জাত : ইমতিয়াজ সুলতান ইমরান
মেয়ের
বাবা হয়ে মহাবিপদে পড়েছেন ইকরাম সাহেব। বিপদে পড়াটাই স্বাভাবিক। অষ্টাদশী
শিক্ষিত রূপবতী মেয়ের বাবা। প্রতিদিন ঘটকরা এসে ঘোরঘোর করে বিভিন্ন পাত্রের
ছবি আর বায়োডাটা নিয়ে। তিনি যতই বলেন, এখনই মেয়ের বিয়ের কথা ভাবছেন না।
নাছোড়বান্দা ঘটকরা তার পিছু ছাড়ছে না। একটার পর একটা পান চিবিয়ে মিষ্টিমুখে
বলবে, অমুক ছেলে শিক্ষিত সুদর্শন। তমুক পাত্র বড়লোক বাবার একমাত্র ছেলে।
এই ছেলের চৌদ্দগোষ্ঠি লন্ডন আমেরিকায়। সেই ছেলেটি বড় চাকুরী করে এমন ভালভাল
পাত্রের ঢাকঢোল প্রায়ই পিটিয়ে যায় ঘটকবাহিনী।
ঘটকবাহিনীর ঢাকঢোল ইকরাম সাহেব কানে ঠাঁই না দিলেও অন্তরি বেগমের কান ঠিকই ভারি করে তুলেছে। ভারি হওয়াটাই স্বাভাবিক। মেয়ের মা বলে কথা। খুব শাদামনের মহিলা। মানুষের প্রতি ভালবাসার সাগর। ঘটকদের তুষ্ট রাখতে যাতায়াত খরচ আর চা পানের টাকাটাও ঠিকভাবে মিঠলো কিনা তলেতলে খেয়াল রাখেন তিনি। কথায় আছে "দয়ায় আপদ বাড়ে।" বেশি দয়ালু হওয়ায় আপদবিপদেরও শেষ নেই। ভিক্ষুক এলে দুটো টাকা। দুমুঠো চাল না দিয়ে পেট ভরিয়ে ভাত খাইয়ে দিবেন। তাই দরজার সামনে ভিক্ষুকের ঝামেলাও কম পোয়াতে হয় না। অতিথি এলে তো কথাই নেই। আদরের অন্ত থাকে না অন্তরি বেগমের।
অন্তরি
বেগমের কাছে ঘটকরাও একেকজন মহান অতিথি হিসেবে গণ্য। একমাত্র মেয়ের জন্য
ভালভাল পাত্র খুঁজছেন যারা তাদের মন তো খুশি রাখতেই হবে। রাতের বেলায় শোবার
ঘরে নরম স্বরে ইকরাম সাহেবের সাথে অন্তরি বেগমের কথা,
- ওগো, ঘটকরা এত কষ্ট করে আমাদের একমাত্র মেয়ের জন্য এতগুলো ভাল ছেলের সন্ধান দিচ্ছে। তোমার কি একটি ছেলেও পছন্দ হয়নি?
- হয় অন্তরি। হয়।
- তাহলে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি হচ্ছো না কেন?
- মেয়ের বিয়ে নিয়ে এত ব্যস্ত হয়েছো কেন বলো তো? মেয়েটা আরো কিছু পড়াশোনা করুক না।
- এত পড়াশোনা দিয়ে কী হবে শুনি? মেয়ে স্বামীর ঘরে গিয়ে মাস্টারি করবে নাকি?
- মাস্টারি না করলেও ডেগমাস্টারি তো করবে।
- মেয়েমানুষ বলে কথা। স্বামীর ঘরে গিয়ে ডেগমাস্টারি তো করতেই হবে। এর জন্য কি মেয়ের বিয়ে দেবো না?
- দেবো গো দেবো। এর জন্যই আরো কিছু পড়াশোনার দরকার।
- কীজানি বাবা, তোমার সবকথাতেই ইয়ার্কি অবহেলা। এসব শুনতে ভাললাগে না আমার।
-
একটু বোঝার চেষ্টা করো গিন্নী। বাচ্ছামেয়ে। সংসারের কী বোঝে সে? পড়াশোনা
করলে বুদ্ধি বাড়বে। শারীরিক পরিপক্বতা আসবে। শ্বশুরবাড়ি গিয়ে সবার সাথে
মানিয়ে চলার বুদ্ধিশুদ্ধি কিছু বাড়ুক না মেয়েটার। রান্নাবান্নার কিছু তালিম
দাও ওকে। আদর দিয়ে তো কোনোদিন চুলোর কাছেই যেতে দাওনি।
- আমাকে দোষ দিচ্ছো? তোমার আদরের চাক্কা মেয়ে কি চুলোর কাছে যায়? তুমি ওকে কোনোদিন কোনো কাজ করতে দিয়েছো?
-
এবার ওকে রান্নাঘরে নাও। শ্বশুরবাড়ি গিয়ে রান্নাবাড়া করতে হবে না?
রান্নাবান্না হচ্ছে একটা শিল্প। বিশেষ করে মেয়েদেরকে সেটা জানতেই হবে।
- ঠিক আছে গো, ঠিক আছে। আমি ওকে সব শিখিয়ে নেবো। এবার বলো, তুমি মেয়েটার জন্য একটা ছেলে পছন্দ করবে।
- আচ্ছা বাবা করবো। তোমাকে নিয়েই করবো। এবার এককাপ কড়ালিকারের চা দাও তো।
- এতরাতে চা খাবে তুমি? তুমি তো রাতে চা খাও না। রাতে চা খেলে তোমার ঘুম হয় না।
- এখন খাবো। আজ খাবো। খুব মাথা ধরেছে।
- ঠিক আছে আমি তোমার জন্য চা করতে যাচ্ছি।
ইকরাম সাহেবের ঘুম হয়নি সারারাত। মেয়ের বিয়ে নিয়ে ভাবনার পাহাড় চেপে বসেছে মাথায়। অতি আদরের একমাত্র মেয়ে শ্বশুরালয়ে চলে যাবে? কোন্ ঘরে যাবে? কী আদর পাবে? ছেলেটি কেমন হবে? শ্বশুরশ্বাশুরি নিজের মেয়ের মতন দেখবে কী? বড় অংকের টাকা আর বড় বাড়ি থাকলেই কী সবার মন বড় হয়? ভাবনা আর ভাবনা। ভাবনার সাগরে সারারাত হাবুডুবু খেলেন তিনি। মেয়ের বিয়ে, এবং ভাল নিয়ে ভাবতে ভাবতে ফজরের আজান হয়ে গেলো। মুয়াজ্জিনের সুরেলা কণ্ঠ, "আসসালাতু খাইরুম মিনাননাউম"। ঘুমের চেয়ে নামাজ উত্তম। ঘুম তো হলোই না। ধীরেধীরে মসজিদের দিকে রওয়ানা দিলেন।
নামাজ
শেষে বাসায় এলেন। কোরান তিলাওয়াতে বসবেন। বারান্দায় বসে মেয়েকে ডাকছেন,
"সুরাইয়া- সুরাইয়া মা--"চোখ কচলিয়ে ঘুমজড়ানো কণ্ঠে সুরাইয়ার জবাব,
- জ্বি বাবা।
- ঘুম থেকে ওঠো মা। ফজরের নামাজ পড়তে হবে না?
- উঠছি বাবা।
- ওজু করে নামাজ পড়ে নাও
- আচ্ছা বাবা।
- আজ তোমার হাতের চা খাবো মা।
- ওকে বাবা। আমি নামাজ সেরে তোমার জন্য চা নিয়ে আসছি।
সুরাইয়া
চুলোয় চায়ের পানি চাপিয়ে ওজু করে নামাজ সেরে নেয়। বাবার জন্য চা নিয়ে যায়।
বাবা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে, মিষ্টি হেসে বললেন, মা আমার
পাক্কা রাঁধুনি হয়ে গেছে। মাথাটায় হাত বুলিয়ে দে মা। রাতে ঘুম হয়নি।
সুরাইয়া বাবার পিঠঘেষে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। এটা তার অভ্যাস।
সবসময় করে। বাবার কাছে গেলেই মাথায় হাত বুলাবে। পাকাচুল ছিঁড়বে। মাথা
চুলকিয়ে দিবে। বাবা ভারী গলায় সুরায়াকে বলছেন, তোর মা তো তোকে বিয়ে দেবার
জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। তোর মতামত কী মা? বাবার মুখে একথা শুনে সুরাইয়ার
চোখেমুখে লজ্জা, খুশি আর রাগের মিশ্রণ ফোঠে ওঠে। সকালের সূর্য কেবল উঁকি
দিতে যাচ্ছে। সূর্যের চেয়েও লাল দেখাচ্ছে সুরাইয়াকে। লজ্জায় লাল। রাগে লাল।
খুশিতে লাল। বাবার মুখে নিজের বিয়ের কথা শুনে, কোন্ মেয়ে লজ্জা না পায়?
সুরাইয়ার লাজুক মুখের কাছে যেন সকালের শিশিরস্নাত লজ্জাবতীও হার মানবে।
খুশির কাছে যেন সূর্যের হাসিও মলিন দেখাচ্ছে।
বাবার
মাথায় হাত বুলাতে আঙুল কাঁপছিল। বাবা সুরাইয়ার মুখের দিকে না তাকালেও
বুঝতে পারছিলেন, ওর মনের অবস্থা কেমন হবে? বাবা আবার বললেন,
- কিছু বল্ মা।
- সুরাইয়া হালকা রাগীস্বরে বললো, তোমরা আমাকে তাড়িয়ে দিতে চাচ্ছো বাবা? আমি তোমাদের উপর বোঝা হয়ে গেছি?
- নারে মা। এভাবে বলছিস কেন? সব মেয়েরাই স্বামীর ঘরে যায়। তুমিও যাবে। এটাই তো নিয়মরে মা।
-
তুমি না স্বপ্ন দেখতে বাবা? আমি পড়াশোনা করে একদিন নিজের পায়ে দাঁড়াবো।
তারপর আমার সংসার নিয়ে তোমাকে আর ভাবতে হবে না। এসব ভুলে গেছো বাবা?
- ভুলিনিরে মা। ভুলিনি। আর ভুলিনি বলেই আজ তোকে নিয়ে আমার এত ভাবনা। তোর মায়ের এত ভাবনা।
- কিসের এত ভাবনা শুনি? আমি কি বুড়ি হয়ে যাচ্ছি?
- নারে মা। আমি তো বলি তোর এখনও বিয়ের বয়সই হয়নি।
- তাহলে কেন মিছেমিছি এত ভাবছো? আর ভেবেভেবে নিজের শরীরটা খারাপ করছো?
- এই শরীরটার জন্যই এত ভাবছি মা।
- আমার বয়স হয়েছে। বুঝতে পারছি বেশিদিন বাঁচবো না। কখন কী হয়ে যায় খোদাই জানেন।
- প্লিজ এসব বলো না বাবা। সুরাইয়া বাবার ঠোঁট চেপে ধরে।
-
বেঁচে থাকতে তোকে একটা ভাল পাত্রস্থ করতে পারলে আমার ভাল লাগবে মা।
প্রয়োজনে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে বাকি পড়াশোনাটা সেড়ে নেবে। আমি যে ছেলেকেই পছন্দ
করি না কেন তোর পড়াশোনার বিষয়ে এই আবদারটা রাখবো।
- বাবা তুমি ভাল থাকো। তুমি ভাল থাকলে আমিও ভাল থাকবো। আমি গেলাম বাবা।
- তোর মাকে একটু ডেকে দে মা। আমার জন্য তোর মাও ঘুমায়নি রাতে। তাই তোর মা'কে ডাকিনি আমি।
ইকরাম সাহেব স্টাডিরুমে কোরান তিলাওয়াত করবেন। স্টাডিরুমটা একটা বিদ্যার সাগর। এই সাগরপারেই অবসর সময় কাটান তিনি। সারাদিন পড়ে থাকেন বই নিয়ে। বইয়ের ভাষায় কথা বলেন তিনি। শুদ্ধ উচ্চারণ। শুদ্ধ শুরেলা উচ্চারণে কোরান তিলাওয়াত করছেন। শুদ্ধ হবারই কথা। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মানুষ। জীবনে হাজার-হাজার ছাত্র পড়িয়েছেন। মানুষ বানিয়েছেন। এদের অনেকেই দেশে বিদেশে ভাল অবস্থানে আছেন। শুধু আমিই পড়ে রইলাম অজোপাড়াগাঁয়ে সাধারণ কবি পরিচয়ে। স্যার আমাকে দেখলে আজও বলেন, তুমি আমার কাছে আজও সেই গাধা ছেলেটি। তাই তোমাকে ছাড়া আমার আর কোনো ভরসা খুঁজে পাই না। এই যা, স্যারে কথা বলতে বলতেই স্যারের ফোন-
- আসসালামু আলাইকুম স্যার।
- ওয়ালাইকুম আসসালাম। কবি সাহেব নাকি?
- জ্বি স্যার।
- আগামী শুক্রবার জুম্মার পরে তুমি আমার বাড়িতে আসতে পারবে?
- পারবো স্যার।
- তুমি তো মনভোলা মানুষ। ভুলে যাও বেশি।
- না স্যার। ভুলে যাবো না।
-
তোমাকে নিয়ে ভয় হয়। স্কুলের পড়া ভুলে যেতে আর এখন কেউ কিছু বললে সেটাও
ভুলে যাও। হা হা হা! আচ্ছা শুনো, আগামী শুক্রবারে আমার বাড়িতে কিছু মেহমান
আসবেন। আমার সুরাইয়ার বিয়ের ব্যপারে কথা বলবেন তারা। মানে সুরাইয়াকে দেখতে
আসবেন। আমি একা মানুষ। তোমার খালাম্মা তো রান্নাঘরেই ব্যস্ত থাকবে। তুমি
পাশে থাকলে আমাদের অনেক হেল্প হবে। ভুলে গেলে চলবে না। আমি খুলে বললাম,
যাতে তোমার মনে থাকে। এবার রাখি।
বরপক্ষ সুরাইকে দেখতে আসবে শুনে, বুকটা কেমন জানি ধপ্পাস করে উঠলো।সুরাইয়া
আমাকে দেখলেই লাজে মুখ লুকায়। কেন? লজ্জা পাবে কেন? তাহলে কী---! তাহলে কি
সুরাইয়াও আমাকে ভালবাসে? সুরাইয়ার লাজুক মুখটা দেখলেই আমার মনে ছন্দ জাগে।
সেদিনও সুরাইয়াকে দেখে চারলাইন কবিতা লিখেছিলাম,
লজ্জা তোমার ঘোমটা রূপের
কেউ দেখুক না কেউ
দেখলে তোমায় নয়ন জুড়ায়
জাগে প্রেমের ঢেউ।
কেন নয়ন জুড়ায়? প্রেমের ঢেউ জাগে কেন? আমি কি সুরাইয়াকে ভালবাসি? ভাকবাসি তো। আমি
সুরাইয়াকে ভালবাসি। আমার বুকের ভালবাসার কথা সুরাইয়াকে বলতে পারছি না।
বলতে যাবো কেন? সেকি বোঝে না? হয়ত বোঝে। যদি বোঝে, বলছে না কেন? হয়ত বলবে।
কবে বলবে? আদৌ কি বলবে? মেয়েরা এসব বলে? ওদের নাকি বুক ফাটে তবু মুখ ফুটে
না। আমারই তো বলা উচিত। কীভাবে বলি? আমাকে কি সেইভাবে দেখে সে? না দেখলে
লজ্জা পাবে কেন? লজ্জা নারীর ভূষণ। হয়ত এমনি লজ্জা পায়। না। বলা উচিত হবে
না। বলবো না কোনোদিন।শরৎচন্দ্র বলেছেন, "বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না,
দূরেও ঠেলিয়া দেয়।" আমার ভালবাসা তো ছোট নয়। আমি সুরাইয়াকে দূর থেকেই
ভালবেসে যাবো।
শুক্রবারে
জুম্মার নামাজ পড়েই চলে গেলাম ইকরাম স্যারের বাড়িতে। স্যার আমাকে দেখে খুব
খুশি হলেন। হাসিমুখে বললেন, ভাবছিলাম তোমাকে একবার ফোন দেবো। এর আগেই তুমি
চলে এলে। আর কোনো চিন্তা নেই আমার। শুনো, মেহমানরা আসলে তোমার খালাম্মা আর
আমি তাদের রিসিভ করবো। তুমিও আমাদের সাথে থাকবে। বসার পর তাদের সাথে আমি
তোমাকে পরিচয় করিয়ে দেবো। আরে আমার একজন প্রিয় ছাত্র দেশের নামি কবি। এটা
ওদের জানাবো না? হা হা হা! চা নাস্তা পরিবেশনের কাজটা তোমার হাতে করবে।
এবার যাও তোমার খালাম্মার মেনু দেখে আসো। সুরাইয়া কেমন সাজগোজ করেছে? একটু
দেখে নিও। হা হা হা!
সুরাইয়া
সাজবে আর আমি দেখবো না? নয়ন জুড়িয়ে দেখবো। একবার দেখবো? মোটেই না। বারবার
দেখবো। শতবার দেখবো। হাজারবার দেখবো। সুরাইয়ার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকবো।
সুরাইয়ার চোখে চোখ রাখবো। ওর চোখে আমার ছবি দেখবো। যদি লজ্জা পায়? লজ্জা
পেলে ভাল। লজ্জায় লাল হয়ে যাক্। আমি তার লাজুক মুখটাই বেশি দেখতে চাই। যদি
কাঁদে? কাঁদুক। আমি ওর অশ্রু মুছে দেবো। ওর অশ্রুতে আমিও সিক্ত হবো। সিক্ত
তো হয়েই গেছি। হৃদয়সিক্ত হয়েছি। বেদনার অথৈ জলে রীতিমত সাঁতার কাটছি আমি।
আমি দেখবো। এ দেখাই শেষ দেখা নয়তো? এ দেখাই শেষ দেখা হয়ত।
বিকেল
প্রায় চারটার সময় কালো রঙের একটা দামি হাইয়েস গাড়ি এসে থামলো ইকরাম
স্যারের বাড়ির সামনে। ইকরাম স্যার আর খালাম্মা দ্রুত এগিয়ে গেলেন মেহমানদের
রিসিভ করতে। সালাম দিয়ে নিজেদের পরিচয় দিলেন। কোমলকণ্ঠে আসুন প্লিজ, আসুন,
আসুন, বলে বাড়ির ভেতরে ঢুকলেন। ড্রয়িংরুমে বসলেন। স্যার আমাকে পরিচয়
করিয়ে দিলেন। বললেন, আমার এক প্রিয় ছাত্র। ভালো লেখালেখি করে। দেশের বেশ
পরিচিত একজন কবি। আপনারা তো দেশের বাইরে থাকেন নতুবা নাম বললেই আশা করি
চিনতেন। সালাম দিলাম মেহমানদের। আমি বুঝতে পারলাম বরপক্ষ দেশের বাইরে
থাকেন। লন্ডন বা আমেরিকাপ্রবাসী হবেন। খালাম্মা চলে গেলেন রান্নাঘরে। আমিও
খালাম্মার পিছুপিছু গেলাম। প্রথমেই ঠান্ডা শরবত দিয়ে আপ্যায়ন শুরু। তারপর
ডাইনিং টেবিলে মিষ্টিমিঠাই পিঠাপায়েস দই, বিভিন্ন ফল সাজিয়ে রাখার কাজটা
করে নিলাম। কাজের ফাঁকে বারবার সুরাইয়াকে দেখলাম। সুরাইয়া মন খারাপ করে
বসেছিল। মন খারাপ কেন ভাবছিলাম। আজ তার খুশি লাগার কথা। মনেমনে ভাবলাম আর
বারবার তাকালাম। দেখলাম। কিছু বলার সাহস পেলাম না।
খাওয়াদাওয়া
শেষ। ডাইনিং টেবিল ছেড়ে আবার ড্রইংরুমে বসা হলো। এবার আমাকে চা আর
ড্রিংকস্ পরিবেশন করতে হলো। পরিবেশন করলাম খালাম্মার হাতে সাজানো বাহারি
পানদানিও।
বরপক্ষ
তাড়া আছে বলে মেয়ে দেখার আশা ব্যক্ত করলো। স্যার বললেন, আপনারা কষ্ট করে
আমার বাড়িতে এসেছেন কিছু সময় বসুন গল্প করি। আমার বাড়িটা ঘুরেফিরে দেখুন।
সম্পর্কে কে কি হন সেটাইতো এখনও জানা হলো না। ঘটক পান চিবাতে চিবাতে বললো,
এই দুজন আপনার হবু বেয়াই-বেয়াইন। অই দুজন হলেন বরের ভাই-ভাবি। আর উনি
হচ্ছেন আপনার হবু জামাতা। স্যার হাসিমুখে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ। জামাইবাবার
ছবি আমি দেখেছি। আজ সরাসরি দেখলাম। জামাইবাবাজি খুব সুদর্শন। আমার মেয়ের
সাথে মানাবে বেশ।
খালাম্মা
সুরাইয়াকে ধীরেধীরে নিয়ে এলেন। সুরাইয়া কোমলকণ্ঠে সবাইকে সালাম দিলো।
সালামের উত্তর উপেক্ষা করে হবু শ্বশুর-শ্বাশুরি সুরাইয়াকে বসতে বললেন।
সুরাইয়া বসলো। বরপক্ষের সবাই একজন আরেকজনের দিকে তাকালেন। কী যেন একটা
বোঝাপড়া করে নিলেন তারা। শ্বাশুরি-মা ওঠে এসে সুরাইয়ার মাথা থেকে কাপড়
সরালেন। সুরাইকে দাঁড়াতে বললেন। সুরাইয়া মাথা নিচু করে ওঠে দাঁড়ালো।
শ্বাশুরি সুরাইয়ার চুলের ঘনত্ব আর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ পরখ করলেন। সুরাইয়াকে
একটু হাসতে বললেন। সুরাইয়া লজ্জায় হাসতে পারছিল না। শ্বাশুরি নিজের হাতেই
সুরাইয়ার ঠোঁটদুটোকে উঠিয়ে নামিয়ে উপরের আর নিচের মাড়ির দাঁতগুলো দেখে
নিলেন। তারপর বললেন একটু হাঁটোতো মা। এমন দৃশ্য দেখে আমি খুব অবাক হলাম।
স্যার আর খালাম্মার মুখের দিকে তাকালাম। দুজনের মুখেই বিরক্তির ছাপ ভেসে
উঠলো। স্যার যেন চুপচুপে রাগে কাঁপছিলেন। আমার কাছে মনে হলো, বরপক্ষের
লোকেরা যেন গরুর বাজারে আসছেন। যাক্ মেহমানদের সম্মানে চুপ থাকাই মানবিক
বলে ভেবে নিলাম।
শ্বাশুরি-মা
সুরাইয়াকে বসার অনুমতি দিলেন। সুরাইয়া আবার বসলো। বাঁকাচোখে হবু স্বামীর
দিকে তাকালো। ভদ্রলোক মোটা একটা এনড্রয়েট মোবাইল অপারেট করছিলেন। বারবার
ম্যাসেঞ্জারে পটাসপটাস শব্দ হচ্ছিল। আমি ভাল করেই বুঝতে পারছিলাম, তিনি
নেটে মগ্ন। কারো সাথে চ্যাট করে যাচ্ছেন। সুরাইয়া মাথা নিচু করে চোরাইচোখে
তার হবু বরকে দেখে নিচ্ছে বারবার। বরটা একবারও সুরাইয়ার দিকে তাকালো না।
আমি ক্রিকেট মাঠের আম্পায়ারের মত প্রখর দৃষ্টিতে ঘটনাটির ঘনঘটা অবলোকন করে
যাচ্ছি। প্রতিক্ষার প্রহর গুনছি, সুরাইয়া কখন আমার দিকে তাকায়? তাকাবে বলেই
বিশ্বাসের বন্ধনে বড্ড পরিকর আমি। সবার চোখকে ফাঁকি দিতে গিয়ে আমার আঁখিতে
আঁতকে ওঠে সুরাইয়া। লজ্জার ছন্দ মাত্রা অনুপ্রাস ছড়িয়ে পড়ে তার সারাবদনে।
লাজুকমুখে আবার তাকালো। কী এক নিদারুণ অসহায়ত্বের দৃষ্টি। দৃষ্টি থেকে
বৃষ্টির ফোঁটার মত দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে এলো দুগাল বেয়ে। ঘোমটার আঁচলে মুখ
লুকালো সুরাইয়া। বরপক্ষের এতসব অভদ্রতার মাঝে বরটাকে আরো বেশি অভদ্র বলেই
মনে হলো আমার কাছে।
সুরাইয়ার
হবু শ্বশুর বললেন, একটুকরো কাগজে তোমার নাম আর বাবা মায়ের নাম লিখে দাওতো
মা। খালাম্মা সুরাইয়ার হাতে খাতাকলম দিলেন। সুরাইয়া মাথা নিচু করে আস্তে
বললো, ইংরেজি নাকি বাংলায় লিখবো? বরপক্ষ থেকে উত্তর আসলো ইংরেজিতে লিখো।
সুরাইয়া লিখলো,
Name- Suraya Akter
Fathers name- Ekramul Haque
Mothers name- Antari Begum
ঘটক সুরাইয়ার হাত থেকে খাতাটি নিয়ে শ্বশুর সাহেবের হাতে দিলো। খাতাটি দেখেই তিনি বললেন, বাহ্! হাতের লেখাতো অসাধারণ! তিনি পড়লেন। ভুরু কুচকিয়ে খাতাটি উনার স্ত্রীর হাতে দিলেন। এক হাত থেকে অন্যহাতে গেলো। সবার হাত হয়ে আবার শ্বশুরের হাতে এলো। সুরাইয়ার শ্বশুরমশাই ইকরামস্যারকে বললেন,
- বেয়াই যদি কিছু মনে না করেন তাহলে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো।
- না না কিছু মনে করার কী আছে? বলুন কী বলতে চান?
- মেয়ের হাতের লেখার তারিপ না করে পারছি না।
- ধন্যবাদ বেয়াই খুব খুশি হলাম।
- আপনাকেও ধন্যবাদ। আমি জানতে চেয়েছিলাম আপনাদের জাত কী?
- জাত? (রীতিমতো বিস্মিত হলেন স্যার।)
- হ্যাঁ, জাত।
- মানুষ।
- মানুষ তো সবাই। বলছিলাম, মেয়ের হাতের লিখায় আপনাদের নামের আগে বা পরে কোনো টাইটেল দেখছি না।
-
ও আচ্ছা। টাইটেল? টাইটেল একটা ছিল বেয়াই। আমার বাপচাচারা নামের শেষে
"খাঁন" লিখতেন। স্বাধীনতার পর থেকে আমরা সেই টাইটেলটি ব্যবহার করছি না। আর
সবাই মানুষ হলেও সত্যিকারে মানুষ সবাই নয়। সবাই যদি মানুষ হতো তাহলে আমরা
আমাদের ছেলেমেয়েদের মানুষ করার জন্য এতো চেষ্টা আর ত্যাগ স্বীকার করতাম না।
- হাসালেন বেয়াই। স্বাধীনতার সাথে টাইটেলের কী সম্পর্ক? আপনি সম্ভবত আমাকে নীতিকথা শুনিয়ে নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করছেন।
- দেখুন বেয়াই সাহেব। আপনি আমার বাড়ির মেহমান। আপনার সাথে আমিও প্রাণখোলে হাসতে চাই।
- বিয়েশাদির বিষয় হাসি দিয়ে চলে কি? আপনি সত্যিকথা বললে আমরা খুশি হবো। আমি আমার সোনার টুকরো ছেলের জন্য একটা ভাল জাতের মেয়ে খুঁজছি।
- তা খুঁজেন। আমি বলি, ব্যবহারেই বংশের পরিচয়।
- আমি আপনার নীতিকথা শুনতে আসিনি ভাই।
- হা হা হা! কেন আসছেন সেটা তো আমি জানি ভাই।
- জানেন যখন, এটাও জেনে নিন, চৌধুরীবাড়ির ছেলেমেয়েরা জাত বংশ দেখেই বিয়েশাদি করে।
- আপনিও জেনে নিন ভাই, আমি আমার মেয়েকে একজন ভাল মানুষের ঘরে বিয়ে দিতে চাই। কোনো টাইটেলের ঘরে নয়।
-
আমরা এখন উঠবো ভাই। বিয়ে হচ্ছে সারাজীবনের একটা বন্ধন। এই কাজটা সম্পন্ন
করার আগে অনেক ভেবেচিন্তে করতে হয়। পরের তিক্তিতার চেয়ে আগের তিক্ততা ভাল।
আপনি মানি মানুষ। আমার কথায় মন খারাপ করবেন না। আপনার মেয়েকে আমাদের খুব
পছন্দ হয়েছে। শুধু মেয়ে পছন্দ হলেই হবে না। মেয়ের জাত বংশও দেখতে হবে। ভাল
হতে হবে। আমরা এবার আসি। আসসালামু আলাইকুম।
- ওয়ালাইকুম আসসালাম। জ্বী আসুন।
মেহমানরা
উঠে দাঁড়ালেন। স্যার আর খালাম্মাও বসা থেকে উঠলেন। সুরাইয়া মাথা নিচু করে
বসেই রইলো। মেহমানগন একএক করে ঘর থেকে বেরুলেন। স্যার আর খালাম্মাও
মেহমানদের সাথে বেরুলেন। মেহমানদের স্বসম্মানের সাথে বিদায় দিবেন। বিদায়
দিতে কিছুটা এগিয়ে দিবেন। গাড়ি পর্যন্ত যাবেন তারা। আমি এখনও আমার স্থানেই
অনড়। মেহমানদের সেবায় নিজেকে আর নিয়জিত করলাম না। কেন করলাম না নিজেও জানি
না। কেন দাঁড়িয়ে রইলাম বুঝতে পারিনি। কেমন জানি হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম আমি।
আমার
সামনে শুধুই সুরাইয়া। সুরায়ার সামনে আমি। আমি নির্বাক হয়ে সুরাইয়াকে
দেখছি। কান্না সামাল দিতে পারছে না সে। ফুঁপিয়েফুঁপিয়ে কাঁদছে। সুরাইয়ার
লজ্জা দেখেছি। হাসি দেখেছি। রাগ দেখেছি। আজ তাকে কাঁদতে দেখলাম। হৃদয়ভাঙা
কান্না নীরব কান্না। সুরাইয়ার হৃদয় কতটা ভেঙেছে? কেন ভেঙেছে? আমি জানি না।
তবে আমার হৃদয়ে যে ঝড় বইলো তা সামাল দিতে পারলাম না। রীতিমত লণ্ডভণ্ড হয়ে
গেলাম। কী বলবো ভাষা খুঁজে পেলাম না। একবার শুধু বললাম, কাঁদছো কেন
সুরাইয়া? সুরাইয়া বারবার অশ্রু মুছে কী যেনো বলার চেষ্টা করছিল আমাকে।
(সমাপ্ত)