গোলাম কিবরিয়া পিনু
গোলাম কিবরিয়া পিনু মূলত কবি । প্রবন্ধ, ছড়াও অন্য শাখায়ও তার বিচরণ চোখে পড়ার মতো। গবেষণা মূলক কাজেও যুক্ত তিনি । জন্ম ১৯৫৬ সালের ৩০ মার্চ গাইবান্ধায় । এই শহরেই তার শৈশব -কৈশোর কেটেছে ।
পড়েছেন শহরের মধ্যপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে । মাধ্যমিক গাইবান্ধা সরকারি উচ্চ বালক বিদ্যালয় । পরে গাইবান্ধা সরকারি কলেজ হয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ( সম্মান) এবং স্নাতকোত্তরসহ পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৮৩ সাল থেকে ঢাকায় বসবাস । লিখছেন চার দশকের বেশি । ১৯টি কবিতার বই, ছড়া -প্রবন্ধ-গবেষণা মিলে ৩২টি গ্রন্থ বের হয়েছে। তার কবিতা, ছড়া , প্রবন্ধ, কলাম নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। ইংরেজি , ফরাসি, ডাচ , হিন্দিও অন্য ভাষায় অনূদিত হয়ে বিভিন্ন দেশে প্রকাশিত হয়েছে। তার তিনটি বই ‘লাইব্রেরি অব কংগ্রেস ’ও World cat member libraries worldwid -এ স্থান পেয়েছে । এ ছাড়া ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে ও স্থান পেয়েছে।
শিশু-কিশোর সংগঠন খেলাঘরসহ ছাত্র ও রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন । মুক্তিযুদ্ধে ও তার রয়েছে ভূমিকা।
বর্তমানে বাংলা একাডেমির জীবন সদস্য ও এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশের সদস্য। ১৯৮৭ সালে জাতীয় কবিতা পরিষদ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই জাতীয় কবিতা পরিষদের নির্বাহী কমিটির সদস্য, বিভাগীয় সম্পাদক, ১০ বছর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও শেষে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন । বর্তমানে বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। দেশ ও দেশের বাইরের বিভিন্ন সংগঠন থেকে পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। পেশাগত প্রশিক্ষণ ও অন্য প্রয়োজনে ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, আমেরিকা, বলিভিয়া, নেদারল্যান্ডসহ কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করেন ।
২০১৮সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মিডিয়া বিষয়ক সংস্থা ‘ ফ্রিপ্রেস আনলিমিটেড’রসঙ্গে কাজ করেছেন। এর আগে এফপিএবিতে উপপরিচালক ( অ্যাডভোকেসি), ফোকাল পয়েন্টও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এফপিএবি থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘সুখী পরিবার’র সম্পাদক হিসেবে ১৯৮৩ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। বিসিসিপি ও অন্য প্রতিষ্ঠানেও যুক্ত ছিলেন । পেশাগত ভাবে বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিকতা, কলাম লেখা , সম্পাদনা ও অ্যাডভোকেসি বিষয়ক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থেকেছেন।
গোলাম কিবরিয়া পিনু-এর সাক্ষাৎকার গ্রহণে সাহিত্যবার্তার সম্পাদক আরিফুল ইসলাম ।
আরিফুল : আপনি মূলত কবিতার মানুষ। তাই প্রথমেই আপনার কাছ থেকে কবিতার কথা জানতে চাই। কবিতা আসলে কী?
গোলাম কিবরিয়া পিনু: কবিতার সংজ্ঞা দিয়ে শেষ করা যাবে না! একটি কবিতা কীভাবে হয়ে উঠবে? তা কি পূর্ব নির্ধারিত হয়ে থাকে? না, কবিও জানেন না-একটি কবিতা কীভাবে হয়ে ওঠে। এমন এক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে কবিতা নির্মিত হয়, যা কবিতা সৃষ্টির মুহূর্তে কবি হয়তো অনুভব করেন। আর কোন্ কবিতা কোন্ পাঠককে অনুরণিত করবে-তা অনেকটা কবিরও অজানা। সে কারণে এক অজানা পথের যাত্রীর মত কবিকেও হাঁটতে হয়-পথ খুঁজে নিয়ে যেতে হয়, কখনো-বা বহু বর্ণিল পথের দেখা পাওয়ার পর-একটি পথ নির্বাচন করে এগিয়ে যেতে হয়, তবে প্রকৃত কবি এগিয়ে যাওয়ার স্পর্ধায় সবসময়ে তৎপর থাকেন, মগ্ন হয়ে নিজেকে সংহত করেন।
কবিতা শুধু কি শব্দ? কবিতা শুধু কি ছন্দ? কবিতা শুধু কি অলংকার? কবিতা শুধু কি ভঙ্গি? কবিতা শুধু কি অর্থ? মনে হয় না। কবিতা অনেক কিছু মিলে এমন এক উদ্ভাস-যা ছোঁয়া না গেলেও, এক ধরনের লাবণ্য মনকে ছুঁয়ে নেয়, অভিনবত্বকে তাৎপর্যমণ্ডিত করে তোলে। কবিতা বহুতল ও স্তর তৈরি করে, পাঠককে নিয়ে যায় সেই স্তরে ও তলের গভীরে। কবিতা এমন এক শিল্প, যা চৈতন্যের বহু স্তর উন্মোচিত করে । জীবনের খণ্ডখণ্ড অনুভূতির মধ্য দিয়ে জীবনের তাৎপর্য উন্মোচিত করে কবিতা। কবিতা বহুবিধ শৈলীর সমন্বয়ে অভিজ্ঞতা-অনুভূতি-আবেগ নিয়ে প্রাণ পায়। কবিতা সমকালের হয়েও আগামীকালের ও চিরকালের হয়ে উঠতে পারে।
আরিফুল : আপনার প্রকাশিত প্রথম বই হাতে পাওয়ার অন‚ভুতি কেমন ছিলো ? এ পর্যন্ত কতগুলো বই প্রকাশিত হয়েছে ?
গো কি পিনু : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে এমএ পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্ট বের হওয়ার আগেই ঢাকায় ১৯৮৩ সালের শেষে এসে চাকরি নিয়ে থিতু হলাম। সেই সময়ে কবিতা লেখার গোপনীয় স্পর্ধা নিয়ে নিজের ভেতর এক ধরনের চঞ্চলতা ছিল। সেই চঞ্চলতার রেশ নিয়ে আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘এখন সাইরেন বাজানোর সময়’ বের হয় ১৯৮৪ সালের অক্টোবর মাসে, একুশের গ্রন্থমেলা উপলক্ষে নয়, তখন মেলা উপলক্ষে এখনকার মত বই বের হতো না, মূলত বছরের অন্যান্য সময়ে বেশি বই বের হতো। তবে, বছরের অন্যান্য সময়ে প্রকাশিত বই মেলায় বিক্রি হতো। বইটি বের হয়েছিল ৪ বাংলাবাজারের ‘ পাণ্ডুলিপি’ থেকে, প্রকাশক ছিলেন লক্ষণ চন্দ্র সাহা, সেই সময়ে কবি নির্মলেন্দু গুণ, মাসুদ বিবাগী ও আমার কাব্যগ্রন্থ একসাথে বের হয়েছিল এই প্রকাশনা থেকে । সেই ‘ পাণ্ডুলিপি’ এখন নেই, প্রকাশক লক্ষণ চন্দ্র সাহা’র খোঁজ এখন আমার অজানা! তবে, মনে আছে প্রকাশক লক্ষণ চন্দ্র সাহা’র সাথে কবি নির্মলেন্দু গুণ ও মাসুদ বিবাগী’র বেশ সখ্য ছিল-আমিও ‘পাণ্ডুলিপি’তে গিয়েছি, প্রকাশক লক্ষণ চন্দ্র সাহা’র সাথে আমারও সংক্ষিপ্ত আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তাঁর মুখটি এখনো উজ্জ্বলভাবে মনে পড়ে! বিশেষ করে বইমেলা বা বইয়ের কথা মনে হলে! আমার প্রথম বইয়ের প্রকাশক হিসেবে তাঁর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা রয়েছে । এখনো আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘এখন সাইরেন বাজানোর সময়’ বের হওয়ার অনুভুতি অনুভব করি-কী এক আবেগ ও শিহরণ নিয়ে বইটি বের করেছিলাম! রাত জেগে ৬৩ হৃষিকেশ দাস রোডের তাহের আর্ট প্রেস থেকে বইটি কালিমাখা অবস্থায় ছেপেছিলাম! ৪৮ পৃষ্ঠার বইটির দাম ছিল বারো টাকা। বইটির প্রচ্ছদ ও নামের লেটারিং আমি করেছিলাম দুই রংয়ে, অন্য নামে। প্রচ্ছদটি একেবারে খারাপ হয়নি, প্রশংশিত হয়েছিল। মনে পড়ে বইটির বিজ্ঞাপন ‘সচিত্র সন্ধানী’তে ছাপা হয়েছিল কয়েক সংখ্যায়, পত্রিকাটিতে তখন আমার কবিতা ছাপা হচ্ছেছিল, এই সূত্র ধরে বিজ্ঞাপনটি ছাপা হয়। এ বিষয়ে কথাসাহিত্যিক সুশান্ত মজুমদার বিশেয় সহায়তা করেছিলেন, তখন তিনি এই পত্রিকাটির সাথে যুক্ত ছিলেন। সাপ্তাহিক একতাসহ আরও কিছু পত্রিকায় বইটির বিজ্ঞাপন ও খবর বের হয়েছিল। পরবর্তি সময়ে বেশ কিছু আলোচনাও ছাপা হয়। সেই সময়ে ঢাকা ও দেশের অন্যান্য এলাকার মধ্যে সড়ক ও প্রযুক্তি নির্ভর যোগাযোগ এখনকার মত এতটা ছিল না, গণমাধ্যমেরও এত বিকাশ হয়নি। বলতে দ্বিধা নেই-কবি হয়ে ওঠার এক ধরনের প্রেষণা নিয়ে ঢাকায় আসা এবং সেই প্রেষণার আওতায় প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ হওয়ায় স্বপ্ন ছুঁয়ে আনন্দ অনুভব করেছিলাম। উল্লে¬খ্য, এই কবিতার বইটি যখন বের হয়-তার অনেক আগে থেকেই গাইবান্ধা অবস্থান করার সময় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে ঢাকার উল্লেখযোগ্য দৈনিক পত্রিকা ও সাময়িকীতে আমার কবিতা নিয়মিত কবিতা ছাপা হচ্ছেছিল। আরও উল্লেখ্য-স্বৈরাচার নিয়ন্ত্রিত সরকার রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ধারাকে তখন করছিল বাধাগ্রস্ত। লিখছি চার দশকের অধিককাল। এর মধ্যে কবিতা-ছড়া-প্রবন্ধ ও গবেষণা মিলে ৩২টি গ্রন্থ বের হয়েছে-বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিশু একাডেমিসহ বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে।
আরিফুল ইসলাম : কবি হয়ে ওঠার গল্পটা জানতে চাই ? মানে আপনার কবিতা লেখার শুরুটা কীভাবে সেই প্রসঙ্গে একটু বলুন।
গো কি পিনু : মুক্তিযুদ্ধের এমন এক পরিবেশের মুখোমুখি আমরা তখন, একদিকে বিধস্ত অবকাঠামো ও স্বজন হারানোর বেদনার্ত সময়, আর অন্যদিকে নতুন করে গড়ে উঠবার উদ্দীপনা ও স্বপ্নের আন্দোলিত প্রেষণা। এমন সময়ের কণ্ঠলগ্ন হয়ে আমরা বেড়ে উঠছি, আমাদের কিশোর-জীবন তখন। পড়ালেখার পাশাপাশি শিশু-কিশোর সংগঠন করছি, করছি ছাত্র সংগঠন, অংশ নিচ্ছি সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। যাচ্ছি পাবলিক লাইব্রেরিতে নিয়মিত । এমন পরিবেশ নিয়ে ছোট শহর গাইবান্ধায় বেড়ে উঠছি। তখন বের হতো স্থানীয় পর্যায়ে বিশেষ দিবস উপলক্ষে বহু সংকলন। আর এসব সংকলনে প্রথম দিকে আমার কবিতা ছাপা হতে থাকে। হতো নিয়মিত সাহিত্যসভা ও অনুষ্ঠান। এগুলোর সংগঠক ও অংশগ্রহণকারী ছিলাম আমিও। আর কবিতা ও অন্যান্য রচনা প্রতিযোগিতায়ও পেয়ে যাচ্ছিলাম পুরস্কার। পাঠ্য- পুস্তেেকর বাইরে কত লেখা পড়েছি, তার সবটা এখন হয়তো মনে নেই। তবে, শৈশবকাল থেকেই নিয়মিত দৈনিক পত্রিকা ও ম্যাগাজিন পড়ার সুযোগ পেয়েছি, এরফলে এসবে ছাপা হওয়া কবিতা ও অন্যান্য লেখার আগ্রহী পাঠক আমিও তো ছিলাম। গাইবান্ধার পাবলিক লাইব্রেরি ও তথ্যকেন্দ্রের ছিলাম একনিষ্ঠ পাঠক। এই দুই প্রতিষ্ঠানের কবিতার বই কী-এক উত্তেজনায় পড়েছি তখন, আর পড়েছি কত ধরনের বই। এই দুটি প্রতিষ্ঠানে যেতাম নিয়মিত। আর ছিল গাইবান্ধা রেল স্টেশনের বুকস্টল আর পত্র-পত্রিকার দোকান, সেসব ছিল নিয়মিত যাতায়াতের ঠিকানা । এমন সামাজিক পরিবেশ পেয়েছি, যা সাহিত্যচর্চার অনুকূলে ছিল । আর বাড়িতে বাবা-মা ও ভাইবোনদের সঙ্গ-অনেক সময় পাইনি কিশোর বয়সে, বাবা-মা ও ভাইবোন থেকে আলাদা থাকতে হয়েছে তখন, তারা থাকতো বাবার সাথে চাকরিসূত্রে অন্য জায়গায়, আমি থাকতাম নানা বাড়িতে, গাইবান্ধা শহরের মোমেনান রোডে । তবে, সাহিত্য-সাংস্কৃতিক পরিবেশ ছিল গাইবান্ধা শহরে-আমাদের অনুকূলে, সেই পরিবেশের বাসিন্দা ছিলাম আমিও বেশ নিবিড়ভাবেই।
সেই অনুকূল পরিবেশ পেয়ে কবিতা ধরা দিতে শুরু করে। গাইবান্ধা থাকাকালীন জাতীয় পত্র-পত্রিকায় কবিতা- ছড়া ও অন্যান্য লেখা ছাপা শুরু হতে থাকে, এছাড়া দেশের বিভিন্ন এলাকার লিটল ম্যাগাজিনেও। প্রথম দিকে যখন নিজের লেখা প্রকাশ হতো কিশোর বয়সে, তখন এক ধরনের উন্মাতাল আনন্দ পেতাম। পোস্ট অফিসের খামে ভরে মফস্বল শহর থেকে লেখা পাঠিয়ে যখন অপেক্ষার পর লেখা ছাপা হতো তখন মনে হতো আমি এক দিকবিজয়ী বীর। তখন তো এত পত্র-পত্রিকা ছিল না, ছিল না এত রকমের গণমাধ্যম। লেখা ছাপা হলে স্থানীয় পর্যায়ে সাহিত্য-মহলে এক ধরনের সাড়া পড়ে যেত, মর্যাদাও বাড়তো, শুধু সাহিত্যমহলে নয়-পাঠকদের মধ্যে থেকেও সাড়া পাওয়া যেত, এক ধরনের গৌরববোধ হতো, সমীহ ও মর্যাদা পাওয়া যেত।
পরবর্তী সময়ে শুধু কবিতা লিখবো-সাহিত্যের সাথে যুক্ত থাকবো বলেই-রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অনার্সে ভর্তি হই, তখন আরও কবিতা লেখায় উদ্দীপিত হতে থাকি, কবিতার সাথে তখন সম্পর্ক আরও নিবিড় হয়ে ওঠে। জাতীয় পত্র-পত্রিকায় তখন আরও কবিতা ও অন্যান্য লেখা ছাপা হতে শুরু করে। এমন ভাবেই কবিতা ও অন্যান্য লেখার সাথে আমার সম্পর্ক দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হতে থাকে।
আরিফুল: প্রথম কোন পত্রিকায় বা ছোটকাগজে কবিতা লিখে কবি জগতে প্রবেশ করেন?
গো কি পিনু : আমি কিশোর বয়সে গাইবান্ধার সংকলনে কবিতা লিখে সাহিত্য জগতে প্রবেশ করি।
আরিফুল ইসলাম: আপনার ছোটবেলার কথা জানতে চাই?
গো কি পিনু : ১৬ চৈত্র ১৩৬২ : ৩০মার্চ ১৯৫৬ গাইবান্ধায় জন্মগ্রহণ করি গাইবান্ধায়। পিতার নাম আব্দুল আজিজ, মাতা মাজেদা বেগম। আমি পিতা-মাতার বড় সন্তান। আমরা ভাইবোন নয়জন। এক বোন নেই, এখন বেঁচে আছে চার বোন ও চার ভাই। বাবা ছিলেন চাকরিজীবী, মা গৃহিনী। বাবা নেই, মা বেঁচে আছেন।
গাইবান্ধা শহরে মূলত শৈশব-কৈশোর কেটেছে। পড়েছি গাইবান্ধা শহরের মধ্যপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ও অন্যান্য বিদ্যালয়ে, এরপর মাধ্যমিক-গাইবান্ধা সরকারি উচ্চ বালক বিদ্যালয়ে, এরপর গাইবান্ধা সরকারি কলেজ হয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় । আমি কিশোর বয়সেই শিশু-কিশোর সংগঠন খেলাঘর-সহ ছাত্র সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলাম।
আরিফুল ইসলাম: বাংলাসাহিত্যের কোন শাখা তুলনাম‚লকভাবে সমৃদ্ধ বলে আপনি মনে করেন ?
গো কি পিনু : পুরো বাংলাসাহিত্যে তো কবিতাই সমৃদ্ধ। একদিক দিয়ে প্রথম দিকে তো কবিতারই চর্চা প্রবল ও প্রধান ছিল। ধারাবাহিকভাবে কবিতার সেই চর্চা এই সময়ে এসেও সমৃদ্ধ। তবে, সাহিত্যের অন্যান্য শাখা উনিশ শতক থেকে বেশ সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।
আরিফুল ইসলাম: এই সময়ে বিশ্বকাব্যে বাংলা কবিতার স্থান কোথায় বলে মনে করেন ?
গো কি পিনু : দীর্ঘ পথপরিক্রমায় বাংলা কবিতা আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতে অনেক দূর এগিয়েছে। আমরা যদি গত একশত বছরের বাংলা কবিতার দিকে তাকাই, তাহলে দেখবো-প্রতি দশকে বেশ ক’জন করে গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য কবি আছেন। এই সময়ের কবিরা থেকেছেন নিবেদিত ও এগিয়ে নিয়েছেন বাংলা কবিতাকে। কত রকমের, কত বৈচিত্র্য নিয়ে কবিতা লেখা হয়েছে, তা যদি আমরা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করি। এযুগ তো একক কবির যুগ নয়। যারা লিখেছেন বা লিখছেন তাঁরা জীবনবাজী রেখে পড়াশুনা, অভিজ্ঞতা ও আরও বহুবিধ অগ্রসরমান অবস্থানে থেকে কবিতায় নিবেদিত ছিলেন বা আছেন, তা ভুললে চলবে না।
এই প্রসঙ্গে বলতে চাই-বাংলা কবিতা শুধু নয়, বিশ্বের অন্যান্য ভাষার কবিতাও ধারাবাহিকতা নিয়ে উজ্জ্বল হয়েছে । এই ধারাবাহিকতা প্রবহমানেরই নামান্তর । কবিতার আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুর পরিধি বেড়েছে, তবে তার মধ্যে এক ধরনের সম্পর্ক ও সাযুজ্য থেকেই যায়। যদি বলি-চর্যাপদ থেকে বাংলা কবিতার যে বিকাশ, সেই বিকাশের ধারায় সমকালীন বাংলা কবিতার অস্তিত্ব ও উজ্জ্বলতা। আর এই কারণে বাংলা কবিতার যে সম্ভাবনা তা অতীত থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। বাংলা কবিতার যে বৈশিষ্ট্য ও ব্যঞ্জনা রয়েছে, সেই প্রবহমান শক্তিকে ধারণ করেই বাংলা কবিতা এগিয়ে চলছে এবং বিশ্বকাব্যে বাংলা কবিতা স্থান করে আছে।
আরিফুল ইসলাম: বাংলাদেশে বর্তমান কবিতা চর্চার বিষয়ে আপনার ম‚ল্যায়ন কি ?
গো কি পিনু : এই সময়ে-টিভি ও ইন্টারনেটের বিভিন্ন চ্যানেল-এর ছবি ও অনুষ্ঠানের মাদকতায় টেনে নিচ্ছে মানুষকে, নেশাগ্রস্ত করে তুলছে। আবার আধুনিক হয়ে ওঠার দৌড়ে কম্পিউটার-ইন্টারনেট ও বহুবিধ যোগাযোগ ব্যবস্থায় পর্ণো-মানসিকতাও সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে সংবাদপত্রও পাঠক টানার কৌশলে যৌনতা, রাজনীতি, খুনখারাপি ও বিভিন্ন স্টোরীর নামে ভেদবুদ্ধির চালচিত্র গিলানোর জন্য মেতে উঠেছে। এইসব কর্মকাণ্ডে রুচিতে এক ধরনের বাণিজ্যিক চাহিদা ও উপযোগিতা তৈরি হচ্ছে-যাতে কবিতার অবস্থান দূরবর্তী বদ্বীপের মত হয়ে পড়ছে অনেকটা।
বর্তমানে কাব্যচর্চার ক্ষেত্রে এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতাও লক্ষ করা যাচ্ছে, এর জন্য শুধু কবিরা দায়ী নয়। এ-জন্য পরিবেশ-পরিস্থিতি ও অন্যান্য কারণও রয়েছে, তবুও সচেতনভাবে কবিদের জন্য এই সংকট কবিদেরই মোকাবেলা করতে হবে। তবে-এ ক্ষেত্রে কিছু কবি বিশেষভাবে দায়ী- তারা ভাবেন, তারাই একমাত্র কাব্যবোদ্ধা! যে ভাবেই কবিতা লিখেন না কেন, আর সেই কবিতায় কোনো শিল্পশর্ত পূরণ হোক না হোক বা ধারাবাহিক অভিজ্ঞতায় সামঞ্জস্য থাক বা না থাক কিংবা কবিতার প্রাণ প্রতিষ্ঠা না হোক-তবুও এভাবে কবিতাকে এক ধরনের শূন্যতায় নিক্ষেপ করতে তারা ভালোবাসেন। এদের ভূমিকায় আজ কবিতা ও পাঠকের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হচ্ছে।
পাঠক হিসেবে লক্ষ করি-বর্তমানে কোনো কোনো কবি আধুনিকতার নামে ও পরিবর্তনের নামে কবিতাকে উদ্দেশ্যহীনভাবে বিভ্রান্তিমূলক পর্যায়ে নিয়ে যেতে সচেষ্ট। কেনো কেনো কবি পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে বিপর্যয়েরও সৃষ্টি করছেন, এরফলে কবিতা হয়ে উঠছে কবিতার নামে খণ্ডিত এক পদ্ধতি মাত্র। শুধু বাঁক পরিবর্তনের ইচ্ছে নিয়ে চলার নাম এক ধরনের স্বাধীনতা হতে পারে কিন্তু আধুনিকতা মূর্ত নাও হতে পারে-কবিতায়। আধুনিকতা সমাজবিচ্ছিন্ন বিষয় নয় : সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়নির্দেশক দর্শন-চেতনা। শুধু পরিবর্তনের স্থূল চালচিত্র নিয়ে আধুনিকতা চিহ্নিত হতে পারে না। কবিতা সমকালীন হলেই-তা আধুনিক হবে, তা ঠিক নয়। শুধু কবিতার আঙ্গিক পরিবর্তন হলেই-আধুনিক কবিতা হয়ে ওঠে না-এরসাথে চেতনাগত বিষয়টিও যুক্ত। সমাজের মানসিকতা পরিবর্তনের ফলে কবিতার পরিবর্তন হয়, তবে কবিরা-সমাজের অগ্রসর মানুষ হিসেবে বিবেচিত হয় বলেই তারা পরিবর্তিত চেতনাকে কাক্সিক্ষত পর্যায় টেনে নিয়ে মানুষের চেতনাকে সমৃদ্ধ করেন বা নতুনভাবে মানুষের ভাবনাজগতকে নির্মাণ করেন বা মানুষের বোধকে ভিন্ন দ্যূতিতে উজ্জ্বল করেন।
কবিতা মানুষ ও জীবনের জন্য। কবিতায় কবি’র অভিজ্ঞতা, তার সমাজচেতনা ও বিভিন্নমুখী বোধ শিল্পের সৌকর্য নিয়ে উজ্জ্বল হয়। আমি বলছি না-যে, কবিতা একেবারে উদ্দেশ্যমূলক হয়ে উঠবে, কোনো শিল্পশর্ত থাকবে না, সৌন্দর্য থাকবে না, হবে নিরাভরণ! কিন্তু কবিতাকে নৈরাজ্যের মধ্যে ফেলে দেওয়ার দায় কোনো কবি কখনো বহন করেন না। একদিকে তরলতা আর অন্যদিকে নিরীক্ষার নামে ভয়াবহভাবে কবিতাকে উন্নাসিকতার কবলে নিয়ে গিয়ে উপস্থিত করা; শুধু কবিতার পাঠককে বিভ্রান্তির মধ্যে ঠেলে দেওয়া নয়, ভালো কবিতার বিকাশকেও বাধাগ্রস্ত করে।
কবিতায় এক ধরনের অস্পষ্টতা থাকতে পারে, তাই বলে এমন দুরূহতা আনা কি সমীচীন, যা শুধু সংকেতহীন সান্ধ্যভাষা হিসেবে বিবেচিত হবে, যা থেকে কোনো পাঠক কোনো কিছুই উদ্ধার করতে পারবে না। প্রচলিত আছে যে, নতুন কবিতা পাঠকের কাছে দুর্বোধ্যতা নিয়ে উপস্থিত হতে পারে, পরবর্তীকালে পুনঃ পুনঃ পঠন ও আগ্রহের ফলে সেই কবিতা আর দুর্বোধ্য থাকে না। এই ধরনের পরিস্থিতি যুগে যুগে কবিতার বাঁক বদলের সময় হয় তো লক্ষ করা যায়। কিন্তু বর্তমানে অর্থ-সঙ্গতির সামঞ্জস্যে অনেক কবিতা পাঠকের সাথে সংযোগ স্থাপনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হচ্ছে। এ কারণে কবিতার পাঠক কমে যাচ্ছে কিংবা পাঠক কবিতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। সব যুগে হয়তো কবিতার পাঠক সীমিত থাকে। কিন্তু পূর্বের যুগ থেকে বর্তমান যুগে মানুষের শিক্ষা- জ্ঞান ও অন্যান্য অনেক কিছুর অগ্রগতির ফলে পাঠককে আগের সময়ের চেয়ে আরও বুদ্ধিহীন ও কবিতার রস আশ্বাদনের ক্ষেত্রে একেবারে তাচ্ছিল্যের পর্যায়ে টেনে আনা ঠিক নয়। অনেক দেশে কবিতার পাঠক বেড়েছে, আমাদের দেশে কবিতার পাঠক কমার কারণ কী? বিষয়টি ভেবে দেখা জরুরি। বাংলা কবিতার একটি উজ্জ্বল ও সমৃদ্ধ ধারাবাহিকতা রয়েছে, যে ধারাবাহিকতায় রয়েছে চিরকালের কবিতা ও কবিতার ঐশ্বর্য।
আরিফুলইসলাম : শোনা যায়, ক্ষেত্রবিশেষে কাব্যরচনা চ্যালেঞ্জ? এ সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
গো কি পিনু : কবিতা লেখাকে একটি সংগ্রাম হিসেবে মনে করি, তাই কবিমাত্রই সংগ্রামরত। একদিকে কবি তার নিজের বোধ ও দর্শনকে সংহত করেন, আবার অন্যদিকে সমাজের অন্যান্য মানুষের রুচি ও মনোভাব লেখার প্রশ্রয়ে সূক্ষ্মভাবে তা নিমার্ণ করেন। এ এক মিথস্ক্রিয়া : গ্রহণ ও বর্জন, নেওয়া ও দেওয়া, অপূর্ণ ও পূর্ণতা। সবিনয়ে আমার উদাহরণ দিয়ে বলি-লেখার জন্য শৈশব থেকে একাগ্র ও নিবেদিত থেকেছি। কিশোর বয়স থেকেই নিয়মিত লিখছি। শুধুই লেখার জন্য আত্মপ্রতিষ্ঠার ভিন্ন অন্যপথে যেতে পারিনি, এ জন্য কোনো হতাশাবোধ নেই-আমার। এজন্য অনেক কিছুকে জীবনে সম্পাদনা করেছি। কবিতা লেখার মূলধারায় নিজেকে স্থাপন করার জন্য কবিতা লেখাকে জীবনের মূল কাজ হিসেবে বিবেচনা করে আসছি। এভাবে তো ব্যক্তিগতভাবে কাব্যরচনায় কবিকে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়।
আরিফুল ইসলাম : সাহিত্যে শ্লীল- অশ্লীলতা কীভাবে নির্ধারিত হয়? অশ্লীলতার মাপকাঠি আদৌ কি আছে ?
গো কি পিনু : সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্যে শ্লীল ও অশ্লীল দিকগুলো চিহ্নিত হয়ে থাকে। আমরা জানি, শত বছর আগেও মানুষ এক ভূখণ্ড থেকে আর ভূখণ্ডে-যোগাযোগহীনতায়, বিচ্ছিন্নতায়, কী দূরবর্তী ছিল! যুগযুগ ধরে, শত শত বছর ধরে, এই বিচ্ছিনতার কারণে অঞ্চলে অঞ্চলে মানুষ বিভক্ত হয়ে ছিল-কত রকমের ভাষা, ধর্ম, আচরণ ও শাসনপদ্ধতিতে অভ্যস্ত থেকেছে, এযুগে তা আমরা জেনে হতবাক হই। সেইসব যুগে শ্লীল-অশ্লীলতার ধারণা ছিল এক ধরনের, এখন সেই ধারণা পাল্টে গেছে।
বিংশ শতাব্দীতে-পরিবর্তন হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থায়-রাস্তাঘাট তৈরি হলো, রেল তৈরি হলো, বিদ্যুৎ এলো। আজ বৈশিৰক ও আন্তর্জাতিক ভাবে মানুষের মধ্যে যাতায়াত বেড়েছে, মেলামেশা বেড়েছে। অভিজ্ঞতার বিনিময় শুধু হচ্ছে না, একই ভূখণ্ডে কত ভাষার মানুষ, কত দেশের মানুষ থিতু হয়ে শুধু জীবননির্বাহ করছে না, যুথবদ্ধ হয়ে বসবাস করছে ঐকসূত্র নিয়ে। পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতা জ্ঞানের মূলভিত্তি, তারপরও-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও অন্যান্য সুযোগ নিয়ে আজকের সভ্যতা এক বিশেষ জায়গায় দাঁড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে শ্লীল-অশ্লীলতা ও ব্যক্তির সম্পর্ক এবং যৌন ধারণা ও সম্পর্ক পাল্টে গেছে। লেখকরা সমাজের অগ্রসরমান মানুষ, তাঁরা অগ্রজ্ঞান নিয়ে অগ্রবর্তী থাকেন, তাঁরা শ্লীল-অশ্লীলতার বিষয়টি নতুন আলো ফেলে দেখতে অভ্যস্ত বলেই-তাঁদের কাছে শ্লীল-অশ্লীলতার মাপকাঠি ও ব্যঞ্জনা ভিন্ন হয়ে থাকে।
আরিফুল: সাহিত্যপদক আজকাল বাজারি হয়ে গেছে, টাকা ছিটালেই নাকি পদক মেলে, কথাটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? এই যে অনেক জায়গায় গণহারে সাহিত্য দেওয়া হচ্ছে! এটা কেন? এটাকে আপনি কিভাবে ম‚ল্যায়ন করবেন ?
গো কি পিনু : ইদানিং কবিতা চর্চার চেয়ে নানান সংগঠনের অনুষ্ঠান ও পুরস্কার প্রদানের আধিক্য চোখে পড়ছে, এর অনেক কারণও আছে, আমরা আনুষ্ঠানিকতা ও প্রদর্শনবাদীতায় আগের সময়ের চেয়ে অনেক বেশি উৎসাহিত হয়ে পড়ছি-সেটাও একটা কারণ, আর অন্যদিকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধে নেওয়া-দেওয়ার ক্ষেত্রে সাহিত্যকে নিজের সংকীর্ণ ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহার করছি । সবার ক্ষেত্রে ঢালাওভাবে তা বলা যাবে না, যেখানে রুচিবোধ আছে, বিবেচনাবোধ আছে এবং সাহিত্য রচনায় উৎসাহিত করার মানসিকতা আছে, তেমন অনুষ্ঠান ও পুরস্কার তা যত ছোট পরিসরে হোক, তাকে অনুমোদন করা যেতে পারে।
আরিফুল: এই প্রশ্নটা অনেককেই করেছি যে, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে উগ্রপন্হীদের হাতে খুন হয়েছেন অভিজিৎ রায়, আহমেদ রাজীব হায়দার শোভন, নিলয় নীল, ওয়াশিকুর রহমান বাবু প্রমুখ মুক্তমনা ব্লগারদের । ভারতেও গোবিন্দ পানসারে, এম এম কালবার্গিকে হত্যা করেছে কট্টর হিন্দুবাদীরা । সমাজে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিপন্ন । আপনার কি মনে হয় না যে শেষ অবধি উগ্রপন্থা এই শতাব্দীর চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়াবে ?
গো কি পিনু : একের পর এক উল্লিখিত নৃশংস হত্যাকাণ্ড হয়েছে, তা যে মহলই ঘটাক না কেন, তারা শুভবুদ্ধির কেউ না, তারা ধর্মেরও না, মানুষ পরিচয়দানকারী মনুষ্যের খানিক অধিকারীও নয় । তারা যে সূচিবিদ্ধ অন্ধকার টেনে এনে এদেশের ভবিষ্যৎ আরও অন্ধকারময় করে তুলতে চেয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাদের ছুরির তলায় থেকে লেখক-প্রকাশক, পুলিশ, ধর্মীয় নেতা ও সাধারণ নাগরিকরা শুধু জীবন হারাইনি, তাদের ছুরির তলায় রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, যুক্তিবাদ, সহনশীলতা, ধর্ম ও শুভ কল্যাণকর যাবতীয় উদ্যোগ। যারা এসব করছে, তারা অন্ধ শুধু নয়, কবন্ধ পুতুলও। তাদের মস্তিষ্ক নেই, তাই বোধ নেই, বিবেচনা নেই । ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞ শুধু নয়, যারা ধর্ম সম্পর্কে অপব্যাখ্যা দিয়ে নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থ হাসিল করছে কিংবা ক্ষমতালোভী হয়ে বিভিন্ন মহলের সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করছে. তাদেরই পুতুলে পরিণত হয়ে ভূমিকা রাখছে। এরা শুধু পুতুলই নয়, রোবটীয় পুতুলে পরিণত হয়েছে। তাই, তারা আরও ভয়াবহ! এরা তৈরি হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে, প্রতিষ্ঠানে আনাচে-কানাচে।
এ দেশটা মধ্যযুগে ফিরে যাওয়ার অনেক প্রবণতা নিয়ে এখনো বিপদসংকুল হয়ে আছে। এই বিপদের ধারাবাহিকতায় অনেক হত্যাকাণ্ড আর বেদনাদায়ক পরিস্থিতি মুখোমুখি হতে হয়েছে আমাদের! এসব কঠোরভাবে মোকাবেলা করতে না পারলে বাংলাদেশ এক বেদনাদায়ক দেশে পরিণত হতে পারে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
জঙ্গিদের আওতা থেকে আমাদের রক্ষা করতে হলে রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় সংগঠনসহ শুভবোধ সম্পন্ন মানুষকে তৎপর হতেই হবে। মুক্তিযুদ্ধের দৃষ্টিভঙ্গিজাত দর্শন সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী ভূমিকা পালনের বিকল্প নেই। স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, প্রতিষ্ঠান, পাড়া-মহল্লা, গ্রাম-গঞ্জ ও অন্যান্য পর্যায়ে রাজনৈতিক-সামাজিক- সাংস্কৃতিক ভূমিকা পালনের জন্য মুক্তিযুদ্ধ ও উদার গণতান্ত্রিক ধারার সকল ধরনের সংগঠনগুলোকে নিরবিচ্ছিন্ন ভূমিকা পালন করতে হবে। এক্ষেত্রে সময়োপযোগী যোগাযোগ, কৌশল ও সাংগঠনিক ভূমিকা পালন করতে হবে। চোখ- কান খোলা রেখে সৃজনশীলভাবে জোরালো ও সময়োপযোগী ভূমিকা পালনের জন্য নড়েচড়ে বসতে হবে।
আরিফুল: অনেক তরুণ কবিই গদ্য কবিতাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে ! আপনি নিজেও গদ্য কবিতা লিখে থাকেন । গদ্য কবিতাকে আপনি কিভাবে দেখছেন ? গদ্য কবিতার ভবিষ্যৎ কী? কবে থেকে গদ্য কবিতার ইতিহাস জানতে চাই ?
গো কি পিনু : বিভিন্ন ধরনের কবিতার অস্তিত্ব থেকে যায়। গদ্য কবিতাও কবিতা। আর এই ধরনের কবিতা শুধু সাম্প্রতিকালেই লেখা হচ্ছে না, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে, বিভিন্নকালে তা লেখা হয়েছে। কবিতা বহুবিধ সংজ্ঞার মধ্যে থেকেও ধারাবাহিকতায় এক ধরনের অন্তঃপ্রাণ নিয়ে বাঁচে, বেঁচে থাকবে। কবিতা বহুবিধ শৈলীর সমন্বয়ে অভিজ্ঞতা-অনুভূতি-আবেগ নিয়ে প্রাণ পায়। আর সেজন্য কবি মাত্রই জানেন-ছন্দ, উপমা, উৎপ্রেক্ষা আর বহুবিধ অলংকারের তাৎপর্য। সে গদ্য কবিতা লিখতে পারেন, নাও লিখতে পারেন। যে কবিতা পাঠককে কাব্যরসে সিক্ত করে এক ভিন্ন শিল্পবোধে চঞ্চল করে তোলে, দোরখোলা মুক্ত দিগন্তে নিয়ে গিয়ে উপস্থিত করে, দর্শানুভূতিতে বিভিন্নমুখী তাৎপর্য সৃষ্টি করে, তখন তা প্রকৃত কবিতার উদাহরণ হয়ে ওঠে।
বিভিন্ন কবির কবিতায় বিভিন্ন বিষয় ও শৈলীর উপস্থিতি আমরা লক্ষ করি, সেই কবি গদ্য কবিতা বা ছন্দ নির্ভর কবিতা লিখতে পারেন । কবিতা স্পষ্ট-অস্পষ্ট, উচ্চকণ্ঠ- নিম্নকণ্ঠ, আখ্যানধর্মী-নাট্যধর্মী-লিরিকধর্মী ইত্যাদি রকমের হতেই পারে।
আরিফুল: একজন কবি যখোন দলান্ধ হয়ে যায় ! যখোন ধর্মান্ধ হয়ে যায় , তখন তাে আপনি কিভাবে ম‚ল্যায়ন করবেন ?
গো কি পিনু : লেখক-শিল্পীরা সংগঠন সক্রিয়ভাবে করতে পারেন, না-ও করতে পারেন। তবে শিল্প-সাহিত্যের মাধ্যমে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি ও ভাবাদর্শের লড়াইটা কখনো মোটা দাগে বা কখনো সূক্ষ্মভাবে চলতে থাকে। এ থেকে শিল্পী ও লেখকেরা কখনো সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকতে পারেন না। এই লড়াই থেকে যে শিল্পী-লেখকেরা দূরে থাকতে চান, তারা অজান্তে কোনো পক্ষের উঠানে গিয়ে উপস্থিত হোন অথবা কোনো পক্ষের সেবাদাস হয়ে পড়েন। আর এই ধরনের যে মানুষেরা শিল্প-সাহিত্যকে রাজনীতিবর্জিত করে রাখতে চান, তারা হয়তো জানেন না-রাজনীতি মানে শুধু মিছিল-সভা-শ্লোগান নয় । রাজনীতি একটি দৃষ্টিভঙ্গি-বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি ।
আমরা জানি-শিল্প ও সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিভ্নিনমুখী মতামত আছে। ভাবুক ও লেখক-সমালোচকের মধ্যে বোঝাপড়ার পার্থক্যও আছে । কোন্টা ভালো সাহিত্য বা শিল্প-তা নিয়েও তর্ক আছে। কিন্তু তারপরও বলি-দেশ ও মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কি কবি-লেখক ও শিল্পীদের কোনো ভূমিকা থাকবে না? তাঁরা কি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক- সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ও অগ্রগতি চাইবেন না? নিশ্চয় চাইবেন। পূর্বেও তাঁরা নিজেদের বিবেক-তাড়িত ভূমিকা রেখেছেন, বর্তমানেও তাঁরা সেই ভূমিকা শাণিত রাখবেন, সেটা অনেকেরই আকাক্সক্ষা।
আমরাও মিলতে চাই-আমাদের ভাবনায়, ঐতিহ্যে ও আগামীর স্বপ্নে; যেখানে সংকীর্ণচিত্তের কুসংস্কার ও ধর্মীয় সংকীর্ণতার সাথে দ্ব›দ্ব থাকবে, এই দ্ব›েদ্বর মধ্যে দিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ঘটাতে হবে। সাহিত্য-শিল্পের প্রভাব সুদূরপ্রসারী এবং তা অবচেতনার তলদেশে ঢুকে পড়ে অনায়াসে। মানুষের মস্তিষ্কে ইতিবাচক সংগ্রামী চেতনার বীজ ছড়িয়ে দিয়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনেও তা ভূমিকা রাখে। জীবনের প্রাত্যহিকতায় সাহিত্য-শিল্পের যোগ ঘটিয়ে মানুষের আত্মবীক্ষণের মধ্যে দিয়ে উপলব্ধির জগতকে সমৃদ্ধ করা যায়, রুচিকে নির্মাণ করা যায়, ফিরে আনা যায় বিকার ও অসুস্থতা থেকে মানুষের মানবিক-সুস্থতা।
আরিফুল: এ সমাজে বর্তমানে কবিদের ম‚ল্যায়ন ততটা নেই যতটা তার প্রয়োজন ! এ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই?
গো কি পিনু : আমিও আমার পর্যবেক্ষণ ও বিবেচনা থেকে জানি এবং বুঝি-প্রকৃত কবির কবিতা এক সময়ে আলোচনায় আসবে-হয়তো বা তা দেরীতে। এমনিতে এদেশে কবিতার সমালোচকের অভাব, তারমধ্যে সৎ সমালোচকের আরও অভাব। শুধু কবিতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে নৈব্যর্ক্তিকভাবে আলোচনা-সমালোচনা হওয়ার বিষয়টি এখনো অনেক কম। এসব জেনেও আমি আশাবাদী। সম্মান খুইয়ে আত্মমর্যাদা বন্ধক রেখে কখনো কাউকে দিয়ে কবিতা বা সাহিত্য নিয়ে আলোচনার জন্য উদগ্রীব হওয়ার প্রয়োজন নেই! তবে-সবসময়ে ভেবেছি লেখাটা কবির মুখ্য হওয়া উচিত। প্রকৃত সমালোচকগণ কবিকে আবিষ্কার করেন, কবিকে চিহ্নিত করেন, টেনে তোলেন কবিকে অন্ধকূপ থেকে, দেদীপ্যমান করেন নতুন আলোয়। অন্য কোনো ব্যক্তি-লোভে আর সুবিধা আদায়ের হাতিয়ার হিসাবে ‘তথাকথিত সমালোচনা’ ব্যবহার করেন না-কোনো সৎ সমালোচক।
আরিফুল: অকবিতা বলে একটা শব্দ প্রায় শোনা যায় ! অকবিতা আসলে কি ? অকবিতাও কি কবিতার অংশ?
গো কি পিনু : কোন্ কবিতা কবিতা কবিতা বা অকবিতা বলা আমার পক্ষে বলা মুশকিল। কোন্ কবিতা কোন পাঠককে অনুরণিত করবে-তা অনেকটা কবিরও অজানা। সে কারণে এক অজানা পথের যাত্রীর মত কবিকেও হাঁটতে হয়-পথ খুঁজে নিয়ে যেতে হয়।
কোনো কবিতা জনপ্রিয় ও বেশি পাঠক পড়লেই তা খারাপ কবিতা নয়। বহু ক্লাসিক কবিতা জনপ্রিয় ও ধারাবাহিকভাবে সমাদৃত। কোনো কেনো কবিতা কালের বিচারে দীর্ঘ সময়ের পরে উজ্জ্বল ও পাঠকনন্দিত হতে দেখা যায়, আবার এককালের পাঠকনন্দিত কবিতা সময়ের ধুলোয় অনেকটা দূরে চলে যায়। সামাজিক-রাজনৈতিক ও মানুষের রুচি পরিবর্তনের ওপরও তা অনেকটা নির্ভর করে। কবিতার প্রকাশের ধরন পরিবর্তিত হয়ে থাকে, তেমনি পাঠকের রুচি ও সমালোচকের দৃষ্টিভঙ্গিও পরিবর্তিত হয়।
আরিফুল: স্বাধীনতার পর থেকে একটা দল বা গোষ্ঠি বাংলা একাডেমি নিয়ন্ত্রণ করছে! বেশির ভাগ পুরস্কার এই গোষ্ঠির পকেটে ! এটাকে আপনি কতটা সত্য মনে করেন ?
গো কি পিনু : বাংলা একাডেমির পুরস্কার প্রদানে বিভিন্ন সরকারের আমলে রাজনৈাতক প্রভাব, দলীয় প্রভাব, আমলাতান্ত্রিক ও সংকীর্ণ ব্যক্তি স্বার্থের প্রভাব আমরা অনেকাংশে লক্ষ করেছি। আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও মানসিকতার উপস্থিতি রাষ্ট্রে ও রাজনৈতিক পরিস্থিতে কাক্সিক্ষতভাবে বিকশিত হয়নি, এরফলে জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠেনি, এটা শুধু বাংলা একাডেমি বা বাংলা একাডেমির পুরস্কারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় । এই অবস্থার পরিবর্তন না করতে পারলে-বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠান বিপন্ন হয়ে উঠবে। এমনিতে এদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের সীমিত চর্চায় বারবার ভোটে অংশ নিয়ে বৃহত্তর জনগণ একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর কাছে বন্দি হয়ে পড়ে। এই গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে লুঠপাঠ করার প্রবণতায় এমনভাবে উদগ্রীব থাকে- যার ফলে জনগণ থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এই গোষ্ঠী তাদের ব্যক্তিস্বার্থকে জাতীয় স্বার্থের উপরে স্থান দিয়ে থাকে। আর অন্যদিকে শাসকদলের মধ্যে যে গোষ্ঠী ক্ষমতার কেন্দ্রভূমিতে থাকে- তারা আদর্শ, নৈতিকতা ও জাতীয় স্বার্থ দ্বারা কতটুকু পরিচালিত হয়-তা বিবেচনার বিষয়। উল্লিখিত ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর হাতে বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠানগুলোও একসময়ে বন্দী হয়ে পড়ে।
আরিফুল: শোনা যায়, টাকা ছিটালেই নাকি সাহিত্য পদক মেলে, কথাটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত ? এ পদকের ম‚ল্যায়ন আপনি কিভাবে করবেন ?
গো কি পিনু : কিছু কিছু পুরস্কারের ক্ষেত্রে টাকা ও তদবির এবং অন্যান্য প্রভাব খাটিয়ে পুরস্কার নেওয়ার প্রবণতা ও উদাহরণ থাকতে পারে, তবে সব পুরস্কারের ক্ষেত্রে ঢালাওভাবে এমনটা বলা সমীচীন নয়। তবে টাকা দিয়ে পুরস্কার নেওয়া তো অবশ্যই নিন্দনীয়, তা কোনোভাবেই গৌরবের হতে পারে না! আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন কেউ তা গ্রহণও করতে পারেন না!
আরিফুল : কবি আপনাকে অনেক ধন্যবাদ । সাহিত্যবার্তাকে আপনার ম‚ল্যবান সময় দেওয়ার জন্য ।
গো কি পিনু : আপনাকেঅশেষধন্যবাদ।সাহিত্যবাতারপথচলাআরওদীর্ঘ, সুন্দওওসফলহোক।