দ্বিখন্ডিত প্রেম
এক.
"তখনও ভোর হয় নি।
তখনও বাসন্তিকা বর্ণ-শোভায় শোভিত
শাড়ীতে দুলে ওঠা
ফাল্গুনের মেঘহীন আকাশের পূর্ব নীলিমা জুড়ে
রক্তরাগে মোড়ানো রক্তিম সূর্যের পূর্বরাগের
পাখনা মেলা সোনামাখা বিজড়ন
দিগন্তের সীমানা ছুঁয়ে যায় নি।
তখনও পাখিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ
আর ঝগড়ার কোলাহলে মিশে যাওয়া প্রলাপে
আকাশ চিরে চৌচির হয়ে যায় নি।
তখনও ঘন ঘোর কুহেলিকার আস্তরন ভেঙ্গে
প্রভাতী-অধর যামিনি শেষের
শুভ্র-ধবল দিবসের আগমনকে সাদর আহবান জানায় নি;
না জানালেও ভরা রাত্রি জেগে থাকা অনেক দূরের--
কোনো ঘণ অরণ্যের কোনো একটি বৃক্ষ-শাখায় বসে
চোখ জুড়োনো, মনোলোভা একটি চিরদিনের চিরচেনা
মিষ্টি পাখি ঘুঘু--
কী মিষ্টি কন্ঠে ওর সঙ্গিনীকে কাছে পাবার জন্যে আকুল হয়ে অবিরত ডেকেই চলেছে।
আরও অতি দূর থেকে
ওর সঙ্গিনীটিও বুঝি
আরও কোনো একটি বনবৃক্ষের শাখার ডগায় বসে
ওর সঙ্গীর আকুলিত আহ্বানে
অবিরাম সাড়া দিয়েই চলেছে।
ওর সাড়াতেও একই আকুলতা জড়ানো।
কিন্তু তারপরেও সঙ্গিনীটি ওর কাছে আসছে না।
সঙ্গীটিও সঙ্গিনীটির কাছে যাচ্ছে না।
অথচ ওদের দু’জনের সাড়াতে বোঝাই যায়
ওদের বিচ্ছেদ হয় নি।
তবুও মনে হয় বিচ্ছেদের বেদনায় ওরা দু’জনই দু’জনের কাছে
কেমন যেন সকরুণ সকরুণ-বিধুর নীল বেদনার মতো।
একেই কি বলে প্রেম??
যদিও ওদের ডাকে বেদনা-বিধুরতার মাত্রাটি
কী পরিমাণের বোঝার কোনো উপায় নেই;
তবুও ওদের সাড়া দেবার শব্দ-ভঙ্গিটি থেকে
কিছুটা হলেও আঁচ করে নেয়া যায় ওরা দু’জনই
একে অপরের কাছে আসতে চায়।
ভাবতে কষ্ট হয় না যে,
এই একটি মাত্র আগ্রহই
ওদের দু’জনের কাছে অতি-প্রবল।
কিন্তু কে কার কাছে আগে আসবে--
এ সিদ্ধান্তটিই বোধকরি ওরা নিতে পারছে না।
হয়তো সঙ্গিনীটি চাইছে সঙ্গীটিই ওর কাছে আগে আসুক,
আবার সঙ্গীটি হয়তো চাইছে এর ঠিক উল্টোটি।
হয়তো দু’জনের-
কাছাকাছি আসবার মাঝখানে
এ ধরনের একটি নিগুঢ় অভিমান বোধ--
ওদের দু’জনের দু’টি অন্তরকে এভাবেই ভিজিয়ে দিচ্ছে।
এ কারণেই বুঝি কেউ কারুর কাছে আসতে পারছে না।
তবে কোনো না কোনো এক সময় আসতে ওদের হবেই।
একজনের ঠোঁটের সাথে
আর একজনের ঠোঁটকে যে কথা কইতেই হবে।
না হলে যে ওদের অভিমানে চুর চুর--
বিরহ-ভাণ্ড পূর্ণ অমৃত-সুধা পান করবার কেউই থাকবে না।
আর সে কারণেই যে--
ওদের পরস্পরকে একে অপরের কাছে আসতেই হবে -
ওই সুধা-ভাণ্ডে রক্ষিত অমৃতের স্বাদ গ্রহণ করবার জন্যে--
এটি নিশ্চিত করেই বলা যায়।
আর এটিই প্রকৃত প্রেমের
সৌন্দর্য মাখা মাধুর্য।
আমরা কি ওই বিহঙ্গ দু'টির হৃদয়ভাঙ্গা আকুলতা দিয়ে
আমাদের ভালোবাসার মাধুর্যকে নির্মান করতে পারি না??
আমরা কি বিহঙ্গ দু'টির এ সামান্য ক্ষণের বিরহকেই
চিরস্থায়ী ভেবে নিয়ে
দ্বিখণ্ডিতই থেকে যাবো??
দুই.
শুন শান নিঝুম এই শেষ রাত্রির
দিগন্ত বিস্তৃত শূন্যতার শেষ বিন্দু থেকে
দু’একটি রাত-জাগা নিশাচর পাখি
ওদের বড় বড় ডানা ঝাপটিয়ে
নিস্তরঙ্গ শূন্যতার হৃৎপিণ্ড চিরে চিরে
মধুরিমার মমতা জড়ানো শব্দ-তরঙ্গ তুলে
আকাশের অপর প্রান্তের বিন্দুটিকে
ছঁয়ে দেখবার জন্যে বুঝি প্রাণপণ ধেয়ে চলেছে।
নিঃসঙ্গ একটি বাদুর--
খুব কাছের একটি খেজুর গাছের
রস নেমে আসবার জন্যে লাগানো
কাঠিটিকে আঁকড়ে ধরবার চেষ্টা করছে।
কিন্তু কাঠিটিকে দু’পায়ে আঁকড়ে ধরে
আর একটি বাদুর ইতোমধ্যেই
কাঠিটির ডগায় নেমে আসা খেজুরের রস পান করছে।
আগন্তুক বাদুরটিকে
ও কিছুতেই কাঠিটি স্পর্শ করবার সুযোগ দিচ্ছে না।
ঝগড়া লেগে যাচ্ছে দু’জনের মধ্যে।
ঝগড়াটি শেষ পর্যন্ত এক পর্যায়ে
সংঘর্ষে রূপ নিলে
সবগুলি বিপজ্জনক
মাপজোকহীন কুৎসিত দাঁত বের করে
দুর্বোধ্য সব চ্যাচামেচি
আর নিজেদের মধ্যে রক্তারক্তি করতে করতে
দু’টি বাদুরই খেজুর গাছটি থেকে বিদায় নিয়ে
আঁধারের দু’প্রান্তে মিশে গেলো।
কেউই কারও দিকে আর ফিরে তাকাবার
এতটুকুও প্রয়োজন বোধ করলো না মোটেই।
আর প্রয়োজন বোধ করবেই বা কেন?
কারণ দু’জনের সংঘর্ষের পর
একজনের পক্ষে তো আর
অপর জনের মুখের দিকে তাকানো সম্ভব নয়,
তাকানো যায়ও না,
নিজে থেকে সেধে গিয়ে কথাও বলা যায় না--
ওদের একটি বিষম রকমের অহং বোধ
ওদের হৃৎপিণ্ডকে দ্বিখণ্ডিত করে চলেছে প্রতি পলে পলে--
বোধকরি ওদের সে অহংবোধটি একটু বেশীই--
যেটি ‘বিষম’-শব্দটিকেও হার মানিয়ে দেয়;
ওরাও কি পারেনা
ঘুঘু দু'টির মতো ওদের বুকভরা ভালোবাসা দিয়ে
একে অপরকে নিবিড় বন্ধুর মতো আলিঙ্গন করে
আপন করে নিতে??
আমরাও কি ওই বাদুর দু'টির মতো
দ্বিখণ্ডিতই রয়ে যাবো??
এই প্রশ্নটির সঠিক উত্তর দেবার
আছে কি কেউ??"
বৃষ্টির নিঃশ্বাস
"কবিতার চোখে আমি দেখেছি কিছু অন্তিম বৃষ্টির শ্বাস;
সুমুখেই দাঁড়িয়ে আছে প্রশ্বাসটি হাতে নিয়ে আমার প্রণয়িনী;
ছুঁতে গেলেই কার্তিকের 'ঝলসানো' চাঁদ;
প্রশ্বাসটি নেই।
একটু আগেই ভুমিষ্ঠ ডাষ্টবিনের সেই শিশুটি শুধু কেঁদেই চলেছে ট্যাঁ ট্যাঁ করে--
চাইলাম দু'হাত বাড়িয়ে ওর প্রশ্বাসটিকে-
চাইতেই উৎকট একটি হাসি দিয়ে কী অপূর্ব ভঙ্গিমায় প্রকাশ করলো-
ওর নিজের জীবনের রাত বারোটা এক মিনিটের ঘোষনা।
তুলে আনলাম স্যুয়ারেজ লাইনের জলে ভেসে আসা আর একটি মৃত সন্তানকে;
মৃত জেনেও পূণরপি চাইলাম ওর কাছে ওর বুকে রক্ষিত প্রশ্বাসটি--
হঠাৎ দু'হাতে আমার গলা বেষ্টিত করে বলে উঠলো-
"আমি তো তোমারই কন্যা-- আমাকে তোমার বুকে জড়িয়ে নাও"--
আমি নিলাম।
চারদিক থেকে ভাটফুলের সুরভিত ঘ্রান ভাসিয়ে নিলো আমাকে,
আমি অনুভব করলাম সুতীব্র অনুভূতি দিয়ে--
আমার সার্টের ওপরের পকেটে তরলিত কিছু প্রবেশ করছে---
আর সার্টের পকেট চুয়ে চুয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে আমার শীর্ণ বুক;
দুহাত দিয়ে তুলে ধরলাম ওর মুখটিকে
আমার চোখের সম্মুখে--
টিক টিকে লাল রক্ত ঝরছে ওর মুখ থেকে--
বুঝলাম-ও আর নেই,
চলে গেছে সূর্যের ওপাড়ে।
এখন কোথায় জুটবে আমার সেই প্রশ্বাস;
কী করে বাঁচচিয়ে ততুলবো আমি--
এই আদরিনী বৃষ্টির অনন্তিম অনিন্দ্য সুন্দর শোভাকে??
কি ভােেব রোপন করবো আমি-
এ রূপালী বৃষ্টির নতুন জীবনের বীজ??
ও যে আমারই দৃৃষ্টির আলোকে ওর
নবতর প্রাণটি খুঁজে পেতে চাইছে--
কিন্তু সবই যে এখানে মৃত্যুর লাশ!!"
পানকৌড়ির ডানা
"ডানা মেলা পানকৌড়ির পৃষ্ঠে বিপণ্ন বালিকা;
নিজেরই দৃষ্টির আগুেেন জ্বলে পুড়ে যায় পাকৌড়ির প্রাণ
দৃষ্টি তবুও নিক্ষিপ্ত হয় ভিন্ন কোনো এক অতীত
সুদুরের ধুসর নীলগ্রামের নীলোৎপলে ঢাকা
নীল জলের ঝিলে--
যেখানে রয়ে গেছে এখনও
পানকৌড়িদের উৎখাতকৃত বসবাস-চিহ্নের উপত্তকা;
সেই দূর অন্তাচলের
অপর প্রান্ত ছুঁয়ে যাওয়া
অলৌকিক নিষিদ্ধ কৌশাম্বী নগরে।
পপানকৌড়ি যেতে চায় না ফিরে আর
সে ঘৃণার্য নগরের
পাাপ-দীর্ণ অসভ্যতর নোংরা কৌলীণ্যের চমকিত কোলাহলের--
উন্মূল প্রলাপের দেশে;
প্রতিষ্ঠিত হয়েছ সে উপত্তকায় এখন
এক বিভৎস বেশালয়-
দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ করতে হয়না সেখানে
বেশ্যারা নিজরাই বিবস্ত্র হয়ে আহ্বাান জানায়
তাদের আহ্লাদের কৌমূদীদেরকে,
একে একে নগ্ন বক্ষে তুলে নেয় সেসব লম্পট মাতালদেরকে--
এদেরকেই বেশ্যারা কৌমূদী ভাবতে বাধ্য হয়।
এখানে এই-ই নিয়ম, এই-ই বিধান
বিধান লঙ্ঘনের কোনো সড়ক উন্মুক্ত হয় না কখনও
এই নিষিদ্ধ ঘোষিত কৌশশাম্বী নগরে;
নির্দিষ্ট করে দেয়া আছে সীমনা-চিহ্ন কে অথবা কারা
এ রাজত্বের বিপুল সৌভাগ্যবান-
যারা এর নাগরিক হবার ছাড়পত্র প্রাপ্তির যোগ্যাতিযোগ্য
বিবেচিত হতে পারে রাজার কাছে;
একচক্ষু রাজার পরিতুষ্টির নির্যাসই হলো
একমাত্র বিধান--
লঙ্ঘনে যার সুনিশ্চিত মৃত্যু অনিবার্য।
মরণ নিশ্চিত জেনেও জীবনটিকে
আপন দুই চরনের ভৃত্য করে রজ্জুেেত বেঁধে
উদ্ধার করে এনেছে নিষ্পাপ এ বালিকাটিকে পানকৌড়িটি
সেই কৌলীণ্যের চাদর দিয়ে মোড়ানো
বিশাল পাপের উপত্যকা থেকে
নিজেরর পৃষ্ঠে আসন পেতে দিয়ে।
পানকৌড়িটি জানে আজকে রাতেই
এ বালিকাটির হাতে সোনার চামচ দিয়ে মত্ত উল্লাসে
একের পর এক ধর্ষণ করা হবে-
তারপর হয়ে যাবে চিরদিনের মতো
বেশ্যালয়ের অতিমূলবান এক দুর্লভ অলঙ্কার।
পানকৌড়ির বসতি স্থলে হলেও
জলেও তার পূর্ণ আধিপত্য;
আর ভাবলো না পানকৌড়ি- মোটেই কালের তিলদণ্ড নেই আর-
ডানা মেলে দিলো পানকৌড়িটি বালিকাটিকে পৃষ্ঠ বহন করে
অথৈ জলের ঠিকানার উদ্দেশ্যে।
বালকাটিকে জল পান করাতে হবে সবকিছু ভুলে গিয়ে
ওকে যে বাঁচাতেই হবে; ও না বাঁচলে
সভ্যতাও যে আর বাঁচবে না!!
প্রশ্ন রয়ে গেলো--পানকৌড়িটি কিসের প্রতীক??
আত্মানুসন্ধানই এখন
চরম তেজস্ক্রিয় বিস্ফোরণের মূল উপাদান।"