কবি : নবারুণ ভট্টাচার্যের
কলকাতার খ্যাতিমান নাট্যকার-অভিনেতা বিজন ভট্টাচার্য এবং সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবীর একমাত্র সন্তান নবারুণ ভট্টাচার্য। ১৯৪৮ সালের ২৩ জুন পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে জন্মেছিলেন তিনি।কবি, গল্পকার এবং ঔপন্যাসিক- এই তিনটি পরিচয়ের মিশেলে নবারুণ গড়ে তুলছিলেন স্বকীয় একটি ধারা। নাটক করেছেন কলকাতার মঞ্চে। বামপন্থী রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী নবারুণ দীর্ঘদিন কাজ করেছেন ‘সোভিয়েত দেশ’ পত্রিকায়।
‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’-এর মতো কবিতার পঙ্কতি কিংবা ‘হার্টবার্ট’, ‘কাঙাল মালসাট’-এর মতো তীর্যক উপন্যাস গড়ে তুলেছে নবারুণের প্রতিষ্ঠান-বিরোধী ভাবমূর্তি। ব্যাক্তি জীবনেও তিনি ছিলেন অনাড়ম্বর।
১৯৯৩ সালে নবারুণের ‘হারবার্ট’ উপন্যাসটি ভীষণ আলোড়ন তোলে। এই উপন্যাসের জন্য সে বছর সাহিত্য অ্যাকাডেমি সম্মানও পান তিনি। পরবর্তী সময়ে এই উপন্যাস নিয়ে একই নামে সিনেমাও বানিয়েছেন সুমন মুখোপাধ্যায়। সুমন অবশ্য নবারুণের রচনা অবলম্বনে ‘মহানগর@কলকাতা’ এবং ‘কাঙাল মালসাট’ নামে আরো দুটি সিনেমা নির্মাণ করেন। সুমন এবং দেবেশ চট্টোপাধ্যায়রা নবারুণের লেখা থেকে আলোচিত কয়েকটি মঞ্চনাটকও করেছেন।
নবারুণ ভট্টাচার্যের অন্যান্য রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘লুব্ধক’, ‘হালালঝান্ডা ও অন্যান্য’, ‘মহাজনের আয়না’, ‘ফ্যাতাড়ু’, ‘রাতের সার্কার্স’ এবং ‘আনাড়ির নারীজ্ঞান’।
নবারুন ভট্টাচার্য জুলাই ৩১,২০১৪ সালে আন্ত্রিক ক্যান্সারের কারণে কলকাতার ঠাকুরপুকুর ক্যান্সার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়, ৬৬ বছর বয়সে মৃত্যু বরণ করেন।
.......................................................................................................................................................
হে রবীন্দ্রনাথ
যে শ্রেণীতে তুমি জন্মেছ
তার অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যেই
দেগে রাখা আছে তোমার ভাগ্য
উদবৃত্ত শ্রম থেকেই কেউ পায়
অর্থ, সুখ, অখন্ড অবসর
এবং কেউ উদবৃত্ত শ্রম দিয়েও
পায় সন্তানের মৃত্যু ও নিখোঁজ হওয়ার অধিকার
এসব কথা আজহ আর চালাকরা যাবে না
এসব কথা বয়ামের মধ্যে আছে
বাসি বিস্কুটের মতো মিইয়ে
বজরুকি ও বর্বরতাই সাজিয়েছে উলটো বিশ্ব
একটা ঠ্যাং ওপরে নীচে গলা কাটা ফাঁকা
ঝুলছে জীবন্ত ও স্বনামধন্য পাঁঠার প্রদর্শনী
ফ্যাসিস্তরা ছুরি, শিক ও কাতান থেকে রক্ত ধুচ্ছে
আবার রক্ত মাখিয়ে নেবে বলে
হাইরাইজ বানাবার সিমেন্টের ধুলোয়
ঢাকা পড়েছে বৃদ্ধ, নারী, সদ্যোজাত শিশুদের শব
হে রবীন্দ্রনাথ,
এরই মধ্যে আপনার জন্ম-উৎসব ?
কবি
এই শহরের মধ্যে অতল আছে, ব্ল্যাকহোল আছে
আছে ম্যানহোলের মধ্যে মৃত্যুশিবিরের গ্যাস
আছে বিপ্লবীর ছিন্ন মুণ্ডের ছবি
টালিগঞ্জে কত মেয়ে সিনেমায় নেমে গেল
কত মেয়ে মারা পড়ে গেল সিরিয়ালে
ওহে সিরিয়াল কিলার-
কত ধান বুঝে নাও মুষ্ঠিমেয় চালে
অতল ও মেয়েদের ছবি জোগাড় করা
আমার হবি
বৃষ্টির উৎসবে
কাদামাখা এক খচ্চরের পিঠে উল্টো বসে
শহরে ঢুকছে এক মাতাল
এইমাত্র জানা গেল মাতালটা কবি
নৈরাজ্য
পাতালে করেছি পাতার সঙ্গে সন্ধি
ঝড়ের সঙ্গে হাত বাঁধা হাতকড়ায়
ভেবেছে জীবন ভিডিও ক্যাসেটে বন্ধি
দ্যাখো না রক্ত কতদূর আরও গড়ায়
হয়তো হাঁটছি নৈরাজ্যের পথেই
দুপাশে ফুঁসছে ক্রুদ্ধ সাগর অথৈ
পৃথিবীর ঘুড়ি ডানদিকে টাল খেলে
হৃদয় কিন্তু বুকেরই বাঁদিকে থাকে
সেখানে এখনও পাওয়া যাবে আলো জ্বেলে
জেলখানা থেকে লেখা চিঠিগুলো মা’কে
যা কিছু ঘটছে সহসা তা হবে তুচ্ছ
এক লহমায় উড়ে যাবে তাস-বাড়ি
শেয়াল শুকন যতই নাচাক পুচ্ছ
কোটি কোটি হাত খুঁজে পাবে তরবারি
ভাগ্যহীন শহর
এই শহরের ভাগ্যে এমন একটা দিন আছে
যেদিন তোমার আর আমার ছাই
দুজনের শেষ নিশ্বাসে ভর করে উড়বে
অথচ ভাগ্যহীন শহর সেটা বুঝতে পারবে না
আমাদের ঠোঁট, চোখ, আঙুল
নিজেদের জন্যে নিজেদের যে চেনা শরীর
যতটা জায়গা নিয়েছিল
হয়তো সেই জায়গাতেই তৈরি হবে বাড়ি,
ট্রাফিক সিগন্যাল অথবা কোনো কাঠামো
একথা ভাবলে আমার উপহাস করতে ইচ্ছে হয়
শহর, কলকাতা শহর
দুপায়ে কম মাড়াইনি তোমায়
দেখেছি আশ্চর্য দৃশ্য
লোডশেডিংয়ে তুমি যখন অন্ধ
তখন আলো জ্বলা অ্যাকোয়ারিয়ামের মতো
ট্রাম চলছে
রোদ্দুরে ক্ষমাময় বাজছে কুষ্ঠরোগীর বাজনা
তারও ঠোঁট, চোখ ও আঙুল ছিল
ভাগ্যহীন শহর
আমরা তোমাকে অভিশপ্ত করে রাখব
শুধু তুমি সেটা বুঝতে পারবে না
দুই হাতের লড়াই
নখে নখে জ্বলছে আগুন, পুড়ছে চালচুলো
আমার দুহাতে লেগেছে লড়াই
তাই হাত থাকতেও আমি নুলো
ছুরি বোমা তরোয়াল পিস্তল
স্তম্ভিত দেখে যাচ্ছি আমি
লড়াই বাঁধিয়ে দিয়ে ভেগেছে হারামি ।
দুই হাত আমার ভুলে গেছেেএক সঙ্গে হাতকড়া
পরেছিল তারা
দুজনকে তাদের
বেঁধেছিল করে পিছমোড়া
ফোঁটা ফোঁটা পড়েছিল
অভিন্ন এক রক্তধারা
বেবাক ভুলে গেছে
দুজনে গারদ
বাইরে পাহারা
চাকু লাঠি ভোজালি বন্দুক
হতবাক দেখে যাচ্ছি আমি
লড়াই লাগিয়ে দিয়ে ভেগেছে হারামি
নখে নখে ঝরছে আগুন, জ্বলছে চালচুলো
আমার দুহাতে লেগেছে লড়াই
তাই হাত থাকতেও আমি নুলো
হতভম্ভ দুই পায়ে
ঠায় দাঁড়ানো দুই পায়ে
শ্মশান আর কবরখানার ধুলো
দায়বদ্ধতার কথা
আপনার এই স্বাধীন, মোহময় জীবন
যা আপনি পরিপাটি ভাঁজ করে
কেচেকুচে, ধুয়ে-মুছে
লকারে রেখে এসেছেন
ন্যাপথালিন বল সহযোগে
তা, অর্থাৎ আপনার ওই জীবন
যা বিকাশপত্রের মতো
বিকশিত হয়ে উঠবে
হাসিমুখে, নিষ্কলুষ, নিশ্চিন্ত
তার প্রতি আমারও কর্তব্য আছে
যা আমি অস্বীকার করতে পারি না
বরং বলা যায় দায়বদ্ধ
এবং সে কর্তব্যে আমি অবহেলা
করতে তো পারিই না
সময়, সুযোগ বুঝে, নির্ভুল দক্ষতায়
মনোনিবেশ সহযোগে
পেট্রোল ভিজিয়ে একটা দেশলাই কাঠি ছুঁড়ে দেব
তবে, এখনই কিছু ঘটছে না
রাত ও শহর
বিল্লাও না রঙ্গাও না
ঝুলছে চাঁদ
ল্যাম্পপোস্টে চোখ জ্বলছে
ফুটপাথের ঠোঁট
যেখানে রাস্তার ঠোঁট ছোঁয়
সেই তীব্র সীমানার ওপারে
একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে
কলকাতায় বিক্রি হয়
পিয়ানো
ভাড়া করা যায়
পিয়ানো
এই সব দৃশ্যমালা ছড়িয়ে
অন্ধকার আকাশের দিকে তাকালে
কিছু উপগ্রহ বা বিমানের
আলোও দেখা যায়
সমাজবিরোধীতার কথা
একটি সজীব মৃতদেহ যখন অপরাপর পুষ্ট
এৃতদেহকে উৎসাহ দেয়
লুকিয়ে মানুষকে ফাঁসি দেওয়ার জন্যে সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্র
যখন বেশ্যার মতো সজাগ
একটি কুকুর যখন বাস চাপা পড়ার পরে
রাস্তায় চাঁদের আলোয় রক্তে ভিজে শুয়ে থাকে
আর তার শেষ চিৎকার টেপ রেকর্ড করে
ইস্কুলের বাচ্চাদের শোনানো হয়
যখন কবি ও লেখকবৃন্দ পোকা ধরার জন্যে
বড় বড় আলোর পাশে ওঁৎ পেতে থাকে
যখন একটা লোকের সাতশোটা লরি ভাড়া খাটে
আর একটা লোক ক্রাচ নিয়ে রাস্তা পার হয়
তখন আমৃত্যু লিখে যাব প্রতিবাদ
উন্মত্ত হিংস্র ও কুদ্ধ নিরবধি
এ যদি সমাজ হয়
তবে আমি সমাজবিরোধী
অনেকগুলো বাড়ি
দুঃখী লোকেদের বাড়ির চেয়ারগুলো কাঁদে
তাদের পায়ের কাছে জল ছপ ছপ করে
দুঃখী লোকেদের বাড়ির দেয়ালগুলোও কাঁদে
দেওয়ালের ছবির মধ্যেও ভাপ জমে কান্নার
কত বাড়ি আছে কত অশ্রুময়
চোখের সামনে তারা টলমল করে ওঠে
দুঃখী লোকেদের বাড়ির বারান্দা, মাদুর, পাপোষ
সব কান্নায় ভিজে থাকে
সেখানে রোদ্দুর বা ক্যামেরার ফ্ল্যাশও ঝাপসা ভিজে হয়ে যায়
এরকম অনেকরকম বাড়ি আছে
রুগি লোকেদের বাড়ি
ছেড়ে চলে যাওয়া লোকেদের বাড়ি
অথবা ফেরারের বাড়ি যে ফিরে আসবে
নয়তো চাঁদের আলোয় আত্মহত্যার বাড়ি
যেখানে কেউ ফিরে আসবে না