ডেইজি সামোরা: জন্ম ১৯৫০, নিকারাগুয়া। সমকালীন মধ্য-আমেরিকান কাব্যক্ষেত্রের গুরুত্বপূর্ণ বুজুর্গদের মধ্যে ডেইজি সামোরা অন্যতম। তাঁর কবিতায় ধ্বনিত হয় এক আপসহীন কণ্ঠস্বর। দৈনন্দিন জীবনের নানা খুঁটিনাটি পুঙ্খে-পুঙ্খে উঠে আসে তাঁর কবিতায়। রাজনীতি থেকে শুরু করে মানবাধিকার, বিপ্লব থেকে শুরু করে নানা নারীবাদী ইস্যু, ইতিহাস থেকে শুরু করে শিল্পসাহিত্য, সংস্কৃতি– এক বিস্তৃত প্রেক্ষাপটের ভেতর দিয়ে প্রদক্ষিণ করে তাঁর কবিতা। স্প্যানিশ ভাষায় রচিত বহুলপঠিত বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থের জননী তিনি। এ ছাড়াও আছে ইংরেজি ভাষায় লেখা বেশ কিছু বই।
নারী-অধিকার বিষয়ে সোচ্চার এই কবি সম্পাদনা করেছেন নিকারাগুয়ান নারী কবিদের কাব্যসংকলন। বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সংকলনখানা। দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর কবিতা। ভূষিত হয়েছেন নানা সম্মাননা ও পুরস্কারে। ১৯৭০-এর দশকে, সোমোজার একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে চলতে থাকা দীর্ঘদিনের সংগ্রাম যখন ছড়িয়ে পড়ে তীব্র ও বিস্তৃত হয়ে, তখন ডেইজি জড়িয়ে পড়েন, রীতিমতো নিমজ্জিত হয়ে যান, বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে। ১৯৭৩-এ যোগ দেন ন্যাশনাল সান্দানিস্তা লিবারেশন ফ্রন্ট বা এনএসএলএফ-এ।
বস্তুত তিনি ছিলেন এনএসএলএফ-এর একজন সক্রিয় যোদ্ধা। সান্দানিস্তা গেরিলাদের গোপন প্রচারমাধ্যম রেডিও সানদিনো-র ভয়েস ও প্রোগ্রাম ডিরেক্টর হিসাবে কাজ করেন ১৯৭৯-এ, সান্দানিস্তাদের সেই চূড়ান্ত ধাক্কা ও অভ্যুত্থানের আগুনঝরা দিনগুলিতে। বিপ্লব চলাকালীন বিভিন্ন সময়ে তিনি নির্বাসিত জীবনযাপন করেছেন হন্ডুরাস, পানামা ও কোস্টারিকায়। ১৯৭৯-এর জুলাইয়ে বিজয়লাভের পর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয় কবি সামোরাকে। এর্নেস্তো কার্দেনাল তখন ওই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। তাঁরা দুজনে বেশ কিছুকাল কাজ করেছেন একসাথে।
১.
চূড়ান্ত অবধি
হৃদয় আমার
লড়ে যায় হরদম:
নাই এমন কোনো ব্যূহ, যাকে সে ভেঙেচুরে ভেদ করে পারে না যেতে;
শহিদ হয়ে যায় আমার এ-প্রাণ আমাদের ভূখণ্ড-রক্ষায়।
২.
কনিষ্ঠতম সন্তানের কাছে মিনতি
[তোমাতে করেছি আমি প্রাণের সঞ্চার
তোমাপ্রতি এ-আমার
নিয়তিবাধিত এক নিদারুণ উপহার
মাফ করে দিয়ো তুমি, সন্তান আমার
–*রুবেন দারিয়ো]
এমন যাতনা নিয়ে আমি করি প্রতীক্ষা তোমার
যে-যাতনা শুধু বেড়ে যায় দিনে দিনে,
এইরূপ ঊষরতা নিয়ে করি প্রতীক্ষা তোমার
যা আমার সুখশান্তি করেছে বরবাদ,
বলদের মতো বাঁধা আমি আস্টেপৃষ্ঠে জলযন্ত্রের চাকার সাথে তার–
একথা জানার যে বিষণ্ণতা, তা-ই নিয়ে করি হে তোমারই ইন্তেজার।
সাহস করি না আর তোমাকে যে শোনাব কূজন,
হাত বোলাতে বোলাতে আমার এ-গর্ভবর্তুলে: যা-কিনা তোমারই জগৎ।
এই যে মৃত্যুবাসনা, বক্ষে কেবলই আমার
জারি রাখে অকথ্য অত্যাচার–
মাফ করে দিয়ো তাকে।
আমাকে তুমি দাও সেই দম, সেই শ্বাস, যা তোমাকে
ঠেলে দেবে জীবনের দিকে
বয়ে নিয়ে যাবে দূরে আমার এ-জাহাজডুবো হৃদয়টিকে।
(*রুবেন দারিয়ো-কে বিবেচনা করা হয় নিকারাগুয়ার শ্রেষ্ঠ কবি হিসাবে। আধুনিকতাবাদী ঘরানার অন্যতম উদ্গাতা ছিলেন তিনি। তাঁর কাজ ও লেখালিখি নিবিড় ও গভীরভাবে ইয়াংকি-বিরোধী।)
৩.
একান্ত অনুগত গৃহিণী
মধুচন্দ্রিমাতেই খতম সবকিছু–
কমলাফুলের ফুটে-ওঠা, প্রেমপত্রাবলি,
শিশুতোষ কান্নাকাটি– সব, সবকিছু।
এইবার হামাগুড়ি দাও তোমার মালিকের পায়ের তলায়,
প্রথমেই তার যে হারেম আছে, সেটার ভেতর,
সেইখানে, তারই মর্জিমাফিক গৃহীতা হবে তুমি, হবে পরিত্যক্তা।
সন্তানের মাতা তুমি, অথচ সে-সন্তান ধারণ করে আছে
তোমার সে-মনিবের নাম,
ডায়পারের ভারে ন্যুব্জ কাপড়-শুকানো দড়ির পাশে দাঁড়িয়ে
নিজের নসিব নিয়ে তোমার ওই অস্ফুট বিলাপ,
হৃদয়কে চিপড়ানো, নিংড়ানো…
যতক্ষণ-না তার শোধন হয় তোয়ালে ও বেডশিটে।
শুকনা রুটির দিকে বাড়ানো, অপমানে নোয়ানো একটি হাত
চিৎকার-চেঁচামেচি আর অপমানে-অপমানে ধ্যাতা-ধরা কোণঠাসা এক অবলা গৃহিণী
মাইগ্রেন, শিরাফোলা আর বহুমূত্রে-ভোগা এক চিরবিলাপিনী ছায়ামূর্তি।
শোকেস-সামগ্রীরূপে রাখা একটি তরুণী
যে-কিনা বিবাহ করেছিল তার প্রথম প্রেমিক,
যে-কিনা বুড়িয়ে গেল শুনতে শুনতে জীবনের দূরবর্তী সংগীত
তার যে কথিত ‘স্ত্রী-মর্যাদা’, সেই জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।
৪.
বিলাপ
আর যদি নাই দেখতে পারি কখনো তোমায়
তাহলে কীসের জন্যে এই চক্ষুদ্বয়?
কেনই-বা এই হাত, সোহাগ বোলায় খাঁ-খাঁ শূন্যতায়, তীব্র ফাঁকাময়তায়?
কেনই-বা জীবন?
৫.
সূর্যকিরণ
কী যে ঈর্ষা করি!
আহা, ঘুম না ভাঙিয়ে তোমার
বসেছে কাঁধের ’পরে এসে ওই রবির কিরণ!
সোনালি আলোর ছোঁয়ায় তার
জ্বলজ্বল করছে ত্বকেরা তোমার
আজ সকালের এই স্যাঁতসেঁতে ছায়ার ভেতর।
৬.
আমি ফের আমি হই আরো একবার
আমি আর আমার বাচ্চারা যখনই ঢুকি তার বাড়ির ভেতর
আমি ফের আমি হই আরো একবার,
আহা ফিরে পাই নিজেকে আবার।
রকিং চেয়ারে বসে থেকে
বুঝে যান এসেছি আমরা, আলতো করে মাথাটা তোলেন।
তেমন আর হয় না আলাপ, যেমনটা হতো আগে।
প্রস্তুত হচ্ছেন তিনি প্রস্থানের জন্যে।
কিন্তু আমি তো আসি তার কোলে মাথাটা ডোবাতে,
বসে থাকতে তার পায়ের নিকট।
নিয়ত বিরাজ করি আমি তার ধ্যানে, ভাবনায়
আমার সে হারিয়ে-আসা বেহেশতখানায়
যেইখানে এই মুখটি আমার হয়ে যায় অন্য এক মুখ,
যেই মুখ ভাসে শুধু তারই চেতনায়
ক্ষণে-ক্ষণে উদ্ধার-করা একটি চেহারা
চির-ঝাপসানো, নীল নিষ্প্রভ ওই চোখের মণিতে,
অন্ধ আঁখিতারায়, যেখানে
খুব হেফাজত করে তুলে রাখেন এ মুখখানি আমার।
৭.
প্রাণী ও তার পোষমনিব
উদ্যানের প্রাণীর মতো, আমি দেখেছি তাদের…
–এর্নেস্তো মেহলা সানচেজ
রেলিঙে দাঁড়িয়ে দেখি—
একজন লোক, প্রাণীদের পোষ মানায়, পানি দিচ্ছে বাগানে এখন
(চেহারা লুকানো তার ছায়ার আড়ালে)
যথেষ্ট নিরীহ লাগে তাকে: যেন এক গোবেচারা,
ব্যস্ত শুধু নেহাত মামুলি কিছু কাজে,
ব্যস্ত কিছু বিবর্ণ গোলাপ আর রুপালি গুল্মের দেখভালে।
পাতাদের একঝলক শিহরন
এই মর্মে জানান দিয়ে যায়, যে, হাওয়া বইছে হঠাৎ
আর পরিপৃক্ত ওই উঠান থেকে উঠে এসে হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে আমায়,
ঢুকে যাচ্ছে ভেতরে আমার,
ঝাপটে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে আমার এ ভাঁজ-পড়া
কোচকানো হৃদয়ের যত বিশুষ্ক বলিরেখা।
৮.
তোমার উৎকর্ষ
সে-এক অনুনকরণীয় উৎকর্ষ তোমার
লুক্সরের মন্দিরের মতন, যা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম আমি, সেই
মেট্রোপলিটান মিউজিয়ামে:
চুনসুরকিহীন, পাথরের ওপর শুধু পাথর বসিয়ে বানানো।
(ব্যাপারটা দেখিয়ে দিলেন জাদুঘরের গাইড মশায়)
নিউ ইয়র্কীয় আকাশের উঁচু ধূসর গম্বুজের
নিচে শানদার একটি মন্দির।
এই এত যে উৎকর্ষ, আর এত যে মহিমা,
তার চেয়েও বেশি পছন্দ আমার
গোধূলিকালীন হাত দুটিকে তোমার।