ছবি: তারিক সামিন
আমি একটা গোলাপ ফুল গাছ। আমি জানি আপনারা সবাই আমাকে ভালবাসেন। সেজন্য আজ আপনাদের কিছু কথা বলতে চাই। কথা গুলো নিতান্তই আমার নিজের সম্বন্ধে। আপনাদের ভাল না মন্দ লাগবে বুঝিনে। তবুও বলছি, শুনুন, আমার লক্ষ বছরের বিবর্তনের ইতিহাস।
এই পৃথিবীতে মহান স্রষ্টা আমাদের প্রথম পাঠান আজ থেকে সত্তর লক্ষ বছর পূর্বে। এরপর হতে আমাদের অনেক বিবর্তন হয়েছে। অর্থাৎ ইংরেজিতে যাকে বলে ইভুলেশন হয়েছে।
প্রথমে আমরা ছিলাম শুধু কাঁটায় ভরা, ঝোপঝাড় আর জংলী প্রজাতির বৃক্ষ। একদিন এক বিজ্ঞজন আমাদের দেখে খুব মুগ্ধ হলেন। তিনি ছিলেন একজন ভাবুক ও দয়ালু প্রকৃতির মানুষ। পৃথিবীর ভাল সব কিছুই তার কাছে ছিল সুন্দর আর মহান স্রষ্টার অনুগ্রহ। তখন আর সব বৃক্ষের মতো আমারাও মানুষের ভাষা বুঝতাম। এমনকি তারাও আমাদের কথা বুঝতো। সর্বাঙ্গে কাঁটা, অদ্ভুত বিদঘুটে ছিলাম আমরা; আমাদের ফুল হতো না। শুধু পাতা আর কাটাঁ।
মনীষী বললেন, ‘বাহ বেশ সুন্দর তো তোমাদের পাতা। তোমাদের ফুল গুলো না জানি কত সুন্দর হবে?’
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমরা বললাম, ‘হে মনীষী, আমারা জংলী গাছ, ঝোপ-ঝাড়ে জন্মাই। কোন ফুল হয়না আমাদের। সর্বাঙ্গে এত কাঁটা দেখে কেউ ফিরেও তাকায় না আমাদের দিকে।’
অতপর সেই মনীষী বললেন, ‘এত কাটাঁর কি দরকার তোমাদের বাপু?’
‘সে তো কখনো ভেবে দেখিনি। তবে এত কাটাঁ বলেই হয়তো অনেক বংশ বৃদ্ধি হয় আমাদের। পশু-পাখি সহজে কেউ ঘাটে না আমাদের।’
মনীষী বললেন, ‘যাই বলো তোমাদের পাতাগুলো বেশ সুন্দর। ফুল ফুটলে তোমাদের আরো সুন্দর লাগবে।’
সেই মনীষীর কথা শুনে হঠাৎ আমূল পরিবর্তন হয়ে গেল আমাদের মনে।
সহসা দুই লক্ষ বছরের ধ্যান-ধারণা ত্যাগ করে, সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম। শুধু বংশ বৃদ্ধির জন্য নয়, শুধু নিজ স্বার্থের জন্য নয়। এবার বাচঁবো সবাইকে নিয়ে, সবার কাছে প্রিয় হবার জন্য, সবাইকে কিছু দেবার জন্য। অন্যের চোখে সুন্দর হয়ে। তাদের সুবাস ও সৌন্দর্যে বিমোহিত করে উচু নৈতিকার জীবন যাপন করবো।
সেদিন থেকেই আমরা শুধু নিজেকে বাঁচানোর জীবন ছেড়ে দিয়ে, অন্যকে খুশি করার জন্য ফুল ফোটানোর চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলাম। প্রথম প্রথম ফুল খুব ছোট হতো। তেমন একটা সুন্দরও ছিল না। এমন কি গন্ধ ও ছিল না আমাদের ফুলে।
সেই মনীষী মাঝে মাঝে আসতেন এদিকে বলতেন, ‘ অপূর্ব। চেষ্টা করে যাও।’ শুনে খুব ভালো লাগতো।
অনবরত চেষ্টায় সতের হাজার বছর ধরে শুধু অন্যের জন্য আনন্দ ও ভাল লাগার চেষ্টা করে করে আমাদের এমন অপরুপ সৌন্দর্য হলো। সেই সৌন্দর্য, সেই ঘ্রাণ এর বর্ণনা বলে বোঝাতে পারবো আপনাদের। সেই সময়কার গোলাপের একটিও কাটাঁ ছিল না। বড় বড় অজস্র ফুল ফুটতো আমাদের। সুন্দর সুন্দর পেলব পাপড়ি, তার নিচে সুন্দর সবুজ পাতা। তার একটি পাপড়ি সাথে থাকলে সবচেয়ে দুর্গন্ধযুক্ত ঘামের মানুষের মনের আনন্দে প্রফুল্ল হয়ে থাকতো। একটি ফুল ফুটলে শত মাইল দূর থেকেও তার সুগন্ধে মাতোয়ারা হয়ে উঠতো প্রাণীকুল।
সে সময় আমাদের উপর কীট-পতঙ্গের উৎপাত ছিল খুব বেশি, মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী ফুল সহ ডালপালা ভেঙে নিয়ে যেত যখন তখন। তবুও মনে কোন দুঃখ ছিল না। বরং ছিল অপার আনন্দ। সবাইকে সৌন্দর্য ও সৌরভের বিমোহিত করার গর্ব ছিল। অন্যের জন্য মহৎ কিছু করার মধ্যে যে কত আনন্দ! অন্যকে খুশি করা, তাদের আনন্দ দেয়ার মধ্যে জীবনের সে কি পূর্ণতা! তার সব পেয়েছিলাম তখন। সবাই আমাদের এত ভালবাসতো, এত প্রশংসা করতো, জীবন ধন্য মনে হতো আমাদের। দিকে দিকে আমাদের গুনের কথা ছড়িয়ে পড়ছিল। বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষ আসতো আমাদের পাপড়ি সংগ্রহের জন্য। অবশেষে পৃথিবীর সব গৃহ, সব বাগান, সব রাজা-রাজন্যদের প্রাসাদ ভরে গেল গোলাপের বাগানে ও সুবাসে।
তারপর একদিন, এক কুমন্ত্রণা দানকারী শয়তান আমাদের কাছে এসে বলল, ‘হে বোকা গোলাপের দল। নিজেদের সৌন্দর্য ও সৌরভ দিয়ে তোমরা সবাইকে খুশি করো। অথচ তোমরা কি পেয়েছো বিনিময়ে? সবাই তোমাদের ফুল ছিড়ে ফেলে, পাপড়ি পায়ের তলায় পিষ্ট করে। এত অত্যাচারিত হয়েও তোমরা কেন প্রতিরোধ করোনা? কেন পাল্টা আঘাত করো না? তোমাদের কি কোন আত্মসম্মান নাই? তোমরা দুর্বল! তোমরা নির্বোধ! তোমরা কাপুরুষ! শুনে সবাই এতটা ক্ষুব্ধ হলাম, এতটা রুষ্ট হলাম যে ভাষায় বোঝাতে পারবো না। ক্রোধ, ক্ষোভ ও হতাশায় সব ফুল ঝরে গেল রাতারাতি। তারপর গৃহ, বাগান, রাজা রাজন্যদের প্রাসাদ সব স্থান থেকে বের করে দেওয়া হলো আমাদের। সেজন্য আমরা সবাইকে আরো বেশি ঘৃণা করতে শুরু করলাম। ঘৃণার যে কি শক্তি টের পেলাম এবার। খুব দ্রুত বড় বড় কাঁটা জন্মে গেল আমাদের শরীরে। সে কাঁটা খেজুরের কাটাঁর চাইতেও বড়। ফনিমনসার কাটাঁর চাইতে বিষাক্ত। কেউ কাছে আসলেই ফুটিয়ে দিতাম সে কাঁটা। তখন ব্যাথা ও তীব্র চিৎকার দিয়ে পালাতো সে। তা সে মানুষই হোক বা হোক অতিকায় ডাইনোসর!
এবার দিকে দিকে ছড়িয়ে পরলো আমাদের কুখ্যাতি। তবে আমরা সেসব পরোয়া করিনি। কারণ সে সময় খুব দ্রুত বৃদ্ধি হচ্ছিল আমাদের প্রজাতির।
এমন সময়! হঠাৎ করেই অন্যান্য সব প্রাণীকুল একসাথে বসে সিদ্ধান্ত নিল। পৃথিবীকে বসবাসযোগ্য রাখতে হলে সমূলে ধ্বংস করে দিতে হবে আমাদের। সেই শুনে আমরা আরো ক্ষিপ্ত হলাম। আরো বিষাক্ত গ্রন্থি ও বড় বড় কাঁটা তৈরি করে, পাতাহীন ক্যাকটাসের মত বড় গাছে পরিণত হলাম আমরা। চললো, পৃথিবীর সব প্রজাতির সাথে আমাদের লড়াই। ভয় পেয়ে গেল বাকি সব প্রাণীকুল। তারপর হঠাৎ একদিন সবাই মিলে আক্রমণ করে বসলো আমাদের। বড়-ছোট, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা থেকে শুরু করে একেবারে শিশু গোলাপ গাছ গুলোকে পর্যন্ত আক্রমন করল তারা। কেটে ফেলে, উপড়ে ফেলে, নির্মম ভাবে আঘাত করে, তারপর আগুন ধরিয়ে দিল সব গোলাপ গাছে। এক কথায় জাতিগত হত্যা। আমাদের কান্না, আমাদের আর্তনাদ, আমাদের বেঁচে থাকার আকুতি শুনলো না কেউ। পৃথিবী থেকে গোলাপের জাত নিশ্চিহ্ন না করে থামলো না তারা। হায়! আমরা তো তখন বুঝতে পারিনি, ঘৃণা এমনই এক বিষ, যা ধ্বংস করে এর পোষণকারী কেই! আমরা তো বুঝিনি যখন কোন সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়কে ঘৃণা করে। তখন সে, নিজের কবর নিজেই খুঁড়ে।
আমাদের সামান্য কয়েকটি গোলাপ গাছ একেবারে লোকচক্ষুর আড়ালে হিমালয় পাহাড়ের উপর বেঁচে ছিল। আস্তে আস্তে আমাদের বোধোদয় হলো। বুঝলাম হারানো সৌন্দর্য ও সৌরভ ফিরিয়ে আনতে না পারলে, এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকা হবে না আমাদের। কিন্তু হায়! বিষ কাঁটা তৈরী করা যত সহজ, ফুল ফোটানো তত সহজ নয়। তাই এবার চললো নিরবে, নিভৃতে ফুল ফোটানোর আয়োজন। প্রায় দশ লক্ষ বছরের চেষ্টায়; কাঁটা, ফুল আর পাতা নিয়ে হারানো সম্মান ও সৌন্দর্য ফিরে পেলাম আমরা। এবার মানুষ সহ সব প্রাণী আমাদের বাঁচিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নিল। আজ আমরা আবার সবার ভালবাসায় সিক্ত। প্রত্যাশা করি, আবার স্বর্গীয় ফুল হব আমরা।