রাতের পরে দিন এসেছে। দিনের আলোর অপেক্ষাতেই ছিলো চুন্নু ঘোষ। আজ তার ছেলেকে সর্বশেষ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। সকালের অপেক্ষায় সবাই হরিনাম জপতে জপতে রাত কাটিয়েছে। ছেলেটি মুর্ছা গেছে রাত দশটার দিকে। সরষের তেলে রসুন গরম করে মেজেছে। সারারাত মাথায় পানির ধারা বইয়ে দিয়েছে, তবুও ছেলেটির জ্ঞান ফিরল না। এ অজগায়ে যোগাযোগ ব্যাবস্থা মানে ধান তুলার ঝুরিতে কিংবা কেওয়ারের পাল্লাতে শুইয়ে বসিয়ে চারজন কি তিনজন, কখনো কখনো ছয়জন মিলে কাঁধে বয়ে নিয়ে যাওয়া। অন্তত তিনমাইল বহন করার পর বড় রাস্তার দেখা পাওয়া যাবে।
চুন্নু ঘোষের দুই ছেলে। বড় ছেলে রত্নাকর এক বিধবাকে বিয়ে করে তার প্রতিপত্তি নিয়ে সুখে আছে। ছোট ছেলে বিভারঞ্জন আজ আছি কাল নেই করছে। রোগের হাত থেকে তার কোনো একটি বারের জন্যও নিস্তার নেই। বিভারঞ্জনের জন্মটাই হয়েছিলো বোধয় কুক্ষণে। জন্মের পর পর ধরলো এলার্জি। সারা গা এতো ফুলে গেলো যে কেউ বাঁচবে বলে মনে করলো না। যা হোক, সে জন্মক্ষণের ঝুঁকি কাটিয়ে উঠলেও একটু বড় হলে ধরলো আবার একসাথে অনেকগুলো রোগ। জর কাশি সর্দি সারা বছর লেগেই থাকতো। কিন্তু তেরো বছর থেকে যে রুগটা তাকে মৃত্যুজীবনের মাঝে বাঁচিয়ে রাখছে তার নামকরণ ডাক্তাররাও এ পর্যন্ত করতে পারেনি।
তার শরীরে রক্ত থাকে না। কায়ক্লেশে রক্ত দিয়ে আনলেও কিছুদিন না যেতেই তার দেহে আবার রক্তশূণ্যতা দেখা দেয়। ফ্যাকাসে, লতলতে, ¤্রয়িমান হয়ে পড়ে সে। যেনো কোনো মৃত মানুষ পড়ে আছে বিছানায়। পিতা চুন্নু ঘোষ এসব দেখে শুনে সহ্য করতে পারে না। সর্বস্ব বিক্রি করে ছেলের চিকিৎসা করাতে নামে।
কোনো ফল হয় না। আবারও ছেলের অবস্থা খারাপ হতে থাকে। আজ শেষ দরোজায় এসে দাঁড়িয়েছে চুন্নু ঘোষ। মোড়ল বাড়ির তাগাদা আছে, যত দ্রæত সম্ভব ছেলেকে সুস্থ করে তুলতে হবে। আর তার পরপরেই মনিকার সাথে মোড়ল গিরিষচন্দ্রের বিয়ে।
মনিকা ছাড়াও চুন্নু ঘোষের আরেকটি মেয়ে আছে, সবিতা। সবিতা ক্লাস নাইনে পড়ে। রূপে গুনে একেবারেই কুৎসিত, কদাকার। কিন্তু মনিকাকে সবাই আগুন নামেই চেনে। তার চোখের দিকে তাকালে আর চোখ ফেরানো সম্ভব হয় না। কলেজে পড়ার সময় অনিরুদ্ধের সাথে প্রেম করে একবার পেট খসিয়েছে। কিন্তু তার দেহ বল্লরীর সাগরিকায় এ যেনো সৈকতেরও অদূরে সামান্য ধূলিকণা। এ কলঙ্ক মনিকার গায়ে লাগে না।
ষাটোর্ধ্ব ভূড়িওয়ালা মোড়ল মনিকার দু’চোখের বিষ। ঘরে বৌ আছে, পুত্র-পুত্রবধূ আছে। তবুও মনিকার মৌ-লোভে মোড়ল আবার বিয়ের পিড়িতে বসতে পাগলপ্রায়। এ জন্য সে চুন্নু ঘোষকে যতরকম সুবিধা দেয়ার আছে সবই দেবে। কিন্তু চুন্নু ঘোষ এ যাবৎ মোড়লের কাছে কোনো সাহায্যের জন্য মুখাপেক্ষী হয়নি। সে তার সর্বস্ব বিক্রিভাটা করে ছেলের চিকিৎসা করিয়েছে। শেষমেষ আর কিছু বিক্রির না থাকায় একবার ভেবেছে, যাক, মরুক ছেলেটা বিনা চিকিৎসায়। আবার পরক্ষণেই ছেলের মৃতমুখ কল্পনা করে শিউরে উঠেছে।
মোড়লের কাছে চুন্নু ঘোষ এসেছিলো গতরাতের নিশিথে। একা একা, চোরের মতো একটি চাদর মুড়ি দিয়ে নিজেকে লুকিয়ে। মোড়লবাড়ির গেটে দারোয়ানের মুখোমুখি হতে তার লজ্জার শেষ নেই। যেনো মৃত স্বরযন্ত্র দিয়ে অস্ফুটে উচ্চারণ করলো, বাবুর কাছে যাই। দারোয়ান চুন্নু ঘোষকে চেনে। আর জানে চুন্নু ঘোষের প্রতি তার মালিকের উদারতার কথা। তবুও একবার পরখ করে দেখতে চায় সে। প্রশ্ন করে, এতো রাতে? ক্যানে? চুন্নু ঘোষ অসুস্থের মতো উত্তর দেয়, ছেলেটার ভীষণ অসুখ।
দাড়োয়ান আর বাতচিৎ বাড়ায়নি। ঢুকতে দিয়েছে চুন্নু ঘোষকে। নিজে গিয়ে নরম সুরে ডেকে তুলেছে মোড়লকে। মোড়ল চোখ মুছতে মুছতে স্বপ্ন দেখার মতো উদ্বেলিত হতে থাকে। হাত ধরে টেনে বসায় চুন্নু ঘোষকে নিজের খাটে। পাশে তার বয়োবৃদ্ধ জীর্ণসীর্ণ স্ত্রী গুঁটি সুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে। চুন্নু ঘোষ কথাটা বলতে লজ্জাবোধ করে। যেনো ঘুমন্ত মানুষটির কাছে তার লজ্জার শেষ নেই। যেনো তার ঘুমন্ত অবস্থায় মৃত্যুর পয়গাম নিয়ে এসেছে চুন্নু ঘোষ। তার নীল নকসা যেনো এখন করবে দুজন মিলে। চুন্নু ঘোষের একবার ইচ্ছে হয় এরচে ভালো সে মরে যায়। এ মুহুর্তে ধূলার সাথে মিশে যায় সে একেবারে।
মোড়ল বুঝতে পেরে তাকে নিয়ে বসার ঘরে আসে। খুব সমীহ করে বসায়। নিজে বসে চুন্নু ঘোষের মুখোমুখি। চুন্নু ঘোষ মুখ খোলার আগেই বলে, কত ট্যাকা লাগব? চুন্নু ঘোষ হতভম্বের মতো বলে, হাজার বিশেক। মোড়ল কোনো কথা না বলে ঘরের ভেতর যায়। কাগজে মোড়ানো দশ হাজার টাকা এনে দেয় চুন্নু ঘোষের হাতে। বলে, আপাতত কাম চলুক, পরে যা লাগব আমি হাসপাতালে গিয়া দিয়ামু। চুন্নু ঘোষ গদগদ হয়ে পারে না পা ছুঁয়ে একবার প্রণাম করে ফেলে গিরিষচন্দ্রকে। কিন্তু গিরিশচন্দ্রই তাকে চমকে দিলো। গড় হয়ে প্রণাম করলো চুন্নু ঘোষের পায়ে। বললো, আশির্বাদটা আগাম নিয়া রাখলাম।
তারপর বাড়িতে এসে চুন্নু ঘোষ আবার রুগ্ন ছেলের শিয়রে বসে। ভোর দেখার অপেক্ষায় থাকে চুন্নু ঘোষের স্ত্রী মালতী দেবী, মেয়ে মণিকা ও সবিতা আর রুগ্ন শয্যায় অচেতন ছেলে বিভারঞ্জন। মনিকা একবার ভায়ের মাথায় জল দেয় তো অন্যবার মায়ের মাথায় তেলজল মিশিয়ে মেখে দেয়। চুন্নু ঘোষের স্ত্রী উচ্চ রক্তচাপের রুগি। ছেলের এমন অবস্থায় সে যেনো জ্ঞানহারা। ঠাকুর দেবতা স্মরণ করছে ঘন ঘন। বিভারঞ্জন আগেও অসুস্থ্য হয়েছে। কিন্তু এবারের মতো এতো মারাত্মক কখনো হয়নি। প্রায় ছ’ঘন্টা যাবৎ অচেতন হয়ে পড়ে আছে। মেয়ে সবিতা একটু পর পর আঙ্গুল রাখে বিভারঞ্জনের নাকের কাছে। শ্বাস প্রশ্বাস চলছে কিনা পরখ করে।
গিরিষ চন্দ্রের সাথে মেয়ে বিয়ে দিতে আপত্তি ছিলো না। কিন্তু তার যা বয়স তাতে মণিকা কখনো মা হতে পারবে বলে কল্পনাও করা যায় না। মোড়ল চোখ বুঁজলে প্রথমপক্ষের সন্তানেরা যে তাকে বের করে দিবে এ ব্যাবারে কোনো অনিশ্চয়তা নেই। এমন জেনে শুনে মেয়েকে সাগরে ভাসিয়ে দেবে, এমন হৃদয় নিয়ে তো চুন্নু ঘোষ বাবা নাম ধারণ করেনি। সেও চায় তার মেয়ে সুখে শান্তিতে সংসার করুক। তার একটি সুন্দর ভবিষ্যত হোক। নাতিপুতিরা লুটোপুটি করুক তার কোলে।
বড় ছেলে রত্নাকর তাদের সাথে কোনোরূপ যোগাযোগই রাখছে না। তাদের ছেলেপুলেরাও কখনো ঠাকুরদা কিংবা দিদার মুখ দেখেনি। চুন্নু ঘোষের ইচ্ছে হয় এ বয়সে নাতি নাতনিতে ভরে থাকুক তার সংসার। কিন্তু বিধি বাম, বড় ছেলেটা কথা শোনেনি। সে তাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেছে। বিভারঞ্জনকে নিয়ে কোনো আশা নেই। তাকে বাঁচিয়ে রাখাই এখন একমাত্র প্রাপ্তি হয়ে দেখা দিয়েছে। তার বিয়েশাদি, সংসার ইত্যাদির বিষয়ে যেনো ভাবাও যায় না।
মণিকাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিলো চুন্নু ঘোষের। মেয়েটি যে বছর মেট্রিক পরীক্ষা দেবে, সে বছরই ছেলেটি বিপত্তি বাঁধিয়ে ফেললো। নবীনগাঁয়ের এক বিধবার সাথে কুকর্মে ধরা পড়ে বিয়ে করতে বাধ্য হয় রত্নাকর। মোড়লই সবকিছু ফায়সালা করে দিয়েছিলো। কিন্তু ছেলেটি একেবারে বেমালুম ভুলে গেলো তার বাবা মায়ের কথা। এখন এ মনিকাই তাদের ভরসা। যদি কিছু একটা করে সংসারের হাল ধরতে পারে। চুন্নু ঘোষ মেয়ের পড়া লেখা চালিয়ে যায়। মেট্রিকে ভালো ফলাফল করে মনিকা। ভর্তি হয় দূরগ্রাম মহিলা কলেজে। বাড়ি থেকে আসতে যেতে তার প্রায় তিনঘন্টা সময় লেগে যেতো। তবুও সে কলেজ বন্ধ করেনি কোনোদিন।
কলেজের সামনে অনিরুদ্ধের দোকান। স্টেশনারী মালামাল আর একটা পুরাতন ফটোকপি মেশিন ঘিরে তার ব্যাবসা। নিজের বিয়ে সংসার ইত্যাদি লুকিয়ে প্রেম করে মনিকার সাথে। মনিকাও সব ভুলে বেভুল হয়ে যায় তার ভালোবাসায়। দুজনের সম্মতিতেই তাদের মধ্যে দেহসম্পর্ক গড়ে উঠে। কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো তখন যখন মনিকা জানালো তার অন্তঃস্বত্তা হবার কথা। অনিরুদ্ধ পুরোদমে অস্বীকার করলো এ দায়। এমনকি অপবাদ দিলো গর্ভের ভ্রæনটিকে। চরিত্রের কালিমা নিয়ে চোখের জলে মনিকা যেদিন কলেজ ছেড়ে চলে আসে তার কিছুদিন পরেই ছিলো আই.এ ফাইনাল পরীক্ষা। সেটি আর তার দেয়া হলো না। উপজেলা হাসপাতাল থেকে কোনোরকম এবর্শান করিয়ে একেবারে ঘরে বসে যায় সে। সেও আজ তিন বছর হলো। মানুষ ইতোমধ্যে সে ঘটনার কথা ভুলতে বসলেও কেউ কেউ বাঁকা চোখে ইয়ার্কি কাটতে ছাড়ে না চুন্নু ঘোষকে। আর এ কারনেই মনিকার বিয়ের বয়েস দীর্ঘায়িত হচ্ছে।
রাতের আধেকটা প্রহর কেটে গেলে মোড়ল তাকে বলেছিলো, এক সাপ্তা সময়, খালি এইডাই শর্ত। এর মধ্যে বিভা ভালা হইলে হইলো না হইলে নাই। আগামী সাপ্তায় একটা লগন আছে। আমি ওইডা মিস করতে চাই না। চুন্নু ঘোষ নিরবে মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়েছিলো। কড়কড়ে নোটের তাড়া যখন হাতে নিলো, চন্নু ঘোষের মনে হয়েছিলো যেনো টাকা নয়, যেনো বিভারঞ্জনের প্রাণের দাম। কিন্তু এ সময়টিতে এসে, যখন সবাই বিভারঞ্জনকে নিয়ে যেতে প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন হঠাৎ চুন্নু ঘোষের মনে হলো, না এ ঠিক নয়। সে প্রাণপণে মৃত্যুকামনা করলো রুগ্ন ছেলেটির। স্ত্রী ও দুই মেয়েকে বললো, তোমরাও রেডি অইয়া আইয়ো। আমি বইলাম বিভার কাছে।
স্ত্রী ও দুই মেয়ে নাইতে গেলে চুন্নুঘোষের ভেতরটা ক্রমশ পাথর হতে থাকে। প্রথমে তার মস্তক, অতপর ধীরে ধীরে হৃদয় ও হাত দুটি যখন পাথরে রূপান্তরিত হলো, ততক্ষণে তেলচিটচিটে বালিশটি সে চেপে ধরেছে বিভার নাকে মুখে। মূর্ছা যাওয়া ছেলে টেরও পেল না তার মৃত্যুর জন্যে আসলে কে দায়ী ছিলো? কান্নার ঘনঘটার মধ্যে বিভারঞ্জনকে বহন করে হাসপাতালে নেবার জন্যে যারা এসেছিলো তারা বাইরে থেকেই ফিরে গেলো। চুন্নু ঘোষ টাকার থলিটা কোমরে নিয়ে মাথায় গামছা বেঁধে খালি গায়ে এমনভাবে মোড়লবাড়ির দিকে হাঁটা দিলো, যে দেখে মনে হবে সে যেনো উর্বর মাঠে আগামীর স্বপ্ন বুনতে যাচ্ছে।