সময়ের গতি প্রবাহের সাথে প্রতিটি মানুষের জীবন প্রবাহ, একই সাথে মানুষের স্নায়ু কোষের নিবিড় অঞ্চলে সৃষ্ট মূল-রূপ ধারণ করে বহিরাঞ্চলে প্রকাশিত সকল ঘটনা, সেই সঙ্গে দুর্ঘটনাও সময়ের সেই নির্ধারিত তীব্র বেগে প্রতি মুহূর্তে সচলমান গতি প্রবাহের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পৃক্ত। আর এই ঘটনা সংঘটন প্রতিটি মানুষের জীবনেই অনিবার্য। এবং এই অনিবার্যতা থেকে গোটা বিশ্ব-চরাচরে বসবাসরত সকল প্রকারের প্রাণীকুলও বিচ্ছিন্ন নয়। মোটা দাগে বললে বলতে হয়- মনুষ্য তথা প্রাণীকুলের কারুরই এই সময়ের বিধিবদ্ধ নিয়মতান্ত্রিকতার গ্রন্থিভুক্ত কঠোর শৃঙ্খলার আনুগত্যের বাইরে বেরিয়ে আসবার বিকল্প কেনো পথ খোলা নেই এবং কখনোই খোলা থাকে না।
প্রতিটি মানুষের জীবনেই কিছু না কিছু ঘটনা থাকবেই। হতে পারে সে ঘটনাগুলি ইতিবাচক অথবা নেতিবাচক। আমাদেরকে অবশ্যই মেনে নিতে হবে যে, সূর্যের অতি তীক্ষ রশ্মি যখন একটি স্বচ্ছ কাচের ওপর পতিত হয় তখন সেই কাচের বিপরীত দিক থেকে সে রশ্মির আলোকে প্রত্যক্ষ করা গেলেও মাত্রাটিকে পরিমাপ করা যায় না। যেমন ধরে নেয়া যাক একটি গল্প, যেটি একটি মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা থেকেই উৎসারিত। এই ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে যে গল্পটির সৃষ্টি হলো সেটিকে যখন সময়ের ব্যবধানে কথনের মাধ্যমে অথবা লিখিত আকারে প্রকাশ করা হয় তখন সে গল্পটি উদ্ধৃত কাচের ওপর পতিত আলোক রশ্মিটিকে কাচটির বিপরীত দিক থেকে যেভাবে উপলব্ধি করা হয় ঠিক সেভাবেই উপলব্ধ হবে। ঘটনাটি ঘটে যাবার সময়কালের যে মাত্রা, সেটিকে কথিত অথবা লিখিত আকারে কোনোভাবেই প্রকাশ করা সম্ভব হবে না। এর নেপথ্যে অনেকগুলি কারণের মধ্যে মূল কারণটি হলো সময়ের ব্যবধান।
এর পরেই আসবে কথক অথবা লেখকের কথন অথবা লেখনীর ক্ষমতার প্রসঙ্গটি। প্রত্যক্ষদর্শী কোনো কথক যখন গল্পটি বর্ণনা করবেন তখন গল্পটিতে অতিরঞ্জনের অথবা দুর্বলতার বিষয়টির সম্ভাবনা যেমন থাকতে পারে তেমনি লেখকের বর্ণনার ক্ষেত্রেও সে রকমটি ঘটতে পারে। বিশেষতঃ একজন লেখক মূল ঘটনাটি প্রত্যক্ষের পর সেটিকে তার চিন্তার গভীরে স্থাপন করে নেন এবং তারপর সে তার চিন্তার পরিপক্বতা প্রয়োগ করে গল্পটিকে লিখিত আকারে বিধৃত করেন। সেই হেতু কথক অথবা লেখককে হুবহু ঘটনাটিকে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে অনেকগুলি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। গল্প অথবা কথাসাহিত্য সৃজনের ক্ষেত্রে এটি একটি সীমাবদ্ধতা। এই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে একজন লেখক সর্বান্তঃকরনে চেষ্টা করেন তার লিখিত গল্পের মাধ্যমে অবিকল ঘটনাটিকে তুলে আনতে- যাতে অতিরঞ্জন অথবা অবাস্তবতা গ্রন্থিত না হয়। মো. মনজুরুল ইসলাম সৃজিত “কাঠের শহর” গল্পগ্রন্থটি সেই স্বভাবজ সীমাবদ্ধতাগুলিকে অতিক্রম করে একটি সার্থক গল্পগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। অবয়ব বিবেচনায় গ্রন্থটিতে ছোটো, মাঝরি এবং বড় আকৃতির মোট সাতটি গল্প রয়েছে। গ্রন্থভুক্ত গল্প সমূহের সবগুলিকেই ছোটো গল্প বলা সঙ্গত হবে না। কোনোটি ছোটোগল্প, কোনোটি গল্প এবং কোনোটি বড় গল্প। গ্রন্থভুক্ত গল্পগুলি যথাক্রমে ‘প্রার্থিত প্রজন্ম’ ‘পানকৌড়ির পৃথিবী’ ‘মেঘলাকাশে শুভ্র শেফালি’, ‘ বিত্তহীন বৃত্তে’, ‘নীল অক্ষর’,‘ অপরাহ্ন প্রসূন’ এবং ‘ কাঠের শহর।’
‘‘প্রার্থিত প্রজন্ম” গল্পে ” শিক্ষা-চরিত্রের” চরম অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে একটি অতিবাস্তব, অতি প্রয়োজনীয় এবং একই সাথে মৌলিক শিক্ষণীয় বিষয়কে চিত্রায়িত করা হয়েছে। গল্পকার তার মেধার সর্বোচ্চ স্ফুরণ প্রয়োগ করে একজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে তার অভিভাবকেরও যে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত সে বিষয়টিকেই আলোকিত করেছেন। বর্তমান প্রেক্ষিত বিবেচনায় গল্পকার এই গল্পটির মাধ্যমে যে বার্তাটি জাতিকে প্রদান করতে চেয়েছেন সেটি হলো সততার মাধ্যমে অর্জিত সাফল্যই প্রকৃত দীর্ঘস্থায়ী সাফল্য। অসততার মাধ্যমে অর্জিত যা কিছু তার সবই অসার এবং তাৎক্ষণিক। বস্তুত এখানেই গল্পকারের চূড়ান্ত সার্থকতা।
সামাজিক বৈষম্য যে সম-সম্ভাবনা নিয়ে বেড়ে ওঠা দুজন কিশোরের মধ্যে সীমাহীন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে সেটিই “ পানকৌড়ির পৃথিবী’’ গল্পের মূল প্রতিপাদ্য। গল্পটিতে “বাবলু” নামের একটি কিশোরের মন প্রাণ দিয়ে লালিত আকাক্সক্ষা এবং অবিরাম প্রতিকূল প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বেঁচে থেকে সে আকাক্সক্ষা পূরণের সর্বোচ্চ প্রয়াসকে অবলম্বন করা হয়েছে। বাবলুর মা আর ছোটো বোনকে নিয়ে সংসার নামের যে দায়ভার আপনা আপনি ওর কিশোর কাঁধের অস্থি সমূহকে প্রতি মুহূর্তে চূর্ণ বিচুর্ণ করে চলেছে নিরন্তর, সেই দায়ের অসহনীয় ভারটিকে কাঁধ থেকে অপসারণের লক্ষ নিয়ে গ্রাম থেকে শহরে আসে বাবলু। কিন্তু শহরে এসে কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েও গ্রামে ফিরে যাবার সিদ্ধান্তকে অগ্রাহ্য করে দৃঢ় চিত্তে অবস্থান করে যায় শহরেই। বাবলুর এই ঘুরে দাঁড়ানোর অঙ্গীকারটি যেন পুরো সমাজেরই ঘুরে দাঁড়ানোর একটি প্রবল প্রতিচ্ছবি।
রক্তের সম্পর্কের বিপরীতে যে সম্পর্ক সুগভীর হৃদ্যতার সৃষ্টি করে তা কখনো কখনো রক্তের বন্ধনকেও অতিক্রম করতে পারে-যেটি সার্থকভাবে ফুটে উঠেছে ‘‘ মেঘলাকাশে শুভ্র শেফালি’’ গল্পের মূল চরিত্র শেফালি এবং মেঘলা আপার মধ্যে সৃষ্ট সম্পর্কের মধ্য দিয়ে। সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে মেঘলার প্রতিবাদী মানসিকতা প্রকৃত প্রেক্ষিতে প্রত্যেক নারীর পাশাপাশি সমাজের জন্য একটি বিশেষ বার্তা। স্বার্থহীন মানসিকতাই যে সমাজ গঠনে সক্রিয় অবদান রাখতে পারে সেটির সার্থক বহি:প্রকাশ গল্পটি।
প্রকৃত মানুষ হবার লক্ষ্য নিয়েই শিক্ষাঙ্গণে প্রবেশের যে ব্রত অতীতে পরিলক্ষিত হয়েছিল সেই ধারণা থেকে বিচ্যুত হবার একটি বাস্তব প্রতিফলন লক্ষ করা গেছে ‘‘ বিত্তহীন বিত্ত’’ গল্পে। জ্ঞানার্জনের নিমিত্তে গ্রন্থ পাঠের প্রতি একজন শিক্ষার্থীর আগ্রহের মাত্রা কতটা প্রসারিত হতে পারে সে বিষয়টিই স্পষ্ট করা হয়েছে গল্পটিতে। এবং পরোক্ষভাবে যে সকল শিক্ষার্থী মৌলিক গ্রন্থ পাঠে বিমুখ হয়ে শুধু চাকরির পড়াশুনাকে প্রধান লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে তাদের মধ্যেও যেন সেই আগ্রহটি সৃষ্টি হতে পারে সেটিও ব্যক্ত করেছেন লেখক তার বুদ্ধিদীপ্ত এবং যুক্তিপূর্ণ লেখনীর মাধ্যমে।
পড়াশুনা কিংবা অভিজ্ঞতার ব্যাপ্তি যাই থাক না কেন, সমসময়ে গ্রন্থ প্রকাশ করে অতি দ্রুত জনপ্রিয় লেখক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠার তাড়না প্রবলভাবে দৃশ্যমান সাহিত্যের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। এবং মানহীন গ্রন্থ প্রকাশের এ কাজটি করবার কারণে কিশোর থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক এ ধরনের ব্যক্তির পাশাপাশি সমাজ কতটা ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে সেটিই স্পষ্টভাবে প্রকাশের চেষ্টা করেছেন লেখক ‘‘ বিত্তহীন বৃত্ত’’ গল্পের মূল চরিত্র ‘আদর’ এর মাধ্যমে।
একটি গল্প তার বিষয়বস্তুর স্বকীয়তার মাধ্যমে একজন পাঠকের মনোজগতে যে অমোঘ প্রভাব বিস্তার করতে পারে তার প্রোজ্জ্বল উপস্থাপন ‘‘ অপরাহ্ণ প্রসূন’’ গল্পটি। গল্পটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত লেখালেখির বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার পাশাপাশি প্রান্তিক অঞ্চলে চর্চারত লেখকদের বাস্তব প্রেক্ষিতটির ওপর গুরুত্ব প্রদান করেছেন লেখক। এবং প্রান্তিক অঞ্চলের প্রকৃত মেধাবী লেখকবৃন্দ যাতে সহজেই তাদের প্রতিভাকে সবার মাধ্যমে তুলে ধরতে পারেন এমন একটি আবেদনও জানিয়েছেন।
সর্বশেষ ‘কাঠের শহর’ নামগল্পটিতে শাহরিক জীবনের কঠোর বাস্তবতার কাছে গ্রাম থেকে আসা একজন সাদা মনের মানুষ, একই সাথে সরকারি কর্মকর্তার যৌক্তিক আবেদন যে কতটা ঠুনকো তাই-ই প্রকাশ পেয়েছে মর্মান্তিকভাবে। এবং এই মর্মান্তিকতার প্রসবটি হয়েছে আমাদের শাহরিক নিষ্ঠুর সমাজের অবক্ষয়িত মূল্যবোধের কলঙ্কিত জরায়ু থেকে। এই প্রসবিত নেতিবাচক মূল্যবোধের কাছে সাধারণ মানুষের দুঃখ, বেদনা, বন্ধুত্ব, আত্মীয়তা, হৃদয়িক অনুভূতি, আকুতি, সহমর্মিতা, সহযোগীতা- এ সবের কোনো মূল্যই বহন করে না। যেটি গোটা মনুষ্য-সমাজের জন্য চরম লজ্জার এবং ঘৃণার। গল্পটির মূল চরিত্র সফিক সাহেবের মাধ্যমে লেখক যা সমাজের চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে ওই লজ্জা এবং ঘৃণার পরিমÐল থেকে সমাজকে বেড়িয়ে আসবার আহবান জানিয়েছেন উদাত্ত কণ্ঠে।
সঙ্গত কারণেই গল্পগ্রন্থটির ওপর শিল্প সমালোচক এবং বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মনিশঙ্কর দাশগুপ্তের ওপর একটি মূল্যায়ন উদ্ধৃত করবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। তার মূল্যায়ন থেকেই গল্পগ্রন্থটির সর্বজনীন স্বীকৃতি প্রাপ্তি যে কেবল একটি অপেক্ষার বিষয় তা সহজেই অনুমেয়। তিনি বলেন-“মনজুরুল ইসলামের কাঠের শহর গল্পগ্রন্থের প্রকাশ মূলত সমাজ ভাবনায় ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির আত্মপ্রকাশ। ব্যক্তিজীবনে নিয়ত তিনি যা চর্চা করেন, যাপিত জীবনে যা ধারণ করেন তাই যেন রূপায়িত হয়েছে গল্পগুলোর চরিত্রের হাত ধরে। স্বপ্ন, আদর্শ, মূল্যবোধ চরিত্রগুলোকে তাড়িত করেছে। গল্পের পরতে পরতে সুন্দর পৃথিবী নির্মাণের আকাক্সক্ষা পাখা মেলেছে। হতাশা নয়, গল্পগুলো পাঠককে আশাবাদী হতে শেখাবে নতুন পৃথিবী গঠনের পথে। গল্পগুলোতে মূল্যবোধের জয়গান যেমন রয়েছে, তেমনি আছে প্রান্তজনের কষ্টবোধ ও সংগ্রাম। রয়েছে পাঠানুরাগী তরুণ এবং লেখক হবার স্বপ্নে বিভোর এক কিশোরের অপরিপক্বতার কথা। কোনো গল্পে গল্পকার প্রকাশ করতে চেয়েছেন একজন লেখকের মনোভঙ্গি ও দৃষ্টিভঙ্গি। আর গ্রন্থের নামগল্পে প্রকাশিত হয়েছে জটিল নাগরিক জীবন, যান্ত্রিকতা ও মূল্যবোধ। গ্রন্থটি আদর্শ সমাজ গঠনের এক নিবিড় বয়ান।’’
প্রকৃত অর্থেই প্রতিটি গল্পেই গল্পকার যে ভাষা ব্যবহার করেছেন এবং প্রয়োজনীয় শব্দ চয়ন করে সে শব্দ সমূহের গ্রন্থিতে যেভাবে বাক্য বিন্যাস করেছেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়। গল্পকার তার রচনা পদ্ধতিকে তীক্ষèতার সাথে ব্যবহার করে একটি বিশেষ মাধুর্য সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। এবং এই মাধুর্য সৃষ্টি গল্পকারের একটি প্রমাণিত কৃতিত্ব। প্রকৃত প্রেক্ষিতে গল্পগুলি যেন গ্রামের ভেতর দিয়ে অতি ধীরে বয়ে চলা ছোট্ট বহতা নদীর মতোই ধীর লয়ে গতিশীল। আর এই গতিশীলতাই যে প্রতিটি গল্পকেই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভাসিয়ে নিয়ে গেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই এবং এই সংযমী গতিশীলতাই একজন পাঠককে গল্পের শেষ অবধি পৌঁছে দেবে। প্রতিটি গল্প থেকেই অঙ্গিকারের যে আলো জ¦ালানো হয়েছে সেই আলোর দ্বারা প্রত্যেক পাঠকই অনুপ্রাণিত এবং আপ্লুত হবেন বলেই আমার নিশ্চিত বিশ্বাস। একইভাবে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচনের যে স্বপ্নও দেখবেন তা বোধকরি সহজেই অনুমেয়। আর পাঠকের বোধ বৃত্তে আলো জ¦ালাবার ক্ষেত্রে গল্পকারকে কৃতজ্ঞতা প্রদান না করে উপায় নেই। গল্পগুলি স্বাপ্নিক বাংলাদেশ গঠনের ক্ষেত্রে মনন থেকে মননজুড়ে প্রার্থিত বিশিষ্টিতাগুলোর বীজ বুননে অনবদ্য ভূমিকা রেখে চলুক- সাহিত্যের একজন কর্মী হিসেবে এটিই প্রত্যাশা।