নেবে—এরকম শংকা? যাক ধীরে ধীরে এই শংকা কেটে গেছে। শংকার কথা কেন বললাম, পড়াশোনা শেষ করেছি বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে। সেখানেও কোনো কোনো নিকট আত্মীয় নাক ছিটকিয়ে বলেছেন—ও বাংলায় পড়ে? কবিতা লিখে? গেছে...? আমি কিন্তু যায়নি। আসলে আমার জীবন ও লেখালেখি আমার মতো করে নিয়েছি—তাতে বিরোধ বা দ্ব›দ্ব তৈরি হয়নি। অজপাড়া গাঁ থেকে মফস্বল, সেখান থেকে জেলা শহর, তারপর রাজধানী—এই কষ্ট ভ্রমণে একদিকে যেমন নিষ্ঠা ছিল, তেমনি একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হেড মাস্টারের ছেলে—অর্থ ও বিত্তের পিছনে না গিয়ে, কবিতার পিছনেই ছুটে চলেছি। তবে উন্মাদনা আছে—যেমন দুটি কাব্যগ্রন্থের কথা বলতে পারি, একটানা প্রায় এক শ’টি কবিতা লিখেছি, ঘোরের মধ্যে—সেটিকে উন্মাদনা বলা যেতেই পারে আর প্রেম—প্রেম তো বটেই, না হলে এতো বছর কবিতার সাথে থাকা যায়?
আরিফুল ইসলাম: তারপর আসতে চাই ব্লগ, ওয়েবজিন ইত্যাদি প্রসঙ্গে। মুক্তবুদ্ধি চর্চার এক অবারিত দিগন্ত আমাদের সামনে খুলে দিয়েছে ইন্টারনেট প্রযুক্তি। বলা হচ্ছে, মুদ্রিত বইয়ের চ্যালেঞ্জার হয়ে উঠেছে এই বৈদ্যুতিন মাধ্যমটি। আপনার কী অভিমত?
শিহাব শাহরিয়ার: প্রিন্টের মজাই আলাদা। তবে প্রযুক্তিকে অস্বীকার করারও উপায় নেই। তথ্য দুনিয়ার এই চরম অবস্থায় প্রযুক্তিকে মেনে নিয়েই বলছি, এখন লেখালেখি করা এবং তা প্রকাশ করার এক স্বাধীন প্লাটফর্ম, যেমন—ব্লগ, ওয়েব, ফেসবুক, টুইটার, এসব বিভিন্ন মাধ্যমে লিখে সহজেই পরিচিত হওয়া যায়, যা আমার কাছে ওয়ানটাইম মনে হয়। আর লেখা বিশেষ করে—সাহিত্য বিষয়ক লেখা সম্পাদনা হয়ে প্রকাশিত হওয়াই ভাল। এসব ভার্চুয়াল লেখায় তো কোনো সম্পাদনা নেই, যে যার মত করে আপলোড করছে, তাই লেখার মান নিয়ে আমার প্রশ্ন আছে।
আরিফুল ইসলাম: আপনার সংসার জীবন সম্পর্কে বলুন। বিয়ে, স্ত্রী, সন্তানের কথা বলুন। কবি-সাহিত্যিকরা সংসার-ধর্মে উদাসীন। আপনার সম্পর্কে এই অভিযোগ কি খাটে?
শিহাব শাহরিয়ার: বিয়ে করেছি ৩৩ বছর বয়সে, একটা মেয়েকেই দেখেছি ঘটকের মাধ্যমে এবং তাকেই বিয়ে করেছি। অনেকেই গাবলির গরুর মতো অনেক মেয়ে দেখে। আমি সেখান থেকে সরে এসে, প্রথমে বন্ধুকে নিয়ে দেখেছি, তারপর পারিবারিকভাবে বিয়ের কাজ শেষ করেছি। বলে রাখি তখন আমি ছিলাম বলা যায় কর্মহীন। বিশ শতকের শেষ বছর বিয়ে করেছি। একুশ শতকের প্রথম বছর প্রথম পুত্র জন্মগ্রহণ করে—ওর নাম প্রাচুর্য শাহরিয়ার। দ্বিতীয় পুত্র সমৃদ্ধ শাহরিয়ার। একইসঙ্গে সংসার ও সৃষ্টি দুটোই—চালছে। চলছে বলতে চালাচ্ছি। আসলে দুটো এক সঙ্গে করা দুরূহ। কারণ সৃজনশীল মানুষদেরকে একটা ধ্যানের মধ্যে থাকতে হয়, যেটি সাধনাও বটে। কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেছেন, ¯ স্রষ্টার পরে কবিরা সবচেয়ে স্বাধীন-সত্তা। এরকম মনে করলে, সংসার আর সৃজন বিপরীত মুখী, দ্বাদ্বিক। সুতরাং দ্বদ্বকে কাঁধে নিয়েই হাঁটছি। কারণ সিদ্ধান্তটা শুরু থেকেই ছিল না—থাকলে সংসার বৈরাগী হওয়া যেত অথবা সৃজন-পাগল। মধ্য বয়সে আর কী সিদ্ধান্ত নেবো।
আরিফুল ইসলাম: একজন বন্ধু এবং শত্রুর নাম বলুন, নির্বাসনে গেলেও যাদের আপনি সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইবেন।
শিহাব শাহরিয়ার: বন্ধু—বঙ্গবন্ধু, জীবনানন্দ ও রবীন্দ্রনাথ—একজনের আদর্শ ও চেতনা, একজনের কবিতা ও একজনের গান, পৃথিবীর যেখানেই থাকি; সঙ্গে রাখতে চাই। শত্রু? শত্রু হলো আমার কবিতা। নিজের কবিতা বার বার পড়তে ভাল লাগে। কখনো মনে হয়—এসব কী আমি লিখেছি? কিম্বা কীভাবে লিখলাম?
আরিফুল ইসলাম: ঠিক কত বছর বয়সে আপনার প্রথম বই প্রকাশিত হয় ? আপনার কি মনে হয় যে সে সময় থেকে এখন পর্যন্ত আপনার কাব্যচর্চা ধাপে ধাপে এগিয়েছে ক্রমশঃ?
শিহাব শাহরিয়ার: কবিতা লেখার পাশাপাশি আমি ফোকলোর বিষয়ে গবেষণা করি। আমার প্রথম বই গবেষণাগ্রন্থ। নাম ‘বাংলাদেশের পুতুলনাচ’। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ সালে বাংলা একাডেমি থেকে। কিন্তু আমার প্রথম কবিতার বই বের হওয়ার কথা ছিল তার এক বছর আগে অর্থাৎ ১৯৯৬ সালে, যখন আমার বয়স ৩১ বছর। গ্রন্থের নাম ছিল ‘হাওয়ায় রাত ভাসে ভাসে নিদ্রা’। কিন্তু বইটি প্রকাশ হয়নি কবি ফরিদ কবির’র কারণে, কারণ সে সময় আমরা একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করি। আমি একদিন এই গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি অফিসে বসে দেখছিলাম, এমন ফরিদ কবির আমার টেবিলে এসে বললেন, ওটা কী দেখছো? ঊললাম, আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি। তিনি বললেন, দেখি দেখি, বলে পাণ্ডুলিপি হাতে নিয়ে—আবার বললেন, আমি দেখি—কী লিখেছি? পরে তিনি পাণ্ডুলিপি নিয়ে গেলেন। এক মাস পরে পাণ্ডুলিপিটি ফেরৎ দিয়ে বললেন, এতো তাড়াতাড়ি তোমার বই বের করা ঠিক হবে না, আরো পরে করো। আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম, কিছু বললাম না, কারণ তিনি আমার বস! এরপর সাত বছর কবিতা লিখিনি, লিখিনি আরো একটি কারণে, কবি সাজ্জাদ শরিফ প্রথম আলোর সাহিত্য সম্পাদক—তিনিও আমার কবিতা প্রথম আলোতে ছাপেন না। অবশেষে—২০০৩ সালে এই পাণ্ডুলিপিটি প্রকাশিত হয়, যখন আমার বয়স ৩৮ বছর। আমার বয়স বাড়ার সাথে সাথে, আমার অভিজ্ঞতাও বেড়েছে বলে মনে করি। পাশাপাশি গ্রাম, মফস্বল, জেলা শহর, তারপর রাজধানী এবং বিশ্বের অনেক উন্নত শহরে যেমন আমি গেছি, তেমনি আমার কবিতার লেখার জার্নিটাও। প্রথম কাব্যগ্রন্থের কবিতার পাশে সর্বশেষ প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের কবিতা রাখলে নিশ্চয়ই একটা পানিশ্চয়ই একটা পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যাবে। যেমন পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায়—জীবনানন্দ দাশের প্রথম কাব্যগ্রন্থ—ঝরা পালক থেকে সবশেষ কাব্যগ্রন্থ সাতটি তারার তিমির-এ। সুতরাং পরিবর্তন আবশ্যিক।
আরিফুল ইসলাম: আমার কাছে আপনার কাব্যের ইমেজগুলোকে ভীষণ বিস্ময়কর মনে হয়। আপনার কবিতার ইমেজগুলোয় কিভাবে পৌঁছান?
শিহাব শাহরিয়ার: ইমেজ বলতে কী বুঝাচ্ছো জানি না—তবে আমি এক এক কবিতায় এমন একটি উপমাশ্রিত বাক্য দেয়ার চেষ্টা করেছি, যা কবিতাটিকে অলংকৃত করে। আমি মনে করি, আমি আমার সব কবিতাতেই এই ঐতিহ্য ও অহংকার প্রতিষ্ঠিত করেছি, যা একদিকে আমার কবিতাকে অন্যেও কবিতা থেকে আলাদা করেছে এবং নতুন কিছু দিতে চেষ্টা করেছি। এই নতুনটাই পাঠকের চোখ ও মনকে নাড়ায়—বিশেষ করে আমার কবিতা যারা নিবিষ্ট-চিত্তে পড়েছেন। তবে এটি খুবই সত্য যে, তোমার ইমেজই বলো আর আমার উপমাই বলি, এগুলো আমি পেয়েছি এবং পাচ্ছি আমার প্রতিদিনের দেখা থেকে। যেমন জীবনানন্দ বলেন, পাখির নীড়ের মতো চোখ তোলে নাটোরের বনলতা সেন।
আরিফুল ইসলাম: আপনার কি নিজস্ব পরিবেশ, দশা বা মনের বিশেষ কোন অবস্থা, যখন আপনার মাঝে কবিতা আসে?
শিহাব শাহরিয়ার: তাঁর গবেষকের কাছে শুনেছি যে, জীবনানন্দ দাশ সন্ধ্যাবেলায় যখন ঘরে প্রচণ্ড পারিবারিক কলহ চলছিল, তখন ঘরের এক কোনে বসে লিখছিলেন—বনলতা সেন কবিতাটি। যদি তাই-ই হয়; তবে কবিতা লেখার জন্য আলাদা পরিবেশ তৈরি করার কোনো প্রয়োজন নেই। তবে হ্যাঁ, নিশ্চয়ই একটু শান্ত ও তুলনামূলক নির্জনতা প্রয়োজন। আমি সকালের নির্জন সময়টাই কবিতা লেখার জন্য বেশি উপযুক্ত মনে করি। আর কবিতা বলে কয়ে আসে না। যেমন বাতাস।
আরিফুল ইসলাম: আমি আপনাকে গদ্যরীতির পদ্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে চাইছিলাম। আমার নিজের গদ্য কবিতার উপর বিশেষ আগ্রহ আছে। আমি নিজে লিখিও। কিন্তু মানুষজন মনে করে গদ্য কবিতা কেমন থলথলে, ঢিলেঢালা। আসলে আমি তাঁদের বক্তব্য তেমন কোন ধর্তব্যের মধ্যে আনিও না। আমি এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য জানতে চাইছিলাম। এই গদ্য আপনাকে ঠিক কী দেয় যেটা আপনি কবিতা লিখতে গিয়ে পান না?
শিহাব শাহরিয়ার: শোনো, গদ্য কবিতা খুব শক্তিশালী। পদ্য ফর্মেটে যা বলা যায় না, গদ্যে তা বলা যায়। আমার ‘ফড়িঙের পাখা পোড়ে’—দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থের ৩৬টি কবিতাই গদ্যকবিতা। এবং আমি মনে করি, এই গদ্য কবিতায় আমি পাইওনিয়রদের একজন। গদ্য কবিতায় নানান ধরনের কাজ করেছি আমি। এখানে আমার প্রথম গদ্য কবিতাটি পাঠকের জন্য তুলে ধরছি:
পেছনে কৈশোরের স্মৃতিময় রেলস্টেশন আর শৈশবের প্রিয় ব্রহ্মপুত্রের শীর্ণ বুক
পেরিয়ে শীতস্নিগ্ধ এক রাতে পূর্ণিমার জলে গা ধুয়ে ধুয়ে হাঁটছি একা নিজ গৃহের
দিকে। শিশিরাক্রান্ত সরিষাক্ষেত আর শাখা নদীর কুয়াশা ভেজা বালুময়
জ্যোৎস্নামাখা পথে হাঁটছি শুধু একা...কুমারীর সতীত্বের মতো পূর্ণিমার পবিত্র
তীব্র-তীক্ষ্ণ-স্বচ্ছ-ঘন আলোয় হাঁটছি একা...হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে ভুলে
গেছি পথের দূরত্ব, ভুলে গেছি হ্যারিকেনের স্মন আলোয় ক্লান্ত চোখে জেগে থাকা
জনক-জননীর কথা...নিঃশব্দ পথে হাঁটছি একা...জ্যোৎস্নার গভীর বিপন্ন আলোয়
ভাসছে প্রান্তর, ঘুমন্ত গ্রাম, স্কুলঘর...আমিই শুধু একা বাড়ি ফিরছি...পূর্ণিমার
অবসন্ন আলোয় হেঁটে হেঁটে...
এই কবিতাটির প্রশংসা করেছেন কবি আল মাহমুদ, কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক থেকে অসংখ্য কবি ও পাঠক। পরবর্তীতে আমার আরো দুটি গদ্যকবিতার কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এখানে পড়ে থাকে অহংকার কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতা তুলে দিচ্ছি:
যে অভিমানে ইট-ভাটার ধুয়ারা উড়ে গেছে; আমিও একই অভিমানে উড়ছি কারোর
কারোর মনোঘরে। কচি বাঁশের মতো দুলছি তাহাদের হাতের বাতাসে। পশ্চিমের
মেঘগুলো কালো করে আমাদের অদৃশ্য উঠোনে নেমে এলে; আমি বকের লম্বা ঠোঁট
থেকে সরিয়ে নিই পুঁটিদের গায়ের লাল পেড়ে শাড়ি আর চেয়ে চেয়ে দেখি তোমার
শাড়ির পাড়জুড়ে বসেছে বৈশাখী মেলা। মেলা, পুঁটি আর নদীজল কাঁসার থালার
মতো বেজে ওঠে আমাদের অহংকারে। তোমার অহংকারগুলো তবে জমা রাখো
বালকের বুক পকেটে, যে পকেট সারারাত সাঁতার কাটে নিদ্রাস্রাতে।
পদ্য ফর্মেটে এভাবে বলা যেত কী?
আরিফুল ইসলাম: কাব্য এবং গদ্য এই দুইয়ের অনুভূতি প্রকাশের মধ্যে কী ধরনের ভিন্নতা আছে?
শিহাব শাহরিয়ার: এটি যদি কবিতার ক্ষেত্রে হয়, সেখানে—ঢং-এ পার্থক্য আছে, অনুভূতি প্রকাশে কোনো ভিন্নতা নেই। আর যদি স্রেফ গদ্য ও কবিতা হয়, তাহলে তো অবশ্যই ভিন্নতা রয়েছে। কারণ দুটি দুই মাধ্যম—একটিতে দরাজ গলায় রেয়াজ করা যায়, আরেকটিতে মৃদু রঙে প্রজাপতি ওড়ে।
আরিফুল : আমি মনে করি ক্ষেত্র বিশেষে কাব্য রচনা চ্যালেঞ্জ? আপনার কি এমনটি মনে হয় বা এ বিষয়ে আপনার মতামত কি ?
শিহাব শাহরিয়ার: এই প্রশ্নটিই। আমি মনে করি না, কবিতা লেখার কোনো বিশেষ চ্যালেঞ্জ আছে। কারণ কবিতা কখনো বন্যার জলের প্রবল স্রোতের মতো, আবার কখনো হেমন্তের রোদের মতো—রোদ ধীরে ধীরে নামে গঞ্জ থেকে শহরের দিকে। কবিতা লিখতে গিয়ে কোনো চাপ নেয়া ঠিক না।
আরিফুল ইসলাম: শিল্পের মধ্যে জীবন থাকে, জীবনের অভিজ্ঞতা থাকে—আপনার কী রকম? কোনো কোনো কবিতায় আপনার টুকরো জীবন উপস্থিত নয় কি?
শিহাব শাহরিয়ার: আমি আগেই বলেছি, অভিজ্ঞতা একজন কবি বা লেখকের প্রধান শর্তের একটি। একজন কবির অবশ্যই থাকতে হবে ভাষাজ্ঞান, পাঠ এবং অভিজ্ঞতা। জীবনের পরতে পরতে যে অভিজ্ঞতা তিনি অর্জন করবেন, তার লেখাকে সমৃদ্ধ করবে। প্রত্যেক লেখকের লেখাতেই তার জীবন থাকে। কবিতাতে তো থাকেই, কথা শিল্পেও থাকে। দেখবে প্রত্যেক ঔপন্যাসিকের প্রথম উপন্যাসটি মূলত আত্মজৈবনিক হয়। আমার অস্বীকার করার উপায় নেই, যে আমার কবিতায় আমার জীবনের অভিজ্ঞতা নেই। কারণ তোমার প্রথম প্রশ্নেই আমি একথা বলে দিয়েছি। আমি মনে করি, যে লেখকের নিজের জীবন যতটা বেশি, সেই লেখা ততটা শক্তিশালি। যেমন ধরো, আমার কবিতা থেকে আমি ব্রহ্মপুত্রকে ফেলে দিতে পারি না, যেমন মাইকেল পারেনি কপোতাক্ষকে, জীবনানন্দ পারেনি কীর্তিনাশাকে ভুলে যায়নি। যেমন আমার কবিতায় সরিষার হলুদ, সরিষার পাতা, সরিষার দানা কেন আসে? উত্তরের কোনো প্রয়োজন নেই।
আরিফুল ইসলাম: আপনার কবিতায় গত তিরিশ বছরে কি কোনো সচেতন পরিবর্তন এনেছেন আঙ্গিকে বা ভাষায়? আনলে সে বিষয়ে কিছু বলুন।
শিহাব শাহরিয়ার: ধারাবাহিক প্রকাশিত আমার কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো পড়লেই এই প্রশ্নের উত্তর পাবে। তবে সম্প্রতি কলকাতা থেকে প্রকাশিত আমার ‘ কবিতা সংগ্রহ’ নিয়ে এক আলোচনায় সেখানকার সাহিত্যজন তিতাস চট্টোপাধ্যায় বলেছেন—‘ এই যন্ত্র-পৃথিবীর মাঝের গলিতে হাঁসফাঁস করতে থাকা সময়কে আর কীভাবে দেখব আমরা? এই সবের মধ্য দিয়েও ভাদ্রের রোদ এসে পড়ে। সমাসোক্তি খুঁজে নেন কবি, তাঁর বৃষ্টিরও আছে হয়তো তৃষ্ণার্ত একটি ঠোঁট। কবিতার শব্দের ভিতরে কখনও বোধি এসে দাঁড়ায়। কবি যেন তখন শ্রোতা হয়ে সেই বোধির কাছে। দীক্ষা নেন। একের পর এক প্রশ্ন এসে ভিড় করে, “ শব্দেরাই কি শব্দের শত্রু? সতীন?” পড়তে পড়তে থামি ‘অদৃশ্যগুচ্ছ’-র কাছে। আদি যুগের চর্যায় কিশোরী আর মধ্য যুগের ফুল্লরা সই পেতেছে এক কবিতায়, “ চর্যার বালিকার নাকফুল ঝুলে থাকে মধ্যরাতের টেবিলে ..... এরপর ফুল্লরার ঘুম”। প্যাটার্ন নিয়ে খেলতে ভালবাসেন শিহাব শায়রিয়ার। তাঁর এই কবিতা সংগ্রহ-র শেষ দু’টি কবিতা ‘গোধূলির রঙ উড়ে যায়’ আর ‘ দূরে ওড়ে শঙ্খচিল’ আসলে কবিতার আঙ্গিকে অণু-চিত্রনাট্য। সংলাপের প্রান্ত ছুঁয়ে জমা হওয়া শব্দদের একান্ত মনে হয়’।
আরিফুল ইসলাম: আজকাল প্রায়ই শুনি যে বক্তব্য, ছন্দ, যুক্তি বিন্যাস কিংবা নিটোল বাক প্রতিমা—কবিতায় এসবের দিন গেছে। এ বিষয়ে আপনার মত কী?
শিহাব শাহরিয়ার: সময়ের সাথে বদলে গেছে মানুষের রং-রূপ। এখন কী ভাল লাগবে ঐ দেখা যায় তাল গাছ, ঐ আমাদের গাঁ? আবার এমন নতুন প্রজন্ম আছেন যারা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পার করে দেন ২০ ঘণ্টা, যারা এখন বই পড়া ছেড়েই দিয়েছেন, কবিতা পড়া তো দূরের কথা; তারা কখনো কখনো বলেন, আগের কবিতাই ভাল ছিল। এটি কী অবরোধ্য সময়ের প্রলাপ, নাকি নাক ছিটকানো কে জানে? তবে কিছুটা তো সত্যি, যে একুশ শতকের শুরুতে যারা লিখতে এসে এখনো লিখে যাচ্ছেন, তাদের ক্ষেত্রে সত্য। এরা অনেকেই ছন্দ পড়েননি, বা বোঝেন না, কিম্বা পড়তে বা বুঝতে চান না। কবিতার মায়াবি জাল তারা অনেকেই বুনতে পারছেন না, কেউ কেউ খামোখা দুর্বোদ্ধ করে তুলেন। নিটল বা প্রতিমাকেই আমি মায়াবি জাল উল্লেখ করলাম। একটি কবিতার যে প্রাণ থাকে, অনেকের কবিতায় তা নিষ্প্রভ। আমি মনে করি, কবিতাকে কবিতা করে তোলাই প্রয়োজন। আরেকটি বিষয় এখন যারা লিখছেন, মনে হয় তাদের জীবন-অভিজ্ঞতা কম। অভিজ্ঞতাকে ফুটিয়ে তুলে, জীবনকে মেলে ধরাই কবিতা।
আরিফুল ইসলাম: এখন যে নতুন ধরনের কবিতা লেখা হচ্ছে, প্রথা ভেঙে নতুন হয়ে ওঠার যে মরিয়া চেষ্টা চারপাশে, সে সম্বন্ধে আপনার অভিমত কী?
শিহাব শাহরিয়ার: আগের উত্তরেই এ বিষয়ে বলা হয়ে গেছে। তারপরও বলে, প্রথাকে ভাঙতে হলে, প্রথমে প্রথাকে বুঝতে হবে, মানতে হবে। নতুনকে নির্মাণ নতুনরাই করবে এবং নতুনদের কাছে আশাও বেশি। সুতরাং প্রথম আলোর মতো বদলে দিবো, বললেই কী সব কিছু বদলে দেয়া যায়? মাইকেল পয়ার ছন্দের সীমানা ভেঙে দিয়ে মুক্তক ছন্দ জোয়ারে বাংলা কবিতা নতুন মাত্রায় আনলেন, সেরকম ক্ষমতা তো থাকতে হবে।
আরিফুল ইসলাম: আপনি কি কখনও ফরমায়েশি লেখা লিখেছেন ? বলতে চাইছি, কোন কারণে কি লিখতে হয়েছে ? ফরমায়েশি লেখা সম্পর্কে কিছু বলুন ।
শিহাব শাহরিয়ার: মা’কে চাচি যেমন যেমন ন্যাক্কার জনক, তেমনি ফরমায়েশি লেখাও। আমি খুব বিরক্ত বোধ করি। দেখবে আমি আমার মতো কবিতা লিখি। ফরমায়েশি লেখা জাতের হয় না।
আরিফুল ইসলাম: পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের লেখকদের লেখা তো আপনি পড়েন। কার লেখা ভালো লাগে?
শিহাব শাহরিয়ার: বলেছি আগে, তবু বলি, কবিতায় শক্তি-সুনীল-জয়-মৃদুল-সুবোধ এবং কাজল চক্রবর্তীর কিছু কিছু কবিতা। আর কথাসাহিত্যে আবুল বাশার। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘ফুলবউ’ পড়ে চমকে গিয়ে ছিলাম।
আরিফুল ইসলাম: বিদেশি লেখকদের মধ্যে কার প্রভাব আপনার লেখায় আছে বা কোন লেখককে আপনার ভালো লাগে?
শিহাব শাহরিয়ার: লাতিনের বিশ্বনন্দিত কবি পাবলো নেরোদা, টি এস এলিয়েট, শামসুর রাহমানের অনূদিত রবার্ট ফ্রস্ট, বদলেয়ার কিছু কবিতা আমাকে টানে ও নাড়ায়। আর ইদানীং ইন্টারনেটের সুবাদে আরবি, আইরিস, রাশিয়া, চীন, জাপানসহ বিভিন্ন ভাষার কবিদের কিছু কিছু কবিতা পড়ছি। তাদের সাথে আমার বাংরা কবিতার বেশ ব্যবধান। যেমন কবি শামস আল মমীনের অনুবাদকৃত ‘ সাম্প্রতিক আমেরিকান কবিতা’ গ্রন্থের ২৫ জন মার্কিন কবির কবিতাগুলো পড়েও মনে হয়েছে, আমাদের সঙ্গে পার্থক্য আছে। তবে বাংলা কবিরাও ভাল কবিতা লিখছেন। আর পশ্চিমবঙ্গের শক্তি-সুনীল-জয় এর কবিতা আমার ভাল লাগে। আসলে ভাল লাগার সীমানা নেই। এই যে বললাম, জয় গোস্বামীর কথা, তার সব কবিতাই আমার ভাল লাগে? না। এমন অসংখ্য কবি আছে—যাদের একটি কবিতা পড়ে আমি পুলকিত হয়েছি, আনন্দ অর্জন করেছি, সেজন্য কারোর কারো নাম বললে, বাকিরা কষ্ট পান। কারণ তারাও দীর্ঘ দিন লিখছেন, তাদের সঙ্গেও ব্যক্তিগত অনেক গভীর সম্পর্ক রয়েছে। যদি আমাদের এখানে নব্বইয়ের চঞ্চল আশরাফের কবিতা আমার ভাল লাগে—এতে নব্বইয়ের বাকি কবি বন্ধুরা মনক্ষুণ্ন হবেন। আসলে সত্য কথাও অনেক সময় বলা যায় না। তবে আমি নিদ্বির্ধায় স্বীকার করছি—আমি বিদেশি কবিদের কবিতা তেমন পড়তে পারিনি।
আরিফুল ইসলাম: সমকালীন বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে আপনার কী মত?
শিহাব শাহরিয়ার: সমকালীন সাহিত্যের পরিধি অত্যন্ত বিস্তৃত—সমকাল রবীন্দ্রনাথ থেকেও হতে পারে? তবে বাংলাদেশের সাহিত্য, যেটি চল্লিশের মাঝামাঝি থেকে অর্থাৎ দেশ বিভাগোত্তর কালে ঢাকা কেন্দ্রিক যে সাহিত্য-চর্চা শুরু হলো, সেটি মূলত প্রবল আকারে যাত্রা শুরু করল—পঞ্চাশের দশকে, মহান ভাষা আন্দোলনের ফসল হিসেবে। এই সময়ে এক ঝাঁক কবি ও লেখকদের আগমন ঘটল বাংলাদেশের সাহিত্যে। যদি কবিতার কথা বলি, তাহলে শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, সৈয়দ শামসুল হক প্রমুখরা শক্তিশালী কলমের আঁচড়ে কবিতার পথযাত্রায় অগ্রণী ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। সমাজ, রাজনীতি, শোষণ, স্বৈরচার, বৈষম্য, বিভেদসহ এবং একইসঙ্গে প্রেম-প্রকৃতিকে বিষয় হিসেবে নিয়ে, তারা অনেকেই নিজস্ব কাব্যভাষা তৈরি করে সমকালীন বাংলাদেশের সাহিত্যকে উর্বর করে তুললেন। পরবর্তী ধারাবাহিক স্নোতের কথা আমরা সবাই জানি। ষাটের দশকে যারা কবিতা নিয়ে হাজির হলেন, তারাও স্ফূরণ ঘটালেন। এরপর ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধোত্তর একটি প্রজন্ম এলো—যারা সত্তরের দশকের প্রজন্ম, এদের লেখায় সমকাল প্রতিফলিত হয়েছে, পরের আশির কবিরা দীর্ঘ নয় মাস বাংলাদেশি স্বৈরচারের কোপানলে থাকলেও অনেকেই নিজস্ব স্টাইলে কবিতা থেকেছেন। নব্বইয়ের দশকে আরো এক ঝাঁক তরুণ—লিখতে এলেন কবিতা আরেকটু উর্বর করতে। এরা অনেকেই ভাল লিখেছেন ও লিখছেন। এরপর একটি শতক পার হলো—এলো শূন্য দশক বা প্রথম দশক। এখানে কয়েকজন কবিকে বেশ প্রখর মনে হলো। পরের দশকটি দ্বিতীয় দশক। যারা এখন লিখছেন এবং এখনো লিখছেন পূর্বের দশকের কবিরাও। এখানে তোমাকে বলে রাখি—যদি প্রতিষ্ঠিত কোনো দৈনিকের সপ্তাহের সাহিত্যের পাতাটি দেখো এবং সবগুলো কবিতা পড়ো, তাহলেই বুঝতে পারবো—পূর্বের দশকসমূহের কবিতা ও বর্তমানদের কবিতার পার্থক্য। সেটি বিষয়ে, আঙ্গিকে, ছন্দে, উপমায়, দুর্বোদ্ধতায় ও চেহারায়। তবে নতুনদের কবিতায় রস কম বলে আমার মনে হয়, একটু কর্কশ, একটু ছন্দোহীন, একটু এলোমেলো, একটু উদাসীনতা—এটি সবার ক্ষেত্রে নয়। পাশাপাশি এটিও সত্য আগের অনেক কবির কবিতা মরে গেছে। তাঁদের কবিতায় যে জল-তরঙ্গ ছিল, তাতে এখন নদীচরার শুকনো বালির মতো হয়ে গেছে। আমার কাছে, কারোর কারোর একটি শব্দও ভাল লাগে না। ঘন কবিতা লেখার কবি কমে যাচ্ছে। তরল কবিতা গরল, একটু পরেই ঠাণ্ডা হয়ে যায়। আমরা যেখানে শামসুর রাহমানের রুপালি স্মান থেকে শুরু করে অসংখ্য কবিতা মনে রাখতে পারি, মনে রাখতে পারি আবুল হাসান, সিকদার আমিনুল হক, নির্মলেন্দু গুণ, আবিদ আজাদেও ঘাসের ঘটনা, রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ বাতাসে লাশের গন্ধ, সেখানে গত চার দশকের কোনো কবির কবিতা কী আমরা মনে আনতে পারি। হয়ত বলতে পারো—এখন আপনি ক’টা কবিতা পড়েন? উত্তর একটাই—এখন কবিতা কেন যেন আমাকে টানে না, কেবল আমার কবিতা ছাড়া! তবে আমি হতাশ নই, আমার অগোচেরেই হয় বেশ কিছু কবিতা লেখা হচ্ছে, যা সমকালকে সমৃদ্ধ করবে।
আরিফুল ইসলাম: প্রবাসী বাঙালিদের কী করা উচিত, যাতে বাংলা সাহিত্যের প্রচার ও সমৃদ্ধি ঘটে?
শিহাব শাহরিয়ার: প্রবাসী বাঙালিরা এক অর্থে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে অনেকটা দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। যেমন—বিলেতে মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ থেকে বর্তমান অবধি ভাষা সাহিত্যের একটা প্ররল স্রোত তৈরি হয়েছে। ডাসপোড়া সাহিত্যেরও প্রভাব প্রবহমান। গত কয়েক যুগ ধরে বিলেতের পাশাপাশি নিউইয়র্কসহ সারা বিশে^র যে সব দেশে বাঙালিরা রয়েছে, তারাই বাংলার অগ্রযাত্রায় কাজ করছে। সেটি সর্বপূর্বের দেশ জাপান থেকে পশ্চিমে কানাডা পর্যন্ত। আমাদের অনেক প্রতিষ্ঠিত লেখক এখন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বসবাস করছে। একটা সুবিধা এখন তথ্য-প্রযুক্তির কারণে হয়েছে—তা হলো কোন দেশে বাংলা চর্চার কী হচ্ছে, আমরা সহজেই জেনে যাচ্ছি। তুমি তো জানো—বাংলা ভাষা এখন বিশে^র ষষ্ঠতম ভাষা, শুধু তাই নয়, বাংলা এখন পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রুতিমধুর ভাষা। কানাডা এবং আমেরিকা প্রবাসী সালাম ও রফিক নামে দুই কীর্তিমান বাঙালি ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে দাবী করেছিলেন, যা পরে অর্থাৎ ১৯৯৯ সালে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব পাঠান এবং তা ইউনেস্কো ঐ দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। দেখবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বড় বড় শহরগুলোতে গড়ে উঠেছে এবং উঠছে শহীদ মিনার। বাঙালিরা প্রবাসে বাংলা বইমেলা করছে। সাহিত্যানুষ্ঠান করছে। তবে এক্ষেত্রে নতুন প্রজন্মের বাঙালি প্রবাসী প্রজন্মকে চর্চার কাঠিটিকে এগিয়ে নিতে হবে। এবং বাংলা কবিতা ও কথাসাহিত্যের অনুবাদ বাড়াতে হবে, যা আনারি অনুবাদ নয়। সত্যিকার অনুবাদ। রবীন্দ্রনাথের আর কোনো বাঙালি লেখক কেন নোবেল পাচ্ছেন না—সেটিও এখানে প্রশ্ন আকারে আসে। অথচ অনেক বড় মাপের লেখক কিন্তু বাংলা সাহিত্যে ছিল এবং আছে। সঠিক অনুবাদ হচ্ছে না বলে, এই আতুরঘরেই আমরা পড়ে আছি। যে তরুণ প্রজন্মেও কথা একটু আগে বললাম, তাদেরকে এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে। সাহিত্যের সমৃদ্ধির কথা চিন্তা করলে, এ বিষয়ে গভীর মনযোগ দিতে হবে। বিকল্প নেই। মনে রাখতে হবে, এখন গ্লোবাল পৃথিবী, তাই যত আগে নজর দেয়া যাবে, তত সুফল।
সাহিত্যবার্তা’কে সময় দেবার আপনাকে অনেক ধন্যবাদ । ভালো থাকবেন।