ভোর
জন্মের অনেক আগে থেকেই পূর্বসূরিদের প্ররোচনায়
প্রাতঃ সূর্যের নিচে পৃথিবীর কক্ষপথে নির্ঘুম লাইন
দিয়েছিলাম একটি ফেরারি ভোরের অপেক্ষায়,
সব জাতীয় প্রাণী আর গাছপালাদের প্রাকৃতিক আইনে ।
রাতের শেষে দিন আসছে, তবে ভোর এখনো আসে নি।
রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন গীতাঞ্জলী নিয়ে
নজরুল অগ্নিবীণা নিয়ে
মুজিবুর সাতই-মার্চ নিয়ে
লালন বা শাহ করিম এসেছিলেন অতীতের বিনম্র দোতারা নিয়ে -
এ গ্রহ হতে সবাইকে বিদায় দিয়েছি।
ওসব অতীতকে নিয়ে কিছুই করার ছিল না,
ওসব পুনরুজ্জিবন বা পুনর্নির্মাণ করা যায় না
শুধু পূজার মত এবাদত করা যায়, দাসত্ব করা যায় -
সময়ের দংশনে ওরা সবাই এখন অতীতের মর্গে ।
ভবিষ্যতের ভোরকেই চাই প্রচলিত সূর্যের চিতাভষ্মে
যাকে আমার মত করে নির্মাণ করতে পারবো।
পূর্ণিমার ঝড়
আজ আকাশ কত বিবর্ণ বিষণ্ণ
এখানে এখনই কী বৃষ্টি ঝরবে ?
শহীদ স্বাধীনের রক্ত ধুইয়ে নিতে -
ধর্ষিতার দুঃখ গ্লানি মুছে নিতে- ।
দগ্ধ জমিন কত রুগ্ন অবসন্ন
আজ এখানে কী পূর্ণিমা নামবে ?
দুর্ভিক্ষ মহামারীর লাশ বপন করতে –
বীরাঙ্গনার দীর্ঘ শ্বাস চাষাবাদ করতে ।
আকাশ হতবাক,
জমিন নির্বাক,
বিবেক অবাক,
পূর্ণিমার ঝড়ের তৃষ্ণায় … ।
দেশ
এ কেমন দেশ, যেখানে রুগ্ন নদীর স্তনে মায়ের কবরে
ফনী মনসার মত ভেদ করে উঠছে বহুতল শহর।
এ কেমন দেশ, মূর্খ মোল্লা ধূর্ত পুরোহিত
অস্পৃশ্য আমলা, ছিচকে রাজনীতিক, সরকারী সাহিত্যিক
তৃতীয় শ্রেনীর অধ্যাপক, বেকার সাংবাদিক
দিনে দুপুরে গড়ছে অনৈতিকতার নহর।
হারামখোর পিতার অনুমতি নিয়েই।
এ কেমন দেশ, জন্মের আগেই নিস্পাপী মৃত্যুর মহড়া
এ কেমন দেশ, বাপের হাতে মেয়ে ধর্ষিতা
ছেলের হাতে বৌ’য়ের হাতে বৃদ্ধা মা লাঞ্ছিতা
রাষ্ট্রের অগ্নি-চোখে একাত্তরের নাগরিকরা দিশেহারা।
এ কেমন দেশ, যেখানে মুক্তবুদ্ধির প্রানীরা বিকলাঙ্গ বা বোকা
হিটলারের নিঃশ্বাসে যুক্তির ঝর্না স্তব্ধ
বিবেকের তৃণভূমি যেন বধ্যভূমি,
বিশ কোটি মানুষ যেন ঝি-ঝি পোকা।
এ কেমন দেশ, যেখানে আকাশ আজ পরাধীন
মানুষ হাঁস মোরগ গাছ মাছ মৌমাছি সবাই পরাধীন
ম্যানুয়ালি বা ডিজিটালি।
নদী শুষিত
হাওড় হজম
বায়ু বিকৃত
পাহাড় পেটে
তা দেখে,
এমন বাঘ নেই, হুঙ্কার দেবে: ‘এবারের সংগ্রাম...’
কোন বেত্তমিজ কবিও নেই, লিখবে: ‘ এখন যৌবন যার ...’
কিংবা, ‘সুখ দে হারামজাদা ...’ ।
মনোযোগ দিয়ে দেখুন -
মনুষ্যত্ব নিখোঁজ বা খুন।
উপর থাকে নীচে।
সুখ কোথায় আছে?
উন্নয়নের কাছে?
গাঁও-গেরাম শহর-বন্দর মাঠ-ঘাট নদী পাহাড়
এ সবই এখন এক জাতীয় কারাগার ।
গন-দাসত্বের চিৎকার যেন দেশাত্মায় নিমজ্জিত আদর্শ।
এ দেশে ব্যবসায়ীক ধর্মশালা এখন ধর্ষণশালা
শিশুর শেষ নিঃশ্বাস, মেধাবী তরুনের রক্তাক্ত কান্না
ধর্ষিতার চিৎকার বধিরের কাছে বিপ্লবী প্রার্থনা
ঈশ্বরপিতা উৎখাতের প্রার্থনা
সমাজপিতা উৎখাতের প্রার্থনা
কে শুনবে যার তার প্রার্থনা ?
এ দেশে, জগৎপিতার কোষে কোষে অসভ্য চেতনা ।
একাত্তরের ধ্বংসাবশেষে ।
ক্ষমাহীন অন্ধকার
যখন নেমে আসে ক্ষমাহীন অন্ধকার -
সে অজ্ঞাত বলেই কী অন্ধ, থাকে নির্বিকার ?
সে অস্পৃশ্য বলেই কী বধির, বুঝে না তোমার ব্যথা ?
তার নৈশব্দ অস্তিত্বই কী সংসারে শেষ কথা?
তোমার ঠোঁটে স্বর্ণালী নোনা স্বেদ বিন্দুয়
সভ্যতার মাতৃত্ত্ব যেন নিরুপায়ে হাসছে -
ভোরে শীতার্ত গোলাপের যোনীতে কুয়াশার ক্লান্তি
আর নির্যাতিতার বুক ফাটা শ্রমের ঘ্রাণ
কিংবা হৃদয়ের ভূমি কম্পমান কান্নায়-
এ গ্রহে নেমে আসে বার বার ক্ষমাহীন অন্ধকার ।
মানুষ তোমার দুর্যোগে বোকা থেকে গেলে,
নিমের জলে শয়তানের মগজ ধুলাই হলে,
আহত সভ্যতা তবু জেগে উঠে বার বার,
ফলবতী মৃত্তিকায় তোমার প্রত্যয়ী অগ্নিঝড়ে-
এ গ্রহে যখন নামবে ক্ষমাহীন অন্ধকার ।
বদমাইশ ধার্মিক
উৎসবমুখর প্রথম জন্ম-চিৎকারেই এ ভবে
আকাশের মেঘময় নদীতে নগ্নপদে নির্ভুল জলজ অঞ্জলি
দিয়েছিলাম। মানুষ হব ভেবে মনে পুঁতেছিলাম ক্লীবলিঙ্গের দৈব-পুরুষের পদধূলি।
মাতা গরুর নম্র দুধে আঙুল ঘর্ষে ভক্তি করেছিলাম এই ভেবে-
বলির ভেড়ার মত অকথ্য মন্ত্র চিবিয়ে এক দিন মানুষ হব।
কাঞ্চনজঙ্ঘায় শীতল মৃত্তিকার আশ্রমে বিধবা যৌন-দাসীর রক্ত
ছুঁয়ে দীক্ষা নিয়েছিলাম আমরা মানুষ হব। বর্বর ধার্মিক নয়।
ভেবেছিলাম, প্রজাপতির শরীরে উৎসব করবো এ মর্তে
বালুকা-তপ্ত বিছানায় সুখ নেব অহিংস তরবারির আঘাতে।
সে-ই হাজার বছর আগের কথা।
বিশ্বাস ছিল কুটিল মনস্তত্তগুলু ধূপ-তুলশীর সংগমে
এই গ্রহকে পুনঃপ্রসব করবে। মোল্লা পুরোহিতদের লিঙ্গকে
বিচারপতির কাঠগড়ায় পাঠাবে।
কেননা আমরা ধর্মদাস বর্ণদাস যৌনদাস গুরুদাস নয়,
-আজন্ম প্রাকৃতিক মনুষ্য হতে চাই।
প্রতি রাতে নিজেদের মগজের সেলগুলোয় বিক্ষোভ মিছিল করি,
বাষ্পীয় অশ্রুর অবরুদ্ধ মৃত্যু-চিৎকার দিয়ে
সকল অসভ্য আত্ম-ঘোষিত ধর্মপিতার বিরুদ্ধে
যারা রাষ্ট্রকে ধর্ষণ করে মানবতার উপাসনালয়ে-
আদিম সন্ত্রাসী পুরুষতন্ত্রের নৈরাজ্যময় লোকালয়ে–
তাঁর বিরুদ্ধে অশ্রু রক্ত সিক্ত রাজপথে যুদ্ধ করি,
আজন্ম প্রাকৃতিক মনুষ্য হব বলে ।