কবি: তৃষ্ণা বসাক
প্রতি-ইতিহাস
কী কী শিখলাম আমি এই অব্দে, ভেবে দেখা যাক,
কিছুতে যা শিখব না, ইতিহাস; ভূগোলের কাক
বরাবর ঠুকরে যাবে, ঠুকরোবেই, আমি ভয়হীন
এভাবেই কেটে যাবে আরো কিছু মধুক্ষরা দিন...
আমাদের ইতিহাস, সত্যি বলতে, লেখাই হল না
উখিলা, এলাচি, ইত্যাদি প্রভৃতি ছলনা,
বামহাতে বটবৃক্ষ, বৌদির চায়ের বিপণি
সেইখানে অকস্মাৎ বেজে ওঠে কালের খঞ্জনি
ইতিহাস জানো কিছু? না জেনেই এত কেতকাত?
স্পর্ধিত বিচি একি! কাঁকুড় যেখানে বার হাত!
উত্তর দিই না কিছু, হেঁটে চলি, উদ্ধাররহিত
দুইপাশে আভা, মনু, তারপরও অনেকটাই শীত....
নিষিদ্ধ এলাকা
দেখতে পাচ্ছ, রাস্তাটা সোজা বসন্তের দিকে চলে যাচ্ছে,
কোথাও থামছে না?
প্রতিটি বাঁকে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন রোদ্দুর?
প্রতিটি থামাই অর্থবহ হয়ে উঠছে,
এতটাই যে আমরা এ রাস্তার নাম দিতে চাইছি চুম্বন সরণি!
চুম্বনগুলো একটুও আটকাচ্ছে না,
আঁতে ঘা দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে একদম গভীরে,
আমরা দেখছি, অনেক পুকুর শুকিয়ে পড়ে রয়েছে,
আর তাদের গভীর খাতে পড়ে আছে আমাদের পোশাক,
বিপজ্জনক সেতু পেরিয়ে
সম্পূর্ণ নিরাভরণ আমরা, ক্রমশঃই ঢুকে পড়ছি
বসন্তের নিষিদ্ধ এলাকায়!
মহাকাল
তারিখ লেখার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে পেড়ে ফেলল মহাকাল,
ঘড়ি মোড়ের লোকটা, কিংবা ক্যাল্টেক্সের বাঁকে দাঁড়ানো স্কুলবাচ্চা
থমকে দাঁড়িয়ে বলল, আমাদের সঙ্গে নেবে না?
আরে, আমি বুঝিয়ে পারছি না,
আমি কোথাও যাচ্ছি না,
এমনকি বারান্দাটাতেও না,
আমি চুপচাপ ওই বাঁশপাতি পাখির বাসায় সেঁদিয়ে যাচ্ছি,
আর লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছি
প্রতিটি বিজয় মিছিল,
মিছিলে কোন কোন মুখ নেই আমার জানা হয়ে যাচ্ছে,
আমি দেখছি আকাশের মিনার থেকে ঝুঁকে পড়ে
পতাকার রঙ দেখছেন দেবাদিদেব,
আর তাঁর ত্রিশূল ব্রাউজারের মতো খুঁজে চলেছে গোটা দুনিয়া
আমি দেখছি বিশেষ যত্ন নিয়ে বিস্ফোরক বানানো হচ্ছে,
আর তারা টুপ টুপ করে ঝরে পড়ছে, যেন ভোরের শিশির,
ঋতুগুলো শেষ পর্যন্ত একটি অতিকায় শীত বা গ্রীষ্ম,
আর তার বাইরে দিয়ে আমরা উড়ে চলেছি ভবিষ্যতহীন!
সৌপ্তিক পর্ব
মৃত্যুর ভগিনীর মতো ভয়ঙ্কর এক অস্ত্র
আমার বুকের মধ্যে ঢুকে এল,
আমি কী করব ভেবে পেলাম না,
হৃদয় বহুকালের এক বেদনাকে
কীভাবে কৃষ্ণবটের মতো সঞ্চয় করে রেখেছে!
আমার কোথাও যাবার নেই, কখনো ছিল না...
সেই ঘোর যুদ্ধের কথা
আমার মনে ছিল,
মনে ছিল একবার যুদ্ধের ফাঁকে
সৈন্যরা কেমন অল্পক্ষণের জন্য ঘুমিয়ে পড়েছিল,
আর তাদের পটে আঁকা ছবির মতো দেখাচ্ছিল,
রাত্রিকালীন যুদ্ধে পদাতিকরা বাতি ধরেছিল,
রথে, অশ্বে, গজে সর্বত্র প্রদীপ
তবু কি অন্ধকার, কি নিঃসীম অন্ধকার!
বেশ্যাশিবিরগুলিও সেই অন্ধকার দূর করতে পারেনি যাজ্ঞসেনী,
যাজ্ঞসেনী, তুমি তো জেগে ছিলে,
তোমার প্রতিশোধস্পৃহা তোমায় জাগিয়ে রেখেছিল,
এত বছর পরে, অনেক ঘুম, জাগরণ ও বিভ্রম পেরিয়ে
তুমি এবার হয়তো বলতে পারবে,
কেন তোমার পাতালস্পর্শী চুলও এতগুলো শবদেহ ঢাকতে পারল না?
নৈশ লাইব্রেরি
এত রাতে লাইব্রেরি খোলা পাব, স্বপ্নেও ভাবিনি।
মাঠ ছিল, চাঁদ ছিল, ছোট ছোট বিপণিও ছিল,
সেখানে অশোক কুঁড়ি, লোধ্ররেণু, মৃগনাভি, চাবি...
যা যা খোলবার ছিল, খুলেছি তো বহুবর্ষ আগে,
তবুও আনন্দ জাগে, অনন্ত এ লাইব্রেরি জাগে।
এ রাত অনেক রাত, বহু বছরের জমা রাত
কখনো খরচ হয়নি, ঝাঁপির গহনে রাখা ছিল
কিনারে সাপের বিষ, আর কথা-মরূদ্যানগুলি
এমন নিরালা নেই যেখানে এই বইটই খুলি!