মনজুরুল ইসলাম
শাহরিক যান্ত্রিকতায় আবদ্ধ কৃত্রিম জীবনে প্রবাহিত স্রোতের দিকে ভাসতে ভাসতে বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন অনাবিল। প্রতিনিয়ত প্রত্যাশা করে আসছিলেন একটুখানি নিস্তব্ধতা ও সারল্যে আচ্ছাদিত জীবনপ্রবাহ। বাস্তবতার প্রকট চিত্রের সামনে এতদিন অসহায় হয়ে পড়লেও অবশেষে ছুটির ঘণ্টাটি বেজেছে। মুক্তি মিলেছে সেই শাহরিক যন্ত্রণার বিরক্তিকর বন্ধন থেকে। পুঞ্জ পুঞ্জ কষ্ট দিয়ে সঞ্চিত জীবনীশক্তির মাধ্যমে জীবিকা অর্জনের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যটি পূরণ হয়েছে। নিশ্চিত হয়েছে মফস্বল শহরে বসবাসের সাম্প্রতিক প্রবণতা। নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলায় পদায়ন পেয়েছেন। পদবী উপজেলা সমাজসেবা অফিসার। যোগদান করেছেন গত মাসের দুই তারিখ। দীর্ঘ দশ বছর ধরে বসবাস করে আসছেন ঢাকায়। গ্রামের বাড়ী সবুজ অরণ্যের লীলাভূমি দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলায়। বাবা শিক্ষিত ব্যবসায়ী এবং মা গৃহিনী। তিন বোনই বিবাহিত। ২০০১ এ প্রথম যেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দায় পা রেখেছিলেন অত্যন্ত অপরিপক্বতার মোড়কে আবৃত ছিলেন। তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক জ্ঞানের পাশাপাশি ঢাকা শহরের বাস্তব জীবন থেকে অর্জিত বোধের মাধ্যমে নিজেকে করে তুলেছেন অত্যন্ত পরিণত। বয়স ২৬-২৭ এর বেশি হবে না। দীর্ঘ নাক, লোমশ ভ্রু, অবিন্যস্ত লম্বা চুল, গায়ের তামাটে রং ও হালকা গড়নে কোনো পরিবর্তন ঘটে নি। অনেকটা আগের মতোই রয়ে গেছেন। টি-শার্ট ও ঢিলেঢালা জামা পরে স্বচ্ছন্দ বিচরণের স্বভাবটি ধরে রেখেছেন সমান গতিতে। একইভাবে ধরে রেখেছেন জ্ঞান চর্চার অভ্যেসটি।
উত্তরের সীমান্তবর্তী উপজেলা হিসেবে পরিচিত ডিমলার পরিবেশ অত্যন্ত প্রশান্ত। নেই যানবাহনের সমারোহ কিংবা জনকোলাহল। উপজেলা পরিষদে অবস্থিত প্রতিটি পৃথক অফিসের সামনে বৃক্ষরাজির সমারোহ সমৃদ্ধ করেছে উপজেলার সৌন্দর্য। নির্বাহী অফিসারের কক্ষের সামনেই বিস্তীর্ণ পুকুর পাড় জুড়ে প্রকা- শিমুল বৃক্ষ মূল রাস্তা থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। পুকুর পাড়ে ইট সিমেন্ট দ্বারা নির্মিত ক্ষুদ্র্র্র ক্ষুদ্র বসার স্থানগুলিতে দূর-দূরান্তর থেকে কাজের জন্যে ছুটে আসা লোকজন বিশ্রাম নেন। অনাবিলের অফিসটি বিস্তীর্ণ পুকুর থেকে সামান্য দূরত্বে অবস্থিত। একতলা বিশিষ্ট ভবনে তিনিই প্রধান কর্মকর্তা। পুরো অফিস জুড়ে রয়েছে মোট পাঁচটি কক্ষ। মূল কক্ষটির প্রবেশ পথেই নামফলকে বড় আকারে লেখা রয়েছে তার নাম ও পদবী। কাঁঠাল কাঠের চকচকে হলুদ রঙের লম্বা চেয়ারটিতে আসন গ্রহণ করেন তিনি। বৃহৎ টেবিলের সামনেই সারিবদ্ধভাবে সাজানো রয়েছে দশটি চেয়ার। নিয়মিতই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সদস্যবৃন্দ যাতায়াত করবার কারণে এ ধরনের আসন বিন্যাস। টেবিলের ডান দিকে টেলিফোন সেটের পাশেই একটি ফাইল বক্রা। তিনটি বৃহৎ আকারের আলমিরা ঠিক তার পেছনেই অবস্থিত। ব্যক্তিগত ল্যাপটপ কম্পিউটারটি নিজের কাছেই রাখেন সবসময়। টেবিলের উপরেই রাখা রয়েছে ল্যাপটপটি। অফিসের ঠিক সামনেই একটি বৃহৎ কৃষ্ণচূড়া বৃক্ষ অবিচল দাঁড়িয়ে আছে। বৃক্ষটির স্বাস্থ্যবান শাখা-প্রশাখাগুলির ছায়া অফিসের প্রায় প্রতিটি কক্ষের উপর দিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রখর তাপদাহেও খুব একটা কষ্ট পেতে হয় না সেই শাখা-প্রশাখাগুলির স্নিগ্ধতা জুড়ানো ছায়ায়।
প্রতিদিন ঠিক ন’টাতেই অফিসে বসেন অনাবিল। অবস্থান করেন অফিসের ঠিক পেছনের দ্বি-তল বিশিষ্ট অফিসার্স কোয়াটার-এ। পুরোনো একটি চৌকিতে কোনোরকমে রাত কাটাচ্ছেন। এখনও গুছিয়ে উঠতে পারেন নি বলে সমস্যা হচ্ছে। তবে যে সমস্যাটি তাকে সর্বোচ্চ মাত্রায় অস্থিরতার দিকে ধাবিত করছে সেটি হলো-চিন্তা বিনিময়ের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সুযোগের অপ্রতুলতা। ‘মফস্বলে এসে ভুল করলাম না তো!’- এমন একটি প্রশ্ন তাকে নিয়ত দোদুল্যমানতার বৃত্তে বেষ্টিত করছে। ঢাকায় অবস্থানকালীন প্রায় সময়ই সমমনা বন্ধু অথবা বয়োজ্যেষ্ঠ লেখকবৃন্দের সাথে ভাব বিনিময় করবার সুযোগ পেতেন। কিন্তু এখানে আসবার পর থেকেই সেই সুযোগটি কোনোভাবেই সৃষ্টি করতে পারছেন না। হঠাৎ একদিন অফিস থেকে বেরুবেন এমন সময় স্থানীয় একজন কবি এসে তাকে একটি পত্রিকা উপহার দিলেন। পত্রিকাটি সাহিত্যের। কবির নাম অপূর্ব আলো। ধবধবে ফর্সা গোলাকার মুখ। চাঁপা দাড়ি। ভাজ করা চুল। পরনে জিন্সের প্যান্টের উপর পাঞ্জাবীর সাথে ঘাড়ে ঝুলানো ব্যাগটি একজন কবির প্রতিমূর্তিকেই প্রতিফলিত করে। সীমাবদ্ধতার মাঝে পত্রিকা প্রকাশ করলেও এক্ষেত্রে তিনি অনুভব করেন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা। তার অনুভূত এই পৃষ্ঠপোষকতার নেপথ্যে গৃহীত প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ হলে জ্ঞান নামীয় চারণক্ষেত্রটিতে আসবে অভাবনীয় পরিবর্তন-বিশ্বাসের এই বোধটি দৃঢ়ভাবে প্রতীয়মান হলো কবি অপূর্বের মস্তিষ্কে প্রবাহিত চিন্তার ¯্রােতধারায়। সেই কবির মাধ্যমেই এলাকার সাহিত্য চর্চার পরিবেশটি সম্পর্কে একটি ধারণা লাভ করলেন অনাবিল। অন্তত এখানেও যে সাহিত্য সম্পর্কে ভাববার মানুষ রয়েছেন সেটি জানবার পর আশ্বস্ত হলেন। অবচেতনাতেই একটি ভালো লাগার সঞ্জীবনী শক্তি দ্বারা ¯œাত হলেন। কবির দেয়া সেই পত্রিকাটিতে সব লেখাই স্থানীয় লেখকবৃন্দের। পুরো পত্রিকাটি মনোযোগ দিয়ে পড়বার পর সাহিত্যের ওপর রচিত একটি প্রবন্ধ তাকে বিশেষভাবে বিমোহিত করলো। মফস্বল এলাকায় প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকায় যে এত উঁচু মানের প্রবন্ধ ছাপানো হতে পারে, সেটি ছিলো তার কল্পনারও বাইরে। প্রবন্ধটির শব্দ বৈভব ও ভাব সৌন্দর্য তাড়িত করলো তাকে সেই লেখকের সাহচর্য লাভের। লেখকের সাথে দ্রুত সাক্ষাতের প্রতিশ্রুতি প্রদান করলেন অপূর্ব। চেষ্টা করলেন লেখকের যাপিত জীবনের পাশাপাশি তার অন্তরিত দর্শন সম্পর্কেও নিঁখুত একটি ধারণা প্রদানের। অনায়াসেই একটি চিত্রকল্প আঁকলেন অনাবিল সেই কাক্সিক্ষত সাক্ষাৎ পর্বের। অপেক্ষা করতে থাকলেন সেই প্রত্যাশিত মুহূর্তটিকে জয় করবার। কবির সহায়তায় অবশেষে লেখকের সাথে দেখাও হলো। চলতে থাকলো সাহিত্য সম্পর্কিত অমূল্য আলোচনা।
লেখকের নিয়মিত সাহচর্যে অস্থিরতার মাত্রা অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে এখন অনাবিলের। ‘আনোয়ার সাহেবের মতো লেখকের সান্নিধ্য পাওয়া যেমন আমাদের পরম সৌভাগ্যের তেমনি দুর্ভাগ্যের এ কারণে যে, তার জন্য কিছু করতে না পারা। তার সাথে নিয়মিত কথোপকথন অব্যাহত রাখতে না পারাও আমাদের স্পষ্ট দুর্বলতা।’ কবি ও সম্পাদক অপূর্ব আলোর এই মন্তব্যটির যথার্থতা উপলব্ধি করতে পারলেন অনাবিল তার সান্নিধ্য লাভের পর থেকে। স্বাভাবিকভাবেই উপজেলা পর্যায়ে অবস্থানের সিদ্ধান্তটিকেও শ্রেয় মনে করতে পারছেন এখন।
লেখকের নাম সরদার আনোয়ার হোসেন। বয়স সত্তরের কাছাকাছি। দীর্ঘাকৃতির একজন মানুষ-এখন বয়সের ভারে কিছুটা ন্যুব্জ। সড়ক দুর্ঘটনায় ডান পাটি আঘাত প্রাপ্ত হওয়ায় হাঁটেন বা পায়ের ওপর ভর দিয়ে। সঙ্গে কেউ থাকলে সবসময়ই বাম হাতটি তার কাঁধে রেখে বাম পায়ের ওপর অতিরিক্ত চাপ কমাবার চেষ্টা করেন। দুটি গাল ভরপুর মাঝারি আকারের সাদাকালো দাড়ি দিয়ে। কপালের ভাজগুলি স্পষ্ট হয়ে এসেছে। মোটা ফ্রেমের বাই-ফোকাল লেন্সের চশমা পড়েন সবসময়ই। দীর্ঘ চুল এলোমেলো। বোধকরি এলোমেলো চুলকেই বেশি পছন্দ করেন তিনি। কারণ যখনই দেখা হয়েছে তখনই লক্ষ করেছেন অনাবিল, তার চুলগুলি বিন্যস্ত নয়। আর অবিন্যস্ত দেখতে দেখতে অবিন্যস্ত চুলগুলিকেই সৌন্দর্যের আবহ দিয়ে নিজের আন্তরিক পরিম-লে গেঁথে নিয়েছেন। স্থুল গোঁফের দু’প্রান্তই দাড়ির সঙ্গে একাকার। ভ্রুতেও দু’একটি সাদা চুল লক্ষিত। প্রায় সবসময়ই লুঙ্গি ও শার্ট পরিধান করে থাকেন। শারীরিক অবস্থা খুব যে ভালো তা বলা যাবে না, আবার একেবারেই যে খারাপ তাও নয়। কিছুদিন আগে হার্টের সমস্যা দেখা দিয়েছিল, কিন্তু এখন নেই, কেটে গেছে।
ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত পড়াশুনার সুযোগ পেয়েছিলেন। ইচ্ছে ছিল উচ্চশিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে আইনজীবী হিসেবে নিজের ক্যারিয়ার গড়বার। কিন্তু উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ ও আর্থিক সচ্ছলতা কোনোটিই ছিল না বলে তা পূরণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে নি। শিক্ষার সেই দীনতা কাটিয়ে উঠবার জন্যে প্রকৃতিসহ বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন সবসময়। এক পর্যায়ে এসে লিখতেও শুরু করেছিলেন। প্রাথমিক পর্যায়ে কবিতা দিয়ে শুরু করলেও পরবর্তীতে প্রবন্ধ ও কথাসাহিত্যের পাশাপাশি নাটকের ওপর লিখবার ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। মূলত এই লেখালেখির অভ্যেসটি তার অধ্যয়নের গতি ও প্রকৃতিতে যুক্ত করেছিল প্রাণিত মাত্রা।
সংসার জীবনে মোটেই সচ্ছল ছিলেন না। ব্যবসা করতেন গ্রন্থ বিক্রয়ের। ডিমলা সদরেই ছিল তার বইয়ের দোকানটি। গ্রন্থ বিতান। অন্যান্য বইয়ের দোকানের সাথে গ্রন্থ বিতানের পার্থক্য ছিল চোখে পড়বার মতো। যদিও উপজেলা পযার্য়ের বইয়ের দোকানগুলিতে সৃজনশীল গ্রন্থ খুব একটা পাওয়া যায় না তবুও তার দোকানে স্কুল, কলেজের তালিকাভুক্ত মূল বইয়ের পাশাপাশি ছিল বিভিন্ন ধরনের সৃজনশীল গ্রন্থ। বাংলার পাশাপাশি বিশ্বসাহিত্যের বিভিন্ন গ্রন্থের অনুবাদ সংগ্রহ করতে তিনি বেশি উৎসাহিত হতেন। সেটি তার গ্রন্থ কেন্দ্রে গেলেই বোঝা যেত। কোনো শিক্ষার্থী এ ধরনের গ্রন্থ পাঠে আগ্রহী হলে তাকে পড়তে দিতেন। একই সাথে এ ধরনের আগ্রহী পাঠকদের নিয়ে সৃষ্টি করতেন একটি দল। পরামর্শ প্রদানের মাধ্যমে তাদের মধ্যে বই পাঠের আগ্রহটি জাগিয়ে তুলতেন। এভাবেই ধীরে ধীরে অনেক শিক্ষার্থীর সাথেই তার হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সকাল থেকে রাত অবধি দোকানেই অবস্থান করতেন তিনি। স্কুল, কলেজে ভর্তির সময় ব্যতীত প্রায় সারা বছরই বিক্রি হতো অতীব মন্থর গতিতে। সৃজনশীল গ্রন্থের বিক্রি একেবারেই শূন্যের স্তরে অবস্থান করলেও পুরোনো লাইব্রেরি থেকে গ্রন্থ ক্রয় করে নিজে পড়বার জন্যে নিয়ে আসতেন রংপুর কিংবা ঢাকা থেকে। দিনের প্রায় পুরো সময় জুড়ে ব্যাপৃত থাকতেন সৃজনশীল গ্রন্থ পাঠে। স্ত্রীর চাকরি ও বই বিক্রির সামান্য উপার্জন থেকে তিন সন্তানের পড়াশুনার ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব হলেও সংসার চালাতে প্রতিনিয়ত হিমশিম খেতে হতো। বর্তমানে প্রত্যেক সন্তানই প্রতিষ্ঠিত। সঙ্গত কারণেই বইয়ের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়ে লেখালেখিতে বিভোর রয়েছেন। সন্তানদেরকে অবহিত করেই গ্রন্থ বিতান নামে একটি গ্রন্থাগার চালু করেছেন নিজ বাড়ীতেই। বাবার ইচ্ছেকে শ্রদ্ধা জানিয়ে সন্তানরাও সেই গ্রন্থাগারে পর্যাপ্ত বইয়ের সংস্থান করেছেন। স্বল্প বেতনে নিয়োগ দিয়েছেন একজন গ্রন্থাগারিক। পাশাপাশি বাবার লেখালেখির গতিটিকে সচল রাখবার জন্য সব ধরনের সহায়তা অক্ষুণœ রেখেছেন।
একজন মানুষ যখন সত্যিকার অর্থেই জ্ঞানের প্রকৃত নির্যাস উপলব্ধি করবার সক্ষমতা সৃষ্টি করতে পারেন তখন তিনি ক্ষুদ্র সীমায়তির ভেতর অবস্থান করেও দৃষ্টিভঙ্গিকে দিগন্ত জুড়ে বিস্তৃত রাখতে সক্ষম হন। গ্রন্থের ভেতর দিয়ে পরিব্রাজন করতে থাকেন ভূখ-ের পর ভূখ-। চূড়ান্ত অর্থে এরই অভ্যন্তরে অনুভব করেন অবিনাশী ও অকৃত্রিম সুখবোধ। এই সুখ প্রাপ্তির অনুভূতিটি ইচ্ছে করলেও কাউকে বোঝানোও সম্ভব নয় যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি নিজে গভীর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে সেই উপলব্ধিকে অনুভব করতে সক্ষম হবেন। বর্তমানে যে কক্ষটিতে আনোয়ার হোসেন অবস্থান করছেন সে কক্ষটির পরিবেশ যে সে ধরনের অনুভূতির প্রসব ঘটানোর জন্যে অতি উত্তম দৃষ্টান্ত তা খুব সহজেই দৃষ্টির দুয়ারে কড়া নাড়ে। আজীবন পঠিত সব ধরনের সৃজনশীল গ্রন্থ দ্বারা সাজিয়ে রেখেছেন তার কক্ষটিকে। কক্ষের তিনদিকের দেয়াল জুড়ে রয়েছে মোট ছয়টি বুক সেলফ। প্রতিটি বুক সেলফে রক্ষিত বইগুলি ক্যাটাগরি অনুযায়ী সাজানো। কক্ষের একদম মাঝখানে রয়েছে একটি বৃহদাকার টেবিল ও রিভলভিং চেয়ার। টেবিলে রয়েছে একটি ডেস্কটপ, একটি ল্যাপটপসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণাদি। টেবিলের পাশেই অপর দেয়াল পর্যন্ত বিস্তৃত কারুকার্যময় একটি পুরোনো চকলেট রংয়ের খাট। এই কক্ষটিতেই সর্বোচ্চ মাত্রায় প্রশান্তির অনুভব নিয়ে দিনের প্রায় পুরোটা সময়ই অবস্থান করেন আনোয়ার সাহেব। মাঝে মাঝে গ্রন্থ বিতানে বসেন। উদার আলোচনার মাধ্যমে দীর্ঘ সময় ধরে অর্জিত জ্ঞানের পাঁপড়িগুলি ছড়িয়ে দেন তরুণ লেখকসহ পাঠকদের মাঝে। তারাও সেই মহার্ঘ্য ক্ষণটির জন্য অপেক্ষায় থাকেন। গ্রহণ করেন জ্ঞানের তরতাজা ফুলেল সুবাস।
বাসাটির অবস্থান ডিমলা শহরের সবুজ পাড়াতেই। অনাবিলের কোয়াটার থেকে তিন কি.মি. দূরে। সন্ধ্যা হবার পূর্ব মুহূর্ত থেকেই এক ধরনের উল্লসিত ভাব বিরাজ করতে থাকে অনাবিলের মনোমুকুরে। আনোয়ার সাহেবের সঙ্গে পরিচয় হবার পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই তার বাসায় যাতায়াত করেন। অবস্থান করেন সন্ধ্যা থেকে রাত ন’টা অবধি। কখনো কখনো সেই সময়টিও উত্তীর্ণ হয়ে যায়। জ্ঞানের প্রায় প্রতিটি শাখা-প্রশাখা নিয়ে আলোচনা করবার এমন দুর্লভ মুহূর্ত যে ডিমলার মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলে এসে সৃষ্টি হয়ে যাবেÑএটি ভাবতেই পারেন নি তিনি। যতই আনোয়ার সাহেবের কাছাকাছি এসেছেন ততই তার জ্ঞানের পরিধি অনুধাবন করে বিস্মিত হয়েছেন। ভেবেই পাচ্ছেন না একজন মানুষ কোনো ধরনের স্বীকৃতি, মূল্যায়ন এমনকি প্রকাশনা ব্যতীত কীভাবে এত দুর্দান্ত গতিতে জ্ঞানচর্চা ও লেখালেখির অভ্যেসটি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন! অনাবিল নিজেও লেখালেখির চর্চা করেন এবং এ কারণেই অতীতে সবসময়ই এক ধরনের আত্মতৃপ্তিতে সিক্ত হবার চেষ্টা করতেন। বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন বিভিন্ন সাহিত্যপত্রিকায় প্রকাশিত লেখাগুলি নিয়ে। কিন্তু আনোয়ার সাহেবের অপ্রকাশিত অজস্র লেখা এবং সেই লেখার গভীরতা পর্যবেক্ষণ করবার পর এখন তার মানসপটে সেই আত্মতৃপ্তির বিষয়টি কোনোভাবেই ক্রিয়া করে না। এমনকি তিনি যে লেখালেখির সঙ্গে সম্পৃক্ত সেটি পর্যন্ত কারো সামনে মুখ ফুটে বলবার সাহসই পান না।
প্রথম দিকে অনাবিল আনোয়ার সাহেবকে স্যার হিসেবে সম্বোধন করলেও অন্তরঙ্গের গভীরতায় বর্তমানে সেটি আঙ্কেল-এ এসে উপনীত হয়েছে। পাশাপাশি আনোয়ার সাহেবের জন্যে কিছু করবার অভিপ্রায় নিয়ে নিজের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন চেতন দায়বদ্ধতা। চেষ্টাও করছেন আনোয়ার সাহেবের সমগ্র সৃষ্টিকর্মগুলিকে একটি ফ্রেমে নিয়ে এসে প্রকাশের ব্যবস্থা করবার। অনাবিলের এমন মেধা ও দায়বোধ প্রত্যক্ষ করবার পর তার প্রতি দুর্বল হবার পাশাপাশি বিশ্বাস রাখতে শুরু করেছেন আনোয়ার সাহেব। যদিও প্রথম দিকে অনাবিলের ওপর খুব বেশি আগ্রহ বোধ করতে পারেন নি তিনি। তার এ জীবনে অনাবিলের মতো অসংখ্য ব্যক্তি এসেছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পেরিয়ে যাবার পর সম্পর্ক ঠিক থাকলেও জ্ঞানভিত্তিক আলোচনাগুলি আর স্থায়ী হতে পারে নি। আজ এতটা বেলা পেরিয়েও এজন্য তার মনে নেই এতটুকু অনুশোচনা। একটা সময় ছিলো যখন বিষয়গুলি তাকে কষ্ট দিতো। কিন্তু এখন তিনি এমন এক ধরনের স্থিতিশীলতায় পৌঁছে গেছেন যে, এমন কিছু ভাববার সুযোগই পান না।
প্রতিদিনের মতো আজও হেঁটে হেঁটেই আনোয়ার সাহেবের বাসার দিকে যাত্রা করেছেন অনাবিল। টি-শার্ট, সুতি গ্যাবার্ডিন প্যান্ট ও ফিতেওয়ালা ছ্যান্ডেল পায়ে দিয়েই বের হন তিনি। স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন বলেই এই গেট আপেই তার দীর্ঘ দিনের অভ্যস্ততা। ডিমলার প্রাকৃতিক প্রাচুর্যময় আবহ হাঁটবার সময় ফুরফুরে ভাব যোগ করে। এতটা দীর্ঘ পথ হাঁটলেও কোনো ধরনের ক্লান্তি কাজ করে না শরীরজুড়ে। প্রশান্তি নিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই আনোয়ার সাহেবের বাসার সামনে চলে এলেন অনাবিল। মূল সড়ক থেকে সামান্য দূরত্বে অবস্থিত বাসাটি। রাস্তা থেকেই লোহার ফ্রেম দিয়ে ডিজাইন করা ধূসর হলুদ রংয়ের গ্রিল দ্বারা বেষ্টিত বারান্দাটি দৃষ্টিগোচর হয়। গ্রিলের সামনে কিছু খোলা জায়গা থাকলেও নেই কোনো প্রাচীর। বারান্দায় শৃঙ্খলভাবে সাজানো রয়েছে তিনটি বেতের চেয়ার। বিদ্যুৎ চলে গেলে সেই চেয়ারেই পাশাপাশি বসে গল্প করেন দুজনই। বারান্দার সামনেই আনোয়ার সাহেব লাগিয়েছেন একটি শেফালী ফুলের গাছ। বৃক্ষটির সবুজ পত্রগুলিতে ময়লা জমতে দেন না একটি দিনও। দীর্ঘ সময় অবধি পরিচর্যা করে আসছেন কাক্সিক্ষত ফুলটির সন্ধান পেতে। প্রথমদিকে অনাবিল বাসার ভেতরে প্রবেশ করবার জন্য নক করলেও এখন আর করেন না। নিয়মিত যাতায়াতের কারণে নিজেই গেট খুলে ভেতরে প্রবেশ করেন। সবার সাথে সখ্যতা এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যেন তাদের পরিবারের একজন সদস্য হয়ে গেছেন তিনি। বারান্দায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে শেফালী ফুলের বৃক্ষটি প্রত্যক্ষ করবার পর ড্রইং রুম পেরিয়ে সরাসরি আঙ্কেল-এর রুমের ভেতর প্রবেশ করলেন।
রিভলভিং চেয়ারে বসে কম্পিউটারে লিখছিলেন আনোয়ার সাহেব। অনাবিলকে দেখবার পর পরই ডেকে বসতে বললেন। তার মুখে হাসির রেশটি দীর্ঘ সময় অবধি অটুট রইলো। শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর নিজে থেকেই অনাবিলকে আজকের আলোচনার বিষয় সম্পর্কে অবহিত করলেন। আজকের এই মুহূর্তটি দুজনের জন্যেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনাবিলের যেহেতু লেখালেখির ওপর তীব্র আগ্রহ রয়েছে সেহেতু অবশ্যই তিনি উপকৃত হবেন কীভাবে লেখালেখি করতে হয় সে বিষয়ে জানতে পারলে। একই সাথে আনোয়ার সাহেবের প্রবল ইচ্ছে-তার হাত ধরে যদি কোনো তরুন লেখক উৎকৃষ্ট সাহিত্যকর্ম রচনায় ব্রতী হন তবে নিজেকে সার্থক ভাবতে পারবেন তিনি। তাছাড়া তার কাছ থেকে প্রদত্ত জ্ঞান ধারণ করবার মতো যোগ্যতা অনাবিলের রয়েছে বলে তিনি বুঝতে পেরেছেন বিধায় প্রত্যাশার পালকটি স্ফীত হয়েছে। বিছানার পূর্ব প্রান্তে আলোচনা শুনবার প্রত্যাশায় উন্মুখ হয়ে বসে আছেন অনাবিল। রিভলভিং চেয়ারটি খানিকটা ঘুরিয়ে নিয়ে অনাবিলের মুখোমুখি হয়ে আনোয়ার সাহেব বলতে শুরু করলেন,‘সাহিত্য হচ্ছে পৃথিবীর মধ্যে সবচাইতে শুদ্ধতম কাজ, মিথ্যের কোনো আশ্রয় নেই এখানে। যদি তুমি প্রকৃতই সাহিত্য করতে চাও তবে এ বিষয়টিকে প্রথমেই মনে প্রাণে ধারণ করতে হবে এবং মনে রাখতে হবে, লেখনীর মাধ্যমে পৃথিবীর সমস্ত আবিলতা দুর করাই লেখকদের একমাত্র ব্রত।’
‘কিন্তু ঠিক কোন ধরনের সাহিত্য আবিলতা দুর করে স্থিতিশীল পৃথিবী সৃষ্টি করবার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।’ ডান হাতের কনুইটি ডান উরুতে ভর করে ডান হাতটি ডান গালে রেখে জিজ্ঞেস করলেন অনাবিল।
‘অবশ্যই উৎকৃষ্ট সাহিত্য। প্রশ্ন করতে পারো উৎকৃষ্ট সাহিত্য কীভাবে সৃজন করা সম্ভব? প্রথম শর্তেই ডেভোশন থাকতে হবে। আর ডেভোশন তখনই সৃষ্টি হবে যখন সেই কাজের ওপর প্রকৃত অনুরাগ থাকবে। কবিতার একটি পঙক্তি অথবা প্রবন্ধের একটি অনুচ্ছেদ লিখবার পর যদি কোনো লেখক তার মেঘস্পর্শী মননে আনন্দানুভূতি সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হন তবে বুঝতে হবে সেই সৃষ্টিটির ওপর উচ্চ মাত্রার কোনো আসক্তি কিংবা প্রচেষ্টাই ছিলো না। ধরো, তুমি যদি কবিতার ওপর কাজ করতে চাও এবং নির্দিষ্ট কিছু কবিতা পাঠের মাধ্যমেই কবিতা লিখতে উদ্যত হও সেক্ষেত্রে কোনোভাবেই তোমার কবিতাটি উৎকৃষ্ট কবিতার পদবাচ্য হয়ে উঠবে না। কারণ কবিতা লিখবার মাধ্যমে তুমি জাতির ওপর যে দর্শনটিকে প্রক্ষিপ্ত করতে চাও সেই দর্শনটিকে তোমার বোধের মাধ্যমে উপস্থাপন করবার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ধরন তোমার আয়ত্ত্বে আনবার লক্ষ্যে অবশ্যই তোমাকে বহুমাত্রিক বিষয়ের ওপর লিখিত প্রবন্ধ, গল্প, নাটক এবং কবিতা পাঠ করে যেতে হবে। কারণ প্রতিটি উৎকৃষ্ট লেখাই, সেটি প্রবন্ধ, গল্প কিংবা নাটক-যাই হোক না কেন, তার মধ্যে অবশ্যই দর্শন অন্তরিত রয়ে যায়। এখন উক্ত বিষয়ে অনবরত অধ্যয়ন করবার মাধ্যমে যদি সেখান থেকে প্রকৃত দর্শনটিকে চিহ্নিত করে তুমি তোমার ভাবনাটিকে ঋদ্ধ করতে পারো, সেক্ষেত্রে তুমি তখন যে কবিতাটি লিখবে অবশ্যই সেই কবিতাটি উৎকৃষ্ট কবিতা হিসেবে সবার কাছে বিবেচিত হবে। এটি করতে না পারলে তোমার লেখার মধ্যে কোনো ধরনের গ্রহণযোগ্যতাই সৃষ্টি হবে না। আর নান্দনিক শব্দ শৈলীর মাধ্যমে লেখাটিকে ঋদ্ধ করবার ক্ষেত্রে অবশ্যই তোমাকে শব্দ ভা-ার সমৃদ্ধ করতে হবে।’ অনর্গল কথা বলবার পর কিছুক্ষণ পূর্বে টেবিলের ওপর রেখে যাওয়া চায়ের একটি কাপ অনাবিলকে দিলেন। নিজেও শুরু করলেন চায়ের কাপে চুমুক দেয়া।
‘তাহলে কি আঙ্কেল, গদ্য রচনা করবার ক্ষেত্রেও একজন লেখককে কবিতার ওপর যথেষ্ট পড়াশুনো করতে হবে?’ চায়ের কাপে প্রথম চুমুকটি দেবার পর প্রশ্ন রাখলেন অনাবিল।
‘শুধু কবিতা কেন, সব বিষয়েই পড়তে হবে। মনে রাখবে, সাহিত্যের যত শাখা-প্রশাখা রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে কঠিনতম শাখা হচ্ছে প্রবন্ধ। মৌলিক চিন্তা ও গবেষণার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। গবেষণালব্ধ আবিষ্কার এবং মৌলিক চিন্তা- দুটি বিষয়ই ভিন্নভাবে মানুষের উপযোগিতা নিশ্চিত করে। এখন তুমি যদি মৌলিক প্রবন্ধ লিখতে আগ্রহী হও সেক্ষেত্রে বুঝতে চেষ্টা করো, তোমার অধ্যয়নের গভীরতা কত দূর অবধি বিস্তৃত রাখতে হবে। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোন বিষয়ের ওপর তুমি প্রবন্ধ লিখতে চাও, প্রথমত সেটি অবশ্যই নির্ধারণ করতে হবে। আর কবিতা পাঠের কথা বলছো,প্রবন্ধ মানেই প্রকৃষ্ট বন্ধন, একটি শব্দের সাথে আর একটি শব্দের মেলবন্ধন। মৌলিক প্রবন্ধ ছাড়াও যে ধরনের প্রবন্ধই লিখতে চাও না কেন, অবশ্যই সেই লেখার মধ্যে গতি নিয়ে আসতে হবে। সেক্ষেত্রে কবিতার ওপর দক্ষতা ব্যতীত কীভাবে প্রত্যাশা করতে পারো যে, প্রবন্ধটি গতিময় হবে। তাছাড়া প্রবন্ধে যদি গতি না থাকে সেক্ষেত্রে পাঠকের কাছে সহজে উপস্থাপন করা কখনোই সম্ভব হয়ে উঠবে না।’
‘সেক্ষেত্রে ভাষাশৈলী কিংবা উপস্থাপনের ক্ষেত্রে কোন ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত?’ আনোয়ার সাহেবের কথার মাঝখানেই আবারও জিজ্ঞেস করলেন অনাবিল।
চেয়ারটি ঘুরিয়ে নিয়ে অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে জবাব দিতে থাকলেন আনোয়ার সাহেব,‘ভালো প্রশ্ন করেছো অনাবিল। আসলে প্রবন্ধের ভাষা কিংবা নির্মাণ শৈলী পুরোপুরি নির্ভর করবে লেখকের পা-িত্য ও বাস্তবতাবোধের ওপর। তিনি যদি মনে করেন তার লেখা শুধু একটি নির্দিষ্ট উচ্চমার্গীয় শ্রেণির পাঠকের জন্যে হবে সেক্ষেত্রে তিনি তার ক্ষমতা অনুযায়ী ভাষাশৈলী কিংবা উপস্থাপনভঙ্গি অতি উচ্চমাত্রায় উন্নীত করতে পারেন। পক্ষান্তরে তার লেখা যদি সকল পাঠকের জন্যে হয় সেক্ষেত্রে ভাষাশৈলী, উপস্থাপনভঙ্গি তুলনামূলকভাবে সহজ হতে পারে। এক্ষেত্রে আমি মনে করি যে,প্রত্যেক লেখকেরই ভাষাশৈলী আদর্শ মানের হওয়া উচিত। জনপ্রিয় হবার লক্ষ্যে কেউ যদি পাঠকের কথা চিন্তা করে লেখার মধ্যে ব্যবহৃত শব্দ অর্থাৎ ভাষার শিল্পমান ক্ষুণœ করেন সেটি কখনোই বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক হবে না। প্রকৃত অর্থে এ ধরনের লেখা বেশিদিন স্থায়ীত্বও লাভ করতে পারবে না। আবার অতিমাত্রায় পা-িত্য প্রদর্শনের জন্যে যদি কোনো লেখক দুবোর্ধ্য শব্দ আরোপ করে নিজের পা-িত্য জাহির করবার চেষ্টা করেন তবে সেই রচনাটিও কৃত্রিম অথবা আরোপিত হয়ে যাবে। ইদানীং প্রায়ই কিছু কবিতা চোখে পড়ে-এত এত পরিমাণে দুবোর্ধ্য শব্দ যে সেগুলোর অর্থ উদ্ধার করতেই গলদঘর্ম হতে হয়। কবিতার মাধ্যমে কবি জাতিকে কি বার্তা প্রদান করতে চেয়েছেন সেটি আর মনে থাকে না। মূলত একটি লেখা যে ধরনের ভাষা ডিমান্ড করবে ঠিক সেভাবেই লিখতে হবে।’
‘কিন্তু সব পাঠক যদি উঁচু মানের না হয় সেক্ষেত্রে লেখকের কি সে দিকটির প্রতি দৃষ্টি রেখে লিখবার ক্ষেত্রে সরলীকরণ পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত নয়?’ দ্বিধা সত্ত্বেও সাহস নিয়ে জানতে চাইলেন অনাবিল।
‘অবশ্যই উচিত, তবে ওই যে বললাম শিল্পমান, লেখার শিল্পমান ঠিক রেখে যদি কোনো লেখক সরলভাবে উপস্থাপন করতে পারেন তবে অবশ্যই তিনি করবেন। কিন্তু শিল্পমান কোনোভাবেই ক্ষুণœ করা যাবে না। পাশাপাশি লেখার গঠনগত আদর্শটিকে অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে। এখন কোনো লেখক যদি নতুন কোনো স্টাইল কবিতা, প্রবন্ধ কিংবা অন্য কোনো শাখাতে প্রয়োগ করতে পারেন সেটি ভিন্ন বিষয়। কিন্তু পাঠক যদি বুঝতে ব্যর্থ হন সেটি তো লেখকের দায় নয়। আর ভবিষ্যতে যে পাঠকের গুণগত মানের ঊর্ধ্বায়ন অথবা অবনমন যাই হোক না কেন সেটি তো ভবিতব্য। অনিশ্চিত ভবিতব্যকে লক্ষ্য করে সাহিত্য রচনা যতটা না হবে বাস্তব তার চাইতে বেশি আনুমানিক। আজকে এ পর্যন্ত থাক, ক্লান্ত লাগছে। কালকে এসো, অন্য বিষয়ে কথা বলা যাবে। ’
তন্ময় হয়ে আনোয়ার সাহেবের কথাগুলি শুনবার সাথে সাথে কখন যে দশটা পেরিয়ে গেছে বুঝতেই পারেন নি অনাবিল। তিনি এতটাই ছন্দোবদ্ধভাবে বর্ণনা করে যাচ্ছিলেন, যেন ছবির মতোই পরিষ্কার হয়ে আসছিল বিষয়গুলি। উপায় না দেখে দ্রুত আনোয়ার সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জোরের সাথে হাঁটতে থাকলেন অনাবিল। হাঁটবার সময় লেখালেখির যে দর্শন লাভ করলেন তাই নিয়ে ভাবতে থাকলেন। সাহিত্যচর্চা যে সত্যিই একটি দুরূহ কাজ সেটিও মর্মে মর্মে অনুধাবন করলেন। যদিও নিজের ভেতরের সীমাবদ্ধতাগুলি উপলব্ধি করতে পারলেন তবুও কোনো নেতিবাচক প্রভাব দ্বারা প্রভাবিত হলেন না। বরং ভবিষ্যতের জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করবার লক্ষ্যে পড়াশুনার গতি বৃদ্ধির স্থির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। রাত দশটা পেরুনোর কারণে একটি রিকশা নিয়ে বুক-বাইন্ডিং এর দোকান থেকে বাইন্ডিংয়ের জন্য রাখা আঙ্কেল এর দুটি গ্রন্থের পা-ুলিপি নিয়ে সরাসরি কোয়াটারের সামনে চলে এলেন।
ইতোমধ্যে কক্ষটি মোটামুটি গুছিয়ে ফেলেছেন অনাবিল। জামাকাপড়গুলি একটি আলনায় সাজিয়ে রেখেছেন। বিছানার পাশেই ঢাকা থেকে নিয়ে আসা গ্রন্থগুলিও টেবিলের ওপর সাজিয়েছেন। রুমের সদর দরজার পাশেই রাখা খাবারটি খেয়ে নিয়ে ঘুমোবার জন্য প্রস্তুতি নিলেন। বালিশের পাশে রাখা আঙ্কেলের পা-ুলিপি দুটি হাতে নিলেন। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। দুটি গ্রন্থেরই দু’বার করে প্রুফ দেখা হয়ে গেছে। এখন প্রিন্টের জন্য ঢাকায় পাঠানো হবে। প্রকাশকের সঙ্গে কথা চূড়ান্ত করে ফেলেছেন। ঢাকায় অবস্থানকালীন প্রুফের কাজে সংশ্লিষ্ট থাকবার কারণে অনেক প্রকাশকের সাথে পরিচয় রয়েছে তার। তাই আনোয়ার আঙ্কেলের গ্রন্থ প্রকাশের দায়িত্ব নেবার ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র ভাবতে হয় নি। বরং এত উচ্চ মার্গীয় লেখার সাথে নিজের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি ভাবতেই নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছেন অনাবিল। তার সাথে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পাবার পর থেকেই অজস্র লেখা পাঠের পর সেগুলির মধ্যে থেকে আপাতত প্রকাশের জন্য কিছু লেখা নির্ধারণ করেছেন অনাবিল। আনোয়ার সাহেব তার এই নির্বাচনকে যে ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করেছেন সে বিষয়টিও প্রমোদিত করে অনাবিলকে। সঙ্গত কারণেই নিজের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা প্রয়োগ করে পা-ুলিপি দুটি নিঁখুত করবার চেষ্টা করেছেন।
প্রুফের কাজ শেষ হবার কারণে অফিসে এসেই পা-ুলিপির কপিদুটি পিয়নকে দিয়ে কুরিয়ারে প্রকাশকের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে নিজেও একটি সফট কপি ই-মেইল করলেন অনাবিল। কুরিয়ারের পর ই-মেইল করবার কারণে সন্তুষ্টি বোধ করছেন আজ। ল্যান্ড ফোন থেকে বিষয়টি আঙ্কেলকে জানালেন। অফিসে কাজের ব্যস্ততা থাকলেও মনে মনে কাক্সিক্ষত সন্ধ্যের কথা ভেবে সন্তুষ্টি বোধ করলেন। দুপুরের পর অচিনপুর ইউনিয়নে ত্রাণ কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে পেরিয়ে গেল। দুর্নীতির সাথে আপোষ করলে হয়ত এত দেরী হতো না। পরিশ্রান্ত শরীরে রুমে এসে দ্রুত কাপড় পরিবর্তন করে আনোয়ার আঙ্কেলের বাসার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। সঙ্গে ডাইরিটি নিতেও ভুললেন না।
প্রতিদিনের মতো আজও কম্পিউটারে বসে লিখছিলেন আনোয়ার সাহেব। অনাবিলকে দেখবার পর অকৃত্রিম উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন। পা-ুলিপি পাঠাবার জন্যে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সন্তুষ্ট চিত্তে বললেন,‘আমি তো লেখালেখি ছেড়েই দিয়েছিলাম, কখনো কল্পনাও করিনি গ্রন্থ প্রকাশিত হবে। আগে যে চেষ্টা করিনি তা নয়, কিন্তু আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে সেটি সম্ভব হয়ে উঠে নি। সন্তানরা এখন পাশে থাকলেও বয়সের কারণে সাহস পাইনি। তুমি যে এমনভাবে শেষ বেলায় এসে আলো জ্বালাবে সেটি কি কখনো ভাবতে পেরেছি অনাবিল?’
‘না, না। আমি না আসলেও অন্য কেউ এসে ঠিকই প্রকাশের ব্যবস্থা করতো।’ শান্ত দৃষ্টি সহকারে আনোয়ার সাহেবের দিকে তাকালেন অনাবিল।
‘প্রকৃত বিষয়টি কী জানো অনাবিল, তুমি না আসলে কোনোভাবেই গ্রন্থ দুটি প্রকাশ করা সম্ভব হতো না। এতগুলি হাতে লেখা পা-ুলিপি কি আমার পক্ষে কম্পোজ করা সম্ভব ছিল, তাছাড়া কেইবা প্রকাশকের সাথে যোগাযোগ করতো? এখন এত ভালো লাগছে যে তোমায় ভাষায় বোঝাতে পারবো না। কখন যে গ্রন্থ দুটি হাতে আসবে, এই ভেবে প্রতিটি মুহূর্ত অস্থিরতায় কাটছে। তবে তোমার কাছে আমার একটিই অনুরোধ, আমার এই সৃষ্টিগুলি যাতে বেঁচে থাকে সে চেষ্টা তুমি কোরো। আমার তো মনে হয় তুমি ছাড়া এই কাজের মর্ম কেউ বুঝতেও পারবে না। আমার বিশ্বাস আমার এই সৃষ্টিগুলি কাল কে উত্তীর্ণ করে যাবেই।’ আবেগতাড়িত কণ্ঠে অনাবিলের চোখের দিকে দৃষ্টি রেখে বললেন আনোয়ার সাহেব।
‘তা তো অবশ্যই, তাছাড়া আপনার সৃষ্টিকর্মের ঋদ্ধতার সূত্র ধরেই তো আপনার সাথে আমার পরিচয়। আমিও বিশ্বাস করি, আপনার সৃষ্টিকর্মগুলি অবশ্যই কালোত্তীর্ণ হবে। আপনার যে বর্ণনা, যে যুক্তি তা তো একদম ক্ল্যাসিক্যাল রাইটারদের সমমানের।’ কথাগুলি বলবার সময় অনাবিলের আত্মবিশ্বাসের ঝরনা থেকে প্রবাহিত হতে থাকলো অবারিত জলধারা।
‘তোমার কথাটিই যেন সত্যি হয়।’ অনেকটাই নির্ভার হয়ে বলবার পর গল্পের ওপর বর্ণনা প্রদানে উদ্যত হলেন আনোয়ার সাহেব।
‘গল্প লিখবার ক্ষেত্রে প্রথম শর্তেই বহুমূখী জীবনাচরণের সাথে পরিচয় থাকতে হবে। একজন লেখক যত পরিমাণে সাধারণ মানুষের বাস্তবজীবন প্রসূত আবেগ, অনুভূতি, দুঃখ, কষ্ট কিংবা অর্জিত আনন্দের নেপথ্যের ঘটনাগুলি জানতে পারবেন, একাধারে তার জীবন দর্শন যেমন তীক্ষè হবে তেমনি লিখবার ক্ষেত্রে অজস্র বিষয়বস্তু এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে যাবে। সেই বাস্তব বিষয়গুলি যখন তিনি গল্পে রূপ দিতে পারবেন তখন স্বাভাবিকভাবেই সেই গল্পগুলি পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে।
‘কিন্তু এই যে বাস্তব জীবনবোধ, সেটি অর্জন করা যাবে কীভাবে? পাশাপাশি গল্পের অন্তর্নিহিত বিষয়গুলি হৃদয়গ্রাহী ও বাস্তবসম্মতভাবে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে কী করতে হবে?’ চিন্তার একটি প্রত্যক্ষ ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠলো অনাবিলের চওড়া কপালে।
ঘূর্ণায়মান পাখার দিকে কিছু সময় অবধি তাকিয়ে রইলেন আনোয়ার সাহেব। চিন্তা করতে থাকলেন। হাতের মধ্যে একটি কলম রয়েছে। কলমটি টেবিলের ওপর রেখে আবারো অনাবিলের মুখের দিকে তাকালেন। স্বল্প কথায় বর্ণনা করা সম্ভব হবে না-বোঝা গেল তার চাহনিতে। শতভাগ মনোযোগ নিয়ে প্রস্তুত অনাবিল।
‘পড়তে হবে, শুধুই পড়তে হবে। মনে রাখবে, একজন লেখক কিন্তু একদিনেই লেখক হয়ে ওঠেন না। প্রথমত তিনি পাঠ করেন। অনবরত পাঠের মাধ্যমে তার মধ্যে সৃষ্টি হয় প্রকৃতি-প্রেম, মানব-প্রেম, দেশ প্রেম এবং অন্তিমে বিশ্বপ্রেম। তিনি ভ্রমণ করেন সমাজের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে, ভ্রমণের মাধ্যমে আস্বাদন করেন বহুমুখী যাপিত জীবনের স্বাদ। ক্লেশহীনভাবে অন্বেষিত থাকেন পাহাড়ী, চরাঞ্চল, সামুদ্রিক কিম্বা শহুরে জীবনের প্রকৃত চিত্রগুলিকে নিজের বিবেকের অন্তরালে নিপূনভাবে এঁকে নেবার। হয়ত এরই মধ্য দিয়ে তিনিও তার অবচেতনাতেই জীবনগুলির দুঃখ-কষ্টের রস ও বোধের দ্বারা জারিত হন। এভাবেই জীবনে ঘটে যাওয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়গুলিকে পুঙ্খানুপঙ্খভাবে বিশ্লেষণের মাধ্যমে চলমান সমাজের সমস্যাগুলোকে সঠিকভাবে শনাক্ত করতে পারেন। শনাক্তকৃত সমস্যাগুলো সমাধানের অভিপ্রায়ে এক সময় তিনি লিখতে বাধ্য হন অথবা মস্তিষ্কে স্থিত ভাবনাগুলিকে প্রকাশ না করা পর্যন্ত স্থির থাকতে পারেন না। একজন লেখক তিনি যত বেশি বেশি পড়বেন, সমাজকে যত পরিমাণে পাঠ করতে পারবেন, দৃষ্টিভঙ্গিকে যতটা বৈশ্বিক করতে পারবেন তার লেখার বিষয়বস্তু ততই উন্নত হবে, সেই বিষয়বস্তুর ওপর লিখিত গল্পের উপযোগিতা ততই বিস্তৃত হবে। সময় আসবে, সেই ধরনের লেখকের গল্প শুধু তার নিজ দেশের মধ্যেই বৃত্তাবদ্ধ থাকবে না, ছড়িয়ে পড়বে পুরো বিশ্বজুড়ে। পক্ষান্তরে পাঠ করতে করতে লেখক নিজেই উপলব্ধি করতে পারবেন, কীভাবে গল্প লিখতে হবে।’
‘তবুও লিখবার ক্ষেত্রে কোন কোন বিষয়গুলির প্রতি লক্ষ রাখতে হবে? যদি একটু ব্যাখ্যা করতেন’ অনুনয়ের সুরে শুধালেন অনাবিল।
অনেক ফুরফুরে দেখাচ্ছে আজ আনোয়ার সাহেবকে। ঢাকা থেকে পাঠানো মেজ মেয়ের উপহার দেয়া একটি ধূসর বাদামী রংয়ের কটি পড়েছেন। হালকা বেগুনী রংয়ের শার্টটি কটির সঙ্গে বেশ মানিয়েছে। ধবধবে সাদা-কালো রঙের লুঙ্গিটি দেখে বোঝাই যাচ্ছে প্রায় নতুন। মুখম-লজুড়ে বিরাজ করছে সজীবতার ভাব। অনাবিলের প্রশ্নের উত্তর প্রদান না করে হঠাৎ চেয়ার থেকে উঠে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবার কথা বলে পাশের কক্ষে গেলেন। এই মুহূর্তে উত্তেজনা অনুভব করছেন অনাবিল। তার উত্থিত প্রশ্নের উত্তর শুনবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে এসে আবারো চেয়ারে বসলেন আনোয়ার সাহেব। দু’হাত দিয়ে দাড়ির দু’প্রান্ত আলতো করে বুলিয়ে নিলেন। আঙ্কেলের কথা শুনবার প্রতীক্ষায় নিশ্চুপ রইলেন অনাবিল। মাথাটি চেয়ারের শীর্ষ প্রান্তে ঠেকিয়ে দিয়ে আনোয়ার সাহেব আবারো মেলে ধরলেন তার মোহনীয় চিন্তার জাল-
‘শোনো, প্রথমত, গল্পের বর্ণনা হতে হবে পোক্ত বাঁধনের, তুমি গল্পের মাধ্যমে পাঠকের কাছে কী উপস্থাপন করতে চাও পূর্বাহ্ণেই তোমার অন্তরে সেটি এঁকে নিতে হবে। অবশ্যম্ভাবীরূপে বর্ণনার মাঝে ধারাবাহিকতা থাকতে হবে যাতে পাঠক শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠ করবার আগ্রহ খুঁজে পায়। দ্বিতীয়ত, চরিত্রটিকে সঠিকভাবে ফুটিয়ে তুলবার প্রয়োজনে তার বর্ণনাটি অবশ্যই স্পষ্ট ও সূক্ষ্ম হতে হবে। চরিত্রের প্রকৃত প্রেক্ষিতটি যেন পাঠক ঋদ্ধ শব্দের তৈরী আরশিতে স্পষ্ট দেখতে পান সে বিষয়ে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। পাশাপাশি প্রতিটি চরিত্রের স্থিত আবেগকে অধিকতর শক্তিশালী ও বিশ্বাসযোগ্য হিসেবে ফুটিয়ে তুলবার জন্য প্রতীকের ব্যবহারে ব্যুৎপত্তি অর্জনের কোনো বিকল্প নেই। তৃতীয়ত, সংলাপ সৃষ্টি করতে হবে অত্যন্ত সাবধানী হয়ে। যখন, যেখানে, যেই মুহূর্তে সংলাপের প্রয়োজন হবে তখন সেখানে সেই মুহূর্তেই সংলাপ দিতে হবে। অপ্রয়োজনে সংলাপ ব্যবহার করা যাবে না। যে ধরনের গল্পই একজন গাল্পিক লিখুন না কেন তাকে তার গল্পের এমন একটি বিষয়বস্তু নির্বাচন করতে হবে যাতে বিষয়বস্তুটিতে সমাজ তথা জাতির কোনো না কোনো ধরনের সমস্যা অন্তর্ভুক্ত রয়ে যায়। সেই সমস্যাটি ফ্ল্যাশ ব্যাকের মাধ্যমে শুরুতেই অথবা গল্পের পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে যে কোনো পর্যায়ে তুলে ধরা যেতে পারে। সমস্যার সমাধানটি যেভাবেই ঘটুক না কেন, উপস্থাপন এমন হতে হবে যাতে পাঠকের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরী হয়। ম্যাজিক রিয়েলিজমের ওপর গল্পগুলো দেখছো না- কীভাবে একজন মানুষের আকাশে উড়বার দৃশ্যকে বাস্তবযোগ্য করে উপস্থাপন করা হচ্ছে। পাঠকের বোঝার কোনো সময় অথবা উপায়ই থাকছে না। পাঠক মন্ত্রমুগ্ধের মতো গল্পের শেষ পরিণতির দিকে যেতে যেতে প্রকৃত ঘটনাটির সারগর্ভ অণে¦ষনে বাধ্য হচ্ছেন। আর ঠিক এখানেই তো একজন প্রকৃত লেখকের মুন্সিয়ানার পরিচয়টি ফুটে উঠে। সত্যি বলতে কী, সাদা চোখে দেখলে বিষয়গুলি অত্যন্ত কঠিন। তবে লিখতে চাইলে এভাবেই লিখতে হবে। শুধু শুধু লিখে নিজেকে উঁচুমানের লেখক হিসেবে ভাববার চেষ্টা করলে নিজের যেমন ক্ষতি হবে তেমনি ক্ষতি হবে সাহিত্যের। সমাজও কি এই ক্ষতির বাইরে থাকতে পারবে? বলো।’
কী বলবেন অনাবিল! বর্ণনায় মোহিত হয়ে আনোয়ার সাহেবের দিকে তাকালেন। স্মিত হাসি তার আননজুড়ে বিকশিত হলো। স্পষ্ট ধারণা পাবার পরও পুনরায় প্রশ্ন করলেন, ‘গল্পের আকার নিয়ে যদি কিছু বলতেন আঙ্কেল?’
মাথাটি চেয়ারের শীর্ষ প্রান্ত থেকে নামিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে বলতে থাকলেন আনোয়ার সাহেব ,‘গল্পের আকার ছোট না বড় হলো সেদিকে কখনোই দৃষ্টি দেয়া যাবে না। গল্প যে গতিতে চলবে সেভাবেই চলতে দিতে হবে। কখনোই হঠাৎ করে গতি রোধ করা যাবে না। গল্প বড় হলে পাঠক পড়বে কি পড়বে না এ ধরনের চিন্তা যদি কাজ করে তাহলে গল্প লিখবারই দরকার নেই। গল্প যদি গল্পের মতো হয় তবে পাঠক পড়তে বাধ্য হবেন। আর অণুগল্প সৃজনের ক্ষেত্রে বর্ণনা এড়িয়ে যাবার যে প্রবণতা লেখকের মাঝে লক্ষ করা যায় সেটিও মোটেও ঠিক নয়। ভারতীয় উপমহাদেশেই বেশ কিছু গল্পকার রয়েছে যারা তাদের অণুগল্পগুলিতে প্রয়োজনের মাত্রা বিবেচনায় বর্ণনা করে গেছেন। এবং গল্পগুলি ধ্রুপদী মর্যাদা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। ’
‘আমার গল্পটি যে মানসম্মত হলো সেটি বুঝতে পারবো কীভাবে? ’ ভীতির একটি অপচ্ছায়া এসে প্রক্ষিপ্ত হলো অনাবিলের মুখের উপর। উচ্চ মার্গীয় সাহিত্য সৃজনের অভিপ্রায়টি দারুনভাবে স্ফুট হলো তার অনুসন্ধিৎসু চাহনিতে।
‘দেশি-বিদেশী সাহিত্যের ধ্রুপদী লেখকবৃন্দের গল্পগুলি পাঠ করো, তাহলে নিজেই বুঝতে পারবে। শোনো অনাবিল, ঘুরে ফিরে যে কথাটি বারবার বলতে হয় সেটি হলো-পড়তে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। তাছাড়া একটি গ্রন্থ প্রকাশের পূর্বক্ষণে সেই গ্রন্থের পা-ুলিপিটি যোগ্য সমালোচক দ্বারা মূল্যায়ন করে নিতে হবে। সমালোচক যদি ত্রুটি বের করেন সেটি গ্রহণ করবার মতো সামর্থ্য থাকাও লেখকের জন্য জরুরি। কিন্তু লেখক যদি সমালোচনা শুনে সমালোচকের ওপর বিরক্ত হন, মনে করেন তিনি যা লিখেছেন তাই সঠিক তবে সেটি হবে সেই লেখক এবং জাতির জন্য সবচাইতে দুভার্গ্যরে। যৌক্তিক সমালোচনা বিবেচনায় নিয়ে যাতে গল্পের মান অধিক মাত্রায় শৈল্পিক ও ঋদ্ধ করা যায় সেদিকেই লেখককে মনোনিবেশ করতে হবে, চূড়ান্ত বিবেচনায় সেটিই হবে লেখকের জন্য অত্যন্ত মঙ্গলময়। একজন লেখক যদি অকপটে নিজের দুর্বলতা স্বীকার করবার মতো উদারতা অর্জন করতে পারেন তবে সেই দুর্বলতা স্বীকারের মধ্যে কোনো লজ্জা তো থাকবেই না বরং তা লেখকের ঔদার্যকেই প্রকাশ করে-এটিও লেখকদের মনে রাখতে হবে। একটি গল্প লিখবার পর ছ’মাসের জন্য ফেলো রাখো। এরপর অধ্যয়ন করে পুনরায় সেই গল্পটি পাঠ করো। দেখবে তুমি নিজেই পূর্বের অসঙ্গতিগুলো শনাক্ত করতে পারবে। ধারাবাহিকভাবে যদি এমনটি করতে পারো তাহলে একটা সময় আসবে যখন তুমি নিজেই বুঝতে পারবে গল্পটি মানসম্মত হয়েছে কি না। বোঝাতে পারলাম কী? অনাবিল। ’ উপযোগিতার আলোয় যুক্তিগুলি ব্যাখ্যার সময় আনোয়ার সাহেবের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত অভিজ্ঞতার ভাবটি আপনাআপনি বেরিয়ে এলো।
স্পষ্ট উত্তর শুনবার পর কিছু বলবার উপক্রম করতেই আনোয়ার সাহেব নিজে থেকেই আবার বললেন ,‘ তা কতদিন লাগতে পারে বই হাতে পেতে?’
‘প্রকাশক তো বলছেন দশ দিন লাগবে। কিন্তু, আমি ধরে নিয়েছি বিশ দিন। হয়ত কমও লাগতে পারে।’ হাই তুলবার পর তৃতীয় বাক্যটি উচ্চারণ করলেন অনাবিল।
‘এক মাস লাগলেও সমস্যা নেই, বেরুচ্ছে তো।’ কথা বলতে বলতে কক্ষ থেকে বেরিয়ে দুজনই বারান্দার দিকে এগুতে থাকলেন।
উপন্যাস লিখবার বিষয়ে এই মুহূর্তে কোনো পরামর্শ গ্রহণের প্রয়োজন বোধ করলেন না অনাবিল । একদিন আনোয়ার সাহেব তাকে স্পষ্টই জানিয়েছিলেন, ‘ন্যূনপক্ষে চল্লিশ বছর এবং পাঠের অভিজ্ঞান ঋদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে তোমার এগুনোর দরকার নেই। বরং ছোট গল্প লিখে লিখে ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করাই হবে শ্রেয়।’
টানা দু’দিনব্যাপী দীর্ঘ আলোচনা শুনবার পর নিজের মধ্যে এক ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন অনাবিল। কক্ষে অবস্থানের সময় পড়াশুনা করবার পাশাপাশি অফিসে যখনই সময় পাচ্ছেন তখনই অধ্যয়নের চেষ্টা করছেন। লেখালেখির ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত পড়াশুনাই যে প্রকৃত পাথেয় সেটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আনোয়ার সাহেবের বর্ণনায়। প্রতিদিন যাই পড়ছেন তাই নিয়ে তার সঙ্গে আলোচনা করবার পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করছেন। তবে যে বিষয়টি তাকে আনন্দ প্রদানের পাশাপাশি মনোযোগী করে তুলছে সেটি হলো-আনোয়ার সাহেবের গ্রন্থ দুটির সার্থক প্রকাশ। এই ভাবনাকে নিজের ভেতর গ্রন্থিত করে প্রকাশকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করেই চলেছেন। ট্রেসিং, প্লেট, ছাপার কাজ যে মুহূর্তে সম্পন্ন হচ্ছে ঠিক সে মুহূর্তেই আঙ্কেলকে জানাচ্ছেন। প্রচ্ছদ কেমন হয়েছে, পৃষ্ঠাগুলি কি মানসম্মত হয়েছে, প্রচ্ছদে বইয়ের নামটি কোন কালার দিয়ে লেখা হয়েছে ইত্যাদি অজস্র প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করে উত্তেজনা প্রশমনের চেষ্টা করছেন অনাবিল। এক একটি পর্যায়ের খবর শুনবার পর আঙ্কেল-এর উচ্ছ্বাস তার ভেতরের তৃপ্ততাকে কোনো দ্বিধা না রেখেই অকপটে প্রকাশ করছেন তার হাসির মাধ্যমে।
ইতোমধ্যে সতের দিন পেরিয়ে গেছে। দশ দিন পেরিয়ে যাবার পর থেকেই অনাবিল প্রকাশকের ওপর প্রতিনিয়ত চাপ প্রয়োগ করে আসছিলেন। নির্দিষ্ট সময়ে বই প্রাপ্তির প্রত্যাশায় নির্ধারিত অর্থও প্রদান করেছেন। আজ কালের কথা বলে অবশেষে আঠারোতম দিনে এসে প্রকাশক নিজেই ফোন করে অনাবিলকে জানালেন কুরিয়ারে বই পাঠানো হয়েছে। প্রত্যাশিত সংবাদটি শুনবার পর থেকে দীর্ঘদিনের কাক্সিক্ষত প্রশান্তি বোধ করবার পাশাপাশি শিহরণ অনুভব করলেন আনোয়ার আঙ্কেলের কথা মনে করে, যে মানুষটি প্রতিটি মুহূর্ত ওই একটি খবর শুনবার অপেক্ষায় উদগ্রীব হয়ে আছেন। একবার ভাবলেন ফোন করে আঙ্কেলকে জানাবেন। কিন্তু সেটি না করে সরাসরি তার বাসায় চলে গেলেন। চেয়ারে বসেই ছিলেন তিনি। নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই অনাবিলকে দেখবার পর আশ্চর্য হয়ে গেলেন আনোয়ার সাহেব। কিছু জিজ্ঞেস করবার আগে অনাবিল যখন প্রত্যাশিত সংবাদটি জানালেন তখন চেয়ার থেকে উঠে এসে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিলেন তাকে। লম্বা হবার কারণে অনাবিলকে মাথা নিচু করতে হলো। অনাবিলের বুক থেকে নিজেকে আলাদা করে উচ্চ কণ্ঠে বলতে থাকলেন, ‘মেনি মেনি থ্যাঙ্কস, ইয়াংম্যান. মেনি মেনি থ্যাঙ্কস। আই ওয়াজ ওয়েটিং এভরি মোমেন্ট ফর হেয়ারিং দ্যাট পারটিকুলার নিউজ। রিয়ালি আই এ্যাম টোটালি ইম্প্রেসড নাউ।’ অনাবিলকে বসিয়ে রেখে বাসার সবাইকেই বিষয়টি জানিয়ে আবারো এসে বসলেন চেয়ারে। অতি উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কাল তাহলে কখন পাচ্ছি?’ প্রশ্নটি করবার পর দু’ঠোঁটের প্রান্তে ¯িœগ্ধ হাসির রেখা ফুটিয়ে যেভাবে তিনি তাকালেন অনাবিলের দিকে, তাতে মনে হলো এই প্রাপ্তিটির জন্যে তিনি কতদিন থেকে না জানি চরম ঔৎসুক্য নিয়ে তৃষিত রয়ে গেছেন।
‘আশা করছি এগারোটা থেকে একটার মধ্যেই পেয়ে যাবো।’ প্রবল আস্থার ছাপটি অনাবিলের মুখ চিরে বের হয়ে আসতে চাইলো।
‘আচ্ছা আঙ্কেল, এই যে দীর্ঘদিন ধরে আপনার কোনো লেখাই গ্রন্থাকারে প্রকাশ হয় নি, এমনকি এ ধরনের কোনো সম্ভাবনাও সৃষ্টি হয় নি, তবুও লিখে গেলেন কীভাবে বলুন তো, একটুও কষ্ট কিংবা হতাশা কি কাজ করে নি কখনো?
প্রশ্নটি শুনে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে ভাববার পর পাশের প্লাস্টিকের চেয়ারে বসা অনাবিলের কাঁধের উপরে নিজের হাতটি রেখে বললেন,‘ কিছুটা খারাপ লাগা তো স্বাভাবিক, নয় কি তাই? কিন্তু, একটি নির্দিষ্ট সময়ে এসে প্রকাশের বিষয়টি আর পরবর্তী সময়ে ভাবায় নি আমাকে। মনের আনন্দে অনবরত লিখেই গিয়েছিলাম। জীবনের এই মুহূর্তে এসে এখন মনে হয়- সাহিত্য হচ্ছে স্থিতিশীল জীবনের গভীর অভ্যন্তরে অবতরণের প্রধান তরী। একজন লেখক যদি সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে জীবনে নিয়ত সম্মুখীন হওয়া প্রতিবন্ধকতাগুলিকে মোকাবেলা করে নিজের ভেতর স্থিতিশীল আবহ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হন তবে তিনি লেখক কিনা সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। ভালো করে শুনে রাখো- তুমি যখন প্রকৃতই সৃষ্টির আনন্দ উপলব্ধি করবে তখন বুঝতে পারবে, বৈষয়িক কোনো কিছুই তোমার সৃষ্টির পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।’
‘রাষ্ট্রীয় অথবা অন্য কোনো পৃষ্ঠপোষকতা গ্রহণের চিন্তা কি কখনো আসে নি?’ তারার মতো মুখখানি থেকে প্রশ্নটি করবার সময় অনাবিলকে অনেক মসৃণ দেখাচ্ছিল। আনোয়ার সাহেবের অভাবনীয় ব্যক্তিত্বের ওপর শ্রদ্ধা প্রদর্শনের সর্বোচ্চ ভঙ্গিটি প্রতিফলিত হচ্ছিলো।
মাথা নিচু করা ছিলো আনোয়ার সাহেবের। বেশ কিছুক্ষণ ওই অবস্থায় থাকবার পর মাথা উঁচু করে অনাবিলের দিকে তাকিয়ে অনবরত বলতে শুরু করলেন, ‘সত্যি বলতে কি, এসব কোনো কিছুই, কখনোই, ভাবায় নি আমাকে। তাছাড়া সাহিত্য তো দৈহিক ক্ষুধা নিবৃত্তির কোনো মাধ্যম নয়, এটি মনের ক্ষুধা নিবৃত্তির মাধ্যম । তবে যে বিষয়টি সর্বোচ্চ মাত্রায় আমার ভাবনা জুড়ে ক্রিয়াশীল ছিল সেটি হলো-সময়। আমার সৃষ্টি যেন দীর্ঘ সময় একটি সত্তা থেকে অজ¯্র সত্তা জুড়ে বিরাজমান থেকে সেই সত্তাগুলির মূল্যবোধকে বিকশিত করতে পারে, আন্দোলিত করতে পারে অন্যায়ের বিরুদ্ধে জেগে উঠতে। এজন্য অতীতের কালোত্তীর্ণ সৃষ্টিগুলিকে বহুবার বহুভাবে বিশ্লেষণ করেছি, উপলব্ধি করবার চেষ্টা করেছি ভবিষ্যৎ সময়কে আমার চিন্তার সর্বোচ্চ সামর্থ্য প্রয়োগ করে। একটা কথা মনে রাখবে-তোমার লেখা যদি উৎকর্ষ অর্জন করতে পারে তবে জীবদ্দশায় কেউ মূল্যায়ন করুক বা না করুক, সময় তার প্রয়োজনে ঠিকই কাল থেকে কালান্তরে সেটিকে অবশ্যই মূল্যায়ন করবে। প্রচারের জন্য যততত্র ছোটাছুটি করার কোনো প্রয়োজন নেই। ’
আচ্ছা আঙ্কেল, একটা কথা, এই যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে জেগে উঠবার কথা বললেন, মূল্যবোধের বিকাশের কথা বললেন, এগুলো আসলে কীভাবে সম্ভব?
‘খুবই সহজ, জ্ঞান, কেবলমাত্র জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের মাধ্যমেই সম্ভব। পাড়ায় পাড়ায় গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করে পাঠক বৃদ্ধির মাধ্যমেই ঘুমন্ত মানুষগুলিকে জাগিয়ে তুলতে হবে। দেশে তো নানান রকমের দিবস পালিত হয়ে থাকে, সেই দিবসগুলির সাথে গ্রন্থ উপহার দিবসও আয়োজন করা যেতে পারে। সে মাহেন্দ্র দিনটিতে দেশের প্রতিটি মানুষ একে অপরকে গ্রন্থ উপহার দেবে। কে কাকে কী ধরনের বই উপহার দেবে কিংবা কেমন বই উপহার পাবে এটি নিয়ে অপেক্ষিত থাকবে ইতিবাচক উৎকণ্ঠা নিয়ে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাধ্যতামূলকভাবে বইমেলার আয়োজন করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজের প্রতিটি বিভাগ আলাদা আলাদা করে সেই মেলায় স্টল দেবে। সাধারণ সময়ে প্রতিটি বিভাগে চালু থাকবে জ্ঞান চক্রের আয়োজন। পাঠাভ্যাস যেন শুধুমাত্র একটি শ্রেণীর মাঝেই সীমাবদ্ধ না থাকে। রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকই যেন পাঠ গ্রহণ কিংবা ভ্রমণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পারে। আর এ দায়টি কিন্তু রাষ্ট্রকে নিতে হবে। একটা জাতি তো আর এমনি এমনি বিকশিত হয়ে উঠবে না, এগুলো করতে হবে, বুঝতে পারলে অনাবিল।’ দৃপ্ততার পাশাপাশি জোরালোভাবে বলবার চেষ্টা করলেন আনোয়ার সাহেব।
প্রচ- ক্লান্ত লাগছিল অনাবিলের। ইচ্ছে করছিল আরো কিছু বিষয়ে জানবার। কিন্তু ক্লান্তির কারণে থাকতে পারছিলেন না। আনোয়ার সাহেবও বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরে নিজে থেকেই অনাবিলকে আজকের মতো আসতে বললেন। আঙ্কেলকে চেয়ারে বসতে বলেই যাত্রা করলেন অনাবিল।
অব্যাহতভাবে না পাবার উৎকণ্ঠা, উৎকণ্ঠার সাথে জড়িত আবেগ ও প্রাপ্তির উচ্ছ্বাসকে চিন্তাস্রোতের ভেতর একীভূত করে যদিওবা ঘুমোবার চেষ্টা করলেন অনাবিল কিন্তু পারলেন না, ব্যর্থ হলেন। এই ব্যর্থতা আরেক দিক থেকে তার চিন্তারাশিতে আপনা আপনি স্থিত করে দিলো কুরিয়ারের অফিসটিকে। কখন অফিসটি খুলবে, গাড়িটি কখন আসবে এবং গাড়ি থেকে কাক্সিক্ষত গ্রন্থগুলি গ্রহণ করবেন তিনি। এভাবে ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছেন, জানেন না অনাবিল। যখন ঘুমটি ভাঙলো তখন ঘড়িটি দেখেই অস্থির হয়ে উঠলেন। দশটা বেজে কয়েক মিনিট অতিক্রান্ত হয়েছে। হয়ত গাড়িটি এরই মধ্যে পৌঁছে গেছে অফিসের সামনে। আর দেরি করলেন না অনাবিল। অত্যন্ত দ্রুততার সাথে জামা কাপড় পড়ে লম্বা পা ফেলে হেঁটে আসলেন মূল সড়কে। রিকশা নিয়ে যাত্রা করলেন কুরিয়ার অফিসে। দ্রুতই পৌঁছে গেলেন সেখানে। অনুসন্ধিৎসু চোখ দুটির প্রক্ষেপ ফেললেন অফিসের চারিদিকে। কিন্তু দুর্ভাগ্য অনাবিলের, গাড়িটি তখনও এসে পৌঁছোয় নি। অফিসে যোগাযোগ করে জানতে পারলেন, আজকে বিকেলের আগে আসবার কোনো সম্ভাবনা নেই। ঘোর অমানিশা চারদিক থেকে ঘিরে ধরলো অনাবিলকে। অভ্রভেদী পাহাড়গুলি যেন দলা হয়ে ধসে পড়তে থাকলো তার শরীরের ওপর। এ মুহূর্তে একমাত্র অপেক্ষা করা ব্যতীত অন্য কোনো বিকল্পই আর সামনে নেই। কিন্তু এ অপেক্ষাটি যে কত কষ্টের, কত যন্ত্রণার তা অনাবিল ছাড়া আর কারো পক্ষেই বোঝা সম্ভব নয়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও অফিসে গিয়ে বিকেল হবার অপেক্ষা করতে থাকলেন। কোনো কাজেই মনোযোগ দেয়া সম্ভব হলো না তার পক্ষে। তাড়াহুড়ো করে খেয়ে নিলেন দুপুরের খাবারটি। বারবার ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকাতে থাকলেন। তিনটে বাজতেই আবারো যাত্রা করলেন কুরিয়ার অফিসের দিকে। দূর থেকেই রিকশায় বসে থাকা অবস্থায়ই অফিসের সামনে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখতে পেলেন কুরিয়ারের গাড়ীটি। দাঁড়ানো গাড়ীতেই বই রয়েছে বিধায় গাড়ির সামনে প্রবল উত্তেজনা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। প্রতিটি কার্টুনের দিকে তীক্ষè দৃষ্টি নিয়ে তাকাতে থাকলেন। কুলিদের কার্টুন নামাবার দৃশ্যটি আজ অন্যরকম উত্তেজনার সৃষ্টি করছে তার শরীরের শিরা-উপশিরাজুড়ে। বেশ কিছু কার্টুন নামাবার পরেও যখন তার কার্টুনটি দেখতে পেলেন না তখন বিরক্তির চরমে পৌঁছে গেলেন। এক পর্যায়ে একজন মজুরকে বলেই ফেললেন, ‘আমার কার্টুন আছে তো?’
গামছা দ্বারা আবৃত মাথা, পেশীবহুল সুঠাম দেহের অধিকারী মধ্যবয়সী একজন মজুর কর্কশ কণ্ঠে যা বললেন তার সারমর্ম এই যে,‘এত অস্থিরতার কিছু নেই, একটু ধৈর্য ধরুন পেয়ে যাবেন।’
মজুরের কথাগুলি শুনবার পর নিশ্চুপ হলেন অনাবিল। লজ্জাবতী ফুলের মতো গুটিয়ে নিলেন নিজেকে। কার্টুনগুলির দিকে তাকানোর পরিবর্তে পাশের ফাঁকা রাস্তায় পায়চারি করতে থাকলেন। কিন্তু তার এই পায়চারির ভঙ্গিটি স্পষ্টই বলে দেয় তিনি প্রখরতাভরা আগ্রহ নিয়ে কোনোকিছুর জন্যে অপেক্ষা করছেন। পায়চারির মাঝেমাঝেই গাড়িটির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বুঝতে চাইছেন, গাড়ির সবগুলি কার্টুন আনলোড করা হয়েছে কিনা। পায়চারি থেমে থাকলো না। এই পায়চারির মাঝেই সংশ্লিষ্ট কুরিয়ারের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি অনাবিল আহমেদের নামটি ধরে ডাকলেন। নামটির শুনবার পর সমুদ্রের প্রবল ¯্রােতের মতো উব্দেলিত হলো অনাবিলের হৃদয়িক পরিম-ল। খুশির ঢেউ হয়ে নিজেই দুলতে থাকলেন স্বচ্ছ নীল জলরাশির অতলান্তে। সমুদ্রের শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে লীন করে দিলেন নিজের শ্বাসকে। অপেক্ষমান মুহূর্তগুলিতে তার ভেতরে যে অস্থিরতা কাজ করছিল সেটি নিমিষেই পরিবর্তিত হয়ে আলোকজ্জ্বল স্থিতিশীল রূপ পরিগ্রহ করলো। আস্বাদন করতে থাকলেন তিনি ভালোলাগার একটি অপূর্ব স্বাদ। এরপর কার্টুনগুলি দুটি রিকশাতে তুলে নিয়ে নিজে অন্য একটি রিকশায় যাত্রা করলেন আঙ্কেলের বাসার দিকে।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়েছে। আকাশেও নেই কোনো তারার আলো- যেহেতু আকাশটি সম্পূর্ণই মেঘাচ্ছন্ন। কিছু সময়ের মধ্যে অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়বার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠেছে। কিছুদূর আসবার পর টিপ টিপ করে দু’এক ফোঁটা বৃষ্টিও ঝরতে শুরু করেছে। অনাবিলের আশঙ্কা কার্টুনের গায়ে বৃষ্টির ফোঁটা পড়লে ফোঁটাযুক্ত অংশটি কার্টুনের মূল রং থেকে ভিন্ন রূপ ধারণ করবে। সেদিকে তাকিয়ে চিন্তান্বিত হয়ে পড়লেন তিনি। কার্টুনের ওজন স্বাভাবিকতার তুলনায় অতিরিক্ত হবার কারণে রিকশার গতিও মন্থর হয়ে পড়েছে। মানবিক কারণ বিবেচনায় জোরে চালাতেও বলতে পারলেন না। উপায়হীনভাবে শুধুই কার্টুনগুলির দিকে তাকাতে থাকলেন। অনুমিত সময় থেকে বেশি সময় নিয়ে অবশেষে বাসার একেবারে বারান্দার সামনে এসে পৌঁছলো রিকশা। বইগুলি রিকশাতেই রইলো। যথেষ্ট প্রসন্নতার সাথে নির্ভারতার একটি পৃথক সুখবোধ অনুভব করলেন অনাবিল।
রিকশা থেকে নেমেই তার দৃষ্টি পড়লো শেফালী ফুলের বৃক্ষটির দিকে। বারান্দার সামনে কিছু লোককে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় দেখতে পেলেন। বিষয়টিকে স্বাভাবিক ভেবেই বারান্দার কাছাকাছি গেলেন তিনি। সন্ধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছে। দু’একটি করে শেফালী ফুলও ফুটতে শুরু করেছে। প্রস্ফুটিত ফুলগুলি দেখবার পর অনাবিলের চোখেমুখে খুশির ভাবটি প্রতিভাত হলো। সাদা পাপড়ির মাঝখানে হলুদ কুঁড়িটি ফুলগুলির সৌন্দর্যকে মোহনীয় মাত্রায় শোভনীয় করে তুলেছে। শেফালীর অভূতপূর্ব স্নিগ্ধ সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। ডান হাতের প্রায় সবকটি আঙ্গুল দ্বারা ফুলগুলিকে একবার স্পর্শ করলেন। মাথা নিচু করে প্রস্ফুটিত ফুলগুলি প্রাণভরে দেখবার সাথে সুঘ্রাণও গ্রহণ করবার চেষ্টা করলেন অনাবিল। অতঃপর বারান্দায় উঠলেন। বারান্দায় রাখা বেতের চেয়ারে বসে থাকা অবস্থায় দেখতে পেলেন কবি অপূর্বকে। ভদ্রলোককে ডেকে ভালোই করেছেন আঙ্কেল- এমন একটি ভাবনা আপনাআপনি তার হৃদয়কে স্পর্শ করলো। নিজের হাতটি বাড়িয়ে দিলেন অপূর্বের হাতের দিকে। কিন্তু তার কাছ থেকে কাক্সিক্ষত ফলাবর্তন না পেয়ে হতাশ হলেন অনাবিল। অপূর্বের রাজকীয় মুখখানিজুড়ে বিষণœতার চিহ্নটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে তাকে জিজ্ঞেস করলেন- ‘ভাই কি হয়েছে আপনার, এমন বিচলিত দেখাচ্ছে কেন আপনাকে?’ উত্তর প্রদান না করে ইশারায় অনাবিলকে ড্রইংরুমে প্রবেশ করতে বললেন অপূর্ব।
আনোয়ার সাহেবের বাড়ির প্রথম কক্ষটিই ড্রইংরুম। রুমের দরোজাটি খোলা। প্রবেশ করলেন অনায়াসেই। ভেতরে বহু লোকের সমাবেশ। চাপা কথাবার্তা, মাঝে মাঝে নারীদের চাপা কান্নার শব্দ অনাবিলের শ্রবণে এসে আঘাত করছে। ভাবতে পারছেন না অনাবিল কী ঘটেছে আঙ্কেলের বাসায়। আর কাল বিলম্ব না করে দ্রুত প্রবেশ করলেন। প্রবেশ করেই চমকে উঠে দু’পা পিছিয়ে আসলেন। লক্ষ করলেন, ড্রইং রুমের ঠিক মাঝখানে একটি স্ট্রেচারে দুগ্ধ ফেননিভ সাদা চাদরে আবৃত হয়ত কোনো ব্যক্তির লাশ। এবার আঁতকে উঠলেন অনাবিল। লাশটি আঙ্কেলের নয়তো! ভাবতে থাকলেন-দুপুরেও তো কথা হলো। কই! ওনার কথায় তো কোনোকিছুর ইঙ্গিত অনুভব করা গেল না। অথচ এখন মনে হচ্ছে সেটিই ঘটে গেছে। চরম আতঙ্কের সাথে প্রবল উত্তেজনা অনুভব করতে থাকলেন নিজের মধ্যে। সামনে এগিয়ে গিয়ে কাউকে কিছু না বলে চাদরের একটি অংশ সরালেন। দেখলেন, তিনি যা আশঙ্কা করেছিলেন তাই ঘটেছে-লাশটি আঙ্কেলের। সেই মুখ, সেই নাক, সেই প্রশস্ত ললাট, সেই ঠোঁট-সেই ঠোঁটে পূর্বের মতো হাসিটি যেন লেগেই রয়েছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন এইমাত্র ঘুমিয়েছেন তিনি। চোখ দুটি মুদিত। হয়ত এখনই তিনি চোখ মেলে জেগে উঠবেন। বিশ্বাস করতে পারলেন না অনাবিল। চোখ দিয়ে অবিরল অশ্রু ঝরতে শুরু করলো। অনাবিলকে দেখে বাড়ীর সবাই বিশেষত তার স্ত্রী ও কন্যাদের কান্নার মাত্রা যেন তিন চার গুণ বেড়ে গেল। ওদের মুখে কোনো কথা নেই। শুধু জ্যেষ্ঠ কন্যাটি একটি কথাই উচ্চারণ করলো, বললো- ‘তোমার আঙ্কেল আর নেই, অনাবিল। আর কার কাছে আসবে তুমি?’ সহ্য করতে পারলো না অনাবিল। এতদিনের কষ্টার্জিত উৎফুল্লময় উত্তেজনা নিমিষেই হ্রাস পেয়ে হিমশীতল হয়ে এলো পুরো শরীর। বিরতিহীন কাঁদতে থাকলো নিঃশব্দে। দু’চোখে প্রবাহিত অশ্রুর ধারা ঝরঝর করে পড়তে থাকলো গাল বেয়ে। ‘আমার এই সৃষ্টিগুলি যাতে বেঁচে থাকে অনাবিল সে চেষ্টা তুমি কোরো। আমার মনে হয় তুমি ছাড়া এই কাজের মর্ম কেউ বুঝতেও পারবে না।’ আঙ্কেলের এই কথাগুলি তার মস্তিস্কে আপনাআপনি প্রবাহিত হতে থাকলো। নিজের এমন অবস্থা থেকে উত্তরণের চেষ্টা করলো। বোঝাতে থাকলো নিজেই নিজেকে-এটিই প্রকৃতির নিয়ম। কেউই চিরদিন থাকে না। কাউকেই চিরদিন ধরে রাখা যায় না।
ধীরে ধীরে বৃষ্টির তীব্রতা কমে আসছে। এখন হয়ত আঙ্কেলের লাশটিকে দাফনের জন্যে কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হবে। বৃষ্টির তীব্রতা কমলেও টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছেই। টিপটিপে বৃষ্টিতেই লাশটিকে যখন বের করা হলো তখন বারান্দার সামনেই শেফালী গাছটির নীচেই আনোয়ার হোসেনের প্রকাশিত গ্রন্থের কার্টুনগুলিও ভিজছে। গ্রন্থের কার্টুনগুলির দিকে তাকিয়ে অনাবিলের হঠাৎ কেন জানি মনে হলো, যিনি এই গ্রন্থের রচয়িতা সেই আনোয়ার হোসেনের লাশটি বৃষ্টিতে যেমন ভিজছে ঠিকই একইভাবে তার সৃষ্টিও যেন ভিজে যাচ্ছে। এই দুটি বিষয়ের সাথে সৃষ্টি এবং স্রষ্টার যে এক অদ্ভুত সমন্বয় সেটি আর একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ইতিহাস হয়ে থাকবে। এর মধ্যেই লাশটি নিয়ে সবাই যাত্রা করলেন কবরস্থানের দিকে। পেছনে পড়ে রইলো শুধু হাহাকার আর স্মৃতির অফুরন্ত ভা-ার।
এক সময় দাফন শেষ হয়ে গেল। সবাই তার আত্মার শান্তি কামনা করে সৃষ্টিকর্তার কাছে মোনাজাত করলেন। এরপর এক এক করে সবাই চলে যেতে থাকলেন, চলেও গেলেন একসময় সবাই। শুধু দাঁড়িয়ে থাকলো অনাবিল। এক সমুদ্র অশ্রু চোখে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আঙ্কেলের কবরের কাছে। আঙ্কেলের মৃত্যুর বেদনা যেন ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি হয়ে সিক্ত করতে থাকলো তাকে।