ক্লান্ত দুপুর। শান্ত চারদিক। চারপাশে ধানক্ষেত সবুজের উৎসবে রৌদ্রের উল্লাস। তারই কাছে দূরের মানুষের সাধ্যমত ঘরবাড়ি। একটি বাড়ির নিকোনো উঠোন পেরিয়ে ছায়া সুনিবিড় বকুলতলা শেষ হলেই বিশাল পুকুর।
তার চার পাড়ে নানা ফলফুলের বৃক্ষ বিথীতে নিপাট নিসর্গ মনকাড়ে । কাঁঠাল পাতার ছায়ায় ক্লান্ত দোয়েল যেন স্তব্ধতার মন্ত্রে শব্দহীন। কাঁদামাখা কৃষক গোসল করতে এসে বকুল ছায়ার নীচে ঘুমিয়ে পড়েছে নিজের অজান্তেই। পাড়ের আমলকির গাছ থেকে মাঝে মাঝেই ঝাকে ঝাকে ঝরে পড়ছে বিন্দু বিন্দু পাতা। শান্ত জলে ভাসছে সরের মতো। ঘুমন্ত শান্ত জলে একঝাঁক হংসমিথুন খাদ্য অন্যেষণে ঝাঁপ দিতেই জল জেগে উঠলো যেন। তবু মৃদু ঢেউগুলো অদূরেই মিলিয়ে যায়।
রৌদ্রের রুদ্র রূপে আজ ঝাঁঝালো ধারের চমক। উত্তপ্ত উত্তাপে নিপীড়িত বৃক্ষের পাতা নূয়ে পড়ে যেন নতস্বীকার করছে। সমস্ত বস্তুজগতটাই যেন নীরব নিশ্চল জড় বস্তুতে পরিণত হয়েছে। স্বচ্ছ নীল আকাশে ভাসমান ছোটবড় মেঘবালিকা সূর্যের রূঢ় রূপের রশ্মিতে বিদ্ধ হয়ে বর্ণশুন্য সাদা বর্ণ ধারণ করেছে।
হঠাৎ করেই সকল নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে দুরন্ত কিশোর কিশোরীর ঝাঁক, ঝাঁপিয়ে পড়ল পুকুরে। চমকে হৈ-হৈ করে জেগে উঠল পুকুরের জল। কি অপূর্ব দৃশ্য, কি প্রাণের উচ্ছ্বাস। এই দৃশ্য গ্রাম বাংলায় চিরকালের। পূথিবীর অন্য কোথাও আছে কি-না কে জানে। এই মুগ্ধ দৃশ্যের ভেতর আরেক দৃশ্য চোখে পড়ে সহজেই। যে দৃশ্য নিয়ে ভাবনার কিছু নেই।
তবু ভাবতে হয়। লক্ষ্য করার বিষয় কিশোরীগুলো গায়ে পড়েছে, হাফ প্যান্ট আর একটি গেঞ্জি অথবা পাতলা কিছু একটা। আর কিশোরগুলো আদিমের আদিমই আছে। যেন শরীরে সত্যবাদী। এই এককড়া বয়সে এই পোশাক বৈষম্যের মানে কি? তবে কি নারীর নারীত্ব আর পৌরুষের সাহসের প্রথম প্রভাতেরই উদয়কাল প্রতিভাত হচ্ছে? হয়তো বা তাই।
ধীরে ধীরে প্রাণের খেলার জট খুলে যায় খেলায় খেলায়। কখনো পানিতে কখনো বা পাড়ে এসে একে অপরের হাত ধরে ঝাঁপিয়ে পড়ছে পানিতে। সায়েন্সের সীমানা অতিক্রম করে প্রাকৃতিক ভাবেই দক্ষ। যে যার জায়গায় পড়ে মুক্ত ডলফিনের মতো উন্মাতাল উচ্ছ্বাসে উচ্ছসিত তারা। সে কী প্রমোদের উল্লাস যেন জীবনের জাগ্রত জয়গান। পুকুরেও যেন প্রাণের ঝলকানী। দুরন্ত জল খেলায় জলের দৃশ্য ফুটন্ত বিন্নী ধানের খইয়ের দৃশ্য রূপ খেলিয়ে যাচ্ছে। কিশোর কিশোরীর ঐ ঝাঁক থেকে এক কিশোরী; চঞ্চল হরিণাক্ষী আর ডালিম দানার মতো দন্ত রাশির হাসিতে মাতিয়ে তুলছে আর বারবার বুকের ভিতরে টানছে সব চাইতে দুরন্ত যে সবল কিশোর তাকে। সারাক্ষণ ঝাঁক থেকে কৌশলে কাছাকাছি থাকে। কখনো লম্বা সাঁতার, ক্লান্ত হলে চিল সাঁতারে ব্যস্ত। ঘাড়টা বাড়িয়ে কিশোরের চিৎকার, “আহঃ নিচের পানি কত ঠাণ্ডা, চল ঠাণ্ডা পানি ছুঁয়ে আসি”। যেই বলা অমনি পানকৌড়ির জুটির মতো জলের অতলে পাতাল পুরীতে যেন প্রাণের অভিসার।
আর সব বালক বালিকা জল খেলতে খেলতে জলে ঝড় তুলছে। ওরা দু’জন জলের অতলে দমের শেষ শক্তি পর্যন্ত ডুবে থাকে। দম শেষ হলে কি সুখ শান্তির উচ্ছ্বাসে ভেসে ওঠে। এই খেলা চলছে পুনঃ পুনঃ। খেয়ালী খেলায় যেন অমৃতের সাধ। ওরা ভেসে উঠে দু’জন দু’দিক হয়ে। ছোট্ট দমে কতটুকু সময়। কি করছে তারা জলের তলে ? ভেসে উঠছে আবার হারিয়ে যাচ্ছে। ওদের চোখে মুখে কাজে ভাবে বিভাবে স্পষ্ট যে সেই গোপন গহন তলে জীবনের অনন্ত আনন্দের সুর তুলছে। যার ব্যাঞ্জনাময় রাগিনী প্রেমের রাগে রাঙানো। ঠাণ্ডা পানির ছলে বা কাঁদা ছুইতে গিয়ে কতটুকুই বা ছোঁয়া লাগে তাতো একেবারেই চন্দ্রকলা মাত্র। যতনা কাঠি ভাসা খেলা তার চেয়ে ঢেরগুন বেশী জড়াজড়ি ওদের। তাদের ঝোক কেবল সকলকে আড়াল করা।
তারা হৃদয়ের ভাষা এখনো বোঝে না শরীরের কথা পাঠ করতে শেখেনি। তবুও তাদের খেলায় ছন্দপতন নেই। এ খেলায় অক্ষরবৃত্ত, স্বরবৃত্ত আর মাত্রাবৃত্ত নেই। তবুও কোন অজানা মধুর ছন্দে ছন্দময় সে মর্ম মিলনের খেলায়।
জাগতিক লজ্জার জাল ছিড়ে তাদের ভাষাকথা, লীলাক্রিয়া যে প্রেমের সুরে তা ছড়িয়ে পড়ছে আকাশ জুড়ে। কি এমন তুলিকার স্পর্শে হৃদয় জাগ্রত হচ্ছে যা বাঁধনহারা। একে কি বলা যায়? শুধুই খেলার খেলা, প্রেম না যৌনতা? এখানে যেন অবুঝ দু’টি হৃদয়ে কোন ভাবনা ভাবের আগেই স্বর্গীয় লীলায় রূপ নিচ্ছে। যার ললাটে ভয় সংশয় আর অন্তরালে শুধুই মধূর রাগিনী