০১.
এক দীর্ঘাঙ্গী শ্যামাঙ্গী নারী অবিচল দাঁড়িয়ে জন-মানবহীন ‘অর্জুনখোলা’ নদীর পশ্চিম তীরে। বয়স খুব সম্ভব পঁচিশ থেকে বত্রিশের মধ্যে। তবে ত্রিশের দু এক বছর বেশীও হতে পারেÑ একেবারে স্থির করে বলা যায় না। সুঠাম দেহ। স্ফীত বক্ষ। উন্নত গ্রীবা। ভারী পশ্চাদ্দেশ। শরীরের শ্যামল বর্ণটিই পৃথক এক অত্যুজ্জ্বল সৌন্দর্যের বিভা ছড়িয়ে দিয়েছে গোটা মুখম-ল জুড়ে- যেন মেঘহীন চৈত্রের জোৎন্সা-ধোয়া মধ্য-যামের এক মুঠো তারার ঝিলিক। ভোলা যায় না। কতো নরম আর মসৃণ সৌন্দর্য ! কোন উগ্রতা নেই। নগ্ন দু‘পায়ের পাতার অর্ধেকটা ডুবে গেছে নদী-তীরের চিক্চিকে বালির আস্তরনে। সাদা শাড়ীতে অপূর্ব ‘চন্দ্রমল্লিকা’-যেন। তাকিয়ে রয়েছে অবিরাম ধীর লয়ে ব’য়ে চলা পানির ছোট ছোট ঢেউয়ের দিকে। তীরে বাঁধা অনেক ছোট বড় নৌকো মৃদু মৃদু দুলছে ঐ ঢেউয়ের ছন্দায়িত দোলায়। কিন্তু সেদিকে বিন্দুমাত্র লক্ষ নেই ওর। তাকিয়ে রয়েছে যেন সেই ঢেউ গুলির হৃদয়-ভাঙ্গা বিপুল বিশাল অনিঃশেষ এক মহাশুন্যতার দিকে। স্থির অচঞ্চল দৃষ্টি- পলকহীন। চোখ দুটি অদ্ভুত রকমের বড়- মৃগ-নয়নকেও হার মানায় বুঝিবা।
মধ্যরাত্রি পেরিয়ে গেছে । কিছু পরেই হয়তো রক্তিম ভোরের ইঙ্গিত-রেখা দেখা দেবে পূব আকাশের নীলোক্ত শরীরে- সূচনা করবে আর একটি ‘সোনালী-রৌদ্রমাখা নতুন প্রভাতের।’ কিন্তু নারীটি জানে, কেমন হবে সে প্রভাতটির লাবণ্য-লতায় জড়ানো শোভা- যে শোভা কখনই দেখতে পাবে না সে। জানতেও পারবে না সে, সে শোভার কনক-কুসুমের হৃদয় থেকে ধীরে ধীরে বিকশিত হওয়া একটি পূর্ণাঙ্গ কুসুমের পত্র-পল্লবের সবুজ সজীবতাকে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো গ্রামের মসজিদ থেকে ভেসে আসবে পবিত্র আজানের ধ্বনি। ধীরে ধীরে মাঝি মাল্লাদের আগমন, কোলাহল, হাঁক ডাক, শিশু কিশোরদের অকারণ হৈ হুল্লোড়, শামুক ধরবার প্রতিযোগিতা, দৌড় ঝাঁপ, চ্যাচামেচি, কান্নাকাটি ইত্যাদিতে মুখরিত হ’য়ে উঠবে চিরাচরিত, গতানুগতিক অর্জুনখোলা নদীটির দুপাড়ের নৈমিত্তিক চিত্রপট।
আর সময় নেই। যত দ্রুত সম্ভব এবার অন্তিম প্রস্থানের পালা। মাহেন্দ্রক্ষণ সমাগত। শুধু একবার মাত্র ফিরে তাকালো পেছনের দিকে। না কেউ নেই। কেউ আসছে না পেছন থেকে। কিছুটা স্বস্তি বোধ করলো বোধকরি নারীটি- এই ভেবে যে- কেউ না আসুক অন্ততঃ নূর আলী ওকে খুঁজতে নদী তীরে আসবেই আসবে, তবে এখনও আসেনি। হয়তো এখনও ঘুমই ভাঙ্গেনি ওর। পরিশ্রমী শরীর। ঘুরে দাঁড়ালো আবার সামনের দিকে। একটি দীর্ঘশ্বাস আপনা আপনিই বেরিয়ে এলো বুক চিড়ে। ধীরে ধীরে গিয়ে বসলো কার্তিক মোল্লার নৌকোর গলুইতে। কার্তিক মোল্লার নৌকোটিকে ও চেনে, কোথায় বাঁধা থাকে তা-ও জানে। গলুইতে বসেই ওর বাম হাতের মুঠিতে ধ’রে রাখা কিছু একটা যেন তুলে নিল ডান হাত দিয়ে, রাখলো সেই হাতের তালুতে- দেখলো সামান্যক্ষণ। তারপর চোখ বন্ধ ক’রে মুখে পুরে চিবুতে শুরু করলো। চিবুতে চিবুতেই নৌকার গলুই থেকে নেমে পাটাতনের ওপর বসলো। দ’ুহাত বাড়িয়ে আঁজলা ভ’রে নদীর পানি তুলে নিয়ে পান করলো। আবারও তুললো, আবারও পান করলো। পান করা শেষে ক’রে চারদিকটা আবারও একবার ভালো ক’রে দেখে নিলো। তারপর নিঃসঙ্কোচে মাথাটি গলুইতে ঠেস দিয়ে চিৎ হ’য়ে শুয়ে পড়লো পাটাতনের ওপর। ধীরে ধীরে চোখ দু’টি বুজে আসতে শুরু করলো। এক সময় পুরোপুরি বুজে গেল। শরীরটি একবার সামনের দিকে বেঁকে গিয়ে আবার সোজা হয়ে গেলো। মুখ দিয়ে ফেনার মতো কিছু লালা বেরিয়ে আসতে শুরু করলো। চোখ দু’টি যেন বিরাট আকার নিয়ে রক্তাক্ত হয়ে বেরিয়ে আসতে থাকলো ওর অক্ষিগোলক থেকে কিন্তু সম্পূর্ণ বেরিয়ে এলো না। বোঝা গেলো অসম্ভব যন্ত্রণা সহ্য করবার চেষ্টা করছে নারীটি। এভাবে কিছু সময় কেটে যাবার পর নিস্তেজ হয়ে যেতে শুরু করলো দেহটি। এরপর এক সময় একেবারেই নিথর হয়ে গেলো নারীটির শরীরটি। কেউ জানলো না মাত্র কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে কোথায় নিরুদ্দেশ হ’য়ে গেল- অপূর্ব শ্যামল শোভায় শোভিত দু‘নয়নে যেন ঘন কাজলমাখা দীর্ঘাঙ্গী অপূর্ব সুন্দর, অদ্ভুত লাবণ্যময়ী কিন্তু অন্তর্দৃষ্টি বিহীন এই হতভাগী ‘নারীটি’ যে আর কখনও, কোনো দিনই ফিরে আসবে না পবিত্র এ মৃত্তিকার ধূলি জলে।
০২.
ওর নাম- ‘তিউবাবা’। যদিও নামটি কোন মেয়ে মানুষের হবার কথা নয় ; তবুও বাবা খুব আদর ক’রে ওই নামেই ডাকতো ওকে শৈশব থেকে। ডেকে খুব খুশি হতো বাবা। বাবার ওই ডাক শুনে মেয়েটিও ছোট ছোট পা ফেলে দৌড়ে গিয়ে বাবার একটি হাত জড়িয়ে ধরতো। বাবাও কোলে তুলে নিয়ে সোহাগমাখা আদরে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিতো ওর ঠোঁট, গাল, গলা সবকিছুকে। অপত্য ¯েœহ যে কতো গভীর, কতো নিস্পাপ- প্রকাশ পেত বাবার আদরে। সেই তিউবাবা আজ একজন পূর্ণাঙ্গ যুবতী। মাত্র বারো বছর বয়সের মধ্যভাগে বিয়ে হয়েছিলো ওর। এখন প্রায় আড়াই বছরের কাছাকাছি বয়সের একটি পুত্র সন্তানের জননী ও।
ছোট আর মাঝারি মিলে সাকুল্যে কয়েক টুকরো জমি ছিল ওর বাবার- নিজেই চাষবাস করতো । উঁচু জমি- তিষির চাষই হ’তো বেশী, অন্য ফসল তেমন এটা ভাল ফলতো না। যেবার মেয়েটির জন্ম হ’লো সেবার তিষির ফলন প্রত্যাশার সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল- খুশিতে উদ্বেলিত হ’য়ে বাবা মেয়ের নাম রেখেছিল-‘তিষি’। কিন্তু এক বছর না পেরুতেই বাবা ওকে ডাকতে শুরু করেছিল- ‘তিউবাবা’- ব’লে। আজও সে নামেই সবাই ডাকে ওকে। নামটি স্থায়ী হ’য়ে গিয়েছিল- আর বদলায নি।
অর্জুনখোলা নদীটি ছিল পদ্মার একটি শাখা নদী । এই নদীর দু‘পাড়ে বসতি গড়া হাড়জিরজিরে দুখী মানুষগুলির জীবিকা নির্বাহের একমাত্র উৎস এই অর্জুনখোলা নদীটি। কেউ নৌকো দিয়ে যাত্রী পারাপার করে, কেউ মাছ ধরে, কেউবা পণ্যবোঝাই নৌকা নিয়ে দূরপাল্লায় পাড়ি দেয়। পদ্মার উত্তর দিকের বাম তীর ফুরে বেরিয়ে এসে পশ্চিমে প্রায় পনের, ষোল মাইল দূরের একটি বৃদ্ধ অর্জুন গাছকে ডানে রেখে সরাসরি একটি বড় আকারের বাঁক নিয়ে সোজা দক্ষিণ দিকে ধাবিত হয়েছিল নদীটি। অঙ্কিত হয়েছিল অর্জুনখোলা নদীর মোহনা। সেই মোহনাকে কেন্দ্র ক’রে বহুদূর বি¯তৃত বিপুল উঁচু জমিতে ধীরে ধীরে গ’ড়ে উঠেছিল বহু আশ্রয়হীন, সম্বলহীন কামার, কুমোর, দিনমজুর জাতীয় বিভিন্ন প্রাকৃত শ্রেণির মানুষ জনের বসতি- সৃষ্টি হয়েছিল একটি ক্ষুদ্র, শীর্ণ লোকালয়ের। দক্ষিণ-পশ্চিমের অজানা অচেনা বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বহু মানুষ এসে জুটেছিল এই লোকালয়ে। লোকালয়টির নামও ওরাই দিয়েছিল-‘দক্ষিণমোহনা।’ এখন সে দক্ষিণমোহনা অনেক প্রসারিত, অনেক সমৃদ্ধ, পাশাপাশি বর্ধিষ্ণু।
এই দক্ষিণমোহনা গ্রামেই ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছিল তিউবাবা। কোন রকমে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করতে পেরেছিল ও। তের বছর বয়স না পেরুতেই বাবা ওর বিয়ে দিয়েছিল দক্ষিণমোহনা গ্রাম থেকে প্রায় পঁচিশ ত্রিশ মাইল দূরের ভাটিতে থাকা ‘মাটিভাঙ্গা’ গ্রামের শক্ত-সমর্থ যুবক নূরল্লা মাল্লার সাথে। নূরুল্লার বাবার সাথে তিউবাবার বাবার বন্ধুত্ব ছিল নিবিড়। সেই বন্ধুত্বের সূত্র ধ’রেই নির্ধারিত হ’য়ে গিয়েছিল দুজনের পুত্র আর কন্যার বিয়ে। নূরুল্লারা বংশানুক্রমেই নৌকোর মাল্লা। ওর পূর্ব পুরুষরাও এই কাজই করতো। নূরুল্লা কখনও নৌকোর দাঁড় বায়, কখনও হাল ধরে, আবার কখনও বা পণ্যবোঝাই নৌকো নিয়ে দূরপাল্লার পাড়ি জমায়। বিয়ের পর স্ত্রী তিউবাবাকে নিয়ে নিজ গ্রাম মাটিভাঙ্গায় ফিরে আসে নূরুল্লা । শুরু হয় তিউবাবা আর নূরুল্লার নতুন সংসার জীবন। দু’বছরের মাথায় উজ্জ্বল শ্যামল বর্ণের একটি কোমল পুত্র সন্তানের জন্ম দেয় তিউবাবা। খুশিতে নিজেকে হারিয়ে ফেলে নূরুল্লা। নিমেষেই সারা গ্রামে ছড়িয়ে দেয় এই শুভ সংবাদটি। দু’বাহুর সমর্থ পেশীর সব শক্তি দিয়ে আরও যেন শক্ত ক’রে বেঁধে রাখতে চায় তিউবাবাকে নিজের বুকের সাথে নূরুল্লা। তিউবাবাও উচ্ছ্বাসে উথ্লে ওঠে। এভাবে গড়িয়ে যায় অনেকটা সময়। আড়াই বছরের কাছাকাছি এসে যায় ওর সন্তানটির বয়স। সামনের ফাল্গুনেই আড়াই বছরে পা দেবে শিশুটি। জমি জিরেত যেটুকু রয়েছে তাতে ওদের সোনার সংসার দিব্বি চ’লে যায়। যদিও বাড়তি কিছু থাকে না হাতে তবুও অভাব বলতে তেমন কিছু থাকে না ওদের, ওরা অল্পতেই তুষ্ট। এবার অত্যন্ত আকস্মিকভাবে অগ্রহায়ণ আসবার আগে কার্তিকের শুরুতেই শুরু হয়েছিলো অকাল বন্যা। এমনিতেই কার্তিক অনাহার আর অর্ধাহারের মাস তার ওপর এই কার্তিকেই অকাল বন্যা। গ্রামের মানুষের সকল জমি ডুবে গিয়েছিল অকাল প্রবল বন্যার পানিতে। সব ফসল ধ্বংস হ’য়ে গিয়েছিল। ফাল্গুনে ওদের ছেলেটি অড়াই বছরে পা দেবে অথচ ফাল্গুন আসতে না আসতেই কার্তিকের শেষ আর অগ্রহায়নের শুরুতেই ঘ’টে গেল এক নিদারুন ছন্দপতন প্রবল বন্যার মহাপ্লাবন- সাথে নিয়ে এলো আর একটি অভিশাপ‘মহা-দুর্ভিক্ষ’। চারদিকে কেবল হা-হাকার আর হা-হাকার। অপরূপ-শোভা প্রকৃতির সজীব, সবুজ রংটিও বুঝি নিমেষেই বিবর্ণ হয়ে রূপান্তরিত হয়ে গেল চৈত্রের শুকনো ঝরা পাতার মতো রস কসহীন একেবারেই হলদেটে।
০৩.
আসলো সেই-
১৯৭৪ সাল।
১৯৭৪ -একটি চরম দুর্ভাগ্যের কাল।
১৯৭৪ - AN AGE OF ABSOLUTE MISFORTUNE .
(বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ)।
কিছুদিনের মধ্যেই মড়ক শুরু হ’য়ে গেল চারদিকে। অনাহারে মৃত্যুর দারুন মড়ক- যেন মহামারী আকারে হু হু ক’রে ছড়িয়ে পড়লো গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। প্রতিদিন কোন না কোন গ্রাম থেকে দুই, তিনজন ক’রে অনাহারী মানুষের মৃত্যু সংবাদ আসতে শুরু করলো। এ রকম একটি অবস্থায় কারো বা কোনমতে দাফনটা হচ্ছে, কাউকে বা বানের পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হচ্ছে- সামান্য কবরের জায়গার মাটির অভাবে। প্রতিদিনই শত শত মানুষ সন্তান সন্ততি নিয়ে পূর্ব পূরুষের ভিটে মাটি ছেড়ে সারিবদ্ধ ভাবে শহরের দিকে পাড়ি জমাচ্ছে। এত লোকের সঙ্কুলান শহরেই বা কি করে হওয়া সম্ভব ? গোটা গ্রামের মানুষের মুখে মুখে এখন একটিই কথাÑ শহরের রাস্তা ঘাটেই নাকি প্রতিদিন মানুষের লাশ প‘ড়ে থাকে। কাফন দাফনও হয় না, কুকুর শেয়ালই নাকি লাশ গুলিকে ভক্ষণ করে। সারা শহরই নাকি এখন দুর্গন্ধের আস্তাকুড়।
‘অই পোলারে সামলাস না ক্যা ? মাঝ রাইতে ঘুমাইবার দিবি, নাকি ঘর থাইক্যা বাইরাইয়া যামু ? ক্রোধাহ্নিত নূরুল্লা অত্যন্ত কর্কশ কণ্ঠে বলে কথাগুলি। ব’লে পাশ ফিরে শোয় নূরুল্লা। ভয় পেয়ে যায় তিউবাবা। কান্নারত ছেলেকে কোনোমতে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় উঠে বসে। অসহায়ের মতো কান্না জড়িত কণ্ঠে যেন নিজের সাথে নিজেই কথা বলে সে তীব্র অভিমানী সুরে- ‘আমি কি করুম। আইজ দুই দিন দুই রাইত থাইক্যা খাওন নাই। বুকের দুধও শ্যাষ অইয়্যা গ্যাছে, খালি একমুঠ কইর্যা মুড়ি আর পানি খাইয়্যাই রইছে। ওইটুকুন পোলা খালি পানি খাইয়্যা থাকবার পারে? আমার বুকে দুধ নাই তবুও অর ঠোডের ফাঁকে স্তনের বোটা ঠাইস্যা ধইর্যা অরে আমি মিছাই কই- ‘দুধ খাইয়্যা ঘুমাইয়্যা পড়।’ কিন্তু পোলায় দুধ পায় না। খালি কান্দে। অর ক্ষিধা পায় না বুঝি ?’শাড়ীর আঁচল দিয়ে চোখের পানি মোছে তিউবাবা।
‘তাইলে আমি কি করুম, আমারে কি করবার কস্ ? যে কয় কানি জমি আছিল হ্যার ব্যবাক ধান তো বানের পানি লইয়া গেছে। একটা শীশও তো ঘরে তুলবার পারি নাই। খর গুলানও বানের কাদায় পইচ্যা, গইল্যা শ্যাষ অইয়া গেছে। তুই তো সবই জানস। অহন ক’ আমি কি করুম ?’
‘কি আর করবা ? তুমি আমার উপর চেইত্যা কতা কইবা না। আমার ডর করে।’- এবার সত্যিই আর রাগ থাকে না নূরুল্লার। হেসে ওঠে- ‘কি কইলি, আমারে তর ডর করে ? অইছে। এতদিন তাইলে আমার লগে ঘর করলি ক্যামনে ?’ ইতোমধ্যে ছেলেটি মায়ের দুগ্ধ-শুন্য স্তনে মুখ লাগিয়ে দুধ না পেয়ে না খেয়েই ক্ষিধের ক্লান্তিতে মায়ের কোলে ঘুমিয়ে গেছে। ওকে ওর বালিশে শুইয়ে দিয়ে কিছুটা স্বাভাবিক হ’য়ে বলে তিউবাবা- ‘এ্যাতদিন তো তুমি এ্যাত্ত চেইত্যা, এ্যাত্ত রাগ কইর্যা আমার লগে কতা কও নাই। আইজক্যা তোমার এ্যাত্ত রাগ দেইখ্যা সত্যই আমি ডরাইছি, শরমও পাইছি।’
‘ওরে আমার আমলকি বউরে ! দেখতে টস্টসা অইলে কি অইব, তিতা মিডা দুইডিই আছে। হোন্ রাগ আহে কহন জানস, যহন মাতার ঠিক থাহে না। দুই দিন উপাস থাইক্যা আমার মাতাডিরও গোলমাল অইয়া গেছে। চল্ এক কাম করি- গ্যারামে তো এক দানা খাওন পাওনের কুনো যোগার নাই, ব্যাক মাইনষের জমি জমা তো বানের পানি লুট কইর্যা নিছে- পানি নামনেরও কুনো লক্ষণ নাই। আশপাশের গ্যারামের মানুষজন তো রোজই লাইন ধইর্যা পিপড়ার লাহান শহরের দিকে যাইতাছে- আমরাও যাই চল্ ।’ -কথা শেষ ক’রে প্রত্যাশিত উত্তর প্রাপ্তির অপেক্ষায় উদগ্রীব হ’য়ে ওঠে নূরুল্লা। কথা বলে না তিউবাবা- যেন কত কাল থেকে নির্বাক। কেবল বড় বড় চোখ তুলে কেমন এক অদ্ভূত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে নূরুল্লার মুখের দিকে। নূরুল্লা ধৈর্য হারিয়ে ফেলে-
‘কি অইলো, কতা কস না ক্যা ?’
‘কি কমু। খাওনের অভাবে যদি মরনই লাগে- তিন জন মিইল্যা এক লগে এই গ্যারামেই মইরা যামু- তবু শহরে যামু না আমি।’
‘ক্যান শহর কি করছে তরে ?’-ক্রোধের লক্ষণ নূরুল্লার কণ্ঠস্বরে।
‘আমারে কিছু করে নাই, তয় সুইফারে করছে, সীতারে করছে, টুলিরেও বাদ দেয় নাই। হ্যারা তো হ্যাগোর স্বামীগো লগেই শহরে গেছিলো। কই শহরে তো সুইফার খাওন জোটে নাই, উল্টা সুইফারেই খুবলাইয়া খুবলাইয়া খাইছে শহরের মানুষগুলান। হ্যাষে কঙ্কালসার অইয়া অর্জুনতলায় আইস্যা পইড়া মরছে। লাশডার কাফন দাফনও অয় নাই, কুত্তা শিয়ালে টাইন্যা লইয়া গেছে।’
‘কতা শ্যাষ অইছে তর ?’- উত্তেজিত হ’তে থাকে নূরুল্লা।
‘সীতা পাগলী অইয়া গেছে, মাটির একটা ভাঙ্গা সরা হাতে লইয়া আমাগো দুয়ারে আইস্যা দুইডা ভাত চায়। ভাত না পাইলে ভাতের ফ্যান চায়, অগো দুয়ারে গিয়া একডা মরিচ চায়, পিয়াজের পাতা চায়। দ্যাহ নাই তুমি ? আর মাটি দেওনের মতো জায়গা নাই বইল্যা টুলির লাশডারে তো তুমিই বানের পানিতে ভাসায়া দিছিলা। ভুইল্যা গেলা ? হ্যাগোর স্বামীরাও আর ফিইর্যা আহে নাই- হ্যাগোর কপালে কি জুটছে কইবার পারে না কেউ- জানো না তুমি ? হেই শহরে আমি যামু ক্যান- তুমি আর তোমার পোলারে শহরের মাটির তলায় পোতাইয়া রাইখ্যা এই শরীল আর জানডারে শহরের মানুষগো কাছে বিলাইয়া দিয়া কুত্তা বিলাইয়ের খাওন করনের লাইগ্যা ?’- একসাথে এতগুলি কথা ব’লে রীতিমতো হাঁপাতে থাকে তিউবাবা। কোনদিনই একসাথে এত কথা বলে নি সে।
০৩.
‘চিক্কুর পাড়বি না। হোন্ আমার কতা যদি না হোনস, আমার লগে যদি শহরে না যাস্- আমি তরে আর রাখুম না। তরে আমি তালাক দিমু।’ চরম উত্তেজিত নূরুল্লা। কঠিন হয়ে ওঠে নূরুল্লার মুখের দুই চোয়াল, রক্তাক্ত হয়ে ওঠে যেন ওর অগ্নিগোলকের মতো দ’ুটি চোখের রং।
‘কি কইলা ??’- দুহাতে মুখ ঢাকে তিউবাবা।
‘হ। কইলাম তো, তালাক দিমু।’
কান্নার বাঁধ আর থাকে না। ভেঙ্গে যায়। দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে তিউবাবা। অনিঃশেষ কান্নায় যেন ভেঙ্গে পড়ে তিউবাবাÑযে কান্নার কখনও শেষ হবে না বুঝি। এই কান্নাটুকু ছাড়া ওর যে আর কোনো সম্বলই নেই। কিছু করবার শক্তিও নেই।
০৪.
‘তালাক’ দিমু- এই একটি কথাই ওদের জীবনের মহা-‘কাল’ হ’য়ে দাঁড়ায়, চূড়ান্ত পরিণতি ডেকে আনে। না খেয়ে, না ঘুমিয়ে কোন রকমে রাতটা কাটিয়ে দেয় ওরা দ’ুজন। কেউ কারো সাথে কথা বলে না। ভোরের আলো ফুটে উঠবার সাথে সাথে ঘর থেকে বের হ’য়ে যায় নূরুল্লা মাটিভাঙ্গা বাজারের দিকে। ছোট্ট এতটুকু বাজার। সকাল বিকেল স্থানীয় লোকজন তাদের নিজেদের তরি তরকারি, বিল বা ছোট কোন খাল থেকে ধ’রে আনা ছোট ছোট মাছ, পালিত মুরগি ইত্যাদি বিক্রি করে। বাজারে দু‘ তিনটি চালা ঘরের সাথে একটি ভাঙ্গাচোরা চায়ের দোকানও আছে। দোকানের সামনে বাঁশের ফালা দিয়ে কাঠের বেঞ্চের মতো ক’রে তৈরী করা অপ্রশস্ত লম্বা আসনে ব’সে ছোট ছোট কাঁচের গ্লাসে চা খেতে হয়। কিন্তু বিগত দেড়, দু’মাস থেকে চায়ের দোকানটি খোলে না। দু’বেলা তরিতরকারি, মাছ, মুরগীর বাজারও তেমন বসে না- জানে নূরুল্লা। জানবার পরেও ওই বাজারের দিকেই হাঁটতে থাকে ও। কাজ তো কিছু নেই- অন্ততঃ সময়টা যদি কাটে। আর এ ভাবেই সামান্য চিড়ে, মুড়ি খেয়ে কখনও বা একেবারেই না খেয়ে কেটে যায় আরও কয়েকটি দিন।
এরই মধ্যে খুব ভোরবেলা একদিন আবারও বাজারের দিকেই হাঁটতে শুরু করে নূরুল্লা। বাজারে পৌঁছে প্রথমেই দেখা হয় বৃদ্ধ মির্জা প-িতের সাথে। লোকটি বড় সৎ। মাটিভাঙ্গা গ্রামের সবার সাথে ওর কেমন যেন একটা আত্মিক সম্পর্ক গ’ড়ে উঠেছে। বয়োজ্যেষ্ঠ হিসেবে সবাই সম্মানও করে ওকে যথেষ্ঠ। নূরুল্লাই প্রথম কথা বলে- ‘এই সাতসকালে কই যাইতাছেন পন্ডিত কাকা। হাইট্যা যাইতাছেন, সাইকেলডি কই ?’
‘অভাব। বোঝনা বাবা! বেইচ্যা ফালাইছি। যাইতাছি উত্তরডাঙ্গায়- আমার এক আত্মীয়ের বাড়ী- দেখি কয়ডি চাইল যদি ধার কর্জ করবার পারি।’-বিষণ্ন একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মির্জা পত্নি। দীর্ঘনিঃশ্বাসটি ছেড়ে একটু সময় নিয়ে আবার বলে-‘দ্যাখ বাবা, শীতের সকালে ঘাস ফুলের উপর দিয়া হাইট্যা যাইতে বড় ভাল লাগে। কিন্তু এই ভালো লাগা আর ঘাসফুলের শোভা দিয়া তো প্যাট ভরে না। চাইয়্যা দ্যাহ, ঘাসগুলির ডগায় কি সোন্দর ছোটো ছোটো মুক্তার দানার লাহান কত্ত সাদা সাদা ফুল ফুইট্যা রইছে মনডি ভইর্যা যায়। নতুন কইর্যা বাঁচবার ইচ্ছা করে। এই নষ্ট জীবনের বোঝা আর সইহ্য অয় না, বইবারও পারি না।’
‘কন কি কাকা ! তাই বইল্যা এই বয়সে এত দূরের পথ হাইট্যা যাইবেন ? উত্তরডাঙ্গা তো এইহান থাইক্যা পেরায় কুড়ি মাইল দূরে। এইহান থাইক্যা তো উত্তরডাঙ্গার দিকে যাইবার নাও-ই পাওন যায় না, ঠিকমতো যাত্রী অয় না বইল্যা কোনো নাওই উত্তরডাঙ্গা যাইবার চায় না, হ্যার বাদেও হাইট্যাই যাইবেন কাকা ? মইর্যা যাইবেন তো!’ বিস্মিত হয় নূরুল্লা। বিশ্বাস করতে পারে না এত দূরের পথ এই বৃদ্ধ বয়সে কেমন করে পাড়ি দেবে মির্জা কাকা! নদী পথেও তো ওর উত্তরডাঙ্গা যাবার কোনো উপায় নেই। নিজেকে বড়ই অসহায় মনে হয় নিজের কাছে।
‘উপায় নাই বাবা। ক্ষিধা বড় দায়। আইচ্ছা নূরুল্লা, আইজ মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়া একডি কতা হুনলাম- তুমি নাকি তোমার বউরে তালাক দিছ ? তালাক দিয়া তারে লইয়াই আবার এক লগে ঘর করতাছ ? ইল্লাল হুজুর তো নামাজ শ্যাষে ব্যাক নামাজীরে কইয়া দিলো। তোমার ঘরের ভিতর থাইক্যা তোমার মুখ দিয়াই নাকি কতাডি বাইরাইছে- হুজুর নাকি নিজ কানে হুন্ছে। মসজিদের ঈমাম তো, দাপটডি ইট্টু বেশীই। তার উপরে আবার নতুন মাদ্রাসার ‘হেড মাস্টার’- মাদ্রসায় তো ছাত্র ছাত্রী কিছুই নাই। হ্যার পরেও ‘হেড মাস্টার’। হ্যার কতার উপরে তো কেউ কতা কয় না বাবা। জান তো সবই।’
‘মিছা কতা কাকা। তালাক দিবার চাইলেই কি তালাক অইয়া যায় ? আমি ক্যান আমার বউরে তালাক দিবার যামু? তালাক কি এতই সহজ কাকা ?’
‘আমিও তো তাই কই বাবা । কিন্তু আমার কতা হোনে ক্যাডায় ? সামনের জু’মাবার নামাজ শ্যাষে মসজিদে সালিশ ডাকছে। সালিশের আগেই ‘ফতোয়া’ দিছে- তোমার বউরে নাকি ‘হিল্লা’ বিয়া দেওন লাগবো। সবাই রাজি থাকলে ইল্লাল হুজুরই বিয়া করবো। ইল্লাল হুজুরের চরিত্র ক্যাডায় না জানে বাবা, তারপরেও হ্যারেই তো গ্যারামের কয়জন মিইল্যা মসজিদের ঈমাম বানাইয়া দিলো, নতুন মাদ্রাসাডার ‘হেড মাস্টার’ও কইর্যা দিলো। অহন হ্যার পাওয়ারডারে ইট্টু বেশী কইর্যা দ্যাহান লাগবো না ?’- ক্ষোভের সাথে তীব্র ঘৃণার প্রকাশ ঘটে মির্জা প-িতের কথায়।
‘আপনের মাতার কি ঠিক আছে কাকা ?’ ইল্লাল মুনসী বিয়া করবো আমার বউরে ? হ্যার দুই নম্বর বউডিরেও তো হ্যায় হিল্লা বিয়া কইরাই রাইখ্যা দিছে। ফেরৎ দেয় নাই। এইডি লইয়া একবার তো হ্যারে গ্যারাম থাইক্যা খ্যাদানও অইছিল, এ্যাত্ত জল্দি হেইডি কি হ্যায় ভুইল্যা গেল ? ’আল্লাহ‘র আইন বইল্যা কি কিছুই নাই ? - প্রবল উত্তেজনা মিশ্রিত কণ্ঠস্বর নূরুল্লার। চোখ দু’টি ছোটো হয়ে আসে তবে চোখের তারা দুটিতে তীক্ষ তা ফুটে ওঠে। চোয়াল দু’টি শক্ত কঠোর হয়ে ওঠে।
‘এই তো একখান ভুল কতা কইলা বাবা। আল্লাহ‘র আইনরে তো অহন ইল্লাল হুজুরগো লাহান ‘না-ফরমান’ মোল্লারা নিজেগো স্বার্থে নিজ হাতে জবাই করে, জবাই কইর্যা টুকরা টুকরা কইর্যা ফালায়। হ্যার পর অরা নিজেরাই অগো মনের মতো কইর্যা আইন তৈয়ের কইর্যা আল্লাহ‘র আইন বইল্য আমাগো বুঝায়। আমরাও বুঝি, না বুইঝ্যা তো উপায়ও নাই। হ্যাগো শরীলে তাকৎ আছে, ঘরে নগদ ট্যাকা আছে, লোকবল আছে। আল্লাহর আইনের টুকরা গুলান্রে অরা বেইচ্যা খায়, আল্লহ‘র কালাম বেইচ্যা অরা ব্যবসা করে। অহন হ্যাগো আইন মাইন্যা না লইয়া আল্লাহ‘র টুকরা আইন দিয়া অগো বানাইন্যা নতুন আইনরে ঠ্যাকাইবার পারবা তুমি, না তোমার বউরে বাঁচাইবার পারবা ? তোমার একলার শরীরে তাকৎ থাকলেও ট্যাকা, পয়সা তো নাই। পারবা না। আমি সবই জানি বাবা, তবুও অনেক বয়স অইয়া গেছে তো। তার উপরে এমুন কতা হুনলে মাতাডিরেই বা আর কতকক্ষণ ঠিক রাখন যায় ? তুমি তোমার বউডিরে সামাল দিয়া রাইখো বাবা, যেভাবে পার। ইল্লাল হুজুরের লোভের আগুনে ঐ নিষ্পাপ মাইয়াডিরে তুমি জ্বইল্যা মরতে দিও না বাজান- তোমার একডি পোলা আছে না ?- যতই অরা আল্লাহ‘র আইনরে টুকরা করুক- আল্লাহ‘র উপরে তোমার বিশ্বাস আছে- আমি বুঝবার পারছি। এই বিশ্বাসডি তুমি শ্যাষ পর্যন্ত ধইর্যা রাইখো বাজান- আল্লাহ‘ই তোমারে রক্ষা করবো। এমন কিছু কইরো না -যাতে আল্লাহ নারাজ অয়। আমি যাই বাবা। উত্তরডাঙ্গায় পৌঁছাইতে দুই দিন লাইগ্যা যাইবো।’- উত্তরডাঙ্গার পথে হাঁটতে শুরু করে মির্জা প-িত।
আর দাঁড়ায় না নূরুল্লা। দ্রুত বাড়ীর দিকে হাঁটতে শুরু করে। পথে দু‘ একজনের সাথে দেখা হয়- তারাও একই কথা বলে নূরুল্লাকে। মাথায় যেন সব রক্ত চ’ড়ে যায় নূরুল্লার। আরও জোরে হাঁটতে শুরু করে বাড়ীর দিকে। লজ্জায়, ঘৃণায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করে এই মুহূর্তে। কয়েক দিন আগে অনেক রাত্রে অসহায়ের মতো অতীব দুঃখ, ক্ষোভ আর রাগের সাথে উচ্চারিত একটি মাত্র শব্দ ‘তালাক’- যে শব্দটি এত ভয়াবহ রূপ নিয়ে আবির্ভূত হ’তে পারে ওর জীবনে- কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারে না নূরুল্লা। ভাবতেই শিউরে ওঠে। -‘এই ইল্লাল মুন্সী সুযোগ পাইয়া কতজনের যে ঘর ভাংছে ! অর দেওয়া ‘ফতোয়া’র আগুনে কত জনের সংসার যে জ্বইল্যা পুইড়্যা ছাই অইয়া গেছে- ইয়ত্তা নাই। কিছুদিন আগেই তো অভাব দূর করনের লোভ দ্যাহাইয়া, অনেক ট্যাকা আর চাইল দেওনের কতা কইয়া সুইফ্যারে নষ্ট কইর্যা নিজে বাঁচনের লাইগ্য হ্যায়ই তো অর স্বামীর লগে অরে শহরে পাঠাইছে। মাইয়াডা বাঁচে নাই, মাটিও অয় নাই- স্বামীডাও আর ফিইর্যা আহে নাই। তিউ তো সঠিক কতাই কইছে।’
বাড়ীতে প্রবেশ ক’রে নিজের ঘরের বিছানার এক কোনায় বসে নূরুল্লা। চোখে মুখে ফোটা ফোটা ঘামের চিহ্ন। তিউবাবাকে ডাকে না, ছেলেটার খোঁজ নেয় না, কোন কথাই বলে না নূরুল্লা। কাছে আসে তিউবাবা। কোন সঙ্কোচ না ক’রেই বলে-
‘কি অইলো, সকালে কতা না কইয়াই চইল্যা গেলা, কুনদিন তো এমুন করো নাই তুমি - অহন রাগ পড়ছে ?’
‘না। তর যা কিছু আছে বাইন্দ্যা, টাইন্দ্যা ল। আমরা আর এই মাটিভাঙ্গা গ্যারামে থাকুম না।’
‘ক্যান, শহরে যাইবা ?’ আঁতকে ওঠে তিউবাবা।
‘না। আইচ্ছা ক‘তো, তর কতার বাইরে আমি কহনও গেছি ? যতই রাগ করি আর গোস্যাই করি না ক্যান- যাই নাই। আইজক্যাও যামু না, যতদিন বাঁইচ্যা থাকুম কুনদিনই যামু না- এ্যাত্তদিন ঘর কইর্যা এইডিই বুঝবার পারলি না তুই ? তয়, এই গ্যারামে আর আমরা থাকুম না, আমার এই কতাডারে তুই মাইন্যা ল তিউ।’- কোমরে বাঁধা গামছা খুলে চোখ মোছে নূরুল্লা।
‘তুমি এমুন করতাছ ক্যান ? খুইল্যা কইবা তো কি অইছে ?’-তিউবাবার চোখেও সূক্ষè পানির রেখা।
‘তর শরীলডার উপরে ‘পিচাশের’ শ্বাস পড়ছে। আমাগো কপাল ভাংছে। ঘাটে নৌকা বান্ধা আছে- আইজ মইধ্য রাইতেই চইল্যা যামু আমরা। তয় শহরে যামু না, ভিন্ন কুনো গ্যারামে গিয়া চেষ্টা কইর্যা দেহুম বাঁচনের কুনো উপায় বাইর করন যায় কিনা। ট্যাকা পয়সা তো কিছু নাই, এক কাম কর- আমাগো ভাত খাওনের দুইডি কাশার বাসন আছিলো না ? আমাগো বিয়ার সুময় তর বাপে দিছিলো।’
‘হ। অহনও তো আছে। একডিতে পোলায় ভাত খায়।’
‘ভাতই নাই, আবার কাশার থালায় খাওন !’
‘আইজ নাই, কাইল অইবো।’-খুব সহজ আর সরল উত্তর তিউবাবার।
‘হ। বাঁইচ্যা থাকলে তো !’-শব্দ না ক’রে হাসে নূরুল্লা। বড় তিরস্কারের হাসি- যেন নিজেকে নিজেই তিরস্কার করছেÑ
‘এই ইল্লাল মুন্সী......................................................... !! তরে ছাড়া আমি বাঁচুম না তিউ। তুই আমারে বাঁচা।’-চরম আকুলতা ঝ’রে পড়ে নূরুল্লার কথায়।
নূরুল্লার মাথাটা নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নেয় তিউবাবা। কিন্তু কাঁদে না। কাঁদলে আরও ভেঙ্গে পড়বে নূরুল্লা। ইল্লাল মুন্সীর নামটা শুনেই কিছুটা হ’লেও বুঝতে পারে তিউবাবা- কি ঘটেছে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় দু’জনে মিলে ওরা। আজ মধ্য রাতেই গ্রাম ছেড়ে চ’লে যাবে। থাকবে না আর নূরুল্লা ওর শৈশব কৈশোর যৌবন জড়ানো এই মাটিভাঙ্গা গ্রামে ।
বিক্রি হ’য়ে যায় ওদের শেষ সম্বল- মাত্র দু’টি ‘কাশার থালা’।
০৫.
মাঝ নদীতে নৌকা ওদের। অর্জুনখোলা নদী। নৌকার পাটাতনের ওপর নিজের পা দু’টি লম্বা করে ছড়িয়ে দিয়ে ছড়ানো পা দু’টির ওপর ছেলেটিকে শুইয়ে দিয়ে ওর মাথাটা কোলে নিয়ে নির্বাক হ’য়ে ব’সে থাকে তিউবাবা। দুচোখে পানির ধারা। নিজের বাড়ী থেকে চোরের মতো গা ঢাকা দিয়ে পালিয়ে আসতে হয়েছে- যদি ‘ইল্লাল মুন্সীর’ চোখে প‘ড়ে যায়Ñ শুধু এই আতঙ্কে। সারাক্ষণ সেই মূর্তিমাণ আতঙ্কটি তাড়া ক’রে ফিরছে ওদেরকে পেছন থেকে। যত জোরে সম্ভব নৌকা বাইছে নূরুল্লা। আকাশে প্রচুর মেঘ। বহুদূর থেকে মেঘের গর্জন ভেসে আসছে। উত্তর দিক থেকে শিরশিরে বাতাস বইছে। এই সময় উত্তুরে বাতাস ভাল না- ঝড়ের সংকেত দেয়। কেউ না জানলেও নৌকার মাঝি মাল্লারা এটা খুব ভাল ক’রে জানে। ঝিরঝির ক’রে বৃষ্টি শুরু হয়েছে- এখুনি হয়তো মূষলধারে শুরু হবে- সাথে থাকবে প্রচ- বাতাস। তিউবাবাকে নির্দেশ দেয় নূরুল্লা- ‘তিউ পোলারে লইয়া নায়ের ছইয়ের ভিত্রে আইয়া বস্ । অহনই তুফান শুরু অইবো। বুদ্দি কইর্যা ছইডা লাগাইয়া লইছিলাম নাইলে........’ কথা শেষ করতে পারে না নূরুল্লা, একটা বাতাসের ঝাপটা এসে লাগে ওদের গায়ে। জোরে চিৎকার ক’রে তিউকে আবার বলে- ‘আমরা ভাটির দিকে যাইতাছি। সামনেই উত্তরডাঙ্গার ঘাট। যত জলদি পারুম ঐ ঘাটেই নাও ভিরামু। পাটাতনের আঁড়াডা ভালো কাইর্যা ধইর্যা রাখ।’
নদীতে আর কোন নৌকা নেই। যা-ও বা দু’একটি ছিল- আকাশের গতি দেখে মাল্লারা সবাই তাদের নিজ নিজ নৌকা ঘাটে বেঁধে রেখে যার যার বাড়ীতে চ’লে গেছে। বাতাসের গতিবেগ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। নৌকাটি দুলছে। কখনও বা কাত হ’য়ে যাচ্ছে। কোন ভাবেই নৌকা সামলাতে পারছে না নূরুল্লা। খুব জোরে চিৎকার ক’রে তিউবাবাকে বলছে- ‘তিউ, পোলারে শক্ত কইর্যা ধর, নাও ডুইবা যাইতাছে। আমি আর সামলাইবার পারতাছি না- আল্লারে ডাক, আল্লার নাম ল। এক আল্লাহ ছাড়া আমাগো রক্ষা করনের আর কেউ নাই।’ কথা শেষ হলো নুরুল্লার কিন্তু শেষ রক্ষা আর হ’লো না ওদের। শুধু তিউবাবার শেষ চিৎকারটি শোনা গেল- ‘তুমি কাছে আহ।’
কিন্তু নূরুল্লার আর তিউবাবার কাছে যাওয়া হলো না। নৌকাটি উল্টে গিয়ে ডুবে গেল। ডুবে গেল তিনজন মানুষকে সাথে নিয়ে। তারপর কি হলো কেউ কিছুই জানলো না। প্রবল বর্ষণ, প্রচ- বাতাস আর বিদ্যুত চমকে উত্তরডাঙ্গা গ্রামের পুরোটাই যেন বিলীন হ‘য়ে যাচ্ছিল। মুহূর্তেই অর্জুনখোলা নদীর দুই পাড়ের প্রায় অর্ধেক বসতি বিদ্ধস্ত হ‘য়ে গেল। অথচ জনমানুষের কোন সাড়া শব্দই পাওয় গেল না। যেন এক জনমানবহীন, বসতিবিহীন শুন্য বিরান ভূমিতে পরিণত হলো অর্জুনখোলা নদীর দু‘পাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকা।
আকাশের লক্ষণ বুঝে নিজের ডিঙ্গি নৌকাটিকে উত্তরডাঙ্গার ঘাট থেকে একটু দূরে উল্টে রেখে আরও কিছু দূরের বাবলা গাছের ঝোঁপে আশ্রয় নিয়েছিল কার্তিক মোল্লা। ঝড়ের পুরোটা সময় ওখানেই ছিল সে। বাবলা গাছ খুব সহজে উপড়ায় না- এই যা ভরসা ছিল মোল্লার। আসলে হলোও তাই- এত প্রবল ঝড়েও একটি গাছও উপড়ালো না। এবার ঝোঁপের ভেতর থেকে বেরিয়ে সোজা উল্টোনো ডিঙ্গিটির কাছে এলো কার্তিক মোল্লা। না, ডিঙ্গিটি ঠিকই আছে, উড়ে যায় নি বাতাসে। ধীরে ধীরে তীরের দিকে এগুতে থাকলো মোল্লা। রাত শেষ হবার এখনও কিছু বাকি। তীরে পৌঁছে চম্কে উঠলো কার্তিক। একটি শিশু ভেসে আসছে তীরের দিকে। এদিক ওদিক তাঁকালো ভালো ক’রে- কেউ নেই, একেবারে শুণ্য পাথার। পানিতে নেমে পড়লো মোল্লা। শিশুটিকে পানি থেকে টেনে তীরে তুললো। পানিতে পেটটি ফুলে উঠেছে। দ্রুত পেট ঠেসে ঠেসে ওর মুখ দিয়ে পানি গুলি যতটা সম্ভব বের করলো। ম’রে যায়নি ছেলেটি, এখনও বেঁচে আছে- ভালো ক’রে শুশ্রুষা করলে হযতো বেঁচেও যেতে পারে। মোটেও কালক্ষেপণ করলো না মোল্লা। এই রাতের আঁধারেই বাড়ীতে পৌঁছুতে হবে। কিন্তু বাড়ীটি কি অক্ষত আছে ? ওর স্ত্রীরই বা কি হলো ? বাড়ীর খুব কাছাকাছি এসে পড়েছে মোল্লা। যাক্
এ যাত্রায় টিকে গেছে বাড়ীটি। বাইরের উঠোনে দাঁড়িয়ে ওর জন্যে দারুণ উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছে ওর স্ত্রী। ওদের কোন সন্তানাদি নেই। শিশুটিকে দেখে ও প্রশ্ন করে- ‘কি অইছে অর ? কই পাইলা ?’
‘অহনই অর বুকে, হাতের তালুতে, পায়ের তলায় গরম সইরষার ত্যাল মালিশ কইর্যা শরীলডারে গরম করতে অইবো। নাইলে অরে বাঁচন্ যাইবো না। আমি নগেন ডাক্তররের বাড়ীতে গেলাম, অরে ডাইক্যা আনুম। আইস্যা ব্যাবাক কতা তোমারে খুইল্যা কমু নে। অহন তুমি অর শরীলডারে শুধু গরম করবার ব্যবস্থা কইর্যা দেও।’
‘আহারে, কোন্ মায়ের যে কপাল ভাংলো !’-মোল্লার স্ত্রীর সমবেদনা। তবে শিশুটিকে পেয়ে ভেতরে ভেতরে খুশিতে ভরপুর মোল্লার স্ত্রী।
ওদিকে উজান থেকে একটি ইঞ্জিন-চালিত নৌকা নিয়ে আগত কয়েকজন লোক মাটিভাঙ্গা ঘাট পার হ’ য়ে সামনে কিছুটা এগুতেই দেখতে পেলো একটি মহিলার দেহ ওদের দিকেই ভেসে আসছে। বাতাসের ধাক্কায় উজানের দিকেই এগুচ্ছে দেহটি। কাছে গিয়ে মহিলাটিকে নৌকায় তুলে নিলো। বেঁচে আছে। পেটে বার বার চাপ দিয়ে কিছু পানি পেট থেকে বের করলো। ওকে ওরা চেনে-
০৬.
দক্ষিণমোহনা গ্রামে ওর বাবার বাড়ী। ওখানেই ওকে পৌঁছে দিতে হবে। তাই করলো ওরা, নৌকা ঘুরিয়ে নিয়ে আবার দক্ষিণমোহনা গ্রামের দিকেই যাত্রা শুরু করলো। এরপর কেটে গেল অনেক বছর। কেউ কোন খোঁজ করলো না ছেলেটির। কার্তিক মোল্লার পরিবারেই বেড়ে উঠতে থাকলো ছেলেটি। দেখতে দেখতে পনেরটি বছর পেরিয়ে গেল। ও এখন পূর্ণাঙ্গ যৌবন প্রাপ্তির দিকে। ‘নূর আলী’- নামটি ওরাই দিয়েছে। কারণ, ও যখন সুস্থ হ’য়ে ওঠে তখন ও ওর নিজের নামটি বলতে পারেনি। বাবার নাম জিজ্ঞাসা করলে চুপ ক’রে থেকেছে, মায়ের কথা জিজ্ঞাসা করলে শুধুই সবার মুখের দিকে তাঁকিয়েছে। কিছুই বলতে পারে নি। সম্ভবতঃ স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলো শিশুটি এমন ধারণাই করলো কার্তিক মোল্লা।
এর মধ্যে ছ‘বছর আগে মোল্লার স্ত্রী গত হ’য়েছে। মোল্লার স্ত্রীকে ও নানী বলে ডাকতো। জ্ঞান হবার পর থেকে দেখেছে গ্রামের মানুষ প্রায় সকলেই মোল্লাকে নানা ব’লে ডাকে। সে সূত্র ধ’রেই নূর আলীও মোল্লাকে নানা ডাকতো আর ওর স্ত্রীকে নানী। এই নানীই ওকে সবচাইতে বেশী আদর যতœ করতো। পুরো শৈশব কালটি নানীর কাছেই ঘুমিয়েছে ও। নানীর মৃত্যুর পর ও-ও যেন কেমন হ’য়ে গেলো। সারাক্ষণ বিষন্ন থাকে, কারো সাথে কোন কথা বলে না। মাঝে মাঝে একদৃষ্টিতে আকাশের দিকে নির্মোহ তাঁকিয়ে থাকে। পাখিদের উড়ে চলা দেখে- কেমন ক’রে উড়তে উড়তে এক সময় মেঘের ভেতর অদৃশ্য হয়ে যায় পাখিরা- বড় ভালো লাগে ওর। চিল দেখলে ভীষণ ভয় পায়, আবার ক্ষেপে ওঠে। শুনেছে চিল নাকি পাখিদের বাসা থেকে ওদের বাচ্চাদেরকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। যখন দু‘ডানা প্রসারিত ক’ের কোন চিল আকাশ থেকে নীচের দিকে নেমে আসতে থাকে তখন ভয়ে ও কুঁকরে যায়। দ্রুত কোথাও লুকিয়ে পড়ে। কি জানি ওকেও ছিনিয়ে নিয়ে যায় !
০৭.
নানা সান্ত¦না দেয়, মাঝে মাঝে নৌকায় নিয়ে যায়, দাঁড় টানা, হাল ধরা- এসব শেখায়। এসব কাজের ভেতর দিয়ে আস্তে আস্তে আবার স্বাভাবিক হ’য়ে ওঠে নূর আলী। এভাবে অনেক দিন যায়। বয়স বাড়ে- যৌবন প্রাপ্ত হয় নূর আলী। এখন সে পুরোপুরি আঠারো বছরের পূর্ণাঙ্গ তরুণ। বিগত দু‘বছর থেকে একটি ঘটনা খুব গভীরভাবে লক্ষ করে ও। একজন মেয়ে মানুষ- বয়স আর কত হবে বড়জোর পঁচিশ থেকে ত্রিশের মধ্যে। মাঘ আর ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝি সময়টাতে প্রায় প্রতিদিনই বিকেল শুরু হ’লে উত্তরডাঙ্গা ঘাটে আসে। ঘাট থেকে কিছুটা দূরে- যেখানে মানুষের কোলাহল নেই সেখানে নীরবে দাঁড়িয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে। হয়তো নদীর বুকে ভেসে চলা নৌকার আসা যাওয়া দেখে, ছোট ছোট ঢেউয়ের দিকে তাঁকিয়ে থাকে, মাঝি মাল্লার হাঁক ডাক শোনে আবার কখনও বা শুধুই আকাশের দিকে তাঁকিয়ে থাকে। ভালো না লাগলে কার্তিক মোল্লার ডিঙ্গির কাছে আসে। যদি ওরা থাকে- ডিঙ্গিতে উঠে বসে। মোল্লা নানার সাথে কথা বলে আর অপলক তাঁকিয়ে থাকে নূর আলীর দিকে। সেই মুখ, সেই চোখ, সেই ভ্রু, সেই নাক, সেই ঠোঁট, সেই চুল, সেই হাত, সেই পেশী- এও কি সম্ভব !! কাকে যেন খুঁজে পেতে চায় নারীটি নূর আলীর শরীরের ভেতর, ওর মুখোচ্ছবির অন্তরালে। খুবই আকর্ষণ বোধ করে নূর আলীর প্রতি- ওর দিকে তাঁকিয়ে থাকলে কেমন যেন একটা মাদকতা এসে ভর করে নারীটির দু’চোখের পাতায়। কেন যেন ওর মধ্যেই নিজেকে সম্পূর্ণ বিলিয়ে দিতে ইচ্ছে করে নারীটির। শত প্রবোধ দিয়েও মাদকতার এই সপ্তরাঙ্গা ডিঙ্গিটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না নারীটি।
নারীটি ওর মনের আকুলতা আর তীব্র কৌতূহল থেকে নানাকেও অনেকবার জিজ্ঞেস করেছে নূর আলীর পরিচয়টি। প্রতিবারই নানা বলেছে নূর আলী ওর নাতি, ওর একমাত্র মেয়ের পুত্র। প্রসবের সময় ওকে জন্ম দিয়েই ওর মা মারা গেছে। কার্তিক মোল্লাই ওকে এত বড়টি করেছে। একমাত্র নানা ছাড়া ওর আর কেউ নেই। নানী ছিলো, কিন্তু ছ’বছর আগে সে-ও মারা গেছে। ইচ্ছে করেই নানা নারীটিকে মিথ্যে কথা বলেছে। নূর আলীই যে এখন কার্তিক মোল্লার একমাত্র অন্ধের যষ্ঠি। সত্যি কথাটি বললে নারীটি যদি ওকে নিয়ে যায়! ওকে নিয়ে গেলে নানা যে একেবারেই অসহায় হয়ে যাবে। নানা যে আর
বাঁচবে না। কিন্তু কেন যেন নানার ওই কথা গুলিকে বিশ্বাস করতে পারে নি নারীটি। নানার কথা গুলিকে কেমন যেন এলোমেলো মনে হয়েছে ওর কাছে। তারপরও মেনে নিয়েছেÑ মেনে নিতে হয়েছে নারীটিকে।
যখন এক দৃষ্টিতে নূর আলীর মুখের দিকে তাঁকিয়ে থাকতো নারীটি তখন কেমন একটি অস্বস্তি বোধ করতো নূর আলী। একদিন তো মুখের ওপর বলেই ফেল্ল- ‘কি দ্যাহ তুমি আমার মুখের দিকে অমন ড্যাব্ ড্যাব্ কইর্যা ? তুমি তো মাইয়া মানুষ-শরম তো তোমারই পাওনের কতা। অহন তো দেহি আমারই শরম পাইতাছে।’
‘আহারে- পুরুষ মাইন্ষের অত শরম পাইলে অয় ? বিয়া করলে......, বউরে দেইখ্যা শরম পাবি ?’ মিট মিট ক’রে হাসতে বলে নারীটি- ‘কি অইলো কতা ফুরাইয়্যা গেলো ক্যা ? এতক্ষণ তো কি সোন্দর কতার জাল বুনতাছিলি।’
‘ধুর। তোমার লগে আর কতাই কওন যাইবো না। ও নানা তুমি কিছু কও না ক্যা ?’উপায় না দেখে নানার সাহায্যের জন্যে হাত বাড়ায় নূর আলী।
‘কি কম্ । হ্যায় তো ঠিকই কইছে। জোয়ান পোলা অইছস- হাতে মাইয়া মানুষগো লাহান চুড়ি পইর্যা বেড়াওগা যা।’
‘ও নানা তোমাগো বাড়ীডি দ্যাহাইবা না ?’-নারীটির এই কথাটিতে একটি বিশেষ আকুলতামাখা মিনতির ইঙ্গিত ফুটে ওঠে যেন।
‘আমগো আবার বাড়ী ! মোটে তো তিনখান ভাঙ্গা চালা।’
‘অইলোই বা। তাই দেহুম।’
‘হ। চলো। অহনই যামু। ও নানা, তুমি অর লগে কতা কও, আমি নৌকা বাই, বেশী দূর তো না। দশ মিনিটেই পৌঁছাইয়া যামু।’- উৎসাহিত নূর আলী।
‘হ চল্।’- নানা সায় দেয়। নূর আলী মোল্লা নানার বাড়ীর দিকে নৌকা বাইতে শুরু করে।
০৮.
দিন যায়। মাস যায়। বছরও পেরিয়ে যায়। নূর আলী আর নারীটির সম্পর্ক দিনে দিনে ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হ’তে থাকে। দৈহিক সম্পর্কও স্থাপিত হয় ওদের দু‘জনের মধ্যে এক সময়। নারীটির গর্ভে নূর আলীর সন্তানের ভ্রুনের সৃষ্টি হয় কখন যেন। বোঝে নারীটি। কিন্তু প্রকাশ করে না নূর আলীর কাছে। ভেতরে ভেতরে আতঙ্কিত হয়, নিজে নিজেকে দগ্ধ করে- কি করলো সে এটা ?। হৃৎপি-ের ভেতরে অনুতাপের আগুন জ্বলতে থাকে ধিকি ধিকি। সহ্য করতে পারে না কিছুতেই। তবুও সহ্য করতে হয়, কারণ উপায় নেই। নিজের ভেতর নিজেই ম’রে যেতে থাকে নিরন্তর।
‘ও নানা, দুপুর তো গড়ায়া গেল ! মাছ ধরবা কহন ? খালি তামুকই খাও, কল্কিতে যে তামুক নাই- ধুমা বাইরায় না। হুনছ নাকি কানে পানি দেওন লাগবো ?’ ডিঙ্গি নৌকা বাইতে বাইতে চিৎকার ক’রে কথা গুলি বলে আঠারো পেরিয়ে যাওয়া তরুণ নাতি নূর আলী। কথাগুলি ব’লে হাসতে থাকে শব্দ ক’রে। মনের ভেতর কেমন যেন এক ধরনের পুলক অনুভব করে- এই ভেবে যে, একটু পরেই নানার কথার ফুল্কি ঝরতে শুরু করবে। আর একবার শুরু হ’লে একমাত্র নূর আলী ছাড়া আর কেউ সে কথা থামাতে পারবে না।
‘অই, অত চিক্কুর পাড়স ক্যা ? আইবার সুময় চাইল ভাইজ্যা আনবার কইছিলাম ত্যাল নুন দিয়া, আনছস ? অনেক দূর থাইক্যা আইলাম না ! আগে নাও ঘাটে ভিরামু , হ্যার বাদে খাইয়া দাইয়া জালে হাত দিমু, বুঝছস। অহন বাইয়া চল জোরে-উত্তরডাঙ্গার ঘাটে।’ -ডিঙ্গির অপর প্রান্তের গলুই থেকে উত্তর দেয় নানা কার্তিক মোল্লা। কার্তিক মাসের অভাব আর উপবাসী দিনে জন্মেছিল ব’লে ওর বাবা মা ওই নামটিই রেখেছিল ওর- বুকে একরাশ দুঃখ নিয়ে।
‘চাইলভাজা নাই , খাইয়া ফালাইছি।’
‘আমারে ভ্যাঙ্গাইতাছস ? আরে এই বয়েসেও নাও বাইতাছি, মাছ ধরতাছি। আমি মরলে খাবি কি ? অহনও জালই তো ঠিক মতো ধরবার শিখলি না। তর লাইগ্যাই তো অহনও নাও বাইতাছি, মাছ ধরতাছি। আমার তো অহন শুইয়া বইয়া খাওনের কতা। হ, কপালে নাই- তা কি আর অয় ?’ নানা জানে চাইলভাজা নূর আলী খায় নাই। নানাকে ছাড়া একটি দানাও সে মুখে দেয় না। শুধু নানাকে ক্ষ্যাপানোর জন্যেই নূর আলী কথাগুলি বলেছে। ‘বিয়ান থাইক্যা নাও বাইতাছি, দুপুর পার অইয়া গেল- না খাইয়া বইস্যা থাকুম নাকি তোমার লাইগ্যা ? তোমার তো তামুক অইলে আর কিছু লাগে না- তুমি তামুকই খাও, আমারে ছবক দেওন লাগবো না। হুন, তোমারে আর নাও বাওন লাগবো না। মাছ ধরতেও অইবো না। এতদিন তুমি খাটছ, অহন আমি খাটুম। গতরে তাকৎ কি কম আছে ? তোমারে আর কষ্ট করবার দিমু না।’-জোরে ডিঙ্গি বাইতে থাকে নূর আলী। নৌকা ঘাটে ভিরিয়ে বাঁধে নূর আলী। মোল্লা নেমে পড়ে ডিঙ্গি থেকে। নেমেই হাঁটতে শুরু করে দোকানের দিকে। তামাক আনতে। নূর আলীকে ব’লে যায়- ‘আমি তামুক আনতে গেলাম। তুই চাইলভাজা তৈয়ের কর।’
গামছায় বাঁধা চালভাজার পোটলাটি খুলে ডিঙ্গির পাটাতনের ওপর রেখে নদীর পানিতে মুখ হাত ধুয়ে ডিঙ্গিতে এসে গামছার এক মাথা দিয়ে মুখ হাত মুছে নিয়ে নিবিষ্ট মনে চালভাজা মাখতে শুরু করে নূর আলী। হঠাৎ পেছন থেকে নারী কণ্ঠস্বর-‘কিরে নূর আলী, আইজক্যাও চাইলভাজা খাওয়াবি ?’
‘অ, আপনে আইছেন ? বহেন। আপনে তো চাইলভাজা খাওনের লইগ্যাই আহেন- ঠিক কইছি না ?’-ঘুরে নারীটিকে দেখে কথাগুলি বলে নূর আলী।
‘বেঠিক কইছস- এইডা কি আমি কইছি ?’- ডিঙ্গিতে উঠে ব’সে নারীটি প্রশ্ন করে- ‘নানায় কই গ্যাছে ?’
‘কই আর যাইবো, যাওনের জায়গা তো একডাই- ঐ তামুক। দোকানে গেছে তামুক আনতে। আইস্যা পড়বো অহনই।’
‘নূর আলী, একডা কতা কমু ?’
‘কও।’
‘ডিঙ্গিতে কইর্যা আইজক্যা আমারে নদীডিরে ইট্টু ভালো কইর্যা ঘুইর্যা ঘুইর্যা দ্যাহাইয়া আনবি ? কয়দিন থাইক্যা শরীলডা ভালো না, মনডাও আইজক্যা কেমন জানি করতাছে। যাবি ?’
০৯.
‘ক্যান যামু না। তোমার শরীল খারাপ, কই আমারে তো কও নাই।’
‘তর কতাগুলান এত কইর্যা মিডা, মিডা লাগে ক্যান্রে নূর আলী ?’-নারীটি অবিচল তাকিয়েই থাকে নূর আলীর দিকে।
‘তোমার কতাও তো আমার কাছে মিডা লাগে। কই আমি তো হেই কতা তোমারে জিগাই নাই।’
‘তর জিগানের আগেই আমি তো উত্তর দিয়াই দিলাম। তর কতা আমার কাছে মিডা লাগলে আমার কতা তর কাছে মিডা লাগবো না ক্যান্ ?’
‘হ। এইবার ঠিক কতাডাই কইছ। ঐ যে নানায় আইতাছে। তুমি নানারে কতাডা কইও।’
নানা ডিঙ্গির কাছে এসেই জিজ্ঞাসা করলো নারীটিকে-‘তুমি কহন আইছ ?’
‘এই তো। আর তো তোমাগো কাছে আহন যাইবো না নানা। তোমার নাতি খালি কয়- আমি নাকি খালি চাইলভাজা খাওনের লইগ্যাই তোমাগো কাছে আহি। নানা, আইজক্যা তোমার ডিঙ্গিডিরে ইট্টু দিবা ? নূর আলীরে লইয়া নদীডিরে ইট্টু ভালো কইর্যা দেহুম। আইজক্যা মনডা ক্যামন জানি করতাছে। দিবা নানা ?’
‘দিমু না মানে, এইডা কতা অইলো একডা। অই নূর আলী, চাইলভাজা খাইয়্যা অরে লইয়া যা, যেমুন কইর্যা দেখবার চায় তেমুন কইর্যাই দেহাবি। আইজ আর মাছ ধরুম না। বাজারেই থাকুম। তরা ফিইর্যা আইলে অরে নৌকায় তুইল্যা দিয়া এক লগে বাড়ীত্ যামু। বুঝছস। অহন খাও।’
১০.
চালভাজা শেষ হ’লে নানা বাজারের পথে পাড়ি দেয়। ওরা দু‘জন ডিঙ্গি নিয়ে নদীতে ভেসে চলে- যেন এক জোড়া মুক্ত চক্রবাক প্রশস্ত ডানা মেলে দূর দূরান্তের অসীমে অনন্ত কালের জন্যে নিরুদ্দেশ হ’য়ে যেতে চায়। নূর আলী ডিঙ্গি বায়। নারীটি তাকিয়েই থাকে ওর মুখের দিকে। অদ্ভূত রকমের সুন্দর লাগে ওকে। শুধু দেখতেই ইচ্ছে করে যুগ যুগান্তর ধ’রে। দেখার তৃষ্ণা যেন কিছুতেই মেটে না ওর। নৌকাতেই কিছু কথা হয় ওদের দু‘জনের। প্রথম নারীটিই কথা বলে-‘নূর আলী কয়ডা দিন আমি আসুম না। বাড়ীতে আমার কিছু কাম রইছে। হেই কামগুলিরে হ্যাষ করতে কয়ডা দিন সুময় লাগবো। কাম হ্যাষ কইর্যাই আবার আমি ফিইর্যা আহুম। তরে লইয়া আমি ভিন দ্যাশে চইল্যা যামু। যাবি না আমার লগে ?
‘হেইডা তো পরে। কিন্তু তুমি না আইলে আমি থাকুম ক্যামনে। আমার যে কিছুই ভাল্লাগবো না। -আকুল হ’য়ে কথাগুলি বলে নূর আলী।
‘তরে না দেইখ্যা থাকতে আমারই কি ভাল্লাগবো ? মাত্র কয়ডা তো দিন। পারবি না থাকতে ? তর লগে আমার অনেক কতা আছে। সব কতা তরে হুনতে অইবো। আর নানারে আগলাইয়া রাখবি। নানার জানি কষ্ট না অয়। এমনিতেই তো হাপানির ব্যারাম আছে অর।’
‘আমারও তো তোমার লগে ম্যালা কতা আছে- তুমি তো হুনবারই চাও না।’।
‘হ। তুই আমার কতা হুনবি, আমি তর কতা হুনুম। তয় কয়ডা দিন পর। অহন চল্ ঘাটে ফিইর্যা যাই।’
‘অহনই নদী দ্যাহন শ্যাষ অইলো তোমার ? কিছুই তো দ্যাখলা না।’
‘যা দ্যাহনের তা আমি দেখছি। আর দ্যাহন লাগবো না, ঘাটে ফিইর্যা চল্।
ঘাটে ফিরে এলো ওরা। আগেই নানা ঘাঠে এসে পৌছেছে। ওদেরকে দেখে নারীটিকে লক্ষ ক’রে নানাই মুখ খুল্ল- ‘কি, নদী দ্যাহন অইলো তোমার ?’
‘হ নানা, অইছে। অহন তুমি আমারে একডা নায়ে তুইল্যা দেও- আমি যাই।’
‘তুমি কই থাইক্যা যে আহ আর কই যাও- এত্ত জিগাইলাম এক দিনও তো কইলা না।’
‘কমু নানা, ঠিকই একদিন কমু। আইজ যাই নানা।’
ফিরে চ’লে গেল নারীটি। যতক্ষণ দেখা যায় তাকিয়ে থাকল নূর আলী ওর দিকে। তারপর ওরাও চ’লে গেল ওদের বাড়ীর পথে। যেতে যেতে ভাবতে থাকলো নানা- কেমন ক’রে ওদের এই অসম ভালোবাসা এত গভীর হ’য়ে উঠলো ? বেঁচে থাক্ ওরা। ওদের এই ভালোবাসা যেন কোন দিন না ফুরায়-মনে মনে কামনা করে নানা।
এর মধ্যে দু‘মাস অতিক্রান্ত হয়েছে- নারীটি আসে নি। প্রতিদিন অধৈর্য অপেক্ষার প্রহর গুনেছে নূর আলী। কিন্তু সে আসে নি। নারীটি চ’লে যাবার দশ দিনের মাথায় নানার এ্যাজ্মা ভীষণ রকমের বেড়ে যায়। নূর আলী স্থানীয় নগেন ডাক্তার, ভুলু কবিরাজের কাছ থেকে বিভিন্ন প্রকারের ওষুধ নিয়ে আসে, নানাকে খাওয়ায়, কিন্তু কোন কাজ হয় না। বরং মাত্রা বাড়তেই থাকে। ভাত খায় না, কথাও বলতে পারে না ঠিকমত- শুধুই হাঁপায় আর কাশিতে অস্থির হ’য়ে ওঠে। একবার হাঁপাতে শুরু করলে গোটা শরীর বাঁকা হ’য়ে নিঃশ্ব^াস যেন বন্ধ হ’য়ে আসতে চায়। সামলাতে পারে না নানা।
কয়েক দিনের অতি-পরিশ্রমে ক্লান্ত হ’য়ে পড়ে নূর আলী। একাকেই নৌকা বাইতে হয়, মাছ ধরতে হয়, সে মাছ আবার আড়তে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করতে হয়। দু‘জনের ভাত রান্না করতে হয়। একই সাথে ডাক্তার, কবিরাজের বাড়ী থেকে ওষুধ এনে নানাকে খাইয়ে দিয়ে অনেক রাত অবধি নানার পাশে থাকতে হয়। যখন রাত্রি গভীর হয় ক্লান্তিতে ডুবে গেলেও ঘুম আসে না দু‘চেখে, ভাবে- এ সময়টাতে তার বড় প্রয়োজন ছিলো, যদি সে আসতো একটিবার। বিনিদ্র রাত্রি কাটিয়ে দেয় নূর আলী। চোখের পানি মোছে।
১১.
একদিন খুব দেরী ক’রে ঘুম থেকে ওঠে নূর আলী। সারা রাত জেগে থাকা চোখ দু‘টিতে শেষ রাত্রির দিকে বুঝি একটু ঘুমের মতো তন্দ্রা এসেছিল। ও জানে নানা হয়তো ঘুম থেকে উঠেছে। কারণ নানা খুব ভোরেই ঘুম থেকে ওঠে- এটা তার প্রতিদিনের অভ্যাস। ঘুম থেকে উঠে বিছানায় শুয়ে শুয়ে নূর আলীর ডাকের অপেক্ষায় থাকে। আজও হয়তো নূর আলীর ডাকের অপেক্ষাতেই আছে। নানার ঘরের দরোজার সামনে গিয়ে নানাকে ডাকে। নানা কোন সাড়া দেয় না। দ্বিতীয় বারের ডাকেও কোন সাড়া নেই। সন্দেহ সৃষ্টি হয় নূর আলীর মনে। বাঁশের দরোজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করেই চাঁপা চিৎকার ক’রে ওঠে- ‘ও নানা তুমি মাটিতে ক্যান ?’ কাছে যায়- নানার শরীর ধ’রে ঝাঁকুনি দেয়- না, নানার কোন প্রতিক্রিয়া নেই। বুঝতে পারে ওর মায়া ত্যাগ ক’রে নানা চ’লে গেছে পরপারে- আর আসবে না। রাতে কখন বিছানা থেকে মাটিতে প’ড়ে গেছে- টের পায় নি নূর আলী। নিজেকে খুবই অপরাধী মনে হয় ওর নিজের কাছে। চোখ দু‘টি খোলা। শিয়রের কাছে গিয়ে মাথাটা কোলে তুলে নিয়ে ডান হাত দিয়ে খোলা চোখ দু‘টি বন্ধ ক’রে দেয় নূর আলী। গ্রামের মানুষই ওর কাফন দাফন করে, ওর কবরে ফাতেহা পাঠ করে। একটি অধ্যায়ের যবনিকাপাত হ’য়ে যায়।
নিজের ছোট্ট ঘরে সামান্য বিছানায় চিৎ হ’য়ে শুয়ে আছে নূর আলী। খোলা চোখ। দু‘টো হাত মাথার নীচে। আকাশে মেঘের ভেতর দিয়ে সাদা ধব্ ধবে লুঙ্গি আর পাঞ্জাবী প’রে হেঁটে চলেছে কার্তিক মোল্লা। দূরে দু‘হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওর ¯ত্রী। ডান দিকের গলার পাশ দিয়ে পেছন দিকে উড়ছে ওর রঙ্গিন শাড়ীর আঁচল। আকুল আগ্রহে আহ্বান জানাচ্ছে স্বামীকে দু‘হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরবার। পাখিরা প্রানপণ চেষ্টা করছে ওদের কাছে পৌঁছে যাবার কিন্তু কিছুতেই পারছে না। কয়েকটি বিশাল চিল উড়ে আসছে ওর দিকে- সহ্য করতে পারছে না নূর আলী। হঠাৎ নারী-কণ্ঠস্বর- ‘নূর আলী।’
১২. কথা বলে না নূর আলী। স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। দরোজার দিকে তাঁকায় নূর আলী। ভেতরে প্রবেশ করছে নারীটি। প্রবেশ করেই ওর মাথার কাছে বসে নারীটি। কপালে হাত রেখে বলে-
‘খুব রাগ করছস না ? এতদিন আহি নাই।’
‘না। রাগ করুম কার লগে। তুমি কি হেই অধিকার আমারে দিছ ?’ অভিমানের সুর নূর আলীর কণ্ঠে।
‘কবেই তো দিয়া রাখছি। তুই নিবার পারস নাই। আইজক্যা হেই অধিকারডিই আবার হক্কলের সামনেই তরে দিবার আইছি। এতদিন তো লুকাইন্যা আছিলো, অহন হক্কলের সামনে নিবি না ?’
‘ক্যান নিমু না ? নিবার জন্যেই তো এতদিন ধইর্যা খালি মিনিট ঘণ্টা গুইন্যা যাইতাছি।’
‘নানায় কই ?’- নারীটি জানতে চায়।‘দ্যাড় মাস অইলো মইর্যা গেছে। খুব জোর হাঁপানিতে ধরছিলো। রাইতের বেলা কহন জানি বিছনা থাইক্যা মাটিতে পইড়া গেছে কইবার পারি না। বিয়ানে দরজা খুইল্যা দেহি মাটিতে পইড়া মইর্যা রইছে। কি করুম, আমার কপালডাই যে এই রহুম। বাপে নাই, মায়ে নাই, হ্যাষে এক নানারে পাইছিলাম হ্যায়ও আমারে একলা ফালাইয়া চইল্যা গেল। অহন ক্যাডা আমারে দেখবো, কার লগে আমি কতা কমু ?’
‘সৎকার অইছে ?’
‘হ গ্যারামের মানুষ মিইল্যা করছে। ফাতেহাও পাঠ করইন্যা অইছে।
‘আমারে একডি খবরও দিলি না ?’
‘কই পামু আমি তোমারে যে খবর দিমু ? কত কইর্যা ঠিকানাডা চাইছিলাম, দিছিলা ?
‘দেই নাই। তয় আইজক্যা দিমু। আইজ থাইক্যা এই বাড়ীই আমার ঠিকানা। এই বাড়ী থাইক্যা আর আমি কুনোদিন যামু না। চল্ নানার কবরডা দেইখ্যা আহি।’
‘সত্য কইতাছ ? তুমি আর যাইবা না ?’
‘ক্যান, তর লগে আমি কি মিছা কতা কই ? না কইছি কুনোদিন ? চল্ কবরডা দেইখ্যা আহি।’
‘চল।’
বেরিয়ে যায় ওরা দু‘জন । নানার কবর দেখা শেষ ক’রে আবার ফিরে আসে। ফিরে এসে বিছানাতেই বসে দু‘জন। নারীটি ওর সাথে থাকা ব্যাগ থেকে কাগজে মোড়ানো একটি প্যাকেট বের ক’রে নূর আলীর হাতে দিয়ে বলে-
‘এইডা ভালো কইর্যা রাইখ্যা দে। এ্যার মইধ্যে তিরিশ হাজার ট্যাকা আছে................................হোন্ তর কানে কানে একডি কতা কই’-বলেই ওর কানে মুখ লাগিয়ে ফিস্ ফিস্ ক’রে কি যেন বলে। আনন্দে উচ্ছ্বসিত হ’য়ে ওঠে নূর আলী। বলে-
১৩.
‘কিন্তু আমার শরম করবো যে। এত কম বয়সে পোলার বাপ হমু মাইনসে আমারে শরম দিবো না ?’
‘দিলো। তাতে তর কি অইলো ? তাতে কি তর বাপ হওন খারিজ অইয়া যাইবো ? পোলা বা মাইয়া যাই হইক তর গরব লাগবো না ? তার উপরে, তর সন্তান আমার প্যাডে- এইডিতেও তো তর গরব লাগনের কতা। যে ট্যাকাডা দিলাম- বাচ্চাডি জন্মাইবার সুময় যদি আমি মইর্যা যাই তাইলে যে শিশুটি জন্মাইবো-যদি বাঁইচ্যা থাহে- তাইলে এই ট্যাকা দিয়া হ্যারে মনুষ করবি, দেখবি তর আরও গরব লাগবো।’
‘তা তো লাগবোই। বাপ অইতে, নিজের সন্তানরে মানুষ করতে কার না গরব লাগে ? কিন্তু তুমি মরবা ক্যান ? আমার চাইতে তোমার বয়েস অনেক বেশী বইল্যা শরম পাইয়া ?’
‘আরে না, এইডি আমাগো ধর্মে কুনো বাধা না।
‘ঈমাম হুজুরও কইছে- ইসলাম ধর্মে এইডি কুনো বাধা না। হুজুররে আমি জিগাইছিলাম- তোমার লগে যদি আমার বিয়া অয় তাইলে তোমার বয়েস বেশী বইল্যা আমাগো ধর্মে কুনো বাধা আছে কি না ? হুজুরে কইছে- কুনো বাধা নাই।’
‘অহন তর ঠোডে আমি একডি চুমা দেই।’-খুশির সাথে উত্তেজনা প্রকাশ পায় নারীটির কথায়। ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ভারী হতে থাকে।
‘দ্যাও। তয়, আমিও তোমার ঠোডে দিমু।’
‘হ। দিস্।
দু‘জন দু‘জনকে প্রগাঢ় চুম্বনে চুম্বনে সিক্ত করতে থাকে পাগলের মতো। নারীটি কথা বলে-
আইজ রাইতে আমরা আর কিছু খামু না, ঘুমামুও না। সারা রাইত কতা কইয়াই পার কইর্যা দিমু- কি কস্ ?’
‘হ। দিমু । ইট্টুও ঘুমামু না।’
‘ঠিক আছে। কাইল সকালে তাইলে পরথমেই তরে কি করন লাগবো ক’তো ?’
‘সোজা উত্তর তো পইড়াই রইছে- তোমারে বিয়া করন লাগবো। আমরা দুইজন দুইজনরে বিয়া করুম। এইডি যে অইবো আমি অনেক আগেই ট্যার পাইছিলাম। তোমার কতাতেই বুইজ্যা লইছিলাম। হেইর লাইগ্যা আমি মসজিদের ঈমাাম হজুরসহ গ্যারামের মূরুব্বিগো অনেক আগেই কইয়া রাখছিলাম- হ্যারা তো বেজায় খুশি। বিয়াতে হক্কলেই আইবো। কিন্তু অগো আমি খাওয়ামু কী ? নানায়ও তো চইল্যা গ্যাছে, হ্যায় থাকলে কত্ত খুশি অইতো। হ্যায় ছাড়া ক্যামনে সামাল দিমু আমি সবকিছু ?’
‘হেইসব লইয়্যা তরে ভাবতে অইবো না। ব্যবাক ব্যবস্থা আমিই করুম।’-দৃঢ়তা লক্ষ করে নূর আলী নারীটির কণ্ঠস্বরে।
‘আইজক্যা রাইতে আমরা মিলুম না ?’-একটি বিশেষ আকাঙক্সক্ষা ফুটে ওঠে নূর আলীর প্রশ্নে।
‘মিলুম। খুব ইচ্ছা করতাছে না ? দুই মাস আহি নাই- ইচ্ছা তো করবোই।’
‘কুপিটা নিভাইয়্যা দে। অহনই অইবো।’-নারীটির নিঃশ্বাস ঘন হ’তে শুরু করে।
কিছক্ষণের জন্যে ওরা দু‘জন হারিয়ে যায় এক ভিন্ন গ্রহান্তরে। আর যেন ফিরতেই ইচ্ছে করে না ওখান থেকে। ইচ্ছে করে ওখানেই থেকে যায় যুগ থেকে যুগান্তর ধ‘রে। ।
বাড়ীর পাশের খাল থেকে চুপি চুপি গোসল ক’রে আসে নারীটি। এসে ব্যাগ থেকে নতুন শাড়ী বের ক’রে প‘রে নেয় নূর আলীর সামনেই- নিঃসঙ্কোচে। ভেজা শাড়ীটি ঘরের বাইরে চিপে নিয়ে ঘরের ভেতর টাঙ্গানো দড়িতে ঝুলিয়ে রেখে শুয়ে পড়ে নূর আলীর পাশে। শুয়ে কিছু এলোমেলো কথার পর জিজ্ঞাসা করে-
‘আইচ্ছাা নূর আলী, তর বাপের কতা তর মনে পড়ে না ? কি আছিলো তর বাপের নাম ? বিয়া পড়াইন্যার সুময় তো তর বাপের নামডি লাগবো।’
‘কইয়া দিমু একডি নাম। আমি খুব ছোড থাকতেই তো বাপে মইর্যা গেছে। আমার কিছুই স্মরণ নাই। ক্যামনে কমু আমি তার নাম ? আমাগো বাড়ীডা কুন গ্যারামে আছিলো হেইডিও তো কইবার পারি না। মায়ের নাম কি আছিলো হেইডিও তো আমার জানা নাই।’
‘তর মায়ের কতা মনে পড়ে না ? হ্যায় অহন কই ? কি অইছে তার, তর কাছে আহে না ক্যান ?’
‘নানায় কইছে- মায়ে একদিন ঘাটে বান্ধা নায়ের উপরে বইস্যা বাপের লাইগ্যা অপেক্ষা করতে আছিলো। বইস্যা থাকতে থাকতে কোমর লাইগ্যা গেলে একবার খাড়া অইছিলো, অমনি একডা খুব বড় চিলা আইস্যা ছোঁ মাইর্যা মায়ের চক্ষু দু‘ইডিরে উপড়াইয়া লইয়া গেছে- মায়ে আর বাঁচে নাই। হেই লাইগ্যা চিলারে আমি সইহ্য করবার পারি না। চিলা নাকি পাখির বাচ্চাগোও লইয়া যায়।’ ওর মায়ের মৃত্যুর বর্ণনাটি নানা মিথ্যে ক’রে ওকে সান্ত¦না দেবার জন্যেই ওভাবে দিয়েছে- আর সেটি নূর আলী বিশ্বাসও করেছে। যেহেতু মিথ্যে ক’রে বলা ছাড়া নানার আর কোন উপায়ও ছিলো না- এটিই সত্য। কারণ নূর আলীর মা‘কে নানা কখনও চিনতই না। আসলে ছোঁ মেরে একজন জীবিত মানুষের দু‘চোখের মনি উপড়ে নেবার ক্ষমতা চিলের যে মোটেও নেই- এটি বোঝার মতো বয়স নূর আলীর তখনও হয় নি- এই ভরসাতেই মিথ্যে ক’রে বর্ণনাটি ওকে দিয়েছিল নানা।
১৪.
‘আইচ্ছা রে নূর আলী মনে কইর্যা দ্যাখতো তর বাপেরে কেউ নূরুল্লা মাল্লা বইল্যা ডাকতো কিনা ?’
‘কইবার পারুম না, মনে নাই। তয় যহন খুব ছুডো আছিলাম তহন ক্যাডা ক্যাডা জানি আমাগো বাড়ীতে আইয়্যা বাপেরে ‘নুইল্লা’ বইল্যা ডাকতো। নাও লইয়্যা যাইবার কইতো। মায়ে আমারে কিছু কইছিলো কিনা ব্যাকডি মনে নাই। এইটুকুন খালি মনে আছে বাপের শরীলে নাকি খুব তাকৎ আছিলো, নাও লইয়্যা দূরপাল্লায় যাইতো।’
যা সন্দেহ করেছিল তাই হলো। একটি কথাও আর বলল না নারীটি। শুধু ভাবলো- নানা যে নূর আলীকে বলেছিল একটি চিল ছোঁ মেরে ওর মায়ের চোখ দু‘টি উপড়ে নিয়ে গিয়েছিল- এখন মনে হচ্ছে এটিই সত্যি। নানা ঠিকই বলেছিল। ওর মা তো অন্ধ হ’য়ে গিয়েছিল। চোখ থাকতেও কিছুই দেখতে পায় নি। যে চোখে দৃষ্টিশক্তি থাকতেও দেখতে পারে না সে চোখ থাকবে কেন ? বালিশের পাশ থেকে দেশ্লাই নিয়ে নিজেই কুপি জ্বালালো। কুপির আলোতে নূর আলীর মুখের দিকে অনেক্ষণ ধ ’রে তাঁকিয়ে থাকলো। ঐ তাকিয়ে থাকা অবস্থাতেই নূর আলী ব’লে উঠলো-
‘কি দ্যাহ তুমি প্রায়ই অমন কইর্যা আমার মুখের দিকে ? এ্যাত্ত জিগাই একদিনও তো উত্তর দ্যাও না ?’
‘জীবনভর তরে দ্যাখলেও তরে দ্যাখনের সাধ আমার মিটবো না যে নূর আলী। হোন্, তুই ঘুমা। নানার লগে শ্যাষ দ্যাহাডাও আমার অয় নাই। নানার ঘরডি খালি পইড়্যা রইছে, আইজক্যার রইতডি আমি নানার ঘরেই ঘুমাই।’-কথাগুলি কোন সম্মোহিত নারীর কণ্ঠ থেকে যেন বেরিয়ে এলো। মনে হ’লো যেন- অন্তরবিহীন নি®প্রাণ কথার ভাবলেশহীন উচ্চারণ মাত্র। ‘ঠিক আছে যাও, ঘুমাও গা।’-নূর আলীর ছোট্ট উত্তর।
১৫.
নানার ঘরে এসে ভালো ক’রে দরোজা লাগিয়ে দিয়ে নানার বিছানায় শুয়ে নিঃশব্দে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে নারীটি। জন্ম জন্মান্তরেও এ কান্নার বুঝি শেষ হবে না। কান্নার সাথে সাথে আগুনে পুড়ে ছাই হ’য়ে যায় ওর অন্তর।
অনুশোচনার তীব্র দহনে জর্জরিত হ’তে থাকে- ‘এ আমি কি করলাম ? নিজের পোলার সন্তান আমি আমার নিজ গর্ভে ধারণ করলাম ! এ্যার থাইক্যা বড় পাপ এ্যাত্ত বড় দুনিয়াতে আর একডিও আছে কি ? দোজখেও তো আমার জায়গা অইবো না।
আর কাউরে না দ্যাহাই, এই মুখ আমি নিজেই বা দেহুম ক্যামুন কইর্যা ? দুনিয়াতেও আর আমার এই পাপে পইচ্যা যাওয়া দেহডিরে পোতাইবার লাইগ্যা একফোটা জমিনও পাওন যাইবো না। ক্যান আমি অরে চিনবার পারলাম না? কই গেছিলো আমার অন্তর ? মায়ে অইয়্যা নিজের পোলারে চিনবার পারলাম নাÑ আমি বাইচ্যা থাহুম ক্যান ?’ এত বড় বিশাল প্রশ্নের অতি ক্ষুদ্র কোনো উত্তরও নেই নারীটির কাছে।
আর না। একটু পরেই নতুন ভোরের আগমনী বার্তা নিয়ে পূর্ব দিগন্ত রক্তিম হ’য়ে উঠবে। সে দিগন্ত বিস্তৃত রক্তিম রেখার রং কোনোভাবেই সহ্য করতে পারবে না নারীটি। এ রংটি পৃথিবীর আর সব মানুষের জন্যে হলেও ওর জন্যে নয়। এ নিষ্পাপ প্রভাতকে প্রত্যক্ষ করবার কোনো অধিকারই যে ওর আর নেই। সে কারণে সে রং দেখবার আগেই চ’লে যেতে হবে ওকে- এটিই চূড়ান্ত।
আর দেরী করলো না নারীটি। অতি সন্তর্পণে ঘর থেকে রেরিয়ে উত্তরডাঙ্গা ঘাটের দিকে যাত্রা শুরু করলো। যেতে যেতে হঠাৎ করে একটি ঝোপের ভেতর প্রবেশ করলো। কিছু সময় পর বাম হাতের মুঠিতে কি যেন নিয়ে বেরিয়ে এলো ঝোপ থেকে। বেরিয়েই এদিক ওদিক একটু দেখে নিয়ে দ্রুত হাঁটতে শুরু করলো উত্তরডাঙ্গা ঘাটের উদ্দেশ্যে। ভোর হ’লে সবাই ঘাটে এসে দেখল কার্তিক মোল্লার ডিঙ্গিতে একজন নারী শুয়ে আছে। দু একজন ডাকলো নারীটিকে। কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে একজন গিয়ে নারীটির শ্বাস প্রশ্বাস পরখ করবার চেষ্টা করলো। এরপর অনেকেই নারীটির কাছে গেলো। দেখলো কিছুক্ষণ। কেউ একজন নারীটির শরীর স্পর্শ করলো। স্পর্শ করেই মুখ ঘুরিয়ে অন্য সবার দিকে তাকিয়ে শুধু মাথাটি নাড়ালো। সবাই বুঝে গেলো নারীটির দেহে আর প্রাণ নেই। কিছু আগেই প্রাণটি বেরিয়ে গেছে। গুঞ্জণ শুরু হলো নারীটিকে নিয়ে। নারীটি প্রায়ই উত্তরডাঙ্গার ঘাটে আসতো, কার্তিক মোল্লার ডিঙ্গিতে বসতো, কার্তিক মোল্লা, নূর আলী -এদের সাথে কথা বলতো- এটি সবাই জানে। আর জানে ব’লেই সবাই দুঃখ প্রকাশ করলো। অনেক ভীরের মাঝ থেকে কে একজন ব’লে উঠল- ‘ এ তো ‘তিউবাবা’। দক্ষিণমোহনা গ্যারামের তিউবাবা, মাটিভাঙ্গা গ্যারামের নূরুল্লা মাল্লার বউ। অনেক বছর আগে মাঝ রাইতে তুফানের মইধ্যে নৌকাডুবির কবলে পইড়্যা কুনোরকমে বাঁইচ্যা গেছিলো। হ্যার পর থাইক্যা বেশীর ভাগ সুময় দক্ষিণমোহনা গ্যারামের বাপের বাড়ীতেই থাকতো। নৌকাডুবির পরে অব মাতা খারাপ অইয়্যা গেছিলো। কাউরেই চিনবার পরতো না। অর বাপে বছর বছর ধইর্যা অর চিকিৎসা করাইছে হ্যাতেও ঠিক করবার পারে নাই। অহনও পূরা মাতাডি ঠিক অয় নাই। অহনও কাউরে কাউরে চিনবার পারে কাউরে কাউরে পারে না। কারো ছুডো পোলা দ্যাখলে ছুইট্যা গিয়া পোলাডিরে টানাটানি করতো, কোলে নিবার চাইতো। জোয়ান মানুষ দ্যাখলে হ্যার লগে কতা কইবার চাইতো। আবার মাতাডি কুনো সুময় ইট্টু ঠিক অইয়্যা গেলে অনেকেরই চিনবার পারতো। এই অবস্থা দেইখ্যা অর বাপে মাঝে মাঝে মাটিভাঙ্গায় অর স্বামীর বাড়ীতেও অরে লইয়্যা যাইতো। কয়দিন ধইর্যা বাপে বেটিতে মিইল্যা হেই বাড়ীতেই থাকতোÑ খালি এইডি ভাইব্যাই অর বাপে অর স্বামীর বাড়ীতে অরে লইয়্যা যাইতো, রাইত কাটাইতোÑ যদি স্বামীর বাড়ীর সবকিছু দেইখ্যা অর মাতাডি পূরা ঠিক অইয়্য যাইবার পারেÑএই আশাতেই! কিন্তু না ঠিক আর অয় নাই, আধা পাগলীই রইয়্যা গেছিলো।
তয়, ফসল কাটইন্যার পুরাডি সুময় জুইড়্যাই বাপের লগে মাটিভাঙ্গা গ্যারামে অর স্বামীর বাড়ীতেই থাকতো। কাটন মারন শ্যাষ অইলে আবার দক্ষিণমোহনা গ্যারামের বাপের বাড়ীতেই ফিইর্যা যাইতো।’
সবাই লোকটির কথা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনলো। এরপরÑ
‘এ্যাত কতা তুমি জানলা ক্যামনে ?’- ভীড়ের মধ্যে থেকে একজন বয়স্ক ব্যক্তি লোকটিকে প্রশ্নটি করলো।
‘আমি তো দক্ষিণমোহনা গ্যারামেই থাহি। ঐ গ্যারামেই আমার বসত। অগো বাড়ীতে তো আমার যাওন আহন আছে। আমি জানুম না ?’
‘তাইলে তুমি দক্ষিণমোহনা গ্যারাম থাইক্যাই আইছ ? হেই গ্যারাম তো এইহান থাইক্যা অনেক দূর।’
‘হ। কি করুম ! কাম খোঁজনের লাইগ্যাই আইছি। আইয়্যা দেহি এইহানেও কাম নাই। চাইর দিকে খালি অভাব।’ ‘ঠিক আছে, অহন কও হ্যার বাদে কি অইলো ?’
১৬.
‘নৌকাডুবির দুই বছর বাদে অর বাপে মাটিভাঙ্গা গ্যারামের নূরুল্লা মাল্লার বাড়ীডিরে নতুন কইর্যা গইড়্যা দিয়া কালা কাকা আর কাকীরে সাথে দিছিলো অর লগে থাহন আর নূরুল্লা মাল্লার সামান্য যে জমি জমা অহনও আছে তা দ্যাহনের লাইগ্যা । তিউবাবার একডি পোলাও আছিলো। কিন্তু তুফান শ্যাষে বাপ আর পোলারে কুনোদিনই খুইজ্যা পাওন যায় নাই। কালা কাকা দিন রাইত নৌকা বাইয়া বিছরাইয়াও অগো পায় নাই। কালা কাকা বড় আপন মানুষ আছিলো তিউবাবার বাপের। তিউবাবার দাদার আমল থাইক্যা ঐ বাড়ীতেই মানুষ অইছে কালা কাকা। ছুডো কাল থাইক্যা বুড়া অইয়্যা গ্যাছে তবুও হেই বাড়ী থাইক্যা ভিন্ন কুনোহানে যায় নাই কুনোদিন। খুবই বিশ্বাসী আছিলো তিউবাবার বাপের।’
লোকটি দক্ষিনমোহনা গ্রামের সামান্য দিনমজুর- যথেষ্ঠ বয়স্ক, হাড্ডিসার। অভাবের তাড়নায় গতকাল উত্তরডাঙ্গা গ্রামে এসেছিল কাজের সন্ধানে। লোকের ভীড় দেখে কৌতূহলী হ’য়ে কি হয়েছে ঘাটে- দেখতে এসেছে।
ঠোটের দু ‘পাশ দিয়ে কিসের যেন কষ্ গাল বেয়ে নীচের দিকে তখনও গড়িয়ে পড়ছে তিউবাবার। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হতভাগ্য নূর আলী তিউবাবার লাশ নিয়ে ডিঙ্গি বেয়ে চল্তে শুরু করল কার্তিক মোল্লার বাড়ীর দিকে। বুঝতেও পারলো না নূর আলী কী ঘটে গেলো ওর জীবনে। শুন্যে তাকিয়ে শুধু দেখতে পেল প্রকা- একটি ডানামেলা চিল যেন ওর বিশাল ডানা মেলে দিয়ে ওদের দিকেই ধেয়ে আসছে। এখুনিই বুঝি তিউবাবার অক্ষিগোলক থেকে ওর চোখের তারা দু’টিকে উপড়ে নিয়ে যাবে।