কবি : গিরীশ গৈরিক
কবি গিরীশ গৈরিকের জন্ম ১৯৮৭ সালের ১৫ আগস্ট গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গীপাড়া
উপজেলায়। তিনি সাধারণ এক কৃষক পরিবারের সন্তান। তাঁর শৈশব কেটেছে মধুমতির
তীরে ঘুরে ফিরে। তিনি এসএসসি পরীক্ষা শেষ করেই তার নিজ গ্রামে গড়ে তোলেন
‘গীতাঞ্জলি সাহিত্য পরিষদ’। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিসাববিজ্ঞানে
স্নাতকসহ স্নাতকোত্তর করেন। বর্তমানে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন সাংবাদিকতা।
গিরীশ গৈরিক মূলত কবি। তিনি কবিতার পাশাপাশি কাব্যবিষয়ক প্রবন্ধ ও কবিতা অনুবাদ করে থাকেন।
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে গ্রন্থমেলায় বেহুলাবাংলা থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ক্ষুধার্ত ধানের নামতা’। এরপর ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয় ‘মা : আদিপর্ব’, ২০১৮ সালে “ডোম”।
কবি গিরীশ গৈরিকের কবিতাগুলো সহজ-সরল এবং বরাবরেই জীবনের গভীরতম বোধের কথা
চিত্রায়িত করেন। তাই খুব কম সময়ে কাব্যগ্রন্থগুলো বেশ পাঠকপ্রিয়তা লাভ
করেছে।
আগামী ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ৫০টি গভীরতম বোধ ও ভাবনার কবিতা নিয়ে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হবে “মেডিটেশন কবিতাগুচ্ছ”।
পরাধীনতা
আমি কিছু পোষাপাখি পৃথিবীর খাঁচায় পোষ মানিয়েছি
তারা চাইলেও পৃথিবী ছেড়ে অন্য কোথাও উড়ে যেতে পারে না।
ওই পাখিগুলোর মাঝে একটি পাখি কথা বলতে জানে
সেই কথা বলতে জানা পাখিটি আমায় একদিন জানালো-
সে নাকি, পৃথিবীর কারাগারে আমাকেসহ কিছু মানুষ পুষে রেখেছে
তারা চাইলেও পৃথিবী ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে পারে না।
স্পর্শ
তারপর ঘরের বাতি নিভে গেলো
তবুও কান্না কেন নিভে যায় না!
জীবনের সবকিছু নিভে যায়-
হাসি আনন্দ আলো কিংবা হাসনাহেনার ঘ্রাণ
শুধু জেগে থাকে আঁধার এবং তার সহোদর কান্না।
মানুষের পায়ে পায়ে ক্লান্তি-পাখির ডানায় বেদনা
তবুও বুকের ভেতর বহুদূরের ভালোবাসা-পায়ে পায়ে উড়ে যায়
ডানায় ডানায় হাঁটে।
জানি-তোমার স্পর্শ পেলে
পৃথিবীর সকল রঙের কান্না আলোতে লীন হয়ে যাবে।
কবিতা-তুমি কোথায়?
তোমার স্পর্শ পেতে চাই
যেমন করে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর স্পর্শ পেতে চায় তার মা।
নিবেদন
আমি তোমাতে বিলীন হতে চাই
যেভাবে নদী সাগরে গিয়ে বিলীন হয়ে যায়।
আমি তোমাতে লীন হতে চাই
যেভাবে নক্ষত্রগণ ব্ল্যাকহোলে লীন হয়ে যায়।
জানি-একদিন জীবনলীলা সাঙ্গ হবে
তবুও নদীর জোয়ারে তোমার চোখের জল বইবে নিরবধিকাল।
জীবন যেন শুরু থেকে শেষ-শেষ থেকে শুরু।
হে প্রকৃতি-হে কবিতা
তুমি আমায় শুরু থেকে শেষের ঊর্ধ্বে নিয়ে চলো
তোমার প্রতি এই আমার শুরু থেকে শেষ প্রার্থনা।
অন্ধবৃষ্টি
তুমুল বৃষ্টি শেষে পাহাড়ি নদী শান্ত হয়ে উঠেছে
মায়াবী মেঘের মাঝে ক্ষণে ক্ষণে সূর্যের লুকোচুরি কী যে আনন্দময়!
দূরে কাছে বহুদূরে পাহাড়ে পাহাড়ে রামধনুর উদয়
রাঙিয়ে দিয়েছে উত্তর গোলার্ধ থেকে দক্ষিণ গোলার্ধের প্রেমিক হৃদয়।
এখন সন্ধ্যা নেমে আসবে-ভেজা সন্ধ্যা
গাছের পাতায় জমে থাকা বৃষ্টির জল টুপটাপ ঝরবে হৃদয় অতলে
রামধনু ছাতা হাতে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে বোধের স্টেশনে
তুমি ওই পাহাড়ে-আমি এই পাহাড়ে
আমাদের মাঝে অদৃশ্য নদী
আমরা ছুটছি, আমরা প্রাণপণে ছুটছি রঙিন ছাতা হাতে অদৃশ্য নদীতে।
পরমব্রত
তুমি স্থির অবিচল হয়ে বসে আছো
যেন বুদ্ধের ভাসান।
যোগৈশ্বর্য তোমাতে লীন হয়ে আছে
আমি তোমার শরণাগত।
কবিতা-আমার এই সমর্পণ গ্রহণ করো
আমার এই নিবেদন তোমাতে আশ্রিত হোক।
ভৈরবী
বাঁশির ভেতর বাতাস ঢুকে যেভাবে সুর হয়ে যায়
তুমিও সেভাবে আমার ভেতর ঢুকে মন হয়ে যাও।
সমুদ্রের জলে ডুব দিয়ে সূর্য যেভাবে শীতল হয়ে যায়
তুমিও সেভাবে আমার ভেতর ডুব দিয়ে প্রেম হয়ে যাও।
তোমাতে আমাতে মনে-মনে ডুবে-ডুবে যে প্রেমের ¯্রােত
দিক থেকে যেসব দিগন্তে প্রবাহিত হয়
সেইসব দিগন্তে দাঁড়িয়ে আছে কবিতা।
যে কবিতার সম্মোহনি স্পর্শে-
তুমি-আমি পাখি হয়ে যাই।
পরম্পরা
রাত হলে মানুষ কেন ঘুমিয়ে পড়ে?
ঘুম-তুমি কে?
কীভাবে তুমি আমাদের শরীরে অবসাদ হয়ে থাকো!
বলো-বলো তোমার রহস্যময় ইতিহাস।
তারপর ঘুম বললো-
এই প্রশ্নের উত্তর কুম্ভকর্ণের কাছে জমা আছে।
কুম্ভকর্ণের কাছে গিয়ে জানা গেলো-
প্রশ্নের উত্তর বাল্মীকির কাছে গচ্ছিত আছে।
অবশেষে বাল্মীকি এসব প্রশ্নের অবসান ঘটালেন
তিনি বললেন-আমিও সৃষ্টিলগ্ন থেকে এই প্রশ্নের উত্তরের অন্বেষণে ব্রত।
শরণাগত
নদীর কোমল বাতাসে ভোর হচ্ছে
ধীরে ধীরে মায়ের কপালের সিঁদুর-
আকাশে আকাশে ছড়িয়ে যাচ্ছে।
দূরে, আরো বহুদূর থেকে ভেসে আসছে-
চৌরাশিয়ার ভৈরবী বাঁশির ঘ্রাণ।
কোমল বাতাস। সিঁদুরে মেঘ। বাঁশির ঘ্রাণ
নদীর জলে মিশে পবিত্র হয়ে উঠেছে
এ যেন কোনো এক সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর মন।
হে জীবনের পুরুষোত্তম চিন্ময় আনন্দ-মায়ামুগ্ধ প্রকৃতি
তোমাদের হৃদয়ের অতলে
আমাকে শরণাগত করে
নির্বাপণ করে
শিশুদের মনের মতো করে।