নিলয় গোস্বামী এর গুচ্ছকবিতা
ত্রসন
দেখা হবে আবার কোথায়?
প্রচ্ছন্ন গোধূলির ওপাড়ে?
ভোরের কাকের ঠোঁটে?
শিউলিদের ঘুমো আলিঙ্গনে?
নাকি মানুষের হাসি বেষ্টিত পৃথিবীর দেয়ালে?
দেখা হোক এভাবেই, আত্মারা থাকুক বুকে জেগে।
নীল ভোর, বৃদ্ধ আলো সরে...
উঠুক জেগে তরতাজা প্রাণ।
প্রণোদনা হোক জীবনের মগ্ন আয়োজনে।
হেরে যাক পরাজয়,যুদ্ধ জিতুক না আরেকবার!
নরম মাটির বুকে মৃত্যুর আঘাত করোনার!
বাতাসের বুকচেপে ধরেছে, অকোষীয় অাততায়ী !
জমানো শ্বাসে লাশের ইমারত গড়ছে মহামারী।
প্রতিটি দিনের মুখে ঝুলে আছে কালো মাস্ক!
নিষিদ্ধ আয়নায় অট্টহাসি দিয়েছে আতঙ্ক...
মানবপাড়ায় লেগে আছে শ্মশানের জোড়া চোখ! আবার প্রকৃতি শান্ত হোক, মাটির নিরাপদ সে বুক চিরে জাগুক সবুজ স্নিগ্ধ তাজা প্রাণ।
আবার আকাশ মাথা গুঁজে
চুমু দিক সংক্রমণহীন এ পৃথিবীর গালে।
প্রাণের টানেতে প্রাণ ছুটে যাক এগাঁয়ে- ওগাঁয়ে।
তালা
অথচ একদিন মঙ্গল গ্রহে বাস করতে উঠেপড়ে লেগেছিলে...
যত্ন করোনি এই পৃথিবীর, ছেড়ে যাবোই তো।
ঘর বাঁধবো নিরাপদ মহাশূন্যে।
এমন ভবিতব্য আগ্রহে নাক ডুবিয়ে পান করেছ
স্ত্রীগ্রহের নির্যাস।
পুড়িয়েছ ফুসফুস আমাজন।
জানতে চাওনি একটা বানরের পোড়া ক্ষতের দগদগানি, একটা বাজপাখির ডানা হারানোর অার্তনাদ।
একটা স্ফুলিঙ্গের আঘাত প্রাণীকুলে কতোটা তীব্র ছিল!
একবারও ভাবোনি তুমি।
অথচ তুমি শ্রেষ্ঠ জীবন নিয়ে এসে ছিলে এই গ্রহে।
শ্রেষ্ঠ সেবা,মমতা আর মানবতা ছিল তোমার কাছ থেকে প্রাপ্য।
এখন নিজের শরীরটাকেও আপন ভাবতে পারছ না,এই বুঝি অকোষীয় অদৃশ্য শত্রু লেগে আছে হাতে, পায়ে, নাকে।
মুখ দিয়ে চলে যাবে ফুসফুসে।
ভয় মারছে সাহসকে,মৃত্যু জেগে আছে প্রহরে,জীবন ঘুমিয়ে আছে হুমকির বালিশে!
আজ বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার দিচ্ছো,প্রকৃতির কানে লেগে আছে প্রতিশোধের তালা।
মুক্তির অনিশ্চিত সম্ভাবনা নিয়ে আধমরা হয়ে টিকে আছে আশা...
প্রকৃষ্ট ধোঁয়ার বেষ্টনী ঘিরে আছে নতুন স্বপ্নে চারপাশ...
মূর্ছাতুর ভোর সময়ের বৃদ্ধ কাঁথায় দম বন্ধ করে শুয়ে আছে আজ!
একটা নিরাপদ সকাল চাই, একটা নিরাপদ সকাল...
যেখানে বুক ভরে শ্বাস টানতে পারবে মানুষ।
নিঃশ্বাস নিরাপদে খেলে যাবে খাঁচাহীন শোঁকা পথে...
আলো
এক মুঠো অন্ধকার খেয়ে বসে আছি।
এখন হাড়ের চিরুনীর মতো ছান মারছি এক পেয়ালা আলো পেতে।
আলো খাবো, আলো....
অন্তর বড় আঁধার হয়ে গেছে।
মানুষ খেয়েও এখন তৃপ্তি লাগে না আর।
এ বুঝি শেষের অতৃপ্তি,
হবেই না ক্যানো!
খাওয়ার যে আর কিছুই বাকী নেই।
কাঁচা মাংস খুবলে খেয়েছি,
আরেকটু আরাম করে খেতে
পুড়িয়ে খেয়েছি মানবতা।
আমার নাম যে অসময়।সৃষ্টি আমার অন্যায়ে,
সুখ আমার ধ্বংসে,
মৃত্যু আমার শুভফলে।
মানুষ আমায় ডেকে নিয়ে আসে অবেলায়;
আবার মানুষই আমায় তাড়াতে চায় নিয়মে।
স্থিতিস্থাপক তাপমাত্রায় আমি মৃত্যুর পায়তারা
যত্নে রাখি।
নক্ষত্রের ভাঁজে ভাঁজে লিখে রাখি ধ্বংসপুরাণ।
তবু মানুষ আমায় ডেকে আনে বার বার...
দীর্ঘশ্বাস দিয়ে বাড়ি বানিয়ে দেয় আমার,
আফসোস আর কান্না দিয়ে সাজায় ঘর।
আমি হয়ে যাই বিন্দাস যাযাবর।
মোহ
এখন ফুরিয়ে যাচ্ছে চোখের ভুল আর বসন্তে
ঘোর লাগানিয়া মোহ।
আরেকটা সকাল মুঠোয় যে আগলে রাখতে চাই আজ।
ঝাউপাতার চিঠি আর পাখিরগানে ভিজতে চাই সুখে।
আবার অনুচ্চারিত উষ্ণতায় স্নান করতে চাই।
ফিরে যেতে চাই শুধু জোনাকি ডাকা রাতের বুকে।
চন্দ্রিমার মুঠো মুঠো সুখী আলো নিয়ে গড়তে চাই-
মসৃণ ভালোবাসার বিভেদহীন সে আদুরে ঘর।
আবার যে ফিরে পেতে চাই তোমার বসন্ত দ্বার।
আমাদের সে দৃষ্টিরা ফিরে পাক ফেলে আসা গান।
দেখো দুহাত উড়িয়ে ডাকছে ছিঁড়ে যাওয়া সেই ভোর,
দুপুরের সুর আর জলঘড়ির থেমে যাওয়া সুখ।
ছোবল
ঘিনঘিনে ক্ষতটা খুঁড়ে খুঁড়ে খুঁজে নেই পরিচিত-
আমোদের কিছু ভুল,গন্তব্যের ভগ্নাংশের রুপ।
ছোবল পড়ে নিয়েছি, যন্ত্রণার সেলাই সয়েছি।
একটা তাড়াস জেগে থাকে ক্ষুব্ধ বুকের কামান ঘরে।
শ্রমণ খুলে আনে যে বারবনিতার সোনালি কান্না।
ঘনক উপসংহার লেখে সমস্ত গল্পের গায়ে।
গল্প গান হয়ে যায় রাতের বালিশে ঘোমটা দিয়ে।
শুরুটা কেনো ঘুঙুর পরিয়েছিল নীরবতার
ফিরোজা রঙের পায় ! সময়ের দোল খাওয়া তানে।
কতো গান গেয়ে যায় রাতের প্লাটফর্ম, পোড়াবাড়ি।
জংলী পেঁচার মতো যে অশুভদের প্রত্যক্ষ করি-
সংহার চেটেছি খুব সাংঘাতিক শিকার হয়ে যে !
মৃত মানুষের কান্না শুনেছি মাদি পিয়ানোটার তার সপ্তকের সুরে,মেঘের নিরালা চোখ পড়ে।
আত্মার কোলাজ দেহ ছুঁয়ে ছোটপর্দা ছিড়ে ফেলে।
আর কেউ শুনেনি তো, শুধু একজোড়া কান শুনেছে,
এবার থেমে যাওয়ার ব্যর্থ আয়োজনের সে পালা।
বোমার শব্দের মতো ক্ষীণ আয়ু দিয়ে নি:শেষ করে-
হীমের শরীর খুলে যুবুথুবু আশঙ্কাটা আনি।
ছোবলের চিহ্নটার মতো চেয়ে রবে আমাদের
আফসোসের নীল ভোর,প্রসূতি রাতের নগ্ন কান্না।
স্মৃতির আর্তনাদ
বিকেলের নম্র আলো, নিজেকে ফিরিয়ে নিচ্ছি আজ এক মলিন আকাশের মতো করে।
ভাবনার শূন্যতারা, আমি চলে যাচ্ছি দূর -আরও দূর অসীমের মাঝে।
চোখের নদীরা টলোমলো সমুদ্রদের ছিটিয়ে দিচ্ছে বুকের হাহাকারে।
সন্ধ্যের আকাশে উড়ে যাওয়া ধূসর বকদের মতো অজানা ঠিকানার পিছু হাঁটছিই তো হাঁটছিই....
দুজনের এক সাথে দেখা নাইট কুইনের পূর্ণতা আর গভীর রাতের মাধবী....
গোধূলির আলিঙ্গন আর বৃষ্টির গান...
এই সবই আজ ফিরে ফিরে উঁকি দেয় মরে যাওয়া প্রেতাত্মাদের মতো।
বেদনায় নুইয়ে পড়েছে হৃদয়।
পাঁজরের হাড়কে পৃষ্টকরছে বৈধতা হারিয়ে;
নিষ্ঠুর সাম্রাজ্যবাদীদের মতন।
দহনের শেষটুকুকে সন্ন্যাস যাপন শিখিয়ে যাচ্ছে মহাকাল।
ঝরে যাওয়া পাতারা নিজেদের পৃষ্ঠা বানিয়েছে; তোমার দুমুখো মনের পদাবলি লিখবে বলে।
বৃদ্ধ মাছরাঙার আকুতির মতো আজীবন চেয়েছি তোমায়....
নিশ্বাসের প্রয়োজনীয়তার মতন অনুভব করেছি তোমায়- জৈবিক আয়োজনে।
শিশুর পবিত্র হাসির মতন প্রতিটা স্পর্শ এঁকেছিলাম তোমার উন্নত গ্রীবায়।
এখন এ সব কিছুই বিপন্ন স্মৃতির আর্তনাদ....
শুধু উড়ে উড়ে যায় আমার অদৃশ্য সুখেরা
- নীরব আকাশের ভেতর।
এক শোকের কবিতায় চিৎকার দেয় ; এক বধির কবির অন্তর।