খেঁiয়ারি ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
খেঁiয়ারি ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস

আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যে ছোটগল্পের ভিত্তি যদিও রবীন্দ্রনাথের হাতে, তারপরও কল্লোল বা কালি-কলম গোষ্ঠীর অবদান ফেলা দেয়া যায় না কোনোভাবে, বঙ্কিমচন্দ্র যে সাহিত্য ধারা তৈরি করতে চেয়েছিল, তা পুরোপুরি মাঠে মারা না গেলেও ওপথে কেউ যায়নি সেভাবে, বাঙালির অনেক কাছের মানুষ হয়ে গেলেন শরৎচন্দ্র, বেশ কয়েক দশকজুড়ে পাঠকসমাজকে মোহিত রেখেছিলেন তিনি, পরবতীর্সময়ে তারা-বিভূতি-মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়াও অচিন্ত্য কুমার-প্রেমেন্দ্র মিত্র-জগদীশচন্দ্র-নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়-সৈয়দ মুজতবা আলী-জ্যোতিরিন্দ্র-সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ-কমলকুমার-কাজী আবদুল ঔদুদ-সমরেশ বসু-শওকত ওসমান-গোলাম কুদ্দুস-রমাপদ-সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ প্রমুখ সাহিত্যিক বাংলা ছোটগল্পকে করেছেন সমৃদ্ধ, প্রবহমান সময়-সমাজ-জীবন ও জীবনের নানান অনুষঙ্গ নিয়ে এ’ যাবৎকাল কাজ করেছেন যারা, উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছেন হাজারো প্রতিবন্ধকতা সত্তে¡ও, দিয়েছেন প্রাণশক্তি, এনেছেন বিষয়ের বৈচিত্র্য-চরিত্রের ভিন্নতা-বণর্নায় অভিনবত্ব-চিন্তার গহনে হয়েছে উৎকষর্মÐিত, কাজী নজরুল ইসলাম তো বাংলা ছোটগল্পকে অন্যরকম সাজে সাজিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন, যার অনেকখানিক প্রমাণ দেখতে পাওয়া যায় তার গল্পসম্ভারে, অথচ সময় স্বল্পতার কারণে সবটুকু নিযার্স দিয়ে সাজিয়ে তুলতে পারেননি তাও সত্য, তারপরও বলতে হয়, বাংলা গল্পসাহিত্যকে একটা রঙ দিতে পেরেছেন নজরুল।

আধুনিক বাংলাসাহিত্যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (১৯৪৩-১৯৯৭) এক রৌদ্রোজ্জ্বল প্রতিভার নাম। ছোটগল্পের শরীরে আখ্যান বা কাহিনী কিংবা বিষয় কতখানি জড়ানো হবে, সেটা বড় নয়, তার বাইরে একটা গল্পকে সময়ের দাবির কাছে পেঁৗছে দেয়া, চরিত্রের আপাদমস্তক খঁুটিয়ে বিশ্লেষণ করাই ইলিয়াসের গল্পের কৌশল। মাঝে-মাঝে আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সবর্সাকুল্যে ত্রিশটি গল্প, (পঁাচটি গল্পসংকলন, এবং অগ্রন্থিত আরও কয়েকটি গল্প) দুটো উপন্যাস এবং একমাত্র প্রবন্ধগ্রন্থ লিখে বাংলাসাহিত্যাঙ্গন দখল করে নিলেন, বারেক আবদুল্লাহ বা কায়েস আহমেদ বা মাহমুদুল হক অথবা শহীদুল জহির, এরাও একটা সময় থেমে যায় পেন্ডুলামের কঁাটার মতো, আসলে কি থেমে যাওয়া নাকি পলায়ন, যবনিকার আড়ালে প্রস্থান করা, ওঁদের সাহিত্যের মুগ্ধ পাঠক আমি বরাবরই, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আধুনিক বাংলাসাহিত্যের অহঙ্কার, তার গল্প-উপন্যাস নিজস্ব স্টাইলে দঁাড়িয়ে, তিনি উদাহরণ, তার ভাষা ব্যবহার-চরিত্রচিত্রায়ন-আঙ্গিকগঠন-শহর-নগরের মানুষের আপদমস্তক বিশ্লেষণ-নাগরিক জীবনের পরিবেশ পযের্বক্ষণ... তিনি সবর্দা গল্পের ব্যাকারণকে দূরে ঠেলে সামাজিক সময়ের প্রেক্ষাপটে কাহিনীর স্তরে খননকাজ করেন, বৃহৎতর মহাকাশে তা নিক্ষেপ করেন, সমাজ-সচেতনই নয়, অন্তভের্দী দৃষ্টি এবং উপস্থাপনের নিজস্ব শৈলীর সমম্বয়ে ইলিয়াস বরাবরই গল্পের অস্থি-মজ্জায়-করোটিতে নিমির্ত করেছেন এক উজ্জ্বল স্বাতন্ত্র্য, বিষয়-বক্তব্য-ভঙ্গি-মেজাজের দিক থেকে তার গল্প হয় এমনি এক ভাস্কযর্। তার সমসাময়িক সাহিত্যিক বা পূবর্বতীর্ সাহিত্যিক খঁুজে পাওয়া যায় না, যার যোগ্য সহোদর, এখানেই তার ভিন্নতা দৃষ্টি কাড়ে। ১৯৬৫ থেকে ১৯৭৫ অবধি লেখা নিয়ে প্রথম গ্রন্থ ‘অন্য ঘর অন্য স্বর’ (১৯৭৬) পরবতীর্সময়ে ‘খেঁায়ারি’ (১৯৮২) ‘দুধভাতে উৎপাত’(১৯৮৫) ‘দোজখের ওম’(১৯৮৯) সবের্শষ গল্পগ্রন্থ ‘জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল’ (১৯৯৬) অথার্ৎ পঁাচটি গ্রন্থে প্রকাশিত গল্পের সংখ্যা এবং পত্র-পত্রিকায় বা অগ্রন্থিত আরও কয়েকটি নিয়ে মোটামুটি ত্রিশটি গল্প লিখেছেন ইলিয়াস। দুটো উপন্যাস ‘চিলেকোঠার সেপাই’(১৯৮৬) ‘খোয়াবনামা’ (১৯৯৬) এবং প্রবন্ধসংকলন ‘সংস্কৃতির ভাঙা সেতু’ (১৯৯৭), এই আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাহিত্যসম্ভার, প্রকৃতপক্ষে তাকে গল্পের কারিগর বলা যায়, গতানুগতিক গল্পের ধারা বা আঙ্গিক ভেঙে নতুন একটা শৈলী বা স্টাইল নিমার্ণ করেছেন, ইলিয়াসের গল্পজগৎ প্রধানত পুরানো ঢাকার অলিগলি-এবড়ো-থেবড়ো ঠিকানাহীন রাস্তা-যত্রতত্র ভগ্নপ্রায় কোঠাঘর-দঁাত কেঁলানো প্যালেস্তারা ক্ষয়া পোড়ো বাড়ি-সেকেলে চিন্তার মানুষজন, এগুলোর ভেতর দিয়েই তার গল্পের চরিত্রেরা আপনাআপনি বেরিয়ে আসে, গভীর রাগে কখনো ক্ষোখে কথা বলে ওঠে, আবার সেগুলো কখনো হয়তো চরিত্র হয়ে যায় সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে, পুরনো ঢাকার বলয়-বৈচিত্র্যে-আভিজাত্যে আর ঐতিহ্যের সঙ্গে চরিত্ররা একাত্ম হয়, আবার কখনো প্রতিবাদ করে, সেই ঝলসানো প্রতিবাদের ভেতর চলে জীবনের দরকষাকষি, মানুষ যে ঘোরের ভেতর থাকে এবং তা তাকে জীবনেরই অংক শেখায় অথবা জীবন থেকে বিচ্যুত করে, সেই গল্পেই ইলিয়াস করেছেন পাঠকের মুখোমুখি বসে, তার কাহিনীমালা তো এভাবেই ডানা ঝঁাপটিয়ে বিশাল আকাশ ছঁুয়ে যায়।

অসাধারণ মমত্বময় গল্প ‘খেঁায়ারি’-এর পটভূমি পুরানো ঢাকা, আর কেন্দ্রস্থল বৃদ্ধ অমৃতলালের জরাজীণর্ বিশাল বসতবাড়ি, শতাব্দী প্রাচীন বাড়িটির এবং বসত করা মানুষজনের স্মৃতিমন্থন করেছে অমৃতলাল, সাতচল্লিশ পূবর্ ঢাকা শহরের হিন্দু-মুসলমানের আথর্-সামাজিক অবস্থার জ্বলজ্বলে অথচ কুয়াশা ঢাকা একটা নিমর্ম ছবি পাঠকের সামনে টেনে এনেছেন, সাতচল্লিশের দেশভাগে বাঙালি যে দু’ভাগে বিভক্ত হয়েছিল সে রেশে অমৃতলালের পরিবার বা পূবর্পুরুষরা বলী হয়, ইলিয়াস তার ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে সমাজের ত্রæটি-বিচ্যুতি ভবিষ্যৎ স্বপ্ন বিদ্রƒপ অপূবর্ রসায়নে তুলে ধরেছেন নিমোর্হভাবে গল্পের আদলে। বিচিত্রমুখী সংকট এবং অবক্ষয়ের আবতের্ বিপন্ন মানবতা, সংকটবিদ্ধ সমাজব্যবস্থা আর তার শরীরের ক্ষতবিক্ষত আত্মচেতনা, এর ভেতর নিঃস্ব-নিরন্ন মানুষের হাহাকার, যা আমাদের চিরচেনা মানুষের ছবিগুলো মনে করিয়ে দেয় দারুণভাবে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূবের্ অমৃতলাল বা তার পূবর্পুরুষেরা ঐশ্বযর্ ও দাপটের সঙ্গে বসবাস করতো ঢাকায়, দেশভাগে হয়ে গেলো সংখ্যালঘু রাতারাতি। বিশাল একান্নবতীর্ পরিবারের অনেকেই কলিকাতামুখী হলো, ঢাকার সঙ্গে সম্পকোের্চ্ছদ ঘটে ক্রমশ, সময়ের ব্যবধানে বিশাল বাড়ির দেয়াল থেকে ক্ষয়ে চুন-সুড়কি পড়তে থাকে, সাতচল্লিশের পরে চৌষট্টির দাঙ্গা এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মতো তিন তিনটে বিশাল ঝঁাকুনি সহ্য করেছে বাড়িটি, একাত্তরে রাজাকারেরা বা পাকিস্তানিরা বাড়িটিকে ক্ষতবিক্ষত করেছে, দেশ স্বাধীন হলেও পরিবতর্ন হয়নি অমৃতলালের পরিবার বা বাড়ি-ঘরের ভাগ্য, গেঁাদের ওপর বিষফেঁাড়ার মতো বরং নতুন আরেক সংকট সামনে দঁাড়াল, অমৃতলালের ছেলে সমরজিতের বন্ধুরা বাড়িটির কিছু অংশ ভাড়া বাবদ দখল চায়, মুক্তিযুদ্ধ ও বাম রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নেতাকমীর্রা অমৃতলালের বিশাল বাড়িখানা তাদের আঞ্চলিক অফিসের জন্য উপযুক্ত স্থান বলে বিবেচনা করে, সে’ কারণে সমরজিতের সঙ্গে মদ পানের আসর বসায় তার বন্ধু জাফর-ইফতেখার-ফারুক। তাদের মধ্যে যতই কথকথন হউক না কেনো মিষ্টিমধুর, প্রকৃতপক্ষে বাড়ি ভাড়ার অজুহাতে দখল নেওয়ার ধান্ধা বড় হয়ে দেখা দেয়। কিন্তু বাড়ি ছাড়ার চাপ বা হুমকি দেওয়ায় অমৃতলাল ক্রমশ প্রতিবাদী হয়ে ওঠে, বাপ-ঠাকুরদার পৈতৃক বাড়ি কেনো ছাড়বেন, কেনো যাবেন অচিন দেশে, মাটির শেকড় ছেড়ে কোথাও তিনি যাবেন না, কারণ ঢাকা শহরের কত বড়-বড় মানুষ তাদের একটা সময় খ্যাতির-যতœ করত, স্বয়ং নবাব বাহাদুর নিজেও একদিন এসেছিলেন, স্মৃতি মন্থনের ভেতর দিয়ে অমৃতলাল অতীতে ফিরে গেলেও সমরজিতের নেশা বাড়ে, বন্ধুরা ওকে মদের নেশা ধরিয়ে ভুলিয়ে-ভালিয়ে বাড়ির অধিকার চায়। ইলিয়াস এভাবেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অত্বিত্বের কঠিন সংকটের স্বরূপটি তুলে ধরেছেন গল্পের আঙ্গিকে, স্বাধীনতা পরবতীর্ মূল্যবোধহীন রাজনীতির একটা স্বচ্ছ পরিচয় ফুটে উঠেছে, সংখ্যালঘু উৎখাত-রাজনৈতিক কতৃের্ত্ব নিজস্ব স্বাথর্ উদ্ধারের চরম নীলনকশা প্রতিফলিত হয়েছে, সে’ সঙ্গে অবক্ষয়িত নষ্ট-ভষ্ট যুব-সমাজের বলয় নিমির্ত হয়েছে গল্পের ছত্রে-ছত্রে, ফারুক-জাফর-ইফতেখার হতাশগ্রস্থ যুবক, নেশা-আড্ডা বা রকে বসে গুলতানি মারে, উচ্চ ব্র্যান্ডের মদ পান করে, সুযোগ পেলে বিশেষ এলাকায় কতৃর্ত্ব করতে ছাড়ে না, তিনজনে তিনরকম চরিত্রের হলেও কেউ কাউকে ছাড়া চলতে পারে না, সমরজিৎ ওদের খুব কাছের বন্ধু, আর সে সুযোগটা ওরা নিতে চায়। তাই সমরজিতের বাবা-ঠাকুরদার সেকেলে বাড়িটা রাজনৈতিক অফিস বানাতে চায়, অমৃতলাল একাত্তর যুদ্ধ-পরবতীর্ যুবসমাজের দিকে তাকিয়ে শিউরে শংকিত হয়ে ওঠে, মানুষের পরিবতর্ন নাকি সময়ের পরিবতর্ন নিণর্য় করতে ভারী কষ্ট হয়, নিজেকে খেঁায়ারির মধ্যে রেখে সময়ের মানুষ দেখার চেষ্টা করে। স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে আজ যারা তৎপর, তাদের পূবর্পুরুষেরা এ’বাড়ির অন্নে মানুষ হয়েছে একদিন, অথচ নিয়তির কি চরম পরিহাস, এ’ বাড়ির মানুষেরা আজ সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হয়েছে, পুরানো ঢাকার জীবন বৈচিত্র্যের নানাবিধ অনুসঙ্গা নিয়ে খোয়ারির মতো গল্প লিখে ইলিয়াস শুধু বাংলা ছোটগল্পকেই সমৃদ্ধ করেননি, নগর জীবনের বিকৃত মানবীয় মূল্যবোধের বিপযর্য়কে চিহিৃত করে পাঠক সমাজকে সচেতন করার চেষ্টা করেছেন বললে নেহাৎ ভুল হবে না। প্লট নিমাের্ণর দক্ষতায় পুরোনো ঢাকার বিশাল বাড়ি অন্যরকম একটা মডেলে রূপান্তর লাভ করে, গল্পটি রচনায় ইলিয়াসের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত নিমোর্হ-নিরাসক্ত এবং পক্ষপাতহীন লক্ষ্য করা যায়।

সমাজবাস্তবতা ও মনোবাস্তবতা সাহিত্যে পরস্পর যুক্ত, চরিত্র-চিত্রণের দক্ষতাও গল্পের কাঠামোকে শক্ত ভিতের ওপর দঁাড় করায়, ‘ তারাবিবির মরদ পোলা’ এমনই একটা মনোবিশ্লেষণধমীর্ যৌন-মনস্তত্বের ফ্রয়েডীয় রূপায়ণের গল্প, ব্যক্তিমানুষের অন্তনিির্হত কমর্ ও বহিজার্গতিক সুখ-দুঃখ হাসি-কান্নার কথা নিপূঁণভাবে গল্পরূপে স্থান করে নিয়েছে সুচারুভাবে, এ’ গল্পে গোলজারের চারিত্রিক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ইলিয়াস বিচিত্র অভিজ্ঞতার ছকে গল্পটিকে একটা বিশেষ চরিত্রে দঁাড় করেছেন, গোলজারের ষাটোধ্বর্ বয়সি পিতা রমজান আলীর চিত্রাঙ্কন করেছেন মানবিক দৃষ্টিতে, এসেছে গোলজারের পঁচিশ বছর বয়সি সৎ মা তারাবিবির বিচিত্রজীবন, আর গোলজারের স্ত্রী সখিনার দৈনন্দিন জীবনের সচিত্র বয়ানে তাদের অভ্যন্তÍরীণ ছবিটা, রূঢ় ও নিখাদ বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে জীবনকে বিবণর্ সময়ের ম্যঁারপ্যঁাচে ফেলে সত্যিকারের একটা কাঠামোতে নিজেকে সমপর্ণ করেছেন, হয়তো এখানেই তার কৃীতর্। তার বিবির মূল সমস্যা নিঃসঙ্গতা, অথবর্ স্বামীর সঙ্গে সংসার করতে গিয়ে জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা এসে গেছে, অতৃপ্ত যৌনকামনা পুঞ্জীভূত হতে-হতে স্বামীর প্রতি ঘৃণা জমে গেছে প্রবলভাবে, আর সে’ কারণে কারো সুখ তার পছন্দ হয় না, ছোট জিনিসকে বড় করে দেখা বা কোনো অহেতুক ব্যাপারে নাক গলানো তার স্বভাবসূলভ আচরণে পরিণত হয়েছে, বুড়ো স্বামীকে উঠতে-বসতে অপদস্থ করা যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা, সতিনের ছেলে গোলজারের স্ত্রী সখিনার মধ্যে অহনিশি সন্দেহ ঢুকিয়ে দিতেই সদা তৎপর, এভাবেই দাম্পত্য কলহে উস্কে দেয় সখিনাকে, গোলজারের অনুপস্থিতির সুযোগে আজবাজে নানান গালগল্পজুড়ে দেয় ঈষার্পরায়ণ হয়ে, আর সে কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দ্ব›দ্ব চলতে থাকে দিনশেষে রাত্রে বাড়ি ফিরে এলে, বাড়িতে নামাজ-বন্দেগি করেও কোনো লাভ হবে না কারণ বাড়িতে পাপ, ঘরে পাপ, পাপে-পাপে ভরে গেছে সবর্ত্র, গোলজারের নামে এমন সত্যমিথ্যা হাজারো অপবাদ দিয়েও ক্ষান্ত হয় না, তামাম বাড়ির নিস্তব্ধতা ভেঙে খানখান করে যৌন অপরাধের মসৃণ পথ করে দেয় গোলজার আর সুরুজের মায়ের মধ্যে, এভাবে দেখা যায় তারাবিবি, তার ক্ষোভ-যন্ত্রণা-অন্তজর্¡ালা নিরারণ করে শান্তি পায়। একদিন বাড়ি ফঁাকার সুযোগে গোলজার আর সুরুজের মা একেবারে কাছাকাছি চলে আসে এবং গোলজারের বাপ রমজান আলীর কাছে তা হাতে নাতে ধরা পড়ে, কাজের কাজ কিছু না হলেও রমজান আলীর ডাকচিৎকারে গাছের একটি পাতাও পড়ে না, তারাবিবির মনে কোনো ক্ষোভও আর জাগে না বরং তারাবিবির অথবর্ বয়োবৃদ্ধ স্বামী রমজান আলীকে তীব্র রোষে স্তব্ধ করিয়ে দেয়, ‘এমন চিল্লাচিল্লি করো ক্যালায়? গোলজারে কি করছে? পোলায় আমার জোয়ান মরদ না একখান? তুমি বুইড়া মড়াটা, হান্দাইয়া গেছো কব্বরের মইদ্যে, জুয়ান মরদের কাম তুমি ভি বুঝবা ক্যামনে?’ এ’ সংলাপের ভেতর দিয়ে তারাবিবির দীঘর্কালের যন্ত্রণার-ক্ষোভের একটা পূণার্ঙ্গ রূপ চিত্রায়িত হয়েছে, মূলত সে যতটা আগ্রাসী মনোভাবের পরিচয় এতকাল দিয়েছিল তা অনেকটা স্তিমিত হয়ে যায়, কারণ সে যৌবনের যে স্বভাবসূলভ আকষর্ণ এবং সে আকষের্ণ মানুষ যে উন্মাতাল হয়, তা নিজের ভেতর অনুধাবণ করে, বোঝার চেষ্টা করে বলেই স্বামীকে ধমকে কুপোকাত করেছে, কারণ যৌবনের ধমর্ তার বোঝার সাধ্য নেই আজ, তারাবিবির ভাবনায় তার মরদপোলা তেজোদীপ্ত মনকে প্রশমিত করতে পারে একমাত্র নারীর সংস্পশর্। জৈবিক প্রবৃত্তির দৃশ্যমান চিত্র ইলিয়াস এভাবেই পাঠকের সামনে হাজির করেছেন মমতা মাখানো কলমে, সূ² দৃষ্টিতে দক্ষতার সঙ্গে চরিত্রের সংমিশ্রণে করে নানান বিষয়াদি সংযুক্ত করেছেন গল্পের পরতে-পরতে, সমাজ এবং সমাজদেহের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা মানুষের জৈবিক ইচ্ছেকে উন্মেচিত করতে ইলিয়াসের জুড়ি নেই।

তারাবিবির যে সমস্যা ‘অসুখ-বিসুখ’ গল্পের প্রধান চরিত্র বৃদ্ধা আতমন্নেসার সমস্যা এক নয়, গল্পটি মনোযোগী পাঠকের কাছে একটা অন্যরকম দৃষ্টান্ত সন্দেহ নেই, জরাগ্রস্ত-বৃদ্ধা এই নারী প্রতিদিন প্রতিনিয়ত ঈষাির্ন্বত হয় পরিবারের অন্য সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা প্রত্যক্ষ করে, গল্পটি বিত্তহীন বা স্বল্পবিত্ত মানুষের জীবনযাপনের গল্প, বৃদ্ধা আতমন্নেসার ছেলে-মেয়ে জামাই- ছেলেবউ নাতি প্রমুখ চরিত্রগুলো গল্পের আখ্যানে গুরুত্বসহকারে স্থান পেয়েছে, চরিত্রের অসুস্থতা যে ইলিয়াসের কাছে গুরুত্বপূণর্ বিষয়, তা বলতে বা ভাবতে পাঠকের কষ্ট হয় না, অথচ সুস্থতার পরিবতের্ অসুস্থতাকে ইলিয়াস বারবার কেন ছঁুতে চেয়েছেন, কেনো তিনি অসুস্থতাকে অবলম্বন করে গল্পের প্লট নিমির্ত করেছেন, তা বুঝতে পাঠকের বাকি থাকে না। নাগরিক জীবনের নানাবিধ সমস্যা এবং সে সমস্যাগুলো উত্তরণের কোনো পথ খোলা নেই, এবং এভাবেই মানুষ নাগরিক জীবনের ঘেঁরা টোপের মধ্যে একটু-একটু করে বেড়ে ওঠে, বড় হয়, এবং তারপর একটা সময় চোখের আড়ালে চলে যায় অথার্ৎ মরে যায়। মানুষ হয়তো তার দু’ চারদিন খেঁাজ-খবর নেয় তারপর পূবের্র মতো সবই মিলিয়ে যায় ভাবনার সেতু। বৃদ্ধা আতমন্নেসার কষ্টের কথা কেউ বোঝে না, শোনে না তার আকুতি, সবাই তাকে সুস্থ মানুষ বলে এড়িয়ে যায়, অথচ মতিবানুর স্বামী সব-সময় ঔষধ-ফলফলালি নিয়ে আসে, হঁাপানির রোগী এবং বন্ধ্যা বউয়ের জন্য ঔষধ খাইয়ে সন্তান নেওয়ার চেষ্টা দেখে আতমন্নেসার ঘৃণা হয়, নিজের মনে নিজে মেয়ে-জামাইকে গালিগালাজ করে, আজেবাজে কথা বলে। শিক্ষিত ছেলে খোরশেদ বলে, মা সুস্থ মানুষ, এ’ তার মনের অসুখ। বাড়ির কেউই তার অসুস্থতাকে আমলে নেয় না, একদিন নাতি আলমকে পান ও পয়সার লোভ দেখিয়ে মতিবানুর ঔষধের পোটলা নিজের কাছে আনে, এবং সুস্থ হওয়ার আশায় খেয়ে ফেলে, তারপর চরম বিপযের্য় পেঁৗছালে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার হয় আতমন্নেসাকে, সেখানে চেকআপ করলে রোগের বাপের বাপ ক্যান্সার ধরা পরে, নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণা-অবহেলার ক্ষোভ আর সন্তান-সন্তাতি বা বউমা-জামাইয়ের কাছ থেকে উপেক্ষার চাপ তাকে ক্রমশ অসুখি করেছে, মনের দিক থেকে তাই সে সংকুচিত হয়ে থাকে, আবহমানকাল ধরে প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় বাধকের্্য মানুষ একটু যতœ-আতির্র আশা করলেও বাকি জীবন বংশধরেরা তাকে দেখবে এই ধারণায় মানুষ স্বপ্ন বোনে এবং সে স্বপ্নটাকে বাস্তবতায় পরিপূণর্ দেখতে চায়। ক্যান্সার রোগী আতমন্নেসার একমাত্র পথ মৃত্যুই, ঘূণায়মান মৃত্যুর দিকে নিবার্ক চোখে তাকিয়ে, ছেলে-মেয়ে পরিবার অশ্রæ ঝরাচ্ছে, মৃত স্বামীর ডাকে সে পরপারে চলে যাবে, বাড়ির সবাই অশ্রæপাত করলেও আতমন্নেসা হাসছে, এ’ কারণে যে তাকে নিয়ে পরিবারের সবাই বেশ ব্যাতিব্যস্ত এখন। মৃত্যুর যে মানুষকে আনন্দ দেয় এবং স্বাভাবিক জীবন থেকে অশস্মৎ বিচ্যুত হলেও এতে যে অন্যরকম ভালোবাসা কাজ করছে তা অসুখ-বিসুখ গল্পে ইলিয়াস রোপিত করেছেন। বাঙালি মানসিকতার এ’ গল্পে মনস্তাত্তি¡ক জটিলতার ছাপ লক্ষ্য করা যায় এবং এটাই হয়তো স্বাভাবিক পন্থা, সেবা-যতœ বেড় যাওয়ার মহত্ব দেখে পাঠক অনুধাবণ করে প্রাত্যাহিক জীবনের অংকটা কতো জটিল ও মারাত্মক, গল্পের চরিত্রগুলো অত্যন্ত মযার্দাশীল, চরিত্র নিবার্চনে নিখঁূত ও পরিশীলতার স্বাক্ষর লক্ষ্য করা যায়। এভাবে জীবনযুদ্ধের এক বৃদ্ধা নারীর আকুতির কাছে গল্পের আপদমস্তক উপলব্ধি শৈল্পিক বণর্নায় চিত্রায়িত হয়ে বাংলাসাহিত্যে জায়গা করে নিয়েছে চমৎকারভাবে।

বৃহৎ পাঠক সমাজকে চরম এবং জটিল বাস্তবতার মুখোমুখি দঁাড় করিয়ে দিয়েছেন ইলিয়াস ‘ পিতৃবিয়োগ’ গল্পে, জন্ম-মৃত্যু নিয়েই মানুষের জীবন, জন্মালে মানুষের মৃত্যু অবধারিত এবং এই সুক্ষè চিন্তা থেকেই মানুষ পৃথিবীতে কিছু একটা দাগ রেখে যায়, সেটা ভালোবাসা অথবা ঘৃণা-মিথ্যের বেসাতি কিংবা হযতো কিছুই নয়, তারপরও মানুষ বেঁচে থাকে, বঁাচার ইচ্ছে তাকে অহনিশি তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়, কিন্তু মৃত্যু এসে একদিন যখন তাকে চিরকালের জন্য নিয়ে চলে যায়, তখন তার কি করার থাকে, মিথ্যেবাদি রাখাল বালকের মতো বাঘের পেটে চালান হতে হয় অথার্ৎ মৃত্যু বরণ করতে হয়, এবং এটাই স্বাভাবিক! এ’গল্পে মৃত্যুচিন্তার সাথর্ক উপস্থাপন দেখে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না, ব্যাপক মনোবিশ্লেষণ প্রবণতার মধ্যেই লুকিয়ে আছে তার গল্পের স্বপ্নবীজ-ঘটনাবিন্যাস এবং আঙ্গিকগত কৌশলের নানাবিধ প্রবৃত্তি। বাস্তবতার সঙ্গে কল্পনার রঙ মিশিয়ে ইলিয়াস জীবনকে সাজিয়ে তোলেন নতুন সজ্জায়, সেখানে যেন জীবন কথা বলে ওঠে সৃষ্টি সুখের উল্লাসে, মৃত পিতা আশরাফ আলীর লাশের পাশে বসে কাফন সরিয়ে দেখে সন্তান ইয়াকুব,এই পিতা এমনই একজন মানুষ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার কাঠামোতে কমর্চারি হিসেবে নিজের দায়িত্ব সৎ ভাবে পালন করে এসেছেন, মায়ের মৃত্যুর পরও দ্বিতীয়বার বিয়েও করেননি, বাকি জীবন নিঃসঙ্গতায় কাটিয়েছেন, সেই পিতা মৃত আজ! পোষ্টমাষ্টার পিতা আশরাফ আলীর ভালো কোনো স্মৃতি ইয়াকুবের মগজে নেই, কারণ তিনি ছিলেন নিমর্ম-নিদর্য়-স্থবির ইয়াকুবের কাছে, তেইশ বছরের চাকুরি জীবন শেষ করেন, ইয়াকুব নানির কাছে মামাদের সঙ্গে বড় হয়, একরোখা-কঠিন হৃদয়ের মানুষ হিসেবে প্রতীয়মান বাবা, অথচ এখানে এসে ইয়াকুব জানতে পারে পিতার বিভক্ত মানসিকতার কথা, ফলে পুত্রের মধ্যে সৃষ্ট হীনম্মন্যতায় তাকে প্রলুব্ধ করে, পিতার দাফন কাযর্ সম্পন্ন না করে কমর্স্থলে চলে যায়। স্বাধীন দেশে উচ্চ সরকারি পদে বসে পিতা শুধুই অফিস চিনেছেন, স্ত্রী-সন্তান বা পরিবারের মানুষদের বোঝেননি-চিনেননি, অফিসিয়াল নিয়মে-খঁাকি পোশাকের নীরস মযার্দা-খসখসে চিঠিপত্র আর মানিঅডাের্রর মতো ব্যবহারিক বিষয়াদি তার মাথায় সারাজীবন অক্টোপাসের মতো ছিল, ইয়াকুব তার জীবনে এমনই একজন পিতাকে দেখে অনুধাবণ করছে, কিন্তু পিতার লাশের পাশে বসে নিরীক্ষণ করার সময়, পিতার বন্ধু বা তার চেনা-জানা পরিচিত মানুষের মুখে অন্যরকম আরেক আশরাফ আলীকে আবিষ্কার করে, যদিও তার কল্পনার পিতার সঙ্গে মিলে না কিন্তু যারা বলছে তারা সঠিকই বলছে, বাইরের লোকের কাছে তিনি কতোটা মানবতাবাদি মানুষ ছিলেন, কতোটা নরোম মনের মানুষ ছিলেন বোঝা যায় তাদের বয়ানে। কতো রসিক আর কমোের্দ্যাগী ছিলেন, এলাকার মানুষের সুখ-দুঃখে শরিক হতেন, কারো ছেলের অসুস্থতায় বা গাঠপড়া-হাতভাঙা বা ট্রেন দুঘর্টনায় আশরাফ আলী যথাসাধ্য সাহায্য করতেন, সামনে এসে দঁাড়াতেন, উপস্থিত মানুষের মুখে পিতার ওমন সুনাম-সুখ্যাতির কথা শুনে ইয়াকুব মিলাতে পারে না কোনোভাবে তার পিতাকে, তবে কি সে অন্য এক পিতাকে দেখছে, যার সঙ্গে কোনো সামঞ্জস্য নেই, পচনশীল লাশের মুখটা দেখে কোনোভাবে নিজের পিতাকে চিনতে পারে না, শূন্য ঘরে নিঃসঙ্গ একজন ইয়াকুব কোনোভাবেই শনাক্ত করতে পারে না নিজের পিতাকে, গল্পের মানবজীবনের বহু সংকটের একটা প্রধান সংকট উপস্থিত হয়েছে যা ইলিয়াস দাশির্নক ভাবনায় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন।

খেঁায়ারি গল্পে বিশেষভাবে সংখ্যালঘু সমস্যার কিছু অন্তময় চিত্র অংকিত হয়েছে, পুরনো ঢাকার ঘিঞ্জি এলাকার জীবনবৈচিত্র্যের নানাবিধ অনুষঙ্গ নিয়ে তার এ’গ্রন্থের গল্পগুলো, ইলিয়াসের মনোবিশ্লেষণ প্রবণতার মধ্যে লুকিয়ে আছে গল্প-উপন্যাসের ঘটনাবিন্যাস কৌশলের এক তাৎপযর্ময় দিক, মনোগত বিশ্লেষণেই স্বাভাবিক পথ ধরেই তার কাহিনীবিন্যাসে অনুসৃত হয়েছে চেতনাপ্রবাহ রীতি।


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান