রহস্যোপন্যাস পছন্দ করেন অথচ “দ্য দা ভিঞ্চি কোড” ও ড্যান ব্রাউন পড়েননি বা শোনেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। বাংলা সহ ৪৫টি ভাষায় অনুদিত বেস্টসেলার বই “দ্য দা ভিঞ্চি কোড” এর লেখক ড্যান ব্রাউন এর এই সাক্ষাৎকারটি ‘বুকব্রাউজ’ তাদের সাইটে ২০০৩ এর মার্চে প্রকাশ করে যেখানে ড্যান ব্রাউনের লেখক জীবন, ব্যক্তি জীবন আর “দ্য দা ভিঞ্চি কোড” এর কাহিনীসহ অনেক কিছুই ওঠে এসেছে তাঁর মনোমুগ্ধকর কথায়। উক্ত সাক্ষাৎকারেই যেন ড্যান ব্রাউন সম্পর্কিত অনেক রহস্য উন্মোচিত হয়ে যায়।
বুকব্রাউজ – আপনার লেখা কোনো উপন্যাস আগে পড়েনি, এমন কারো কাছে “দ্য দা ভিঞ্চি কোড” কে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
ড্যান ব্রাউন – “দ্য দা ভিঞ্চি কোড” হলো খ্যাতিমান হার্ভার্ড প্রতীকবিদ্যা বিশারদ রবার্ট ল্যাংডন এর গল্প, যাকে ল্যূভর যাদুঘরে ডেকে পাঠানো হয়েছিল লিওনার্দো দা ভিঞ্চির চিত্রকর্মের সাথে সম্পর্কিত কিছু গুপ্ত সংকেত উদ্ধারের জন্য। তিনি এই রহস্যময় সংকেত উদ্ধার করে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি রহস্যের দুয়ার খুলে দিলেন…… এবং সবার আকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিতে পরিণত হলেন। দ্য দা ভিঞ্চি কোড অদ্বিতীয় হওয়ার অন্যতম একটি কারণ হলো গল্পের বাস্তবধর্মীতা। এই উপন্যাসের সব ইতিহাস, চিত্রকর্ম, প্রাচীন দলিল, এবং গূঢ় আচারানুষ্ঠান সঠিক…… যা লিওনার্দো দা ভিঞ্চির বিখ্যাত চিত্রসমূহের কিছু লুকায়িত সংকেতে দেখা যায়।
বুকব্রাউজ – আপনার পরবর্তী বইগুলোতেও কি রবার্ট ল্যাংডন থাকছে?
ড্যান ব্রাউন – অবশ্যই। পরবর্তী বছরগুলোতেও আমি রবার্ট ল্যাংডনকে আমার উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র হিসেবে রাখতে চাই। প্রতীকবিদ্যা ও মূর্তিশিল্পে তাঁর অভিজ্ঞতা তাঁকে অচেনা জগতে নিরবধি দুঃসাহসিক অভিযানের বিলাসিতা প্রদান করে। সম্প্রতি আমি বিশ্বের রহস্যময় স্থানগুলোতে রবার্ট ল্যাংডন এর রোমাঞ্চকর অভিযান নিয়ে প্রায় ডজন খানেক গল্পের নকশা দাঁড় করিয়েছি। বর্তমানে আমি “দ্য সিকোয়েল টু দ্য দা ভিঞ্চি কোড” (The Sequel to The Da Vinci Code) নামের আরেকটি রবার্ট ল্যাংডন থ্রিলার লিখছি। এ উপন্যাসে প্রথমবারের মত ল্যাংডন যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে একটি রহস্যে জড়াবেন। এই নতুন উপন্যাস আমাদের জাতীয়-সম্পদের লুকানো ইতিহাস খুঁজে বের করে।
বুকব্রাউজ – আপনি কি মনে করেন অন্যান্য সংখ্যাতাত্ত্বিক রীতিগুলো (যেমন পিথাগোরাসীয়, অথবা সম্ভবত কাব্বালীয়…) আপনার পরবর্তী গ্রন্থগুলোতে ওঠে আসবে?
ড্যান ব্রাউন – আহা, কাব্বালীয়! হ্যাঁ, তারা আকর্ষণীয়… পিথাগোরাসীয়দের মতই। সন্দেহ নেই, ল্যাংডন এই দলগুলোকে ভবিষ্যতে আরো ভালোভাবে অনুসন্ধান করবেন। আসলে “দ্য দা ভিঞ্চি কোড” এর একটি দৃশ্যে ল্যাংডন মৌলিক কাব্বালীয় সংখ্যাতত্ত্বের রহস্যভেদ করেন এবং তা একটি বিভ্রান্তিকর সংকেত খুলতে ব্যবহার করেন। বইটি আরেকটি অতিগোপনীয় সংখ্যাতাত্ত্বিক দলের পরিচয়েরও ইঙ্গিত দেয় যা আমাকে মুগ্ধ করে, কিন্তু তাদের নাম বলে আমি পরবর্তী বইয়ের চমক নষ্ট করতে চাই না।
বুকব্রাউজ – “দ্য দা ভিঞ্চি কোড” গবেষণার কোন অংশটি আপনার কাছে ব্যক্তিগতভাবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল? এমন কোনো ঘটনা, চিহ্ন বা বিষয়বস্তু কি ছিল যা আপনি যুক্ত করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত গল্পে তা আর আসেনি?
ড্যান ব্রাউন – “দ্য দা ভিঞ্চি কোড” গবেষণার সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো আমাদের কল্পনাতীত, ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি গোপনীয়তার দ্বার উন্মোচন। এর বাস্তব রহস্যগুলো আমাদের চারপাশেই পাওয়া যায়… শিল্পে, সংগীতে, স্থাপত্যে, রূপকথায়, এবং ইতিহাসে। রবার্ট ল্যাংডনের ভাষায়, “সর্বত্রই নিদর্শনাবলী।“
বুকব্রাউজ – পাঠকরা ফ্রি মেসনদের ইতিহাস পড়তে চাইলে, এমন কোনো বই কি আছে যা আপনি তাদের পড়তে বলবেন?
ড্যান ব্রাউন – ফ্রি মেসনদের সম্পর্কে এত বেশি লেখা আছে যে কোথা থেকে শুরু করবে তা বলা মুশকিল। এদের সম্পর্কে আমার গভীর জ্ঞান (বই পড়ে ও তাদের সাথে কথা বলে) থাকায় আমি পাঠকদেরকে একটি ব্যাপারে সতর্ক করে দিতে চাই যে এই ‘ভ্রাতৃসংঘ’ নিয়ে লেখা অধিকাংশ বই-ই যথাযথ নয়। ননমেসনদের দ্বারা অনেক বই লেখা হয়েছে যা কল্পিত এবং অনেকক্ষেত্রেই এসব “প্যারানয়েড ষড়যন্ত্র তত্ত্ব”। এই ‘ভ্রাতৃসংঘ’ সম্পর্কে যথাযথ তথ্য পেতে আপনার উচিৎ শুধুমাত্র সেই বইগুলো পড়া যেগুলো মেসনরা (অথবা প্রাক্তন মেসনরা) লিখেছেন।
বুকব্রাউজ – আপনি ঠিক এখন কী পড়ছেন? আপনি প্রভাবিত এমন কোনো লেখক (জীবিত বা মৃত) কি আছে যার নাম নেয়া যায়?
ড্যান ব্রাউন – অদ্ভুত শোনাতে পারে, কথাসাহিত্য আমি খুব কমই পড়ি। কারণ আমার উপন্যাসে এত বেশি গবেষণা দরকার হয় যে আমি কাহিনী, জীবনী, প্রাচীন লিপির অনুবাদ সহ যা পড়ি প্রায় সবই বাস্তব। যাই হোক, অল্প কয়েকজন কথাসাহিত্যিক আমাকে অনুপ্রেরণা দেন, এরা হলেন জটিল পটভুমির জন্য লুডলাম, কাহিনী চিত্রনের জন্য স্টেইনবাক, এবং বুদ্ধিদীপ্ততার জন্য শেকসপীয়ার।
বুকব্রাউজ – কোন বইটি আপনার জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে? – এবং কেন?
ড্যান ব্রাউন – আমি কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার আগে প্রায় কোন আধুনিক বাণিজ্যিক কথাসাহিত্যই পড়িনি (স্কুলে থাকার সময় চিরায়ত সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক ছিল)। ১৯৯৪ সালে, তাহিতিতে অবকাশযাপনের সময় সমুদ্রতটে সিডনি শেলডনের “ডুমস্ডে কন্সপিরেসি” (Doomsday Conspiracy) এর একটি পুরোনো কপি খুঁজে পাই। বইটির প্রথম পৃষ্ঠা পড়লাম… এবং এর পরের পৃষ্ঠা… এবং তার পরের পৃষ্ঠা। অনেক ঘণ্টা পর, আমি বইটি পড়ে শেষ করলাম এবং ভাবলাম, “হেই, আমিও এরকম লিখতে পারি।“ ফিরে এসে আমি আমার প্রথম উপন্যাসের কাজ শুরু করি …. ডিজিটাল ফোর্ট্রেস…. যেটি ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল।
বুকব্রাউজ – আপনার প্রিয় দশটি বইয়ের নাম বলুন? বইগুলো কেনো প্রিয়?
ড্যান ব্রাউন – জন স্টেইনবাক এর “অফ মাইস এন্ড মেন” (Of Mice and Men) – সরল, উৎকন্ঠাময় ও মর্মভেদী। প্রতিটি অধ্যায়ের প্রথম অনুচ্ছেদে সার্থক বর্ণনা দেয়া হয়েছে। ডগলাস হফস্ট্যাটার এর “Godel, Escher, Bach” – আমি বইটির মাত্র তিনভাগ লেখা বুঝতে পেরেছিলাম, আর ততটুকুতেই মোহাবিষ্ট হয়ে গিয়েছিলাম। জ্যাফরী আর্চার এর “কেইন এন্ড অ্যাবেল” (Kane and Abel) – এত দীর্ঘ সময় ধরে আর্চার কীভাবে বর্ণনার ধারা ঠিক রেখেছেন তা ভেবে আমি বিস্মিত হই। ‘ভ্রাতৃকলহ’ নিয়ে লেখা শ্রেষ্ঠ বই। নেলসন ডিমাইল এর “প্লাম আইল্যান্ড” (Plum Island) – নেলসন ডিমাইলকে বিষয়বস্তু, খেয়ালিপনা এবং নিয়ন্ত্রিত দৃষ্টিকোণের ‘মাস্টার’ বলা যায়। লুডলাম এর “দ্য বোর্ন আইডেনটিটি সিরিজ” (The Bourne Identity Series) – লুডলামের সাম্প্রতিক বইগুলো জটিল ও গোছানো এবং চলছেও বজ্রগতিতে। এই সিরিজ আমাকে রোমাঞ্চকর আন্তর্জাতিক থ্রিলারগুলোতে আগ্রহী করে তোলে। উইলিয়াম শেক্সপীয়ারের “মাচ অ্যাডো অ্যাবাউট নাথিং” (Much Ado About Nothing) – আমি ইংরেজীর শিক্ষক হয়ে এটা পড়ানোর আগে পর্যন্ত নাটকটি প্রকৃতপক্ষে কত মজার ছিল তা বুঝতে পারিনি। নাটকটিতে কোনো জ্ঞানগর্ভ সংলাপ নেই। জন ল্যাংডনের “ওয়ার্ডপ্লে : অ্যাম্বিগ্রামস অ্যান্ড রিফ্লেকশন্স অন দ্য আর্ট অফ অ্যাম্বিগ্রামস” (Wordplay : Ambigrams and Reflections on the Art of Ambigrams) – শিল্পী ও দার্শনিক জন ল্যাংডন একজন সত্যিকারের জিনিয়াস। প্রতিসমতা, প্রতীক এবং চিত্রকর্ম সম্পর্কে আমার ধারণাকে পাল্টে দেয় তাঁর এই বই। ফ্রেড রিক্সন এর “কোডস চিফার্স অ্যান্ড আদার ক্রিপটিক অ্যান্ড ক্ল্যান্ডেস্টাইন কমিউনিকেশন” (Codes Ciphers & Other Cryptic & Clandestine Communication) – প্রতীক বিদ্যা, শিল্প, বিজ্ঞান, ইতিহাস এবং দর্শনের উপর একটি বিস্ময়কর বিশ্বকোষ। জেমস ব্যামফোর্ডের “দ্য পাজল প্যালেস” (The Puzzle Palace) – সেকেলে হলেও এই বইটি অ্যামেরিকার প্রিমিয়ার ইন্টেলিজেন্স অ্যাজেন্সির গোপন জগতের তথ্যের জন্য একটি অত্যধিক আকর্ষনীয় বই। স্ট্রাঙ্ক অ্যান্ড হোয়াইট এর “দ্য এলিমেন্টস অফ স্টাইল” (The Elements of Style) – এমন কেউ কি আছে যে ব্যাকরণের সবকিছু মনে রাখতে পারে? (ব্যাকরণ শেখার জন্য এই বইটি পড়া।)
বুকব্রাউজ – আপনার প্রিয় মুভি?
ড্যান ব্রাউন – ফ্যান্টাসিয়া (Fantasia), লাইফ ইজ বিউটিফুল (Life is Beautiful), অ্যানি হল (Annie Hall) এবং জ্যাফিরেলির রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট। অবশ্যই, নির্মল বিনোদনের জন্য ইন্ডিয়ানা জোনস (Indiana Jones) এবং পিঙ্ক প্যান্থার সিরিজ (Pink Panther series) কে হারানো যাবেনা।
বুকব্রাউজ – আপনার প্রিয় সঙ্গীত?
ড্যান ব্রাউন – আমি ইদানিং স্প্যানিশ গায়ক ফ্র্যান্সো দা ভিটা (Franco De Vita) কে নিয়ে পড়ে আছি। দ্য জিপসি কিংস (The Gypsy Kings), এনিয়া (Enya), Sarah McLachlan এবং খুব তরুণ ও দক্ষ গীতিকার ভ্যানেসা কার্লটনকেও (Vanessa Carlton) (যখন আমি বয়স্ক অনুভব করি নিজেকে তখন) শুনি।
বুকব্রাউজ – আপনার একটি বুক ক্লাব থাকলে কী পড়তেন – এবং কেন?
ড্যান ব্রাউন – মারিও লিভিওর “দ্য গোল্ডেন রেশিও : দ্য স্টোরি অফ ফাই, দ্য ওয়ার্ল্ড মোস্ট অ্যাস্টনিশিং নাম্বার” (The Golden Ratio : the Story of phi, the World Most Astonishing Number) – নিঃসন্দেহে, একটি বুক ক্লাব ‘সম্ভবত-অসম্ভব শোনায়’ এমন একটি সংখ্যা নিয়ে মেতে ওঠতে পারতো, কিন্তু এই বই একইসাথে শিল্প, ইতিহাস, প্রকৃতি, গণিত, দর্শন এবং ধর্মকে উপলভ্য ও জ্ঞানগর্ভ উপায়ে একত্রিত করেছে। প্রাণবন্ত আলোচনা হবে নিশ্চিত।
বুকব্রাউজ – উপহার হিসেবে কোন বইটি আপনি দিতে বা পেতে চাইবেন?
ড্যান ব্রাউন – বিশ্রী শোনাবে, কিন্তু উপহারের বইয়ের সাথে একটি অক্সফোর্ড ডিকশনারী যুক্ত করা চাই। একটি ম্যাগ্নিফাইং গ্লাস সাথে দিতে অবশ্যই ভুলে যাবেন না।
বুকব্রাউজ – আপনার সম্পর্কে মজার কিছু বলুন।
ড্যান ব্রাউন – যদি আমি ভোর চারটার আগে আমার ডেস্কে না বসি তবে আমার মনে হয় আমি অত্যন্ত লাভজনক কিছু সময় হারাচ্ছি। আমার ডেস্কে একটি পুরোনো বালি ঘড়ি রাখি আর প্রতি ঘণ্টার বিরতি অতিবাহিত হয় পুশ-আপ, সিট-আপ, আর আড়মোড়া ভাঙার মাধ্যমে। রক্ত সঞ্চালন ও চিন্তাশক্তির জন্য এটা সহায়ক। আমি গ্র্যাভিটি বোটের একজন বড় ভক্ত। মাথা নিচে আর পা উপরে দিয়ে ঝুলে থাকাটা আমার কাজকে সহজ করে দেয় বলে মনে হয়। সম্প্রতি আমি টেনিসে আসক্ত হয়েছি এবং প্রতি বিকালে লেখালেখি শেষ করার পর টেনিস খেলি।