প্রচ্ছদ-
যে নদী যতো গভীর,তার বয়ে চলার শব্দ ততো কম। শব্দের বিবেচনায় গভীরতার বিচার বোধকরি বহতা নদীর নামে খুব সহজে হয় না। কাল হতে কালঅবধি অণে¦ষী দৃষ্টির গন্তব্য গিয়ে মিশেছে নদীর উৎসে, মিশেছে জীবনের উৎসে।আর প্রবহমান জীবনের যাপিত সময়টুকু মানুষ ব্যবহার করেছে নিজেকে টিকিয়ে রাখায়।এরই মাঝে গড়ে উঠেছে নিবিড় সম্পর্ক মানুষে মানুষে। মিলন বিরহ, প্রেম-ভালাবাসা আর সামাজিক নানা সম্পর্কের উত্থান-পতন ঘটে জীবন বসতির বর্নিলতায় ।যাকে চোখ দিয়ে দেখে শুধুই দেখার সহজ অর্জন হয় কিন্তু অন্তরে ধারণ করতে হলে দেখতে হয় মন দিয়ে।আর এমন দেখার এক অভিনব দর্শক হলেন কবি জীবননান্দ দাশ। তার সাথে পরিচয় নাই এমন বাঙালি বাব্যপ্রেমিকের সংখ্যা হয়তো হাতে গোনা। তবে ঔপন্যাসিক জীবননান্দের সাথে হয়তো অনেকেরই পরিচয়ের বৃত্তটা খুব একটা বড় না।তিনি যে কাব্য রচনার পাশাপাশি উপন্যাসেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন তার প্রকাশ হয়েছে জীবনাবসানের অনেক পরে।
উপন্যাসের রং-রূপ পূর্বে যা-ই থাকুক না কেনো বর্তমানে আধুনিক শিল্প সৃষ্টির ধারায় এসে পৌঁছেছে।যদিও কাহিনী প্রধান গদ্যশিল্পের অনবদ্য রূপ হিসেবে উপন্যাস প্রকাশ পাচ্ছে তবুও পারিবারিক,সমাজিক কিংবা রাজনৈতিক জীবনদর্শনের বর্ণনা মূলত গদ্যে ঠাঁই পাচ্ছে। উপন্যাসে মানব জীবনের গূঢ় তত্ত্ব ফুটে উঠে।আর তার সাথে অত:প্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে ব্যক্তি,সমাজ জীবন ও সমকালীন চিত্র।কিন্তু এ সবের সাথে যা ঘটনাবলীকে উপন্যাস হতে সাহায্য করে, সাহায্য করে গল্পকে মানুষের কাছে নিয়ে আসতে তা হলো, লেখকের অপূর্ব জীবনবোধ।তাই এধর্মী লেখাকে জীবন অণে¦ষী শিল্পকর্ম বললেও বোধকরি অসমীচীন হবে না।
জীবননান্দ দাশ নামটি শুনলে চোখের সামনে ভেসে উঠে সৌম্য-শান্ত,ভাবাবেগি এক কবির ছবি।‘বনলতা সেনে’র কথা মনে পড়ে।কবি রূপসী বাংলাকে ভালোবেসে সাহিত্যজগতে দেশ প্রেমের এক ভিন্ন স্বর তৈরি করেছিলেন।এক কথায় বলতে গেলে তিনি কবি। তবে ঔপন্যাসিক হিসেবেও তিনি সমান গুরুত্বপূর্ণ। বিংশ শতকের বিশ্ব রাজনৈতিক উত্তপ্ততা, সামাজিক অবক্ষয়,নৈতিকস্খলন,অর্থনৈতিক বিপর্যয়, মূল্যবোধের বিচ্যুতি,জীবনের জটিলতা,অবসাদ,নৈরাজ্যকে উপন্যাসে লেখক যেমন ঠাঁই দিয়েছেন তেমনি জীবনের সত্যকে জীবনে রূপায়িত করতে প্রকৃতি,ইতিহাস-ঐতিহ্যে ডুব দিয়েছেন। ফলে তিনি একদিকে যেমন অবজেক্টিভস লাইফের নার্সিং করেছেন অপর দিকে তেমনি সোস্যাল উইটনেস এডব করেছেন। দৈনন্দিন জীবনের যুক্তিসিদ্ধ অস্তিত্বের ঊর্দ্ধে অবস্থিত কোনো এক চৈতন্যময় সত্তার অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে তার উপন্যাসে।তাই বাংলা কবিতার মতো উপন্যাসের পরম্পরায় জীবনানন্দ দাশ একটা বিশেষ স্থান ধারণ করেছেন।১৯৫৪ সালের অক্টোবর যখন কবির মৃত্যু হয়,তার পূর্ব পর্যন্ত অজানা ছিলো তার উপন্যাস লেখার ব্যাপারটি।অথচ ১৯২৮-এ যখন ‘ঝরাপালক’ বের হয় তখনই তিনি বাংলাভাষার শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে পঠিত। এছাড়া ‘ধূসরপা-ুলিপি’(১৯৩৬), ‘বনলতাসেন’(১৯৪২),‘মহাপৃথিবী’(১৯৪৪),সাতটি তারার তিমির’(১৯৪৮),‘জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা’(১৯৫৪),‘রূপসী বাংলা’(১৯৫৭),‘বেলা অবেলা কালবেলা’(১৯৬১) এমন সব সাড়া জাগানো কবিতা গ্রন্থ বের হচ্ছে তখন ১৯৪৮-এ লেখা চারটি উপন্যাস বাক্সবন্দীই থেকে যাচ্ছে ।কবির মৃত্যুর অনেক পরে উপন্যাস চারটি প্রকাশ পায়। যথাক্রমে-‘মাল্যবান’ ‘ সুতীর্থ’ ‘জলপাইহাটি’ ‘ বাসমতীর উপাখ্যান’ তখনো কবির উপন্যাস পা-ুলিপি সম্পূর্ণরূপে পাওয়া যায়নি।১৯৩৩-এ আরও পাঁচটি উপন্যাস লিখেছিলেন। জীবনানন্দ দাশের উপন্যাসে বিশেষত:১৯৩৩ থেকে ১৯৪৮ এই পনের বছর সময়ের ব্যাবধানে একদিকে বিংশ শতাব্দীর বিপন্ন মানবতার ছবি অঙ্কন করেছেন অন্যদিকে টি এস এলিয়টের ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’-এর হতাশা,নিঃসঙ্গতা, নেতিবাচকতা প্রকাশ পেয়েছে। ‘মাল্যবান’ এমনই নিঃসঙ্গ মানুষের পটভূমি।কবি জীবনানন্দ সখের বসবর্তী হয়ে এসব উপন্যাস লেখেননি। উল্লিখিত পনেরটা বছর কবির ভেতর উপন্যাসের জোয়ার বয়ে গেছে। তা না হলে ‘জলপাইহাটি’ ও ‘বাসমতীর উপখ্যান’ ( প্রায় চার’শ পৃষ্ঠার মতো) দুটি উপন্যাস প্রকাশ সম্ভব হতো না। একই সত্তার দুটি রূপ কবি জীবননান্দ ও ঔপন্যাসিক জীবনানন্দ। জীবনানন্দের ভেতর লক্ষ্য করা যায় নারী-পুরুষের জাগতিক প্রেম,আর চরিত্রের নাম এক একটা কাহিনী বহন করে যেমন- বনলতাসেন, অরুনিমা সান্যাল,সবিনয় মুস্তফী বা রহিম এরা প্রত্যেকে নাম বৃত্তে গল্প আখ্যান। ‘অনুপম ত্রিবেদী’ ‘ মহাপৃথিবী’র অন্তরগত চরিত্রগুলো গল্প থেকে এসেছে। জীবনানন্দ তার ঔপন্যাসিক সত্তাকে খন্ড খন্ড করে কবিতায় কবিতায় রুপান্তর করতে চেয়েছেন। ঔপন্যাসিক সত্তার আড়ালে গল্পকারে চরিত্রটি উঁকি দেয় ১৩৪৪-এ প্রকাশিত ‘আট বছর আগের একদিন’ উপন্যাসের সম্ভবনায় পুষ্ট আকারে ছোট গল্প। ১৯৩০-এ উপন্যাস লেখার চেষ্টা করেছিলেন আর ১৯৩১-এ এসে শুরু করেছিলেন ছোট গল্প। ১৯৩৩-এ প্রকাশিত ‘প্রেতিনীর রূপকার’ ‘জীবনপ্রণালী’ ও ‘কারুবাসনা’ কবির লেখা এই তিনটি বড় গল্প উপন্যাসের সমগোত্রিয়। প্রেতিনীর রূপকথায় এক অশরীরী প্রেমের আখ্যান ফুটে উঠেছে। উপন্যাসটি শুরু হচ্ছে একেবারে কঠোর বাস্তবতা থেকে।Ñ “ শুনেছিলাম জায়গা জমি আছে, জমিদারের ছেলে,আবার কপাল খুললো বুঝি। কিন্তু বিয়ের আগেই বুঝেছিলাম অত সুখ কি আমার সইবে” স্ত্রীর এই সামান্য সংলাপেই উপন্যাসের ভিন্ন স্বর স্পষ্ট হয়ে আসে।বাঙালী মধ্যবিত্ত সংসারের সাহসী যুবক বেকার অবস্থায় বিয়ে করার সাহস পায়।একজন এম.এ পাশ ছেলের ঐ বয়েসে জুতো সেলাই শিখার ইচ্ছে জাগে। অলৌকিক অরণ্যের ভেতর থেকে এ উপন্যাসে মালতির যেমন রোমান্টিসিজম বেরিয়ে এসেছে তেমনি শেষ বাক্যে পক্ষী জীবন পাবার বাসনাও এসেছেÑ“ আমার মনে হয় ভবিষ্যতে কোনো এক জীবনে পক্ষীর জীবন পাব ;হয়তো সিঙ্গপুরের এক জঙ্গলে ময়না হয়ে জন্মাব, কিংবা তোমাদেরই এই আম কাাঁঠালের ডালে টুনটুনি হয়ে আসা-দাম্পত্য না হোক , ভালোবাসা ও জীবনের এক নতুন আস্বাদ পাব সে দিন।” ১৯৩৩-এ আর একটি প্রকাশিত উপন্যাস‘জীবনপ্রণালী’ যা প্রকাশনীর সংস্পর্শে এটির নামকরণ হয়েছে লেখক নিজে দেননি।এ উপন্যাসে বিবাহিত জীবনের সংলাপ বিস্তৃত।কেন্দ্রীয় চরিত্র অঞ্জলি। মাস ছ‘য়েকের দাম্পত্য জীবনের একমাত্র মেয়ে তাও নেই, নেই স্বামী। হিন্দু নারীর সব রিচ্যুয়াল মেনে কাটিয়ে দেয়া এ নারীর জীবনে অমলের দেয়া চিঠি উপন্যাসে ভিন্ন স্বর তৈরি করে। অমল যে জীবন পথের ওপর আধুনিক যুগের চুম্বন এঁকেছে তা অর্বাচীন পন্থি সমাজের চোখ খারাপ,তা উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র অঞ্জলি নিঃসম্বল সংসার ও অজেয় নারীত্বের অন্তক্ষরণে দেখিয়ে গেছে। ১৯৩৩‘র আর একটি উপন্যাস‘কারুবাসনা’ যেটির নামকরণ জীবনানন্দ করেননি। সেখানেও জীবন সংসারের মুখচ্ছবি গভীরভাবে দেখা দিয়েছে যেমনÑ“যদি বিবাহ না করতাম, সন্তান না হতো আমার, যদি একা থাকতাম আমি-তা হলেও শিল্পসৃষ্টি ভালোবেসে, সংসারে বিফল হয়ে,মনের ভিতর কোন নিরবিচ্ছিন্ন বেদনা থাকতো না।হয়তো লঘুভাবে থাকতো।তার জিজ্ঞাসা:সমস্ত কারুতান্ত্রিকই কি সংসারে স্ত্রীর প্রতি এমনভাবে উদাসীন?” এমন প্রশ্নের আবহমান ধারার বীজ এ উপন্যাসে রয়ে গেছে।
দুই.
১৯৩৩’র পনের বছর পর ১৯৪৮-এ প্রকাশিত চারটি উপন্যাস তাৎপর্যপূর্ণ। এরমধ্যে‘মাল্যবান’ ও ‘সুতীর্থ’ দুটি উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র পুরুষ। আর অপর দুটি উপন্যাস ‘জলপাইহাটি’ ,‘ বাসমতীর উপখ্যান’ যার নামকরণ কাল্পনিক স্থানের ভিত্তিতে। লক্ষ্যণীয় যে এ নামকরণও জীবনানন্দের নিজের দেয়া না। তাঁর জীবদ্দশায় নামকরণ হয়নি। মাল্যবান(১৯৭৩), সুতীর্থ(১৯৭৭),জলপাইহাটি(১৯৮৫),বাসমতীর উপাখ্যান(১৩৯৫বাং)-তে প্রকাশিত হলেও লেখকের জীবদ্দশার দৈন্যতা বিন্দুমাত্র সঙ্গ ছাড়েনি। বিশিষ্ট সমালোচক ক্লিন্টন সিলি জীবনানন্দের উপন্যাস রচনার সাথে অর্থ কষ্টের সম্পর্কের কথা আলোচনায় স্বীকার করেছেন । তাই ১৯৪৮এর উপন্যাসের মূল পুরুষ চরিত্রে জীবননান্দ কেন্দ্রীয়ভাবে উপস্থিত। কিন্তু পাঠকের কাছে টেক্সটটাই মূখ্য, আর এই চেক্সটের ওপর সে সময়কার কনটেক্সট-সমাজগত, দেশগত, শ্রেণীগত চাপ উপলদ্ধি করা যায়।ঔপন্যাসিকের ব্যক্তিজীবন উপন্যাসে স্পর্শকের মতো প্রকাশ পাই এটা সত্য।
তিন.
‘মাল্যবান’ উপন্যাসটি সমাজের একটা বিশেষ মধ্য বয়সী ,মধ্যশ্রেণীর বাঙালী দম্পতির সম্পর্কের স্টাডি। এ উপন্যাসটি জীবনানন্দের দুর্বলতম উপন্যাস তবে মাল্যবানই১৯৩৩-এর বলিষ্ঠ লেখক সত্তার রেশ বহন করছে। বহুরৈখিক কামতাড়িত‘মাল্যবানে‘র নায়ক মাত্র একবার দার সঙ্গ গ্রহণ করেÑ“এ রাতটা মাল্যবান ও উৎপলার বেশ নিবিড়ভাবেই কাটল। সমস্ত রাত- সমস্তটা শীতের রাত” এই সংলাপের মাধ্যমে অথাৎ ‘নিবিড়ভাবে’ এ কথার মধ্য দিয়ে দাম্পত্যজীবনের সঙ্গতাকে বুঝিয়েছেন। মাল্যবানে উৎপলার পুরুষবেষ্টিত নারী চরিত্রটি বাংলা উপন্যাসে ব্যতিক্রম। তবে ১৯৩৩-এর কাছাকাছি সময়ে লিখিত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের নারী চরিত্র এ উপন্যাসের নারী চরিত্র একমাত্রিক।
মাল্যবানের পাশাপাশি ‘সুতীর্থ’ উপন্যাসটি লেখেন তাঁর চেনা জগতের বাইরে দৃষ্টি দিয়ে। ১৯৪৮ এ লেখা উপন্যাসগুলি জীবনানন্দ লেখেন পূর্বপাকিস্তান ছেড়ে আসার পর, কোলকাতায় বসে। তাই এ উপন্যাসে দেখা যায় মাল্যবানের স্বামী-স্ত্রী’র সম্পর্কে বদ্ধ বলয়টি ভেঙে ভাগ ভাগ হয়ে যায়। আসলে সুতীর্থ উপন্যাসটি বাসমতীর উপাখ্যানের সিদ্ধর্থর মত,জীবনানন্দের পুরুষ চরিত্রের বিপরীতে। সুতীর্থ একদিকে যেমন শ্রমিক আন্দোলনে জড়াতে চেয়েছিলো অপর দিকে মনিকাকে ধর্মঘটে জড়িয়ে জয়তীকে নিয়ে গ্রামে যেতে চেয়েছিলো। বাঘ-বাঘিনীর উপমায় মনিকার প্রতি সুতীর্থর কাম আকর্ষণ লক্ষ্য করা যায়। এখানে লেখকে অন্তঃযন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। কারণ দেখা যায় জীবনানন্দের কোন মূল পুরুষ চরিত্রই আর্থিকভাবে স্বচ্ছল নয়।
চার.
‘বাসমতীর উপাখ্যান’ ও ‘জলপাইহাটি’ উপন্যাস দুটি জীবনানন্দের সবচেয়ে উচ্চাক্সক্ষী উপন্যাস। উপন্যাস দুটি পূর্ববঙ্গের মফঃস্বল মানুষদের কাহিনী। ‘বাসমতীর উপাখ্যান’ উপন্যাসটির প্রধান চরিত্র‘বাসমতী’ যার পৃথিবীই উপন্যাসের বিষয়। যে পাকিস্তানে পড়াশোনার পশাপাশি কোলকাতাতেও পড়বে। কিন্তু দেশের বিচ্ছিন্নতা তাকে বিচলিত করেÑ“দেশ এখনো স্বাধীন হয়নি, হবে শিগগিরই জোর বৈঠক হচ্ছে সব চারদিকে,স্বাধীন হবে,দু টুকরো হবে,কাটাঁেছড়া না করে স্বাধীনতা ভোগ করার সম্ভাবনা খুব কম।” উপন্যাসের শুরুর এই পটভূমিই স্পষ্ট করে তৎকালীন অবস্থাকে। কিন্তু বিভাজিত সীমারেখার নো ম্যানস্ ল্যান্ডে দাঁড়িয়ে বাসমতীর ব্রাক্ষসমাজ বাসমতীর অন্তরে বিভাজ্যের ধারপাত পুসব্যাক করতে পারে না। এছাড়া আত্মকথনের মাধ্যমে‘বিভা’ নামের উপন্যাসটির সূচনা করেন লেখক।এখানে বিভাকে কেন্দ্র করে লেখক যে অসাধরণ উপমার ব্যবহার করেন তা পাঠককে নিঃন্দেহে বিমোহিত করে যেমনÑ“বিভার মুখের লাবণ্য বেশ উচ্চজাতীয়। সচরাচার এ-রকম সৌন্দর্য চোখে পড়ে না। খুব অবর্ণনীয় সৌন্দর্য নয়Ñকিন্তু এর বিশেষ ধরনটা আমার কাছে বড্ড চিত্তাকর্ষক।” আবার সৌন্দর্যের কথায় বলছেন-“একটা ছিপছিপে নিমীলিত চাঁপাফুল, কিংবা শীর্ণ একটা উন্ম ুখ চাঁপার কলির মতো নারীর আঙুলের দিকে তাকালে এ সৌন্দর্য উপলদ্ধি করতে পারা যায় যেন” এই মেয়েটি ষোল-সতের বছরে মারা যায়। বিভা নামের মেয়েটির মুখ লেখকের মানসপটে বারবার ভেসে উঠে। সেই মেয়েটির করুণ মৃত্যু কবি লেখককে দারুণভাবে ব্যথিত করে।আর তার সাথে কথোপকথন ও বিভিন্ন চরিত্রের সাথে কাকাতুয়া,ময়না,টিয়া এমন পাখির রুপক কথার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে উপন্যাসের কাহিনী। আর ‘নিরুপম যাত্রা’র নিরঞ্জন একজন সরস মানুষ। যে আনন্দের কথা বলে। তবে এ উপন্যাসের শেষে এসে আবারও এবং মৃত্যুর কথা এসেছেÑ“পৃথিবীর বাজপাখির নয়Ñ চড়–ইপাখি,শালিখ পাখি,এই উদাসী,করুণ,সংসারের কর্তব্য-সংগ্রামনিষ্পেষিত বন্ধনাত্মা যুবক কোনোদিন তার প্রমত্ততম কল্পনায়ও মনে করে নি যে এই মেসে সে মরবে” আর এই উপন্যাসে ড্রিল মাষ্টার ছিলেন দ্বিজেনবাবু ও দেবদারু, মেহেদি গাছের কথাও এসেছে।কার্তিকবাবুর অনুপম প্রবেশও ঘটেছে এখানে। প্রতিটি জীবজন্তু আর বস্তুর অন্তজ্বালা,অন্তকথন অলোৗকিক আরাধ্য সাধনে জীবনানন্দ আলিঙ্গন করেছেন।হৃদয়ঙ্গম করেছেন নিজের ভেতর। আর তার চুম্বকীয় আকর্ষণে কাছে টেনেছেন পাঠককে।
পাঁচ.
‘জলপাইহাটি’ উপন্যাসের মূল দুই চরিত্র পিতা নিশিথ ও পুত্র হারীত। জলপাইহাটি কে ঘিরে যাদের বেড়ে ওঠা, উপার্জনের খোঁজে দূরে যাওয়া, হারীতের সাথে অর্চনার পরিচয়ের মধ্য দিয়ে জীবন যৌবনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতি, প্রেমের উজ্জীবন পরিলক্ষিত হয়। উপন্যাস পরিক্রমায় মনে হয় জীবনানন্দ অনেকটাই নারী বিদ্বেষী। আসলে কী তাই ? তাঁর উপন্যাসে নারী-পুরুষের সম্পর্ক‘মাল্যবান’ ব্যতীত সব উপন্যাসেই পরিণত,সহজ নয় স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক। তারপরও সাহিত্য যেহেতেু মনন ও চৈতন্যেবোধের আধার ফলে পরিবর্তনশীল মানব চৈতন্যের সারথী হিসেবে সাহিত্যে বারবার পালাবদল ঘটে।তাই রোমান্টিসিজম শেষে শুরু হয় রিয়ালিজম এবং রিয়ালিজমের রুঢ় রাহার ভেতর এক তীক্ষ্ম বোধের উৎসারণ ঘটে যা বিশ্ববাস্তবতার বীক্ষণে একবিংশ শতকের সার্থক সহযাত্রী হয়ে হেঁটে যাবে উপন্যাসের পথে।
গ্রন্থ সহায়ক
১. আধুনিক বাংলা কাব্যপরিচয়-দীপ্তি ত্রিপাঠী
২. জীবনানন্দ প্রতীভা-রবীন্দ্রনাথ সামন্ত
৩. কবি জীবনানন্দ দাশ-সঞ্জয় ভট্টাচার্য
৪. জীবন শিল্পী জীবনানন্দ-ড.আসাদুজ্জামান
৫. জীবনানন্দ দাশের কাব্য সংগ্রহ-দেবী প্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত
৬. পার্থ প্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায়-জীবনানন্দ উপন্যাসের ভিন্ন স্বর
৭. শ্রেষ্ঠ জীবনানন্দ-আবদুল মান্নান সৈয়দ সংকলিত ও সম্পাদিত
৮. জীবনানন্দ দাশের প্রেম-মতিউর রহমান মতি