গানের মুকুল কি আর ঝরে যায় অবহেলায়
গানের মুকুল কি আর ঝরে যায় অবহেলায়

প্রণব মজুমদারঃ ছেলেবেলা থেকেই তাঁকে চিনি বেশ ভালোভাবে। আমার প্রয়াত বড়দা গীতিকার, কবি, সংগীতজ্ঞ এবং কৃষিবিদ প্রবীর মজুমদার বাবুলের সহপাঠী ও অন্তরঙ্গ বন্ধু তিনি। চাঁদপুর শহরের পুরানো সংগীত প্রতিষ্ঠান চাঁদপুর ললিতকলা এর অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠাতা দু'জন ! মুখলেসুর রহমান মুকুল, প্রবীর মজুমদার বাবুল এবং সংগীত শিল্পী ও সুরকার শীতল ঘোষাল ও তিনি ছিলেন পরস্পরের হরিহর আত্মা! শীতলদা মর্ত্যলোক ছেড়ে গেছেন ক' বছর হলো। চাঁদপুর শহরের অতি পরিচিত কবি ও গীতিকার মুখলেসুর রহমান মুকুল। ধবধবে শুভ্র গায়ের রং এবং ক্ষীণকায়া শান্ত প্রকৃতির অকৃত্রিম সৃজনশীল ব্যক্তি তিনি। ওনাকে বিকেলে শহরের প্রাণকেন্দ্র কালী বাড়ী মোড় ইস্টার্ন লাইব্রেরির পাশেই দোতলায় চাঁদপুর ললিতকলা। লাইব্রেরির নীচেই বেশির ভাগ সময় দেখতে পেতাম। সিগারেট হাতে কি যেন ভাবছেন! দেখা হলেই ঠোঁট প্রসারিত করে আঞ্চলিক ভাষায় বলতেন ‘কেমন আচো ?' ললিতকলার বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মহড়া বা অনুষ্ঠানে দেখা হতো।

১৯৮০ সালের জুন অবধি ছিলাম আমার জন্মভূমি সাহিত্য ও সংস্কৃতির শহর চাঁদপুরে। সে সময় একুশে ফেব্রুয়ারি, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বাংলা নববর্ষ, ঈদ ও শারদীয় দূর্গা উৎসবে চাঁদপুরের বিভিন্ন সংগঠন স্মরণিকা প্রকাশ করতো। প্রায় ম্যাগাজিনেই স্থান পেতো মুখলেসুর রহমান মুকুল ভাইয়ের কবিতা। প্রায় ৪ যুগ ধরে তিনি লিখে চলেছেন কবিতা ও গান! এখন তিনি ঘরবন্দি! চার বছর আগে মস্তিকে রক্তক্ষরণ হয়! সেই দুর্ঘটনা থেকে কোমর থেকে পা অবধি শক্তি পান না! হাটতে পারেন না। সহধর্মিণী ভাবী ওনার সার্বক্ষণিক সঙ্গী। দেখভালো ভাবীই করছেন। দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা চলছে! তবে স্বাভাবিক হচ্ছেন না। চিকিৎসকরা বলছেন, তিনি স্বাভাবিক হয়ে যাবেন যদি ওনার অস্ত্রোপচার করা হয়। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এমপি কবির স্টেডিয়াম রোডের বাসভবনে ওনাকে দেখে এসেছেন। বললেন, শহরের জনপ্রিয় এবং জাতীয় সংগীত শিল্পী রূপালী চম্পক। তিনিও মন্ত্রীর সঙ্গে ওনাকে দেখতে এসেছেন। সে সময় মন্ত্রী গীতিকার হিসেবে প্রাপ্ত চাঁদপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমি সম্মাননা - ২০১৯ পদকটি মুখলেসুর রহমান মুকুলকে তাঁর বাসভবনে এসে তুলে দেন। একই সময়ে তিনি অসুস্থ কবি ও গীতিকারের চিকিৎসায় সহযোগিতা করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন।

বড় ভাইয়ের একমাত্র সন্তান বড় ভাইপো প্রীতম মজুমদারের বিবাহ উপলক্ষে সপরিবারে চাঁদপুর গিয়েছিলাম গত ১০ ডিসেম্বর সন্ধ্যায়। ফিরেছি ১৫ ডিসেম্বর দুপুরে। আগের দিন চাঁদপুরের বাল্যবন্ধু এডভোকেট সেলিম আকবরের ছোট বোন প্রাবন্ধিক ও প্রগতিশীল নারী নেত্রী এবং জাতীয় পর্যায়ের সাহিত্য ও সংস্কৃতি সংগঠন জিগীষা এর সাধারণ সম্পাদক মনিরা আক্তারের ফোন। একটি অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণের জন্য নিমন্ত্রণের জন্য আমায় অনুরোধ। বললাম চাঁদপুর অবস্থান করছি। ঞুশি হয়ে পরে মনিরা অনুরোধ জানালো, মুকুল ভাইকে যেন দেখে আসি। আর জিগীষা সাহিত্য সম্মাননা - ২০১৯ তিনি পুরস্কৃত হচ্ছেন তা যেন ওনাকে জানিয়ে আসি।

যাঁর মাধ্যমে ছেলেবেলায় দেয়ালিকায় আমার প্রথম লেখা প্রকাশ চাঁদপুরের আমার সেই অগ্রজ আলোড়ন দেয়ালিকার সম্পাদক শহরের আলিমপাড়ার ব্যবসায়ি মাহবুবর রহমান সেলিম ভাইকে সঙ্গে নিয়ে মুকুল ভাইয়ের বাসায় উপস্থিত হলাম সকালে। মিসেস মুকুল মানে স্বপ্না ভাবী দরজা খুলে দিলেন। মুকুল ভাই শুধু হাটাচলা করতে পারেন না! কিন্তু ওনার স্মৃতিশক্তি এখনও সতেজ! স্পষ্টভাবে কথা বলেছেন! বললাম আমার বাবার কথা! বাবাতো আপনার মতেই ছিলেন! কোন চিন্তা করবেন না! আপনি শিগগিরই হাঁটতে পারবেন! -'আপনাকে অনেক সজীব মনে হচ্ছে মুকুল ভাই!' খুশি হলেন আমার কথায়! তিনিতো (বাবা) দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসায় ভালো হয়েছিলেন এটাও উল্লেখ করলেন মুকুল ভাই।

ফোন করলাম চাঁদপুরের আরেক কৃতি সন্তান কবি, গল্পকার ও গীতিকার এবং জিগীষা সভাপতি ইলিয়াস ফারুকী ভাইকে। সেলফোনের হ্যান্ডসেটটা দিলাম মুকুল ভাইকে। ইলিয়াস ভাইয়ের কণ্ঠে শোনলেন জিগীষা এবার আপনাকে এবং প্রণব মজুমদারকেও সাহিত্য সম্মাননা দিচ্ছে ! ইলিয়াস ভাই বললেন, প্রণব জানায়নি আপনাকে শুভ সংবাদটি? উত্তরে মুকুল ভাই বললেন জানিয়েছে। ফোনের পাশেই ছিলো মনিরা। মনিরাকে রিসিভারটা দিলে মুকুল ভাই মনিরাকে প্রশ্ন করে বললেন, 'আমাকে যে তোমরা সম্মাননা দিচ্ছো আমি কী যোগ্য? আসলে তোমরা আমাকে অনেক ভালোবাসো।' ঢাকা ফিরে আসার তাড়া ছিলো। তাই আসার সময় স্বপ্না ভাবীকে চা তৈরি করার জন্য বারবার তাগাদা দিচ্ছিলেন তিনি। বললাম, জেগে থাকার সময়টুকুতে লিখুন কবিতা কিংবা স্বার্থবাদী সমাজ জীবনের গান। শহরের নির্জন প্রান্ত স্টেডিয়ামের বিপরীতে যে নিজস্ব দোতলা বাড়ীতে প্রখ্যাত গীতিকার কবি মুখলেসুর রহমান মুকুল বসবাস করছেন তার নাম জীবন আলয়। যে গৃহে আলোতে তিনি নিবিড় চৈতণ্যে সৃষ্টি করেছেন অনেক রচনা সে ঘরটি আজ বড় নিঃসঙ্গ! নিচতলার ঘরে সূর্যালো কিংবা চন্দ্র কিরণ প্রতিদিন হয়তো ভীড় করে কিন্তু কবি মনের অলিন্দে একাকীত্বে গ্রাস করে অন্ধকার। কাছে নেই প্রিয়জন এবং ভালোবাসার মানুষগুলো। মোহের পিছনে ছুটছে প্রাণীরা! আসুন আমরা বিশিষ্ট গীতিকার ও কবি মুখলেসুর রহমান মুকুলের সুচিকিৎসায় কার্যকর পদক্ষেপে সচেষ্ট হই। তবেই চাঁদপুর শহরের ১৮/১৪ নম্বর স্টেডিয়াম সড়কে কবি আবার জীবন আলয় প্রাণবন্ত হবে! তখন মুখরিত হবে তাঁরও জীবনানন্দের গান। #


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান