প্রতি মাসেই ভাড়া নিতে এসে একটানা খানিক্ষন বক বক করে যায় লোকটা। নিজের সুখ দুঃখের কাহিনী, অভাব অনটনের অতীত গল্প বলে বেড়ায়। তখন তারা থাকত মেঘনার কুল ঘেঁষা কলাপাড়া গ্রামে। বাপদাদার ভিটায়। নদী ভাঙ্গনের কবলে বসতভিটা ভেসে যাওয়ায় পুরো পরিবারসমেত ভৈরবের কমলপুরে চলে আসে। আজকের কমলপুর তখন ছিল উলুখাগড়ার বন। রাত বিরাতে শিয়ালরা দল বেধে হুক্কাহুয়া ডাকত। কারো কারো চোখে নাকি মেছো বাঘ আর হরিণ টরিণের ও দেখা মেলত। এখন যে ঝকঝকা কমলপুর তখন এই কমলপুরের নামগন্ধও ছিলনা। লিবারেশনের পরে এর চেহারা পাল্টাতে শুরু করল। তারপর বাপ মরল, মা মরল। একটা জুট মিলে দারোয়ানের চাকরি জুটিয়েছিল, জুট মিলটাও কিভাবে বন্ধ হয়ে গেল। কত ধান্ধাবাজরা চোখের পলকে বড়লোক হয়ে গেল। গত দুই বছরে সেই একই গল্প কতবার যে শুনতে হলো সজলকে বাড়িওয়ালা আনিস সাহেবের মুখে তার হিসেব নেই।
আনিস সাহেবের এই বাড়িটার দুতলায় ভাড়া থাকে সজল-মৌরি দম্পত্তি।তিনতলা বিশিষ্ট বাড়িটার দুতলায় বেশ বড়সড় একটা ড্রয়িংরুম, লিভিং রুম, রান্নাঘর, ছোট্র একটা স্টাডিরুম। আর মনভুলানো পূর্ব-দক্ষিণ খোলা বারান্দা। বারান্দার গ্রিল ঘেঁষে দু দুটো বড় আম গাছ, পাশেই একটু দূরে কালের স্বাক্ষী হয়ে একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা প্রাচীন তালগাছ। তালগাছটা ঘিরে রয়েছে ছোটখাট একটা জঙ্গল। শুবার ঘরের জানালা দিয়ে শুয়ে শুয়ে জোছনা দেখা যায়।
সারাদিন অফিসে খাটাখাটনির পর ক্লান্ত দেহ চায় একটু প্রশান্তি। সেই শান্তির খোঁজেই খোলা বারান্দায় কফি হাতে বসে আছে সজল। শেষ বিকালের মন খারাপী আকাশ মেঘ লুকোচুরি দিনের সুবাস দিয়ে রাতের আমানিশায় ডুবে যেতে প্রস্তুত হচ্ছে। দিনের আলো হয়তো আর পাওয়া যাবে ঘণ্টা খানেক। আজ ঘরের পাশের আকাশটাও অন্য রকম লাগে।ডুবন্ত সূর্যের মৃদু ওম ছুয়ে যায় হৃদয়,কোন এক শীতলতার স্পর্শে সিক্ত হতে চায় দেহ, মন, আত্মা। ততক্ষনে সন্ধ্যা নেমে এলো,রাতের আঁধারে চারপাশে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। আরাম কেদারায় বসে দূর অন্ধকারে তাকিয়ে আছে সজল। ভাবনার আকাশ তার একেবারেই শুন্য। অফিস থেকে ফিরে এই সময়টায় খোলা বারান্দায় আড্ডা আর কফি খেতে খেতে মৌরির সাথে একান্তে সুন্দর সময় কাটায় সজল। আজ মৌরি বাসায় নেই।রুমের এলইডি লাইটের খানিকটা বারান্দায় এসে পড়ছে। ফলে বারান্দায় একটা আলো আধারি লুকোচুরি খেলা চলছে।
বারান্দায় বসে একটার পর একটা সিগারেট ফুকছে আর এতাল-বেতাল অনেক স্মৃতিই আওড়াচ্ছে সজল। সজলের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের মিঠামইন হাওরে। হাওরের বুকেই কাটে তার শৈশব-কৈশোর। ফেলে আসা হাওরের সময় গুলো কেন জানি আজ খুব মনে পড়ছে সজলের।নাগেশ্বরী হাঁসের গোশত ভুনা, আহা কি স্বাদ! ভাবতেই যেন জিবে জল চলে আসে। হাওরের ভরা বর্ষা তাকে সব সময় ই টানে।কি চমৎকার হাওরের পরিবেশ! পানির নিচে লতা পাতা জলজ উদ্ভিদগুল্ম যেন গড়ে তুলেছে অপরূপ সবুজের স্বর্গরাজ্য। হাওরের নীলাভ জলরাশি কেটে কেটে কি সুন্দর সামনে এগিয়ে যায় ডিঙ্গি নৌকা।গলুইয়ে হেলান দিয়ে দুপা স্নিগ্ধ জলে আচড়ে দিয়ে বসে থাকতে কতই না ভাল লাগে। উপরে যত দূর চোখ যায় নীল আকাশ,মনশুধু চায় হারিয়ে যেতে এই নীলাভের নীলিমায়।
ঘাস ভরা মাঠে চড়ে বেড়াচ্ছে গরু মহিষের পাল। হাওরের এই নীলাভ জল রাশিতে বালি হাঁস, পানকৌড়ির জলকেলি কতই না মনোমুগ্ধকর। দূর থেকে দেখা গ্রাম গুলো যেন জলে ভাসমান,যেন জলেই তাদের বাস। এই এলাকার অধিকাংশের জীবিকা মাছ ধরা। সবাই পেশাদার জেলে এরকমও নয়। বেশিরভাগই মৌসুমি জেলে। পেশায় কৃষক,সারাদিন জমিতে কাজ করে। রাত হলে অনেকেই ছোট্ট কোসা অথবা ডিঙ্গি নৌকা আর হেজাক লাইট কিংবা টর্চ নিয়ে ছুটে মাছ ধরার জন্য। হাওরের বুকে শঙ্খচিলের ছু মেরে মাছ শিকারের দৃশ্যটাও এক অন্যরকম ভাল লাগে সজলের ।শঙ্খের মত সাদা এদের মাথা,ঘাঢ়,বুক,পেটের তলা’র পালক আর তাই বুঝি এদের নাম হয়েছে শঙ্খচিল। কিন্তু ডানা দু’টি ও শরীরের অন্যান্য অংশ খয়েরী কিংবা সোনালী হওয়ায় কেউ কেউ সোনালী ডানার চিলও বলে এদের। প্রায় বিপন্ন প্রজাতির এই চিল বাংলার আকাশে আগের মত খুব একটা দেখা না গেলেও সজলের স্বপ্নের আকাশে প্রায়ই জোছনার সঙ্গী হয়ে ধরা দেয় এই শঙ্খচিল । ইদানিং একটু বেশিই। সুনীল আকাশে উড়তে উড়তে হঠাৎ ছু মেরে হাওরের বুক ছিড়ে শঙ্খচিলের মাছ শিকারের দৃশ্যটা আজ খুব মনে পড়ছে তার। রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাসের কবিতায় এই শঙ্খচিল খুব দেখা যায় । হাওরের মন মাতানো স্মৃতিতে মুগ্ধ হয়ে সজলের মনে জীবনানন্দের সেই বিখ্যাত কবিতা উকি দেয়ঃ
“আবার আসিব ফিরে ধান সিড়িটির তীরে এই বাংলায়-
হয়তো মানুষ নয় হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে-
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে-”
অফিস থেকে ফিরে বাসার গেইটের সামনে অনেকক্ষণ ধরে হাঁটাহাঁটি আর দোলাচালে ভুগছে সজল। এখনই বাসায় ঢুকবে নাকি বাইরে থেকে আরও খানিকটা সময় হাওয়া খেয়ে তারপর বাসায় যাবে? হঠাৎ কে যেন পিছন থেকে বললো,-বাসার সামনে এমন করে ঘুরঘুর করছেন কেন ভাই? পিছনফিরতেইসজল জ্ঞান দার মুখোমুখি। আনিস সাহেবের বাসার আরেক ভাড়াটিয়া উনি। জ্ঞান দা নামটা সজলের দেয়া। ভাল নাম নেসার উদ্দিন জুয়েল।একটা বীমা কোম্পানিতে একাউন্ট্যান্ট হিসেবে আছেন। মানুষ হিসবে অতটা খারাপ না। মজার লোক বটে। তবে বেশি মাত্রায় জানার ভান করে থাকেন। মনে হয় সবজান্তা শমসের। খালি জ্ঞান দেয়। এই রকম বিরক্তি থেকেই লোকটাকে সজলের এমন উদ্ভট নাম দেয়া। উনার ধারনা সজল খুব বউ পাগলা। তাই যখনই দেখা হয় সজলের বউ এর প্রসঙ্গে কথা বলতেই হয় জ্ঞান দার। কাঁচাবাজার থেকে এলো মনে হয়। বাজারের ব্যাগ দুটো রিক্সা থেকে নামাতে নামাতে কথা বলে সজলের সঙ্গে।
-জানেন সজল ভাই জ্ঞানী লোকেরা কিন্তু আমাদের মত বউকে এত পাত্তা দেয়না। তার মতে স্ত্রীকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে নেই।খুব কঠোর হতে হবে বউ এর প্রতি। সব সময় বউকে বেশি বেশি ভালোবাসলে নাকি বউয়ের কাছে স্বামীর ভালোবাসাটা সস্তা হয়ে যায়। কিছুই বলেনা সজল। অন্য মনস্ক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এমনিতেই আজকে মেজাজ টা অনেক খারাপ। অফিসে ঝামেলা চলছে। অফিস আর চাকরি-দুটোর প্রতিই বিতৃষ্ণা দিন দিন বাড়ছে। পড়াশোনা করলেই কি চাকরি করতে হবে? চাকরি টা ছেড়ে দিলে কেমন হয়? সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে বাসায় ঢুকে সজল।
মৌরি এখন আর আগের মত খুব একটা সাজুগুজু করেনা। কি মনে করে আজ খুব ঘটা করে সাজলো ও। নাহ! আজ কোথাও কোন দাওয়াত টাওয়াত নেই। এমনি নাকি সেজেছে। হয়তবাসজলের জন্যই মৌরির এই সাজ।‘কালো শাড়ি,সাথে সাদাকালো রেশমি চুড়ি , চোখে হালকা কাজল,কপালে কালো টিপ, খোলা চুলে’ দেখতে তো ভালই লাগছে। ঠিক যেন কোন উপন্যাসের জীবন্ত নায়িকা। মনে মনে কথাটা ভাবছে সজল কিন্তু মুখে কিছুই বলেনা। রাতের খাবারের পর দুজনে বসে টিভি দেখতে দেখতে মৌরি ঘুমিয়ে পড়লেও সজল এখনও জেগে আছে। ইদানিং একটা খুব বাজে অভ্যাস পেয়ে বসেছে সজলকে। নির্ঘুম রাত। একটা সময় ছিল যখন শোয়া মাত্রই ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিত। ফেইসবুক আজকাল অনেকের মত সজলের চোখের ঘুম ও কেড়ে নিতে ব্যস্ত। অদৃশ্য এই ভার্চুয়াল জগৎ টাতে হামাগুড়ি দিতে দিতে কখন যে ভোর হয়ে এল সজল ঠের ই পায়নি।
ভোর থেকেই আবহাওয়াটা কেমন গুমোট রূপ ধারণ করে আছে। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। এরকম আবহাওয়া দেখলে মনটাও কেমন যেন ভারী হয়ে উঠে তার। প্রকৃতি আসলেই মানুষের মনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বাইরের ঘোলাটে আবহাওয়াটা দেখছিল। হঠাৎ বসের মুখ টা ভেসে উঠলো। কি গম্ভীর মুখখানা! সব সময় ভ্র কুঁচকে থাকে। একটু ও হাসি নেই মুখে। কাজ ছাড়া দুনিয়ার কিছুই যেন তার মনের জায়গা দখল নিতে পারেনা। কি যেন একটা জরুরী কাজে আজ সকাল সকাল অফিসে যেতে বলেছিল সেটা কিছুতেই মনে করতে পারল না সজল। সে যাই-হোক ; বউ এর ভালবাসার টানে আজ এমন বাদল দিনে অফিসে না গেলে কোম্পানীর তেমন কোন ক্ষতি হবে না। আপাতত সেটাই ভাবছে সজল। সুতরাং সিদ্ধান্ত স্থির,আজকের দিনটা শুধুই মৌরির জন্য বরাদ্দ। প্রেম-ভালোবাসা দ্রুহের কাছে বাকি সব দ্রুহ যেন অর্থহীন আজকের সজলকে দেখে তাই ই মনে হচ্ছে।
সজলের ভিভো-৭ এন্ড্রয়েডের প্লে লিস্টে বাজছে,‘শ্রাবণ মেঘের দিন’সিনেমার জনপ্রিয় গান ‘একটা ছিল সোনার কন্যা’। গানটাএমন মুহুর্তের সাথে মিলেমিশে যেন একাকার।বাদল দিনে রোমান্টিক আবহে সোনার কন্যা মৌরি সজলের মনে খুব নাড়া দিয়ে যায়। মৌরির সাথে সজলের বিশ্ববিদ্যালয়ের দারুণ প্রেমের সময়গুলোর কথা খুব মনে পড়ে। এমন বাদল দিনে আমবাগান আর এগ্রোনমি মাঠে কিংবা ব্রহ্মপুত্র নদে নোকায় দুজনে আপন মনে কত ভিজেছে! উপভোগ করেছে প্রকৃতিকে। হাতে হাত ধরে প্রিয় ক্যাম্পাসের ফিশারি আর ডিভিএম করিডোর ধরে কতই না হেঁটেছে। টিউশনির টাকায় মৌরিকে কত বাদাম কিনে খাইয়েছে তার হিসাব বলা মুশকিল। মেঘের ডাক কিংবা বজ্রপাতের শব্দ তাদের কখনো আলাদা করতে পারেনি। সময় পেলেই সজল ছুটে যেত মোরির কাছে। বকুল তলায় মৌরির জন্য অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থেকে থেকে কত যে ভিজেছে সজল। সে ভেজায় পরম আনন্দ ছিল। অনেক সময় জ্বর হয়েছে। আর সেজন্য মৌরির কাছ থেকে বকাও খেয়েছে কম নয়। আবার পরম মমতায় কাছেও টেনেনিয়েছে। সে সুখস্মৃতি আজ এ আবহে কেন জানি বড়ই মনে পড়ছে।
আজ থেকে প্রায় আট বছর আগে মৌরির সাথে পরিচয় সজলের এক বান্ধবী তনুর মাধ্যমে। সজল তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সের ছাত্র। অ্যাসাইনমেন্টের কাজে প্রায়ই লাইব্রেরিতে বসে ওরা। সেদিন লাইব্রেরি ওয়ার্ক শেষে তনুর সঙ্গে হাটতে হাটতে বঙ্গবন্ধু চত্বরের দিকে যাচ্ছিল ওরা। পেছন থেকে কে যেন তনু আপু বলে ডাকল। ফিরে তাকাতেই সজল থ বনে গেল। কি যে মায়াবী এক মুখ! জীবনে এমন মায়াভরা মুখ আজই প্রথম দেখেছে সজল। প্রথম দেখাতেই ক্র্যাশ। মেয়েটার পরনে ছিল ফেরুজাকালারেরথ্রি-পিছ,সাথে ম্যাচিং করা অফ হোয়াইট কালারের প্লাজু। মৃদু হাসি,মেঘবরণকেশ সবকিছু মিলিয়ে এক ভিন্ন আবহ। এমন নান্দনিক আবহে সে যে সোনার কন্যা এটি নিয়ে কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়। অসাধারণ এক সৌন্দর্য তার মধ্যে লক্ষ্য করল সজল। তার শরীরে এক শীতল রক্তের প্রবাহ বয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ঠিক যেন জহির রায়হানের একুশের গল্পের নায়িকা রেণু। পরে বান্ধবী তনু পরিচয় করিয়ে দিল। ওর নাম সৈয়দা মেহজাবিন মৌরি; তার জুনিয়র রুমমেট। এবার লেভেল টু সেমিস্টার ওয়ানে পড়ছে। তারপর তার নাম ফেসবুকে খুঁজে খুজে কম করে হলেও একশটা মৌরিকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে সজল। আসলে বেশিরভাগ মেয়েই তার ফেসবুক প্রোফাইলে নিজের কোন ছবি দেয়না। তাই আন্দাজে ডিল মারে সজল। যদি লাইগ্যা যায় বলে একটা কথা আছেনা!
ক্লাস নেই আজ। লাইব্রেরির ডেস্কটপে বসে ফেসবুক টাইমলাইনে স্ক্রলিং করছে সজল। ইনবক্সে কে যেন নক করল-হায়, ভাইয়া কেমন আছেন? ইনবক্স টা চেক করতেই সজলের চোখ যেন ছানাবড়া! মৌরি তাহলে তাকে অ্যাকসেপ্ট করলো,কিন্তু কোন মৌরি? সেটা জানতে আরও দুচারটে মেসেজ চালাচালি। আর বুঝার বাকি রইল না যে এই মৌরি ই সেই মৌরি। মানে তনুর জুনিয়র রুমমেট। যার জন্য অলরেডি ফিদা হয়ে বসে আছে সজল। অনেকটা অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল সজলের কাছে। যেমনটি ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অস্ট্রেলিয়াকে তাদের নিজ দেশের মাটিতে হারানো। তারপর থেকে দুজনের ইনবক্স ভরা থাকত নিয়মিত। সাড়ে বার’শ একরের সবুজ ক্যাম্পাসে মৌরিকে নিয়মিত বিকেল আর সন্ধ্যার আড্ডার সঙ্গী হিসবে পেতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি সজলের। দীর্ঘ একবছর ভালো বন্ধুত্ব,তারপর প্রেম। কোনো এক জোছনা পূর্ণিমা রাতে নিজের সবটুকু আবেগ আর ভালবাসা দিয়ে স্বরচিত কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে প্রেম নিবেদন। মৌরি অবশ্য সে প্রস্তাবে সাড়া দিতে তিন দিন তিন রাত সময় নিয়েছিল। সেদিনের মৌরির ভালবাসাকে জয় করা সজলের কাছে যেন এভারেস্ট বিজয়ের আনন্দের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না।
মাঝেমধ্যে মৌরিকে বাইকের পেছনে বসিয়ে খুব জুরে ড্রাইভ করত সজল।মোরির খোলা চুল উড়ে গিয়ে পড়ত সজলেরচোখে,নাকে আর মুখে। পরিচিত ঘ্রাণে উতলা হত সজল কিন্তু স্পর্শ করতে পারত না। এই না পারার আফসোস তাৎক্ষণিক এবং বিয়ে নামক দিল্লিকা লাড্ডুটা না গেলা পর্যন্ত ওর মনে খচখচ করত। আর এই খচখচানির কথা ভেবে সেই দিন গুলোতে আসলেই খুব সুখ অনুভব করতো সজল। এরই মধ্যে সজল মাস্টার্স শেষ করে একটা বড় কোম্পানিতে জব ম্যানেজ করে ফেলে। সময়ের সাথে সাথে সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতা পাচ্ছে। নির্ভরশীলতা,বিশ্বাস একে অন্যের প্রতি বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিনিয়ত। তারপর একদিন দুপরিবারের সম্মতিতে সজল-মোরির দাম্পত্য জীবনের শুভ সূচনা।
মানুষের জীবন অনেক বৈচিত্রময় এবং সেই জীবনে যে অনেক বেশি টানাপোড়ে সেটা এই মুহূর্তে সজলের চেয়ে ভাল কেউ জানেনা। ইদানিং সময়টা বড্ড খারাপ যাচ্ছে সজলের; অফিসে-বাসায়-সমাজে। মেঘলা দিন। তাই বিকেল টাকেও সকালের মতই লাগে। বস কে বলে আজ একটু আগে ভাগেই অফিস থেকে বেরিয়ে পড়লসজল। যে শুন্যতা বাইরের আচ্ছন্ন আকাশে সে শুন্যতার ছায়া যেন সজল তার অন্তরেও অনুভব করছে। নেই, নেই, কিচ্ছু নেই, কেউ নেই। নেই নেই রোগ টা আজকাল খুব পেয়ে বসেছে সজলকে। সজল মৌরির বিবাহিত জীবনের অর্ধযুগ পার হতে চলল। এখনও কোন অতিথির আগমন ঘটেনি। সমস্যা টা মৌরির। ডাক্তার বলছে ওর পক্ষে মা হওয়া টা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। যদিও সজলের এ নিয়ে নুন্যতম দুঃখ নেই। আসলে কিছু কিছু ব্যাপারে মানুষের পক্ষে করার মত তেমন কিছুই থাকেনা। ভরসা একমাত্র সৃষ্টিকর্তা। কিন্তু চিয়ায়ত সমাজকে সে কথা বুঝানো যে এতটা সহজ নয় সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে এই দম্পত্তি।এরই মধ্যে বড় ভাই আর মায়ের চাপে পড়ে দ্বিতীয় বিয়ের চিন্তাটাও ঘুরপাক খাচ্ছে সজলের মাথায়।
এখন শেষ রাত। রাতের শেষ ট্রেন টা কাছের ষ্টেশনে এসে থামল। হুইসেলের বিকট শব্দে হঠাৎ ঘুমের মধ্যে মৌরি সজলকে জড়িয়ে ধরলো। মৌরির ডান হাতটা নিজের হাতের মাঝে বন্দি করে নিয়ে জানালা দিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে সজল। ততক্ষনে মেঘের আড়াল থেকে চাঁদটা সরে এসেছে। তাইতো অন্ধকার রাতটা হঠাৎ জোছনার আলোতে ভরে গেল।চাঁদের আলোর এক ফালি জোছনা জানালা দিয়ে বিছানায় আঁচড়ে পড়ছে। নিবিড় শান্ত একটা ছায়াস্নিগ্ধ শীতল পরিবেশ যেন মুহূর্তে মনকে স্পর্শ করে। তবু কি যেন একটা চাপা শূন্যতা।ঘুমে দু’চোখ ঝাপসা হয়ে আসে সজলের।
ঘুমের মধ্যে আজকাল প্রায়ই একটা দুঃস্বপ্ন দেখে সজল। মাঝরাতে একা একা বারান্দায় বসে আছে। খুব জোছনা। আম গাছের ডালপাতার আড়াল থেকে একটা খচ খচ শব্দ আসে। সজল কান খাড়া করে সেটা দেখার চেষ্টা করে। চাঁদ ভেজা আম পাতা, ডালের ছায়া থেকে কিছু একটা বেরিয়ে আসছে। সেই ডানা ভাঙ্গা শঙ্খচিল টা না! সারা শরীরময় ভরা চাঁদের জোছনার আলো জড়িয়ে আছে। সেবার হাওরের বুকে ডানা ভাঙ্গা চিলটাকে দেখে খুব কষ্ট লাগছিল সজলের। মানুষ কত নিষ্টুর? বালি হাস শিকারের জন্য শিকারীর পেতে রাখা ফাঁদে পড়ে ডানা ভেঙ্গে যায় চিলটার। ভাঙ্গা ডানা নিয়ে বেশিদূর উড়তে পারেনা চিলটা। কিন্তু ওটা ভৈরবের এই শহরে এলো কি করে? উত্তর খুজে পায়না কিছুতেই। চিলটাকে আজ অন্যরকম লাগছে। চোখে মুখে কি যেন একটা হিংস্র চাহনী। চোখ দুটো যেন বের হয়ে আসছে। আচমকা ছু মেরে সজলের দিকে তেড়ে আসতে চায়। কিন্তু পারেনা। বাঁধ সাধে বারান্দার লোহার গ্রিল। চোখের পলকে শঙ্খচিলটা কোথায় যেন উদাও হয়ে যায়। মুহুর্তের মধ্যে অদ্ভুত এক অন্ধকারের কুন্ডলি এসে তার চোখে মুখে নাড়া দিয়ে যায়। বারান্ধার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে তাকায় সজল। এ এক অন্য রকম আকাশ ঠিক যেন ভূতচতুর্দশীর আকাশে লক্ষকোটি প্রেতের চোখ জ্বলছে। একটু ভয় লাগে তার। কেমন জানি একটা ভয়, ঠিক বোঝানো যায়না!
ঘুম ভেঙ্গে যায় । বিছানা থেকে উঠে বসে সজল। অচেনা ভয় তাকে জড়িয়ে ধরে। সে আর কিছু ভাবতে পারেনা। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। কণ্ঠরোধ হয়ে আসে। বুকে প্রচন্ড তৃষ্ণা। মাথার কাছে টেবিলে রাখা পানি ভর্তি গ্লাস টা ঢক ঢক করে এক নিঃশ্বাসে পুরোটা শেষ করে দেয় সজল। বুকের বাম পাশের হৃদ যন্ত্রটা বেশ জুরে জুরে বিট দিচ্ছে। স্বাভাবিক হতে খানিক্ষন সময় লাগে। দূরের মসজিদ থেকে আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে। যেন নতুন আরেকটা ভোরের আগমনী। এক হাতে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে মোরির দিকে চোখ যায়। কি স্নিগ্ধ আর মায়াবী লাগছে মুখটা। উফ! হে খোদা, নতুন ভোরটা কি তুমি শুন্যতাহীন করে দিতে পারনা? একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস আযানের ধ্বনিতে মিশে যায়।
লেখক পরিচিতিঃ ফয়সুল আলম, জন্ম ১মার্চ, ১৯৮৭; ভৈরবের কালিকাপুর গ্রামে। বাংলাদেশ কৃষিবিশ্ববিদ্যালয় থেকে পশুপালনে অনার্স ও পশুবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছেন। লেখালেখির শুরু স্কুলজীবন থেকেই। প্রথম প্রকাশিত লেখা ‘তিন ঘন্টার কারাগারে’। দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্র ও সাহিত্য পত্রিকায় লেখালেখি করেন। পরিবেশ, অর্থনীতি, নাগরিক ও ব্যক্তিজীবনের নানাদিক তার লেখার উপজীব্য বিষয়। লেখালেখির পাশাপাশি ভাল লাগে তার ভ্রমন করতে ও ছবি তোলতে। বর্তমানে তিনি একটি সরকারী ব্যাংকে কর্মরত আছেন।